সম্পর্কের মায়াজাল পর্ব-২৫

0
3024

#সম্পর্কের_মায়াজাল
#ফারজানা_আফরোজ
#পর্ব_২৫

স্পন্দন শুভ্রতা-কে কোলে তুলে ঘুরাতে লাগল। শুভ্রতা ভয়ে চিৎকার করতে লাগল। স্পন্দন শুভ্রতা-কে খাটের উপরে এনে ছেড়ে দিয়ে নিজের কোমরে হাত রাখে…….

—” সিরিয়াসলি বলছি শুভ্রতা তোমার দ্বারা কিচ্ছু হবে না। ভাবছি এখন রোমান্স করবো আর তুমি চিল্লা-চিল্লি করে রোমান্স করার মুড টাই নষ্ট করে দিলে।”

শুভ্রতা কিছুক্ষণ জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে রাগান্বিত স্বরে বলল…..

—” হটাৎ করে এইভাবে কোলে নিয়ে কেউ ঘুরায়? কোন দেশ থেকে এমন আজগুবি রোমান্স শিখেছেন, বলেন?

—” আই লাভ ইউ মুভি থেকে। দেব যখন পায়েলকে কোলে তুলে এইভাবে ঘুরাচ্ছিল তখন থেকেই এই ইচ্ছাটা মনে পুষণ করে রেখেছিলাম। তাছাড়া তোমাকে এইভাবে কোলে নিয়ে আমি এক প্রকার ব্যায়ামও করে ফেললাম। ”

—” ঢং কত, বুড়া বয়সে রোমান্স করতে আসে।”

—” বাচ্চা হলো না, নাতি নাতনী হলো না কিভাবে বুড়া হলাম?”

—” জানি না। যান তো আপনি সব সময় বিরক্ত করতে ভালো লাগে তাই না?”

—” বিষণ ভালো লাগে। তোমাকে রাগলে খুব কিউট লাগে তাই রাগাতে ভালো লাগে।”

শুভ্রতা মুখ ভেংচি কেটে আলমারির ভিতরে থাকা এলো-মেলো কাপড় গুলো গোছাতে লাগল। স্পন্দন শুভ্রতার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে ফোন হাতে নিয়ে কাজ করতে লাগল।

শুভ্রতা হটাৎ করেই বলে উঠল…..

—” এই শুনছেন?”

—” কানে যেহেতু শুনতে পাই তাহলে অবশ্যই শুনতে পাচ্ছি।”

—” আগামীকাল থেকে কি অফিস যেতে হবে আমায়?”

—” চাকরি হারাতে না চাইলে তো যেতেই হবে। এখন ইউর উইশ।”

—” অফিসের বস হয়ে নয় স্বামী হয়ে বলুন।”

—” স্বামীর চরিত্রে এন্ট্রি নিলে অনেক কিছু হয়ে যেতে পারে তখন এর দায় ভার কে নিবে? তুমি?”

—” আমার ঘুরতে ইচ্ছা করছে।”

শুভ্রতা মাথা নিচু করে আস্তে বলল কিন্তু স্পন্দন শুনে ফেলল…….

—” সরি এখন আর ঘুরাতে পারবো না। অনেক ওজন তুমি।”

—” আমি লং ড্রাইভের কথা বলছি।”

—” লং ড্রাইভ?”

—” হুম। শীত কালে লং ড্রাইভে অনেক মজা হয়। দুইজন একসাথে হাতে হাত রেখে হাঁটাহাঁটি করা, একজন অন্যজনকে খাবার খাইয়ে দেওয়া, কিছুটা সময় একজন আরেকজনের চোখে চোখ রাখা, চোখের মাধ্যমে কথা বলা, গরম চা সাথে বিস্কুট একসাথে বসে খাওয়া, নিরিবিলি পরিবেশে দুজন একত্রে বসে একজনের কাঁধে অন্যজন মাথা রাখবে, শীতকালীন আড্ডা দেওয়া। ”

শুভ্রতার কথা শুনে স্পন্দন শুভ্রতার চোখের দিকে তাকালো। দুইজনের একসাথে চোখ একত্রে হওয়ার সাথে সাথে শুভ্রতা চোখ ফিরিয়ে নিলো। স্পন্দন নিজেকে কন্ট্রোল করে বলল…..

—” যেভাবে কথাগুলো বললে মনে হলো অভিজ্ঞতা আছে। কারো সাথে গিয়েছিলে কোনোদিন কখনও?”

শুভ্রতা স্পন্দনের এই রকম কথা আশা করে নাই। মন খারাপ করে বলল…..

—” আমার চরিত্র এতটাও খারাপ না যে বিয়ের আগে অন্য কারো সাথে লং ড্রাইভে যাবো। আমি সব সময় মনে করে এসেছি বিয়ের পর বরের সাথে ঘুরাঘুরি করবো। আমার বড্ড ইচ্ছা পুরো দেশ ঘুরা। পাখির মতো দু হাত মেলে উড়তে ইচ্ছা করে আমার। উরে উরে পুরো দেশ ঘুরবো।”

—” বাজে কথা বন্ধ করে নিজের কাজ করো। সব সময় কাজে ফাঁকি দেওয়ার ধান্দা।”

—” আচ্ছা আমার কোনো ইচ্ছা আপনার পূরণ করতে হবে না বাট একটা কথা রাখবেন?”

—” রাখার মত হলে রাখবো।”

—” আমি সন্ধ্যার কাছ থেকে চকোলেট বক্স চুরি করে এনেছি।”

শুভ্রতার কথাটা শেষ করতে পারলো না শুভ্রতা তার আগেই স্পন্দন বলল…..

—” চুরি করার কি আছে সন্ধ্যা যদি চকোলেট না দিতো আমাকে বলতে পারতে আমি কিনে এনে দিতাম। চুরি করবে কোনোদিন ভাবেনি।”

—” খাওয়ার জন্য চুরি করিনি। চুরি করেছি অন্য কারণে।”

—” চুরি করার আবার অন্য কারণ?”

—” হুম। আপনি এই চকোলেট গুলো পরীক্ষা করতে পারবেন ল্যাবে?”

—” কেন?”

—” এখন বলবো না আগে পরীক্ষা করে আনুন পরে যদি আমার সন্দেহ ঠিক হয় পরে সব বলবো আপনাকে।”

—” ওকে আমি আগামীকাল সাগরের কাছে দিয়ে আসবো ও পরীক্ষা করে বলবে। সাগরকে মনে আছে তো?”

—” হুম আছে আপনার ওই ব্যাস্ত ডক্টর ফ্রেন্ড।”

—” হুম।”

রাত আটটা……

স্পন্দন শীতের পোশাক পড়ে শুভ্রতার সামনে আসলো….

—” হাহাহা এই জানেন আপনাকে কেমন দেখাচ্ছে পুরাই হনুমান হাহাহাহা।”

—” শীতের সব পোশাক গায়ে দেও। যা যা আছে সব।”

—” আমার বাবা এত শীত লাগে নাই যে সব শীতের পোশাক পরতে হবে।”

—” তোমার না লং ড্রাইভে যেতে ইচ্ছা করছে এখন কি যাবে না?”

শুভ্রতা অবাক হয়ে স্পন্দনকে জিজ্ঞাসা করলো…..

—” আপনি লং ড্রাইভে নিয়ে যাবেন আমাকে?”

—” শুনো আমি খুব দয়ালু তার উপর কেউ দুঃখ দুঃখ ভাবে কোনো কথা বললে আমি না রেখে পারি না। যাবে?”

—” হুম। আমি এক্ষুনি সব শীতের পোশাক পরে আসছি।”

—” হুম। বাহিরে কিন্তু খুব ঠাণ্ডা তাই বেশি করে পরিধান করো।”

—” ওকে।”

স্পন্দন দুইটা শীতের গেঞ্জি, একটা সোয়েটার , জ্যাকেট, মাথায় টুপি, হাতে গ্লাভস, পায়ে বুট জুতো এক কথায় দেখতে তাকে ৯০ ওজনের বেশি ব্যাক্তির মতো লাগছে।

স্পন্দন শুভ্রতা-কে দেখে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। শুভ্রতা-কে ফুটবলের মত দেখতে লাগছে। কিন্তু শুভ্রতা-কে বেশ ভালো মানিয়েছে লেডিস হুডি পড়াতে।

শুভ্রতা ও স্পন্দন ড্রয়িং রুমের কাছে আসতেই মিসেস সাবিনা বেগমকে দেখতে পেলেন। শুভ্রতা এই অবস্থায় শাশুড়ির সামনে পড়ে লজ্জায় স্পন্দনের পিছু দাঁড়িয়ে পড়লো। মিসেস সাবিনা বেগম স্পন্দনের দিকে প্রশ্ন ছুড়ে মারলেন…..

—” কোথায় যাচ্ছিস তোরা?”

—” আম্মু আমরা দুজন ঘুরতে যাচ্ছি।”

মিসেস সাবিনা বেগম হাসি দিয়ে স্পন্দনের কাঁধে হাত বুলিয়ে বললেন….

—” সাবধানে যাবি কেমন। কুয়াশায় রাস্তা ঘাট অন্ধকার হয়ে আছে।”

—” ওকে আম্মু।”

শুভ্রতা মাথা নিচু করে লজ্জায় দাঁড়িয়ে আছে। মিসেস সাবিনা বেগম শুভ্রতার মুখে আলতো হাত রেখে বললেন….

—” এই লজ্জা পাচ্ছিস কেন? বিয়ের পর বরের সাথে এমন একটু আধটু ঘুরতে হয় এই জন্য লজ্জা পেতে হবে না। সাবধানে যাবি কেমন।”

—” আচ্ছা আম্মু।”

—” লক্ষী মেয়ে আমার।”

স্পন্দন শুভ্রতা বাসা থেকে বের হয়ে বাড়ির বাহিরে আসলো। স্পন্দন শুভ্রতার দিকে তাকিয়ে বলল….

—” বাইকে চড়তে ভয় পাও না তো আবার?”

—” না আমি বাইকে উঠবো না। খুব ভয় করে আমার।”

—” আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরবে তখন ভয় বাপ বাপ করে পালাবে।”

—” আমরা বাইকে যাবো?”

শুভ্রতা অবাক ও ভয় পেয়ে জিজ্ঞাসা করলো। স্পন্দন চিন্তাহীন ভাবেই বলল…..

—” অফকোর্স। রাতে লং ড্রাইভে যাবো আর বাইকে চড়ে যাবো না তা কি করে হয়।”

—” শীতে বাইকে চড়ে ঘুরলে খুব শীত করবে।”

—” শীত করবে বলেই তো এতগুলো পোশাক পড়েছি। এত ভয় পেও না তো দেখবে ভালোই লাগবে।”

স্পন্দন সিড়ির নিচ থেকে হাঁটিয়ে বাইক আনলো।

—” বসো ভয় পাওয়ার কিছু নেই।”

শুভ্রতা নিজের ইচ্ছা পূরণ করার জন্য ভয়ে ভয়ে স্পন্দনের বাইকে উঠলো।

—” বেশি ভয় হলে জড়িয়ে ধরতে পারো আমি মাইন্ড করবো না তাছাড়া শুনেছি কোনো ছেলেকে কোনো মেয়ে বাইকে চড়ার পর শক্ত করে জড়িয়ে ধরলে ছেলেটির বাইক না-কি খুব দ্রুত গতিতে চলে।”

—” আপনি বাইক স্টার্ট দিন আমি ভয় পাচ্ছি না।”

—“যা হুকুম মহারাণী।”

স্পন্দন ইচ্ছা করেই বাইক জোরে চালাতে লাগলো শুভ্রতা ভয় পেয়ে স্পন্দনকে জড়িয়ে ধরে।

—” আগেই বলেছি শুনলে না কিন্তু এখন ঠিকই জড়িয়ে ধরলে।”

—” বেশি কথা বললে এক্ষুনি লাফ দিব বাইক থেকে।”

স্পন্দন কিছু বলল না সে বাইক চালাতে লাগলো। শুভ্রতা তার মাথা স্পন্দনের পিটে রাখলো, দুইটা হাত দিয়ে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলো। স্পন্দন ফাঁকে ফাঁকে গাড়ির আয়না দিয়ে শুভ্রতার দিকে তাকিয়ে আবারো সামনে তাকায় খুব ভালো লাগছে তার শুভ্রতা তাকে এইভাবে জড়িয়ে ধরাতে।

এই পথ যদি না শেষ হয়, তবে কেমন হত তুমি বলত?

এই পথ যদি না শেষ হয়, তবে কেমন হত তুমি বলত?

যদি পৃথিবীটা স্বপ্নের দেশ হয়, তবে কেমন হত তুমি বলত?

তুমিই বল.

এই পথ যদি না শেষ হয়, তবে কেমন হত তুমি বলত?

লাল্লা লা লা, লাল্লা লা লা, লা লা লা…

দুইজনের মনের ভিতর এই রোমাঞ্চকর গান বাজছে। এই শীতের মাঝেই স্পন্দনের দেহে এক রকম উষ্ণ গরম সৃষ্টি হচ্ছে। ভালোবাসার মানুষের স্পর্শে শীত কখনো স্পর্শ করতে পারে না। ভালোবাসার মানুষের ইচ্ছার কাছে শীত বা কাজ কোনো কিছুই বাঁধা হয়ে আসে না। ভালোবাসার মানুষের ইচ্ছাটি প্রবল শক্তিমান। নদীর স্রোতের চেয়েও খুব দ্রুত গতিতে চলে ভালোবাসার শক্তি যদি ভালোবাসা সত্য হয় খাঁটি হয় আর মানুষ দুটি স্বার্থহীন হয়।

নয়টার দিকে স্পন্দন বাইক থামা-লো শুভ্রতা মাথা উচু হয়ে জিজ্ঞাসা করলো…..

—” বাইক থামালেন কেন?”

—” ওই দেখো ঝালমুড়ি চাচা আগুনের সামনে ঝালমুড়ি বিক্রি করছে খাবে?”

—” খেলে মন্দ হবে না তার উপর আগুনের উষ্ণ গরম পাবো কিছু সময়।”

স্পন্দন ও শুভ্রতা বাইক রাস্তার মোড়ে রেখে ঝাল মুড়ি চাচার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো…..

—” চাচা রাতেও কি ঝাল মুড়ি বিক্রি হয়?”

—” হো বাবা। শহরের ব্যাস্ত মানুষ গুলো তো সব সময় থাকে আর আমারও বেচা কেনা হয়। সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত স্কুল কলেজের ছেলে মেয়েরা কিনে আর রাতে তোমাদের মত ছেলে মেয়ে আসে।”

—” চাচা আপনি তো খুব সুন্দর ভাবে কথা বলেন। ”

—” ধন্যবাদ বাবা। কত টাকার দিবো?”

শুভ্রতা চট করে বলে উঠল….

—” দু প্যাকেটে পঞ্চাশ টাকার দিন। একটায় ঝাল দিবেন প্রচুর ।”

—” আচ্ছা মা-মুনি।”

শুভ্রতা আর স্পন্দন ঝাল মুড়ির প্যাকেট যাকে আমরা বলি ঠোঙ্গা হাতে নিয়ে তাদের বাইকের কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। স্পন্দন শুভ্রতার হাতে ঠোঙ্গা দিয়ে বলল….

—” চলো ওই লেকের ধারে বসি। সোলার স্ট্রিট লাইটের আলোতে ঝালমুড়ি খেতে খেতে কথা বলা যাবে।”

শুভ্রতা স্পন্দনের কথায় রাজি হলো। বাইক হাঁটিয়ে ওই লেকের ধারে নিয়ে গেল। শুভ্রতা বাইকে হেলান দিয়ে একটু একটু করে ঝালমুড়ি খাচ্ছে স্পন্দন শুভ্রতার দিকে তাকিয়ে দেখছে। লাইটের আলোতে শুভ্রতা-কে দেখতে একদম অপ্সরার মত লাগছে।

—” খাচ্ছেন না কেন?”

—” খাচ্ছি তো তুমি খাও।”

শুভ্রতা মুচকি হেসে আবারো তৃপ্তি নিয়ে খেতে লাগল।

চলবে…..

বানান ভুল হলে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।