#আড়ালে_আবডালে
#পর্ব_৩৬
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
_____________________
ড্রয়িংরুমের সোফায় বসে গল্প করছে নিহি,তরু, আবুল আর টুকটুকি। রান্নাঘরের দায়িত্ব আজ আমানের। আজ বলতে এখন আরকি! বৃষ্টি হবে আর খিচুড়ি খাওয়া হবে না এটা তো হতে পারে না। বৃষ্টির দিনে গরম গরম খিচুড়ি সঙ্গে আচারের তেল! ইশ! জিহ্বায় পানি এসে যায়। খিচুড়ি রান্না করার দায়িত্ব আমানকে দিয়েছে নিহি। আবুল আর টুকটুকি সাহায্য করতে চাইলেও নিহি দেয়নি। একটা শাস্তি তার পাওয়া দরকার। করুক একা একা রান্না হুহ!
বৃষ্টির তেজ কখনো বাড়ছে আবার কখনো কমছে। এখন বৃষ্টির পরিমাণ মিডেলে আছে। মানে বেশিও নয় আবার কমও নয়। নিহির এক মন বলেছিল বৃষ্টিতে ভিজতে। কিন্তু আমানের জন্য সাহস হয়নি। নিহি যে খুব বাধ্য বউ তা কিন্তু নয়। আমানকে দিয়ে বিশ্বাস নেই। তার কথা না শুনলে দেখা যাবে সেও সঙ্গে বৃষ্টিতে ভিজবে। আর পরে জ্বরে বিছানায় পড়ে থাকবে। তার চেয়ে বরং না ভেজাই ভালো।
খিচুড়ির ঘ্রাণ পাওয়া যাচ্ছে এখানেই। আবুল উৎসুক ও আনন্দিত হয়ে নিহিকে বলে,
“আপামুনি আপনে খিচুড়ির ঘেরাণ (ঘ্রাণ) পাইতাছেন? আহা! খিদা মনে হয় আমারই বাইড়া গেছে।”
নিহির উত্তরের আগে টুকটুকি বলে,
“হ রে! আমিও ঘেরাণ (ঘ্রাণ) পাইতাছি।”
নিহি হেসে বলে,
“হুম পাচ্ছি। তোমাদের ভাইজান তাহলে রান্না পারে!”
“পারে মানে? ভাইজানের রান্না হাত চাইটা(চেটে) তো খাইতে মন চাইবই। পারলে মনে কয় পেলেট (প্লেট) চাইটা (চেটে) খাই।” একটু ভাব নিয়েই বলল আবুল।
টুকটুকি তখন আবুলকে মৃদু ধাক্কা দিয়ে বলে,
“জানেন না আপা এই ছেম্রায় দুনিয়ার খারাপ। পেলেট (প্লেট) চাইটাও খায়।”
তরু আর নিহি শব্দ করে হেসে ফেলে। আবুল আর টুকটুকির ঝগড়া লেগে যায়। নিহি ওদের থামিয়ে বলে,
“তোমরা না আমায় কথা দিয়েছিলে আর ঝগড়া করবে না?”
আবুল জিভ কেটে বলে,
“ভুল হইয়া গেছে আপামুনি। এতদিন কিন্তু ঝগড়া করি নাই। আপনের সামনে আইজ করলাম। আপনে যে ধমক দেন আমগো ভালো লাগে।”
টুকটুকিও তখন মাথা চুলকে বলে,
“আবুল কিন্তু ঠিক কইছে আপাজান।”
“বুঝলাম! আমাকে ছাড়া থাকতে কেমন লাগে তোমাদের?” বলতে বলতে নিহি রান্নাঘরে যায়।
ড্রয়িংরুম থেকে উত্তর আসে,
“ভালা লাগে না আপা। আপনে তাড়াতাড়ি আইসা পড়েন।”
নিহি কোনো উত্তর করল না। আমানের গা ঘেঁষে দাঁড়ালো। আমান সরলো না। জিজ্ঞেস করল,
“এখন কেউ দেখবে না?”
“কী দেখবে?” অবাক হয়ে জানতে চাইল নিহি।
“এইযে আমার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়েছ।”
“তো? আমি কি আর কিছু করেছি নাকি?”
“এহ্! করতে চাইলেই মনে হয় আমি এলাউ করব? কখনো না।”
“ঐ হ্যালো! পার্ট কম নেন ওকে?”
আমান নিহির মুখের সামনে একটু ঝুঁকে গিয়ে বলে,
“পার্ট নয় এটাই সত্যি।”
তারপর নিহির মুখে একটা ফুঁ দিয়ে আবার রান্নায় মনোযোগ দেয়। নিহি রাগে ফুলছে। হুট করেই আমানকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে। আমান মুচকি মুচকি হাসে। নিহিকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে না। নিহি তখন ভাব নিয়ে জিজ্ঞেস করে,
“একটু আগে কে যেন পার্ট নিয়ে কীসব বলল?”
আমান মুচকি মুচকি হাসতে হাসতে বলে,
“ঐসব না বললে কি এখন বউ কাছে এসে জড়িয়ে ধরত?”
সঙ্গে সঙ্গে নিহি তাকে ছেড়ে দেয়। আমান শব্দ করে হাসে। নিহি দাঁত কটমট করে বলে,
“আপনি খুব বাজে। খুব!”
“বউয়ের কাছে বাজে হলে কিছু হয় না।”
“আপনার মাথা!” বলে নিহি রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আসে।
.
.
বাড়িতে গিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছেন নিজাম ইসলাম। সালেহা বেগম চা নিয়ে আসেন। নিজাম ইসলাম চায়ে চুমুক দিয়ে বলেন,
“আমান ছেলেটাকে প্রথমে চিনতে না পারলেও এখন কিন্তু ওকে আমার বেশ লাগছে।”
সালেহা বেগম বিছানায় বসে বলেন,
“আগেই তো বলেছিলাম তোমায়। আমানকে আমারও খুব ভালো লাগে। আল্লাহ্ যা করেন ভালোর জন্যই করেন।”
“হ্যাঁ। অনলের সঙ্গে না জড়িয়ে ভালোই হয়েছে। ঐ ছেলের সঙ্গে রিলেশনে গেলে নিহি কখনোই সুখী হতো না। প্রতিশোধ পরায়ণ লোক কখনো ভালোবাসতে পারে না।”
“ওর জন্য তুমি নিহিকে কম কষ্ট দাওনি!”
“তা আমি মানি। মাথা ঠিক ছিল না। মেয়েটাকে দূরে রেখে আমি নিজেও ভালো নেই। বাড়িটা খুব ফাঁকা ফাঁকা লাগে।”
“মন খারাপ কোরো না। আর তো মাত্র এক বছরের মতো আছে। তারপর তো চলেই আসবে।”
“চলে আসলেই কী? আমান তো নিহিকে নিয়ে যেতে চাইবে।”
“তাহলে তুমি কী চাইছ? মেয়েকে সারাজীবন নিজের কাছে রেখে দেবে?”
এবার তিনি হাসলেন। চায়ের কাপ পাশের টেবিলের ওপর রেখে বলেন,
“তা তো আর সম্ভব নয়। মেয়ে হয়ে যখন জন্ম নিয়েছে, তখন পরের ঘরে তো যেতেই হবে। আমি ভাবছি, এই এক বছরের মাঝেই আমানের পরিবার সম্পর্কে খোঁজ-খবর নেব। আমানের সম্পর্কে খোঁজ নেওয়া শেষ। ওকে নিয়ে আমার মনে কোনো সন্দেহ নেই। খাঁটি সোনা আমান। এখন ওর পরিবার কেমন সেটাই জানতে হবে।”
“হ্যাঁ, তাই ভালো।”
___________________
চেয়ারে বসে টেবিলের ওপর পা উঠিয়ে মোবাইলের দিকে তাকিয়ে আছে অনল। নিহির অনেকগুলো ছবি কালেক্ট করেছে নিহির ক্লাসমেটদের কাছ থেকে। সেই ছবিগুলোই এখন দেখছে। উপমার আইডিতে গিয়েও নিহির কয়েকটা ছবি পেয়েছে। কলেজের প্রথম দিনের ছবি দেখে বুকের ভেতর ঢিপঢিপ ব্যথা শুরু হয়। সেই জামা, সেই চুল, সেই কাজলকালো চোখ। অনলকে ব্যাকুল করে তোলে! নবীনবরণ অনুষ্ঠানের শাড়ি পরা ছবিও আছে। হলুদিয়া পাখি যেন! থাপ্পড়ের কথাটা মনে পড়ে যায়। অদ্ভুত বিষয় হচ্ছে, আগে থাপ্পড়ের কথা মনে পড়লে যেমন রাগ হতো এখন রাগ হচ্ছে না। বরং ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি। এই হাসিতে আছে ভালোবাসা সঙ্গে বিষাদ। একটার পর একটা ছবি দেখছে আর নিহির স্মৃতিচারণ করছে।
আজমল আহমেদ অনলের ঘরে আসেন। অনল ফোনটা রেখে বাবার দিকে তাকায়। সে বিছানায় বসে জিজ্ঞেস করে,
“কী করছিলে?”
“কিছু না আব্বু। ফোন ঘাঁটছিলাম।”
“ফোনে কী করছিলে সেটাই জানতে চাচ্ছি।”
“তেমন কিছুই না আব্বু।” হেসে বলে অনল।
তিনি বলেন,
“আমি কিন্তু দেখেছি। তুমি একটা মেয়ের ছবি দেখছিলে। বলো দেখছিলে না?”
অনল লজ্জামিশ্রিত হেসে উপর-নিচ মাথা ঝাঁকায়। উনার ঠোঁটের হাসি চওড়া হয়। তিনি বলেন,
“কে মেয়েটা? ইরা?”
“না আব্বু! কিন্তু তুমি ইরার কথা জানো কীভাবে?”
“ছেলে রিলেশন করে। আর তার কথা আমার কানে আসবে না? তোমার সব খোঁজ-খবরই আমার কাছে থাকে। ব্রেকাপও করে ফেলেছ শুনলাম।”
“গোয়েন্দাগিরি করো না?”
“ছেলে দুষ্টু হলে বাবার তো একটু গোয়েন্দাগিরি করতেই হয়!”
অনল হেসে বলে,
“হুম, আমি তো আর ভাইয়ার মতো গুড বয় না।”
“কে বলল? অবশ্যই তুমি গুড বয়। তবে তুমি তোমার মতো। আর আমান আমানের মতো। আমার দুই ছেলেই হীরের টুকরা।”
“ভাইয়া হীরের টুকরা হতে পারে। কিন্তু আমি বোধ হয় নই!”
“এভাবে বলছো কেন আব্বু? তুমি কি কোনো বিষয় নিয়ে আপসেট?”
অনল হাসার চেষ্টা করে বলে,
“না আব্বু।”
“মিথ্যা বলবে না। কী লুকাচ্ছো বলো?”
“কী লুকাবো?”
“সেটাই তো আমি জানতে চাচ্ছি।”
অনল একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। কিছুক্ষণ মৌন থেকে বলে,
“আমার খোঁজ-খবর যখন রাখো তখন অবশ্যই নিহির কথাও শুনেছ?”
“কোন নিহি?”
“আমার পরিচিত জীবনে একটাই নিহি আব্বু!”
“যে মেয়েটা তোমায় লাইব্রেরিতে জড়িয়ে ধরেছিল?”
“ঐ নিহিই! সবাই এটাই জানে। কিন্তু আসলে সেদিন নিহি নয় বরং আমিই ওকে জড়িয়ে ধরেছিলাম।”
তিনি অবাক হয়ে প্রশ্ন করেন,
“তাহলে তুমি প্রিন্সিপ্যালের কাছে কেন মিথ্যা কথা বলেছ?”
“প্রতিশোধ! প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য।”
শুরু থেকে সবটা তাকে খুলে বলে অনল। সব শুনে তিনি আফসোস করে বলেন,
“সময় থাকতে কেন যে বোঝোনি!”
“এখন কি সময় নেই আব্বু?”
“একেবারে যে নেই তাও নয়। তবে এতকিছুর পরও নিহি তোমার কাছে ফিরে আসবে বলে মনে হয় না। আবার আসতেও পারে। আল্লাহ্ চাইলে কী-না সম্ভব বলো?”
“হুম।”
“আচ্ছা তুমি মন খারাপ কোরো না। আমি দেখি তোমার জন্য কিছু করতে পারি নাকি।”
“না আব্বু। তুমি কিছু করবে না। যা করার আমি করব।”
তিনি অনলের পিঠ চাপড়ে বলেন,
“আরে বাহ্! আচ্ছা ঠিকাছে ছবি তো দেখতে পারি?”
“অবশ্যই।”
অনল ফোন থেকে নিহির ছবি বের করে দেখায়। তিনি বলেন,
“মাশ-আল্লাহ্! আমার ছেলের পছন্দ আছে বলতে হয়।”
অনল হাসে। তারপর বলে,
“তুমি কিন্তু কাউকে বলবে না। মাকেও না।”
“তোমার মাকে বললে সমস্যা কী?”
“না! মাকে আমার ভয় করে।”
তিনি হেসে বলেন,
“আচ্ছা বলব না। এখন চলো।”
“কোথায়?”
“তোমার মা ভুনাখিচুড়ি রান্না করেছে। বৃষ্টির মধ্যে ভুনাখিচুড়ি খাওয়ার স্বাদ নিশ্চয়ই জানো?”
“অবশ্যই। ভাইয়া তো ভুনাখিচুড়ি খুব পছন্দ করে। দাঁড়াও একটা ফোন দেই। দেখি আসে নাকি!”
“দাও।”
.
.
আমান, নিহি, তরু, আবুল আর টুকটুকি সবাই একসঙ্গে টেবিলে খেতে বসেছে। আবুল আর টুকটুকি নিচে বসে খেতে চাইলেও ওরা কেউ শোনেনি। খিচুড়ির প্লেট সামনে নিয়ে নিহি ঘ্রাণ নেয়। বলে,
“একটু আচারের তেল হলে দারুণ হতো।”
আমান হেসে রান্নাঘরে চলে যায়। ফিরে আসে আচার নিয়ে। ছোট কাঁচের বৈয়ামে আম তেলের মাঝে ডুবানো। নিহি খুশিতে প্রায় লাফিয়ে উঠে বলে,
“ওয়াও! আপনিও আচারের তেল দিয়ে খান?”
“হুম। আমার খুব ফেভারিট। আম্মু বানিয়ে বানিয়ে পাঠিয়ে দেয়।”
“তাড়াতাড়ি দিন। আমার তো খিদে বেড়ে গিয়েছে।”
আমানের ফোন বাজছে। ফোন ঘরে। আচারের বৈয়াম টেবিলের ওপর রেখে ঘরে চলে যায় ফোন আনতে। অনল ফোন করেছে। ফোন লাউডে দিয়ে কথা বলতে বলতে ডাইনিংরুমে আসে। আচারের তেল নিয়ে খাওয়া শুরু করেছে নিহি। অনলের কণ্ঠস্বর শুনে খাবার গলা দিয়ে নামা বন্ধ হয়ে যায়। চুপচাপ ওদের কথোপকথন শুনতে থাকে। অনলের পাশ থেকে ওদের বাবা-মায়ের কথাও শুনতে পায়। আমান হেসে হেসে কথা বলছে। অনল লোভ দেখিয়ে বলে,
“খিচুড়িটা দারুণ হয়েছে ভাইয়া। সঙ্গে আমের আচারের তেল। খেতে চাইলে কিন্তু চলে আসতে পারো।”
আমান হেসে বলে,
“তুই খা। তাহলেই আমার পেট ভরবে।”
“মিস করবে কিন্তু বলে দিলাম।”
“মিস করব না। আমিও খিচুড়ি রান্না করেছি।”
আরো কিছুক্ষণ ওদের কথাবার্তা চলতে থাকে। আমান খেয়াল করে দেখে নিহি খাচ্ছে না। ইশারায় জিজ্ঞেস করে,
“কী হয়েছে? খাচ্ছো না কেন?”
“এমনি!” ঠোঁটে মেকি হাসি টেনে বলে নিহি।
আমান হাত ধুয়ে নিহির প্লেটটা নিজের সামনে নিয়ে আসে। তারপর খিচুড়ি তুলে নিহির মুখের সামনে ধরে। নিহি একবার উপস্থিত সকলের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়িয়ে বলে,
“খাব না!”
আমান চোখ পাকিয়ে তাকায়। তরু বলে,
“আরে খা। আমরা কিছু দেখব না।”
আমান পরে কথা বলবে বলে ফোন রেখে দেয়। নিহিকে জিজ্ঞেস করে,
“সমস্যা কী? রান্না ভালো হয়নি?”
“ভালো হয়েছে।”
“তাহলে খাচ্ছো না কেন?”
“এমনিই।”
“এমনি তো না। অবশ্যই কোনো কারণ আছে। কারণটা বলো।”
“আসলে… মানে আমার লজ্জা করে!”
আমান বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে তাকায়। নিহি ইতস্তত হয়ে বলে,
“কারো হাতে খেতে আরকি! আনইজি লাগে কেমন জানি।”
“কোনো রকম কথাই আমি শুনব না। কারো হাতে খাওয়ার অভ্যাস থাকুক বা না থাকুক আমার হাতে খাওয়ার অভ্যাস করো। যখন একেবারে আমার কাছে চলে আসবে তখন একবেলা করে হলেও আমার হাতেই খেতে হবে।”
নিহি লজ্জায় লাল হয়ে যায়। তরু, আবুল, টুকটুকি মুচকি মুচকি হাসছে। নিহি ভেবেই পায় না এই লোকের কি সামান্য লাজ-লজ্জাও নেই? ওদের সামনেই বলতে হবে? নিহির উপায় নেই। অল্প করে আমানের হাতে খায়। খেতে খেতেই হঠাৎ করে ঐ পিচ্চির কথা মনে পড়ে যায়। জিজ্ঞেস করে,
“আপনার ছোট কোনো কাজিন আছে?”
“না। আমার আব্বু ভাইদের মাঝে একাই। ফুপুর ছেলে-মেয়ে সবাই বড় বড়। মামা নেই। খালামনির ছেলে-মেয়েরাও বড়। একটা কলেজে পড়ে, আরেকটা ভার্সিটিতে।”
“স্কুলে পড়ে এমন কোনো কাজিন নেই?”
“না। কেন?”
“এমনিই জানতে ইচ্ছে হলো। যাদের বিয়ে হয়েছে তাদের ছেলে মেয়ে নেই?”
“আছে কয়েকটার। একজনের তো কিছুদিন আগে একটা মেয়ে হলো।”
“তাদের মধ্যে কেউ স্কুলে পড়ে?” উৎসুক হয়ে জানতে চাইল নিহি।
আমান নিহিকে পানি খাইয়ে দিতে দিতে বলল,
“আরে পাগলী না! ওরা সবাই অনেক ছোট ছোট। কাউকেই স্কুলে ভর্তি করানো হয়নি। কিন্তু তুমি এসব কেন জিজ্ঞেস করছো বলো তো? বাচ্চা লাগবে তোমার? লাগলে আমায় বলো। আমি রাজি।”
তরু, আবুল, টুকটুকি শব্দ করে হাসে। নিহি দাঁতমুখ খিঁচে বলে,
“আপনি আসলেই বদ লোক!”
আমান নিজেও হাসতে হাসতে অস্থির। নিহির সেদিকে মন নেই। সে ভাবছে অনলের সাথে তাহলে ঐ ছেলেটা কে? কেমন ভাই হয় চিঠির মালিক? আর এই চিঠির মালিকটাই বা কে! আমান, অনল নাকি অন্য কেউ?
চলবে….
#আড়ালে_আবডালে
#পর্ব_৩৭
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
____________________
অর্ধবৃত্ত চাঁদের আলো জানালা দিয়ে ঘরে প্রবেশ করে নিহির মুখমন্ডলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ছে। ভ্যাপসা গরম লাগছিল বলে জানালা খুলেই রেখেছিল। তার পাশে তরু ঘুমিয়ে আছে। আমান অন্য ঘরে। নিহির চোখের পাতায় ঘুম নেই। বারবার প্রশ্নরা কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে তাকে। এই চিঠির মালিক তবে অনলই? অনল কেন আমায় এত ভালোবাসাময় চিঠিগুলো পাঠাবে? যন্ত্রণায় মাথার রগ দপদপ করছে। এত টেনশন আর নেওয়া যাচ্ছে না। এদিকে ঘুমেরও দাম বেড়েছে আজ। ধরাই দিতে চাচ্ছে না। একবার ভাবলো আমানকে ডেকে তুলবে। আরেকবার ভাবলো, থাক! দরকার নেই। সকালে আবার অফিস আছে তার। এপাশ-ওপাশ করতে করতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে টেরও পায়নি।
.
.
সকাল ১০টা
রাতে ভ্যাপসা গরম ছিল। আর আজ ভোর থেকেই মুষলধারায় বৃষ্টি হচ্ছে। ছাতা মাথায় অনল কলেজ ক্যাম্পাসে আসে। শার্টের বিভিন্ন অংশ বৃষ্টির ছাঁটে ভিজেও গেছে। ভেজা হাত দিয়ে চুলের ফাঁকে হাত বুলিয়ে চুলগুলো ঠিক করে নিলো। মিলন আর সাকিব আগে থেকেই ক্যাম্পাসে ছিল। অনলকে দেখে মনে হচ্ছে মন আজ বেশ ফুরফুরে। প্রায় সময়ই যেখানে চিন্তিত দেখাতো সেখানে আজ এত হাসিখুশি? ভাব্বার বিষয়! কৌতুহল নিয়ে সাকিব জিজ্ঞেস করল,
“আজকে মন ভালো?”
অনল মৃদু হাসলো। কিছুক্ষণ মুচকি হেসে বলল,
“মন খারাপ থাকে কবে?”
“এ কয়দিন একটু অন্যরকমই ছিল মনে হচ্ছে।”
“তেমন কিছু না। বাদ দে। চল ক্যান্টিনে যাই।”
ওরা আর কেউ অনলকে ঘাঁটালো না। ক্যান্টিনে গিয়ে তিনজন বসতেই সুমাইয়া আর লিসাও চলে আসে। সবার জন্যই কফি অর্ডার করা হয়েছে। ক্যান্টিনের প্রতিটা আনাচে কানাচে তাকাচ্ছে অনল। কত স্মৃতি এখানে! নিহির স্মৃতি। কত ঝগড়া, কত খুনসুটি হয়েছে এখানে। আনমনেই অনল হেসে ফেলল। নিহিকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু তা তো এখন সম্ভব নয়। নিহির স্মৃতিকে আঁকড়ে ধরেই মনের তেষ্টা মেটায় সে।
আজ সকালে উঠে ফজরের নামাজ আদায় করেছে অনল। প্রার্থনায় মন থেকে চেয়েছে নিহিকে। কেউ যদি নিহিকে ফিরিয়ে দিতে পারে তাহলে সে একজনই। আল্লাহ্! তিনি ব্যতীত আর কেউ এই কাজ পারবে না। তার কাছে কোনো কিছুই অসম্ভব নয়। অনলের মনে যদি প্রতিশোধের নেশা, ক্রোধ, অহংকার দূর করে ভালোবাসার বীজ বপন করতে পারে তাহলে নিহিকে কেন ফিরিয়ে দিতে পারবে না? অবশ্যই পারবে। অনলের সেই বিশ্বাস আছে। নামাজ পড়ে আল্লাহ্-র কাছে নিহিকে চাওয়ার পর থেকে বুকের ওপর থেকে একটা ভার নামতে আরম্ভ করেছে। মন-মেজাজ এজন্যই সকাল থেকে এত ভালো। প্রশান্তি লাগছে খুব!
.
শিশিরের সঙ্গে তরুর ঝগড়া হয়েছে। ঝগড়াটা লেগেছে সকালের দিকে। রাগ করে ফোনও অফ করে রেখেছে তরু। এদিকে আবার কান্নাকাটি করে যা তা অবস্থা। বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে বালিশে মুখ গুঁজে সেই যে কেঁদে চলেছে থামার কোনো নামই নেই। নিহি কতকিছু বলল, কতবার বুঝালো। কে শোনে কার কথা! তরুকে কিছুক্ষণ একা থাকতে দিয়ে সে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ালো। টুৃকটুকি রান্না করছে। নিহিকে দেখে একগাল হেসে জিজ্ঞেস করে,
“কেমন আছেন আপাজান? ঘুম কখন ভাঙছে?”
“আলহামদুলিল্লাহ্ ভালো আছি। উঠেছি আরো আগেই। আবুল ভাই কোথায়?”
“বাজারে গেছে।”
“এই বৃষ্টির মধ্যে?”
“হ। ভাইজান না করছিল। তাও শুনে নাই।”
“ওহ। আচ্ছা কী কাজ বাকি আছে বলো। আমি তোমায় সাহায্য করছি।”
টুকটুকি বাঁধা দিয়ে বলে,
“না, না আপাজান। আপনের কুনো কাম করা লাগব না। এতদিন পরে আইছেন। আপনে ঘরে যান।”
“এতদিন পরে এসেছি তো কী হয়েছে? তুমি বলো কী করতে হবে?”
টুকটুকি নিহির কোনো কথাই শুনলো না। কোনো কাজও নিহিকে করতে দিল না। অগত্যা নিহিকে রান্নাঘর থেকে বের হতে হলো। ঘরে একবার উঁকি দিয়ে দেখল তরু এখনো কাঁদছে। মেয়েটা যে এত ছিঁচকাঁদুনে! কী হয়েছে জিজ্ঞেস করলে আরো বেশি কাঁদবে। তারচেয়ে বরং কান্না থামুক আগে।এ ঘর থেকে বেরিয়ে সে আমানের ঘরে গেল। আমান তখন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে হাত দিয়ে চুল ঝাড়ছিল। আয়নাতেই নিহিকে দেখে সেই ভুবনজয়ী হাসিটা দেয়। উত্তরে নিহিও হাসি উপহার দেয়। আমান বলে,
“নিহুপাখির এতক্ষণে বুঝি আসার সময় হলো?”
“ইচ্ছে করেই এতক্ষণ আসিনি।”
আমান নিহির দিকে ঘুরে প্রশ্ন করল,
“কেন?”
“কারণ আপনি একটা বদ লোক।”
আমান হাসলো। বিছানার ওপর থেকে টাই নিয়ে জিজ্ঞেস করল,
“টাই বেঁধে দিতে পারো?”
“ফাঁস লাগাতে পারি।”
“তাহলে ফাঁস লাগিয়েই দাও।” টাই-টা নিহির দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল আমান।
নিহি গলায় ফাঁস লাগিয়ে দিল না। বরং সুন্দর করে টাই পরিয়ে দিল। আমান টাই ঠিক করতে করতে বলল,
“আমার বউয়ের অনেক গুণ।”
“সামান্য টাই বাঁধাও গুণ?”
“এটাই বা ক’জন পারে।”
“সবাইকে সব পারতে হবে নাকি?”
“এজন্যই বলেছি আমার বউয়ের অনেক গুণ।”
“এত গুণও নেই।”
“যা আছে আমি তাতেই সন্তুষ্ট।”
“হয়েছে।”
আমান আর কিছু বলল না। নিহির দিকে এক পা, দু পা করে এগিয়ে গেল। নিহি যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল সেখানেই ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। নিহির দু’গালে হাত রেখে কপালে চুমু খেল আমান। গালে স্লাইড করতে করতে বলল,
“নিজের খেয়াল রেখো। আমি অফিসে যাচ্ছি।”
“খেয়ে যাবেন না?”
“না। সময় নেই। আর্জেন্ট মিটিং আছে। অফিসে গিয়ে খেয়ে নেব।”
“আচ্ছা। সাবধানে যাবেন।”
আমান চলে যাওয়ার পর সকালের নাস্তা খেয়ে নিহি তরুকে নিয়ে মিহির বাসায় গেল। সৈকত আর মিহি তখন নাস্তা করছিল। ওদেরকে দেখে সৈকত খেতে খেতে বলল,
“এত দেরি করে আসলে কেন? খেতে বসো।”
“আমরা খেয়েই এসেছি।” বলল নিহি।
তরু ঘরে চলে গেল। সৈকতের খাওয়া প্রায় শেষ। তখন মিহি বলল,
“বার্গার নিয়ে এসো তো লাঞ্চে।”
“লাঞ্চে আমি না-ও আসতে পারি।”
তরুর বার্গার খুব প্রিয়। একেই তো মন খারাপ করে বসে আছে। বার্গার পেলে মন ভালো হতেও পারে। নিহি তখন ফট করে বলল,
“দুলাভাই আমাকে সাথে করে নিয়ে যান। বার্গার কিনে আমার কাছে দিয়েন।”
“না। বৃষ্টির মধ্যে তোর কোথাও যাওয়ার দরকার নেই।” বলল মিহি।
নিহি বায়না ধরল যাবে মানে যাবেই। তাছাড়া এখন বৃষ্টি তেমন নেই। গুড়িগুড়ি বৃষ্টি পড়ছে। মিহির নাকচ শুনতে অবাধ্যতা পোষণ করল বরাবরের মতো। শেষমেশ সৈকত নিয়ে যেতে বাধ্য হলো। রেষ্টুরেন্টে গিয়ে বার্গার পার্সেল করে নিলো। বাড়ি থেকে আসতে আসতে বৃষ্টি বেড়েছে আবার। নিহিকে একটা রিক্সায় উঠিয়ে দিয়ে সৈকত বলল,
“সাবধানে যাবে। বাড়িতে গিয়ে আমায় ফোন দেবে।”
“আচ্ছা ভাইয়া। আপনিও সাবধানে যাবেন।”
ভাঙা গর্তমত রাস্তায় বৃষ্টির কাদাপানিতে ভরে গেছে। কোথায় সমতল আর কোথায় ঢাল কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। বৃষ্টির গতি বেড়েছে। বড় বড় ফোঁটা নিহির মুখে আছড়ে পড়ছে। পায়ের ওপর থাকা নীল পলিথিনের কাগজটা দমকা বাতাসের চোটে উড়ে যেতে চাচ্ছে। ধীরে ধীরে বৃষ্টি যেমন বাড়ছে সেই সঙ্গে বাড়ছে বাতাস। একহাতে বার্গার আর ছাতা,পার্স, আর অন্য হাতে পায়ের ওপর থাকা পলিথিন ধরে রেখেছে। এখন মনে হচ্ছে বাড়ি থেকে বের হওয়াটা আসলেই ভুল হয়েছে।
বিপদের ওপর আরো এক বিপদ হলো। রিক্সার চাকা পাংচার হয়ে গেছে। রাগে শরীর কাঁপছে নাকি শীতে তা নিহি বুঝতে পারছে না। মাঝরাস্তা তার মধ্যে আবার বৃষ্টি! এখন তো গাড়িও পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। রাগে বিড়বিড় করতে করতে রিক্সা থেকে নেমে ফুটপাত দিয়ে হাঁটা শুরু করল। বৃষ্টির যেই জোর! ছাতা প্রায় উড়ে গেল বলে। এই টুকুন ছাতা তো বাতাস যখন তখন উড়িয়ে নিয়ে যাবে। শরীরও ভিজে প্রায় জপজপে হয়ে গেছে। রাস্তার ধারে একটা ছাউনির নিচে আশ্রয় নিতে হলো। শীতে কাঁপুনী ধরে গেছে।
ঐ রাস্তা দিয়েই বাড়ি ফিরছিল অনল। নিহিকে এক পলক দেখে বুকের মাঝে তোলপাড় শুরু হয়ে যায়। মনের মাঝে প্রশ্ন জাগে নিহি এখানে কী করে আসবে? এটা কী মনের ভুল? নাকি বৃষ্টির মধ্যে নিহির মতোই কাউকে দেখে নিহি ভাবলো? মন বলছে এটা নিহিই। রিক্সাওয়ালাকে রিক্সা থামাতে বলল সে। ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে গুটি গুটি কদমে এগিয়ে এলো ছাউনির দিকে। নিহি অন্যদিকে মুখ করে তাকিয়ে ছিল। তাই অনলকে দেখতে পায়নি। ছাউনির নিচে দাঁড়িয়ে স্পষ্ট নিহিকে দেখে হৃৎপিণ্ড কেঁপে ওঠে। গলা দিয়ে কোনো কথাও বের হচ্ছে না। আবেগে পুরো শরীর শিরশির করছে। অজানা অনুভূতি তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে। অস্পষ্ট স্বরে ডাকে, ‘নিহি!’
নিহি চমকে পেছনে তাকায়। অনলকে দেখে অবাক হয়। তার সেকি করুণ গলার স্বর! করুণ মুখ! নিহি ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকে। অনল খুশিতে প্রায় আত্মহারা। মনে মনে আল্লাহ্-র শুকরিয়া আদায় করছে। খুব সন্তুষ্ট ও আল্লাহ্-র ওপর। চোখ দুটো পানিতে চিকচিক করে ওঠে। এত আবেগ এতদিন কোথায় ছিল? অনল প্রশ্ন করে,
“তুমি এখানে?”
নিহি কোনো উত্তর দিল না। ছাতা ফুটালো চলে যাওয়ার জন্য। অনল ব্যস্ত হয়ে বলল,
“প্লিজ আমার কথা শোনো। একটু কথা বলো।”
নিহির কাঠখোট্টা উত্তর,
“আপনার সঙ্গে আমার কোনো কথা নেই।”
“কিন্তু আমার কথা যে তোমাকে শুনতেই হবে।”
“জোর খাটাচ্ছেন? নাকি থ্রেড করছেন কোনটা?”
“কোনোটাই না। তুমিই তো বলেছিল, এরপরের বার যখন আমাদের দেখা হবে তখন নাকি আল্লাহ্-র ইচ্ছেতেই হবে। দেখো আজ তো তাই হলো।”
নিহি কিছু সময়ের জন্য চুপসে গেল। সে তো এইদিনের জন্য অপেক্ষা করতে বলেনি। আমানের সঙ্গে নিহিকে দেখবে এমনটাই তো চেয়েছিল নিহি। তবে আজ কেন সব উল্টো হলো? এমনটা তো হওয়ার কথা ছিল না।
“নিহি চুপ করে থেকো না। একটু কথা বলো। আমি ভুল করেছি। আমায় ক্ষমা করে দাও। একটা সুযোগ আমায় তুমি দাও।”
অনলের এলোমেলো কথার আকুতি-মিনতি নিহিকে বিব্রত করে তুলছে। কড়া কথা শুনাতে গিয়েও পারছে না। তাই সে জায়গা প্রস্থান করে। ছাতা মাথায় দিয়ে হাঁটতে থাকে। পেছন পেছন অনলও আসে। ওর কাছে ছাতা নেই। বৃষ্টিতে ভিজছে আর নিহিকে থামানোর চেষ্টা করছে। এক পর্যায়ে অনল নিহির হাত টেনে ধরে। নিহি ক্ষেপে গিয়ে চেঁচিয়ে বলে,
“কোন সাহসে আপনি আমার হাত ধরেন? হাত ছাড়েন আমার!”
বৃষ্টির প্রবল বেগের শব্দের সাথে নিহির চিৎকার মিলিয়ে যায়। রাস্তায় মানুষজনও নেই তেমন। যারা আছে সবাই গাড়িতে অবস্থানরত। তারমধ্যে মাঝরাস্তা। অনল এখনো হাত ছাড়েনি। নিহি হাত ছাড়ানোর জন্য ব্যর্থ চেষ্টা করছে। অনল অনুরোধের স্বরে বলে,
“প্লিজ আমার কথা শোনো!”
“আপনার কোনো কথা আমি শুনতে চাই না।”
অনল হাত ছেড়ে দিলো। নিহিকে অবাক করে দিয়ে ওর পা প্যাঁচিয়ে ধরল। অনল কাঁদছে! নিহি অবাকের চরম সীমানায় পৌঁছে গেছে। অনল কাঁদতে কাঁদতে বলে,
“আমায় ক্ষমা করে দাও নিহি। আমায় ক্ষমা করে দাও।”
রাস্তা ফাঁকা থাকলেও কিছু উৎসুক লোক এবার দূর থেকে এদিকেই এগিয়ে আসছে। নিহি অনলকে সরানোর জন্য চেষ্টা করছে। “কী করছেন আপনি? পা ছাড়েন।”
“তুমি আমায় ক্ষমা করো আগে। আমায় সুযোগ দাও।”
জোর জবরদস্তি করতে গিয়ে নিহি অনলকে ধাক্কা মারে। অনল রাস্তায় ছিটকে পড়ে। তখনই বাঁকা রাস্তা থেকে আসে একটা সিএনজি। কিছু বুঝে উঠার আগেই অনলকে ধাক্কা দিয়ে আরো দূরে সরিয়ে দেয়। লোকজন এবার ছুটে আসতে শুরু করে। ড্রাইভারও বুঝতে পারেনি কী থেকে কী হয়ে গেল। আপাত দৃষ্টিতে দেখতে গেলে তার কোনো দোষও নেই। নিহির পা চলছে না। অনলের রক্তাক্ত দেহ রাস্তায় পড়ে আছে। ব্যথায় ছটফট করছে অনল। উঠে বসার চেষ্টা করছে। সিএনজিওয়ালা সিএনজি থেকে নেমে এসে অনলকে ধরে বসায়। অনল এবার দাঁড়ানোর চেষ্টা করে। নিহির কাছে আসতে চায়। মাথা ফেঁটে গলগল করে রক্ত পড়ছে কপাল বেয়ে। চোখমুখ রক্তে মাখামাখি। বৃষ্টির পানি রক্ত যতই ধুয়ে দিচ্ছে ততই রক্ত যেন পাল্লা দিয়ে পড়ছে। হাতেও রক্ত। নিহি মুখে হাত দিয়ে বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে। চোখে পানি উপচে পড়ছে। অনল রক্তাক্ত হাত নিহির দিকে বাড়িয়ে আছে। লোকজন ছুটে এসে অনলের কাছে জড়ো হয়েছে। কয়েকজন বিশ্রী ভাষায় গালাগাল দিচ্ছে ড্রাইভারকে। নিহি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না। দৌঁড়ে গেল অনলের কাছে। নিহিকে কাছে পেয়ে যেন প্রাণ ফিরে পেল অনল। রক্তাক্ত হাতে নিহির এক হাত শক্ত করে ধরার চেষ্টা করল। একজন লোক বলল,
“আপনি কি উনাকে চিনেন?”
নিহির কান্না পাচ্ছে। কথা বলতে পারছে না। ঠোঁট কামড়ে শুধু উপরনিচ মাথা ঝাঁকায় তারপর বলে,
“ওকে হাসপাতালে নেওয়ার ব্যবস্থা করুন প্লিজ!”
অনল আহতস্বরে বলে,
“আমায় ক্ষমা করো নিহি! আমাকে ছেড়ে যেও না।”
সবাই ধরাধরি করে ঐ সিএনজিতেই অনলকে উঠালো। নিহি বসলো অনলের এক পাশে। অন্যপাশে একজন অপরিচিত লোক। একটা ছেলে এসে নিহির পার্স দিয়ে গেল। খাবার, ছাতা কাদাপানিতে পড়ে শেষ! অনল বারবার বিলাপ করছে, ‘আমায় ছেড়ে যেও না। মাফ করো, মাফ করো!’
কাছেই একটা হাসপাতালে তাকে নেওয়া হলো। এখনো নিহির হাত ছাড়েনি। ট্রিটমেন্টের জন্য যখন অনলকে নিয়ে যেতে আসলো নার্স তখন অনল বাঁধা দিলো। নিহিকে রেখে কিছুতেই যাবে না। উপায় না পেয়ে ডাক্তার নিহিকেও ভেতরে আসতে এলাউ করল। অনলের এমন রক্তাক্ত অবস্থা নিহি দেখতে পারছে না। অসহায় অসহায় লাগছে খুব। ডাক্তার জানালো, মাথার একপাশে ফেঁটে রক্ত বের হয়েছে খুব। আর হাতে কেটেছে। তাছাড়া তেমন কোনো ক্ষতি হয়নি। ড্রাইভার ব্রেক করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু সেই চেষ্টা করতে করতেই অনলের পাশ দিয়ে ধাক্কা দিয়ে যায়। এজন্যই তেমন বিরাট কোনো ক্ষতি হয়নি। মনে মনে আল্লাহ্-র কাছ শুকরিয়া জানায় নিহি। অন্যদিকে অনলের এই অবস্থার জন্য নিজেকেই দায়ী করে। কান্না আর আটকে রাখতে পারছে না। কী করবে তাও ভেবে পাচ্ছে না।
করিডোরের শেষ মাথায় এসে কাদামাখা পার্স থেকে ফোন বের করে উপমাকে ফোন দিলো। ফোন তুলছে না সে। হয়তো ক্লাসে আছে এখন। দু’বার রিং হয়েও কেটে গেল। উপমার টেক্সট আসে।
“আমি ক্লাসে আছি রে।”
নিহিও এবার টেক্সট করে,
“অনলদের ক্লাসে যা একটু। ওর বন্ধুরা কেউ না কেউ তো থাকবেই। তাদেরকে তাড়াতাড়ি মডার্ণ হাসপাতালে আসতে বল। আর কোনো প্রশ্ন করিস না। আমি পরে সব বলব। তাড়াতাড়ি যা প্লিজ!”
নিহির টেক্সট দেখে উপমার ভয় করছে। কী হলো হঠাৎ? ক্লাস টিচারের কাছে বলে অনলের ক্লাসে গেল। অনল বাদে বাকি সবাই আছে। ক্লাসে স্যারও ছিল। উপমা জানালো সে সুমাইয়ার সঙ্গে কথা বলবে। সুমাইয়া ক্লাসের বাইরে আসার পর উপমা নিহির টেক্সট দেখালো। অজানা আশঙ্কায় ভয় হতে লাগল সুমাইয়ার।
.
হাসপাতাল থেকে বেশ কিছুটা দূরে একটা পাম্প রয়েছে। নিহি হাসপাতালের বিল মিটিয়ে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চলে এসেছে এতদূর।বসার মতো জায়গায় গিয়ে পা তুলে বসে রইল। জায়গাটা ভেজা। নিহির শরীরও ভেজা। সঙ্গে জামা-কাপড়ে লেগে আছে রক্ত। কষ্টে বুকটা ভারী হয়ে আছে। হেঁচকি তুলে কাঁদে সে। এত কষ্ট কেন হচ্ছে! অনলের জন্য কষ্ট হচ্ছে? অনলের প্রতি মায়া হচ্ছে! নিহি মানতে পারছে না এসব। সহ্য হচ্ছে না। আমানকে দরকার এখন। যে করেই হোক এখন আমানকে লাগবে। আমানকে ফোন করে নিহি। ফোন কেটে দিয়ে ব্যাক করে নিরব। নিহি কান্নামিশ্রিত কণ্ঠে বলে,
“আপনি তাড়াতাড়ি আসুন!”
নিহির কণ্ঠ শুনে নিরব ভড়কে যায়। বলে,
“ম্যাম আমি নিরব। আপনার কী হয়েছে? কাঁদছেন কেন আপনি?”
কাঁদতে কাঁদতেই নিহি বলে,
“আপনার স্যার কোথায়? মডার্ণ হাসপাতালের কাছে যে পাম্প আছে সেখানে এক্ষুণী আসতে বলুন।”
আর কিছু না বলে নিহি ফোন কেটে দিল। ডুকরে কেঁদে ওঠে একটুপর পর। আমান তখন মিটিং-এ ছিল। মিটিং এ গিয়েই নিরব আমানকে ডেকে সব বলে। সেদিনের মতো মিটিং ক্যান্সেল করে তৎক্ষণাৎ গাড়ি নিয়ে চলে আসে আমান। নিহির কোনো অঘটন হলো নাকি ভেবে গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে তার।
.
গাড়ি পার্কিং না করেই আমান দৌঁড়ে গেল নিহির কাছে। হাঁটুতে মুখ গুজে রেখে কাঁদছিল। সে নিহির কাঁধে হাত রেখে জিজ্ঞেস করে,
“কী হয়েছে নিহু? এই অবস্থা কেন তোমার?”
আমানকে দেখে সঙ্গে সঙ্গে তার বুকে ঝাপিয়ে পড়ে নিহি। হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে। আমান শক্ত করে ধরে রাখে। নিহির শরীর সাংঘাতিক রকমের গরম। জামা-কাপড়ে রক্ত দেখে অস্থির হয়ে পড়ে সে। নিহির দু’গালে হাত রেখে বলে,
“কী হয়েছে নিহু? বলো? কী হয়েছে জান? তুমি ঠিক আছো? তোমার গায়ে রক্ত কেন? এই? নিহু!”
কান্নায় কোনো কথাই বলতে পারছে না নিহি। আমান আর কথা না বাড়িয়ে নিহিকে কোলে করে গাড়িতে বসালো। তারপর নিজে ড্রাইভিং সিটে বসে ড্রাইভ করে বাসায় নিয়ে আসলো নিহিকে। বাসায় আনতে আনতে নিহি সেন্সলেস হয়ে যায়। একটানা কতক্ষণ বৃষ্টিতে ভিজেছে কে জানে! নিহির এমন অবস্থা দেখে আবুল আর টুকটুকিও চমকে যায়। শতশত প্রশ্ন করে আমানকে। সে কোনো উত্তর না দিয়ে থ্রি-পিছ টুকটুকির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,
“নিহুর জামাকাপড় দ্রুত পাল্টে দাও।”
টুকটুকিকে ঘরে রেখে আমান আর আবুল ড্রয়িংরুমে আসে। আমান আবুলকে ডাক্তার আনতে পাঠিয়ে পায়চারি করতে থাকে। মিনিট পাঁচেক পর টুকটুকি দরজা খুলে দেয়। আমান জিজ্ঞেস করে,
“হয়ে গেছে?”
“হ ভাইজান।”
“এখন যাও ফ্রিজ থেকে দুধ বের করে গরম করো। আর ডিম সিদ্ধ করো।”
“আচ্ছা।”
আমান ভেতরে গিয়ে একটা ছোট্ট বোলে পানি নেয়। ছোট একটা কাপড় পানিতে ভিজিয়ে নিহির শরীর মুছে দেয়। তার হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে ঘষে ঘষে উষ্ণ করে দেয়। হাত দিয়ে নিহির পায়ের তালুতে ঘষতে থাকে। মিহিকে খবর দেয়নি আগেই। কী হয়েছে নিহির মুখ থেকে শুনবে। অন্যদিকে মিহি কতবার যে নিহিকে ফোন করেছে তার কোনো ইয়ত্তা নেই। শেষমেশ চিন্তায় পড়ে আমানকে ফোন করেছে। আমান বলেছে নিহি ওর সাথেই আছে। আরো কিছু কথা বলে বিষয়টা হ্যান্ডেল করে নিয়েছে।
আবুল ডাক্তার নিয়ে আসে। ডাক্তার এসে নিহির জ্ঞান ফেরায়। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ওষুধ দিয়ে যায়। আমানের চিন্তা হচ্ছে এখনো। নিহির কী হয়েছে হঠাৎ!
_________________
ঘুমের ইঞ্জেকশন দিয়ে এতক্ষণ ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছিল অনলকে। ঘুম ভাঙার পর কেবিনে দেখতে পায় বন্ধুদের। চোখদুটো ঝাপসা হয়ে আসছে। মাথায় যন্ত্রণা হচ্ছে প্রচুর। মাথা দু’হাতে চেপে ধরে বেডে উঠে বসে। সাকিব সাহায্য করে বসতে। অনল ভাঙা ভাঙা গলায় প্রশ্ন করে,
“নিহি কোথায়?”
সকলে নিশ্চুপ। সুমাইয়া বলে,
“আমরা এসে নিহিকে পাইনি।”
অনল মাথা নত করে কিছুক্ষণ বসে থাকে ঝিম মেরে। তারপর নেমে দাঁড়ায়। মিলন আর সাকিব অনলকে চেপে ধরে বলে,
“কোথায় যাচ্ছিস তুই? আমি ম্যামকে ফোন করেছি। সে আসুক।”
অনলের গায়ে শক্তি নেই বললেই চলে। শরীর দুর্বল অনেক। তবুও মনের জোর অপ্রতিরোধ্য। নিহির কাছে যাওয়ার আকুলতা সব দুর্বলতাকে একপাশে রেখেছে। আনমনেই বিড়বিড় করে আর বলে, ‘নিহির কাছে যাব! নিহির কাছে যাব।’
এই মুহূর্তে সকলেরই অনলকে পাগল মনে হচ্ছে। পাগলের মতো প্রলাপ বকছে সে। আল্লাহ্-র ইচ্ছেতেই দুজনের অজান্তে ওদের দেখা হয়েছে। নিহি তো এটাই বলেছিল। তার মানে আল্লাহ্ অনলের দোয়া কবুল করেছে। অনলের প্রলাপ বাড়ছে। কারো বাঁধা মানতে সে নারাজ। সে এক্ষুণী যাবে নিহির বাসায়। উপায় না দেখে মিলন আর সাকিবও ওর সঙ্গে যায়। সুমাইয়া আর লিসা হাসপাতালেই অপেক্ষা করে অনামিকা ম্যামের জন্য।
.
নিহির বাড়ির দরজার কাছে এসে কলিংবেল বাজায় সাকিব। অনলের অস্থিরতা বাড়ছে। পাগলের মতো আচরণ শুরু করেছে। এরকম পাগলের মতো ভালোবাসা প্রকাশ করছে। তাও অনল! এটা কারোরই বিশ্বাস হচ্ছে না। এতই যখন ভালোবাসা তাহলে কেন বুঝল না প্রথমে? কেন তখন ভালোবাসাকে পায়ে পিষে মেরেছে?
দরজা খুলে দিল তমা। অনলের হাতে, মাথায় ব্যান্ডেজ। গায়ে কাদা ও রক্ত মাখা জামা-কাপড়। তমাকে অবাক হতেই হলো। এর আগে কখনো অনলকে দেখেনি বলে চিনতেও পারল না।অনল ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করে,
“নিহি কোথায়?”
“আপনারা কারা?” অপ্রস্তুত হয়ে জিজ্ঞেস করল তমা।
সাকিব অনলকে থামিয়ে বলে,
“আমরা নিহির আগের কলেজ থেকে এসেছি।”
তারপর অনলকে দেখিয়ে বলল,
“ওকে আপনার চেনার কথা। ও অনল।”
তমার মুখের ভঙ্গি মুহূর্তেই বদলে গেল। চোখমুখ কঠিন করে বলল,
“উনার এই অবস্থা কেন? আর এখানেই বা কেন এসেছে?”
অনল অধৈর্য হয়ে পড়ে। তমাকে সরিয়ে ভেতরে চলে যায়। নিহির নাম ধরে ডাকতে থাকে। তমা বাঁধা দেওয়ার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়ে বলে,
“নিহি বাড়িতে নেই।”
“মিথ্যে কথা। নিহি এখানেই আছে।”
প্রতিটা জায়গায় অনল খুঁজতে থাকে। কথা বলার শব্দ পেয়ে ঘর থেকে নিজাম ইসলাম ও সাহেলা বেগমও বেরিয়ে আসেন। অনলকে এই অবস্থায় দেখে যেমন অবাক হয় তেমন বিরক্তও হয়। বিরক্তমুখে নিজাম ইসলাম বলেন,
“তুমি নিহিকে কেন খুঁজছ?”
অনল তার সামনে এসে ফ্লোরে বসে পড়ে। হাত জোর করে বলে,
“প্লিজ আঙ্কেল নিহির সঙ্গে আমায় দেখা করতে দিন।”
“অদ্ভুত তো! কলেজের সুপার ক্রাশ বয়, যার এটিটিউড আকাশসম সে এসে আমার সামনে হাত জড়ো করছে? তাও কীনা ঐ মেয়ের জন্য, যাকে সে পুরো কলেজ এবং তার পরিবারের সামনে অপদস্থ করেছে!”
“আমি মানছি আমার ভুল। আমার একটা ভুলকে আপনারা কেন ক্ষমা করতে পারছেন না? কেন আমায় একটা সুযোগ দিচ্ছেন না?”
অনলের গলা ধরে আসে। নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,
“একবার নিহিকে আমার সামনে আনুন।”
“নিহি বাড়িতে নেই।”
“মিথ্যে কেন বলছেন?”
“তোমায় মিথ্যে বলতে যাব কেন? তোমার সাথে কথা বলতে আমার রুচিতে বাঁধছে। আমার মেয়ে তোমার মুখও দর্শন করবে না। তুমি এখন আসতে পারো।”
কথাগুলো বলে তিনি রুমে চলে যান। সঙ্গে সালেহা বেগমও। যাওয়ার আগে তমাকে বলেন,
“বৌমা এই ছেলেকে আমার বাড়ি থেকে বের হতে বলো।”
ঘরে গিয়ে দরজা আটকে দেন তারা। ড্রয়িংরুমে তমা দাঁড়িয়ে আছে। অনলের করুণ পরিণতি দেখে কেন জানি খারাপ লাগছে। কষ্ট হচ্ছে খুব। এই মানুষটার জন্য কষ্ট পাওয়াটা কি ঠিক? কিন্তু মন যে মানছে না। এমন অবস্থায় তার অস্থিরতা ব্যাকুল করে তুলছে তমাকে। তমা ভাবছে, ‘যেখানে আমিই ওর কষ্ট সহ্য করতে পারছি না সেখানে নিহি থাকলে কী করত? ভাগ্যিস নিহি বাড়িতে নেই! আল্লাহ্ ওদেরকে তুমি মুখোমুখি কোরো না। নিহি সহ্য করতে পারবে না।’
মিলন আর সাকিব অনলকে বুঝিয়ে বাড়িতে নিয়ে যেতে চাচ্ছে। কিন্তু অনল কিছুতেই নিহির সঙ্গে দেখা না করে যাবে না। সে উঠে দাঁড়িয়ে নিহির বাবা-মায়ের ঘরের দরজায় কড়াঘাত করে বলে,
“নিহিকে কোথায় রেখেছেন বলেন প্লিজ! আমি নিহির সঙ্গে কথা বলতে চাই।”
অনলের আর্তনাদ তমাকে কাঁপিয়ে তোলে। পাশের ঘর থেকে বেরিয়ে আসে তিতির। অনলকে দেখে ওর চিনতে কষ্ট হয় না। দরজায় কড়াঘাত করছে আর নিহির সঙ্গে কথা বলতে চাইছে। আর্তনাদ করতে করতে অনল আবার ফ্লোরে বসে পড়ে। তমা ওর বন্ধুদের বলে, “উনাকে নিয়ে যান প্লিজ। তার কন্ডিশন ভালো মনে হচ্ছে না। নিয়ে যান।”
তিতির অনলের কাছে এগিয়ে যায়। তার কপালের ব্যান্ডেজে হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করে,
“তোমার এখানে কী হয়েছে পঁচা আঙ্কেল?”
অনলের আর্তনাদ এবার কান্নায় রূপ নেয়। তিতিরের ছোট হাত চেপে ধরে কান্না করে ফেলে। তিতির আবার বলে,
“তুমি কাঁদছো কেন? ফুপির কাছে এসেছ তুমি?”
অনল কাঁদতে কাঁদতে বলে,
“তুমি জানো তোমার ফুপি কোথায়?”
“নিহি ফুপি বড় ফুপিমনির বাসায়।”
তিতিরের হাতে চুমু খায় অনল। বুকে জড়িয়ে ধরে আদর করে দেয়। তারপর তৎক্ষণাৎ বাড়ি থেকে বের হয়। সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় পড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। তবুও মনের জোরের দ্বারা নিজেকে সামলে নেয়। মিলন, সাকিব বারবার বাঁধা দিতে চাচ্ছে। ওদের বাঁধা উপেক্ষা করে সে একাই একটা রিক্সায় উঠে পড়ে। একদিকে অনলের জন্য যেমন ওদের কষ্ট হচ্ছে। আবার রাগও লাগছে। নিজেকে একটু সুস্থ করার সুযোগ তো দেবে। এদিকে আকাশের অবস্থাও ভালো না। আবারও বৃষ্টি আসবে মনে হয়। আরেকটা রিক্সা ডেকে ওরাও উঠে পড়ে। অনলকে ফলো করে। অনামিকা ম্যাম তখন মিলনকে ফোন করেন। কাঁদতে কাঁদতে অনলের কথা জিজ্ঞেস করেন। মিলন শান্ত হতে বলে জানায়,
“আমরা অনলকে নিয়ে আসছি ম্যাম।”
বাস স্ট্যান্ডে গিয়ে অনলকে হারিয়ে ফেলে ওরা। কোন বাসে উঠে পড়েছে খুঁজে পাচ্ছে না।
.
.
মাহিরকে খাওয়াচ্ছিল মিহি। তখন দরজায় কলিংবেল বাজে। তরু পাশেই ছিল। মিহির উদ্দেশ্যে বলে,
“তুমি ওকে খাওয়াও। আমি দেখে আসি কে এসেছে!”
“দেখ গিয়ে নিহিই এসেছে মনে হয়।”
দরজা খুলে তরুও অবাক হলো। সামনে অনল দাঁড়িয়ে। তরুকে দেখে অনলের ঠোঁটে হাসি ফোটে। তরু এখানে মানে নিহিও এখানে আছে। জিজ্ঞেস করে,
“নিহি… নিহি কোথায়? ওকে ডাকুন প্লিজ!”
তরুর গলা কাঁপছে। কোনো রকমে মিহিকে ডাকে। মাহিরকে কোলে নিয়েই মিহি দরজার কাছে আসে। মিহিও আগে কখনো অনলকে দেখেনি। তাই অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে,
“আপনি কে ভাই? কাকে খোঁজেন? দেখে মনে হচ্ছে এক্সিডেন্ট করেছেন।”
সবগুলো প্রশ্ন উপেক্ষা করল অনল। পাল্টা প্রশ্ন করল,
“নিহি কোথায়?”
মিহি তরুর দিকে তাকালো। তরু কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলল,
“উনি অনল!”
“অনল!” আপনা-আপনি মুখ থেকে নামটা বেরিয়ে আসলো মিহির। রাগ করতে গিয়েও কেন জানি রাগ করতে পারছে না। সোজাসুজিভাবেই বলে,
“নিহির খোঁজ কেন করছেন? নিহি বাড়িতে নেই।”
“দয়া করে আমায় মিথ্যা বলবেন না। আমি জানি নিহি এখানেই আছে।”
“আমি মিথ্যা বলছি না। বিশ্বাস না হলে আপনি বাড়ি চেক করে দেখতে পারেন।”
“কোথায় তাহলে নিহি?”
মিহি কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর বলে,
“আপনি জানেন নিহির বিয়ে হয়ে গেছে? আর নিহি এখন ওর স্বামীর সঙ্গেই তার বাড়িতে আছে।”
টলমল করা চোখ তুলে তাকায় অনল। গগনবিদারী চিৎকার করে বলে,
“চুপ! নিহির খোঁজ না দিলে না দিবেন। তবুও কোনো রকম মিথ্যা কথা বলবেন না। নিহির বিয়ে হতে পারে না। আপনারা মিথ্যা কথা বলছেন সবাই। নিহিকে আমার থেকে দূরে সরানোর জন্য মিথ্যার আশ্রয় নিচ্ছেন। আমি বিশ্বাস করি না আপনাদের। বিশ্বাস করবও না। আমি অপেক্ষা করব নিহির জন্য। অপেক্ষা করব আমি!”
হাতের উল্টোপিঠে চোখ মুছতে মুছতে অনল নিচে নামে। নিহির বিয়ে হয়ে গেছে! কথাটা ভাবতেই বুকের ভেতর অসহনীয় কষ্ট অনুভূত হচ্ছে। মনের জোর কমে আসছে কথাটা শোনার পর থেকে। কী করে নিহির বিয়ে হতে পারে? পারে না। সব মিথ্যে। সব তাদের চাল!
বৃষ্টি পড়া শুরু হয়েছে আবার। চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে তার। যেকোন সময়ে মাথা ঘুরে পড়ে যাবে বলে মনে হচ্ছে। এদিকে নিহির সঙ্গে দেখা না করেও যাবে না বলে পণ করেছে সে। ভেবে নেয় আমানের বাসায় একটু বিশ্রাম নেমে। টলতে টলতে আমানের বাড়ির ভেতর প্রবেশ করে অনল। সিঁড়ির রেলিং ধরে ধরে উপরে ওঠে। কলিংবেল বাজাতে গিয়ে দেখে দরজা খোলাই। একটু চাপিয়ে রাখা। মাথা ব্যথা বাড়ছে। চোখ বুজে মাথাটা ঝাঁকিয়ে ভেতরে যায়। বৃষ্টি আবারও শুরু হয়েছে। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। রান্নাঘর থেকে আওয়াজ আসছে। টুকটুকি বোধ হয় রান্না করছে। আমানের ঘরের দরজাও চাপিয়ে রাখা। অনল দরজা ঠেলে ভেতরে যায়। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বিছানায় আমানকে দেখতে পায়। কেউ একজন ভাইয়ের বুকে গুটিসুটি হয়ে ঘুমিয়ে আছে তাকে আঁকড়ে ধরে। রুমের লাইট বন্ধ। তবে ডিম লাইট জ্বালানো। ঝাপসা চোখে ডিম লাইটের আলোতে মুখটাও ঠিকমতো স্পষ্ট হচ্ছে না চোখের সামনে। ভাইয়ের সঙ্গে একটা মেয়ে? লাইট জ্বালাতে যাবে তখনই বিদ্যুৎ চমকানোর আলোতে নিহির মুখটা ভেসে ওঠে। সঙ্গে সঙ্গে দু’পা পিছিয়ে যায় অনল। দেয়ালের সঙ্গে ঠেস দিয়ে দাঁড়ায়। বুক কাঁপাকাঁপি শুরু হয়েছে। হৃদস্পন্দন বেড়ে গেছে। চোখ বন্ধ করে কাঁপা কাঁপা হাতে রুমের লাইট অন করে অনল। লাইটের আলো চোখে পড়তেই আমানের ঘুম ভেঙে যায়। নিহিকে ঘুমের ওষুধ খাওয়ানো হয়েছে। তাই তার ঘুম গাঢ়। অনলকে এই অবস্থায় এখানে দেখে আমান অবাক হয়। অস্থির হয়ে অনলের দিকে চোখ বুলায়। এদিকে অনলের পায়ের নিচে মাটিকে বড্ড ফাঁকা মনে হচ্ছে। বিশ্বাস করতে পারছে না নিজের চোখকে। হ্যাঁ, আজ নিজের চোখকেই ওর অবিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে। এসব সব স্বপ্ন হয়ে যাক। নাহ! দুঃস্বপ্ন হয়ে যাক। হ্যাঁ, এইতো এখনই অনলের ঘুম ভেঙে যাবে। একি! ঘুম ভাঙছে না কেন? এটা কি তবে স্বপ্ন নয়? নিহির দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। নিহির হাত আমানের শার্ট আঁকড়ে ধরে রেখেছে। মাথাটা ঠিক আমানের বুকে। অন্য হাতে আমান নিজেও নিহিকে নিজের সাথে জড়িয়ে রেখেছে। তেষ্টা পাচ্ছে অনলের। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে কেউ গলা চেপে ধরেছে। এখনই বোধ হয় মরে যাবে। এসব কী হচ্ছে!
আমান নিহিকে পরম যত্নে বালিশে শুইয়ে দিয়ে অনলের কাছে আসে। তার দু’গালে হাত রেখে বলে,
“তোর কী হয়েছে ভাই? এই অবস্থা কেন তোর?”
গভীর দৃষ্টিতে এক পলক আমানের দিকে তাকিয়ে ঝাঁকি দিয়ে তার হাত দুটো সরিয়ে দেয় অনল। তারপর টলতে টলতে বিছানার দিকে এগিয়ে যায়। ফ্লোরে হাঁটু মুড়ে বসে নিহির দিকে ডান হাতের অনামিকা আঙুল তাক করে আমানের দিকে তাকায়। কিছু বলতে চাচ্ছে অনল। কথা বের হচ্ছে না। কণ্ঠস্বর রুদ্ধ হয়ে আছে। দু’চোখ ভর্তি অশ্রু কণা। বাইরে ঝড়বৃষ্টি। সেই সঙ্গে বিদঘুটে শব্দে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। ভাঙা ভাঙা গলায় বলে,
“ন…নি…হ..নিহ…নিহি!”
চলবে…
[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ]