#প্রেমপ্রদীপ
Part–24
Arishan_Nur (ছদ্মনাম)
গরম কষকষে চা পায়ে পড়ার পরও রোদেলা নির্বিকার। সে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রয়েছে৷ মনে হচ্ছে চারিপাশ ঘুরছে। সে ও ঘুরছে, জগতটাও ঘুরছে। রোদেলার যেন বিশ্বাস হচ্ছেনা আবেগের কথা!
সে চোখ বড় করেই আবেগের দিকে তাকিয়ে আছে। তার ঢোক গিলতে কষ্ট হচ্ছে। চোখ বেয়ে ইতিমধ্যে কয়েক ফোটা পানি গড়িয়ে পড়েছে।
আবেগ রোদেলার চেহারা দেখে কিছু ই বুঝতে পারছে না। রোদেলার মনে কি চলছে জানে না সে। আচ্ছা রোদেলা যদি না আসতে চায় তাহলে কি করবে? এতোটুকু ভাবতেই আবেগের গা ঘামতে লাগল। সে আর ভাবতে পারছেনা। না যেতে চাইলে কি হবে তার উত্তর আবেগের কাছে নেই।
রোদেলা ধপ করে সোফায় আবেগের মুখোমুখি বসে পড়ে। আবেগের দৃষ্টি রোদেলার পায়ের পাতার দিকে গেল। সে কি! গরম চা পড়ায় পায়ের পাতা লাল হয়ে গেছে। এভাবে চলতে থাকলে তো পায়ে ফোসকা পড়ে যাবে। আবেগ দ্রুত উঠে দাড়ালো এবং ফ্রিজের কাছে গেল। সে নিজের বাসায়ই কোনদিন ফ্রিজ খুলে দেখে না কি আছে, আর আজকে প্রয়োজনে শ্বশুড়বাড়ির ফ্রিজ খুলতে হচ্ছে। ফ্রিজ খুলে দেখে বরফ নেই কিন্তু এক বোতল ঠান্ডা পানি আছে।
সে রান্নাঘর থেকে একটা ছোট হাড়ি এনে রোদেলার পায়ের সামনে রেখে পায়ের পাতার উপর ঠান্ডা পানি ঢালতে লাগে।
রোদেলা আবেশে চোখ বুজে ফেলে৷ উফ! এতো শান্তি লাগছে কেন তার?
আবেগ বেশ সময় নিয়েই রোদেলার পায়ে পানি ঢেলে দিচ্ছে। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বলে, ডিমের সাদা অংশ দিলে ভালো হত।
রোদেলা চটজলদি বলল, দরকার নাই ডিম দেওয়ার। জ্বলছে না।
আবেগ মাথা নিচু করে বলে, কিছু পীড়ার জ্বলন পরে হয়। সঙ্গে সঙ্গে না।
রোদেলা চমকে উঠে আবেগের কথায়!
আবেগ এবার সরাসরি রোদেলার দিকে চোখ তুলে তাকায় এবং ভরাট কন্ঠে বলে, আমি সবকিছু ভুলে যেয়ে আবার আগের মতো করে বাচতে চাই! নিজের ছেলে-মেয়েদের সাথে কিছু মুহূর্ত একসাথে থাকতে চাই!
রোদেলা কোমল গলায় বলে, তাহলে বলতে চাচ্ছো, তুমি সমুদ্র আর পিউয়ে নিয়ে থাকতে চাইছো?
— হুম!
— হুট করে মেয়ের জন্য এতো দরদ আসলো কোথা থেকে?
— মেয়ের জন্য আমার ভালোবাসা আগেও ছিলো, এখনো আছে। মারা গেলেও ভালোবাসা থাকবে।
মারা যাওয়ার কথা শুনে রোদেলা কেপে উঠে। হুট করে মারা যাওয়ার কথা শুনে তার গা শিরশির করে উঠে।
রোদেলা কাপা কাপা গলায় বলে, আর আমি? আমি কিছুই না। তোমার জীবনে আমার কোন মূল্য নেই?
— রোদেলা, ভালোবাসা কিছুটা শক্তির মতো! পর্দাথ বিজ্ঞান বলে,শক্তির কোন শেষ নেই, কখনো নিঃস হয়ে যায়না। শুধু রুপান্তর হতে থাকে। শক্তি যেমন কোন স্থান বা বস্তুতে স্থানান্তর হয় কিন্তু ধ্বংস হয় না। তেমনি ভালোবাসা ও শেষ হয়না, নিঃস হয় না। ভালোবাসা ও শুধুমাত্র রুপান্তর হয়!
আবেগের কথার সারমর্ম রোদেলা বুঝতে সক্ষম হলো। কিন্তু প্রতিত্তোরে কিছু বললো না।
আবেগ পুনরায় বলে, আমি এসেছি তোমাকে নিয়ে যেতে। একটা পরিপূর্ণ পরিবার স্বচোখে দেখতে চাই। তুমি কি যাবে? বেশি দিন থাকতে হবে না। ছুটির দিন গুলো শুধু থেকো। ছুটি ফুরিয়ে গেলে চলে যেও নিজ গন্তব্যে।
রোদেলার চোখ চিকচিক করতে লাগলো।
আবেগ আশেপাশে তাকিয়ে বলে, পিউ কোথায়? আর বাবা-মা বা কোথায়?
— মেঘের মেয়ে অসুস্থ। হাসপাতালে গেছে সবাই ওকে নিয়ে।
— বল কি! কি হয়েছে কি?
— জন্ডিস।
আবেগ বললো, জন্ডিসের জন্য আবার হাসপাতালে যাওয়ার লাগে নাকি? বাসায় আসতে বলো। বাসায় বিশ্রাম নিবে। ঠিকমতো বেড রেস্ট নিলেই সেড়ে যাবে।
— আজকেই বাসায় আনবে ওকে।
— ওহ। আমি একবার পিউয়ের সাথে কথা বলি। দেখি ও আমার সাথে যেতে ইচ্ছুক কিনা।
রোদেলা কোমল গলায় বলে, পিউ যাবে।অসুবিধা নেই।
আবেগ বড় আশা নিয়ে বলে, আর তুমি?
রোদেলা চোখের মনি এদিক-ওদিক করতে করতে বলে, আমিও যাব। শাড়িটা বদলে আসি।
আবেগের চেহারায় এক চিলকে হাসি ফুটে উঠল। সে ভাবতেও পারেনি তার ইচ্ছা পূরণ হবে। সত্যি নিজেকে কিছুটা হলেও ভাগ্যবান লাগছে৷
রোদেলা উঠে গেল। আসলে সে এখানে থাকতে পারছেনা। তার কান্না পাচ্ছে। প্রচুন্ড কান্না পাচ্ছে। এতো বছর পর তার নিজের একটা একক সংসার হবে। যেখানে সামান্য লবন কেনার মতো তুচ্ছ বিষয় থেকে শুরু করে বড় বড় সব ধরনের ব্যাপারের দায়িত্ব তার কাধে থাকবে। রোদেলা নিজ হাতে তার বাসা সাজাবে৷
বাসার প্রতিটা কোনায় মায়া নামক বস্তু ঢেলে দিবে। বাসার আনাচে-কানাচেতে তার ছোয়া থাকবে। তার বাচ্চাদের স্মৃতি থাকবে। ভাবতেই কান্না পাচ্ছে তার। রোদেলা শাড়ি বদলানোর নাম করে রুমে এসে অঝোর ধারাউ কেদে দেয়।
নিজেকে বিশ্বের একমাত্র সুখী মহিলা মনে হচ্ছে। এই অশ্রুমালা বেদনার না, যন্ত্রনার ও না, এই অশ্রুমালা কেবল এবং কেবলমাত্র সুখের আভাসের অশ্রু!
সে আলমারি খুলে একটা কচুপাতা রঙের শাড়ি পড়লো। সুন্দর করে কুচি দিয়ে শাড়ি পড়ে বের হলো রুম থেকে।
তারপর রান্নাঘরে গিয়ে দুধ সেমাই বানানোর প্রস্তুতি নিল। দুধ সেমাই আবেগের প্রিয় খাবার৷ সেমাইয়ে আবার কিশমিশ দেওয়া যাবে না। আবেগ কিশমিশ খায় না। অথচ রোদেলার কিশমিশ এতোটাই পছন্দ যে খালি মুখে অনায়াসে চার-পাঁচ টা কিশমিশ খেতে পারবে।
আচ্ছা, আবেগ কি জানে তার কিশমিশ অনেক পছন্দ??
★★★
শ্রাবণ ছাদে একাধারে সিগারেট টানছে আর আলিয়াকে ফোন দিচ্ছে। কিন্তু মেয়েটা তার ফোন ধরছেনা। বরং কেটে দিচ্ছে। এই নিয়ে বিশ বারের অধিক তার ফোন একবার ডায়াল হতেই কেটে দিয়েছে আলিয়া। যতোবারই আলিয়া ফোন কাটে শ্রাবণ উদাস হয়ে যায়।
মাত্রই আলিয়া তার ফোন কেটে দিলো। তাই উদাসিনতা ঘিরে ধরেছে তাকে। সে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে৷
আকাশ বড়ই অদ্ভুত! যখন মন খারাপ থাকবে তখন মনে হবে আকাশটার মন খারাপ। আবার যখন মন খুশি থাকবে তখন আকাশটাকে আনন্দিত লাগবে৷
শ্রাবণ সিগারেটে টান দিয়ে বলে,
আকাশ ভরা তারার মাঝেও, শূন্য আমি!
একলা এই আমি!
তার চোখ চিকচিক করে উঠে। হঠাৎ ফোন বেজে উঠল। তার ঘোর কাটলো। সে ফোনের স্ক্রিনে আলিয়ার নাম লেখা। চেনা নাম্বার থেকে কল আসতে দেখে শ্রাবণ হেসে দিলো।
সে দ্রুত ফোন রিসিভ করতেই আলিয়ার ঝাঝালো কন্ঠস্বর ভেসে আসছে।
— এই! তোর ভাইয়ের সমস্যা কি হ্যা? ভাব নেয় কেন এতো?
শ্রাবণ চমকে উঠে। মেয়েটা এতো ডেঞ্জেরাস কেন? কোথায় ডাক্তার মেয়ে, কোমলীয় হবে, শান্ত হবে তা না রাগ করে তুই-তুরাকি করতেও পিছপা হয় না।
সে মুচকি হেসে বলে, কি করেছে সমুদ্র ভাই?
আলিয়া চেচিয়ে উঠে বলে, আজকে আপাকে দেখতে এসে একবারও তার কাছে গিয়ে বসলো না। তাইলে আসছে কেন মিয়া? ফল দিতে এসেছে? আমার সমুদ্র ভাইয়ার মাথা ফাটাতে মন চাচ্ছে। আপা তার জন্য কেদেছে অথচ সে একবারো আপার দিকে তাকায়নি। রেডিকুলাস!
— আরে চিল! ভাইয়া একটু শান্ত-শিষ্ট, চুপচাপ। কিন্তু মনের দিক দিয়ে সাদা।
আলিয়া দাত কটমট করে বলে, আই হেইট ইউ এন্ড ইউর চৌদ্দ গুষ্টি।
শ্রাবণ হোহো করে হেসে বলে, বাট আই লাভ ইউ!
আলিয়া থ হয়ে গেল। বললো কি আর উত্তর পেল কি! সাপটা এতো বেয়াদব কেন? অসভ্য!
সে খট করে ফোন কেটে দিলো।
শ্রাবণ ফোন পকেটে ঢুকালো। মনটা কিছুটা ভালো লাগছে। সে চোখ বন্ধ করে ফেলে।
আহা কি মধুর দিন কাটিয়েছিল সে আর আলিয়া। কি গভীর প্রেম ছিল তাদের! বাবু তুই না খাইলে আমিও খাব না টাইপ নিব্বা-নিব্বির প্রেম না! একে-অপরকে অনুভব করত তারা!
শ্রাবণ টুকটাক লেখালেখি করত। সেই লেখা আবার ফেসবুকে দিয়ে চরম খ্যাতি লাভ করে। বিরহের লেখা লিখত সে! সেই লেখা পড়ে মেয়েরা হুমড়ি খেয়ে তার প্রেমে পড়ত! তার সাথে কথা বলার জন্য মেয়েরা লাইন লাগাত। শ্রাবণ এসব দারুণ উপভোগ করত। নিজেকে সেলিব্রিটি সেলিব্রিটি লাগত তার।
একবার নারীরা ছলনাময়ী এই টপিকে লিখেছিল৷ ব্যস! কমেন্ট সেকশনে আলিয়া নূর আইডি থেকে বিশাল এক রচনা পায়, তাকে গালিও দিয়েছি আলিয়া।
শ্রাবণ দ্রুত আলিয়ার আইডিতে গিয়ে একটা বড়সড় ধাক্কা খায়। ধাক্কা খায় কারন সে একটা গোলাপি পরি দেখেছিল! আলিয়ার প্রোফাইল পিকচার গোলাপি রঙের একটা জামা পড়া ছিল। সে অনেকক্ষণ ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকে।
এখনো আছে ছবিটা তার ফোনে।
★★★
আবেগ রোদেলা আর পিউকে নিয়ে বের হলো বাসায় ফিরে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে আবেগ আর পিউ ভাগ্যকূলে থেমে পিউয়ের পছন্দের মিস্টি কিনলো। সঙ্গে রোদেলার প্রিয় দই নিতেও ভুলে না আবেগ। দোকানের পাশেই ফুল বিক্রি হচ্ছিল।
পিউ সেখান থেকে রজনীগন্ধার স্টিক কিনে৷ এর আগে এই ফুল সে দেখেনি।
গাড়ি তে বসে সে বারবার ফুলটা নাকে ধরছে৷ অদ্ভুত সুন্দর ফুলটার গন্ধ। সে মাঝখানে বসেছে। বাম পাশে মা আর ডান পাশে বাবা। ফুল হাতে বসে থাকতে তার ছয় বছরের বাচ্চা মেয়ে লাগছে। পিউ অকারণে হেসেই চলেছে।
তার মনে হচ্ছে, সময়টা এতো দ্রুত চলে যাচ্ছে কেন,? একটু আস্তে যেতে পারে না?
পিউয়ের চোখ-মুখে উজ্জ্বলতা, খুশির ছাপ। আজ থেকে নতুন গন্তব্য, নতুন কিন্তু আপন ঠিকানায় যাচ্ছে সে।
চলবে।
#প্রেমপ্রদীপ
part–25
Arishan_Nur (ছদ্মনাম)
কলিং বেল বেজে উঠল। সমুদ্র ড্রয়িং রুমে চুপচাপ বসে আছে। বেল বাজার শব্দে সে মেইন গেটের দিকে তাকায় কিন্তু গেট খোলার জন্য উঠে না বরং কিছুটা বিরক্ত হয়। এই সময় কে আসতে পারে?
ময়নার মা রান্নাঘর থেকে প্রায় দৌড়ে ড্রয়িং রুমে আসলেন। তাকে দেখে সমুদ্র বলে উঠে, খালা আস্তে৷ বাসায় কোন প্রেসিডেন্ট আসেনি যে এভাবে ছুটাছুটি করতে হবে।
ময়নার মা স্মিত হেসে বলে, ভাইজান আসছে বোধহয় ।
ময়নার মা খালা বাবাকে ভাইজান বলে ডাকে এটা জানে সমুদ্র। সে ভ্রু কুচকে বলে, আব্বু বাসায় ছিল না?
— জি না।
— ও।
ময়নার মা গেট খুলে দিল। সমুদ্রের নজর ও দরজার দিকে। গেট খুলতেই আবেগ হাসি হাসি মুখে ভেতরে ঢুকল।
আব্বু কে আসতে দেখে সমুদ্র ও মুচকি হাসে কিন্তু তার হাসিমুখটা মুহূর্তের মধ্যে কালো হয়ে যায় যখন সে মাকে ভেতরে আসতে দেখে।
সমুদ্রের মুখের চোয়াল শক্ত হয়ে যায়। ভ্রু কুচকে ফেলে সে। মুখে রাগের আভা ফুটে উঠল তার। ক্রোধে চোখ জ্বলছে তার।
রোদেলা যখন বাসার ভেতরে পা রাখে তার মনটা আনন্দে নেচে উঠে। এতো আনন্দ লাগছে কেন তার! এই অনুভূতি টা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না৷ সবকিছু আপন- আপন লাগছে তার কাছে। এমনকি বাসার গন্ধটাও মনে হচ্ছে নিজের গায়ের গন্ধ!
সে বাসার ভেতরে ঢুকেই সমুদ্র কে দেখতে পেল। রোদেলার ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটে উঠল ছেলেকে দেখে।
কিন্তু সমুদ্রের চোখে ক্রোধ। দাতে দাত চেপে রেখেছে সে। সমুদ্র বরাবর ই চুপচাপ স্বভাবের। রেগে গিয়ে চিল্লানো তার স্বভাব না। কিন্তু আজকে এই মূহুর্তে প্রচুন্ড জোড়ে চিতকার করতে মন চাচ্ছে তার।
আবেগ সমুদ্র কে উদ্দেশ্য করে বলে, বাইরে, তোমার মায়ের লাগেজ- ব্যাগ আছে নিয়ে আসো তো৷
সমুদ্র চট করে দাঁড়িয়ে গিয়ে বলে উঠে, লাগেজ ব্যাগ মানে? লাগেজ কেন এনেছে উনি? আর এখানেই বা কি চাই তার? কেন এসেছে? (কিছুটা জোড় গলায়)
আবেগ গলার আওয়াজ বাড়িয়ে বলে, চিৎকার করছো কেন? মা-বাবার সাথে উচু আওয়াজে কথা বলতে হয় না সমুদ্র। তোমার মা আজ থেকে এখানেই থাকবে।
— কেন? কেন এখানে থাকবে? এখানে থাকলে কি তার ক্যারিয়ার ঠিক থাকবে? আমাদের স্ট্যান্ডার আর তার স্ট্যান্ডার এক না তো! উনি বড়লোক মানুষ, আমাদের মতো গরীবের ঘরে কেন এসে থাকবে। আমাদের তো এসি নাই!
কথাগুলো তাচ্ছিল্যের সুরে বলে সমুদ্র।
রোদেলা আহত গলায় বলে, আমার এসি লাগেনা৷
— অবশ্যই লাগবে। আপনি টাকা ছাড়া বুঝেন না কিছু। সেলফিশ একটা মহিলা আপনি। দয়া করে আমার বাসা থেকে চলে যান। এখানে এডজাস্ট করতে পারবেন না। কষ্ট হবে আপনার। এক কাজ করেন, সোনারগাঁও বা ওয়েস্টির্ন এ গিয়ে উঠুন। আর রেহাই দেন আমাদের।
সমুদ্র প্রচুন্ড রেগে গেছে। ফর্সা মুখটা লাল হয়ে যাচ্ছে। কথার তাল কেটে যাচ্ছে।মাথা কাজ করছে না।
ছেলের কথায় রোদেলার চোখ ছলছল করে উঠে। সে চুপ রইল। সমুদ্রের এই রাগ তাকে সহ্য করতে হবে। আগুন যখন লাগিয়েছে তখন এর উত্তাপ তো সহ্য করতেই হবে। মানুষের সাথে কথা কাটাকাটি করা যায় কিন্তু নিজের সন্তানের সাথে পারা যায় না!
আবেগ এবার মুখ খুললো।সে রোদেলা কে উদ্দেশ্য করে বলে, তুমি রুমে গিয়ে ফ্রেস হও। ওর কথা শুনতে হবে না।
একথা শুনে সমুদ্র আরো রেগে যায়। সে ধাম করে হাতে থাকা রিমোট সজোরে ফেলে দিয়ে নিজের রুমের দিকে হাটা ধরল।
যাওয়ার আগে সমুদ্র তার বাবার সামনে গিয়ে বলে, আব্বু আপনি একজন মেরুদণ্ড হীন পুরুষ। আপনার জায়গায় আমি হলে কোন দিন তাকে ক্ষমা করতাম না, যার কাছে আমি অপশনাল!
সমুদ্র গটগট করে হেটে তার রুমে ঢুকে গেল এবং জোড়ে করে দরজা লাগালো।
আবেগ সমুদ্রের কথায় বিচলিত হয়না। ছোট মানুষ, গরম রক্ত টগবগ করছে। এই রকম যুবক বয়সে তেজ থাকবে, রাগ থাকবেই।
সে রোদেলাকে আশস্ত দিয়ে বলে, রেগে আছে ও। এখন তোমাকেই রাগ ভাঙ্গাতে হবে। এখানে আমার কিছু করার নেই। শুধু বেয়াদবি করলে ব্যাপার টা আমি দেখব।এছাড়া বাকিটা তোমাদের মা-ছেলের ব্যক্তিগত ব্যাপার।
এতটুকু বলে আবেগ পিউয়ের কাছে গেল৷ পিউ বাসার বাইরে দাঁড়িয়ে থেকে ভাইয়ের কথা শুনছিল। সত্যি বলতে তার খুব কষ্ট হচ্ছে। ভাইয়া এমন কেন করে? এতো রাগী কেন!
আবেগে পিউকে উদ্দেশ্য করে বলে, কি ব্যাপার পিউমনি ভেতরে আসো।
পিউ মুখ কালো করে বলে, কিন্তু ভাইয়া তো রেগে গেলো আমরা আসায়।
আবেগ স্মিত হেসে বলে, বাবার বাসায় মেয়ের রাজত্ব বেশি! ছেলেটা তো কিছুদিন বাদে পর হয়ে যাবে।
পিউ হিহি করে হেসে ফেলে বলে, বাবা, মেয়েরা বিয়ের পরে পরের ঘরের হয়ে যায়।
— দূরে গেলেই বুঝি পর হয়!
পিউ ভেতরর ঢুকে বাবার বলা কথাটা ভাবতে লাগে। ভাইয়ার তো বিয়ে হয়ে গেছে। তবে কি তাকেও বিয়ে দিয়ে দিবে? অবশ্য তার বিয়ে করতে কোন সমস্যা নাই। এতোটুকু ভাবতেই পিউ নিজের কথায় নিজেই লজ্জা পেল!
রোদেলা আবেগ আর তার বেডরুমে গেল। রুমটা পুরাতন হয়ে গেছে কিন্তু ওয়াল ঝকঝকে করছে। সম্ভবত নতুন করে পেইন্ট করা হয়েছে৷ সে ছলছল চোখে চারপাশে তাকালো। বিয়ের পরের দিন ঠিক যেমনটা অনুভব করেছিল আজকে তেমনি অনুভব করছে সে। কিছুটা সংকোচ, কিছুটা ভীত আর মাঈল খানেক ভালো লাগার এক দারুণ মিশ্র অনুভূতি!
রোদেলা পেছন থেকে দরজা খোলার শব্দ পেল। হয়তোবা আবেগ এসেছে। রোদেলা পেছনে তাকালো।
প্রিয়জনকে পেছন থেকে দেখতে নেই! বরং সামনে বসিয়ে মুখোমুখি হয়ে দেখতে হয়!
— রোদেলা?
রোদেলা পেছন থেকেই বলে উঠে, জ্বি?
— কোন কিছু লাগলে আমায় বলবে। আচ্ছা?
রোদেলার জবাব না পেয়ে আবেগ বলে, সমুদ্রের কথায় মন খারাপ করেছো?
রোদেলা এবার আবেগের দিকে ঘুরে তাকালো।
রোদেলাকে দেখামাত্র আবেগের বুকটা ছ্যাত করে উঠে। সে তো ভেবেছিল রোদেলা এমনি দাঁড়িয়ে আছে। কে আবার জানত সে কেদে বন্যা বইয়ে ফেলেছে। রোদেলার চোখ ভরা অশ্রু দেখে মনে মনে বলে, রোদেলাকে কাদলেও কতোটা মায়াময়ী লাগে!
আচ্ছা রোদেলা কি আসলেই সুন্দর নাকি তার চোখে তাকে সুন্দরী লাগে? প্রশ্নটা তোলা রাখলো হুট করে একদিন রোদেলাকে জিজ্ঞেস করা যেতে পারে। আপাতত তার কান্না থামাতে হবে।
আবেগ ধীর পায়ে রোদেলার দিকে আগালো। সে একাধারে কেদেই চলেছে। কাদতে কাদতে হিচকি তোলার অবস্থা। তাকে কাদতে দেখে আবেগের কষ্ট হচ্ছে। কিছু কিছু মানুষ আছে যাদেরকে আমরা কখনোই কাদতে দেখতে চাই না। আমাদের চোখ তাদের কান্নারত মুখ দেখতে চায় না জন্য নিজেও ঝাপসা হয়ে যায়! আচ্ছা এই শ্রেণির মানুষ কে কি তবে ভালোবাসার মানুষ বলে?
হতে পারে! ইদানীং আবেগের কি যেন হয়েছে। কোন কিছুই সুক্ষ্ম ভাবে ভাবতে পারেনা। সম্ভবত চিন্তা করার ক্ষমতা তার লোপ পেয়েছে৷
আবেগ কাছে এসে দাড়াতেই রোদেলার কান্নার বেগ আরো কয়েকগুণ বেড়ে গেল। আবেগ বুঝে পাচ্ছে না কি করা উচিত তার! সে রোদেলার গাল বেয়ে লেগে থাকা নোনাজল নিজের ডান হাত দিয়ে মুছে দিলো। রোদেলা নড়েচড়ে উঠল এবং মৃদ্যু কেপে উঠে।
আবেগের ছোয়া পেয়ে রোদেলা আরো অনুভূতি পূর্ণ হয়ে পড়ে এবং হাউমাউ করে তার বুকে ঝাপ্টে পড়ে কাদতে থাকে। আবেগ ভ্রু কুচকে কিছুক্ষন রোবটের ন্যায় দাঁড়িয়ে থাকে।
মনটাতে এতোবছরে ধুলো জমে ছিলো।ধুলোর মধ্যে মনটা চাপা পড়ে ছিলো। আজকে রোদেলার স্পর্শ পেয়ে ধুলো-বালি সরে যাচ্ছে নাতো! এজন্য ই বোধহয় বুক চিনচিন করছে।
আবেগ ও রোদেলাকে পরম যত্নে জড়িয়ে ধরে বলে, আরে! কি আশ্চর্য! কাদছো কেন বাচ্চাদের মতো করে। দেখি কান্না থামাও। বাচ্চারা দেখলে কি ভাব্বে? দেখো তো কি কান্ড! এই বয়সে এসে এমন কান্না মানায় নাকি!
★★★
আয়না বিছানায় শুয়ে আছে। মাথার উপরের সিলিং ফ্যানটার উপর তার নজর। ফ্যানের তিনটা পাখাই থেমে আছে। তার মনে হচ্ছে, গায়ে থাকা কাথা, ওড়না সরিয়ে ফেলে, ফ্যানটা ফুল স্প্রীডে ছেড়ে দিতে। জ্বর যখন সেরে উঠতে ধরে তখন নাকি গরম লাগে। আয়না চায় না তার অসুখ ভালো হোক। সে অসুস্থ হওয়ার পর বাবা তাকে রেখে কোথাও যায় নি। অফিসেও না। বাসায়ই ছিলো। শুধু তাই না! মাও তার অনেক সেবা করেছে। মনে মনে আয়না অনেক প্রফুল্ল! জ্বর না সারলেও তার মন কি সেরে উঠছে নাতো!
আয়না গা থেকে কাথা সরালো। পিঠ ঘামের জন্য ভিজে গেছে। সে উঠে বসলো। বিছানার পাশের টেবিলে হাফ গ্লাস ডাবের পানি রাখা। আয়না মুচকি হেসে গ্লাসটা হাতে দিলো এবং ডাবের পানির গ্লাসে চুমুক দিলো।
সমুদ্র নাকি তার জন্য আজ দু’দিন ধরে দুইটা করে ডাব পাঠায় তাকে খাওয়ানোর জন্য।
এজন্য আগ্রহ নিয়ে খায় আয়না। ডাবের পানি খাওয়ার পর খুব শান্তি লাগে তার। আজকের ডাবে একটা শাঁশ ও ছিলো। আয়না খুশি মনে সেই শাঁশ খেয়েছে।
সমুদ্রের কথা ভাবতেই তার চোখের কোণে পানি চিকচিক করছে। আচ্ছা কি হয় যদি সমুদ্র অন্তত একবারের জন্য হলেও তার সাথে দেখা করতে আসে। এক সেকেন্ডের জন্য হলে ও চলবে। এতোই ব্যস্ত সে! আয়না কি এতোটাই তুচ্ছ সমুদ্রের কাছে? তুচ্ছ এবং বিরক্তিকর?
নাকি সমুদ্র তাকে ঘৃণা করে? সে বিধবা জন্য তাকে ঘৃণা করে কি সমুদ্র? আয়নার অসুখ মাখা মুখ টা মলিন হয়ে গেল। সমুদ্র কে একবার দেখার জন্য তার মন ছটফট করছে কিন্তু কাউকে কিছু বলতে পারছেনা। আচ্ছা সমুদ্র কে কি একবার ফোন দেওয়া যায় না? কিন্তু তার তো ফোন নেই! নাম্বার ও জানে না সে।
আয়না উঠে বসলো। আলিয়ার কাছে ফোন নাম্বার আছে। তার কাছ থেকে ফোন দিলেই সমুদ্র কে পাওয়া যাবে৷
আয়না তার ঘর ছেড়ে বের হয়ে আলিয়ার কাছে গেল।
আলিয়া তখন বসে বসে পড়ছিলো। আপাকে তার রুমে আসতে দেখে কিছুটা বিষ্মিত হলো সে। আপা এতোদিনে একবারও রুম ছেড়ে অন্যকারো রুম যায়নি। মাঝে মধ্যে ছাদে যেত। আজ হুট করে কি হলো?
আয়না আলিয়ার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করে, তোর ফোনটা দিতে পারবি?
আলিয়া প্রথমে হতভম্ব হলো। তারপর খুশি হলো সে। সে দ্রুত তার ফোনটা আপার হাতে ধরিয়ে দিলো।
আয়না ফোন হাতে নিয়ে তার রুমের দিকে পা বাড়ালো। রুমে পৌছে সে দরজা লাগিয়ে দিয়ে সোজা বারান্দায় চলে গেল।
তার রুমের সাথে লাগানো বাথরুম ও বারান্দা আছে।
সে ফোনের ডায়াল লিস্ট থেকে এস লিখতেই সমুদ্রের নাম চলে আসে।
সে এক মুহূর্ত অপেক্ষা না করে কল দেয়। কিন্তু অনেকক্ষণ রিং হওয়ার পর ও সমুদ্র উঠালো না। এতে আরো অস্থির লাগতে শুরু করে আয়নার।
সে আবারো কল দেয়। এবারে কল রিসিভ করে সমুদ্র এবং সঙ্গে সঙ্গে হ্যালো বলে উঠে।
আয়না স্তব্ধ হয়ে যায়। সমুদ্রের কন্ঠস্বর শুনার পর তার গা বেয়ে শিহরণ বয়ে যায়। ঘাবড়ে যায় সে। কি বলবে সে? তাই চুপচাপ থাকলো।
সমুদ্র হ্যালো হ্যলো করে থেমে যায়। দুজনেই চুপচাপ ফোন কানে ধরে বসে রইল।
তারপর সমুদ্র নিরবতা ভেঙে বলে উঠে, আয়না!
সমুদ্রের মুখে নিজের নাম শুনেই আয়না কেদে দিয়ে বলে, তুমি কি একবার আসতে পারবে?
সমুদ্র কঠিন স্বরে না বলতে চাচ্ছিল কিন্তু পারলোনা। খট করে ফোন কেটে দেয় সে।
চলবে।