সম্পর্কের মায়াজাল পর্ব-২৬ ( ১৮+ এলার্ট)

0
3158

#সম্পর্কের_মায়াজাল
#ফারজানা_আফরোজ
#পর্ব_২৬

(১৮+ এলার্ট)

শুভ্রতা মুচকি হেসে আবারো তৃপ্তি নিয়ে খেতে লাগল।

ঝালমুড়ি শেষ করে দোকান থেকে মিনারেল ওয়াটার কিনে প্রয়োজন মত পানি পান করে আবারো বাইক স্টার্ট দিল স্পন্দন। শুভ্রতা এইবার স্পন্দনের পেটে হাত দিয়ে অন্য হাতে গলা জড়িয়ে ধরে হেলান দিয়ে বসে রইলো…..

—” খুব কষ্ট হচ্ছে আপনার তাই না?”

—” একদমই না বরং খুব ভালো আর আনন্দ লাগছে। জানো কি পৃথিবীর আনন্দময় সম্পর্ক হলো স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক। যতই প্রেম করো, প্রেমিকের সাথে যতই লং ড্রাইভে যাও এত শান্তি, আনন্দ, সুখ পাবে না যা বৈধ, পবিত্র সম্পর্ককে পাবে। জানো আমি কোনোদিন ভাবিনি আজকের দিনটা এতটা আনন্দময় হবে আমার জীবনে। ”

শুভ্রতা নিজের ঠোঁট হালকা চেপে ধরে মিষ্টি হাসি দিয়ে বলল…..

—” আমিও জানতাম না। আজকের রাতটা আমার জীবনে স্মরণীয় একটি রাত হবে। প্রিয় মানুষের সাথে রাতে ঘুরাঘুরি করার মজাই আলাদা।”

—” আমি তোমার প্রিয়জন?”

শুভ্রতা এইবার জিভে কামড় দিয়ে আমতা আমতা করে বলল….

—” আমি তো জাস্ট কথার কথা বলেছি সিরিয়াসলি নেওয়ার কিছু নেই।”

স্পন্দন মনে মনে হাসলো কেননা, তার বুঝতে আর বাকি নেই শুভ্রতা যে তাকে ভালোবাসে। ভালোবাসে বলেই তাকে প্রিয়জন বলেছে।

রাত বারোটা…..

স্পন্দন আর শুভ্রতা গ্রামের দিকে চলে এসেছে। গ্রামের মানুষ সন্ধ্যা হলেই রাত ভাবে। রাত আটটায় তাদের কাছে অনেক রাত মনে হয় কিন্তু শুভ্রতা আর স্পন্দন যে এলাকায় এসেছে এইখানে অনেক মানুষই এখনও জেগে আছে।

পাঁচ কি ছয় জায়গায় আগুন নিভু নিভু করে জ্বালিয়ে অনেক মানুষ আগুনের তাপ নিচ্ছে। লাল,নীল,হলুদ কাপড় দিয়ে মাঝারি সাইজের স্টেজ সাজানো। ছোট ছোট বাচ্চারা শীতের পোশাক পরে আলদা গোল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অনেক মহিলারা চাদর গায়ে দিয়ে বাড়ির উঠানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলছে আর হাসাহাসি করছে। ১৪ থেকে ২৪ বছরের ছেলেগুলো একত্রে মিটিং করছে। মজার ব্যাপার হলো স্টেজ এত বড় বা লাইটিং না করা সত্বেও খুব সুন্দর লাগছে। সুন্দর লাগার প্রধান কারণ বিভিন্ন রঙের বেলুন আর হাতে কাজ করা কাপড়ে গেইট বানানো হয়েছে। ছোট বড় ফুলের টব দাঁড় করিয়ে রেখেছে। এইগুলো দেখে শুভ্রতা আর স্পন্দন বেশ অবাক হলো। গ্রামে এই সময় বড় বড় মানুষরা ঘুমিয়ে কাঁদা হয়ে যায় সেখানে কি-না ছোট ছোট বাচ্চারা না ঘুমিয়ে হাঁটাহাঁটি করছে।

স্পন্দন বাইক দাঁড় করিয়ে শুভ্রতা-কে জিজ্ঞাসা করলো……

—” যেতে চাও ওইখানে?”

শুভ্রতা মন থেকে চাইছিল ওইখানে যেতে কিন্তু মুখে বলতে পারেনি এখন যেহেতু স্পন্দন জিজ্ঞাসা করেছে তাই সাথে সাথেই বলে দিল….

—” যেতে তো খুব ইচ্ছা করছে কিন্তু…..!”

—” কিন্তু কি?”

—” আপনি বকবেন না তো?”

স্পন্দন এক গাল হেসে শুভ্রতার মাথায় আলতো ভাবে হাত রেখে বলল…..

—” বউয়ের ইচ্ছা যেহেতু তাহলে না করবো কেন? তাছাড়া আমারও যেতে ইচ্ছা করছে। মনে হচ্ছে খুব ইন্টারেস্টিং ব্যাপার।”

—” আচ্ছা উনারা যদি আমাদের গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয় তাহলে?”

—” বড়লোকের মন কিন্তু অনেক ছোট আর গরীব মানুষদের মন পাহাড়ের থেকেও বড়। তারা মানুষের অ্যাপায়ন করতে খুব ভালোবাসে। আমরা বড়লোক-রা যখন কোনো অনুষ্ঠান করি তখন যদি কেউ বিনা নিমন্ত্রনে চলে আসে তখন তার সাথে আমরা যা তা ব্যাবহার করি কিন্তু যখন কোনো গরিবদের বাসায় অনুষ্ঠান হয় তখন কেউ বিনা নিমন্ত্রনে চলে যায় তখন তারা পাগল হয়ে পরে ওই অতিথিকে কিভাবে সেবা দিতে পারবে। এইতো কিছুদিন আগে যে মধু-দের বাড়িতে গেলাম দেখলে না ওরা গরুর ঘরে ঘুমিয়ে আমাদের তাদের থাকার ঘরে জায়গা দিয়েছে। আর গ্রামের মানুষ গুলো বড্ড ভালো তারা সবাইকে আপন করে নিতে পারে কিন্তু শহরের মানুষ গুলো ব্যাস্ত শহরে থেকে অতিথি সেবা প্রায় ভুলেই গিয়েছে।”

শুভ্রতা মন দিয়ে স্পন্দনের কথাগুলো শুনতে লাগল। এই মানুষটার সব কিছুই তার খুব ভালো লাগে। কি সুন্দর ভাবে কথা বলে। একবার শুনলে বার বার ইচ্ছা করে শুনতে। শুভ্রতার হটাৎ করেই মুগ্ধর নাম মনে পড়ে যেহেতু স্পন্দন এখন ভালো মুডে আছে তাই জিজ্ঞাসা করলো…..

—” আচ্ছা আপনি মুগ্ধ নামের কাওকে চিনেন?”

স্পন্দন কিছুক্ষণ ভাবলো তারপর মাথা দু দিকে হেলিয়ে বলল…..

—” নামটা শুনেছি মনে হচ্ছে বাট জানি না। কে উনি?”

—” নাহ আমিও চিনি না হটাৎ নামটা মনে হলো তাই বললাম। তেমন কিছু না।”

—” ওকে চলো যাওয়া যাক।”

—” হুম চলেন।”

স্পন্দন শুভ্রতা মাঠের কাছে যেতে লাগলো। শুভ্রতা মনে মনে ভাবছে…..

—” সাধনার কথা শুনে মনে হচ্ছিল মুগ্ধ আর স্পন্দন জাত শত্রু কিন্তু এইদিকে স্পন্দন তো মুগ্ধকে চিনেই না। তাহলে কি সাধনা মিথ্যা বলেছে না-কি এইখানেও কোনো মায়াজাল জড়িয়ে আছে। এই ছোট্ট মাথায় কিছুই ঢুকছে না। একদিকে সন্ধ্যার ওই অপরিচিত আপু আর এইদিকে সাধনার স্বামী মুগ্ধ দুইজন কেন আমাদের পিছনে পরে আছে এই কথাটা কেন মাথায় ঢুকছে না। মুগ্ধর সাথে কি নিয়ে শত্রুতা? শত্রুতা থাকলে তো স্পন্দন তাকে চিনতো জানতো তাহলে কেন সে চিনছে না? ইসসসসসস এখন চিন্তা ভাবনা এক হাজার মাইল দূরে রেখে আজকের রাতটা উপভোগ করি কে বলতে পারে এই রকম রাত যদি আর না পাই।”

বাঙালি মেয়েরা চাকমা জাতীয় মেয়েদের পোশাক পরিধান করেছে। চাকমা, মগ বা মারমা মেয়েরা তাদের দৈনন্দিন জীবনে যে পোশাক পরেন সেটাকে পিনন বলে। কিন্তু এখন এই সব পোশাক নিয়ে আমাদের ফ্যাশন ডিজাইনাররা প্রতিনিয়ত নিরলস চেষ্টায় ফুটিয়ে তুলছেন পুঙ্খানুপুঙ্খ ডিজাইন। তাছাড়া এসব পোশাক বাঙালিদের কাছে পরিচিতি পেয়েছে উপজাতি পোশাক হিসেবে। এই উপজাতি পোশাক পাচঁটি মেয়ে পরিধান করে আছে। কান ও গলায় মাটির অলংকার। কোপা করে মাথায় ফুলের মালা।

শুভ্রতার কাছে মনে হচ্ছে সে এখন রাঙামাটি পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে একদল চাকমা মেয়েদের দেখছে। ভারী সুন্দর লাগছে তাদের। পাঁচটি ছেলে চাকমা ছেলেদের মত দুতি উপরে ফতুয়া মাথায় গামছা বেঁধে একপাশে দাঁড়িয়ে আছে। শুভ্রতা স্পন্দনের কানে ফিসফিস করে বললো….

—” আচ্ছা এদের কি শীত করে না?”

—” এরা নাচতে নাচতে টায়ার্ড তাই ওদের শীত লাগে না। ”

শুভ্রতা ও স্পন্দন ফিসফিস করে কথা বলছে। বাইশ বছরের একটি যুবক তাদের সামনে এসে বলল…..

—” কারা আপনারা কি চাই?”

শুভ্রতা ছেলেটির কথায় স্পন্দনের বাহু শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। স্পন্দন তখন ছেলেটিকে বলল….

—” আমরা ঘুরতে এসেছি। গ্রামের পথ ধরে যাবার সময় আপনাদের অনুষ্ঠানটি দেখতে পাই আর দেখার জন্য আসি।”

ছেলেটি সন্দেহ নজর দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলল…..

—” আপনারা কারা? বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছেন না-কি?”

ছেলেটির কথা শুনে বুঝা গেল শিক্ষিত ছেলে। স্পন্দন তখন বলল….

—” আমরা স্বামী স্ত্রী। আমার স্ত্রীর আর আমি আজ লং ড্রাইভে বের হয়েছি। আপনি চাইলে প্রুভ দিতে পারি। আমাদের বিয়ের পিক ফ্যামিলি পিক ফোনে আছে। ”

স্পন্দন তার ঠিকানা, কি করে যাবতীয় সব কথা ছেলেটিকে বলল। ছেলেটি তখন হটাৎ করেই স্পন্দনকে জড়িয়ে ধরলো। শুভ্রতা আর স্পন্দন ছেলেটির এই প্রক্রিয়া দেখে খুব অবাক হলো।

—” তাহলে আপনি সেই স্পন্দন ভাইয়া।”

—” কোন স্পন্দন?”

—” আপনিই তো কিছুদিন আগে আমাদের এলাকায় একটি হসপিটাল তৈরি করে দিয়েছেন। আজ আপনার জন্যই আমরা গ্রামের মানুষরা ভালো সেবা পাচ্ছি।”

অন্ধকারের কারণে স্পন্দন এলাকাটি লক্ষ্য করে নাই। ছেলেটি তখন গ্রামের নাম আর জেলার নাম বলার পর স্পন্দন বুঝল আজ থেকে এক বছর আগে সে এইখানে একটা সরকারি হসপিটাল তৈরি করে দিয়েছিল।

ছেলেটি তখন অন্যান্য ছেলেদের এইখানে এনে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। আজ এলাকায় ইয়াং ছেলেরা মিলে ফাংশন করছে তাই এলাকার সব মানুষ এই ফাংশনে দর্শক হিসেবে অংশ গ্রহণ করেছে। শুভ্রতার সাথে বেশ কয়েকটি মেয়ের পরিচয় হয়। শুভ্রতা স্পন্দনের কাছ থেকে দূরে গিয়ে ওই মেয়েদের কাছে গিয়ে বসলো। খড়ের উপরে বসে আগুনের তাপে হাত আর শরীর গরম করার মজাই আলাদা। স্পন্দন ইশারা করছে তার সাথে বসতে কিন্তু শুভ্রতা শুন-লো না।

সবার সাথে গল্প,আড্ডা আর শেষে খিচুড়ি খেয়ে প্রায় তিনটার দিকে তারা নিজেদের গন্তব্যে স্থলে রওনা দিলো। শুভ্রতা আর স্পন্দন আবারো সেই লেকের ধারে আসলো। স্পন্দন বাইক থামা-লো। শুভ্রতার দু চোখে ঘুম বাসা বেঁধেছে। ঘুম ঘুম কণ্ঠে বললো….

—” আর ঘুরবো না বাসায় যাবো।”

—” বাইক থেকে নামো।”

—” কেন?”

—” আমি বলছি তাই।”

একরাশ বিরক্তি নিয়ে শুভ্রতা বাইক থেকে নেমে দাঁড়ালো। স্পন্দন আশে পাশে তাকিয়ে দেখলো কেউ নেই। এত রাতে কারো থাকার কথা নয়। আচমকাই স্পন্দন শুভ্রতার দু হাত টান দিয়ে নিজের বুকের কাছে নিয়ে আসে। শুভ্রতার মুখের কাছে হাত রাখলো গ্লাভস ঠান্ডা থাকার কারণে শুভ্রতা বিরক্তি নিয়ে চোখ ছোট করে বললো…..

—” এ কেমন রসিকতা?”

স্পন্দন শুভ্রতার কথায় পাত্তা না দিয়ে শুভ্রতার ঠোঁটে নিজের ঠোঁট ডুবিয়ে দিল। শুভ্রতা ঠান্ডার সাথে সাথে স্পন্দনের এমন কান্ডে এক প্রকার কাঁপাকাঁপি শুরু করে দিয়েছে।

স্পন্দন বিরক্ত নিয়ে বলল…..

—” কি হয়েছে তোমার?”

—” আমার ঠান্ডা লাগছে আমি বাসায় যাবো। ”

স্পন্দন শুভ্রতার দু হাত নিজের হাতের মুঠোয় ভরে বলল…..

—-“তোমাকে মন থেকে আমি কতটা ভালোবাসি এটা প্রকাশ করার জন্য ভালোবাসি এই শব্দটা অনেক ছোট হয়ে যায়। তোমাকে আমি যে পাগলের মতো ভালোবাসি এটা বুঝানোর জন্য আমার এক জীবন খুব ছোট হয়ে যায়। ভালোবাস শব্দটা সবসময় নতুন, কখনোই তা মলিন হয় না, এর রং ধূসর নয় কিংবা বর্নহীনও নয়, যা আছে তা রংধনুর রঙে রাঙ্গানো। হোক না সেটা অনেক বিভেদ, তারপরেও ভালোবাসা শুধুই ভালোবাসা। সবকিছুর পর বলবো শুধুই ভালোবাসি। তোমাকে কখন কিভাবে কি দেখে ভালোবেসেছি জানি না। মনকে অনেক বার জিজ্ঞাসা করেছি কিন্তু কোনো উত্তর পাই নি। আমাকে ছেড়ে কোনোদিন যেও না প্লিজ।”

—” বাহ আজ এত রোমান্টিক মানুষ কিভাবে হলেন?”

—” ভালোবাসো আমায়?”

শুভ্রতা লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে রাখল…..

—” নিরবতা কি আমি সম্মতির লক্ষণ ভাববো?”

শুভ্রতা মাথা একবার উপরে আরেকবার নিচে নামিয়ে বলল….

—” হুম।”

স্পন্দন শুভ্রতা-কে জড়িয়ে ধরলো। শুভ্রতা তখন বলল….

—” ঘুম পাচ্ছে আমার তাড়াতাড়ি বাসায় চলুন আর একটা কথা রাখবেন প্লিজ?”

—” বলো?”

—” আমি আজ অফিস যাবো না। ছুটি চাচ্ছি আমি।”

শুভ্রতার বাচ্চা বাচ্চা মুখের আদুরে গলায় কথা শুনে স্পন্দনের মন গলে গেল।

—” ওকে দুইদিনের ছুটি দিচ্ছি বরের সাথে ছুটিয়ে প্রেম করার জন্য ওকে।”

—” থ্যাঙ্কু স্যার হিহিহিহি।”

—” টেলকম ম্যাম।”

স্পন্দন শুভ্রতা বাইকে উঠে বাসার উদ্দেশ্য রওনা দিল আবারো…….

চলবে…….

বানান ভুল হলে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।