#আসক্তিময়_ভালবাসা
#Part_20
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
দেখতেই দেখতে নতুন বৎসরের আমেজ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। নতুন কিছু প্রতিজ্ঞা, প্রত্যাশা, স্বপ্ন ও উদ্যোগ নিয়ে শুরু হয় বৎসরটি। ছোটদের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে বই উৎসবের উল্লাস। কতই না উচ্ছাস দেখা যায় তাদের মধ্যে নতুন বইগুলোকে বরণ করে নেওয়ার। বড়রাও ফুরফুরে মনে শুরু করে নতুন বৎসরের নতুন যাত্রা। বৃদ্ধরা আরও মগ্ন হয়ে পড়ে আল্লাহ তা’য়ালার ইবাদতে। এমনটাই হয় আমাদের দেশের নতুন বছরের শুরু।
নতুন বছরের প্রথম সপ্তাহ চলছে। ধীরে ধীরে নতুন বছরের আমেজ নিভু নিভু হয়ে আসছে। কিন্তু সেইদিকে এখন কাউরো ধ্যান নেই। সকলেই মগ্ন নতুন উৎসবটি বরণ করে নেওয়ার। আর সেই উৎসবটি হচ্ছে “সাকরাইন” অথবা “সাকরান্ত্রি”। অনেকে আবার ” ঘুড়ি উড়ানো উৎসব”-ও বলে। অঞ্চলভেদে একেক জন একেক নামে চিহ্নিত করে। নাম ভিন্ন হলেও এই উৎসবটি কম বেশি সকলেই উৎযাপন করে। তখন ঘুড়িময় আকাশ জুড়ে আলোর ঝলক ফুলকি দিয়ে উঠে। এর বিশেষ প্রভাব দেখা যায় পুরান ঢাকার দিকে। উৎসবটি আসতে এখনো বেশ কয়েক দিনই বাকি। কিন্তু তাও এখন থেকেই খোলা আকাশে রঙে-বেরঙের ঘুড়ি এইদিক সেইদিক ছুটাছুটি করতে দেখা যাচ্ছে। মুক্ত পাখির মত দানা ঝাঁপটে স্বাধীনভাবে উড়ে চলে সে। অনেক সময় দুই পিঁপড়ের কথা কাটাকাটির মত দেখা যাচ্ছে দুইটি ঘুড়ির মাঝে। অবশেষে মনে হচ্ছে কেউ একজন কথায় না পেরে কেটে গড়িয়ে পড়ছে ভূপৃষ্ঠের বুকে। কি স্নিগ্ধই না সেই দৃশ্য। এর মধ্যে যেন লুকিয়ে আছে আরেক আনন্দ। আমি ছাদের এক কোনে দাঁড়িয়ে এইসব মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখছি আর পর্যবেক্ষণ করছি। বিকেলের নরম হয়ে আসা সূর্যের এক ফালি রোদ এসে পড়ছে মুখের উপর। এতে বিরক্ত নয় বরং আরামই লাগছে। মন চাচ্ছে এই রোদটুকে হাতে মুষ্টি বদ্ধ করে সারা গায়ে মাখিয়ে নেই। আমি যখন এইসব ভাবছি তখনই ছাদের কার্নিশে বসে থাকা কাকের কর্কশ ডাকে চমকে উঠি। বড় বড় চোখ করে তার দিকে তাকাতেই সে ফুড়ুৎ করে উড়ে যায়। তা দেখে হাল্কা হাসি। এমন সময় হাতের মুঠোফোনটি ক্রিংক্রিং শব্দ করে বেজে উঠে। সাথে সাথে ভ্রু কুটি কুঞ্চিত হয়ে আসে। আমি ফোন তুলতেই দেখি বাবা ফোন করেছে। আমি চটজলদি ফোনটা তুলে নেই,
— আসসালামু আলাইকুম আব্বু!
— ওয়ালাইকুম আসসালাম আম্মু। কেমন আছো?
— আলহামদুলিল্লাহ! তুমি কেমন আছো?
বাবা শুকনো গলায় বলে
— এইতো!
বাবার কন্ঠস্বর কিছুটা বিচলিত আর শুকনো শুনাচ্ছে বলে আমি জিজ্ঞেস করি,
— তোমার কি কিছু হয়েছে? তোমার গলা এমন শুনাচ্ছে কেন?
বাবা আমতা আমতা করে বলে,
— না মানে….
আমি জোড় গলায় বলি,
— বল?
— মন কেমন কু ডাকছে রে। কাল রাতে তোকে নিয়ে বড্ড খারাপ স্বপ্ন দেখেছি। দেখেছি তুই রক্তাক্ত অবস্থায় পরে আছিস।
— বাবা ওটা একটা স্বপ্ন ছিল। তুমি খামাখা চিন্তা করছো। এই দেখ আমি ঠিক আছি, তোমার সাথে কথাও বলছি।
— সে আর কতদিন? যেকোন সময় ওরা তোর খোঁজ পেয়ে যাবে। তারপর? আমার স্বপ্নটাই তো সত্যের রুপ ধারণ করবে।
— তাহলে তুমি এখন কি চাইছো? ওদের ভয়ে ঘর বন্দী হয়ে যেতে বলছ নাকি পালিয়ে বেড়াতে বলছো?
— আমি চাইছি ওরা যা চায় তা তুই দিয়ে দে মা। আমি পারবো না নিজের মেয়ের লাশ কাঁধে চড়াতে। এতটা শক্ত আমি নই।
— স্বার্থপর হয়েও না আব্বু। এমন তোমায় মানায় না। আচ্ছা আগে তুমি শান্ত হও আর ঠান্ডা মাথায় ভাব। আমি যদি ওদের কথা মেনেও নেই তাহলে কি তারা আমায় ছেড়ে দেবে বলে ভাবছো? কোনদিনও না। তুমি জানো না ওরা কতটা হিংস্র। কিছু পাক আর নাই পাক তারা আমায় মারবে। মোরাল অফ দ্যা স্টোরি আমার মৃত্যু নিশ্চিত। তো সেখানে ওদের কথা মেনে নেওয়ার কোন যুক্তিই হয় না।
— তোর কি একটুও ভয় করে না?
— সত্যি বলবো? আমারও ভয় করে। অনেক ভয় করে। কিন্তু নিজের জন্য না। যারা আমায় ভালবাসে, আমার আশেপাশে সবসময় থাকে তাদের জন্য। আমার যা হওয়ার হবে কিন্তু যদি তাদের উপর কোন আঘাত হানা দেয় তাহলে আমি সহ্য করতে পারবো না। বিশেষ করে মা, তুমি আর রি…..
কি যেন ভেবে আমি থেমে গেলাম। চুপ করে রইলাম। অতঃপর বললাম,
— আব্বু তুমি যত তারাতাড়ি সত্য মেনে নিবে ততই তোমার জন্য ভালো হবে। ভুলেও যেও না দাদু তোমায় কি শিক্ষায় বড় করেছে। একজন আর্মি অফিসারের ছেলে হয়ে তোমার মুখে এমন ভীতু ধরনের কথা মানায় না?
— আমার অনুভূতি তুই এখন বুঝবি না। যখন মা হবি তখন বুঝবি এই অনুভূতি গুলোর কথা। নিজের সন্তান ঝুঁকির মধ্যে আছে জেনেও আমি কিছু করতে পারছি না। নিজেকে কি পরিমাণ অসহায় লাগছে তা তোকে কিভাবে বুঝাই। একদিকে মৃত বাবার প্রতি আমায় দায়বদ্ধতা আরেকদিকে সন্তানের প্রতি আমার কর্তব্য। একজনের প্রতি দায় পালন করতে গিয়ে আরেকজনের কর্তব্য থেকে পিছিয়ে যাচ্ছি। হিমসিম খাচ্ছি। আমার চেয়ে অসহায় কে আছে বল এই দুনিয়ায়?
আসলে সব দোষ আমারই। আমার জন্যই আজ সব হচ্ছে। না আমি…
— তোমার এইখানে কোন দোষ নেই। সবই নিয়তির লিখা। তাই নিজেকে দোষারোপ করা বন্ধ করো। আর কে বলেছে তুমি হিমসিম খাচ্ছ? তুমি দুই দায়িত্ব খুব ভালো ভাবে পালন করছো বুঝলে? কোন কমতি নেই এতে।
ফোনের অপর পাশ থেকে শুধু দীর্ঘ নিঃশ্বাস নেওয়ার শব্দ পাওয়া গেল। বাবা নরম কন্ঠে বলে,
— এতটুকুই বলবো নিজের খেয়াল রাখিস। একটু সাবধানে চলিস। কখন কি হতে পারে তা বলা দায়।
— হুম! তুমিও নিজের খেয়াল রেখ। সাথে মায়েরও। আর এইসব চিন্তা করে নিজের বিপি বারিও না। আল্লাহ ভাগ্যে যা লিখবেন ঠিক তাই হবে।
আর কিছু বলতে পারলাম না। ফোন কেটে দিলাম। একটু আগের ফুরফুরে মনটা নিমিষেই বিষিয়ে গেল। মুখটা মলিন হয়ে এলো। আমি দূর আকাশে তাকাতেই দেখতে পেলাম একটা ঘুড়ি নিচে পড়ে যাচ্ছে। সম্ভবত কাটা পড়েছে। আমি এক ধ্যানে সেইদিকে তাকিয়ে থেকে আনমে বলি,
— আমার অবস্থাও কি এই ঘড়ির মত হবে? এখন তো উড়ন্ত আকাশে ডানা মেলে উড়ছি। কখন কোন সময় এমন ঝরে পড়ি কে জানে। কিন্তু ঘুড়ির এই কাটা পড়া থেকে একজন তাকে বাঁচাতে পারে। আর সে হচ্ছে যার কাছে নাটাই আর সুতোর টানটা আছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে আমার জীবনের নাটাই ও সুতোটা কার হাতে? বাবার কাছে না-কি রিয়ানের কাছে না-কি আমার কাছেই?
জীবন বড্ড রহস্যময়। পদে পদে সে তার রহস্য ভেদ করে। একে বুঝা বড় দায়। জীবনে কখন কোন মোড় চলে আসে কে জানে?
আমি শূন্য দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে রই। সূর্য ডুবে যাচ্ছে পশ্চিম আকাশের অন্তরে। কানে মাগরিব আযানের প্রতিধ্বনি এসে বারি খাচ্ছে। চারদিকে ধীরে ধীরে অন্ধকার নেমে আসছে। তারই সাথে আমার জীবনেও।
_____________________________________________
সাত-সকাল ডোরবেলা দরজার বেল বেজেই চলেছে। কিন্তু কেউ দরজা খুলছে না। আনিশা রুমে বসে পড়ছিল। আজ ক্লাস নেই তার। তাই নতুন ইয়ারের বইগুলো একটু পড়ছিল। এমন সময় অনবরত ডোরবেলের আওয়াজ শুনে সে অতিষ্ঠ হয়ে উঠে। পাশে তাকাতেই দেখে নিশু বিছানায় পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে। ডে শিফটে স্কুল হওয়ার যেই লাভ আরকি? দের সকাল পর্যন্ত নিশ্চিন্তে ঘুমানো যায়। আনিশা কাঠ কাঠ গলায় নিশুকে কয়েকবার বললো উঠে দরজা খুলার জন্য। কিন্তু সে তো ঘুমে বিভোর। আনিশা নিশুর দিকে কটমট দৃষ্টিতে তাকিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে আসে। আর বিরবির করতে থাকে,
— পড়ার সময় যত যায় জামেলা। উফফ!
রুম থেকে বেড়িয়ে আনিশা চারদিকে চোখ বুলাতে থাকে। বাবা গোসলে গিয়েছে। তার আবার সকাল সকাল গোসল করার অভ্যাস। মা হয়তো রান্নাঘরে ভাত নামাচ্ছেন। যার জন্য তৎক্ষনাৎ তা রেখে আসতে পারছেন না। আনিশা দীর্ঘ নিশ্বাস নিয়ে দরজার দিকে চলে যায়। দরজার খুলার সাথে সাথে যাকে দেখতে পায় তাকে তার মাথায় বাজ পড়ে। চোখ দুইটো রসগোল্লার মত বড় হয়ে যায়। এই বুঝি বেড়িয়ে আসবে। হুট করেই কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে শুরু করে। ভয়ে ঢোক গিলতে থাকে। মনের মধ্যে অজানা ভয় জমতে শুরু করে। সে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,
— আপনি এইখানে?
#চলবে