শেষ পাতায় তুমি পর্ব-১৪+১৫

0
4131

#শেষ_পাতায়_তুমি(Revenge Story)
#ফাবিহা_নওশীন

|পর্ব-১৪|

বিছানার উপর ফায়াজের ফোনের রিংটোন বাজতে বাজতে ক্লান্ত হয়ে থেমে গেছে। মেহের একবার আড়চোখে ফায়াজের দিকে তাকাচ্ছে আরেকবার ফোনের দিকে। মেহের দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে
বিছানার উপর থেকে ভাজ করা কাপড়গুলো আলমারিতে রাখতে গেল। আলমারিতে কাপড় রাখতেই আবারও ফোনটা বেজে উঠলো। মেহেরের ভ্রু কুচকে এলো। বিরক্ত লাগছে ফোনের রিংটোন শুনতে। ফায়াজ ফোন রিসিভ করছে না কেন?

মেহের নরম গলায় বলল,
“কলটা রিসিভ করুন না। ফাইজা আপু কখন থেকে ফোন দিচ্ছে। বোনের উপর কেউ এত অভিমান করে?”

ফায়াজ মেহেরের দিকে সরু চোখে তাকিয়ে বলল,
“এখন তোমাকে বলতে হবে আমি কি করব না করব? লাইক সিরিয়াসলি?”

মেহের বুঝে গেল একে বুঝিয়ে লাভ নেই।
ফোন বাজতে বাজতে আবারও ক্লান্ত হয়ে গেল। কিছুক্ষণ পরে দরজায় টুকা পড়ল। ল্যান্ডলাইনে ফোন এসেছে। মেহের ফায়াজের দিকে তাকাল। ফায়াজ মেহেরের দিকে তাকিয়ে বিরক্তি নিয়ে নিচে গেল। মেহেরের মনে হচ্ছে ফাইজাই ফোন দিয়েছে।

ফায়াজ ল্যান্ড লাইনে হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে বলল,
“ভাইয়া ফোন কাটবে না। আমার কথা শুনো। না শুনলে আমি দেশে আসতে বাধ্য হবো। তুমি জানো আমার পরীক্ষা চলছে। এখন দেশে যাওয়া মানে আমার পড়াশোনার ক্ষতি।”

ফায়াজ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
“আমি ভিডিও কল দিচ্ছি।”

ফাইজার ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটল।

ফায়াজ উপরে এসে ল্যাপটপ নিল। মেহের আড়চোখে ফায়াজের কাহিনী দেখছে।
ফায়াজ ফাইজাকে কল দিল।
স্কিনে ফায়াজকে দেখা মাত্রই ফাইয়া বলল,
“ভাইয়া তুমি আমার সাথে এমন করছো কেন? আমাকে বিষয়টা এক্সপ্লেইন করার তো সুযোগ দিবে।”

ফায়াজ গম্ভীরমুখে বলল,
“বল।”

ফাইজা দম নিয়ে বলল,
“আমি কিছুই জানতাম না। মম হুট করে ঘরে চলে আসছে। আমি একদম খেয়াল করি নি। মম সাধারণত এই সময় আমার রুমে আসে না। ওইদিন হুট করে চলে আসছে। আর তোমাকে দেখে তোমার সাথে কথা বলার জন্য আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ে। এখানে আমার দোষ কোথায়? তুমি তো আর কথা বলো নি। আর আমিও বলি নি কথা বলতে। তাহলে আমার উপর রাগ করছো কেন?”

“কিন্তু তোর খেয়াল রাখা উচিত ছিল। তোকে আমি আগেই বলেছি।”

“সরি ভাইয়া প্লিজ। আর হবে না। এইবারের মতো ভুলে যাও। প্লিজ।”

“আচ্ছা যা। পরবর্তীতে এমন হলে তোকে আর ক্ষমা করব না।”

ফাইয়া উৎফুল্ল হয়ে বলল,
“ডান। এখন তাড়াতাড়ি আমার আইসক্রিম দেও।”

দু’জনে খুনসুটিতে মেতে উঠেছে। মেহের কাহিনি কিছুই বুঝতে পারছে না। এই ফ্যামিলির কোনো একটা রহস্য আছে। ফায়াজের বাবা দু’দিনও বাসায় থাকে না। তাই তার সাথে কথা বলা হয়ে উঠে না। একমাত্র ফাইজার কাছ থেকে সবটা জানতে পারবে। কিন্তু ফাইজার সাথে তেমন কথা হয় না। ফায়াজ কথা বললে তখন হাই হ্যালো বলে। মেহের কাজের বাহানায় ওদের আশেপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে যাতে ফাইজার চোখে পড়ে আর ফাইজা ওর সাথে কথা বলতে চায়।
তাই মেহের বারবার হাটাহাটি করছে। অবশেষে ফাইজার চোখে পড়ল মেহের।

“ভাইয়া, ভাবির সাথে কথা বলব। ভাবির সাথে কথা হয় না অনেকদিন। ভাবির কাছে তোমার নামে বিচার দিব।”
ফায়াজ বোনের কথা শুনে মনে মনে হাসছে। মেহেরের কাছে নাকি ওর নামে বিচার দিবে। যে ওকে জমের মতো ভয় পায়।

মেহেরের সাথে ফাইজা কথা বলছে।
“আপু ভালো আছো?”

ফাইজা মেহেরের মুখে আপু শুনে বলল,
“আপু!! আমি আপু! ভাবি তুমি কি বললে এটা? তুমি আমার বড় ভাইয়ের বউ। আমি তোমার একমাত্র ননদ। আর আমাকে আপু বলছো? আমি তোমার সমবয়সী। আমাকে নাম ধরে তুমি করে বলবে। ফাইজা আমার নাম। ভাইয়ার নামের চেয়ে সুন্দর। আমার নাম ধরে ডাকবে বুঝেছো?”

মেহের মৃদু হেসে বলল,
“হ্যা বুঝেছি।”

“আর হ্যা ভাইয়ার নামে বিচার আছে। তুমি ভাইয়াকে একটু বকে দেবে। আমার সাথে শুধু শুধু রাগ করে।”

মেহের মনে মনে বলছে, “আমি বকতে গেলে আমার হাড়-হাড্ডি থাকবে?”

তারপর নানান কথা বলছে। কিন্তু ফায়াজ রুম থেকে সরছে না। আশেপাশে হাটছে। মেহের কি বলে সবটা শুনছে। মেহের যেন ফাইজা ওদের ব্যাপারে কিছু না বলতে পারে তাই মেহেরকে একা ছাড়ছে না। আর মেহের বারবার সুযোগ খুজছে ওদের ফ্যামিলিতে কি প্রব্লেম সেটা জিজ্ঞেস করার জন্য। কিন্তু ফায়াজ সেই সুযোগ দিচ্ছেই না। মেহেরের বিরক্ত লাগছে।

মেহের অনেক ভেবে ফাইজাকে বলল,
“আচ্ছা তুমি বাড়িতে আসো না কেন?”

“ভাবি পড়াশোনার অনেক চাপ। পরীক্ষা শেষ হোক তারপর আসব।”

মেহের ঠোঁট কামড়ে ভাবতে লাগল কি করে ওদের মায়ের কথা জানা যায়।

“আপু তুমি থাকো কই? আমার মনে হচ্ছে তুমি ঢাকা থেকে অনেক দূরে থেকে পড়াশোনা করো।”

ফাইজা মেহেরের কথা শুনে বিস্ময়ে হা করে রইল।
“ভাবি আমি মায়ের সঙ্গে ইতালি থাকি। আমি আর মা মামাদের সাথে থাকি। তোমাকে ভাইয়া বলে নি?”

মেহের মাথা নাড়িয়ে বলল,
“না আমি আজই জানলাম। তুমি নাহয় পড়াশোনার জন্য থাকো কিন্তু আন্টি মানে মা….”

ফায়াজ পেছন থেকে ফাইজাকে ইশারা করল কিছু না বলতে।

ফাইজা বুঝতে পারে নি ফায়াজ মেহেরকে কিছুই জানায় নি ওদের ব্যাপারে। এখন তো বলে ফেলে নিজেই ভয় পাচ্ছে। ফায়াজ না আবার রাগ করে কথা বলা বন্ধ করে দেয়।
ফাইজা আমতা আমতা করে বলল,
“আসলে আমিই জোর করে নিয়ে এসেছি। আমি একা থাকতে পারব না তাই।”
তারপর জোরপূর্বক হাসল। মেহেরের কাছে ফাইজার কথা বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছে না। পেছনে ফায়াজকে দেখে আর বুঝতে বাকি রইল না।

মেহের স্নিগ্ধ হেসে বলল,
“তাহলে পড়াশোনা করো ভালো মতো। নিজের খেয়াল রেখো। শরীরের যত্ন নিও। ভালো থেকো।”

ফাইজা, ফায়াজের দিকে একবার চেয়ে কল কেটে দিল।

ফায়াজ মেহেরকে বলল,
“তোমার জানা হয়েছে সব? এত খুটে খুটে প্রশ্ন করো কেন?”

“আমি জাস্ট জানতে চাইলাম ফাইজা কোথায় থাকে। খুটে খুটে প্রশ্ন করলাম কই?”

“তুমি বেশি কথা বলো।”

মেহের মনে মনে বলল,
“বেশি কথা তো তুই বলিস শয়তান ছেমড়া।”

.

মেহের এতটুকু তো জানতে পেরেছে ফাইজা আর শাশুড়ী মা ইতালি প্রবাসী। ওরা মামাদের সাথে থাকে। এর মানে কিছু একটা কারণ আছে। যে কারণে আলাদা থাকে। কিন্তু জিজ্ঞেস করবে কাকে। মেহের এসব ভাবতে ভাবতে চুল আঁচড়াচ্ছে ড্রেসিং টেবিলের সামনে। একজন সার্ভেন্ট দরজার ওকে খাওয়ার জন্য কখন থেকে ডাকছে। কিন্তু মেহেরের সেদিকে ধ্যান নেই। সার্ভেন্ট অবাক হয়ে মেহেরের দিকে তাকিয়ে আছে। মেহের কোথায় হারিয়ে গেছে?

ফায়াজ ওই সময় রুমে ঢুকে সার্ভেন্টকে মেহেরের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে। ওর মাথায় যেনো ধপ করে আগুন জ্বলে যায়। সার্ভেন্টের সামনে গিয়ে গলা খাকারি দিয়ে ভ্রু উঁচিয়ে বলল,
“এখানে কি চাই?”

সার্ভেন্ট হকচকিয়ে যায়। ঢোক গিলে বলল,
“মেমকে খাওয়ার জন্য ডাকতে এসেছিলাম।”

ওদের কথোপকথন শুনে মেহেরের ঘোর ভাঙলো। মেহের দ্রুত উঠে দাঁড়াল।
ফায়াজ চোখ মুখ শক্ত করে বলল,
“ডাকা শেষ হয় নি? কতদিনের মেয়াদে ডাকতে এসেছো?”

সার্ভেন্ট আমতা আমতা করে বলল,
“আসলে মেম শুনছিলেন না।”

ফায়াজ চিতকার করে বলল,
“শুনে নি চলে যাবে। এভাবে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কি দেখছিলে?”

মেহের ফায়াজের কথা শুনে কিছুই বুঝতে পারছে না। সার্ভেন্ট প্রচন্ড ভয় পেয়ে যায়।
“স্যার আপনি যেমন ভাবছেন তেমন নয়। আমি মেমকে অনেক বার বলেছি কিন্তু তিনি শুনছিলেন না। শুধু এটুকুই। এছাড়া আর কিছু না।”

ফায়াজ নিজের দিকে দু আঙুল দিয়ে বলল,
“আমাকে অন্ধ মনে হচ্ছে? আমি দেখি নি?”

সার্ভেন্টের নজর খারাপ ছিল না। সে তো মেহেরকে দেখে অবাক হচ্ছিল।
তবুও চেয়ে তো ছিল তাই বলল,”সরি স্যার। আর এমন হবে না।”

ফায়াজ কড়া গলায় বলল,
“আজ থেকে এ বাড়িতে মেয়েদের বেডরুমে বয়েজ সার্ভেন্টের ঢুকা নিষেধ। ওর দিকে সবার রেস্পেক্টের দৃষ্টি থাকবে। গট ইট?”

সার্ভেন্ট মাথা নিচু করে বলল,
“জি স্যার। মনে থাকবে। আর এমন হবে না।”

ফায়াজ চুটকি বাজিয়ে বলল,
“নাও আউট।”

সার্ভেন্ট কোনো রকমে চলে গেল।

সার্ভেন্ট যেতেই মেহের ভয়ে ভয়ে বলল,
“কি হয়েছে? কিছু হয়েছে?”

ফায়াজ মেহেরের বরাবর দাঁড়িয়ে শক্ত কন্ঠে বলল,
“তুমি কোথায় ভাসছিলে? একটা ছেলে তোমার রুমে এসে দাঁড়িয়ে আছে আর তোমার খেয়াল নেই?”

মেহের মাথা নিচু করে নিচুস্বরে বলল,
“আমি খেয়াল করি নি।”

ফায়াজ মেহেরের থুতনি উঁচু করে বলল,
“পরবর্তীতে খেয়াল রাখবে৷ এ-সব আমার একদম পছন্দ না। এখন নিচে এসো।”

মেহেরের থুতনি ছেড়ে চুলের বিনুনি পেছনে দিয়ে বলল,
“আর হ্যা ওড়না জড়িয়ে আসবে।”

ফায়াজ মেহেরকে ছেড়ে মেহেরের দিকে চোখ কটমট করে তাকাল।
তারপর চলে গেল। ফায়াজ রুম থেকে বের হতেই মেহের নিশ্বাস নিল। ভয়ে এতক্ষণ কলিজা শুকিয়ে যাচ্ছিল। শ্বাস আটকে ছিল।তারপর দ্রুত বিছানা থেকে ওড়না নিল।
এতক্ষণ ওড়না ছাড়া দাঁড়িয়ে ছিল সার্ভেন্টের সামনে। ভাবতেই লজ্জায় মরে যাচ্ছে।

.

মেহের নিচে গিয়ে ফায়াজের খাবার বেড়ে দিচ্ছে। ফায়াজ আগেই নিয়ম করে দিয়েছে খাওয়ার সময় মেহের খাবার সার্ভ করবে আর কোনো সার্ভেন্ট থাকবে না। মেহের খাবার বেড়ে দিচ্ছে। ফায়াজ মুখ ভার করে খাবার খাচ্ছে। পুরোটা সময় কোনো কথা বলে নি। খেয়েদেয়ে এসে শুয়ে পড়ল। কোনো কথা বলে নি। ফায়াজ এমনিতেও মেহেরের সাথে কথা বলে না। যখন বলে তখন রাগারাগি করে,বকাবকি করে। ভালো মতো কথা কখনোই বলে না। কিন্তু মেহেরকে প্রতিটি কাজের জন্য ফায়াজ কথা শোনায়। আজ তাও করে নি।
ফায়াজ বুঝতে পারছে না মেহেরের প্রতি ওর কি হচ্ছে। কেউ মেহেরের দিকে তাকালে ওর কি। এমন কেন লাগে?

.

মেহের সকালে রেডি হয়ে নিজের মতো ভার্সিটিতে চলে যায়।
ভার্সিটিতে গিয়েই আলিফের সাথে মেহেরের ঝগড়া বেঁধে যায়। মেহের আলিফকে নানা কথা বলেছে। আলিফ মেহেরের হিজাব ধরে টানছে। মেহের আলিফকে দুই হাত দিয়ে মারছে। আলিফ মেহেরের দুহাত ধরে মার আটকাচ্ছে।
মেহেরও নিজের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করছে। ফায়াজ ওই মুহুর্তে বন্ধুদের নিয়ে হাজির। ফায়াজ প্রতিদিন মেহেরের ক্লাসরুমের সামনে চক্কর দেয়। কিন্তু বিষয়টি মেহেরের চোখে সব সময় পড়ে না। মেহের ফায়াজকে দেখে থমকে যায়। ফায়াজ ভ্রু কুচকে ওদের হাতের দিকে তাকাতেই আলিফ মেহেরের হাত ছেড়ে দেয়। ওর শরীর থরথর করে কাঁপছে। ফায়াজ না জানি আজ কি করে। মেহেরের হৃদপিণ্ডে হাতুড়ি পেটাচ্ছে।
ভয়ে ভয়ে ফায়াজের দিকে তাকাচ্ছে।

ফায়াজ আলিফের দিকে তাকিয়ে বলল,
“মেয়েদের হাত ধরে টানাটানি করা হচ্ছে? তুমি জানো কার হাত ধরে টানাটানি করছো?”

মেহের আলিফকে সেভ করতে বলল,
“ও আমার বন্ধু আলিফ। ও আমার হাত ধরে টানাটানি করছিল না। আমরা এমনিতেই দুষ্টুমি করছিলাম।”

ফায়াজ মেহেরের দিকে চোখ পাকিয়ে তাকাল। কেউ মেহেরের হাত ধরে টানাটানি করছে আর তাতে মেহেরের সম্মতি আছে সেটা ফায়াজ মেনে নিতে পারছে না। ফায়াজ চোখ বন্ধ করে দাঁতে দাঁত চেপে রাগ কন্ট্রোল করার চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না।
“মানুষ একটা কথা ঠিকই বলে। বড়রা যে পথে যায় ছোটরাও সে পথে যায়। তোমাকে আমি বারবার সাবধান করেছি। ক্লাস বাদে যেনো অন্য কিছুতে না দেখি। কিন্তু তুমি তো আমার কথা না মাহিকে অনুসরণ করবে। এক বোন হবু বর রেখে অন্য ছেলের সঙ্গে প্রেম করে বেড়ায় আর তুমি বর রেখে ছেলে বন্ধুর সাথে,,।”

ফায়াজ কথাটা যেনো কিভাবে বলল। মেহেরের শরীরে কাটার মতো বিধছে। মেহেরের চোখে পানি চলে এসেছে। আলিফ মেহেরের দিকে তাকাল। মেহেরকে অপবাধ দিচ্ছে। বাড়িতে নিয়ে না জানি কি করে মেহেরের সাথে।
আলিফ তাই বলল,
“ভাইয়া আপনি ভুল ভাবছেন। আসলে দোষটা আমার। আমি ওকে রাগাচ্ছিলাম ইচ্ছে করে। আর তাই ও রাগ করে আমাকে মারছিল আর আমি ওর হাত চেপে ধরি। দোষটা আমার। আমি ওর হাত ধরেছি।”

ফায়াজ ওর কথা শুনে মেহেরের দিকে তাকিয়ে বলল,
“ও তোমার হাত ধরেছে। একটা ছেলে একটা মেয়ের হাত ধরলে তাকে শাস্তি দেওয়া উচিত। তাই তুমি ওকে শাস্তি দিবে।”

মেহের ফায়াজের কথা শুনে চমকে গেল। ভয়ে মুখ শুকিয়ে গেছে। ফায়াজের মেজাজ গতকাল থেকেই খারাপ সেটাই এখন ঝাড়ছে।
আলিফও ভয় পাচ্ছে।

ফায়াজ বাকা হেসে বলল,
“তুমি এই ছেলেকে সবার সামনে থাপ্পড় মারবে।”

মেহের ফায়াজের কথা শুনে বিস্ফোরিত চোখে তাকাল। তারপর বলল,
“কখনোই না। আমি ওকে ফুলের টোকাও দেব না।”

আলিফের চোখের কোনে পানি জমেছে। ফায়াজকে খুশি করার জন্য আলিফ এতেও রাজি। ও শুধু চায় মেহের সেভ থাকুক। ফায়াজ যেন মেহেরের সাথে খারাপ কিছু না করে।
ফায়াজ চোখ মুখ শক্ত করে বলল,
“তা দিবে কেন? তোমার তো কষ্ট হবে। হাতে হাত ধরে ঘুরে বেড়াতে পারলে খুশি।”

আলিফ মেহেরকে বলল,
“মেহের, তুই আমাকে থাপ্পড় মার। আমি তোকে বোনের চোখে দেখি। আমার বোন আমাকে মারলে আমি কিছু মনে করব না।”

মেহের রাগী কন্ঠে বলল,
“চুপ কর তুই। কোনো কথা বলবি না। আমি তোকে মারব না। আমাকে মেরে ফেললেও না।”

ফায়াজের শরীর রাগে জ্বলে যাচ্ছে। হাতের মুঠো শক্ত করে রেখেছে। মেহেরের জেদ মেনে নিতে পারছে না। মেহের এই প্রথম জেদ দেখাচ্ছে। অন্য ছেলের জন্য মায়া দেখাচ্ছে। কেন দেখাবে? ফায়াজের জন্য তো মায়া হয় না। ওর জন্য কেন হবে?

ফায়াজ মেহেরের হাত চেপে ধরে টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছে। আলিফ, ওলিদ, অনু আতংকিত চোখে চেয়ে আছে। আজ মেহেরের সাথে ফায়াজ কি করবে সেটা ভাবতেই কলিজা কেপে উঠছে।

চলবে……!

#শেষ_পাতায়_তুমি (Revenge story)
#ফাবিহা_নওশীন

|পর্ব-১৫|

ফায়াজ মেহেরকে রুমে এনে এক প্রকার ছুড়ে মারলো। মেহের ছিটকে পড়ে যেতে নিলেও সোজা হয়ে দাঁড়াল। ফায়াজ পা দিয়ে পেছনের দরজায় সজোরে লাথি মারল। দরজা বিকট শব্দে বন্ধ হয়ে গেল। এতো জোরে শব্দ হলো যে মেহের কেঁপে উঠল। কানে যেন তালা লেগে গেল। মেহের ভয়ে ভয়ে ফায়াজের দিকে তাকাচ্ছে। ফায়াজ শার্টের হাতা গোছাতে গোছাতে
মেহেরের দিকে এগুচ্ছে। মেহের ঢোক গিলে পেছনে যাচ্ছে। ফায়াজ আচমকা মেহেরের এক হাত ধরে টান মারল। তারপর হাতটা মেহেরের পিঠের সাথে চেপে ধরে ফিসফিস করে বলল,
“ভয় লাগছে? এখন ভয় পাচ্ছ? কিছুক্ষণ আগে তো বন্ধুদের সামনে গর্জে উঠেছিলে। একদম বাঘিনী।”

মেহের চোখ বন্ধ করে চোখের পানি ফেলছে। ঠোঁট ফুলিয়ে ফুপিয়ে উঠছে। আর ডান হাতে চোখের পানি মুছছে।
ফায়াজ মেহেরের ডানহাত চেপে ধরল বাম হাতে।

তারপর ধমক দিয়ে বলল,
“স্টপ ক্রায়িং। তোমার অনেক বড় স্পর্ধা হয়েছে তাই না? তুমি এতগুলো মানুষের সামনে আমার অবাধ্য হলে।”

মেহের তবুও কাঁদছে। চোখ মেলছে না। মেহেরের উত্তর না পেয়ে ফায়াজের আরো রাগ হচ্ছে। ফায়াজ মেহেরের হাত ছেড়ে দিয়ে ওর থুতনি ধরে উঁচু করে চেপে ধরল।
মেহের ব্যথা পেয়ে শব্দ করে কাঁদছে।
“আমার কষ্ট হচ্ছে খুব। খুব লাগছে।”

ফায়াজ বাকা হেসে বলল,
“আচ্ছা তাই নাকি? তখন মনে ছিল না?
আমার অবাধ্য হওয়ার সময় মনে ছিল না?”

মেহের কান্নারত অবস্থায় বলল,
“ও আমার ছোট বেলার বন্ধু। আমি ওর গায়ে কি করে হাত তুলবো?”

বন্ধু শব্দটা শুনে ফায়াজের রাগ আরো বেড়ে গেল। মেহেরের দুবাহু চেপে ধরে চিতকার করে বলল,
“এই মেয়ে তোর কিসের বন্ধু হ্যা? তোকে আমি বলি নি ক্লাস বাদে সব ভুলে যা। মাহির মতো হতে চাস? তোর আর পড়াশোনা করার দরকার নেই। আগামীকাল থেকে ভার্সিটি অফ।”

মেহের কান্নার বেগ বাড়িয়ে দিয়ে অনুনয় করে বলল,
“এটা করবেন না প্লিজ। আমি পড়াশোনা করতে চাই। আমি আর কারো সাথে মিশব না। কোনো ছেলের সাথে কথা বলব না। তবুও এমন করবেন না।”

কিন্তু ফায়াজের মায়া হলো না।
“ডানা আমি ছেটে দেব। তুই এই ঘরবন্দী হয়েই থাকবি। তোর বাইরে যাওয়া নিষেধ।”

ফায়াজ মেহেরকে ছেড়ে দিল।
মেহের দুহাত জোর করে বলল,
“এমন করছেন কেন আমার সাথে? আমি পড়াশোনা করতে চাই। বললাম তো আর এমন করব না। আমি আপনার সব কথা শুনব।”

ফায়াজ মেহেরকে পাত্তা না দিয়ে দরজার সামনে যেতেই মেহের কেঁদে কেঁদে চিতকার করে বলল,
“আপনি এটা করতে পারেন না।”

ফায়াজ আবারও মেহেরের সামনে এসে দাঁড়িয়ে শান্তভাবে বলল,
“পারি। আমি সব করতে পারি। আমার যা ইচ্ছে হবে আমি তাই করব৷ বিকজ আ’ম ইউর হাসব্যান্ড।”

মেহের ফায়াজের কথা শুনে কান্না থামিয়ে দিয়ে বলল,
“ইউ আর নট মাই হাসব্যান্ড। ভুলে গেলেন কি বলেছিলেন? আমরা ঘর ঘর খেলছি। ঠিক তাই। আমরা ঘর ঘর খেলছি। আপনি শখ করে আর আমি বাধ্য হয়ে। তার মানে এই না আপনি আমার উপর অধিকার দেখাবেন, আমার জীবন নিয়ে খেলবেন। আপনার যা ইচ্ছে হয় আপনি তাই করেন কিন্তু আমার বেলায় কেন অন্য নিয়ম? আপনি আপনার মতো আর আমি আমার মতো লাইফ লিড করব। যা খুশি করব। আমার হাজার বন্ধু থাকুক তাতে আপনার কি? এ নিয়ে তো আপনার মাথা ব্যথা হওয়ার কথা না। আপনার আমাকে বিয়ে করার উদ্দেশ্য তো অন্য কিছু। তাই আমি ওদের সাথে যা খুশি করবো,ঘুরবো,কথা বলবো,হাত ধরে ঘুরবো তাতে আপনার কি? আপনার এতো লাগে কেন?”

ফায়াজ এতক্ষণ দাঁতে দাঁত চেপে মেহেরকে সহ্য করলেও আর পারছে না। হাত ধরে ঘুরবো এই কথাটা কানে বাজছে। ফায়াজ রাগের মাথায় মেহেরকে সর্বশক্তি দিয়ে আচমকা থাপ্পড় মারল। মেহের এমন কিছুর জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না। বিছানায় ধপ করে পড়ে গেল। ওর মাথা যেন ভনভন করে ঘুরছে। কান ঝিম ধরে গেছে৷ গালটা যেন পুড়ে যাচ্ছে। মেহের গাল ধরে ভ্যা ভ্যা করে কেঁদে দিল। ফায়াজ মেহেরকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে গালে হাত দিয়ে বলল,
“বেশি বাড়লে ঝড়ে পড়ে যাবে। নেক্সট টাইম এত স্পর্ধা দেখিও না। তাহলে এই সুন্দর গালটা আর সুন্দর থাকবে না।”

মেহের তখনও ভ্যা ভ্যা করে কেঁদে যাচ্ছে। ফায়াজ ধমকে বলল,
“চুপ!! একদম চুপ।”

ফায়াজের ফোন বেজে উঠল। ফায়াজ পকেট থেকে ফোন বের করে দেখে মেহেরের মায়ের নাম্বার। ফায়াজ ফোন রিসিভ করে সালাম দিল।
“বাবা, আগামীকাল মাহি আর তূর্জ আসবে। তুমি মেহেরকে নিয়ে চলে এসো। এসো কিন্তু বাবা।”

ফায়াজ হাসিমুখে বলল,
“জি আন্টি আমরা আগামীকাল চলে আসব চিন্তা করবেন না।”

তারপর ফায়াজ মেহেরের দিকে তাকিয়ে বাকা হেসে বলল,
“শ্বশুর বাড়ি যাচ্ছি। তোমার আপু আসছে। রেডি থেকো।”

ফায়াজ রুমের বাইরে চলে গেল। মেহের চাপা কান্না কাদঁছে। আজকে অনেক বড় ভুল করে ফেলেছে৷ ফায়াজের মুখে মুখে কথা বলে ভুল করে ফেলেছে। ওর কথার অবাধ্য কেন হতে গেল? ওর উপর রাগ করে বাড়িতে গিয়ে আবার কোন তামাশা শুরু করে। নিজের উপর নিজের রাগ হচ্ছে।

.

মেহের চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। গালটা প্রচন্ড ব্যথা করছে। কিছুক্ষণ পর পর ফুপিয়ে উঠছে। ফায়াজের অনেক খারাপ লাগছে মেহেরকে মেরে। এত রাগ কেন উঠল? কেন মেহেরের মুখে অন্য কারো নাম সহ্য করতে পারে না? কেন মেহেরের দিকে কারো দৃষ্টি, কারো স্পর্শ মেনে নিতে পারে না? ফায়াজের অস্থির লাগছে।
“মানব মন খুবই অদ্ভুত। সে যে কি চায়, কিসে তার সুখ কিছুই বুঝতে পারে না। আর যখন বুঝতে পারে তখন আর পাওয়ার উপায়টা হয়তো থাকে না।”

ফায়াজ মেহেরের পাশে এসে বসে। মেহেরের লাল হয়ে ফুলে যাওয়া গালের উপর হাত বুলাল। হটাৎ মেহের চোখ খুলল। ফায়াজ সাথে সাথে হাত সরিয়ে মুখে কাঠিন্য এনে বলল,
“খাবে চলো।”

মেহের নরম গলায় বলল,
“আমি এভাবে নিচে গেলে সবাই প্রশ্নাত্মক দৃষ্টি নিয়ে আমাকে দেখবে। আমি খাব না।”

ফায়াজ কিছু না বলে নিচে চলে গেল। মেহের উঠে আয়নার সামনে গিয়ে দাড়াল৷ গালে হাত বুলিয়ে বিরবির করে বলছে,
“আসছে দয়া দেখাতে। আমার এত সুন্দর গালের কি অবস্থা করেছে। তুই একটা শয়তান,ইতর,বান্দর, উল্লুক, উগান্ডার সাদা হাতি, শেওরা গাছের পেত্নীর জামাই।(মেহের জিহবায় কামড় দিল)এইটা বাদ। শেওয়া গাছের পেত্নীর জায়গায় অন্য কিছু হবে। কিন্তু কি দেওয়া যায়?”

এ-সব ভাবতেই দরজা খোলে ফায়াজ রুমে ঢুকল। মেহের পেছনে ঘুরে ওকে দেখল। সাথে এক সার্ভেন্ট খাবার নিয়ে এসেছে। টেবিলের উপরে খাবার রেখেই চলে গেল।
ফায়াজ মেহেরের সামনে গিয়ে ওর হাত
ধরে ওয়াশরুমে নিয়ে গেল। তারপর কল ছেড়ে পানিতে হাত দিতেই দাঁতে দাঁত চেপে অদ্ভুত শব্দ করল। ফায়াজ রাগের মাথায় দেয়ালে ঘুষি মারে। তাতে হাত কিছুটা ছিলে গেছে। রক্ত জমে আছে। মেহের সেটা দেখে ফায়াজের দিকে তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিল। ফায়াজ পানি নিয়ে মেহেরের মুখে দিয়ে বলল,
“আমি তোমার সাথে রুড বিহেভিয়ার করতে চাই না কিন্তু তুমি বাধ্য করেছো। তাই পরবর্তীতে এমন কিছু করো না। এখন খেয়ে নেও।”

ফায়াজ ওয়াশরুম থেকে বের হতেই মেহের চোখ মুখ ধুয়ে বের হয়ে চুপচাপ খেয়ে নিল।

.

ফায়াজ,মেহের,মাহি আর তূর্জ মেহেরদের বাড়িতে ড্রয়িংরুমে বসে আছে। মেহের ফায়াজের দিকে একটু পর পর আড়চোখে তাকাচ্ছে। ফায়াজ হেলান দিয়ে বসে চুইংগাম চিবাতে চিবাতে কিছুক্ষণ পর পর মুচকি হাসছে। মেহেরের কেমন জানি লাগছে। তূর্জ এটা সেটা বলছে আর মাহি হু হা করছে। মাহি ফ্রি হয়ে কথা বলতে পারছে না। মাহি মেহেরের দিকে তাকাচ্ছে ক্ষনে ক্ষনে।
মাহি খাবার আনার বাহানায় উঠে গেল। তারপর তূর্জ মেহেরের দিকে মনোযোগ দিল।
“শালিকা খবর কি? হানিমুন টানিমুনে যাবে না?”

মেহের ভ্রু কুচকে বলল,
“ভাইয়া হানিমুন শব্দটা শুনেছি কিন্তু টানিমুন আবার কি?”

তূর্জ ওর কথা শুনে হা করে আছে। তারপর ফায়াজের দিকে তাকিয়ে বলল,
“ভাই, এই বাচ্চা মেয়ে নিয়ে সংসার করছো কিভাবে?”

ফায়াজ আফসোসের ভঙ্গিতে বলল,
“অনেক কষ্টে ভাই।”

মেহের মনে মনে আবার ফায়াজকে গালাগাল করছে।

মাহি চানাচুর দিয়ে ঝাল করে মুড়ি মাখিয়ে নিয়ে এসেছে। ফায়াজ মুড়ি মুখে দিয়ে দেখল অনেক ঝাল। তারপর মাহির দিকে তাকিয়ে দেখল নির্দ্বিধায় খাচ্ছে। ফায়াজের মাথায় চট করে কিছু একটা এল। তারপর বাকা হেসে বলল,
“আরে মাহি তুমি এত ঝাল খাওয়া শিখলে কবে? তুমি আগে ঝালই খেতে পারতে না। আমি সব সময় তোমার জন্য কম ঝাল দিয়ে ঝালমুড়ির অর্ডার দিতাম।”

মাহি ফায়াজের কথা শুনে তূর্জের দিকে তাকাল। তূর্জ মাহির দিকে প্রশ্নাত্মক দৃষ্টি নিয়ে চেপে আছে। মেহের ফায়াজের দিকে তাকাল। ফায়াজ মেহেরকে চোখ মারল।

চলবে…..!