আড়ালে আবডালে পর্ব-৪৮

0
3498

#আড়ালে_আবডালে
#পর্ব_৪৮
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
______________

সমুদ্রের উত্তাল গর্জনের ন্যায় বুকের ভেতর কষ্টগুলো ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়ছে। প্রচণ্ড ঝড়ে গাছগুলো নুইয়ে গিয়ে অনেক সময় যেমন ভার সইতে না পেরে, স্থির না থাকতে না পেরে কখনো গোড়া অথবা কখনো মাঝখান থেকে ভেঙে পড়ে নিহির পরিবার,উপমার পরিবার, আমান এবং জান্নাতের মনও কষ্ট সহ্য করতে না পেরে ক্লেশে আচ্ছান্নিত হয়ে খণ্ড বিখণ্ড হয়ে যাচ্ছে। সকলের কষ্টগুলো যেন একই সুঁতোয় বাঁধা। যেই সুতোর গিঁটে গিঁটে রয়েছে শুধুই ক্লেশের বসবাস! কোথায় খুঁজবে বা কোথায় খুঁজলে ওদের হদিস মিলবে তার কোনো কূলকিনারাই খুঁজে পাচ্ছে না কেউ।

ছেলে মানুষ নাকি সবার সামনে কাঁদতে পারে না। কিন্তু এদিকে আমানের চোখের পানিও বাঁধ মানছে না। নিজেকে শান্ত করতে পারছে না কোনোভাবেই। নিহিকে হারিয়ে ফেলার ভয় কাবু করে ফেলেছে তাকে। স্থির থাকতে পারছে না। নিজেকে শেষ করে ফেলতে ইচ্ছে করছে। এখন একটু শান্তি দরকার। শক্তি দরকার। নিহি ব্যতীত আর যার কাছে আমান শান্তি খুঁজে পায় তিনি হচ্ছে অনামিকা রহমান। মায়ের কোলে মাথা রাখলে মন শান্তি হবে। মাথা কাজ করবে। নিহিকে খোঁজার জন্য লোক লাগিয়েছে সব জায়গায়। বাড়িতে গিয়ে কলিংবেল বাজানোর পর দরজা খুলে দেয় অনল। এতো রাতে আমানকে দেখে অবাক কম হয়নি। রাত তখন তিনটারও বেশি সময়। আমান জিজ্ঞেস করে,
“মা কোথায়?”
“ঘুমাচ্ছে।”

আমান ভেতরে যাওয়ার পর অনল দরজা লাগিয়ে দেয়। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমানকে পর্যবেক্ষণ করে বোঝার চেষ্টা করে লুকানো কোনো কথা কী আছে। আমানকে এর আগে কখনোই এতো বিধ্বস্ত লাগেনি৷ অনল জানে, নিহিকে তার ভাই কতোটা ভালোবাসে। নিহির সঙ্গে ঝামেলা হওয়ার কথা নয়। আর হলেও এতো রাতে নিহিকে রেখে তো আসবে না। নাকি অন্য কোনো কাহিনী লুকিয়ে আছে? তর সইতে না পেরে অনল জিজ্ঞেস করে ফেলে,
“কোনো সমস্যা? মাকে ডাকব?”
“না, এখন ডাকতে হবে না।”

অনল আমানের পাশে বসলো। এই মুহূর্তে আমানের ভেতরে থাকা কথাগুলো জানা অতীব জরুরী। হতেও পারে কোনো কথায় জড়িয়ে আছে নিহি। ভাইয়ের কাঁধে হাত রেখে বলল,
“আমায় বলো কী হয়েছে ভাইয়া?”
আমান লম্বা শ্বাস নিলো। ঠোঁট কামড়ে কান্না থামানোর বৃথা চেষ্টা করল। ক্ষণকাল স্তব্ধ থেকে বলল,
“নিহুকে খুঁজে পাচ্ছি না!”

অনল আৎকে ওঠে। বুকের ভেতর তীর প্রবেশ করলে যতটা ব্যথা অনুভব হয় এখনও ঠিক ততটাই অনুভূত হচ্ছে অনলের। নিহির একমাত্র শত্রু ছিল সামিয়া। সামিয়াকে তো অনল শেষ করে দিয়েছে। তাহলে নিহির নিরুদ্দেশ হওয়ার পেছনে কে রয়েছে?
.
.
ঝিঁঝিঁ পোকার আওয়াজ আসছে। অনতিদূরে কোথাও কুকুরদের আর্তনাদ শোনা যাচ্ছে। ঈষৎ কেঁপে ওঠে নিহি৷ অনামিকা ম্যাম কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে কয়েকটা ছেলের সঙ্গে শলাপরামর্শ করছে। নিহির কিছুতেই বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে না অনামিকা ম্যাম যে ওকে কিডন্যাপ করিয়েছে। যেই ম্যামকে নিজের আদর্শ মানতো, যাকে মন থেকে শ্রদ্ধা করতো তার এমন নিকৃষ্ট রূপ সহ্য-সীমার বাহিরে৷ কেন করছেন তিনি এমন? কী স্বার্থ আছে তার? শুধুমাত্র অনলের জন্যই কি তিনি এতোটা নিচে নেমেছেন? বুক ফেঁটে কান্না আসে নিহির। চোখের পত্রপল্লব অশ্রুশিক্ত আচ্ছান্নিত। দু’গালে রয়েছে চোখের জলের ধারা। কিছু অশ্রু গাল গড়িয়ে ঠোঁটের কোণায় গিয়ে ঠেকে। যার দরুণ নোনতা স্বাদ জিভও গ্রহণ করে। নিহি মনে মনে চাইছে কিছু মীরাক্কেল হোক। অথবা এটা দুঃস্বপ্ন হোক। ঘুম ভেঙে গেলেই যেন দেখতে পায় এটা সত্যিই একটা দুঃস্বপ্ন ছিল। আর দুঃস্বপ্নই যদি হয় তবে এই স্বপ্নটিই হবে নিহির দেখা সবচেয়ে বাজে স্বপ্ন। আর কিছু না হোক, শুধুমাত্র নিরব বেঁচে যাক আর যাকে নিজের আদর্শ মানতো তার নিকৃষ্ট রূপ মিথ্যে হয়ে যাক! হ্যাঁ, ঠিক এই দুটো কারণেই নিহি চাচ্ছে এটা দুঃস্বপ্ন হোক। চাইলেই কি হবে? মুছে যাতে এতো সহজে সব গ্লানি?

হাই-হিলের খটখট শব্দে চোখ মেলে সামনের দিকে তাকায়। চোখ বন্ধ করেই এতক্ষণ আল্লাহ্-র কাছে মীরাক্কেল কিছু হোক চাচ্ছিল নিহি। অনামিকা রহমানের ঠোঁটে হাসি৷ খুব কুৎসিত হাসি৷ আগে তিনি গম্ভীর থাকলেও তাকে স্নিগ্ধ অপরূপ লাগতো। সেসব কি তাহলে অভিনয় ছিল? মানুষ এতোটা নিখুঁত অভিনয় কী করে করতে পারে?

একজন চেয়ার এগিয়ে দিলো। অনামিকা রহমান চেয়ারটি নিহির সামনে রেখে মুখোমুখি বসলেন। বিদ্রুপাত্মকভাবে হেসে বললেন,
“মনের ভেতর অনেক প্রশ্নই জমা হয়েছে তাই না?”
নিহির মুখ বাঁধা। কোনো উত্তর দিতে পারল না। শুধু অসহায় চাহনী নিক্ষেপ করে তাকিয়ে রইল। তিনি আবার বললেন,
“তুমি জানো এখানে তোমায় কেন নিয়ে এসেছি?”

এবারও যখন নিহি কোনো উত্তর করল না তখন তিনি খেয়াল করলেন ওর মুখ বাঁধা। পাশে দাঁড়ানো ছেলেটিকে ইশারা করলেন মুখের বাঁধন খুলে দিতে। ছেলেটি বাঁধন খুলে দিতেই ফোস করে দম নিলো নিহি। অনামিকা ম্যাম হাসলেন। নিহি কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল,
“আমি বিশ্বাস করতে পারছি না! আপনি…”
এবার শব্দ করে কেঁদে ফেলল নিহি। তিনি ‘চ’ এর মতো বিদঘুদে বিদ্রুপাত্মক শব্দ করে বলেন,
“আহারে! বিশ্বাসটা তাহলে অর্জন করতে সক্ষমই হয়েছিলাম। কী বলো? তাছাড়া যেখানে ছোট থেকেই আমানের বিশ্বাসের যোগ্য মা হয়ে উঠেছি সেখানে তুমি আর এমন কী!”
“আপনি কেন করছেন এমন? অনল আপনার ছেলে। আমানও আপনার ছেলে৷ তাহলে শুধু অনলের পক্ষপাতিত্ব করতে গিয়ে এতো নিকৃষ্ট কর্মে কেন লিপ্ত হচ্ছেন?”

অনামিকা রহমান এবার বেশ শব্দ করে হাসলেন। তার হাসিটা বিশ্রী লাগছে। খুব বিশ্রী! যেই মুখে একসময় শ্রীর রেখা অভিযুক্ত ছিল সেই মুখে আজ পৈশাচিক আনন্দ। হাসতে হাসতেই তিনি বললেন,
“আজ তোমায় সব বলব। মরার আগে অন্তত আমার সিক্রেট জেনে যাও। তুমিই প্রথম এবং তুমিই শেষ যে আমার একমাত্র সিক্রেট জানতে পারবে।”

নিহি নিশ্চুপ রইল। পাশে দাঁড়ানো ঐ ছেলেটিকে বলল,
“ওকে ঐ রুমে নিয়ে যাও।”
ছেলেটি নিহির হাত-পায়ের বাঁধন খুলে টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছে। পুরো জায়গাটা এতো অন্ধকার যে নিহি কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। এতোক্ষণ যেখানে ছিল সেখানে নিভু নিভু আলো থাকলেও এখানে আলোর চিহ্ন মাত্র নেই। অবশেষে নিহিকে একটা কাঁচের রুমে আনা হলো। লাইট অন করতেই চোখ বন্ধ করে ফেলে নিহি৷ এতোক্ষণ অন্ধকারে থাকার জন্য এখন হুট করে আলো চোখে পড়ায় চোখ ঝলসে যাচ্ছে মনে হয়। চোখ বন্ধ রাখা অবস্থাতেই নিহিকে আবারও বেঁধে রাখা হয়। এবার নিভু নিভু চোখে তাকায় আবার চোখ বন্ধ করে ফেলে। চোখের দৃষ্টি আটকে যায় রুমটা দেখে। অনামিকা রহমান তখন আসেন। কাঁচের দরজাটাও লক করে দেন। পুরো রুমটায় শুধু মাত্র দুটো চেয়ার ছাড়া আর কিছু নেই। একটা চেয়ারের সাথে নিহিকে বেঁধে রাখা হয়েছে। আর অপর চেয়ারটি ফাঁকা। হয়তো অনামিকা রহমানের জন্যই৷ ধারণা ঠিকই হলো। চেয়ারেই বসলেন তিনি। নিহির মুখের বাঁধন খুলতে খুলতে বললেন,
“সাউন্ডপ্রুফ রুম। চিৎকার-চেঁচামেচি করার থাকলে করতে পারো।”

নিহি নিশ্চুপ রইল। তিনি ভাবছেন কোথা থেকে শুরু করবেন। বাম হাতের তালু চুলকাতে চুলকাতে বললেন,
“বলব যখন তখন প্রথম থেকেই বলি। কী বলো?”
নিহি কাঁদছে। তিনি হাসছেন। বলা শুরু করেন,
“আমার বয়স যখন ২৩ বছর তখন আমার বিয়ে হয়। নিতান্তই গরীব ঘরের মেয়ে ছিলাম। তবে পড়ালেখায় ছিলাম খুব মেধাবী। তাই বাবা-মা চাইলেও আমি তাড়াতাড়ি বিয়ে করিনি। যার সাথে আমার বিয়ে হয় তাকে আমি পরিচয়ের প্রথম থেকেই খুব পছন্দ করতাম। বিয়ের পর ভালোবাসার কোনো কমতি রাখিনি। আমি ছোট থেকেই শান্ত স্বভাবের নিজের রাগ, ক্ষোভ কখনো কাউকে বুঝতে দেই না। বিয়ের পর অজপাড়াগাঁ থেকে সে আমায় ঢাকায় নিয়ে আসে। আমাদের সংসার খুব ভালো চলছিল। ভালোবাসায় পরিপূর্ণ যাকে বলে। বিয়ের পরও আমি পড়াশোনা চালিয়ে গিয়েছি। সে সারাদিন অফিসে থাকতো বলে বাজারটা আমাকেই করতে হতো। একদিন বাজার করে বাড়ি ফেরার পথে দেখি আমার উনার সাথে একটা মেয়ে রিক্সায় খুবই ঘনিষ্ঠভাবে বসে আছে। বিশ্বাস করতে পারিনি। চোখের ভুল বলে এড়িয়ে যেতে চেয়েছি। কিন্তু আমার দৃষ্টিশক্তি প্রবল। ভুল হওয়ার প্রশ্নই আসে না। নিজেকে ক্ষান্ত রাখার চেষ্টা করলাম। কোনোকিছুতেই আমি সঙ্গে সঙ্গে উত্তেজিত হয়ে পড়ি না৷ যা করি সব ঠান্ডা মাথায় করি। বাড়িতে এসে রান্নার জোগাড় করি। আর ভাবতে থাকি কীভাবে এর সত্যতা যাচাই করব। আর যদি সত্যিই আমার দেখা সত্য হয় তাহলে তখন আমি কী করব? ডিভোর্স করব? নাহ্! আমি তাকে খুব ভালোবাসতাম৷ ডিভোর্স তো সম্ভব নয়। অন্য কারো সঙ্গে তাকে আমি সুখী দেখতে পারব না। সে বাড়ি ফেরার পর গোপনে তার ফোন চেক করলাম। ক্লু হিসেবে কোনোকিছুই পেলাম না। রাতে সে ঘুমানোর পর সব নাম্বার একটা কাগজে টুকে নিলাম। এমনকি ছেলেদের নাম্বার পর্যন্তও। কারণ আমার ধারণা ছিল সে যদি পরকিয়া করেই থাকে তাহলে অবশ্যই সব প্রমাণ লুকিয়ে রাখবে। পরেরদিন সে অফিসে চলে যাওয়ার সময় পিছু পিছু আমিও ফলো করলাম। বাস স্টপেজে পৌঁছে দেখলাম তার সাথে রিক্সায় দেখা সেই মেয়েটাকে। তাকে দেখেই এক গাল হাসলো। আমি ভালো করে মেয়েটিকে চিনে রাখলাম। বাড়িতে এসে টুকে রাখা নাম্বারগুলো সব ফোনে সেভ করলাম। এরপর নেট অন করলাম৷ যতগুলো নাম্বারে ইমো,হোয়াটসঅ্যাপ খোলা ছিল তাদের ছবিসহ আইডি নাম আসলো৷ এটা ছিল আমার প্ল্যান এ (A)। ভাগ্য ভালো থাকায় প্রথম প্ল্যানই কাজে লাগল। মেয়েটির নাম্বার আমার স্বামীর ফোনে একটা ছেলের নাম দিয়ে সেভ করা ছিল। অন্য নাম্বার থেকে ফোন করে শিওর হয়ে নিলাম সেই মেয়েটাই কী-না!

একদিন সুযোগ বুঝে আমার স্বামীকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে ঘুম পাড়ালাম। ইতিমধ্যে উনার ফেক আইডিরও সন্ধান পেয়েছিলাম৷ যেখানে ঐ মেয়ের সাথে তিনি নিষিদ্ধ আলাপে মত্ত থাকতেন। শুধু তাই নয়, আমি গ্রামে আসলে তিনি ঐ মেয়েকে বাড়িতে এনে মজা-মাস্তিও করতেন। শহরে আমাদের বাড়িটা নির্জন জায়গায় ছিল বলে তারা সকলের নজর খুব সহজেই এড়িয়ে যেতে পারতো। সবকিছু জানার পরও নিজেকে ঠান্ডা রেখেছিলাম। তাকে ঘুম পাড়িয়ে মেয়েটাকে টেক্সট করলাম, ‘বাড়িতে আসো। অনামিকা নেই।’ সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটির রিপ্লাই আসলো, ‘আসছি।’
আমিও তৈরি হয়ে নিলাম। নির্জনতায় বাড়ি হওয়ায় তাদের মতো আমিও সুযোগটাকে কাজে লাগালাম। হাতে গ্লাভস পড়ে নিলাম। সায়েন্সের স্টুডেন্ট হওয়ায় এতটুকু জানতাম, কোথায় আঘাত করলে আমি সফল হবো। দরজা খোলাই রাখলাম। মেয়েটি আসলো প্রায় ত্রিশ মিনিট পর। আমার প্ল্যান অনুযায়ী মেয়েটিকে শেষ করে দিলাম। বিদায় দিলাম এই পৃথিবী থেকে। এরপর ছাড় দেইনি আমার প্রাণের স্বামীকেও। তাকেও শেষ করে দেই। মুছে ফেলি সব প্রমাণ। বিশ্বাসঘাতকের বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই। আমার জীবনের প্রথম খুন ছিল ঐ দুটোই।”
“তার মানে আগেও আপনার একটি বিয়ে হয়েছিল আর আপনি…”
তিনি হাত উঠিয়ে বললেন,
“আমায় বলতে দাও। কথার মাঝে কথা বলবে না। বিরক্ত লাগে আমার।

এরপর বান্ধবী জিমির সাহায্যে ওর হাজবেন্ডের অফিসে চাকরী নিই৷ জিমিও বিবাহিত ছিল। তিন মাসের ছোট একটা বাচ্চা ছিল। আর সেই বাচ্চাটা কে জানো? তোমার ভালোবাসার স্বামী আমান! আমার বাবা ছিল না৷ মা-ও মারা যায়। দুনিয়ায় পুরো একা আমি৷ জিমির সুখ সহ্য হতো না। মাথার ভেতর যন্ত্রণা হতো। ভাবতে থাকি কী করা যায়! কী করলে আমি শান্তি পাব। সম্পত্তি পাব। এভাবে কেটে যায় আরো তিন মাস। সুবর্ণ সুযোগ আসে আমার। জিমিকে ছাদ থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিই। পাঁচ তলার ওপর থেকে পড়ে বেচারী অক্কা পায়। অকালে প্রাণ হারায়। এখনো অব্দি এই সত্যটা আজমল জানে না। আমানের বাবা তখন দিশেহারা হয়ে পড়ে। একদিকে প্রিয়তমা হারানোর শোক, আর অন্যদিকে আমানের চিন্তা। তখন ভরসার পাত্রীর অভিনয় করে উপস্থিত হই আমি। ঐসময়ে তিনি আমায় বিশ্বাস করতে বাধ্য হোন। বিয়ে করেন আমায়। সব পেয়েও তখন আমি সব পাইনি। কারণ সম্পত্তি সব ছিল আমানের নামে। এইটুকুন বাচ্চার নামেই কেন সব সম্পত্তি দিতে হবে! পরে ভাবলাম, থাক সমস্যা কী? আমি তো রাণীর হালেই থাকব। পাঁচ বছরের মাথায় অনল হলো। আমার সুখ সুখ লাগল আরও বেশি করে। সবার সামনে আমানের প্রতি খুব ভালোবাসা দেখালেও বিরক্ত লাগতো আমার। সহ্য করি তাও মুখ বুজে। কারণ আমান জানতো না আমি ওর সৎ মা৷ এমনকি এখনো জানে না। এরপর এক সময় হোস্টেলে পাঠিয়ে দিই। তখন মাথায় আরেক চিন্তার উদয় হলো।সব সম্পত্তি নিজের নামে কী করে নেব?

কোনো দিশা পাইনি আমি। আমান পড়াশোনা শেষ করে অফিসের দায়িত্ব নিল। আরও হাতছাড়া হতে চলল সব। এক মনে ভাবলাম ওকে শেষ করে দিই। আবার ভাবলাম,দেখিই না কী হয়। এরপর আলোর দিশা হয়ে আসলে তুমি। ওর বাসায় যাওয়ার পর প্রায়ই দেখতাম লুকিয়ে লুকিয়ে ও তোমায় দেখে। তোমায় নিয়ে হাজারও কবিতা লিখে। আরও অবাক হলাম যখন কলেজে ভর্তি হওয়ার ব্যাপারে আমান তোমার জন্য সুপারিশ করে। ভাবলাম ভালোই হলো৷ এবার আমার কাজ করতে সুবিধা হবে।”

এবার তিনি একটু থামলেন। থেমে আবার বললেন,
“এর মাঝেই অনল তোমার প্রেমে পড়ে যায়। অবশ্য তখন আমি জানতাম না যে, প্রতিশোধের নেশায় অনল অভিনয় করেছিল। যেহেতু আমি জানতাম অনল তোমায় সত্যিই ভালোবাসে সেহেতু দু’পরিবারের প্রস্তাবের মাধ্যমে তোমায় আমানের বউ করে আনা সম্ভব ছিল না। কারণ আমার নিজের ছেলেকে তো আমি চিনি। ও তো আর এসব হতে দেবে না। তখন আরও দুশ্চিন্তায় পড়ে যাই আমি। তখন অন্য প্ল্যান ভাবতে থাকি। আর কাজেও লাগাই। আচ্ছা নিহি, তোমাদের বাসায় নিলুফা নামে যেই মেয়েটা কাজ করতো তার কথা মনে আছে? এক মাস হলো কাজ বাদ দিয়েছে!”

নিহি ঘাবড়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করে,
“আপনি কি নিলুফা আপাকেও মেরে ফেলেছেন?”
তিনি হেসে ফেললেন। হেসে হেসে বললেন,
“শোনো তো আগে! ঐ নিলুফা কোনো সাধারণ মেয়ে না। ও আমার লোক। তোমার ওপর নজর রাখার জন্য আমিই ওকে পাঠিয়েছিলাম। আমানের সঙ্গে তোমার বিয়েটা কোনো কাকতালীয় বিষয় ছিল না। ঐটা আমারই প্ল্যান ছিল।”
“মানে!” অস্পষ্ট স্বরে বলল নিহি।

“ঠিকই শুনেছ। নিলুফার কাছেই জানতে পারি তোমার বাড়ির সবাই হাসপাতালে গেছে। এবং এটাও জানতে পারি তিতিরের ওষুধ আনার জন্য তুমি বাইরে যাবে। সঙ্গে সঙ্গে আমার লোক দ্বারা খবর নেওয়াই তোমার বাড়ির পাশে যতগুলো ডাক্তারের দোকান ছিল সেগুলো খোলা কী-না৷ যদি খোলা থাকে তাহলে টাকা খাইয়ে যেন কয়েক ঘণ্টার জন্য বন্ধ করিয়ে রাখে। খবর পেলাম, কয়েকটা বন্ধ আর কয়েকটা খোলা। প্ল্যান মোতাবেক দোকান বন্ধ করালাম। প্রত্যেকটা ডাক্তারের দোকানের সামনে একজন করে রিক্সাওয়ালা রাখলাম। কারণ, আমি জানতাম ওষুধ আনতে গেলে তোমায় তখন বাজারেই যেতে হবে। আমার লোকদের মধ্যে একজনের রিক্সায় উঠে পড়লেও তুমি।

এরপর আমানকে ফোন করে বলেছিলাম, আমার শরীরটা খুব খারাপ। তাড়াতাড়ি যেন বাড়িতে আসে। ওর ড্রাইভারকে ফোন করে বলে দিয়েছিলাম ওর সঙ্গে আসতে। এবং মাঝরাস্তায় গাড়ি থামিয়ে নামতে। কী হয়েছে দেখার জন্য বের হয়ে গাড়ির একটা তার কেটে দিতে। তখন আমান ম্যাকানিক খোঁজার কথা বলবে এটা তো জানা কথা। ড্রাইভার আমার বলা বুলি বলে দিলো। বলল তার মেয়ে অসুস্থ। বেশি দেরি করতে পারবে না। আমান তাকে বাসায় যেতে বলে নিজেই ম্যাকানিক খুঁজতে বের হলো। আর এরপর তো সবটা জানোই। যেই ছেলেগুলো তোমাদের আটকিয়েছিল ওরা আমারই লোক।”

নিহি ‘থ’ মেরে বসে আছে। ভালো মানুষীর পেছনে এতো জঘন্য রূপ। নিহি প্রশ্ন করে,
“আমার সঙ্গে আমানের বিয়ে দিয়ে আপনার কী লাভ ছিল”
“আমি চেয়েছিলাম আমান তোমায় নিয়ে নিয়েই ব্যস্ত থাকুক। এই বাড়ি, সয়সম্পত্তি সবকিছু থেকে দূরে থাকুক। অনলের ভালোবাসার মানুষের সাথে আমানের বিয়েটা নিশ্চয়ই অনল মেনে নিতো না। তখন আমানকে সারাজীবনের মতো দূরে থাকতে হতো। আমান যেই ধরণের মানুষ ওকে বাড়ি থেকে বের করে দিলে কোনো সম্পত্তিই ও নিতো না।”

“সব তো আপনার প্ল্যান মতোই হয়েছে। তাহলে আমায় কেন কিডন্যাপ করেছেন?”
“আমার ধারণার বিপরীত সব হচ্ছিল। আমান তোমায় ছাড়তে নারাজ। আর এদিকে অনল তোমার জন্য পাগল। এটা তো আমি মানতে পারব না। আমি ভেবেছিলাম, অনল নিজেকে মানিয়ে নেবে৷ কিন্তু আমার ধারণা ভুল। অন্যদিকে তুমি আমানের পাশে থাকলে আমানকে দুর্বল করা যাবে না। আর আমান দুর্বল না হলে ওকে মারাও যাবে না।”
“কী করতে চাচ্ছেন আপনি?”
“খুব সিম্পল। আমানকে আর তোমাকে শেষ করে দিতে। তোমাকে হয়তো মারতাম না। কিন্তু আমানের জন্যই তোমায় মরতে হবে। তোমায় তুলে এনেছি আমানকে দুর্বল করার জন্য। তুমি নিরবের খুন হতে দেখেছো। নিরবের মতো তুমিও আরেক প্রমাণ। তাই তোমাকেও মরতে হবে। আমার ছেলেও শান্তি পাবে আর সব সম্পত্তিও ভোগ করতে পারব।”
“ছিঃ! আমার ঘৃণা হচ্ছে আপনাকে। আপনাকে আমি আদর্শ মানতাম ভাবতেই নিজের ওপর আমার রাগ হচ্ছে।”
তিনি তাচ্ছিল্য করে হেসে বলেন,
“রেডি থেকো মৃত্যুর জন্য।”

নিহি শব্দ করে কাঁদতে থাকে। কোনো উপায় নেই। কিচ্ছু করার নেই নিহির। আগে থেকে সবটা জেনেও হয়তো আমানকে বাঁচাতে পারবে না।আর বাঁচতে পারবে না নিজেও। অনামিকা রহমান বের হওয়ার সাথে সাথে লিসা ভেতরে আসে। স্তব্ধ হয়ে তাকায় নিহি। ভাষাহীন দৃষ্টিতে আটকে আছে আরো কিছু প্রশ্ন। লিসা চেয়ারের হাতলে দু’হাত রেখে নিহির দিকে কিছুটা ঝুঁকে বলে,
“আলবিদা নিহি।”

চলবে…