#_সেই তুমি
#-পর্ব-১২
#- সানজিদা সন্ধি
আহনাফকে নিয়ে কেউ মাতামাতি করুক সেটা তার খুব একটা পছন্দ নয়। তাই সে আতিয়া চৌধুরীকে সরে যেতে বলে উল্টো করে শুয়ে বালিশে মুখ গুঁজলো । কিন্তু আতিয়া চৌধুরী বারবার জিজ্ঞেস করতে লাগলো, ” বাবা তোর কী খুব বেশি ব্যাথা করছে? নিজের একটু যত্ন নিতেও তো পারিস। ঔষধও খাসনা, ডক্টরও দেখাসনা এখন পায়ে ইনফেকশন হয়ে গেলে কী হবে বলতো? আর পায়ে যে ব্যান্ডেজ করে দিয়েছিলাম সেটা কেন খুলেছিস? আর পায়ে কী আবার কিছু লেগেছে? মনে তো তাই হচ্ছে! নয়তো কাটা স্থান থেকে কেন রক্ত পড়বে আবার? ”
আহনাফ যখন রেলিং এ পা দিয়ে লাথি মেরেছিলো তখন কাটা যায়গাটাতেও আঘাত লেগে যায়। আর ফলাফলস্বরূপ আবার রক্ত পড়ছে। ক্ষতটা বেশ বড়ই।
আতিয়ার কথা শুনে আহনাফের কোনো হেলদোল নেই। কানে ইয়ারফোন গুঁজে ফুল ভলিউমে সে গান ছেড়েছে যাতে তার মামনির কথা কর্ণগোচর না হয়। কারণ এখন মামনির কথা শুনলেই তার মেজাজ খারাপ হয়ে যাবে।
কিন্তু মামনি তার ইয়ারফোন খুলে নিয়ে কথা বলতে শুরু করলো। আর তখনই বাঁধলো বিপত্তি।
আহনাফ ঝটকা দিয়ে মামনিকে সরিয়ে দিয়ে বললো, ” তুমি কী শুরু করেছো হ্যাঁ? শান্তিমতো থাকতে দেবে না আমাকে? আমার জীবনটা তিলে তিলে শেষ করে দিয়েও তোমার শান্তি হয়নি? আমার জীবন নষ্টের পেছনে তোমার অবদান কতটা ভুলে গিয়েছো? তবে কেন আসো আমার কাছে?তোমার ছায়াও আমি সহ্য করতে পারিনা। মনে নেই তোমার অদিতি আমাকে ছেড়ে যাওয়ার সাহস পেয়েছে একমাত্র তোমার কারণে! তখন তুমি কেন ওকে সাপোর্ট করেছিলে আমাকে ছেড়ে যেতে? হ্যাঁ আমি মানছি আমি ওর খেয়াল রাখতাম না, ওকে যন্ত্রণা দিতাম। কিন্তু সে ছাড়া আমি অচল সেটা কী জানতে না? আমার রাগ, জেদ,অভিমান সব বুঝতো সে। আমার খেয়াল রাখতো। আমি হয়তো পরে ঠিক হয়ে যেতাম। সিরিয়াস হতাম সম্পর্ক নিয়ে কিন্তু সে তো আমায় ছেড়ে চলেই গেলো! কেন মামনি? কেন? ”
আতিয়াও যেন গর্জে উঠলো। বললো, ” তুই সম্পর্কটার দাম দিতে পারিসনি। যখন অদিতির তোকে দরকার ছিলো তখন তুই বন্ধুদের নিয়ে পার্টি করে বেড়াতি। আর মেয়েটা একটু কথা বলার জন্য ছটফট করে মরতো! আমাকে আগে কতবার বলেছিলো মামনি আহনাফকে বলো না আমার দিকে একটু তাকাতে। আমিও পাত্তা দিতাম না ওর কথায়। একপর্যায়ে যখন সে আমায় জানায় তোকে ছেড়ে যেতে চায় তখন আমি অবাক হই। কিন্তু কিছু করার ছিলোনা তখন। নিজের ছেলের ভালোর জন্য অপরের মেয়ের ক্ষতি কেন করবো? তাছাড়া অদিতিও আমার মেয়ের মতোন। তোর সাথে ওর সম্পর্ক ব্যাতীত আমার সাথেও তার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক হয়েছিলো। এতো ভালো মেয়েটার ভালো থাকার ইচ্ছেতে আমি কী করে বাঁধা দিতাম? আর সময় থাকতেই সবকিছুর মূল্য দিতে হয় আহনাফ। নয়তো পরে আফসোস করতে হয়। যেটা তুই এখন করছিস!”
আহনাফকে অদিতি যেদিন বলেছিলো,” আহনাফ আমি তোমাকে ছাড়তে চাই! সেদিন আহনাফের এক্সিডেন্ট হয়। তাই অদিতি বিষয়টা নিয়ে আর কথা আগায়নি। কিন্তু ততদিনে অদিতি নিজের নতুন সম্পর্ক শুরু করে দিয়েছিলো। আহনাফ সেই সম্পর্কের কথা জানতে পারে কিন্তু ছেলেটার খোঁজ পায়নি সে। সবটা জানাজানি হলে আহনাফ ভীষণ খারাপ ব্যবহার করে অদিতির সাথে। তবে অদিতি তার সিদ্ধান্তে অনড়। দুই পরিবারের সবাই তাদের সম্পর্কের কথা জানতো। আহনাফ জেদ ধরেছিলো কিছুতেই অদিতিকে যেতে দেবে না তাকে ছেড়ে। আর আহনাফের যে রাগ তাতে কেউ তার মুখের উপরে কথা বলার সাহস পায়নি। তখন অদিতি আতিয়া চৌধুরীকে বলে, ” মামনি তোমার ছেলেকে ছাড়লেই আমি একমাত্র ভালো থাকতে পারবো। এখন সিদ্ধান্ত তোমার।” আতিয়া চৌধুরী তখন অদিতিকে চাওয়াকে সমর্থন জানায়। সেদিন চৌধুরী পরিবারে ঝড় উঠেছিলো। অদিতিকে যেতে দেওয়ার কারণে আহনাফ পুরো বাড়িতে ঝড় তুলেছিলো। সেদিন থেকে আতিয়া চৌধুরীর সাথে কথা বলা বন্ধ করে দেয় আহনাফ। কিন্তু তার ছোট বোন সব মিটমাট করে দেয়৷ কিন্তু তারপর যখন আতিয়া চৌধুরীর কারণে সে তার কলিজার টুকরা বোনকে হারায় সেদিন থেকে আতিয়ার ছায়াও সহ্য করতে পারে না সে। তবে বোনকে দেওয়া কথা রাখতে আতিয়ার সাথে কথা বন্ধ করেনি আহনাফ। স্বাভাবিক আচরণ করেছিলো।
আতিয়ার কথা শুনে আহনাফ যেন কয়েক সেকেন্ড স্তব্ধ হয়ে রইলো৷ আসলেই সময় থাকতে সবকিছুর মূল্য দিতে হয়। নয়তো সময় চলে গেলে হা হুতাশ করা ছাড়া কিছুই করার থাকবে না। তারপরেও ভাঙা গলায় সে বললো, ” অদিতি একটা স্বার্থপর। স্বার্থের জন্য ছেড়ে গিয়েছে আমায়! ”
আহনাফের কথা শুনে আতিয়া চৌধুরী বড্ড বেশি বিরক্ত হচ্ছেন। এতবড় ছেলে কিছু বোঝে না কেন? তিনি বললেন, ” যে নিজে ভালো থাকার জন্য তোকে ছেড়ে গিয়েছে তাকে কীভাবে তুই স্বার্থপর বলতে পারিস? আর সে যদি স্বার্থপরও হয় তবে বেশ করেছে। কারণ সে নিজের ভালোর কথা ভেবে তোকে ছেড়েছে। নিজেকে ভালোবাসা জরুরি। আর তুইও তো মহা স্বার্থপর। তার খেয়াল রাখতি না কখনো ঠিকমতো। কিন্তু সে তোর খেয়াল রাখতো বলে তাকে নিজের কাছে রাখতে চাইতি। কিন্তু সে থাকলো না বলে তোর আত্মঅহংকার ক্ষুন্ন হয়েছে বলে পাগলামি করছিস! অপরকে দোষ দেওয়ার আগে নিজের দোষ খুঁজতে শিখিস আহনাফ। জীবন সুন্দর হবে! ”
বাক বিতন্ডা চলছে তো চলছেই। থামাথামির নাম গন্ধ নেই কারো। একপর্যায়ে সহ্য করতে না পেরে আতিয়া চৌধুরী আহনাফের ঘর থেকে চলে এলো। চোখের জ্বল ফেলে আল্লাহর কাছে প্রশ্ন করছেন, ” হে আল্লাহ! আমার সুন্দর সংসারটাতে শান্তি নেই কেন? একমাত্র ছেলের আচরণ যদি এমন হয় তাহলে আমি কোথায় যাবো? আমি কী সত্যিই তার জীবন নষ্ট করেছি? সেদিন যদি অদিতিকে আটকাতাম তাহলে তার দীর্ঘশ্বাসে যে কতো অভিশাপ লেখা হতো আমার। হাহ দিনশেষে আমিও স্বার্থপর। সবাই স্বার্থপর। আমার আহনাফটা কেন বোঝেনা? আমি কী নিজের মেয়েকে ইচ্ছে করে মেরেছি? কোনো মা করতে পারে সেটা?
” আহনাফের বোন আদিলা তার কলিজার টুকরা ছিলো। বাড়ির একমাত্র আদরের মেয়ে। সবার ভীষণ পছন্দের। কিন্তু তার আঠারো বছর হতে না হতেই আহনাফের খালামনি তার ছেলে নিরবের সাথে আদিলার বিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব পাঠায়। আদিলা, আহনাফ কিংবা আবির চৌধুরী কেউই বিয়েতে রাজি ছিলো না। তবে আতিয়া চৌধুরী বোনের মন রক্ষার্থে আদিলার সাথে নিরবের বিয়ে দেয়। কথা ছিলো আদিলা তার বাবার বাসায় থেকে পড়াশোনা করবে। কিন্তু নিরবের পরিবার আদিলাকে তাদের কাছে নিয়ে যায়। বিয়ের পর আদিলা সংসারে কিছুতেই মনযোগী হতে পারে না। তার মন পড়ে থাকে বাবা- মা, ভাইয়ের কাছে। তার শাশুড়ি তাকে আগলে রাখে বোনের মেয়ে হিসেবে। তবে নিরব আদিলার মন সংসারে আনার জন্য তার সঙ্গে জোরপূর্বক শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করে। যেখানে বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিলো না আদিলার।আহনাফকে ফোন করে সবটা বলতেই বদমেজাজি আহনাফ সেখানে গিয়ে ঝামেলা করে আদিলাকে নিয়ে আসে৷ আদিলা বাসায় আসার তিনমাস পরে সে জানতে পারে সে প্রেগন্যান্ট। অল্পবয়সে মা হওয়ার সুখবর আদিলাকে মন থেকে খুশি করতে পারেনি। স্বাধীনভাবে জীবন উপভোগ করতে চাওয়া বাবার আদুরে মেয়ের সংসার জীবনে বড্ড অনিহা। বাচ্চা পেটে আসার পর থেকে শুরু হয় তার নানান সমস্যা। হাত পা ফুলে যাওয়া, খিচুনী ওঠা, মেজাজ খিটখিটে হওয়া সহ অনেক সমস্যা। বাচ্চা পেটে আসার সাত মাস পরে আদিলার ডেলিভারি পেইন ওঠে। সেদিনের কথা মনে করতেও শিউরে ওঠে আতিয়া চৌধুরী।”
বাচ্চা পেটে আসার পর পুরোটা সময়ই বাবার বাড়িতে ছিলো আদিলা। আহনাফ ব্যাক্তিগত জীবনের বিক্ষিপ্ততা একপাশে রেখে বোনের দিকে বেশ মনযোগী ছিলো। পুরো পরিবার তাকে আগলে রাখতো। আদিলা যখন ব্যাথায় কাতরে উঠতো আহনাফের মনে হতো কেউ যেন তার কলিজা ছিঁড়ে নিয়েছে । বেবি হওয়ার পর তাকে নিয়ে কী কী করবে এটা ভেবে দুই ভাইবোনের সে কী আনন্দ! হুট করে রাতের বেলায় ডেলিভারি পেইন ওঠে আদিলার৷ ব্যাথায় চিৎকার করে উঠতেই সবাই তাকে নিয়ে হাসপাতালে যায়৷ অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হওয়ায় শরীরের অবস্থা ভীষণ বাজে তার। আর নবাগত শিশু জন্মেছে নিউমোনিয়ার লক্ষণ নিয়ে। আদিলাকে অল্পবয়সে বিয়ে দেওয়ার মায়ের প্রতি বড্ড বেজার সে। অসুস্থ শরীরে ভাইকে খুঁজতে ব্যাস্ত। বাবাকে একনজর দেখবার জন্য কী তৃষ্ণা তার। শ্বশুর বাড়ির লোকজনও এসেছে তাকে দেখতে। তবে সেসব বাদ দিয়ে দুজন অবিভাবককে খুঁজতে মরিয়া আদিলার চোখ। সারারাত জেগে থাকার পরে আহনাফ যখন আসলো কেবিনে আদিলা তখন বাচ্চাটাকে কোলে দিয়ে বলে ” মা এটা তোমার মামা! তুমি তার কাছে থাকবে। আহনাফ কখনো বাচ্চা পছন্দ করতো না। অথচ বোনের মেয়ে পেয়ে আনন্দে আত্মহারা সে।”
নিজের জীবনের শেষ হয়তো বুঝতে পেরেছিলো আদিলা। আহনাফের হাত জড়িয়ে সেদিন কেঁদে বলেছিলো আমার বাচ্চাটাকে দেখিস ভাইয়া। ওর বাবার কাছে দিসনা। লোকটা একটা জানোয়ার! আচ্ছা তুই কী আমায় মিস করবি? আমি তোকে ছাড়া অন্ধকার ঘরে থাকবো কী করে ভাইয়া? আমার বেবিটা কাকে মা বলে ডাকবে?আদিলার কথা শুনে আহনাফের অস্থির লাগতে শুরু করলো। আদিলাকে চুপ করতে বললো কিন্তু জীবনের শেষ মুহূর্তে মাকে কাছে টেনে আদিলা বললো, তোমার আদরের মেয়েকে বুঝে শুনে বিয়ে দিতে মা। আমি ভীষণ মিস করবো তোমায়। আমায় ওই অন্ধকার ঘরে কে খাইয়ে দিবে মামনি? ওখানে কেউ তো আমায় সাথে থাকবে না। আমার যে ভীষণ কষ্ট হবে। নিঃশ্বাস আটকে তো মরেই যাবো। উপস মরার পরে তো কেউ মরে না। আমার জন্য দোয়া করো মা। শেষ মুহূর্তে বাবার কোলে মাথা রেখে বাচ্চাকে বুকে নিয়ে, আদরের ভাইয়ের হাত ধরে মায়ের ছায়াতলে শেষ নিঃশ্বাস ছাড়লো আদিলা।
চলবে,,,,,
#-সেই তুমি
#-সানজিদা সন্ধি
#-পর্ব-১৩
আদিলার কথা শুনে আহনাফের মনে হচ্ছিলো সে যেন জলন্ত অগ্নিকুণ্ডের উপর রয়েছে। সেই সাথে তার মায়ের উপর রাগটাও যেন ভীষণ বাড়তে লাগলো তার। ” আপা তোর মেয়ের সাথে আমার ছেলের বিয়ে দেবো! ” কথাটা কিছু কিছু পরিবারে প্রযোজ্য হয়ে থাকে। দুই পরিবারের ইচ্ছার জন্য বলি হতে হয় ছেলে, মেয়ে বা উভয়কেই। যেখানে দুজনের কারো ইচ্ছাই থাকে না। আহনাফ ভেবে পায় না তার মা কীভাবে আদিলা এবং তাদের সকলের ইচ্ছার বিরুদ্ধে যাওয়ার সাহস দেখিয়েছে। আদিলার কন্ঠস্বর শুনতে না পেরে আহনাফ ভেবেছে সে বুঝি ঘুমিয়েছে। কিন্তু আতিয়া চৌধুরী আদিলার শরীর স্পর্শ করেই চমকে ওঠে। নির্বাক হয়ে যায় তিনি৷ আবির আতিয়ার মুখের দিকে তাকাতেই কিছু বুঝে যায়। অতঃপর পুরো একটি পরিবার নিঃস্তব্ধ। আদরের মেয়েকে হারিয়ে বাবা-মা মৃতপ্রায়। আর আহনাফ নিশ্চুপ। আদিলার সামান্য হাত কেটে গেলেও আহনাফ পাগল হয়ে যেতো৷ সারা বাড়ি মাথায় করে ফেলতো। অথচ সেই আদিলাই আজ পৃথিবীতে নেই। সে আর কখনো গুটিগুটি পায়ে পেছন থেকে এসে আহনাফকে চমকে দেবে না। আহনাফের মাথা ব্যাথা হলে কখনো মাথায় হাত বুলিয়ে দিবে না। আদিলা কখনো আর ভাইয়ের কাছে কিছু নিয়ে আবদার করবে না। আহনাফ চাইলেও আদিলার প্রাণবন্ত মিষ্টি হাসিটা কখনো দেখতে পারবে না। আর না শুনতে পাবে আদিলার কথা। আহনাফের এখন ভীষণ কান্না করা উচিৎ। কিন্তু আহনাফের চোখ থেকে পানি পড়ছে না। যেন কিছুই হয়নি। সব ঠিক আছে। আদিলার মৃত্যুর খবরে বন্ধু বান্ধব, আত্মীয় স্বজন সবাই স্তব্ধ, শোকাহত। আবির চৌধুরী এবং আহনাফ আদিলার দাফন কার্য সম্পন্ন করে এসেই অসুস্থ হয়ে পড়লো। আদিলার বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে আহনাফ এক পলকে চেয়ে আছে। কী ফুটফুটে একটা বাচ্চা। নরম নরম হাত পা। যে কেউ দেখলেই আদর করতে চাইবে। সেই বাচ্চাটাই কখনো মায়ের ভালোবাসা পাবে না ভেবেই আহনাফের চোখ ঝাপসা হয়ে এলো। এতো কিছুর পর বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে আহনাফ ডুকরে কেঁদে উঠলো তার দিকে অপলক চেয়ে বিড়বিড় করে বলতে লাগলো আদিবা তোমার মামা ভীষণ পঁচা তাইনা? তোমার মাকে ঠিক রাখতে পারলোনা। আবির চৌধুরী মামা ভাগনীর কথা শুনে কাছে এসে আবিরকে জড়িয়ে হু হু করে কাঁদতে আরম্ভ করলো। সব কান্নারা যেন আজ বাঁধ ভেঙেছে। আহনাফকে তিনি বললেন,” বাবা আল্লাহ যা করে ভালোর জন্যই করে। এটা ভাগ্যে লেখা ছিলো।”
দীর্ঘশ্বাস ফেললো আহনাফ। দুধের শিশুর কাছ থেকে তার মা হারিয়ে যাওয়ার মধ্যে কোন ভালোটা আছে বুঝতে পারলোনা সে।
এরপর কেটে গেলো বেশ কয়েকমাস। মৃত্যুর শোক আস্তে আস্তে সবাই কাটিয়ে উঠেছে। তবুও হুটহাট আদিলার স্মৃতি মনে হলে প্রত্যেকের বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে ওঠে। আদিবা আ উ করে কী যেন বলার চেষ্টা করে । আতিয়া চৌধুরী তাকে আগলে রাখে। রাতটা সে মামার সঙ্গেই কাটায়। আর মেয়েটাও এতো লক্ষ্মী হয়েছে! কাউকে জ্বালায় না। আদিবার জন্মের একবছর এবং আদিলার প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীর দিন মামার কোলে চুপটি করে আছে আদিবা। এই একবছরে আহনাফের বেঁচে থাকার কারণ হয়ে উঠেছে সে। একদিকে অদিতি আরেক দিকে আদিলা দুজনকে হারিয়ে মৃতপ্রায় আহনাফের বেঁচে থাকার ইচ্ছে যেন আদিবার জন্যই। আদিবার খিলখিলিয়ে ওঠা। নরম নরম হাত দিয়ে আহনাফের চুল টানা। গালে হামি খাওয়া, আধো আধো কথা সবকিছুই তার বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা। আদিলার মৃত্যুবার্ষিকীতে গ্রামের বাড়িতে সবাই এসেছে। গ্রামের গরীব দুখীদের খাওয়াতে। বিশাল এক বাড়ি আহনাফদের। সারাদিন নিজের কাছে আদিবাকে রাখলেও কিছুসময়ের জন্য আতিয়া চৌধুরীর কাছে তাকে দিয়ে আহনাফ কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। উঠানে সব মহিলাদের সাথে ছিলো আতিয়া। মেয়ের মৃত্যুর স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে পাগলপ্রায় অবস্থা তার। এদিকে গ্রামের এক বাচ্চা কখন আদিবাকে নিয়ে গেছে টেরও পাননি তিনি। আদিবাকে নিয়ে পুকুরপাড়ের কাছে যেতেই হোটচ খায় বাচ্চাটি আর তার কোল থেকে আদিবা পুকুরে। সেই বাচ্চাটি সবার ভয়ে কাউকে বলে না আদিবা পুকুরে পড়েছে। আর এদিকে ছোট্ট আদিবা পানি খেতে খেতে মৃতপ্রায়। নিঃশ্বাস আর ধরে রাখতে পারে না সে। হয়তো আদিবা অনেক বাঁচতে চেয়েছিলো। মামার সাথে থাকতে চেয়েছিলো। ইস! ছোট্ট আদিবার কত কষ্ট হয়েছে। ছোট্ট প্রাণটা কীভাবে ছটফট করেছে। আহনাফ এসে আতিয়ার কাছে আদিবাকে দেখতে না পেরে পাগলপ্রায় হয়ে পড়ে। সারা গ্রাম খোঁজে। অবশেষে আদিবার ছোট্ট শরীরটা পাওয়া যায় পুকুরে। কেমন ফ্যাকাসে, নির্জিব। পেটটা ফুলে আছে। লাল রঙের জামাটা শরীরে লেগে আছে। আদিবাকে কোলে নিয়ে গগনবিদারী চিৎকার করে ওঠে আহনাফ। একবছর আগে নিজের বোনকে হারিয়ে এই সাত রাজার ধনটাকে পায় সে। অথচ একবছর ঘুরতেই তাকেও হারিয়ে ফেলে আহনাফ। আদিবার কথা বারবার ভাবতেই সে অজ্ঞান হয়ে পড়ে। ছোট্ট আদিবাকে দাফন করা হয়। আদিবাকে কবরে শোয়ায়ে এসে প্রলাপ বকতে থাকে আহনাফ। বলে, মা মেয়ে কতো স্বার্থপর তোরা। আমাকে ছেড়েই আল্লাহর কাছে চলে গেলি? আমি তোদের কাছে যাবো। কিন্তু হুস উঠতেই বাঘের মতো হিংস্র হয়ে ওঠে আহনাফ। আতিয়া চৌধুরীর কাছে গিয়ে তাকে যা নয় তাই বলতে থাকে। রাগ সামলাতে না পেরে তার গলা চিপে ধরে। সবাই তাকে শান্ত করতে হিমশিম খায়। সেই বাচ্চাটাকে খুঁজে বের করে আহনাফ কিন্তু কিছু বলে না। সেদিন থেকে দীর্ঘদিন আতিয়ার সঙ্গে কথা বলেনি আহনাফ। নিজের ভেতরের জেদ বাড়িয়ে সে নিজের মতো কাজ করে যায়। আতিয়াও কখনো আহনাফের মুখোমুখি হয়নি। কোন মুখে যেতো সে? আর আহনাফ জেদ করে তার সাথে কথা না বললেও সে কেন আহনাফের খোঁজ নেয়নি সেই ক্ষোভ মনে পুষেছে আহনাফ।
অতীতের স্মৃতিচারণ থেকে ফিরে আতিয়া একদৃষ্টিতে সিলিং এর দিকে তাকিয়ে রইলো। এদিকে আহনাফের ঘর থেকে ক্রমাগত ভাঙচুরের শব্দ আসছে। আহনাফ বরাবরই অ্যাগ্রেসিভ ধাঁচের ছেলে। তবে দিনদিন তার অ্যাগ্রেসিভনেস যেন ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। এখন ইচ্ছে মতো জিনিস ভাঙচুর করে একপর্যায়ে শান্ত হবে সে।
জাফনার মাথায় একটা জিনিস অনেকক্ষণ থেকে ঘুরছে। আহনাফের মতো হ্যান্ডসাম ছেলে এতো তাড়াতাড়ি বাবা হতে চলেছে? আর তার মতো রাগী দৈত্যকে বিয়ে করেছেই বা কে? আচ্ছা মেয়েটা কী করে সংসার করছে এরকম লোকের সাথে? জাফনা একবার ভাবলো প্রিন্সিপাল স্যারকে ফোন করে আহনাফের বিষয়ে সত্যিটা জানবে। পরে ভাবলো জাহিন কী তাকে মিথ্যা বলবে না কি? এই ভেবে আর সে কোনো খোঁজ নেয়নি। তবে আহনাফের ট্রান্সফার না করালেও তাকে যে জব্দ করবেই জাফনা। বাসার অন্য নম্বর থেকে আহনাফকে কল দিলো জাফনা।
এদিকে ঘরে ভাঙচুর করতে ব্যাস্ত আহনাফ। ফোনের শব্দ পেয়ে সে ভাঙচুর বন্ধ করলো। দরকারি কল ভেবে রিসিভও করলো। কিন্তু ওপাশ থেকে আসা কন্ঠস্বর শুনেই আহনাফের মেজাজ বিগড়ে গেলো৷ এটাতো জাফনার কন্ঠ৷ জোর করে অন্যরকম গলায় কথা বলতে চেষ্টা করছে সে। কিন্তু আহনাফ ধরে ফেলেছে। আহনাফ বড্ড দোটানায় পড়ে গিয়েছে জাফনাকে নিয়ে। একবার তার মনে হয় জাফনা বুদ্ধিমতী আর একবার মনে হয় জাফনার মাথায় গোবর ছাড়া কিছুই নেই। যেটা এখন মনে হচ্ছে তার। তারপরেও নিজের মেজাজ সামলে জাফনার সাথে কথা বলা শুরু করলো। জাফনা ওপাশ থেকে কন্ঠস্বর আলাদা করে চেষ্টা করে বললো, ” হাই দোস্ত! কী খবর? ” আহনাফ কিছুই বুঝতে পারে নি এমন ভাব করে বললো, ” সরি! কে আপনি? আমাকে কেন দোস্ত বলছেন?”
আহনাফের উত্তর শুনে জাফনার প্রচুর হাসি পেলো! যদিওবা হাসি পাওয়ার কোনো কথা নয় তারপরও হাসি পেলো। জাফনা বললো,”আরে তুই আমারে ভুলে গেছিস? তোর বত্রিশ নম্বর গার্লফ্রেন্ডের সঙ্গে ব্রেকাপ হওয়ার পরে যখন ছ্যাকা খেয়ে অপরাধী গান গাইছিলি আর তোর গানের গলা শুনে কুকুর তোকে তাড়া করেছিলো তখন তো আমিই তোকে সাহায্য করেছিলাম! ছি বন্ধু ছি। ভুলে গেলি আমায়?”
আহনাফ এবার বড্ড বেশি দোটানায় পড়ে গেলো। এই মেয়ে কী আসলেই কোনো সুস্থ আছে? কীসব বকছে সে!
চলবে,,
গঠনমুলক মন্তব্যের অনুরোধ রইলো 🙂