#সম্পর্কের_মায়াজাল
#ফারজানা_আফরোজ
#পর্ব_৩৪
খুব ভোরে ঘুম ভেঙে যায় সাধনার। আজকাল মুগ্ধর কথা খুব ভাবাচ্ছে তাকে। সন্তান পৃথিবীতে আসার পর যখন সে তার বাবার কথা জানতে চাইবে কি উত্তর দিবে এইসব ভাবতে নিলেই মাথা পছন্দ ব্যাথা করে তার। এত সকালে কেউ এখনও ঘুম থেকে উঠেনি। মুঠোফোনটা হাতে নিয়ে ফেসবুক লগ ইন করে ঢুকে বিভিন্ন ধরনের পোষ্ট পড়তে লাগলো। আচমকাই তার নিউজফিডে পাঁচ দিন আগের একটি পোষ্ট আছে। পোষ্ট-টি দেখে চোখের পানি আটকাতে পারছে না সে। চোখ বেয়ে নোনা জল ক্রমশ ভাবেই পড়তে লাগলো। বুকের বা-দিক টায় ব্যাথা অনুভব করতে লাগলো সাধনা। সকাল সকাল ভালো কোনো খবর পাবে সেই ভেবে সে ফেসবুকে ঢুকে মুগ্ধের আইডি থেকে এমন একটি পোষ্ট দেখে সে বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। মুগ্ধর বিয়ে আর কিছুদিন পর। প্রথম এই ভেবে ভালো লাগছে সে মুগ্ধ বেচেঁ আছে কিন্তু মুগ্ধর বিয়ের খবরটি শুনে আচমকা তার হাত পেটে চলে গেল……
—” বাবু দেখো তোমার আব্বু বেঁচে আছে। এখন তোমার আম্মু আর খুনি নয়। তোমাকে কেউ আর বলবে না তোর আম্মু খুনি তোর বাবার খুনি। কিন্তু সোনা তোমার আব্বু তোমাকে কোনোদিন আদর করতে আসবে না। সে এখন তার নতুন জীবন গোছাতে ব্যস্ত। তোমার এই আম্মু খুব খারাপ জানো তুমি? তোমার জন্য কিছু করতে পারবে না। ক্ষমা করে দিও সোনা তোমার এই পঁচা আম্মুকে।”
সাধনা পালিয়ে আসার পর থেকে ফেসবুক ইউজ করেনি। হটাৎ আজ লগ ইন করে ফেসবুকে ঢুকে এমন একটি নিউজ দেখলো। মনে মনে এইটাও বলছে যে…….
—” ভালো হয়েছে আমি তো ওকে মারতে চেয়েছি তাহলে কেন ও আমার সাথে সম্পর্ক রাখবে তাছাড়া আমিই তো ওর কাছ থেকে মুক্তি পেতে চেয়েছি তাহলে এখন কেন কান্না করছি আমার তো এখন খুশি হওয়ার কথা বাট আমি খুশি হতে পাচ্ছি না কেন? কি হচ্ছে এইসব আমার সাথে।”
মুগ্ধর আইডির সবুজ বাতিটি জ্বলছে তার মানে সে এখনও অলনাইন। এত সকালে অলনাইনে দেখে সাধনা ভাবলো নতুন বউয়ের সাথে প্রেম করছে। রাগে কষ্টে সাধনা নিজের আইডিতে পোষ্ট করলো…….
_____ এই আইডির মালিক গতকাল রাতে বাথরুমে পা পিছলে প্রচুর রক্ত করণ হওয়ার ফলে কিছুক্ষণ আগে মারা গিয়েছে। মৃত ব্যাক্তি-টি যদি আপনাদের কারো সাথে খারাপ ব্যাবহার করে থাকে তাহলে দয়া করে তাকে ক্ষমা করে দিবেন। আমিন।________
পোষ্ট করার সাথে স্যাড রিয়েক্ট আর কমেন্টে ভরে যাচ্ছে সাথে তো শেয়ার আছেই। সবাই দোয়া করছে কেউ বলছে প্রেগনেন্ট অবস্থায় অসাবধান থাকা একদম ঠিক হয় নি। কেউ কেউ পরিবারের উপর দোষ চাপাচ্ছে। সাধনা একবার ডিলেট করতে চেয়েও ডিলেট করলো না। মুগ্ধ ফেসবুকে ঢুকলে অবশ্য পোষ্ট-টি তার চোখে পড়বে তখন মুগ্ধের কেমন রিয়েক্ট হয় দেখবে সে। পরে না হয় সবার কাছ থেকে ক্ষমা চেয়ে নিবে।
ফোনটা বিছানায় রেখে আস্তে আস্তে বিছানা থেকে নেমে ওয়াশ রুমের দিকে হাঁটা শুরু করলো সাধনা……..
__________________
ফজরের নামাজ আদায় করে সেই কখন থেকে সন্ধা সমুদ্রের সাথে কথা বলছে। সন্ধার মেজাজ আজ খুব ভালো নেই। মাথাটা ধরেছে খুব। কষ্ট করে হলেও সে চকোলেট খাবে না বলে প্রতিজ্ঞা করেছে।
—” আচ্ছা চাদর একটা কথা বলবো?”
—” হুম বলো?”
—-” শীত কিন্তু ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। চাদরের ব্যবহারও কমছে যখন গরম কাল পড়বে তখন তো আর চাদরের দরকার পড়বে না তখন কি তুমি আর আমি আলাদা হয়ে যাবো?”
সমুদ্র মুচকি হাসলো……
—-” আমি মানুষ চাদর। এই মানুষ চাদর শীত বা গরম এইসব মানে না । যতদিন বেঁচে থাকবে এই মানুষ চাদর তোমার সঙ্গী হয়েই বেচেঁ থাকবে।”
—” সত্যি তো?”
—-” তিন সত্যি। এখন বলো মন খারাপ কেন ?”
—” ভাইয়া চকলেট খেতে বারণ করেছে তাই।”
—-” এখনও খাচ্ছ চকোলেট?”
—” বেশি না সারাদিন দুইটা কিন্তু এখন ভাইয়া বারণ করে দিয়েছে।”
—” আহারে বাচ্চাটা রাগ করে না। যখন আমি তোমার সামনে আসবো অনেক অনেক চকোলেট কিনে আনবো কেমন?”
—-” ওকে।”
দুইজনের কথা চলতে লাগলো। তাদের কথার জন্য এইবার ফোনটা বিরক্তকর স্বরে বলা শুরু করল……
—-” ছাইরা দে মা কেঁদে বাঁচি।”
___________________
শুভ্রতা আজ সকাল থেকে জেদ ধরে বসে আছে ঘুরতে যাওয়ার জন্য। কিন্তু স্পন্দনের আজ কোথাও যেতে ইচ্ছা করছে না। শুভ্রতার জেদের কাছে শেষমেশ হার মানতে রাজি হলো স্পন্দন। আজ তারা দুইজন মধুদের গ্রামে যাবে। কতদিন পর চাচা চাচী আর মধুকে দেখতে পাবে বলে শুভ্রতার যে কি খুশি লাগছে বলার বাহিরে।
শুভ্রতার এই খুশির মাঝে আঁধার করিয়ে চিৎকার করে আগমন ঘটলো মুগ্ধের। রুম পর্যন্ত চিৎকারের শব্দ আসায় কেউ আর রুমে বসে থাকতে পারলো না। স্পন্দন ও শুভ্রতা দ্রুত হাঁটা দিয়ে ড্রইং রুমে আসলো……
—-” কে আপনি আর এইভাবে চিৎকার করছেন কেন?”
স্পন্দনকে দেখে এমনিতেই মুগ্ধ তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো। স্পন্দনের কলার চেপে ধরে বলল.…….
—” সাধনা আর আমার বাচ্চা কোথায়? ওদের যদি কিছু হয় তাহলে তোকে খুন করতে আমার হাত কাঁপবে না।”
শুভ্রতা স্পন্দনের কলার থেকে মুগ্ধর হাত ছাড়াতে ব্যাস্ত হয়ে পড়ল। রাগী গলায় বলল…..
—” আপনি কে আর আমার বোনের কথা বলছেন কেন?”
সাধনার বড় বোন হিসেবে শুভ্রতার কথা শুনে মুগ্ধ স্পন্দনের কলার ছেড়ে দিল নিচু স্বরে বলল……
—-” আমি মুগ্ধ, সাধনার হাসবেন্ড।”
শুভ্রতার কেন যেন মুগ্ধকে দেখে ভীষণ রাগ হলো। রাগের বশে মুগ্ধর গালে চড় বসিয়ে দিল। মুগ্ধ তবুও নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
—” আজ তোমার জন্যই আমার বোনের এত কষ্ট। বিয়ের আগে প্রেমের নাটক করে যা ভুল করেছো তার জন্য তো তোমাকে থানায় দেওয়া উচিত। লজ্জা করে না যাকে ভালোবাসো তাকে নিয়ে অন্যজনের সাথে অভিনয় করাতে। আচ্ছা জীবন কি খেলনা না-কি সিনেমা মনে হয় তোমার কাছে। সাধনা যখন প্রেগনেন্ট ছিল তখন বাচ্চা আর মাকে দিয়ে আরেকটি বাজে কাজ করাতে তোমার লজ্জা করলো না হাজার হোক বাচ্চাটি তোমার ছিল। তোমার একটি অংশকে দিয়ে এই রকম কু-কর্ম করাতে বুক কাঁপল না তোমার? তোমার মত জঘন্য লোককে কিভাবে যে আমার বোন ভালো বাসতে পারে বুঝতে পারি না আমি। তোমার কাছ থেকে পালিয়ে আসার পরেও তোমার কথা ভেবে সব সময় কান্না করে এমনকি খাওয়া দাওয়া ঠিক মত করে না।”
মুগ্ধর চোখ দিয়ে পানি ঝড়ছে। এতদিন সাধনা আর ওর বাচ্চাকে ছাড়া খুব কষ্টে সে থেকেছে। সাধনা পানিতে ঘুমের ওষুধের পরিমাণ খুব বেশিই দিয়েছিল যার ফলে তাকে কিছুদিন হসপিটালে থাকতে হয়েছে। মুগ্ধর ভাগ্য ভালো যেদিন এমন ঘটনা ঘটেছে সেদিন তার এক বন্ধু ও বন্ধুর বউকে বাড়িতে দাওয়াত দিয়েছিল। মুগ্ধের বন্ধু ও তার বউ যখন মুগ্ধের বাড়িতে আসে দেখে মেইন দরজা খুলা। তারা কিছুটা অবাক হয়ে উপরের ঘর গুলো চেক করতে গিয়ে দেখে মুগ্ধ অচেতন হয়ে বিছানায় শুয়ে আছে। তখন তারাই মুগ্ধকে হসপিটালে ভর্তি করে। পনেরো দিন পর্যন্ত আইসিউতে থাকে মুগ্ধ। জ্ঞান ফিরার পর থেকে সাধনা আর তার বাচ্চার অভাব অনুভব করে। কিন্তু লজ্জায় সাধনার সামনে আসতে চায় নি। নিজের স্বার্থের জন্য ভালোবাসার মানুষ ও সাথে অনাগত বাচ্চাকে ব্যাবহার করার জন্য প্রচন্ড লজ্জা ও ঘৃনা হচ্ছিল নিজের প্রতি। আগের ফোন ওই জঙ্গলের বাড়িতেই পরে থাকে সেই জন্য নিউ ফোন কিনে আগের আইডি লগ ইন করে। সাধনার আইডি অনেকদিন ধরে বন্ধ দেখাচ্ছে। হটাৎ কি মনে করে নিজের বিয়ের মিথ্যা পোষ্ট করে। যদি সাধনা এই পোষ্ট দেখে কিছু রিয়েক্ট করে তাহলে তো কথা বলার একটি সুযোগ সে পাবে। কিন্তু আজ সকালে ফজরের নামাজ পড়ে ফোন অন করে সে ভোরের সূর্য উঠা দেখছিল। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে যখন রুমে এসে ফোন হাতে নিয়ে সাধনার প্রোফাইলে প্রবেশ করে আর এমন একটি খারাপ খবর দেখে মাথা পুরো নষ্ট হয়ে যায় তার। সেই জন্য দ্রুত সম্ভব স্পন্দনের বাসায় আসে আর চিৎকার করে মুগ্ধ।
শুভ্রতা অনেক কিছু বলা সত্বেও মুগ্ধ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। এখন এই কথা গুলো স্পন্দন বললে হয়তো মারামারি হয়ে যেতো কিন্তু শুভ্রতা বলাই কিছু বলছে না মুগ্ধ।
—” উত্তর দেও ?”
—-” আপু সাধনা কোথায়?”
—” ওর রুমে হয়তো শুয়ে আছে।”
—” আপু মিথ্যা বলবেন না প্লিজ সাধনা কোথায়? আর এমন একটি নিউজ কে লিখেছে তাকে দেখতে চাই আমি।”
—” কি নিউজ?”
মুগ্ধ কিছু বলতে যাবে সাধনা তার রুম থেকে বের হয়ে বলল……
—” আমি লিখেছি এই পোষ্ট।”
এতদিন পর সাধনাকে দেখতে পেয়ে চোখের তৃপ্তি মিটাচ্ছে মুগ্ধ। সাধনার পেট কিছুটা ফুলেছে বাট চেহারার মাধুর্য অনেকটা রঙিন হয়েছে। বাচ্চা হওয়ার সময় হয়তো মেয়েরা মাতৃত্বের স্বাদের জন্য আগের থেকে দ্বিগুণ সুন্দর হয়।
—” কেমন আছো তুমি?”
সাধনা চোখ ফিরিয়ে অভিমানী সুরে বলল…..
—” নতুন বিয়ের দাওয়াত পাওয়ার জন্য খুবই ভালো আছি।”
—” এই রকম খারাপ পোষ্ট কেন লিখেছো তুমি? জানো আমি তো মারা যেতে পারতাম এই পোষ্ট দেখে তাই না?”
সাধনা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। মুগ্ধ স্পন্দনের সামনে কিছু বলছে না। শত্রুর সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে তার অস্বস্তি বোধ হচ্ছে। স্পন্দন শুভ্রতার কানে ফিসফিস করে বলল…….
—” সাধনাকে বলো মুগ্ধকে তার রুমে নিয়ে যেতে। তাদের মাঝে সমস্যা তারাই মিটমাট করুক। আমরা ওদের মাঝে কিছু বলবো না।”
—-” কিন্তু মুগ্ধ তো সাধনাকে……”
—-” যাই কিছু করুক মুগ্ধ সে কিন্তু সাধনাকে খুব ভালোবাসে। আজ যদি ভালো না বাসতো তাহলে কোনো কিছুর বিনিময়ে এইভাবে ছুটে আসত না। তাছাড়া মুগ্ধর চোখ গুলো দেখো মনে হচ্ছে সাধনাকে তার সামনে দেখতে পেয়ে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছে।'”
—-” মুগ্ধ কেন আপনার ক্ষতি করতে চায় জানতে চাইবেন না?”
—” এখন না জানতে পারলেও অবশ্যই পরে জানতে পারবো বাট এখন ওদের দুইজনের একত্রে কথা বলাটা আমাদের দুজনের কি এত শত্রুতা সেইটা থেকেও বেশি ইম্পর্টেন্ট। বুঝাতে পেরেছি আমি?”
শুভ্রতা মাথা হেলিয়ে বুঝাল সে বুঝতে পেরেছে। স্পন্দনের কথা অনুযায়ী সাধনাকে উদ্দেশ্য করে বলল…….
—” সাধনা মুগ্ধকে তোর রুমে নিয়ে যা। নিজেরা আলাদা ভাবে কথা বলে সমস্যার সমাধান কর। আর হুম আমি জানি তুই মুগ্ধকে খুব ভালোবাসিস যা নিয়ে যা।”
সাধনা মুখে কিছু না বললেও নিজের রুমের দিকে হাটা শুরু করলো পিছন পিছন মুগ্ধ যেতে লাগলো…….
স্পন্দন শুভ্রতার দিকে তাকিয়ে বলল……
—-” ওদের দুজনকে খুব মানিয়েছে তাই না শুভ্রতা?”
শুভ্রতা বার বার স্পন্দনের কথায় হারিয়ে যায়। আলাদা এক প্রকার ভালো লাগা সৃষ্টি হয়। মুগ্ধ তার কত ক্ষতি করতে চেয়েছে কিন্তু সে মুগ্ধকে কিছু বলল না বরং তার বাড়িতেই মুগ্ধর সমস্যা সমাধান করতে বলেছে। আসলেই মানুষটা অন্য রকম।
চলবে…….
বানান ভুল হলে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।