সম্পর্কের মায়াজাল পর্ব-২২

0
3029

#সম্পর্কের_মায়াজাল
#ফারজানা_আফরোজ
#পর্ব_২২

সকালের দিকে ছাদের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে শুভ্রতা।আকাশ জুড়ে শ্রাবণের কালো মেঘের মতো ছেয়ে আছে। আশ্চর্য ব্যাপার হলো, শীত কালে যখন আকাশ জুড়ে মেঘের রাজ্য উরে বেড়ায়।

শুভ্রতার কাছে আজকের আকাশ শ্রাবণের কালো মেঘের মতই লাগছে।

সামনের চুল গুলো বেশ বড় শুভ্রতার তার উপর ছেড়ে দেওয়া।একটু পর পর দমকা বাতাস এসে শুভ্রতার সামনের চুল গুলো উড়িয়ে দিচ্ছে।।মনে হচ্ছে খুব জোড় বৃষ্টি হবে কিন্তু শুভ্রতার সেদিকে কোনো খেয়াল নেই।।আবার ঝড়ের আভাস বেশ ভালো মতোই টের পাচ্ছে শুভ্রতা।

অনেক কিছুই শুভ্রতার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে কিন্তু কোনো কথারই হিসাব সে মিলাতে পারছে না।কমার্সের স্টুডেন্ট হয়ে হিসাব না মিলাতে পারা শুভ্রতা একের পর এক কথা গুলো মিলানোর চেষ্টা করছে। আজ তার অনেক কিছু ভাবতে ইচ্ছা করছে কিন্তু মাথা একদম ফাকা ফাকা মনে হচ্ছে তার।।

এরই মধ্যে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেলো।তবুও অন্যমনস্ক হয়ে
চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে শুভ্রতা। শীতের মাঝেও বৃষ্টি এসে শীতকে আরো দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিল তবুও শুভ্রতার আজ শীত লাগছে না।আকাশে মেঘের গর্জন ক্রমেই বেড়ে চলেছে।মূহুর্তের মধ্যেই শুভ্রতার সমস্ত শরীর ভিজিয়ে দিলো শীতের এই অসময়ের প্রথম বৃষ্টি।

অন্য সময় হলে হয়তো শুভ্রতা শীতে কাবু হয়ে দৌড় দিতো কিন্তু আজ সে চোখ বন্ধ করে দাড়িয়ে রয়েছে । মনের মাঝে যে ঝড় শুরু হয়েছে সেই ঝড়ের কাছে এই প্রকৃতির ঝড় কিছুই না। পুরো শরীর ঠান্ডায় জমে যাচ্ছে তার তবুও শীত করছে না শুভ্রতার। এক মনে আকাশের দিকে চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে।

শুভ্রতা-কে রুমে খুঁজে না পেয়ে মিসেস সাবিনা বেগমকে জিজ্ঞাসা করল স্পন্দন…..

—” শুভ্রতা কোথায়?”

—” অনেক্ষণ আগে ওকে দেখেছি ছাদের দিকে গেল। কেন এখনো আসে নাই?”

—-” আমি তো মাত্র আসলাম অফিস থেকে । এসে তো ওকে রুমে দেখলাম না।”

—” এই সকালে অফিস থেকে আসলি মানে?”

—” ওহ্ ভুলেই গিয়েছিলাম তোমাকে বলতে। গতকাল রাতে হটাৎ করেই ম্যানেজার ফোন দিয়ে বলল মিস্টার ফায়াজের না-কি ইম্পর্টেন্ট কথা আছে আমার সাথে। আমাকেও তাড়াতাড়ি অফিস যেতে হবে তাই রাতেই চলে গিয়েছিলাম। আর এখন ফিরার পথে কি বৃষ্টি হচ্ছে এই অসময়ে যে এত বৃষ্টি হয় জানা ছিল না।”

—” তাহলে শুভ্রতা কোথায়? বৃষ্টি দেখে তো আর মেয়েটা ছাদে দাঁড়িয়ে থাকবে না। তুই বরং সন্ধ্যার রুমে যা গিয়ে দেখ ওর সাথে হয়তো গল্প করছে।”

—” ওকে।”

স্পন্দন সন্ধ্যার রুমে আসলো কিন্তু শুভ্রতা-কে খুঁজে পেলো না। বাধ্য হয়ে ছাদের দিক-টায় পা বাড়ালো। শুভ্রতা-কে ছাদের মেঝেতে শুয়ে থাকতে দেখে দৌড় দিলো স্পন্দন। ঠান্ডায় পুরো শরীর জমে আছে তার উপর বৃষ্টিতে ভেজা। শরীরের এই ধকল সইতে না পেরে অজ্ঞান হয়ে মেঝেতে পরে আছে শুভ্রতা।

স্পন্দন কোলে তুলে শুভ্রতা-কে রুমে নিয়ে আসে। নিজেই শুভ্রতার ভিজা কাপড় চেঞ্জ করে দেয়। স্পন্দনও তার শরীরের ভেজা কাপড় চেঞ্জ করে ফেলে।

ডক্টর এসে শুভ্রতা-কে দেখে মেডিসিন আর ইনজেকশন দিয়ে চলে গেল।

তিনটা কম্বল শুভ্রতার গায়ে দিলো স্পন্দন তবুও শুভ্রতার কাঁপুনি থামছে না। শুভ্রতার দিকে তাকিয়ে রাগান্বিত স্বরে বলল…..

—” চোখে কি দেখতে পারো নাই যে বৃষ্টি আসছে? এত শীত তার উপর বৃষ্টিতে ভিজ-ছো কমন সেন্স নেই তোমার? এই অসময়ের বৃষ্টিগুলো মোটেও ভালো নয়।”

শুভ্রতা কিছু শুনছে না বা বুঝতে পারছে না স্পন্দন খুব ভালো ভাবেই বুঝতে পেরেছে। শুধু শুধু যে শুভ্রতা-কে বকছে জানে সে………

—-” ধ্যাত! শুধু শুধু কথা বলে সময় প্লাস আয়ু নষ্ট করছি। শুনেছি বেশি কথা বললে আয়ু কমে যায়।”

স্পন্দন নিজে নিজে বকবক করছে। তখন মিসেস সাবিনা বেগম দরজার ওপাশ থেকে বলল…..

—” স্পন্দন! আসবো?”

—” আসো আম্মু। আমার রুমে আসতে কি তোমার অনুমতি লাগে?”

—” কথা সেটা না। তুই এখন বিয়ে করেছিস। তোর রুমে আসতে এখন অনুমতি প্রয়োজন। এখন হয়তো জিজ্ঞাসা করবি না যে কেন প্রয়োজন।”

মায়ের কথায় খুব লজ্জা পেল স্পন্দন। মা যে তাকে কি মীন করে বলেছে খুব ভালো ভাবেই বুঝতে পেরেছে। ছেলের লজ্জা মাখা মুখ দেখে মিসেস সাবিনা বেগম কথা এড়িয়ে অন্য কথায় মনোযোগী হলেন।

—-” শুভ্রতা কেমন আছে এখন?”

—” জ্বর বাঁধিয়ে বসেছে। শীতকালে কেউ বৃষ্টিতে ভিজে? আজব মেয়ে!”

—” মেয়েটা বড় হলেও কিন্তু এখনও মন থেকে বাচ্চা। হয়তো ইচ্ছা করেছে তাই ভিজেছে তুই আর বকাবকি করিস না মেয়েটাকে।”

—” আম্মু তুমি কিন্তু ওকে আদরে আদরে বাঁদর বানিয়ে ফেলছো। তুমি তো জানোই এই অসময়ের বৃষ্টি গুলো বড্ড খারাপ। আচ্ছা বাদ দেও কিন্তু… এই শীতে এমনিতেই কেউ গোসল করতে চায় না আর ও বৃষ্টিতে ভিজে একাকার। একটা ছোট বাচ্চাও দৌড়ে রুমে আসবে এই শীতের বরফ বৃষ্টির স্পর্শে।”

—” ভুল করেছে তার শাস্তি তো পাচ্ছে বেচারি তুই আর কিছু বলিস না। সকাল থেকে মনে হয় পেটে কিছু পড়েনি। আমি রহিমাকে বলে তোর খাবার রুমে পাঠাচ্ছি।”

—” কিন্তু শুভ্রতা…..?”

—-” ওর জন্য গরম স্যুপ পাঠাচ্ছি।”

—” ওতো ঘুমিয়ে আছে।”

—” সমস্যা নেই। যখন জেগে উঠবে খাইয়ে দিস। চিন্তা করার কিছু নেই ঠাণ্ডা হবে না স্যুপ।”

মিসেস সাবিনা বেগম চলে গেলেন নিজের রুমে।

মিস্টার আজম সাবিনা বেগমকে দেখে বললেন…..

—” মেয়েটার এখন কি অবস্থা গো?”

—” এখন ভালো আছে কিন্তু জ্বর এসেছে। তাছাড়া ডক্টর এসে দেখে গেছে।”

—-” আমার তো খুব যেতে ইচ্ছা করছে কিন্তু তোমার ছেলে তো আমাকে দেখেই জ্বলে উঠবে। নানান ধরনের বিভ্রান্ত মূলক প্রশ্ন করবে। ছেলেটা যে কিভাবে এমন হলো বুঝলাম না।”

—” এই নিয়ে তোমার সাথে কথা বলতে আমি ইচ্ছুক না। আর কি যেন বললে? স্পন্দন এমন হওয়ার কারণ তুমি জানো না? সত্যিই জানো না?”

মিস্টার আজম মিসেস সাবিনা বেগমের কথা শুনে কথা না বাড়িয়ে বুক সেলফ থেকে “রবীন্দ্র নাথ ঠাকুর” এর “প্রজাপতির নির্বন্ধ” উপন্যাসটি বের করে পড়তে লাগলেন। মিসেস সাবিনা বেগম শব্দ করে নিঃশ্বাস ফেলে পানের ঝুড়ি থেকে পান বের করে চিবুতে লাগলেন।

কষ্ট, একাকিত্ব, নীরবতা ও কান্না এরা কিন্তু একে অন্যের পরম বন্ধু।কথাটা হাস্যকর মনে হলো তাই না? হাস্যকর হলেও কথাটা কিন্তু চরম সত্য একটি কথা। কষ্ট যখন বুকে বাসা বাঁধে তখন একা থাকতেই খুব ভালো লাগে। মন চায় তখন দরজা বন্ধ করে শব্দ করে কান্না করতে কিন্তু যখন শব্দ করে কান্না করতে না পারা যায় তখন নিরব হয়ে আপন মনে নিরবে চোখের পানি ফেলা ছাড়া কোনো উপায় নেই। ঠিক তেমনি মিস্টার আজম তার কষ্ট গুলো বইয়ের মাঝে লুকিয়ে রাখে। নিরবে তার কষ্ট গুলো জমিয়ে রাখে।

।।

।।

স্পন্দন বার বার শুভ্রতার কপালে জল পট্টি দিচ্ছে। শুভ্রতার চেহারা দেখে খুব মায়া লাগছে স্পন্দনের। শুভ্রতার গরম কপালে ভালোবাসার পরশ একে দিয়ে শুভ্রতা-কে নিজের বুকের মাঝে মিশিয়ে রাখে। শুভ্রতার গায়ের উষ্ণ গরমে স্পন্দনের শরীর গরম হয়ে যায়। শুভ্রতা স্পন্দনকে আষ্টেপৃষ্টে আঁকড়ে ধরে।

—-” কি হয়েছে আজ তোমার কেন এইভাবে বৃষ্টিতে ভিজেছিলে? কিছু কি হয়েছে তোমার?”

ভাবনাহীন শুভ্রতা স্পন্দনের কথায় উত্তর দিল……

—-” উনি খুব খারাপ। থাকবো না আমি উনার সাথে। খুব বাজে লোক উনি।”

—-” কার সাথে থাকবে না? কে বাজে লোক?”

—” উনি বাজে লোক। থাকবো না আমি উনার সাথে। উনাকে ছেড়ে দিয়ে অনেক দূরে চলে যাব যেন আমায় খুঁজে না পায়। আমি আর থাকতে চাই না। এই সম্পর্কের মায়াজালে জড়িয়ে খুব বড় ভুল করেছি আমি।”

শুভ্রতা কথাগুলো অস্পষ্ট স্বরে বলল। স্পন্দন কিছু বুঝতে পারলো না।

—-” কিসের সম্পর্ক শুভ্রতা? বুঝিয়ে বলো আমি বুঝতে পারছি না।”

—-” উনি খুব খারাপ লোক।খুব খারাপ।”

স্পন্দন শুভ্রতার কথাগুলো গুরুত্ব না দিয়ে শুভ্রতা-কে জড়িয়ে ধরে শুয়ে রইল।

।।

।।

বিকালে……..

মুগ্ধ সাধনার জন্য মাদার হরলিক্স বানিয়ে আনলো সাথে নিজের হাতে বানানো চটপটি। সাধনা প্রথম হরলিক্স খেয়ে মুগ্ধর দিকে তাকিয়ে বলল…..

—-” আজ বিকালে আনলে কেন? সকালে তো খেয়েছি।”

—” বিকাল টাইম তার উপর মেঘাচ্ছন্ন আকাশ তাই বানিয়ে আনলাম। সমস্যা নাই খেতে পারো বাচ্চার হেলথ ভালো হবে। আর এই চটপটি আমি বানিয়েছি কিছু হবে না খেতে পারো।”

সাধনা প্রচুর টক নিলো চট-পটিতে। মুখে দিয়ে অসম,ওয়াও, বলতে লাগলো। মুগ্ধ হাসি দিয়ে বলল…..

—” ভালো লেগেছে?”

—” অসম্ভব ভালো হয়েছে। বাই দা ওয়ে এত ভালো রান্না কিভাবে শিখলে? মনে হয় তুমি ভালো কোনো শেফ। মাঝে মাঝে তোমার বিভিন্ন রূপ দেখে বলতে ইচ্ছা করে যেমন খুশি তেমন রূপে আবির্ভূত হয় তুমি। এই ডক্টর,এই শেফ,এই গুন্ডা,এই ভালো স্বামী,এই ভালো বাবা। তোমার আসল পরিচয় কি গো?”

—” আমার আসল পরিচয় হলো আমি সাধনার স্বামী এবং আমাদের অনাগত সন্তানের বাবা।”

—” হাহাহা। তুমি খাচ্ছ না কেন? খাও খুব মজা হয়েছে।”

—” হুম খাচ্ছি তো তুমিও খাও।”

—“হুম।”

।।

।।

রাত ১০ টা ৪৫ মিনিট………

শুভ্রতার জ্বর কিছুটা কমেছে। কিন্তু এখনও নিজের হুস-এ আসে নাই। সামান্য নরা-চড়া করলেই স্পন্দন ব্যাকুল হয়ে পড়ে। শুভ্রতা-কে দেখতে মারাত্মক সুন্দর লাগছে। এক কথায় ভয়ংকর সুন্দরী। মেয়েদের এত সুন্দর হতে নেই। সুন্দর বলতে ধবধবে ফর্সা, চিকন শরীর তা নয়। সুন্দর বলতে বুঝায় যে যাকে পছন্দ করে তার চোখের দৃষ্টিকে। মন থেকে ভালোবাসলে কালো অন্ধকার ছায়াকেও চোখের দৃষ্টিতে সুন্দর বলা যায়। এক কথায় সুন্দর বলতে যাকে সুন্দর বলা হয়েছে তার বিপরীত পাশের মানুষের চোখের দৃষ্টির উপর নির্ভর করে।

এই জন্যই তো সেইন্ট আগস্টিন বলেছেন-

“যেহেতু তোমার মধ্যে ভালোবাসা জন্মলাভ করে, সুতরাং সেখানে সৌন্দর্যও জন্ম নেয়। ভালোবাসা হলো আত্মার সৌন্দর্য।”

—-” আজ তোমার অনুমতি ছাড়া তোমাকে ভালোবাসতে খুব ইচ্ছা করছে। কিন্তু আমি চাইবো না এই ভুল আমি করি। কজ ভালোবাসি তোমাকে। শুনতে চেয়েছিলে না কথাটা তাই আজ বলে দিলাম।”

অন্যদিকে……

তাজরীন আর সন্ধ্যা মেসেঞ্জারে লুডু খেলছে। সন্ধ্যার অতি প্রিয় একটি খেলা। খেলার পাশাপাশি তারা ফোনে কথাও বলছে।

—” চকোলেট পেয়েছিস?”

—” হ্যাঁ পেয়েছি আপু। জানো আজ নিজেকে কেমন যেন পাগল পাগল লাগছিলো। তোমার এই চকোলেটে কি আছে গো? একদিন না খেলেই মরে যেতে ইচ্ছা করে।”

—” সিক্রেট। তোর জন্য স্পেশাল ভাবে বানানো। ভালো লাগে তোর কাছে?”

—” প্রচুর।”

—” চকোলেট পেয়েছিস এখন আমার কাজ কখন করবি?

—” কি কাজ তোমার?”

—” ভুলে গেলি।তোকে না বলেছে তোর ভাবীকে এখন এই চকোলেট গুলো গিফট দিতে।”

—-” ইহহহহ আমি এই চকলেট গুলো কাওকে দিবো না।”

—” আরেহ তোকে তো দিয়েছি। এক্সট্রা গুলো শুভ্রতা-কে দিয়ে দিস। যদি না দিবি তাহলে আর পাবি না চকোলেট।”

—” ওকে দিবো। এখন এত রাতে যাবো না সকালে দিয়ে আসবো।”

—” এইতো গুড গার্ল। উম্মাহ।”

—” উম্মাহ টু।”

পরের দিন সকালে…….

স্পন্দনকে তার এত কাছে দেখে শুভ্রতা সজোরে ধাক্কা মেরে ফেলে দেয় স্পন্দনকে। তাল সামলাতে না পেরে ফ্লোরে পরে যায় স্পন্দন। ঠান্ডার মাঝে একটু ব্যাথা পেলে বেশি ব্যাথার অনুভব সৃষ্টি হয়। হাতের কব্জিতে খুব ব্যাথা পেলো স্পন্দন। রেগে গিয়ে শুভ্রতার দিকে তাকিয়ে বলল…..

—“পাগল হয়ে গেলে না-কি? এইভাবে কেউ ধাক্কা মারে? আজব।”

চলবে……