#শেষ_পাতায়_তুমি(Revenge story)
#ফাবিহা_নওশীন
|পর্ব-২৬|
মেহের ভার্সিটিতে সবার সাথে গানের অনুশীলন করছে। কিন্তু ওর মন পড়ে আছে অন্যদিকে। গতকাল মুখ ফসকে ফায়াজকে যা বলেছে তারপর থেকে মন ভালো নেই। ঠিকমতো ঘুম হয় নি। মনে বারবার কু ডাকছে। আর আজ ভার্সিটিতে এসে ফায়াজের দেখা পায় নি। প্রতিদিন যেখানে গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকতেই ফায়াজের দেখা মিলে সেখানে আজ লাপাত্তা।
ফায়াজ আজ ইচ্ছে করে মেহেরের সামনে আসে নি। মেহেরের কথায় কষ্ট পেয়েছে খুব। দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে মেহেরকে দেখছে। মেহেরের কেন জানি বারবার মনে হচ্ছে কেউ ওকে দেখছে। ওর দিকে নজর রাখছে। মেহের কি মনে করে উঠে দাঁড়ায়। অনু আর সামিরা গানের অনুশীলন করতে করতেই মেহেরের দিকে তাকাল। মেহের হাতের ইশারায় বুঝালো যে আসছে। মেহের গুটিগুটি পায়ে দরজার সামনে গেল। ডানে-বামে দু’পাশে তাকিয়ে হতাশ হলো। কেননা ফায়াজ কোথাও নেই। বারান্দার ডান পাশে একটা মেয়ে হেঁটে হেঁটে আসছে। আর বাম পাশে দুটো ছেলে দাঁড়িয়ে গল্প করছে। মেহের ফিরে এলো।
ফায়াজ সিড়ি দিয়ে নামতে নামতে হাত ঝাড়ছে। মেহেরকে আসতে দেখে দ্রুত সরতে গিয়ে দরজার সাথে হাত লেগে কাটা জায়গায় নতুন করে ব্যথা পেয়েছে। সাদা ব্যান্ডেজের কিছু অংশ লাল হয়ে গেছে।
~ফ্ল্যাশব্যাক ~
ফায়াজ মেহেরের যাওয়ার পর পর গাড়ি স্টার্ট দেয়। মেহেরের শেষের কথাটা খুব লেগেছে। ফায়াজ গাড়ি চালাচ্ছে আর ভাবছে,
“এত ঘৃণা করো আমায় মেহের? আমার মৃত্যু কামনা করতে তোমার একটুকুও বাধঁল না। একটুও কষ্ট হলো না? আমি মরে গেলে তুমি খুব খুশি হবে?”
ফায়াজ স্টিয়ারিংয়ে সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে ঘুষি মারল। ফায়াজের হাত ফেটে রক্ত পড়ছে। প্রচন্ড ব্যথা করছে কিন্তু সেদিকে ফায়াজের একদম খেয়াল নেই। কেননা মনের ব্যথাটা যখন প্রকট সেখানে শরীরের ব্যথা তুচ্ছ। ফায়াজ একের পর এক ঘুষি মেরেই যাচ্ছে। আর হাত থেকে রক্ত ঝড়ছে।
ফায়াজ ভার্সিটির ক্যাম্প থেকে নতুন করে ব্যান্ডেজ লাগিয়ে নিল। পুরো দিন মেহেরের সামনাসামনি হয় নি। আর হবেও না।
.
মেহের আসরের নামাজ আদায় করে মাথার ওড়না সরিয়ে বিছানায় বসে। আর তখনই মেহেরের ফোন বাজছে। মেহের ব্যাগ থেকে ফোন বের করতেও ভুলে গেছে। ব্যাগ থেকে ফোন বের করতেই দেখল নাম্বারটা বিডির নয়। মেহের কিছুক্ষণ ফোনের দিকে তাকিয়ে থেকে ফোন রিসিভ করে সালাম দিল।
ওপাশ থেকে মিষ্টি কন্ঠ ভেসে এলো,
“ওয়ালাইকুম আসসালাম ভাবি। আমি ফাইজা বলছি।”
মেহেরের মনে হচ্ছে ফাইজা ফায়াজের কোনো খোঁজ দিবে। কিন্তু না। ফাইজা তো কুশল বিনিময়ের ধাপ পাড় করছে না।
“ভাবি, একটা কথা বলব?”
মেহের আগ্রহের সহীত বলল,
“হ্যাঁ, বলো।”
“ভাইয়াকে ক্ষমা করে দেও না ভাবি। সত্যিটা জানার পর ভাইয়ার উপর আমার অনেক রাগ হয়েছিল। আমি বিশ্বাস করতে পারি নি ভাইয়া তোমার সাথে এটা করেছে। ভাইয়া নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে। আর এটাও বুঝেছে ভাইয়া তোমাকে কতটা ভালোবাসে। আমি রোজ ভাইয়ার সাথে দেখা করতে যেতাম। সব সময় মন-মরা হয়ে থাকত। ভাইয়া না বললেও আমি বুঝতে পারতাম তোমাকে মিস করছে। আমি তাই রোজ ভাইয়ার সঙ্গ দেওয়ার জন্য ওর ফ্ল্যাটে যেতাম।”
মেহের কৌতূহলবশত জিজ্ঞেস করল,
“ওর ফ্ল্যাটে মানে? তোমরা এক সাথে থাকো নি?”
“কি যে বলো ভাবি? ভাইয়া আমাদের সাথে থাকবে, তোমার কি তাই মনে হয়? ভাইয়া মমের সাথে থাকবে? ভাইয়া যে এতদিন ইতালি ছিল সেটাও তো মম জানতো না। ভাইয়া প্রায়ই আমার সাথে দেখা করতে ইতালি আসত। তাই এখানে একটা ফ্ল্যাট নিয়েছিল। সেই ফ্ল্যাটেই একা থাকত। আমি যেতাম রোজ কথা বলতে, দেখা করতে। মমকে বলতে নিষেধ করায় মমকে আর জানাই নি। একবার তো দেখেছিলেই ভাইয়া কি রিয়েক্ট করেছিল। তাই ভয়ে আর জানাই নি।”
“তার মানে একা ছিল?”
“হ্যাঁ। একদিন তো এসে দেখি কি ভিষণ জ্বর। জ্বরে আবল-তাবল বকছে। তারপর দ্রুত জলপট্টি দিয়েছি। বারবার তোমার নাম করছিল জ্বরের ঘোরে। কি সব বলছিল। তখনই বুঝতে পারলাম ভাইয়া তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছে। তারপর সে ছুটে গেল তোমার কাছে।”
মেহের চুপ করে আছে। কি বলবে বুঝতে পারছে না।
ফাইজা আবারও বলল,
“দুদিন ধরে ভাইয়ার সাথে কথা হয় না। লাস্ট যেদিন কথা হয়েছিল ভাইয়া বলল তুমি নাকি পাত্তা দিচ্ছো না। প্লিজ ভাবি তোমরা দুজন আবারও এক হয়ে যাও। আমার অধিকার নেই তোমাকে জোর করার। আর তাছাড়া ভাইয়া যা করেছে আমার সাথে এমন হলে আমিও মেনে নিতে পারতাম না। তবুও বলছি ভেবে দেখো।”
মেহেরের মুখে কথা ফুটল,
“আচ্ছা ভেবে দেখব। তুমি ভালো থেকো।”
।
সামিরা ব্যাগ গুছানোতে ব্যস্ত। ওর নাচের দলের সাথে পার্লারে সাজতে যাবে। আজ ভার্সিটির প্রোগ্রাম। তাই ব্যাগে শাড়ি, অর্নামেন্ট সব গুছিয়ে রাখছে। হটাৎ চোখ যায় বিছানার উপর রাখা লাল শাড়ির দিকে। সামিরা কৌতূহল নিয়ে শাড়িটা খুলে।
সামিরা বিস্ময় নিয়ে মেহেরকে জিজ্ঞেস করল,
“এত সুন্দর শাড়িটা কার?”
মেহের আলতো হেসে বলল,
“আমার। কেমন? ”
সামিরার চোখে মুখে বিস্ময় ভাব নিয়ে বলল,
“অসাম। কে দিয়েছে? আন্টি?”
মেহের কি বলবে বুঝতে পারছে না। ফায়াজের নাম নিয়ে সামিরা কানের সামনে রেডিও বাজাতে থাকবে। মেহের তাই বলল,
“এছাড়া আর কে দিবে? মা-ই তো সব কিছু দেয় আমাকে।”
সামিরা বলল,
“হ্যাঁ তা ঠিক। তুই পরবি? ”
“হ্যাঁ। আমি তো আর তোদের সাথে নাচ করছি না। বাদ পড়ে গেছি। তোরা সবাই শাড়ি পরবি আর আমি পরব না তা হয়? তাই আমিও ঠিক করেছি তোদের সাথে শাড়ি পরব। হোক অন্য রকম।”
মেহের ফায়াজের জন্য শাড়ি পরবে। ফায়াজ যে ওর উপর রাগ করেছে বেশ বুঝতে পারছে। তাই শাড়ি পরবে।
মেহের শাড়ির সাথে হিজাব পরিধান করেছে। ফায়াজ যেমন চেয়েছিল ঠিক তেমন করে সেজেছে। সামিরা তার দলের সাথে ব্যস্ত। মেহের শুধু গান গাইবে। আর সেটাও ফায়াজের জন্য। সেদিন সিদ্ধান্ত নিয়েছিল আর গান গাইবে না। কিন্তু ফায়াজের জন্য সে সিদ্ধান্ত পাল্টে নিয়েছে। মেহের এদিক সেদিক ঘুরছে কিন্তু ফায়াজের দেখা নেই। বুঝতে পারছে না কোথায় আছে। আর এসেছে কি না। কাকে জিজ্ঞেস করবে তাও বুঝতে পারছে না। ফায়াজের বন্ধুদের কাছে জিজ্ঞেস করলেও জানা যায় কিন্তু মেহের সেটা করবে না। ফায়াজ জানতে পারলে কি ভাববে। প্রোগ্রাম শুরু হয়েছে অনেকক্ষন। কিন্তু ফায়াজকে একবারো দেখে নি। মেহেরের নাম এনাউন্স করা হবে কিছুক্ষণের মধ্যে গানের জন্য। কিন্তু মেহেরের ইচ্ছে করছে না।
ফায়াজকে না দেখতে পেয়ে ভালো লাগছে না।
মেহের আর না পেরে ফায়াজের বন্ধু তুষারের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। কিন্তু আমতা আমতা করছে। কিছু জিজ্ঞেস করতে পারছে না।
তুষার ব্যাপারটা বুঝতে পেরে বলল,
“ফায়াজের খোঁজ করছো?”
মেহের জোরপূর্বক হেসে বলল,
“না মানে..!”
তুষার মন খারাপ করে বলল,
“ফায়াজ আসে নি। ও অসুস্থ তাই।”
অসুস্থের কথা শুনে মেহেরের বুক ছ্যাত করে উঠল। সেদিন ফায়াজকে একটা অলুক্ষণে কথা বলেছিল। আর সেজন্য কি অসুস্থ হয়ে পড়েছে। মেহেরের চোখ ছলছল করছে। মেহের কোনো কথা না বলে চুপচাপ চলে গেল। স্টেজের সামনে যেতেই শুনতে পেল ওর নাম এনাউন্স করেছে আর সামিরা ওকে খোঁজছে।
সামিরা মেহেরের সামনে এসে বলল,
“এই মেহের, কোথায় গায়েব হয়েছিস? তোর নাম এনাউন্স করা হয়েছে।”
মেহের প্রতিউত্তরে বলল,
“আমি গান গাইবো না। আমি ফায়াজের বাড়িতে যাচ্ছি। উনি অসুস্থ।”
মেহের যেতে নিলে সামিরা ওর হাত চেপে ধরে বলল,
“পাগল হয়েছিস? আগে গান শেষ কর তারপর যা। আর ফায়াজ ভাই অসুস্থ তাতে তোর কি?”
মেহের চুপ করে গেল। ওদের কি করে বলে ফায়াজের জন্য ওর চিন্তা হচ্ছে।
“শোন, মানবতা বলেও একটা কথা আছে। আমি সেজন্য যাচ্ছি। তোরা বলিস আমি অসুস্থ হয়ে পড়েছি তাই চলে যাচ্ছি।”
মেহের সামিরাকে কিছু বলতে না দিয়েই চলে গেল।
.
মেহের ফায়াজের বাড়ির দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ভেতরে ঢুকতে পারছে না। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছে। একজন সার্ভেন্ট মেহেরকে দেখে হাসি মুখে দৌড়ে এল।
“মেম, আপনি? আসুন আসুন ভেতরে আসুন।”
মেহের সৌজন্যতার হাসি হেসে বলল,
“না মানে.. আসলে আমি ভেতরে যাচ্ছি। কিন্তু ফায়াজ কোথায়?”
“স্যার পুলসাইটে।”
মেহের কথা না বাড়িয়ে পুলের কাছে চলে গেল।
ফায়াজ হাঁটু অবধি প্যান্ট তুলে পা ভিজিয়ে বসে আছে। আর আনমনে কি জানি ভাবছে। মেহের ওকে দেখে হন্তদন্ত হয়ে বলল,
“আপনার কি হয়েছে?”
ফায়াজ আচমকা মেহেরের কন্ঠ শুনে চমকে যায়। দ্রুত ঘুরে তাকায়। মেহেরকে এখানে একদমই আশা করে নি।
“তুমি!!”
“হ্যাঁ, তুষার ভাইয়া বলল আপনি অসুস্থ।”
ফায়াজ ভ্রু কুচকে বলল,
“অসুস্থ! ”
ফায়াজ তারপর ভাবল তুষার হয়ত ইচ্ছে করে বলেছে। ফায়াজ মেহেরের চিন্তিত মুখ দেখে বলল,
“আমি অসুস্থ তাতে তোমার কি? তুমি ছুটে এসেছো কেন?”
মেহের দমে গেল। তারপর কাচুমাচু করে বলল,
“মানবতার খাতিরে।”
ফায়াজ মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে বলল,
“দেখা শেষ। এইবার যেতে পারো।”
মেহের ফায়াজের কথা শুনে ভাবছে চলে যাবে না দাঁড়িয়ে থাকবে। চলে যাওয়া উচিত। না গেলে যদি ফায়াজ রাগ করে। কিন্তু মেহেরের তো যেতে ইচ্ছে করছে না। ওর তো ফায়াজের সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে। মেহেরকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ফায়াজ মেহেরের হাত ধরে টান দিল। সাথে সাথে মেহের চিতকার করে উঠল।
“আমি পড়ে যাব। পড়ে গেলে ডুবে যাব। আমার ভয় করে। আমি সাঁতার জানি না।”
ফায়াজ মেহেরের হাত ধরে তবুও নিজের পাশে বসিয়ে দিল।
“আমি থাকতে তোমার ভয় কিসের? তুমি পড়বে না। আমি আছি না। আর পড়ে গেলে কি হাত গুটিয়ে বসে থাকব?”
মেহের ফায়াজের পাশে ভয় নিয়ে চুপ করে বসে আছে। সাঁতার না জানায় ভয় লাগছে কিছুটা।
ফায়াজ পানি থেকে পা তুলে বলল,
“আজকে না তোমার গান আছে।”
“ছিল তবে গাই নি। চলে এসেছি।”
“কিভাবে চলে এলে?”
“সামিরাকে বলতে বলেছি আমি অসুস্থ তাই অনুষ্ঠান ছেড়ে চলে গেছি।”
ফায়াজ মেহেরের কথা শুনে হাসছে মুচকি মুচকি৷
“মানুষ কখন মিথ্যা বলে জানো?”
মেহের বোকার মতো প্রশ্ন করল,
“কখন?”
ফায়াজ ঠোঁট কামড়ে হেসে বলল,
“প্রেমে পড়লে মেহেরজান, প্রেমে পড়লে।”
মেহের চোখ বড়বড় করে তাকাল ফায়াজের দিকে। ফায়াজ পানিতে আবারও পা ভিজিয়ে হাসছে।
চলবে……!
#শেষ_পাতায়_তুমি(Revenge story)
#ফাবিহা_নওশীন
|পর্ব-২৭|
ফায়াজ মেহেরের বিস্ময়ের মাঝেই উঠে দাঁড়াল। হাঁটু অবধি গুছানো প্যান্ট টেনে নামাচ্ছে। মেহের তখনও ঠায় বসে আছে। ফায়াজ মেহেরের হাত ধরে দাঁড় করালো। মেহেরও দাঁড়িয়ে গেল। ফায়াজ মেহেরকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে মেহেরের দিকে তাকিয়ে বাকা হেসে বলল,
“লুকিং সো মাচ হট।”
মেহের ফায়াজের দিকে চোখ বড়বড় করে তাকাল। তারপর নাক সরু করে বলল,
“আপনি ইদানীং অনেক আজেবাজে কথা বলেন। যা মুখে আসে তাই বলেন। লজ্জা শরম একদম নেই দেখছি। এক কথায় লুচু হয়ে গেছেন। ছিহ। আগে তো এমন ছিলেন না।”
মেহের ফায়াজের দিকে তাকিয়ে বেশ অবাক হলো। মনে হচ্ছে ফায়াজ কথাগুলো বেশ উপভোগ করছে।
ফায়াজ ভাবলেশহীন ভাবে কোমড়ে হাত দিয়ে এদিক সেদিক দেখছে। আর মেহের ফায়াজকে দেখছে। ফায়াজ আচমকা মেহেরের ডান বাহু চেপে ধরে টান মারল। মেহের ফায়াজের বুকে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। মেহের সরে যেতে নিলে ফায়াজ মেহেরকে দু’হাতে আগলে নেয়। ফায়াজের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে গেছে পুরোপুরি।
“কি বললে আগে এমন ছিলাম না? আগে তো আর এই মেয়ের প্রেমে পড়ি নি, ভালোও বাসিনি। এখন প্রেমে পড়ে এমন হয়ে গেছি। সব তোমার দোষ। দোষ যেহেতু তোমার, এর ফল তোমাকেই ভুগতে হবে। সিম্পল।”
ফায়াজ মেহেরের হাত ধরে ঘুরাতে লাগল। তারপর আবার নিজের কাছে। মেহেরের থুতনিতে হাত দিয়ে মুখটা উঁচু করে বলল,
“আমি বলেছিলাম না মেহের তুমি নিজেই একদিন আমার বাড়িতে আসবে। তুমি কিন্তু এসেছো। আমি নিয়ে আসি নি কিংবা ফোর্সও করি নি। তুমি যে আসবে সেটাও জানতাম না। তুমি এসেছো। নিজেই এসেছো।”
মেহের আবারও কিছু বলতে যাবে ফায়াজ মেহেরের হাত ধরে ঘুরাতে লাগল। ফায়াজের এমন ঘুরানোর ফলে মেহেরের সিক্স সেন্স বলছে ওর শাড়ি শেষ। ফায়াজ মেহেরের হাত ধরে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নাচ করছে। মেহের হটাৎ করে থেমে গেল।
মেহেরের থেমে যাওয়া দেখে ফায়াজ ভ্রু কুচকে তাকাল। মেহের দাঁত কেলিয়ে হেসে বলল,
“গলা শুকিয়ে গেছে। পানি খাব।”
ফায়াজ মেহেরের হাত ছেড়ে দিয়ে বলল,
“চলো ভেতরে চলো।”
“আমি যাচ্ছি বলে” মেহের দ্রুত পায়ে একাই ভেতরে ঢুকে গেল। কুচির জায়গায় হাত দিয়ে ধরে সিড়ি বেয়ে উপরে যাচ্ছে। ফায়াজের রুমে গিয়ে দরজা লক করে দিল। ফায়াজ ওর পেছনে পেছনে এসেছে। মেহেরের এমন কাজের আগামাথা কিছুই মাথায় ঢুকছে না। ফায়াজ দরজায় নক করে বলল,
“এই তুমি দরজা বন্ধ করলে কেন? কি করছো?”
মেহের পড়েছে জ্বালায়। কি বলবে আর এই শাড়ি নিয়ে কি করবে কিছুই বুঝতে পারছে না। কুচিগুলো বের করে আবারো গুজে নিল। কিন্তু শাড়ির নিচের দিকে কুচির ভাজ গুলো এলোমেলো হয়ে গেছে।
এর মধ্যে ফায়াজ আবারও ধাক্কা দিল দরজা। মেহের বিরক্তি নিয়ে বলল,
“দু মিনিট অপেক্ষা করতে পারেন না? আমার কাজ আছে। একটু অপেক্ষা করুন।”
ফায়াজ থেমে গেল। ফায়াজের মনে হচ্ছে মেহের ওয়াশরুম ব্যবহার করবে তাই ভেতরে গিয়েছে। লজ্জায় বলতে পারছে না। ফায়াজ দাঁড়িয়ে না থেকে নিচে চলে গেল।
মেহের মাথা চুলকাচ্ছে। কি করবে বুঝতে পারছে না। মেহের ফায়াজের আলমারি খুলল। ফায়াজের জামাকাপড় ছাড়া কিছুই নেই। থাকার কথাও না। কিভাবে থাকবে। মেহের তো কিছু রেখে যায় নি। মেহের তবুও কি মনে করে পাশের আলমারি খুলল। আলমারি খুলে ওর চোখ কপালে। পুরো আলমারি ভর্তি মেয়েদের জামাকাপড়। শাড়ি, লেহেঙ্গা, টপস, সেলোয়ার-কামিজ আর হিজাব। এগুলো কোথায় থেকে আসল। মেহের নিজের কিছুই রাখে নি এই বাড়িতে। প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিজের সাথে নিয়েছিল আর যাওয়ার আগে বাকি সবকিছু এনজিওতে পাঠিয়ে দিয়েছিল। তাহলে এগুলো কার? কিন্তু এ নিয়ে মেহেরের মাথা ঘামানোর সময় নেই। আপাতত শাড়ি চেঞ্জ করতে চায়। মেহের একটা ড্রেস নিয়ে চেঞ্জ করে আবারো হিজাব পরিধান করে নিল। তারপর দ্রুত নিচে নেমে গেল।
ফায়াজ সিড়ি দিয়ে মেহেরের নামার শব্দ পেয়ে ঘুরে তাকাল। মেহের সাদা রঙের একটা লং টপস আর জিন্স পরা, মাথায় আগের হিজাব। ফায়াজ মেহেরকে এভাবে দেখে উঠে দাঁড়ায়। মেহের ফায়াজের সামনে দাঁড়িয়ে এক হাতে আরেক হাত ঘষছে। ফায়াজ বুঝতে পারছে না মেহের ওর রুমে গিয়ে আলমারি খুলে ওর রাখা জামা পারমিশন ছাড়া পরে নিল। কিন্তু কেন?
মেহের কাচুমাচু করতে করতে বলল,
“শাড়ির কুচি খুলে যাচ্ছিল তাই উপরে গিয়েছিলাম ঠিক করতে কিন্তু পারছিলাম না। তাই আলমারিতে এই ড্রেস পেয়ে পরে নিয়েছি। এই ড্রেসগুলো কার? মেয়েদের জামাকাপড় আপনার রুমে কিভাবে?”
ফায়াজ আসল ঘটনা এখন বুঝতে পারল। তারপর আলতো হেসে বলল,
“আমার বউয়ের।”
মেহের বিস্ময় নিয়ে বলল,” বউয়ের মানে?”
ফায়াজ ভাবলেশহীন ভাবে বলল,
“বুঝলে বুঝপাতা, না বুঝলে ঘাসপাতা।”
মেহের মুখ বাকাল ফায়াজের দৃষ্টির আড়ালে। ফায়াজ দু’হাত ভাজ করে বলল,
“আমার রুমেও নিজেই গিয়েছো। দেখেছো তোমার ফিরে আসার সময় হয়ে গেছে।”
মেহের কথা ঘোরানোর জন্য বলল,
“আমাকে যেতে হবে। হোস্টেলে ফিরতে হবে। অনেক সময় পাড় হয়ে গেছে। আমি যাচ্ছি।”
ফায়াজ মেহেরের কথায় ক্ষিপ্ত হয়ে কিছু বলতে গিয়ে থেমে গেল।
“চলো তোমাকে হোস্টেলে ছেড়ে আসব।”
মেহের আগ বাড়িয়ে বলল,
“আমি একাই যেতে পারব।”
ফায়াজ ধমক দিয়ে বলল,
“পাকামো করতে হবে না। তোমাকে কেউ জিজ্ঞেস করেছে? আমি বলেছি দিয়ে আসব। চুপচাপ চলো।”
মেহের আর কথা বাড়ায় নি। ফায়াজের সাথে ফায়াজের গাড়িতে ওঠল। ফায়াজ গাড়ি স্টার্ট দেয়। মেহের চুপ করে বাইরে দেখছে আর আড়চোখে বারবার ফায়াজের দিকে তাকাচ্ছে। ফায়াজ সামনের দিকে তাকিয়ে গাড়ি চালাচ্ছে। হটাৎ ফায়াজের হাতের দিকে চোখ পড়ল মেহেরের। ফায়াজের ডান হাতে ব্যান্ডেজ করা।
মেহের আতঁকে উঠে বলল,
“আপনার হাতে ব্যান্ডেজ কেন? কি হয়েছে হাতে? কেটে গেছে নাকি? নাকি কোথাও ব্যথা পেয়েছেন?”
ফায়াজ হুট করে গাড়ি থামিয়ে দেয় এক পাশে। তারপর মেহেরের দিকে তাকিয়ে বলল,
“মরে তো যাই নি। মরে যেতে বলেছিলে তো। জাস্ট নিজেকে একটু কষ্ট দিয়েছি।”
মেহের ফায়াজের কথা শুনে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,
“কষ্ট দিয়েছেন মানে কি? কি করেছেন? আপনি এমন কেন করেন?”
মেহের ফায়াজের হাতের দিকে হাত বাড়িয়ে আবারও সরিয়ে নিল। ফায়াজ সেটা লক্ষ্য করে স্টিয়ারিং ছেড়ে দিয়ে গাড়ির গ্লাস বন্ধ করে দিল। মেহের সেদিকে দেখে ফায়াজের দিকে প্রশ্নাত্মক দৃষ্টি দিল। ফায়াজ মেহেরের দিকে আগাচ্ছে। মেহের পেছাতে পেছাতে গাড়ির দরজার সাথে মিশে গেছে। মনে হচ্ছে দরজা ভেদ করে বের হয়ে যাবে।
“আপনি এভাবে আমার দিকে আগাচ্ছেন কেন?”
ফায়াজ বাকা হেসে বলল,
“এই যে তুমি আমার বউয়ের জন্য কেনা জামা বিনা পারমিশনে পরে নিলে সেটা কি ঠিক করেছো?”
মেহের ভয়ে ভয়ে মাথা নাড়িয়ে না বোধক ইশারা দিল। ফায়াজ আবারও হাসল। মনে মনে বলছে,
“কি বোকা মেয়ে আর সাথে বোকার মতো উত্তর।”
ফায়াজ ডান গাল চুলকে বলল,
“তাহলে এর জন্য তো একটা শাস্তি পেতেই পারো।”
মেহেরের কাছে ফায়াজের ভাবসাব ভালো ঠেকছে না। তাই নড়াচড়া করতে করতে বলল,
“আমার কাছে আসবেন না।”
মেহের মুখ ঘুরিয়ে নিল অন্য দিকে। ফায়াজ মেহেরের মুখ নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলল,
“কি বলছিলে তখন? আমি লুচু হয়ে গেছি?”
মেহের দ্রুত মাথা নাড়িয়ে বলল,” না একদম না।”
ফায়াজ মেহেরের কথা শুনে ফিক করে হেসে ফেলল। তারপর মেহেরের ঠোঁটের নিচের তিলে শব্দ করে চুমু খেল। মেহের যেন ফ্রিজড হয়ে গেল। চোখ বড়বড় করে আছে। নড়তে পারছে না। একটা অদ্ভুত শিহরণ বয়ে গেল সাড়া শরীর জুড়ে। ফায়াজ থেমে থাকে নি। মেহেরের নাকের ডগায় আলতো করে ঠোঁট ছুইয়ে দিল। মেহের বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে। নিজের অজান্তেই চোখ বন্ধ করে নিল।
ফায়াজ সরে যাওয়ার পরেও মেহের চোখ বন্ধ করে আছে। ফায়াজ মেহেরের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে গাড়ি স্টার্ট দিলে মেহেরের টনক নড়ে। মেহের লজ্জায় অন্যদিকে ঘুরে গেল। সারা রাস্তা আর ফায়াজের দিকে তাকায় নি। হোস্টেলের সামনে গাড়ি থামতেই মেহের দ্রুত গাড়ি থেকে নেমে গেল। তারপর ফায়াজের দিকে না তাকিয়েই বলল,
“আসলেই একটা লুচু। লুচু নাম্বার ওয়ান।”
মেহের দ্রুত ভেতরে ঢুকে গেল। ফায়াজ সেখানেই বসে বসে হাসছে।
.
মাহি ওর ছেলে মিশানকে ঘুম পাড়িয়ে সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে আনমনে কি জানি ভাবছে। তূর্জ ল্যাপটপে অফিসের কাজ করছে। মাহিকে কিছুদিন যাবত আপসেট লাগছে। কি জানি ভাবে সারাক্ষণ।
তূর্জ মাহির পাশে এসে কখন বসেছে খেয়ালই করে নি।
“মাহি!”
মাহির ঘোর ভাঙল। মাহি তূর্জের দিকে তাকাল।
“মাহি, কি হয়েছে তোমার? কি ভাবো এত?”
মাহি লুকিয়ে বলল,
“কই? কিছু না তো।”
“মাহি তুমি কি কিছু লুকাচ্ছো? কি হয়েছে তোমার? আমাকে বলো।”
“তূর্জ, আমি অনেক আপসেট। কিন্তু কি নিয়ে আপসেট তুমি আমাকে জিজ্ঞেস করো না। আমি তোমাকে এখনি বলতে পারব না। তোমাকে বলব তবে আমার সময় প্রয়োজন। প্লিজ তূর্জ জোর করো না।”
তূর্জ বিষয়টা বুঝতে পারছে না। কিন্তু মাহিকে জোরও করতে পারছে না। আলতো হেসে বলল,
“ঠিক আছে যখন ইচ্ছে বলো। আমি তোমাকে প্রেসার দেব না। কিন্তু এভাবে মন খারাপ করে থেকো না। তুমি এখনো পুরোপুরি ফিট নও।”
মাহি আলতোভাবে হাসল। কিন্তু ওর মনের আকাশে যে কালো মেঘেরা ছেয়ে আছে তা দূর হচ্ছে না। মনে হচ্ছে দিন দিন বেড়ে চলেছে৷ সব ভারী লাগছে। জীবনটা বিষাদ লাগছে। কিছুই ভালো লাগে না। মানসিক যন্ত্রণা বেড়ে চলেছে। তূর্জকে কি করে বলবে? তূর্জ এত বিশ্বাস করে এত ভালোবাসে তাকে ঠকাচ্ছে এতদিন ধরে। তার সামনে কি করে বলবে সত্যটা।
ফায়াজ নিজের রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে বের হতেই দেখল বিছানার উপরে মেহেরের শাড়িটা সরানো। ফায়াজ শাড়িটা হাতে তুলে নিয়ে হেসে ফেলল।
“পাগলি মেয়ে। শাড়িটা ফেলেই চলে গেছে।”
ফায়াজ যত্ন করে শাড়িটা ভাজ করে আলমারিতে রাখল। আলমারির দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছে,
“কবে আসবে তুমি মেহের? একদম পারমানেন্টলি?”
মেহের চেঞ্জ করে এসে ভাবছে শাড়ির কথা। শাড়িটা ভুল করে ফেলে এসেছে৷ এত সুন্দর শাড়িটা। ফায়াজ কি শাড়িটা যত্ন করে রেখেছে না ফেলে রেখেছে?
.
পরের দিন ফায়াজ শাড়িটা একটা শপিংব্যাগে করে ভার্সিটিতে নিয়ে এসেছে কিন্তু মেহেরকে খোঁজে পাচ্ছে না।
সামিরা আর অনুকে এক সাথে দেখতে পেয়ে ফায়াজ জিজ্ঞেস করল,
“মেহের কই? ওকে দেখছি না কেন?”
সামিরা বলল,
“কি আর বলব ভাইয়া মেহেরের পেটে ব্যথা।”
ফায়াজ চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল,
“পেটে ব্যথা! কেন? কিভাবে?”
“আসলে ওর হোস্টেলের খাবার পোষায় না। আমি তো বাইরে থেকে খেয়ে অভ্যাস করে ফেলেছি কিন্তু ও এখনো অভ্যস্ত হতে পারে নি। তাই আর কি।”
ফায়াজ সামিরার হাতে শপিং ব্যাগ দিয়ে বলল,
“ওকে দিও।”
ফায়াজ যেতেই সামিরা ব্যাগে সেই শাড়িটা দেখতে পেল। শাড়িটা দেখে নানান প্রশ্ন মাথায় উঁকি দিচ্ছে।
সামিরা হোস্টেলে ফিরে দেখে মেহের এলোমেলো চুলে চেয়ারে বসে চোখ বন্ধ করে রেখেছে। সামিরার আসার শব্দ পেয়ে চোখ খুলল। সামিরা মেহেরকে ব্যাগটা দিয়ে বলল,
“ঘটনা কি? সত্যি করে বল।”
মেহের না বুঝে বলল,
“কি ঘটনা? কোন ঘটনা? ”
সামিরা ব্যাগ থেকে শাড়ি বের করে বলল,
“তোর শাড়ি ফায়াজ ভাই দিল। তার কাছে কি করে গেল? কিভাবে গেল? এই তুই না গিয়েছিলি ভাইয়ার বাড়িতে?”
“হ্যাঁ গিয়েছিলাম। শাড়িতে অস্বস্তি লাগছিল। ঠিক করে হাঁটতে পারছিলাম না তাই চেঞ্জ করেছি। তারপর ভুলে ফেলে এসেছি। তাই হয়তো দেওয়ার জন্য নিয়ে এসেছে।”
সামিরা ভ্রু নাচিয়ে বলল,”কেস কি?”
মেহের শাড়িটা নিয়ে বলল,”তোর মাথা।”
.
পরের দিন ফায়াজ মেহেরকে ক্যান্টিনে বসে থাকতে দেখে বলল,
“ক্যান্টিনে খাওয়া নিষেধ। চলো আমার সাথে।”
ফায়াজ মেহেরকে গাড়িতে নিয়ে বসাল। তারপর হটপট বক্স বের করে খাবার বের করে বলল,
“আমি রোজ সকালে তোমার ব্রেকফাস্ট আর লাঞ্চ নিয়ে আসব। আর সন্ধ্যায় হোস্টেলের গেট বন্ধ হওয়ার আগে খাবার নিয়ে যাব।”
মেহের কিছু বলতে যাবে ফায়াজ থামিয়ে দিয়ে বলল,
“আগে খেয়ে নেও।”
চলবে…..!