ঝরা পাতা পর্ব-৩৪+৩৫+৩৬

0
1395

#ঝরা_পাতা
#Angel_Frozen_Nishi_khatun
#পর্ব_৩৪

আমি জানি কে আমাকে সাহায্য করতে পারবে!
আমি রাইমার সাথে লুকিয়ে যোগাযোগ করে জানতে যা জানতে পারি তাতে আমার মরে যেতে ইচ্ছা করছিল।
সুমু ভেবেছিল আয়াশের সাথে আমার বিয়ে হলে সে আমাকে মাঝ রাস্তায় ফেলে চলে যাবে কিন্তু তেমন কিছুই হয়নি বরং আয়াশ বিয়েটা মেনে নেয়।
এটা সুমু মানতে পারছিল না।সুমু আমার থেকে প্রতিশোধ নিতে চাইছিল।

কারণ সে কখনো স্কুল থেকে ভার্সিটি লাইফে আমার জন্য মনের মতো কাউকে পায়নি।এমন কি কখনো আমার থেকে ভালো রেজাল্ট করতে পারতো না।
ও বড়লোকের মেয়ে হবার পরেও সব স্যার ম্যাডামের চোখের মনি আমি ছিলাম। সুমু আর আমি সব কিছুতে পারদর্শী ছিলাম। সুমু আমার সাথে সব সময় ভালো ব্যবহার করলেও আড়ালে সুমুর মাঝে সময় আমাকে নিয়ে জেলাসির কাজ করতো।সুমু জোর করে আমার বিয়ে দিয়ে ভেবেছিল এক ঢিলে দুই পাখি মাড়বে।

কিন্তু সেই রকম কোনো কিছুই হয় না।তাই সুমু উন্মাদ হয়ে যায়।আমার খুশি গুলোর গলা টিপে হত্যা করার জন্য সে মরিয়া হয়ে ওঠে।অবশেষে হঠাৎ করে ঘটনাচক্রে সুমুর সাথে আমার বাবার দেখা হয়।
বাবা চাইছিল না আমি আয়াশের সাথে সংসার করি।তাই আমাকে দরকার হলে সে এই পৃথীবি থেকে সরিয়ে দিতে দিবে।

আমার বাবার মনের ইচ্ছার সাথে সুমুর ইচ্ছাও মিলিত হয়।সুমু চাইছিল আমিও দুনিয়ার বুক থেকে হারিয়ে যায়।মেয়ের জন্মদাতা পিতা যদি হত্যার ষড়যন্ত্র করতে পারে তাহলে আমি কেনো তাকে সাহায্য করতে পারবো না?

তারা দু জনে মিলে আমাকে মারার প্লানিং করে।আফসোস আমার মামুজান সবটা কি ভাবে বুঝতে পারে।সেদিন যখন ওরা আমার বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়।তার আগেই মামুজান আমার বাড়ির পেছনের দরজার তালা খুঁলে এমন ব্যবস্থা করে যাতে মনে হয় ভেতরে কেউ একজন আছে।ওরা তো বাহিরে আগুন দিয়ে পালিয়ে যায়।মামুজান তখন তার বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ করে একটা মহিলার বেওয়ারিশ লাশ এনে আমার স্থানে রেখে দেয়।
এরপর ওদের আগে মামুজান আমার বাড়িতে পৌঁছে যায়।বাহিরের কাউকে সে লাশ দেখতে দেয় না।
আর আমার কাছে সবটা গোপন করে রাখে।
যাতে আমি কখনো যেনো এসব জানতে না পারি।
বাবা আর বান্ধবীর প্রতি যেনো কোনো খারাপ মনোভাব না থাকে।এসব জানলে হয়তো খুব কষ্ট পাবো।

তাই সে সব দোষ নিজের ঘাড়েমাথা পেতে নিয়ে চুপচাপ থাকে।সেদিন খুব কষ্ট পেয়েছিলাম এরা আমার সাথে এমন কিছু করতে পারে ভাবতেও পারি নাই।জানের থেকে প্রিয় বান্ধবী কি না আমাকে হত্যা করতে চাইছে?বাবার কথা না হয় বাদ দিলাম।যে ছোট বেলায় মরার একা রেখে চলে যেতে পারে। তার কাছে এমনটা মানাই।

সেদিন এসব কিছু জানার পর রাইমার কাছে থেকে বিদায় নিয়ে আমি উন্মদের মতো চলতে থাকি।
হঠাৎ করে কখন যে মাঝ রাস্তায় চলে আসি বুঝতেই পারি নাই।তখন এভাবে চলতে গিয়ে একটা বাসের সামনের চলে যাচ্ছিলাম।

তখন রোহানের বাবা আমার হাত ধরে টানদিয়ে বাঁচিয়ে দেয়।
সে কোনো এক কাজে এপথে যাচ্ছিল।
হঠাৎ তাদের গাড়িটা নষ্ট হয়ে যাওয়াতে পানির খোঁজে সে এদিকে ওদিকে হাটছিল।আমাকে এমন ভাবে মরতে দেখে সে বাঁচাতে ছুটে চলে আসে।

সে আমাকে তার সাথে করে নিয়ে আসে।আমি এমন মূর্তি মতো কয়েক দিন ছিলাম।এরপর নিজে থেকে তাদের কাছে আমার সব কথা খুঁলে বলি।তারা সেদিন আমাকে আপন করে নেয়।

রোহানের বাবা আমাকে বলে,”সত্যি ভালো কাজ করেছে তোমার মামা।অর্ণা জীবনে অনেক কষ্ট দেখেছে।
সে আজ ঝরা পাতার মতো ঝরে গিয়ে নতুন সজীবতার সাথে প্রাণ খুলে বাঁচার স্বাদ গ্রহণ করবে তারিফা নামে।তোমার উচিৎ মাস্টার্স কমপ্লিট করে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে সমাজে তোমার মতো মানুষদের সাহায্যদান করা।”

আমি সেদিন নিজের পুরাতন সব কিছু ভুলে নতুন করে বাঁচতে শুরু করি।এসবের মাঝে আমার সাথে আবারো ভাগ্য আয়াশের দেখা করিয়ে দেয়।ওদিকে অর্ণার মরার পর আর কিছু হয়েছিল কি না সে সব আমার অজানা ছিলো।

আয়াশ আমাকে কখনো দেখে নাই তাই সে চিনতে পারে না।আমি তার সম্পর্ক খোঁজ খবর নিতে শুরু করি।এরপর সবটা জানতে পারি।অরিন রোহান কে পছন্দ করে।আর রোহান ও অরিন কে পছন্দ করে।তবে এদের দু জনকে মিলিয়ে দিতে গিয়ে আমি একটু নিজের জন্য স্বার্থপর হয়ে যায়।
নিজের স্বামী কে নিজের করে পাওয়ার জন্য রোহানের বোনের বিয়ের দিন ওদের দু জনের দূর্ঘটনার ভিডিও করি।সেই ভিডিও কে নানারকম বাজে ভাবে ছড়িয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে আয়াশ কে বাধ্য করি আমাকে বিয়ে করতে।এতপর আয়াশ সেদিন একপ্রকার বাধ্য হয়ে আমাকে বিয়ে করে।

এরপর নিজের নতুন পরিচয় নিয়ে তো আমি খুব ভালোই ছিলাম তবে এসবের মাঝে সুমু আবারো বিষ ঢেলে দেয়।সে আয়াশের নামে অরিনের কাছে খারাপ কথা বলে দু জনের মধ্যে সমস্যা সৃষ্টি করে।তবে আমি জানতাম না যে অরিনের কাছে আয়াশের নামে মিথ্যা কথা বলেছে।
সময়ের সাথে সাথে সব সত্যি প্রকাশ পেয়েছে। আমার সত্যি সবার সামনে এসেছে।
এবার আপনারা বলেন আমার দোষটা কোথায়?
আমার মা নিজের স্বামীর ধোঁকা সহ্য করতে না পেরে জীবনটা শেষ করে দিয়েছে এটা?
আমার জন্মদাতা পিতা কোনোদিন ও আমার খোঁজ খবর নেই নি এখানে?জোর করে বিয়ে আয়াশ করেছে!আমি শুধু তাকে নতুন করে পেতে চেয়েছি।
বাবা থাকতেও আজ আমি এতিমের লিস্টে এটা আমার দোষ?
আজ আমি আমার জীবনের প্রতিটা কাহিনী বলেছি এবার বলেন এখনো কি আমি ঝরা পাতার মতো ঝরে যাবো?আমার কী অধিকার নেই জীবনটা কে উপভোগ করার?আমি কাউকে ঠকিয়ে এখানে আসি নাই।
আমার সাথে আয়াশের ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে।
আয়াশ আমার জীবন নষ্ট হবার জন্য দায়ী নয়।
আমার জীবনটা তো আমার কাছের আপনজনরা নষ্ট করেছে।নিজেদের ইচ্ছা মতো আমাকে নিয়ে গল্প সাজিয়েছে।আমি সেই ছোট থেকে বার বার ঝরা পাতার মতো ঝরে যাচ্ছি। আজ আমি বড় ক্লান্ত।
আমি আর এভাবে ঝরা পাতার মতো ঝরতে পারছি না।বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মেঝেতে বসে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে।

এখানে উপস্থিত সবাই বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছে।তারাও তো মেয়েটার সাথে কম খারাপ ব্যবহার করে নি।তারা সবাই ইচ্ছা করলে তো সাধারণ ভাবে সবটা মেনে নিতে পারতো।

আয়াশ সবার সামনে ছুটে গিয়ে অর্ণা কে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে থাকে।সত্যি সেও ইচ্ছা করলে নিজের রাগ কন্ট্রোল করে অর্ণার সাথে সব কিছু নরমাল করে নিতে পারতো।কিন্তু আয়াশ অর্ণার উপর অভিমান করে একবুক অভিযোগ নিয়ে মুখ ফিরিয়ে রেখেছিল।
.
.
.
চলবে……

#ঝরা_পাতা🍂🍂
#Angel_FROZEN_Nishi_khatun
#পর্ব_৩৫

অর্ণার ইতিহাস শোনার পর আর কারো সাহস হয়নি তারা অর্ণার সামনে দাঁড়িয়ে থাকবে।
সবাই যে যার মতো রুমে চলে যায়।
অনেক রাত হয়েগেছে আজ এইবাড়িতে কারো চোখে ঘুম আসছে না।সত্যি তারা অনেক বড় অপরাধ করেছে।সত্যি তো তারা সবাই খুব খারাপ মানুষিকতার পরিচয় দিয়েছে।হয়তো এতোটা হতো না মেয়েটার সাথে যদি ওর বাবা সাথে থাকতো।

কিন্তু কথায় আছে না,রক্ষক যখন ভোক্ষক হয়ে যায় তখন মানুষ নিরাপত্তা হীনতায় ভুগতে থাকে।

মমতা খান নিজের স্বামীর চোখে আজ চোখ রেখে কথা বলতে পারছে না।কারণ সেও কম খারাপ ব্যবহার করেনি অর্ণার সাথে।

মরিয়ম খান বিছানার এপাশ ওপাশে ফিরে বার বার শুয়েও ঘুমোতে পারছে না।কারণ সে তো প্রথমে অর্ণাকে খুব ভালোবেসেছিল।কিন্তু যেই না জানতে পারছে অর্ণা এতিম সেদিন থেকে গিরগিটির মতো নিজের রুপটা বদলেছে।যা তার এই বয়সে এসে করাটা মোটেই উচিৎ হয়নি।সে সবাইকে বলবে মেয়েটাকে মেনে নিতে, সেখানে সে নিজের মনুষ্যত্ববোধটা সঠিক রাখতে সক্ষম হয়নি।

অরিন সারারাত রোহানের সাথে ফোনে কথা বলে,”নিজের বাড়ির সদস্য তো অর্ণা।
তার আপন বড় ভাইয়ের বউ।
কিন্তু সে সব সময় মেয়েটার পাশে থাকতে পারে না।
তবে দোষটা কার?হয়তো আমাদের মনুষ্যত্ববোধের।আমরা সহজে কোনো কিছু গ্রহণ করতে পারি না।”

আয়াজ আর সুমুর মাঝে বড্ড বেশি কোলাহলের সৃষ্টি হয়েছে।সুমু আয়াজের কাছে বার বার মাফ চাইতে থাকে তবে আয়াজ মাফ করতে রাজী নয়।যেখানে আত্মহত্যা করা মহা পাপ।সেখানে সুমু তো একটা প্রাণ খুণ করার পরিকল্পনা করতে সাহায্য করে।আল্লাহর কাছে সব থেকে অপ্রিয় ব্যক্তি সেই যে অন্যকে খুন করে বিনা কারণে।

আয়াজ সুমুকে বলে,”যে মেয়ে তার বান্ধবীর পিঠে ছুড়ি চালাতে দ্বিধা বোধ করে না।সে মেয়ে যে তার স্বামীকে এভাবে খুন করতে চেষ্টা করবে না।তার বিশ্বাস নেই।বিষধর সাপের থেকেও বেশি বিষধর মনে হচ্ছি আয়াজের কাছে সুমু কে।তাই তো সে রাতে সুমুকে আর নিজের ঘরে কোনো স্থান দেয়নি আয়াজ। ”

সুমু সারারাত আয়াজের ঘরের দরজার সামনে বসে কান্না করতে থাকে।সুমুর কান্নার শব্দে আয়াজের মন গলে না।আয়াজ বলে,”তোমার এটা কুমিরের কান্না।
যে মেয়ের বিবেকবোধ মারা যায়।তার থেকে দূরে থাকা উওম।আমি আগেই বলেছিলাম।তোমার কোনো অন্যায় থাকলে আমাদের সম্পর্ক থাকবে না।সেখানে তো তুমি গুনাহগার।”

সুমু বার বার বলে,”প্লিজ মাফ করে দাও।এমন কাজ আর কখনো করবো না।”

আয়াজ বলে,”এসব কথা তোমার আগে ভাবা উচিৎ ছিলো।যখন এসব কাজ করেছিলে তখন পাপের পরিণাম কি হবে ভেবে কাজ করো নাই।তাই এখন তোমার অযথা কান্নার মানে হয় না।তোমার জন্য একটা মেয়ের পুরো দুনিয়া উজাড় হয়ে যেতে পারতো।
যদি সে সঠিক সময় মতো নিজের জন্য একটু স্বার্থপর না হতো।”

কথায় আছে নদীর এক কূলে ভাঙ্গন ধরে তো অন্যকূলে গড়ে ওঠে।আজ সুমু আয়াজের সম্পর্কের বিত্তি নড়ে গেছে।
অন্যদিকে অর্ণা আর আয়াশের সম্পর্কের নতুন সূচনা হতে থাকে।

আয়াশ অর্ণার দুহাত নিজের হাতের মুঠোয় বন্দি করে ক্ষমা চাইতে থাকে। অর্ণা আয়াশের হাতের মাঝে থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে আয়াশের গালে আলতো-ভাবে স্পর্শ করে বলে,”প্লিজ আমার কাছে ক্ষমা চেয়ে আমাকে ছোট করবেন না।কারণ আপনি পরিস্থিতির শিকার ছিলেন।যদিও সত্যিটা আপনি জানতে চেষ্টা করেছেন।কিন্তু মিথ্যার দেওয়ালের ওপাশে এরা আপনাকে পৌঁছাতে দেয়নি।
তাই আপনার প্রতি আমার কোনো অভিযোগ নেই।
বরঞ্চ আপনি আমাকে মাফ করে দিন।
আমার জন্য আপনি অনেক কষ্টের সময় পার করেছেন।
আমি চাইলে হয়তো কিছুটা কম করতে পারতাম।
তবে তখন যে আমাকে আপনি বিশ্বাস করতে না।
তাই কিছু সময় মানুষের উচিৎ সঠিক সময়ের অপেক্ষায় থাকা।”

আয়াশ অর্ণাকে নিজের বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে বলে,”প্লিজ তুমিও ক্ষমা চেয়ে আমাকে নিজের কাছে আর ছোট করো না।”

আয়াশ অর্ণা কে জড়িয়ে ধরে বলে,”আজকের পর থেকে তুমি সজীব পাতার মতো নতুন রুপের আলোতে আমার পুরো পৃথীবি আলোকিত করে রাখবে।
এরপর থেকে কখনো আমরা কেউ কারো উপর অভিমান করবো না।আমি আর তুমি আমাদের সম্পর্কটা স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের থেকেও বেশি বন্ধুত্বের সম্পর্কের মতো পালন করবো।তাহলে কখনো নিজেদের মধ্যে অন্যকেউ ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি করতে পারবে না।”

অর্ণা নিজের স্বামীর বুকে মাথা রেখে আজ পৃথিবীর সব কষ্ট ভুলে গেছে।হ্যা স্বামী-স্ত্রী সম্পর্কটা এমন একটা সম্পর্ক যেখানে দুটি মানুষের মধ্যেই পৃথীবির সব সুখ খুঁজে পাওয়া যায়।অর্ণার আজ তার স্বামীর এতোটা কাছে আছে বলে আগের সব কষ্টের কথা ভুলে গেছে।আসলেই স্বামীর বুকে মাথা রেখে মেয়েরা তাদের সব কষ্ট হাসি মুখে ভুলে যেতে পারে।অর্ণা আর কোনো কষ্টের কথা মনে করতে চাইছে না আজ।
কারণ দুঃখের পর একদিন সুখের মুখ দেখবে সে আশায় এতোদিন ধৈর্যের বাদ ভাঙ্গতে দেয়নি।
আজ যখন তার আপন মানুষটাকে এতোটা কাছে পেয়েছে আর তাকে দূরে যেতে দিতে চাইছে না।আল্লাহ নিজেই এই পবিত্র সম্পর্কের মাঝে ভালোবাসার সৃষ্টি করে দেওয়ার দায়িত্ব নিয়েছেন।ইসলামিক শরীয়ত মোতাবেক যখন অপরিচিত দু জন নর-নারীর বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হয়। তখন সম্পর্কের পবিত্রতায় তাদের মধ্যে মায়াজন্মে যায়।
বিয়ের সেই অদৃশ্য মায়াতে জড়িয়ে আয়াশ অর্ণা কে না দেখে ওর মনের মাঝে অর্ণার প্রতি অদৃশ্য ভালোবাসার সৃষ্টি হয়।

সব দুঃখের গ্লানি ভুলে আজ হোক না নতুন সম্পর্কের সূচনা।অর্ণা আজ পরম ভালোবাসার আবেশে আয়াশ কে নিজের প্রতি মুগ্ধ করে।
আয়াশের ভালোবাসার প্রতিটা স্পর্শে অর্ণার পুরোশরীরে শিহরণ জাগিয়ে দিতে থাকে।
আজ লজ্জায় লাল হয়ে,এমন মাদকতা যুক্ত স্পর্শে পৃথীবির সব সুখ উপলব্ধি করতে অর্ণা নিজেকে বিলীন করে দিতে রাজী আয়াশের মাঝে।
দুটি হৃদয়ের মাঝে ভালোবাসার যে ঝড় উঠেছিল তা তাদের শরীর ও মনের পবিত্র মিলনের মাধ্যমে ওদের দু জনের সম্পর্ক আজ পূর্ণতা পেয়েছে।

পরেরদিন ভোরবেলা অর্ণা নিজেকে আয়াশের এতোটা কাছে দেখে সব কিছু মনে পড়তেই সে তো লজ্জায় হাত দিয়ে নিজের মুখটা ঢেকে রাখে।

আয়াশ ঘুমঘুম চোখ মেলে অর্ণার এমন কান্ড দেখে হাসতে শুরু করে।অর্ণার কানে আয়াশের হাসির শব্দ আসতেই লজ্জাবতীর মতো আয়াশের বুকের মাঝে মুখ লুকিয়ে রাখে।

আয়াশ অর্ণার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে আর বলে,”আমার বুকের মাঝে এভাবে মুখ লুকিয়ে রাখলে তো আমার বউয়ের লজ্জায় রাঙা মুখটা দেখতে পারবো না।এটা বড় অন্যায় গো বউ।”

অর্ণা আর কিছুই না বলে আয়াশ কে নিজের থেকে দূরে ধাক্কা দিয়ে বিছানা থেকে নেমে তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হতে বাথরুমের দিকে ছুটে যায়।

অর্ণার এমন কান্ড দেখে আয়াশ অট্টট্ট হাসিতে ফেটে পড়ে।আয়াশ জোরে জোরে অর্ণাকে শুনিয়ে বলে,”একটা মাইয়া আমার মনডা চুরি করিয়া বাথরুম পালিয়ে গেছে গো ও ও ও!আমি হৃদয় হরিণীর লজ্জায় রাঙা মুখটা দেখতে পাইলাম না!”

অর্ণা বাথরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে অজু করে এসে আয়াশ কে রাগী কন্ঠে বলে,”রোমান্সে চ্যাপ্টার বন্ধ করে ফ্রেশ হয়ে ফজরের নামাজ টা পড়ে নিলে খুশি হবো।”

আয়াশ বলে,”বউয়ের আদুরে কথা রাখতেই হবে।”
এরপর দুজনে নিজেদের নামাজ আদায় করে।আয়াশ নামাজ পড়ে আবারো বিছানার উপর কুমিরের মতো পড়ে ঘুমোতে শুরু করে।

অর্ণা আয়াশের এমন কান্ড দেখে মুচকি হেসে চুপচাপ নিজের রুমের বাহিরে সবার জন্য নাস্তা রেডি করতে চলে যায়।

অর্ণা নিজের রুম থেকে বেড়িয়ে নিচে যাবার সময় দেখে সুমু আয়াজের দরজার সামনে হাটুগেড়ে বসে আছে।
অর্ণার সুমুর জন্য খারাপ লাগছিল।যতোই অন্যায় কুরুক না কেনো!তবুও তো সে মানুষ।আর মানুষের দ্বারা ভুল হতেই পারে।কেউ নিজের ভুল বুঝতে পেরে ক্ষমা চাইলে তাকে মাফ করে দেওয়া উচিৎ।
তাই অর্ণা সুমুর দিকে এগিয়ে যেতে থাকে।




চলবে…..

#ঝরা_পাতা🍂🍂
#Angel_Frozen_Nishi_khatun
#পর্ব_৩৬

হঠাৎ করে পেছন থেকে কেউ একজন অর্ণার হাত ধরে টানতে শুরু করে দেয়।হঠাৎ এমন ভাবে কে টানাটানি শুরু করেছে তা দেখতে পেছনের দিকে ফিরে দেখে তার একমাত্র ননদী।

অরিন অর্ণার হাত ধরে সোজা নিচে ড্রয়িংরুমে নিয়ে চলে আসে।অর্ণা অরিনের দিকে প্রশ্ন বিদ্ধ দৃষ্টিপাত করতেই অরিন আগ বাড়িয়ে বলতে শুরু করে।

“দেখো ভাবী তোমার আপন মানুষেরা তোমার সাথে যা করেছে তার জন্য তাদের শাস্তিভোগ করা উচিৎ।যাতে করে কেউ দ্বিতীয় বার আপন মানুষের পিঠে ছুড়ি দিয়ে আঘাত করতে ভয় করে।তবে আমার মনে হয় না তুমি ওদের শাস্তি দিবে।তবে নিজে মাফ করে দিবা ভাল কথা তবে কেউ ওদের শাস্তির ব্যবস্থা করলে প্রতিবাদ করবে না।”

অর্ণা বলে,”কেউ যদি নিজের ভুল বুঝতে পেরে ক্ষমা চাইতে আসে তাহলে কি তাকে ক্ষমা করে দেওয়া উচিৎ না?”

অরিন এবার রাগী কন্ঠে বলে ওঠে,”কাল এতো কাহিনী হবার পর কি তোমার বান্ধবী একটি বারের জন্য তোমার কাছে মাফ চেয়েছে? তাহলে অযথা এতো দরদ দেখানোর মানে হয় না।”

অর্ণা বলে,”কেউ যদি ভুল কাজ করে তাহলে তাকে মাফ করে দেওয়াটা একটা মহৎকাজ।”

অরিন বলে,”তাহলে সেদিন তোমার মামা তোমাকে যদি প্লানিং করে না বাঁচাত তাহলে তুমি তো সেদিন পটল তুলে বসে থাকতে।”

অর্ণা চুপ করে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে।

আয়াশ সেখানে এসে বলে,”অর্ণা সুমু এখন আয়াজের বউ।তাই তাকে তুমি মাফ করে দিলেও যে আয়াজ মাফ করে দিবে আমার কাছে তেমন মনে হয় না।আর কোনো স্বামী যদি তার স্ত্রী কে শাসন করে। তাহলে সেখানে নাক গলানোর কোনো অধিকার আমাদের নেই।তাই তুমি মন দিয়ে নিজের সংসার করো।অন্যের জন্য চিন্তা করে নিজের সংসার নষ্ট করতে হবে না।”

অরিন বলে,”তা ছাড়া কথায় আছে,যে যেমন কর্ম করে। সে তার ফল ঠিক একদিক ভোগ করবে।মানুষের সামনে তার অন্যায় ধরা না পড়লেও আল্লাহর কাছে তো ফাঁকি দিতে পারবে না।আল্লাহ সবার জন্য দয়ালু ঠিক তেমন খারাপের জন্য বিচারদাতা।তাই তুমি সবটা আল্লাহ উপর ছেড়ে দাও।”

অর্ণা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নাস্তার টেবিলের কাছে যায় সব কিছু রেডি করতে।সেখানে গিয়ে দেখে মরিয়ম খান চুপচাপ টেবিলের পাশে আলাদাভাবে চেয়ার নিয়ে বসে আছে।মমতা খান সব কিছু টেবিলের উপর সাজিয়ে রাখছে।

অর্ণা কাজ করতে গেলেই মরিয়ম খান বলে ওঠে,”এই তোমাকে কাজ করতে বলেছি তুমি আগ বাড়িয়ে কাজ করছো?”

মমতা খান এসে বলে,”দেখছো না আমার শাশুড়ি তার ছেলের বউকে দিয়ে কাজ করিয়ে নিচ্ছে?
তোমার শাশুড়ি কি তোমাকে বলেছে কাজ করতে?তাহলে দাদী শাশুড়ির পাশে চুপচাপ বসে থাকো।”

অর্ণা কিছু বলবে তার আগেই মমতা খান এসে অর্ণার দু হাত জড়িয়ে ধরে বলে,”দেখো বউমা আমরা তোমার সাথে যে দুর্ব্যবহার করেছি তার কোনো মাফ হয় না।তারপর ও আমরা তোমার থেকে বড় আর গুরুজন। সে কথা ভেবে আমাদের মাফ করে দিও।আমরা চেষ্টা করবো নিজের মানুষিকতা বদলাতে। কি তোমার এই বড় মেয়েটা কে মাফ করতে পারবে না?”

অর্ণা কোনো কথা না বলে সোজা নিজের শাশুড়ি মা কে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দেয়।
মরিয়ম খান উঠে এসে অর্ণার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,”দেখো দেখি পাগলী কান্ড! কেউ এভাবে কান্না করে?এখন তো তোমার সুখের দিন।চারিদিকে যা কিছু আছে সব কিছু গুছিয়ে নিতে হবে তোমাকে। ”

অর্ণা বলে,”আপনার কিছু না বললেও আমি আমার সব কিছু গুছিয়ে নিতে জানি।এটা আমার বাড়ি সংসার বুঝলেন। আপনার দু জন এখন শুধু আড়াম করবেন আর তদারকি করবেন আমার কাজের।যদি কোনো ভুল কাজ করি তার জন্য বকা দিয়ে শিখিয়ে দিবেন। তারপর কখনো আমার কাছে মাফ চেয়ে আমাকে ছোট করবেন না।”

মমতা খান বলে,”উঁহু বউমা এতো সহজে আমি আমার সংসারে হাল ছাড়ছি না।তোমাদের আগে চার পাঁচটা বাচ্চাকাচ্চা হোক তারপর সংসারের দায়িত্ব তোমার কাঁধেচাপিয়ে দিবো।”

বাচ্চাকাচ্চার কথা শুনে লজ্জায় লাল টুকটুক হয়ে যায় অর্ণার মুখটা।

মরিয়ম খান বলে,”বাব্বাহ নাতিবৌ দেখি লজ্জায় নুইয়ে পড়ছে।তার মানে খুব তাড়াতাড়ি হয়তো এবাড়িতে সুখবর আসবে।”

অর্ণার এসব কথা শুনে মনে হচ্ছিল সে লজ্জায় মাটিতে মিশে যাবে।মাথা উচুঁ করে আর সামনের মানুষদের দিকে তাকাতেই পারছিল না।

মরিয়ম খান অর্ণার থুতনি তে হাত দিয়ে মুখটা উচুঁ করে ধরে বলে,”এই মমতা দেখো তোমার বউমা লজ্জা পেলে লাল টুকটুক আর বেশি সুন্দরি হয়ে যায়।”

এমন সময় অরিন আর আয়াশ সেখানে চলে আসে!আয়াশ এসে তার দাদী মা কে জড়িয়ে ধরে বলে,”কি হলো জানপাখি?এখানে কেউ মনে হচ্ছে লজ্জায় আশেপাশে তাকাতেই পারছে না!”

মরিয়ম খান বলে,”হুম!তবে এখানে জানপাখি ডাক কি আমাকে ডাকলে না নিজের বউকে?”

আয়াশ একটু স্টাইল করে বলে,”দু জন কে উদ্দেশ্য করে বলেছি।এখন যার ইচ্ছা সেই গ্রহণ করবে।”

মরিয়ম খান আয়াশের কান টেনে বলে,”বউ কে কাছে পেয়ে আমার সাথে বাটপারি শুরু করেছো এসব চলবে না।”

অরিন একটু অভিমানের সুরে বলে,”বাহ আমে দুধে মিলে যাচ্ছে আর আমাকে ভুলে যাচ্ছো।”

আয়াশ বোন কে জড়িয়ে ধরে বলে,”ওরে আমার আদুরে বোনটি।দুদিন পর তুই তো তোর সারাজীবনের সঙ্গীর সাথে চলে যাবি তখন আমাদের কথা মনে পড়বে তো?”

অরিন বলে,”কেনো মনে পড়বে না?এই ভাবী তোমার বাড়ির মানুষদের কথা মনে পড়ে না বলো?”

বাড়ির মানুষের কথা শুনে অর্ণার হাসিমুখটা ফ্যাকাসে হয়ে যায়।সাবাই মেয়েটার মলিন চেহারা দেখে বুঝতে পেরে কথার বিষয় বদলে দেয়।

এরপর বাড়ির সবাই একসাথে নাস্তা কমপ্লিট করে।আয়াজ ও নাস্তার সময় এসে চুপচাপ বসে অল্প একটু খাবার খেয়েছিল। সুমু আসে নাই নাস্তার টেবিলে।

কিছু সময় পর যখন সবাই নিজের নিজের কাজে ব্যস্ত তখন হঠাৎ করে বাড়িতে সুমুর বাবা মা চলে আসে।তাদের সাথে বাড়ির সবাই একদম সাধারণ ভাবে কথা বলে।তাদের আসার একটু পর এবাড়িতে উকিল বাবু আসেন।

উকিলবাবু কে দেখে সুমুর শরীরের থেকে প্রাণটা বেড়িয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়।

অরিন তবুও আগ বাড়িয়ে আয়াজের কাছে গিয়ে বলে,”ভাইয়া সুমু অনেক বড় ভুল করেছে বুঝলাম তবে এর জন্য কি এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিৎ হবে?”

আয়াজ বলে,”যে আপনার সাথে এতোটা খারাপ ব্যবহার করেছে তার জন্য সাফাই দিতে আসবেন না।তাছাড়া যে মেয়ে বান্ধবীর প্রতি ঈর্ষান্বিত হয়ে এতো জঘন্য কাজ করতে পারে সে যে কিছুদিন পর আমার সাথে এর থেকে বেশি খারাপ ব্যবহার করবে না এমন গ্যারান্টি কেউ দিতে পারবে না।আর তাছাড়া ওর সাথে আমার সম্পর্ক যদি থাকে তাহলে আমি নিজেই কখনো নিজের দিকে তাকাতে পারবো না।জানি আপনি সুমুর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিবেন না।তাই আমাকে আমার মতো ব্যবস্থা নিতে দিবেন আশা করি।তা ছাড়া এটা আমাদের স্বামী স্ত্রীর বেপার।”

আয়াজ নিজ দায়িত্বে সুমুর বাবা মা’র কাছে তাদের মেয়ের নোংরা মানুষিকতার সব কিছু খুলে বলে।এরপর সুমুর বাবা মা বলে,”আমাদের ভাবতেই ঘৃণাজনক লাগছে এই মেয়ের পিতামাতা আমরা।”

সুমু ওর বাবা মা কে বলে,”প্লিজ তোমরা আমাকে ভুল বুঝো না।সব কিছু অর্ণার জন্য হয়েছে।দেখে তোমাদের জামাই আমাকে ছেড়ে দিতে চাইছে।আমি যে আয়াজ কে ছাড়া কোনোদিন ও সুখি হতে পারবো না।প্লিজ তোমরা আয়াজ কে বোঝাও না।”

সুমুর বাবা মেয়ের গালে কয়েকটা থাপ্পড় দিয়ে বলে,”এতো পাপ করার পর ও নিজের সুখের কথা চিন্তা করতে লজ্জা করছে না?আজ মনে হচ্ছে তোর মতো মেয়ের জন্মদাতা হবার থেকে ঐ অর্ণার মাতাপিতা হওয়া অনেক ভাগ্যের বেপার।”

সুমুর মা আয়াজ কে উদ্দেশ্য করে বলে,”আমার মেয়ে যে অপরাধ করেছে তার জন্য তোমাদের কাছে মাফ চাইছি।তার মানে এটা নয় যে তোমরা ওর শাস্তি মাফ করে দিবে।তোমাদের যা ইচ্ছা হয় সেই শাস্তি দাও আমার মেয়েকে আমরা মাথা পেতে তা গ্রহণ করবো।”

আয়াজ উকিল বাবুকে ইশারা করতেই তিনি একটা কাগজ এগিয়ে দেয়।আয়াজ সেই কাগজটা হাতে নিয়ে স্বাক্ষর করে সুমুর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,”এটাতে সাইন করে দিয়ে এবাড়ি থেকে এবং আমার জীবন থেকে চিরদিনের মতো চলে যাও।!

সুমু কাগজটা হাতে নিয়ে দেখে তালাকের কাগজ।
তা দেখে সুমু চিৎকার দিয়ে কান্না করে ওঠে।

সুমু আয়াজের কাছে যেতে লাগলে আয়াজ চলে যায়।আর পিছনে ফিরে দেখে না।সুমুর বাবা মা সুমুকে জোর করে তাদের সাথে নিয়ে চলে যায়।

কিছু পাপের শাস্তি সারাজীবন ভোগ করতে হয়।সুমুর শাস্তি এটাই ছিলো। যাকে পাওয়ার জন্য এতো আয়োজন আজ তাকেই চিরদিনের জন্য হারিয়ে ফেলতে হলো।যাকে পাবার জন্য এতো পাপ আজ নিজের পাপের শাস্তি স্বরুপ সারাজীবনের জন্য ভালোবাসার মানুষটাকে হারিয়ে ফেলা।

সুমু চলে যাবার পর পুরোবাড়ি কেমন জানি স্তব্ধ হয়ে ছিলো। এতোটা নিরবতা যা বোঝানোর উপায় নেই।এতো মানুষের আনাগোনা এবাড়িতে তারপর ও এই সংসার ভাঙ্গার নিরবতার কাছে কোনো কিছুই না।



চলবে……