শেষ পাতায় তুমি পর্ব-৩৪+৩৫

0
3760

#শেষ_পাতায়_তুমি(Revenge story)
#ফাবিহা_নওশীন

|পর্ব-৩৪|

পুরো বাড়ি থমথমে অবস্থা। ফায়াজ রেলিঙ ধরে দাঁড়িয়ে আছে। আর কিছুক্ষণ পর পর তুষারের দিকে তাকাচ্ছে। ফায়াজের অস্থিরতা বেড়েই চলেছে। বুকটা হু হু করছে অজানা আশংকায়। ও আর এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। কিন্তু তুষার ওকে আঁটকে রেখেছে। মেহেরকে একজন মহিলা ডাক্তার দেখছেন।
ফায়াজ মেহেরকে পড়ে থাকতে দেখে চিৎকার করে আর ওর চিৎকার শুনে সবাই জড়ো হয়। ফায়াজ মেহেরকে কোলে তুলে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দেয়। আর ওর বন্ধুরা দ্রুত একজন ডাক্তারকে ফোন করে। ফায়াজ মেহেরের চোখে-মুখে পানি ছিটা দিয়েও জ্ঞান ফেরাতে পারছিল না। ফায়াজ অস্থির হয়ে পড়ছিল। কি করবে বুঝতে পারছিল না। পাগলামি শুরু করেছিল। এমনকি ডাক্তার আসার পরেও ফায়াজ বারবার ডাক্তারকে এটা সেটা জিজ্ঞেস করে বিরক্ত করছিন। ফলে ডাক্তার তার ট্রিটমেন্ট করতে পারছিল না। তাই তুষার ওকে বাইরে নিয়ে আসে।

পুরো রুম ফাকা। মেহেরের জ্ঞান ফিরেছে। ডাক্তার ওকে বিভিন্ন প্রশ্ন করছে। ডাক্তার মেহেরের কথা শুনে একচুয়াল কি হয়েছে বলতে পারছে না। কিন্তু উনার একটা ডাউট হচ্ছে। ডাক্তার ফায়াজকে ডাকল। ফায়াজকে ডাকতেই ও দ্রুত ভেতরে গেল। মেহেরের চোখ খোলা দেখে হন্তদন্ত হয়ে মেহেরের কাছে গেল।

তারপর দ্রুত জিজ্ঞেস করল,
“মেহের, তুমি ঠিক আছো?”

মেহের কিছু বলতে যাবে তখন ডাক্তার বলল,
“উনি ঠিক আছেন। আপনার সাথে আমার কিছু কথা আছে।”

ফায়াজ ও মেহের দুজনেই ডাক্তারের দিকে পূর্ণ মনোযোগ দিল। ডাক্তার বলল,
“আপনার ওয়াইফের ঠিক কি হয়েছে বুঝা যাচ্ছে না। উনার কিছু টেস্ট করলে ভালো হয়। তবে প্রাথমিকভাবে সব কিছু বিবেচনা করে যেটা মনে হচ্ছে উনি প্রেগন্যান্ট।”

প্রেগন্যান্ট শব্দটা শুনে মেহের শোয়া থেকে উঠে বসল। আর ফায়াজের কান যেন ঝিমঝিম করছে। মেহের চোখ কপালে তুলে বসে আছে। মুখ দিয়ে হু হা শব্দ করতে পারছে না। ফায়াজ মেহেরের দিকে তাকাল।

মেহের ফায়াজের দৃষ্টি বুঝতে পেরে ডাক্তারকে বলল,
“আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে।”

ডাক্তার স্মিত হেসে বলল,”হয়তো। হয়তো বা না। টেস্টগুলো করা জরুরী। তাহলেই সবটা ক্লিয়ার হবে। আপনারা কাল একবার গিয়ে টেস্টগুলো করিয়ে নিবেন। আমি এখন উঠি।”

ডাক্তার উঠে যেতেই দরজার সামনে থেকে ফায়াজের এক বন্ধু এসে ডাক্তারকে এগিয়ে দিতে গেল। ফায়াজ গভীর ভাবনায় বিভোর। মাথায় কিছুই ঢুকছে না। ফায়াজ ধীরপায়ে বেরিয়ে গেল। মেহের তখনও চুপ করে বসে আছে। ও নিজেও কিছু বুঝতে পারছে না।
ফায়াজ বাইরে যেতেই ওর বন্ধুরা ওকে ঘিরে ধরল। ওরা ঠাট্টা-মশকরা শুরু করেছে।
“কিরে চাই তলে তলে এত কিছু?”
“ভাই অবশেষে চাচা হয়ে যাচ্ছি।”
“আরে ফায়াজ তো বাবা হয়ে যাচ্ছে। কিউট পাপা।”

ফায়াজের ওদের কথা একদম ভালো লাগছে না। ফায়াজ বিষন্নতা নিয়ে বলল,
“তোরা সবাই চলে যা। আমাকে একটু একা ছেড়ে দে।”

ফায়াজের বন্ধুরা ফায়াজের মুখ দেখে কিছু আচ করতে পারছে না। মনে হচ্ছে ওরা যেমনটা ভাবছে তেমন না।
ফায়াজ ওদের কৌতূহল থামানোর জন্য বলল,
“এখন আমি কোন প্রশ্নের উত্তর দিতে পারব না।”

ওরা ফায়াজকে কিছু জিজ্ঞেস করল না। ওরা চলে গেল। ফায়াজ তখনও দাঁড়িয়ে আছে। মাথাটা কেমন করছে। মনে হচ্ছে পোকারা কিলবিল করছে। মেহের পেছনে এসে দাঁড়াল। ফায়াজ মেহেরের অস্তিত্ব অনুভব করে পেছনে ঘুরে বলল,
“তুমি উঠে এসেছো কেন?”

মেহের ছলছল চোখে বলল,
“আপনি কি আমাকে অবিশ্বাস করছেন? আপনার কি মনে হচ্ছে ডাক্তার ঠিক বলেছে?”

ফায়াজ মেহেরের কাঁধে হাত রেখে বলল,
“না তা কেন হবে?”

“আপনার আচরণ তাই বলছে।”

“না মেহের। আমি তোমাকে অবিশ্বাস করি না। আমি অন্য ব্যাপারে চিন্তিত। তোমার অসুস্থতার কারণ উদঘাটন করার চেষ্টা করছি। আমার তোমার জন্য টেনশন হচ্ছে।”

মেহেরের ফোনটা বারবার বেজে থেমে যাচ্ছে। ফায়াজ মেহেরের কাঁধ থেকে হাত সরিয়ে বলল,
“হয়তো সামিরা ফোন করেছে। কল রিসিভ করো।”

মেহের ফোন হাতে নিয়ে দেখল ওর মা ফোন করেছে। মেহের ফোন রিসিভ করে কানে নিতেই ওর মা বলল,
“মেহের! তুই কই? হোস্টেল থেকে ফোন এসেছে। কত টেনশন হচ্ছে জানিস? তুই কি বুঝিস না? হোস্টেলে থাকিস তাতেই তোকে নিয়ে টেনশনে থাকি। আর এত রাত হয়েছে হোস্টেলে ফিরিস নি। কোথায় আছিস তুই?”

মেহের নরম সুরে বলল,”মা আমি ঠিক আছি।”

মেহেরের মা বিচলিত হয়ে বলল,” কিন্তু আছিস কোথায়? সামিরাও জানে না তুই কোথায় আছিস।”

মেহের ঘড়ির দিকে তাকাল। ৮টা ৪০বাজে। কত রাত হয়ে গেছে। হোস্টেলের গেট রাত ৮টার মধ্যে বন্ধ হয়ে যায়। আর এখন ৮টা ৪০।
মেহের মিথ্যা বলতে চায় না। তাই বলল,
“আমি ফায়াজের বাড়িতে এসেছি। উনার জন্মদিন ছিল তাই।”

মেহেরের মা ফায়াজের নাম শুনে বিস্ময়ের পাশাপাশি ভয় পেয়ে গেল।
“মেহের, তুই ফায়াজের বাড়িতে!! তুই পাগল হয়েছিস? মেহের তুই আবার কি করছিস? তুই সব ভুলে গেছিস? যাকে ভালোবেসে সব ছেড়েছিস সে তো মাঝরাস্তায় একা ফেলে চলে গেছে। তুই বাড়িতে পর্যন্ত জায়গা পাস নি। মেহের আর ভুল করিস না মা। তুই হোস্টেলে যা।”

ওর মা-তো আর সত্যটা জানে না। কার জন্য মেহেরকে এত দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। কে এসবের মূলে?
মেহের ওর মা’কে বলল,
“মা, ফায়াজ আগের মতো নেই। উনি অনেক চেঞ্জ হয়ে গেছে। তুমি শুধু শুধু চিন্তা করছো। আর আমি তো থাকতে আসি নি। হোস্টেলেই যাব।”

মেহেরের মা চিন্তিত কন্ঠে বলল,
“মেহের, তুই আমার অবস্থাটা বুঝতে পারছিস না। আমার তোর জন্য অনেক টেনশন হচ্ছে৷ হাজার চেষ্টা করেও তোকে বাড়িতে রাখতে পারি নি তোর বাবার জন্য। হোস্টেলে আছিস কত টেনশন করি৷ আর এখন তোর বোকা বোকা কথা শুনে আরো টেনশন লাগছে। তুই এখুনি হোস্টেলে যাবি। পৌছে ফোন করবি। আমি আগামীকাল তোর সাথে দেখা করব তারপর ফায়াজকে নিয়ে কথা বলব। কিন্তু এখন তুই হোস্টেলে যা।”

“আচ্ছা, যাচ্ছি। গিয়ে তোমাকে ফোন করব। তোমাকে কিছু বলার আছে।”

মেহের ফোন কেটে ঘুরে দাঁড়িয়ে ফায়াজ দেখল। ফায়াজ বলল,
“এই শরীরে না গেলে হয় না? আজ নাহয়…।”

মেহের বলল,”আমাকে যেতে হবে। মা টেনশন করছে। আমাকে দিয়ে আসবেন প্লিজ।”

ফায়াজ বিধ্বস্ত কন্ঠে বলল,
“হ্যাঁ আমি খারাপ মানুষ। আমার সাথে থাকলে টেনশন করারই কথা। চলো তোমাকে দিয়ে আসি। আর আগামীকাল রেডি থেকো। তোমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব। তোমার শরীরের কন্ডিশন আমার ভালো লাগছে না। ভালো একজন ডাক্তার দেখাতে হবে।”

মেহের মাথা নাড়িয়ে সায় দিল।

মেহেরের মা কিচেনে সবজি কাটছে। মেহের ফোন করেছে। তাই উনি আঙুল দিয়ে ফোন পিক করে লাউডস্পিকার দিল।
“হ্যাঁ, মেহের। তুই হোস্টেলে ফিরেছিস? আগামীকাল আসছি আমি। তোর আর ফায়াজের সাথে কথা বলব। ফায়াজের যদি পরিবর্তন হয় তবে আমি বিষয়টা বিবেচনা করে দেখব। কিন্তু এইবার আর তোকে নিজে নিজে বোকামি করতে দেব না।”

মেহের বিষন্নকন্ঠে বলল,
“মা, আমার মনে হচ্ছে আমার কিছু হয়েছে।”

মেহেরের মা সবজি কাটা থামিয়ে দিয়ে ফোনের দিকে তাকিয়ে বলল,
“কি হয়েছে?”

মেহের ইতস্তত করে বলল,
“মা আজ আমি পেট ব্যথায় সেন্স হারিয়ে ফেলেছিলাম। ডাক্তার বলল মেবি আমি প্রেগন্যান্ট অথবা অন্য কিছু হয়েছে।”

মেহেরের মা কিছুটা জোরে বলল,
“কি? প্রেগন্যান্ট?”

“মা, আমি প্রেগন্যান্ট নই। বাট ডাক্তার অনুমান করছে শুধু। আগামীকাল গিয়ে কিছু টেস্ট করিয়ে আসতে বলেছে।”

মেহেরের কথা শুনে ওর মায়ের হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। মেয়েটার কি হলো? খারাপ কিছু নয়তো?
“আমি সকালে হোস্টেলে যাব। তোকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাব। তুই তো কখনো বলিস নি
তুই অসুস্থ? কেন বলিস নি?”

মেহের আমতা আমতা করছে। সেদিনের মতো মা’কে বিদায় জানাল।

ফায়াজ ঘুমে বিভোর। ওর ফোন বাজছে। এই সকাল সকাল কে ফোন দিবে? ফায়াজ ঘুমেঘুমে হাতড়ে ফোন নিয়ে রিসিভ করে কানে দিল। ঘুমঘুম কন্ঠে বলল,” হ্যালো।”

“ভাইয়া, মেহের খুব অসুস্থ। ওকে হাসপাতালে নেওয়া হচ্ছে।” ফায়াজ সামিরার কন্ঠ শুনে চমকে গেল৷ মেহের অসুস্থ শুনে ওর পিলে চমকে গেল। ওর চোখ থেকে ঘুম বিদায় নিল। শোয়া থেকে উঠে বসল। তারপর আতংকিত কন্ঠে বলল,
“মেহের…! কি হয়েছে ওর? সামিরা কি হয়েছে ওর?”
ফায়াজ শোরগোল আর এম্বুলেন্সের শব্দ পাচ্ছে।
“ভাইয়া, হটাৎ করেই ওর পেটে প্রচন্ড ব্যথা করছে৷ ও অনেক চিৎকার, কান্নাকাটি করছে। ওকে দেখে অনেক খারাপ লাগছে। ও অনেক কষ্ট পাচ্ছে ভাইয়া।” সামিরাও কেঁদে দিল।
ফায়াজের পুরো দুনিয়া এলোমেলো লাগছে। হাত-পা থরথর করে কাঁপছে। কখনও এমন ভয়ংকর অনুভূতি হয় নি। কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,
“আমি আসছি।”

“ভাইয়া, আপনার এখানে আসতে হবে না। আপনি দ্রুত হাসপাতালে চলে আসুন। আমি ওর বাসায় ফোন করব।”
সামিরা গাড়িতে উঠতে উঠতে মেহেরের বাড়িতে ফোন করল।

ফায়াজ পাথর হয়ে আছে। নড়তে পারছে না। ওর বুকে চিনচিনে ব্যথা করছে। কি জানি হারিয়ে ফেলছে। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। তখনই ব্রেইন জানাল ওকে যেতে হবে।
ফায়াজ বিছানা ছেড়ে ফোন নিয়ে রুম থেকে দৌড়ে বের হয়ে গেল। তারপর মনে হল গাড়ির চাবি নিতে হবে। ফায়াজ আবারও দৌড়ে দিয়ে রুমে এলো। ড্রয়ার খুলে চাবি নিল। চাবি নিয়ে এলোমেলো ভাবে দৌড়াচ্ছে। বারবার ভুল হচ্ছে। কয়েকবার হোচটও খেয়েছে। ফায়াজের বুক ফেটে যাচ্ছে।

হসপিটালে সবাই জড়ো হয়েছে। মেহেরের বাবা-মা, মাহি-তূর্জ, সামিরা, মেহেরের বন্ধুরা, ফায়াজের কয়েকজন বন্ধু। ডাক্তার ভেতরে মেহেরকে দেখছে। ডাক্তার বাইরে বের হতেই সবাই এগিয়ে গেল।
ডাক্তার বলল,” ওর কিছু টেস্ট করতে দেওয়া হয়েছে রিপোর্ট না আসা পর্যন্ত কিছু বলা যাচ্ছে না। আপনারা সময় দিন একটু।”

মেহেরকে ঘুমের ইঞ্জেকশন দেওয়া হয়েছে। মেহের ঘুমাচ্ছে। সবাই রিপোর্টের জন্য অপেক্ষা করছে। ফায়াজের বাবা কিছুক্ষণ পর পর ফায়াজের দিকে ক্ষুব্ধ দৃষ্টিতে তাকাচ্ছেন। ফায়াজ সে দৃষ্টি উপেক্ষা করছে বারবার।

মেহেরের রিপোর্ট আসার পর থেকে সবাই চুপ হয়ে গেছে। মেহেরের মা কাঁদতে কাঁদতে যেন পাথর হয়ে গেছে। ফায়াজ স্থির দৃষ্টিতে কডিটোরের এক কোনায় একা দাঁড়িয়ে আছে। কিছুক্ষণ পর পর চোখের কোনা থেকে পানি মুছছে। মেহেরের টিউমার ধরা পড়েছে। ওর এই পেটে ব্যথাটা স্বাভাবিক ছিল না। টিউমারের জন্য ব্যথা করত কিন্তু মেহের বারবার হেলা করেছে।

মেহেরের জ্ঞান ফেরার পর ওর বাবা-মা আর মাহি ভেতরে গেল। ফায়াজ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। মেহের কিছুই জানে না। সবার সাথে টুকটাক কথা বলছে আর ফায়াজকে খোঁজছে। ওর এমন একটা ঘটনা ঘটেছে আর ফায়াজ আসবে না তা হয় না।
ফায়াজ দূর থেকে মেহেরের দৃষ্টি বুঝতে পেরে সব উপেক্ষা করে ভেতরে এলো। মেহের ফায়াজকে দেখে মৃদু হাসল। মেহেরের বাবা মেহেরের জন্য ফায়াজকে কিছুই বলতে পারল না। ডাক্তার তখন ভেতরে এসে মেহেরকে বলল,
“তোমাকে হয়তো কেউ কিছু জানায় নি। তবে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। কিছুদিন মেডিসিন নিলে ঠিক হয়ে যাবে।”

মেহের কৌতূহলী দৃষ্টি নিয়ে বলল,” মানে? কিসের মেডিসিন? আর কি হয়েছে?”

“তোমার টিউমার ধরা পড়েছে।”
মেহের ডাক্তারের কথা শুনে ফায়াজের দিকে ছলছল চোখে তাকাল।
ডাক্তার শান্তনা দিয়ে বলল,” ভয় পাচ্ছো? মেডিসিন নিলেই সুস্থ হয়ে যাবে। তুমি এই টিউমার এতদিন কি করে সহ্য করলে? এতে তো প্রচন্ড ব্যথা হয়।”

মেহের মলিন হেসে বলল, “আসলে সবার কাছে থেকে এতটা মানসিক যন্ত্রণা পেয়েছি সে শরীরের যন্ত্রনাকে কিছুই মনে হয় নি। সব তুচ্ছ মনে হয়েছে।”

মেহেরের কথা শুনে মাহি, ফায়াজ আর ওর বাবা মাথা নিচু করে নিল। কারণ ওরাই ওর মানসিক যন্ত্রণার কারণ ছিল।

ফায়াজ আপসোস করে বলল,
“আমি ওর পেটের ব্যথার ব্যাপারে জানতাম৷ আমি কেন বুঝতে পারি নি। আর মেহেরও আমাকে তেমন করে বলে নি। আমি এসেছি পাঁচ মাস। আর এই পাঁচ মাস ধরে তোমার এমন ব্যথা হয় অথচ তুমি কাউকে তেমন ভাবে বলো নি। কেন বলো নি?”

মেহের নিজেও বুঝতে পারে নি।
“আপনি আসার আগ থেকেই অল্প অল্প ব্যথা হত। কিন্তু তখন এতটা ছিল না। আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে কিন্তু আমি এটাকে হোস্টেলের খাবারের জন্য ভেবেছি। ভাবি নি এমন কিছু।”

ডাক্তার ফায়াজ আর মেহেরের বাবাকে ডেকে নিয়ে গেল কথা বলতে। ডাক্তার জানাল দু সপ্তাহের জন্য ওষুধ দিবে যদি ইম্প্রুভ না হয় তবে অপারেশন করতে হবে। আর যদি তাই হয় সেটা রিক্সি হবে।

এ-সব শুনে ফায়াজের জান যায় যায় অবস্থা। ফায়াজ মেহেরকে নিজের কাছে নিয়ে যেতে চায় আর এদিকে ওর পরিবার ওর বাড়িতে নিতে চায়। মেহেরও নিজের বাড়িতে যেতে চায়। কতদিন বাড়িতে যায় নি।
ফায়াজ বলল,
“হয় মেহের আমার সাথে যাবে আর নয়তো মেহের যেখানে যাবে আমিও ওর সাথে যাব।”

মাহি বলল,
“মেহেরকে একা ছেড়ে দেও। ও অসুস্থ। প্লিজ।”

মেহের মা’য়ের দিকে তাকিয়ে অনুনয়ের সুরে বলল,
“উনি আমার সাথে যাবে। মা প্লিজ। না করো না।”

মাহি অবাক হয়ে মেহেরের দিকে তাকাল।

চলবে……

#শেষ_পাতায়_তুমি(Revenge story)
#ফাবিহা_নওশীন

|পর্ব-৩৫|

“আপনি নরমাল টি-শার্ট, টাউজার আর ঘরে পড়ার জুতা পড়ে শ্বশুর বাড়িতে যাবেন?”
নার্স ওষুধ দিতে আসায় সবাই যখন বাইরে যাচ্ছিল তখন মেহের পেছনে থেকে ফায়াজকে উদ্দেশ্য করে বলল। ফায়াজ পেছনে ঘুরে মেহেরের দিকে তাকাল। মেহের খিলখিল করে হাসছে। এই শরীরে কিভাবে খিলখিল করে হাসছে? কি অদ্ভুত মেয়ে। অদ্ভুত ই তো।

ফায়াজ নিজের দিকে তাকিয়ে মেহেরের দিকে দু পা এগিয়ে গেল। নার্স ওষুধ দেখছে।
ফায়াজ লজ্জিত ভঙ্গিতে বলল,
“আসলেই তো এভাবে যাব শ্বশুর বাড়ি? আজ দাঁত ব্রাশও করি নি।”

মেহের নাক মুখ কুঁচকে বলল,
“ইয়াক! আপনি দাঁত ব্রাশ করেন নি?”

ফায়াজ মৃদুস্বরে হেসে বলল,
“ফোন পেয়ে যে অবস্থায় ছিলাম সে ভাবেই চলে এসেছি। যে পোশাকে ছিলাম, যেভাবে ছিলাম চলে এসেছি।”

“আপনি বাড়িতে যান। ফ্রেশ হয়ে হসপিটালে আসুন। আমার রিলিজ আর ডাক্তারের সাথে কথা বলা নিয়ে অনেক সময় লাগবে।”

নার্স মেহেরের কাছে ওষুধ নিয়ে যেতেই ফায়াজ বেরিয়ে গেল। কিন্তু ওর বাড়িতে যেতে ইচ্ছে করছে না। বাড়িতে যাওয়ার পর যদি মেহেরকে নিয়ে ওরা চলে যায়? তাই ফায়াজ বাড়িতে ফোন দিল। ওর লাগেজ গুছিয়ে নিয়ে আসতে বলল। ও বাড়িতে যাবে না। হসপিটাল থেকেই মেহেরের সাথে যাবে।

.

মেহের গাড়ি থেকে নামছে। মাহি আগ বাড়িয়ে মেহেরকে ধরতে গেলে মেহের বাঁধা দিয়ে বলল,
“আমার হাত-পা ভাঙে নি। আমি হাঁটতে পারি। এত ভালোবাসা দেখানোর দরকার নেই।”

ফায়াজ মেহেরের সামনে এসে দাঁড়াতেই মেহের ফায়াজের সাথে ভেতরে যাচ্ছে। মাহি থমকে দাঁড়িয়ে আছে। তূর্জ মাহিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলল,
” কি গো দাঁড়িয়ে আছো কেন?”

মাহি থমথমে মুখে বলল,
“না এমনি চলো। মিশানকে খাওয়াতে হবে।”

মাহি আর তূর্জও ভেতরে গেল।
মেহেরের মা মেহেরকে ওর রুমে রেস্ট করতে দিয়ে আসার পর ফায়াজ ওর ঘরে গেল। মেহের ফ্রেশ হয়ে বের হলো। ফায়াজ আচমকা গিয়ে মেহেরকে জড়িয়ে ধরল। মেহের ফায়াজের অশান্ত শ্বাস আর বুকের ধুকধুকানি স্পষ্ট অনুভব করতে পারছে। ফায়াজ শান্ত হয়ে আছে। মেহেরকে জড়িয়ে ধরে চুপ করে আছে। মেহেরও চুপ করে আছে।

ফায়াজ কিছুক্ষণ পরে বলল,
“আমার দম বন্ধ হয়ে আসছিল মেহের। আমি অনেক ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। মনে হচ্ছিল আমার পুরো পৃথিবী থেমে গেছে। খবরটা শুনে আমার হৃদ স্পন্দন থেমে গিয়েছিল। কিছু সময়ের জন্য আমার বোধ হারিয়ে ফেলেছিলাম। মাথা কাজ করছিল না। তুমি আর এমন করো না মেহের। তুমি কেন আমাকে তোমার অসুস্থতার কথা বলো নি। আমি রোজ তোমার জন্য খাবার নিয়ে যেতাম। তারপর আমি ভেবেছিলাম তুমি ভালো আছো। কিন্তু এর পরেও তুমি অসুস্থ বোধ করেছো কিন্তু কেন বলো নি কেন?”

“আমি বুঝতে পারি নি। ভেবেছি এমনি…

ফায়াজ মেহেরের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলল,
” হু এমনি…। তুমি আর কখনো আমার কাছে কিছু লুকাবে না।”

মেহের ফায়াজকে ছাড়িয়ে বলল,
“আচ্ছা। এখন আপনি ফ্রেশ হয়ে আসুন। আপনার শরীরে গন্ধ প্রচুর। ওয়াক!”
মেহের আবারও খিলখিল করে হাসছে।

ফায়াজ নাক মুখ কুচকে চোখ ছোট ছোট করে মেহেরের দিকে তাকিয়ে ফ্রেশ হতে চলে গেল।

মেহের নিজের ঘরে শুয়ে আছে। ফায়াজ ওকে জোর করে শুইয়ে দিয়ে গেছে। বলেছে যেন একদমই বের না হয়। তাই মেহের বাধ্য হয়ে শুয়ে আছে। চোখ বন্ধ করে আছে কিন্তু ঘুম নেই। শুয়ে শুয়ে বোর হচ্ছে আর মনে মনে ফায়াজকে বকছে। “আমাকে শুইয়ে দিয়ে নিজে ঘুরতে চলে গেছে।”
তখনই দরজায় খট শব্দ শুনে মেহের দ্রুত চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর ভাব করল।

মেহের কিছুক্ষণ পরে নিজের পায়ে কারো হাত আর মাথার অস্তিত্ব অনুভব করছে। এক চোখ খুলে চোখের কোনা দিয়ে দেখার চেষ্টা করছে কে আছে। মেহের মাহিকে দেখে শকড। মেহের দ্রুত উঠে বসে।
মেহের মাহিকে দেখে বলল,
“এ-সব কি হচ্ছে আপু?”

মাহি অনুনয়ের সুরে বলল,
“মেহু পাখি আমি তোর সাথে একটু কথা বলতে চাই।”

মেহের ক্ষিপ্ত হয়ে বলল,” ওই নামে আমাকে ডাকবে না। মেহু পাখি মরে গেছে।”

মাহি আতংকিত কন্ঠে বলল,”মেহু!”

মেহের হাত জোর করে বলল,
“আমি হাত জোর করছি, প্লিজ। আমার জীবনে ইন্টারফেয়ার করার চেষ্টা করো না। তোমার লাইফে আমি যেমন ইন্টারফেয়ার করি নি, তেমনি তুমিও আমার লাইফে ইন্টারফেয়ার করো না।”

“আমি ইন্টারফেয়ার করছি? আমি তো শুধু তোর খোঁজ….।”

মেহের কড়া গলায় বলল,
“দরকার নেই। একদম দরকার নেই। আমার খোঁজ নেওয়ার মানুষ আছে৷ আমাকে নিয়ে ভাবার মানুষও আছে। তুমি সব সময়ের মতো তোমাকে নিয়ে ভাব।”

মাহি মেহেরের পা জড়িয়ে ধরে শব্দ করে কাঁদছে। মেহের পা ছাড়ানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু পারছে না।
মাহি কেঁদে কেঁদে বলল,
“মেহের ক্ষমা করে দে না আমায়। আমাকে ক্ষমা কর। আমার জন্য আজ তোর এই অবস্থা। আমার জন্য তোর জীবনটা এলোমেলো হয়ে গেছে। তুই আমার জীবনটা সাজিয়ে দিয়ে নিজের জীবনটা এলোমেলো করে ফেলেছিস। শরীরে এত বড় একটা রোগ বাসা বাঁধছে। মেহের প্লিজ আমাকে মাফ কর। আমি প্রমিস করছি আমি সবাইকে সত্যটা বলে দেব। কিন্তু আমার কয়েকদিন সময় প্রয়োজন। নিজেকে তূর্জ আর বাবা-মার মুখোমুখি দাঁড় করানোর জন্য সাহস প্রয়োজন। কারণ আমি যা করেছি সেটা মেনে নেওয়া ওদের জন্য সহজ হবে না। তাই আমার সময় প্রয়োজন।”

মেহের তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলল,
“তাতে কি হবে? আমার সাথে যা যা হয়েছে তার প্রতিকার আমি পাব? আমি যে কষ্টগুলো সহ্য করেছি তা মেটানো যাবে? তা মুছে যাবে? যাবে না আপু। তুমি আমার সাথে ফায়াজের সাথে যা করেছো তা ক্ষমার অযোগ্য।”

মাহি কাঁদছে। মেহেরের পা তখন ধরে আছে মাহি।
“আমি জানি আমি যা করেছি তা ক্ষমার অযোগ্য। কিন্তু আমি তো চেয়েছিলাম নিজের পাপের সাজা নিজেই পেতে। তোকে তো বলি নি ফায়াজের কাছে যেতে৷ ওকে বিয়ে করতে। আমি তো চেয়েছিলাম ফায়াজের দেওয়া শাস্তি মাথা পেতে নিতে। বলেছিলাম তো, অনুনয় করেছিলাম ওর কাছে তোকে ছেড়ে দিতে। তোর জীবনটা নষ্ট না করতে।”

মেহের ভাবছে সেদিন ফায়াজের সাথে বিয়ে করেছিল বলেই আজ এমন একজন ভালোবাসার মানুষ পেয়েছে। যে ওকে পাগলের মতো ভালোবাসে। কিন্তু এই মুহুর্তে মাহির মুখে ফায়াজের নামটা ভালো লাগছে না। বড্ড বিরক্ত লাগছে।
মাহি দু’হাত জোর করে কাঁদছে।
“তুই আবার আমার সেই মেহু পাখি হয়ে যা মেহের। আমি সবার সামনে সবটা স্বীকার করব। আমি ফায়াজের কাছেও..।”

ফায়াজের নাম শুনে মেহের দ্রুত বলল,
“ঠিক আছে, ঠিক আছে। তোমাকে ক্ষমা করে দিলাম।”

মেহের মিশানকে কোলে নিয়ে নিজের রুমে এলো। ফায়াজ রুমে বসে আছে। মেহের কোথায় গেছে সেটা ভাবছে। মেহেরকে দেখে দ্রুত উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“কোথায় ছিলে এতক্ষণ?”

মেহের মিশানকে চুমু খেয়ে বলল,
“বাবা, আংকেলের কোলে যাবা?”

ফায়াজ মিশানকে দেখে হাসিমুখে কোলে নিল। এর আগে কখনো কোন বাচ্চাকে কোলে নেয় নি। এই প্রথম নিল। কোলে নেওয়ার কিছুক্ষণ পরেই মিশান ফায়াজের কাপড় নষ্ট করে দিল। ওর টিশার্ট আর প্যান্ট কিছু অংশ ভিজে গেছে। মেহের আবার খিলখিল শব্দ করে হেসে উঠল। ফায়াজ মেহেরকে বারবার বলছে কোলে নিতে। মেহের নিচ্ছে না। শুধু হেসেই যাচ্ছে। মাহি মিশানকে নেওয়ার জন্য আসতেই দেখে এই অবস্থা। দ্রুত ভেতরে ঢুকল। একবার ফায়াজের দিকে আরেকবার মেহেরের দিকে তাকাচ্ছে।

তারপর মেহেরকে বলল,
“তোকে বলেছিলাম ওকে ডায়াপার পড়িয়ে নে। ডায়াপার পড়াস নি কেন? তাহলে তো এমন হতো না।”

মেহের হাসি থামিয়ে বলল,
“আমি পড়ানোর চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু পারি নি। তাই এভাবে নিয়ে এসেছি।”

মাহি ফায়াজের কাছ থেকে মিশানকে নিয়ে মেহেরকে বলল,
“ডায়াপার পড়াতে পারিস না? নিজের বাচ্চাকাচ্চা লালন পালন করবি কিভাবে?”

ফায়াজ মাহির কথা শুনে বিরক্তি নিয়ে বলল,
“আমার বাচ্চাকাচ্চা পালন করার লোকের অভাব হবে না। হাজার মানুষের লাইন বসিয়ে দেব। মেহেরকে কিছু করতে হবে না।”

মাহি মেহেরের দিকে একবার তাকিয়ে মিশানকে নিয়ে চলে গেল। মাহি যেতেই মেহের আবারও খিলখিল করে হাসছে। ফায়াজ মেহেরের দিকে চোখ পাকিয়ে চেয়ে চেঞ্জ করতে চলে গেল।

ফায়াজ আবারও মেহেরকে শুইয়ে দিয়েছে। বসে বসে মেহেরের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। তখনই ওদের দরজায় কড়া পড়ল। দরজা খোলা ছিল। মাহি দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। মেহের মাহিকে দেখে উঠে বসল। ফায়াজের চেহারায় বিরক্তি স্পষ্ট।

মাহি অস্বস্তি নিয়ে বলল,
“খেতে ডাকছে।”
মাহি বলেই চলে গেল। মেহের ফায়াজের দিকে তাকাল। ফায়াজ কপাল কুচকে আছে। ফায়াজের চোখ মেহেরের দিকে পড়তেই বলল,
“ওকে দেখলে আমার মেজাজ খারাপ হয়ে যায়।”

মেহের মুখ গম্ভীর করে বলল,” আপনি বাড়িয়ে চলে যান৷ আজই চলে যাবেন। আমি সুস্থ হলে আমাকে নিয়ে যাবেন।”
মেহের কথাটা বলেই হনহন করে বেরিয়ে গেল। মেহের হাঁটছে আর ভাবছে,
“ফায়াজের মনের কোথাও না কোথাও মাহি আছে। নয়তো ফায়াজ মাহিকে দেখে রিয়েক্ট করবে কেন? মাহির অস্তিত্বে ফায়াজের মধ্যে কোন অনুভূতি সৃষ্টি করবে না। না বিরক্তি, না রাগ, না খুশি কোনটাই ফায়াজের অনুভব হবে না। তবে কেন হয়? তার মানে মাহির উপস্থিতি ফায়াজকে প্রভাবিত করে। মেহের এটা মেনে নিতে পারছে না।

চলবে…..