প্রেমপ্রদীপ পর্ব-৩০+৩১

0
2890

#প্রেমপ্রদীপ
Part–30
Arishan_Nur (ছদ্মনাম)

নিয়তি মাঝেমাঝে আমাদের পরিস্থিতি দেখে হেসে দেয়! হেসে দিয়ে বলে, এতো ভাবার কি আছে! Just go with the flow. বাকিটা আমি সামলে নিব।

কিন্তু নাহ! মহান মানবেরা নিয়তির এ বাণী কানে নেয় না। তারা নিজেরাই সবকিছু করতে চায়। স্রোতের প্রতিকূলে ভেসে যেতে চায়। এজন্য তা দেখা নিয়তি হেসে ফেলে।

আবগ রোদেলাকে কাদতে দেখে কিছুটা জোড় গলায় বলে, এতো কাদার কিছু নেই তো। শক্ত হও।

রোদেলা টলমল চোখে আবেগের দিকে তাকালো। আবেগের বুকটা দুমড়েমুচড়ে যেতে লাগে। তবুও সে নিজেলে সামলে নিয়ে বলে, রোদেলা! এই কথাটা তোমার-আমার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে। আর কাউকে জানাবে না। স্পেশালি পিউকে। পিউ বাংলাদেশে ঘুরতে এসেছে। ওকে এসবের মধ্যে জড়াবে না প্লিজ।

রোদেলা চাপা বেদনা গলায় বলে, তোমার মাথা ঠিক আছে? তোমার অসুস্থতার খবর ওদের সবার আগে জানা উচিত। আর তুমি ব্যাপার টা গোপন ই বা কেন করতে চাইছো?আজকে ধরা না খেলে তো আমিও জানতে পারতাম না।

আবেগ মাথা নিচু করে নিল। রোদেলা যে সবাইকে বলবে এই ব্যাপারে সে শতভাগ নিশ্চিত। রোদেলা কেন বোঝেনা যে সে চায় না তার জন্য বাচ্চারা কষ্ট পাক। তার ক্যান্সার একথা শুনলেই পিউ কান্না জুড়ে দিবে।মেয়েটার চোখে কান্না মানায় না একদম ই।

সে ছোট্ট করে দম ফেললো।

রোদেলা এখনো কেদেই যাচ্ছে। সে রোদেলার পাশে বসে বলে, কেদো না। তোমরা কাদলে আমার খুব কষ্ট হয়। রোদেলা?

–হু।

— আমি শেষ কিছু দিন তোমাদের সাথে খুব সুখে কাটাতে চাচ্ছি। তোমার ছুটি কবে শেষ? আমেরিকা যেতে হবে কবে? আর এক মাস কি থাকা যায়?

প্রতিত্তোরে রোদেলার কাছ থেকে জবাব না পেয়ে সে নিজ থেকে বলে উঠে,

এক মাস না হলে ও চলবে। দশ-পনেরা থাকো। এতেই হবে।

রোদেলা হুট করে বলে উঠে, আমি আর কোথাও যাব না! আমার অনেক বড় ভুল হয়ে গেছে৷ আমার জন্য আজকে তুমি অসুস্থ।

–অসুস্থতা কারো জন্য তো হয় না। এখানে তোমার কোন দোষ নেই। আল্লাহ তায়াল প্রদত্ত রোগ আসে। মানুষের জীবনে আল্লাহ রোগ দিয়ে মানুষ কে পরীক্ষা করে। এখানে তোমার কোন হাত নেই।

রোদেলা কেদে কেদে উত্তর দিল, তোমার নিজের প্রতি অযত্নের জন্য আজকে তুমি অসুস্থ। আর এইজন্য আমি দায়ী। আমি তোমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলাম। কেউ ছিল না তোমার সঙ্গে। তুমি একা একা নিজের যত্ন নিতে পারোনি।

আবেগ স্মিত হেসে বলে, অযত্নের জন্য ক্যান্সার হয় না।

— তাহলে কিসের জন্য হয়?

–, জিনে মিউটেশন ঘটে গেলে এমনটা হয়৷ এখানে তোমার কোন হাত নেই৷

রোদেলা তাও বিড়বিড় করে বলে, আমি অনেক বড় ভুল করে ফেলেছি। আমাকে ক্ষমা করে দাও! তোমাকে রেখে বিদেশে যাওয়া ঠিক হয়নি। তোমার সাথে থাকা উচিত ছিল! আমায় ক্ষমা করে দিও।

আবেগ কড়া গলায় বলে, কাদবে না একদম!

— আমি কোথাও যাব না!

— আচ্ছা যেতে হবে না।

রোদেলা চুপ হয়ে গেল।

আবেগ আর কিছু বললো না। আসলে সে বলতে পারছে না কিছু। গলা আটকে আসছে৷ একবার অলরেডি সে রোদেলার সামনে কেদে দিয়েছে আর কাদতে চাচ্ছে না৷

তখনি বেল বেজে উঠল। সে দ্রুত উঠে গিয়ে গেট খুলে দেখে পিউ দাঁড়িয়ে আছে৷

পিউকে একা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সে ভ্রু কুচকে বলে, তোমার ভাই কই?

— ভাইয়া কাজে গেছে। হাসপাতাল থেকে ওকে এপোয়েন্টমেন্টের জন্য ডেকেছে৷

— তুমি একা একা আসলে নাকি?

–হু।

আবেগ চিন্তিত মুখে বলে, সমস্যা হয় নি?।

তখনই রোদেলা তাদের কাছে এসে দাড়ালো এবং ফ্যাকাসে মুখে পিউকে চেপে ধরে ডুকরে কেদে উঠে বলে, পিউ রে! মা তোর বাবা খুব অসুস্থ! ক্যান্সার ধরা পড়ছে।

পিউ স্তব্ধ হয়ে যায়। সে ধপ করে মেঝেতে বসে পড়ে। আবেগ ও হতভম্ব! মেয়ে তার কাদছে তাও ফ্লোরে বসে! কি করবে এখন সে?

মেয়েটা মাত্র বাসায় আসলো। এখনি জানানো ঠিক হলো না রোদেলার। পরে আস্তে ধীরে বললেও হতো৷

সেও মেয়ের দেখাদেখি মেঝেতে বসে পরে। মা-মেয়ে কান্না করছে। কিন্তু সে কিছুই করতে পারছে না৷ মাথা কাজ করছে না তার।

সমুদ্র থাকলে খুব উপকৃত হত সে। সমুদ্র এমন না । সে যথেষ্ট শক্ত ছেলে। তার অসুখের খবর শুনে ঘন্টা খানেক চুপ থাকবে। তারপর বলবে, ক্যান্সার কোন অসুখ হলো! আজকাল ক্যান্সার হলো জ্বর-সর্দির মতো! ছেলেটাকে নিয়ে আবেগের অনেক গর্ব। খুবই যুক্তি বাদী এবং ঠান্ডা মাথার ছেলে সে। পুত্র হিসেবে তাকে দশে এগারো দেওয়া যেতে পারে।

তার পিউমনিকে নিয়েও অহংকার হয়। পিউমনি হচ্ছে একটু আল্লাদি আর নরম মনের। একটুতেই কেদে ভাষায়। এটা অবশ্য মেয়েলী স্বভাব। সব মেয়েরাই নরম মনের হয়। Soft as cotton. এই নরম মনের অধিকারীনীরাই আবার জগতে রাজ করছে। পুরুষ সিংহাসনে বসলে ও পৃথিবী চালাচ্ছে মেয়েরা।

আচ্ছা, সম্ভবত, নরম মনের রমনীরা জগৎ চালাচ্ছে জন্যই এই বিশাল জগতটা টিকে আছে। নাহলে এতোদিনে পুড়ে ছাড়াখাড় হয়ে যেত!

★★★

আয়না চা বানিয়ে এনে বারান্দায় বসলো। বিকেলের শেষ ভাগ। চা হাতে নিয়ে দেয়ালে ঘেষে থাকা রকিং চেয়ারটায় বসল। দেয়াল ঘেষে রাখায় রকিং চেয়ারটা নড়ানো যায় না। সাধারণ চেয়ারের মতোই এক জায়গায় বসে থাকে। আয়নার অবশ্য দোলনা আর রকিং চেয়ারে দোল খেতে ভয় লাগে, মাথা ঘুরায়!

সে বারান্দার বাইরে তাকালো।চারিপাশে শূন্যতায় খা খা করছে। আগে আম গাছ ছিল । আম গাছের ডালপালা,পাতা, তার বারান্দার সাথে ঘেষে থাকত। আগে সে আর আলিয়া বৈশাখের শুরুতে কাচা আম এখান থেকে চুরি করে খেত। চুরি করেখেত কারন, এই গাছটার মালিক, আম পাকলে তাকেই দিয়ে যেত। খুব ভালো ছিল চাচা। এখন আর নেই। বছর পাচেক আগেই মারা গেছেন।

উনার বাড়িটা ভেঙে এখন বিল্ডারর্সরা বারো তলা বিল্ডিং বানাবে। যেদিন চাচার বাসা ভাঙ্গা শুরু হয় আয়না খুব কেদেছিল।

চাচাও নেই, চাচার লাগানো আম গাছটাও আর নেই। সে হতাশ হলো।

এতোকিছু ভাবতেই তার চা ঠান্ডা হয়ে গেল। সে চায়ে চুমুক দিয়ে মুখ কুচকে ফেলে।

নাহ এই চা খাওয়া যাবে না। আয়না চা খাওয়ার ব্যাপারে বেশ শৌখিন। চা হতে হবে চুলা গরম।কাপে ফুক দিয়ে দিয়ে ছোট ছোট চুমুক দিতে হবে।

কিন্তু সমুদ্র এর উলটা। সে চা ঠান্ডা হওয়ার পর খায়। সে খেয়াল করেছে ব্যাপার টা।

রান্না-বান্না করেই রেখেছে। শুধু খাওয়া বাকি। মা আর আলিয়া আসলেই খাওয়া হবে। তাদের বাসায় খাওয়া যখন তখন হয়।

রাতের খাবার তারা আটটার মধ্যে ও খায় মাঝে মাঝে। তাদের বাসায় আয়নাই শুধু চা খায়। এই চা খাওয়ার অভ্যাস তার ক্যামিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টে ভর্তি হওয়ার পর হয়েছে। রাত জেগে পড়ার সময় ফ্ল্যাস্কে করে চা বানিয়ে টেবিলে রাখত৷

এক পাশে পানির বোতল আর এক পাশে চায়ের ফ্লাক্স। আয়নার আরো একটা অভ্যাস আছে। তা হলো চা খাওয়ার পর এক ঢোল পানি খাওয়া।

দাদি বলে, চা খেয়ে পানি খেলে নাকি দাত পড়ে যায়। তার বেলায় এমন কিন্তু কিছু ঘটেনি।

আজকে অনেক দিন পর তার বই পড়তে ইচ্ছে করছে। যে-সে বই না ইংরেজি সাহিত্যের কালজয়ী কিছু কবিতার বই পড়তে মন চাচ্ছে তার। তার কবিতা পড়ার নেশা আছে। কিন্তু কবিতা শুধু ইংরেজি সাহিত্যের পড়ে। তার মনে হয়, রসায়ন বিভাগে না পড়ে ইংরেজি সাহিত্যে পড়লে ভালো হত!

আয়নার চোখ গেল নিচের দিকে। মা আর আলিয়া ফিরছে। সে উঠে দাড়ালো। তার কেন যেন মন চাচ্ছে উপর থেকে মাকে জোড়ে করে ডাক দিতে। এই কাজটা করা কি আদৌ ঠিক হবে?

সমুদ্র তাকে মনের যত্ন নিতে বলেছে৷ তাই মন যখন যা করতে চাইবে তাই করা উচিত।

সে জোড়ে হাক পেড়ে ডেকে উঠে, আম্মু!

অথৈ আয়নার আওয়াজে উপরে তাকাতেই ভড়কে গেল। আয়না তাকে দেখে মুচকি হেসে হাত নাড়ছে। তার পরনে হলুদ রঙের সালোয়ার কামিজ।

আয়না তো রুমে থেকে বের হতে চায় না। সেই মেয়ে আজ বারান্দা থেকে দাঁড়িয়ে তাকে ডাকছে। ব্যাপার টা অদ্ভুত লাগলো তার।

বাসায় এসে আরো অবাক হন সে। আজকে নাকি রাতের রান্না আয়না করেছে। সে খুশিই হলো।

আলিয়া ফ্রেস হয়ে এসে বোনের পাশে বসে খেতে লাগলো। আয়নাও তার সাথে খেতে বসেছে। তার খুব ঘুম পাচ্ছে।

রাতে খেয়ে ঘুমিয়ে পড়বে। তবে সমুদ্রের সাথে আবারো কথা বলতে ইচ্ছা করছে।

সমুদ্রের কথা ভাবতেই তার লজ্জা লাগছে। আচ্ছা সমুদ্র কি তার স্বামী?

মনের মধ্যে খচখচ করতে লাগলো। প্রথম স্বামী না। দ্বিতীয় স্বামী। আয়নার মুখে মেঘের কালো ছায়া নেমে আসল৷

সে কি সমুদ্রর যোগ্য? কোন ভাবে কি সে সমুদ্রকে ঠকাচ্ছে? সমুদ্রের ভালোবাসা পাওয়ার অধিকার বা যোগ্যতা কি তার আছে? সমাজ কি বলবে? বিধবা সে!

সমুদ্রের সাথে কি সে বেমানান?

চলবে।

#প্রেমপ্রদীপ
Part–31
Arishan_Nur (ছদ্মনাম)

রোদেলাকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে বসে আছে আবেগ। কিছুক্ষন আগে রোদেলার মাথায় পানি ঢালা হয়েছিল। তার প্রেসার বেড়ে গেছে। সেই সাথে শ্বাসকষ্ট শুরু হয়েছিল। ভাগ্যিস ঘরে ইনহেলার ছিলো। রোদেলার আগে থেকেই শ্বাসকষ্টের সমস্যা। বেশী ঘাবড়ে গেলে, ভয় পেলে, টেনশনে থাকলে সমস্যা হয় তার শ্বাস নিতে। আজকেও এর ব্যতিক্রম হয় নি।

আবেগ রোদেলাকে নিয়েই বসে আছে। তাকে রেখে অন্য কোথাও যেতে ইচ্ছা করছে না। একবার পিউয়ের খবর নেওয়া দরকার। আর সমুদ্র এখনো আসছে না কেন? রাত তো হয়ে গেল।

আজকে ইভানা তার ছেলেকে নিয়ে ননদের বাসায় ঘুরতে গেছে। তারা সকালেই বেরিয়ে গেছে। আজকের রাতটা ওইখানে থাকবে।

সে রোদেলার দিকে তাকালো। তার মুখমণ্ডল লাল হয়ে আছে। চোখের নিচে পানি চিকচিক করছে। রোদেলার প্রতি মায়াটা আরো জোড়ালো করে আকড়ে ধরছে আবেগকে। এই ক’টা মানুষ ই তো তার আপন! সে মারা গেলে তো এরাই তার জন্য দোয়া করবে। তার ও চোখ ভরে উঠল।

সে রোদেলার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো।রোদেলা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন।

ঘুমের ঔষধ খাইয়ে দিয়েছে আবেগ। তার ই ফলস্বরূপ সে এখন শান্তির ঘুমে আছে।

আবেগ তার কপালে ঠোঁটের মৃদ্যু উষ্ণ স্পর্শ একে দিলো। বুকের ভেতর টা তার ঠান্ডা হয়ে এলো।

রোদেলাকে নিজের কাছ থেকে সরিয়ে বিছানায় বালিশের উপর মাথা রেখে ঠিক মতো শুইয়ে দিল।

ফাল্গুনের শুরু সবে। শীত ভাব যায় নি এখনো। পাতলা কাথা তার গায়ে জড়িয়ে দিয়ে লাইট অফ করে মেয়ের কাছে গেল সে।

পিউ রুমে চুপচাপ বসে ছিল। এই রুমে সে আর ফুপি থাকে। আজকে ফুপি নেই বলে সে একা আছে। পিউ বিছানায় হেলান দিয়ে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সাদা দেয়ালের দিকে। নিজেকে বড্ড অসহায় লাগছে! বাবা অসুস্থ! তাও আবার ক্যান্সার! কিন্তু সে তাকে একবারো জানায় নি। কিংবা প্রয়োজন বোধ ও করেনি। আচ্ছা বাবা কি তাকে নিজের মেয়ে ভাবে না? আপন ভাবে না? দূরে থাকে বলে ভালোবাসে না?

এমন চিন্তা মাথায় আসতেই তার কষ্ট হতে লাগে। পিউ ডুকরে কেদে দিল।

আবেগ প্রায় সঙ্গে সঙ্গে মেয়ের রুমে ঢুকে ব্যতিব্যস্ত হয়ে বলে, মা! আর কান্না করিস না তো। আর কত কাদবে মা?

পিউ চোখ তুলে বাবার দিকে তাকায়। বাবাকে দেখে বোঝার কোন জো নেই তার এতো বড় কঠিন অসুখ হয়েছে। তাকে বিন্দুমাত্র বিচলিত লাগছে না।

পিউয়ের কান্নারত চেহারাটা দেখে আবেগ প্রথমে চমকে উঠে। তার মনে হচ্ছে, আম্মা খাটে বসে আছে। অবিকল আম্মার মতো লাগছে পিউকে! বয়স কম থাকতে আম্মা একদম ঠিক পিউকে এখন যেমন দেখতে লাগছে, সেরকম ছিল দেখতে! কি অদ্ভুত নিয়তির খেল!

আবেগ পিউয়ের মাথায় হাত দিয়ে বলে, আসো! খেতে আসো মা।

পিউ বাবার হাত সরিয়ে কিছুটা জোর গলায় বলে, তুমি আমাকে নিজের মেয়ে ভাবো না তাই না? নিজের অংশ ভাবো না তাই না আব্বু?

আবেগের ভ্রু কুচকে গেল। সে চিন্তিয় এবং না বুঝেই বলতে লাগলো, এসব কি বলছো পিউমণি?

— ঠিকই বলছি আব্বু। যদি নিজের মেয়ে ভাবতে তবে এতো বড় সত্যটা আড়াল করতে না কোনদিন।

এতোটুকু বলেই পিউ কেদে দিলো আবারো। আবেগ স্মিত হেসে মেয়ের পাশে বসে বলে, তোমরা দুই ভাই-বোন ই আমার জীবন। দুইজনকেই সমান সমান ভালোবাসি। আমি আসলে তোমাদের কষ্টে দেখতে চাই না! এই যে তুমি এখন কাদছো এই দৃশ্যটা আমার জন্য একটা শাস্তি! এই দৃশ্যটা দেখতে চাই নি আমি তাই সত্যটা গোপন করেছিলাম।

— ভাইয়া জানে?

— নাহ। ওকে কিছু বলি নি আমি৷

পিউ বাবার দিকে অসহায় চোখে তাকিয়ে আছে।

আবেগ পিউকে বলে, ডিনার করে নেও মা।

— খাব না। খিদে নেই আমার৷

— এক গ্লাস দুধ দেই? খাবে?

— না।

আবেগ উঠে গিয়ে দুধ গরমে দিলো। না খেয়ে ঘুমানো ঠিক না। পেট খালি রেখে ঘুম আসবে না পিউয়ের। তাই মেয়ের জন্য দুধ গরম করছে।একটা সময় ছিল যখন সে রান্না বাজার এসবের কিছু ই বুঝত না। অথচ এখন সে প্রতিনিয়ত বাজার করছে। রান্না হচ্ছে, পরিবারের সদস্যরা খাচ্ছে।

আবেগের মাথায় হুট করে উদ্ভট একটা চিন্তা আসলো। তার ছেলেটাও তো বাজার করে না কোন দিন। সে যখন সাংসারিক জীবনে যাবে কি করবে?

দুধ গ্লাসে ঢালতে ঢালতে সে মনে মনে বললো, ঠিকই হাসপাতাল থেকে ফেরার পথে তখন এক কেজি আলু, পটল হাতে করে আনবে। শুক্রবার করে কাচা বাজারে গিয়ে রুই-কাতলা, বোয়াল মাছ কিনে আনবে ছেলে।

ছেলেদেরকে বাজার আর মেয়েদেরকে রান্না করা হাতে-কলমে শেখাতে হয়না। এসব গুণ তাদের ডিএনএ তে থাকে। আপনা-আপনি তারা এই কাজ দুটি করতে শিখে যায়৷

সে মেয়েকে জোড় করে ধরে-বাধে দুধ খাইয়ে দিলো। তারপর শুয়ে পড়তে বলে নিজের রুমে চলে আসে।

রোদেলা গভীর ঘুম। আবেগ ফোন হাতে দাঁড়িয়ে আছে। একবার বারান্দায় যাচ্ছে তো একবার রুমে আসছে। সমুদ্রের সাথে তার মাত্র কথা হলো। সে ফিরছে। বাসার সামনের গলিতে এসে গেছে সে। তবুও অস্থির লাগছে তার। বাসায় না আসা অব্দি এই অস্থিরতা কাজ করতেই থাকবে। সে সাইড টেবিল থেকে পানি ঢেলে খেয়ে নিল।

তখনি বেল বেজে ওঠে। সে দ্রুত গেট খুলে দেয়৷

গেটের বাইরে সমুদ্র দাঁড়িয়ে আছে। হাসি হাসি মুখ করে। হাতে মিস্টির প্যাকেট।

সে বাবাকে দেখেই শান্ত গলায় বলে উঠে, আব্বু আমার না পপুলারে মেডিকেল অফিসার হিসেবে চাকরি হয়ে গেছে। স্টাস্টিংয়েই পয়ত্রিশ হাজার দিবে।

আবেগ নিজেও এ খবর শুনে খুব খুশি হয়ে বলে, আলহামদুলিল্লাহ। বাবা ফ্রেস হয়ে দুই রাকাত শুকরিয়া নফল নামাজ পড়ো৷

সমুদ্র জানে কোন খুশির বা দুখের যেই সংবাদ ই আসুক না কেন বাবা দুই রাকাত নফল নামাজ পড়তে বলে। সে তার রুমে চলে গেল। যাওয়ার আগে বাবার কাছ থেকে পিউয়ের খোজ নিল।

রাত বেশি হয়ে গেছে জন্য আর পিউয়ের রুমে গেল না৷ নিজের রুমে ঢুকে পড়লো।

আবেগ গেট লাগিয়ে দিয়ে রোদেলার কাছে গেল। তারপর তার পাশে শুয়ে পড়লো। নিস্তব্ধ রাত। চারিদিক শুনশান! আবেগ শুধু ভাবছে, কবরে কিভাবে থাকবে সে? সে যে অন্ধকার বড্ড, বড্ড বেশি ভয় পায়!!!

★★★

রাত আটটার দিকেই আয়না শুয়ে পড়েছিল। এতোক্ষণ ঘুমাচ্ছিল সে। পানির পিপাসা পেয়ে ঘুম ছুটে গেল। সে পিটপিট করে চোখ খুললো। ঘুমের মধ্যে চমৎকার একটা স্বপ্ন দেখেছে সে। স্বপ্নের কথাটা ভাবতেই তার গাল লাল হয়ে এলো।

সম্পূর্ণ স্বপ্ন জুড়ে সমুদ্রের উপস্থিতি ছিল। স্বপ্নটা কিছুটা এমন,

সমুদ্র ঘুমিয়ে আছে। সকালের গভীর ঘুম৷ নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে সে। কিন্তু আয়না এত্তো সকালে উঠে গোসল করে রেডি হচ্ছে কোথাও যাওয়ার জন্য। শাড়ি পড়েছে সে। হালকা বাদামি কটনের শাড়ি। চুল গুলোতে বেনী বেধে সে সমুদ্রের কাছে গিয়ে তাকে ডাকতে লাগে। সমুদ্র ঘুমের মধ্যেই হু হু করছিলো। কিন্তু ওঠার নাম নাই। তাই ডেকেই যাচ্ছে সমুদ্র উঠে না।

তাই উপায় না পেয়ে সে বিছানায় বসে সমুদ্রের হাত ঝাকাতে লাগলো।

সমুদ্র ছোট ছোট করে চোখ খুলে এবং হাই তুলতে লাগে।

আয়না ঝাঝালো কন্ঠে বলে, এই উঠো! অফিস যাবে না?

— না।

— কেন?

— খুব ঘুম পাচ্ছে। ঘুমাব।

— এটা কেমন কথা? ঘুমের কারনে অফিস মিস দিবে?

সমুদ্র চোখ খুলে তার দিকে তাকায় এবং আয়নার হাত হ্যাচকা টান দিয়ে তাকে নিজের বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে, তোমাকে নিয়ে ঘুমাব।

আয়না কড়া চোখে তার দিকে তাকালে, সমুদ্র আরো নিবিড় ভাবে তাকে জড়িয়ে ধরে বলে, আমরা স্বামী-স্ত্রী না? এজন্য একসাথে ঘুমাব, একসাথ খাব। শুধু বাথরুমে আলাদা আলাদা যাব।

স্বপ্ন এতোটুকুই ছিল। এরপর ঘুম ভেঙে যায়। আয়না উঠে এক গ্লাস পানি খেল।

তার এখন সমুদ্রের সঙ্গে গল্প করতে ইচ্ছা করছে। বাবার ফোনে কি কল দিবে? মাত্র বারোটা বাজে। বাবার রুমে গিয়ে ফোনটা চাইলেই হবে। বাবা কিছুই জিজ্ঞাসা করবে না৷ সে ওড়না জড়িয়ে রুমের বাইরে গেল।

গুটিগুটি পায়ে ড্রয়িং রুমে আসতেই সে অবাক। বাবার ফোনটা খাওয়ার টেবিলের উপর রাখা। বাবা কি ফোন রুমে।নিয়ে যাওয়ার কথা ভুলে গিয়েছে নাকি ইচ্ছে করে ফেলে গেছে?

সে ফোন হাতে নিয়ে সমুদ্র কে কল দেয়। কিছুক্ষনের মধ্যে সমুদ্র রিসিভ করে কোমল গলায় বলে, হ্যা বল আয়ু৷

আয়নার গা বেয়ে মৃদ্যু কম্পন বয়ে গেল। সে স্মিত হেসে বলে, কেমন আছো?

— কে আমি?

–হু।

— ভালো। তুমি?

আয়না কিছু বললো না। সে চিন্তিত গলায় বলে, শোন!

–হুম। বল। (সমুদ্র)

— আমি কি তোমার যোগ্য? আমার গায়ে কিন্তু কলঙ্ক লেগে আছে! পারবে সেই দাগ মুছে ফেলতে? আমাকে মন থেকে গ্রহণ করতে পারবে তুমি?

সমুদ্র আয়নার কথা শুনে কিছুক্ষন থ মেরে চুপ থেকে বলে উঠে, মুড টা খুব ভালো ছিলো। কিন্তু তুমি ভালো মুডের মধ্যে পানি ঢেলে দিলে। ধ্যাত!

বলে ফোন কেটে দিলো।

আয়নার মন বিষিয়ে এলো। কিন্তু মনে শান্তি পাচ্ছে সে। অন্তত তার মনের খচখচানিটা কমলো তো! কিছু ব্যাপার আছে যা সরাসরি জিজ্ঞেস করে নিতে হবে!

দুই মিনিটের মধ্যে সমুদ্রের নাম্বার থেকে কল আসলো, শাস্তি হিসেবে কালকে বিরিয়ানি রান্না করে ধানমণ্ডি লেকের সামনে আসবে। ঠিক দেড়টা বাজে!

আয়নার ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটে উঠল। সে তার উত্তর পেয়ে গেছে। আচ্ছা সত্যি সে এতোটা ভাগ্যবতী? ভাগ্য কি তাকে সেকেন্ড অপশন দিল তবে?

চলবে৷