#বেটারহাফ
#Nishat_Tasnim_Nishi
|পর্ব ১২|
বৃষ্টির সন্দেহ এবার আরো গাঢ় হয়ে গেলো। তার মানে সাগরের মা তার আপন মা নন। তাহলে তার আপন মা কে?
বৃষ্টি মনে মনে ঠিক করে নিয়েছে যে সে সাগরকে জিজ্ঞেস করেই নিবে।এখন কাজ করা যাক। কিন্তু কাজে তার মন বসছে না,মাথায় প্রশ্ন টা ঘুরপাক খাচ্ছে।
★★
চারদিক দিয়ে বসন্তের হাওয়া বইছে। রাতের ঝড়বৃষ্টির পর খোলা আকাশ টা পরিষ্কার দেখাচ্ছে। আশেপাশের ছোট ছোট গাছপালা ভেঙ্গে রাস্তায় পড়ে আছে। ছাদের টবের শিউলি ফুলগুলো ঝরে নিচে পড়ে আছে। ছাদের কার্ণিশের পাশে দাড়িয়ে আছে সাগর আর মাহি। দুজন নিশ্চুপ। কারো মুখে কথা নেই। মাহির দৃষ্টি সেই ঝরে যাওয়া ফুলগুলোর দিকে। নিরবতা ভেঙে সাগর বলে উঠে,—“ছেলেটা কে?”
সাগরের এমন প্রশ্নে হকচকিয়ে যায় মাহি। সে অবাক হওয়ার ভান করে বলে,—“কোন ছেলে?”
—“মাহি আমি সব দেখেছি রাতে। ”
মাহি এবার চুপ করে যায়। সে আমতা আমতা করে বলে,—“ওহ, রাতের ওই ছেলেটার কথা বলছো?ও আমার ফ্রেন্ড। আমার বার্থডে ছিলো তো কাল তাই ও গিফ্ট নিয়ে এসেছিলো।”
—“ফ্রেন্ড? এত ঝড় বৃষ্টির রাতে কোন ফ্রেন্ড বাড়ীর নিচে এসে কান ধরে সরি বলে দাড়িয়ে থাকে?তাও আবার তুই নিচে নামা না পর্যন্ত দাড়িয়ে ছিলো।”
মাহি শুকনো ঢুক গিললো। ভয়ে গলা শুকিয়ে আসছে তার। রাফিকে রাতে তাহলে সাগর ভাইয়া দেখে ফেলেছে? এখন নিশ্চই মা কে বলে দিবে। আর মা কে বললে মা বাবাকে, বাবা একবার এ খবর শুনলে আমাদের কারো আস্ত রাখবে না। যেদিন শুনবে সেদিনই টিকেট কেটে চলে আসবে। মাহির হাত পা কেঁপে উঠলো। সে সাগরের সামনে আচমকা হাত জোড় করে বলে,–“ভাইয়া,প্লিজ তুমি মা কে বইলো না। ”
সাগর মাহিকে ইশারায় হাত নামিয়ে শান্ত হতে বলে। মাহি চুপ করে যাই।
সাগর মাহির মুখোমুখি দাড়িয়ে সহজ গলায় বলায় বলে,—“ছেলেটা কে?”
—“রাফি, আমার বেচমেইট। ইটার্নি করার সময় ওর সাথে পরিচয়। প্রতিদিন একসাথে উঠাবসা করতাম। সবকিছুতে ও আমায় হেল্প করতো। সেদিন হুট করে ও আমাকে প্রপোজ করে বসে। আমি জবাব দেই নি, উল্টো ওর সাথে কথা বলা বন্ধ করে দেই। সে থেকেই ও আমার পিছন পড়েছে।”
—“ওহ, তার মানে তুই ওকে ভালোবাসিস না। আচ্ছা, সমস্যা নাই। আজকেই ওকে টাইট দিয়ে দিবো। ”
—“না,না ভাইয়া।ওকে কিছু বলার দরকার নেই।”
সাগর ভ্রু কুচকে মাহির আগাগোড়া স্ক্যান করে।
—“কেনো?”
—“না, মানে এমনি। আমি কাল ওকে বারণ করে দিয়েছিলাম, ও আর আমার পিছনে ঘুরবে না বলেছে।”
সাগর কিছুক্ষণ নিরব দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকায়। এত ঠান্ডা, হাওয়া বাতাসের মধ্যেও মাহি ঘামছে। দুই হাতের আঙ্গুল কচলাচ্ছে। সাগর হাসলো মাহির অবস্থা দেখে।
—“তুই কি ওকে ভালোবাসিস?”
মাহি নিরব। কোনো জবাব দিচ্ছে না সে। সাগর আবারো একই প্রশ্ন করলো। মাহি মাথা উঁচু করে ওর দিকে তাকালো। মাথা নাড়িয়ে বললো হ্যা। বলেই ও কেঁদে দিলো।
—“হেই,কুল। একদম কাঁদবি না। আমি তো আছি। ”
মাহি ফিকরে কেঁদে বলে উঠে,
–“বাবা মানবে না। বাবা আমার বিয়ে উনার বন্ধুর ছেলের সাথে ঠিক করেছে। ”
—“আমি সব জানি। একদম চিন্তা করবি না আমি ফুফার সাথে কথা বলে দেখবো।”
—” না,কিছু বলবে না তুমি। বাবাকে এ কথা বললে ঘরে আগুন লেগে যাবে। বাবা মা কে ছেড়ে দিবে সাথে আমাকেও। প্লিজ তুমি এসব বলে কোনো অশান্তি করো না। ”
সাগর নিরব। সে তাকিয়ে আছে মাহির দিকে। মাহি নিচের দিকে তাকিয়ে কাঁদছে। সাগর আকাশের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। পৃথিবী এমন কেনো? সবাই কেনো তার ভালোবাসার মানুষের সাথে ঘর-সংসার করতে পারে না? পরিবার কেনো সকল সম্পর্কের বাঁধা হয়ে দাড়ায়? খোঁজ নিলে দেখা যাবে এ শহরের অর্ধেক বিচ্ছেদের কারণ পরিবার!
★★
আয়নার সামনে দাড়িয়ে তৈরি হচ্ছে সাগর। বৃষ্টিকে নিয়ে সিলেট শহর ঘুরবে সে। অথচ বৃষ্টির এখনও কোনো খবর নেই। সে রান্নাঘরে ব্যস্ত। সাগর গলার টাই পরছিলো তখনই হুড়মুড় করে প্রবেশ করে বৃষ্টি। কপাল বেয়ে ঘাম ঝরঝর করে পড়ছে। শাড়ি কোমড়ে গুঁজে রয়েছে যার ফলে কোমড়ের পাশের অনেক অংশ দেখা যাচ্ছে। বৃষ্টির সেদিকে হুশ নেই,সে নিজে নিজে বকবক করছে দেরী হওয়া নিয়ে।
সাগর হাসলে তার দিকে তাকিয়ে। দরজাটা লাগিয়ে এগিয়ে যায় বৃষ্টির দিকে, বৃষ্টি হতভম্ভ হয়ে ওর দিকে তাকায়। কোমড়ে গুঁজে থাকা শাড়ির আঁচল টান মেরে বের করে দিয়ে বৃষ্টিকে বলে,—“মাহিন সহ বাড়ীতে আরো ছেলে মানুষ আছে।সবার সামনে এভাবে ঘুরাঘুরি করা টা বেমানান।”
বৃষ্টি লজ্জা পেয়ে সরে যায়। কিছু বলতে নিচ্ছিলো সে,কিন্তু সাগরের কর্মকান্ডে সেটা মাথা থেকে চলে যায়। ব্যাগ থেকে কালো সেলোওয়ার স্যুাট বের করে ওয়াশরুমের দিকে চলে যায়।
সাগর দরজা টা মিলিয়ে মাহির রুমের দিকে পা বাড়ায়। সাগরদের পাশের রুম টা মাহির। দুবার দরজায় কড়াঘাত করার পরেও ভেতর থেকে কোনো রেসপন্স আসলো না।
সাগর জোর গলায় ডাক দিলো,–“মাহি!”
সাগরের গলার আওয়াজ পেয়ে মাহি উঠে দরজা খুলে দেয়।
—“কিছু লাগবে ভাইয়া?”
–“হু,লাগবে। পাঁচ মিনিট সময় দিলাম রেডী হয়ে আয়। ”
—“কি?কিন্তু কেনো? আমি এখন কোথাও যাবো না।”
—“আমি তোর পারমিশন চাই নি, অর্ডার দিয়েছি। ”
মাহি নাকচ সুরে বলে,–“কিন্তু ভাইয়া?”
—“নো মোর ওয়ার্ডস। আমি ফুফিকে বলেছি।”
মাহি ঘ্যানঘ্যান করে বিরক্তি নিয়ে দরজা লাগিয়ে দিলো রেডী হওয়ার জন্য। সাগর হাস্যজ্জ্বল মুখ নিয়ে চলে গেলো রেহানা বেগমের রুমের দিকে।
রেহানা বেগম রুমে বসেছিলেন, সাগরকে দেখে তিনি এমন রিয়েক্ট করলেন যেনো এখন তিনি সাগরের কাছেই যেতে চাইছিলেন। সাগরকে টেনে রুমে ঢুকিয়ে দরজা লাগিয়ে দিলেন তিনি।
সাগর জোরপূর্বক মুখে হাসি ফুটিয়ে বলে,—“কিছু বলবে ফুফি?”
—“সর্বনাশ হয়ে গিয়েছে। আমি মুখ ফসকে বলে ফেলেছি। ”
সাগর কপাল কুচকে বলে,–“কী বলে ফেলেছো?কাকে বলে ফেলেছো?”
রেহানা বেগম সাগরকে সকালের ঘটনার বিস্তারিত বললেন। সব শুনে তো সাগরের কপালে ভাঁজ পড়ে যায়।
—“ফুফি,তুমি এটা বলতে কেনো গিয়েছো যে আমার থেকে যেনো জিজ্ঞেস করে!! কথা ঘুরিয়ে ফেললেই তো চলতো।”
—“কি জানি,আমার মাথায় কুলায় নি। আমি বলে ফেলেছি। এখন তুই কি বলবি?”
সাগর স্বাভাবিকভাবে বলে,–” সত্য চাপা থাকে না। একদিন না হয় একদিন ও জানতো এসব। আর কে বলেছে উনি আমার মা নয় উনিই আমার মা। ”
রেহানা বেগম সাগরের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। রেহানার ভাইয়ের প্রথম স্ত্রী সাগরকে জন্ম দেওয়ার ছয়মাস পরেই মারা যান। সোহেল, শামিমের বয়স তখন দশ কী বারো! ছোট ছোট বাচ্চাদের শফিক সাহেব সামলাতে পারবে না বলে তাকে দ্বিতীয় বিয়ে করায় সাগরের দাদী। প্রথম বউ সোহানার চাচাতো বোন শাহিনুরকে বিয়ে করিয়ে নিয়ে আসেন তিনি। শাহিনুর বিয়ের জন্য রাজি ছিলো না, কিন্তু যখন ছোট্ট সাগরকে দেখেছিলেন তখন ই তিনি রাজি হয়ে গিয়েছিলেন। বিয়ের পর থেকেই তিনি সাগরকে নিয়ে ওভার পজেসিভ ছিলেন। ওর একটু সর্দি-কাশি উনার সহ্য হতো না। পাগলের মতো বিহেভ করতেন। সবসময় সাগরকে কোলে কোলে রেখেছিলেন। শাহিনুরের এমন কান্ডে রীতিমত সবাই অবাক ছিলেন। সৎ মা হওয়া স্বত্তেও ছেলের প্রতি এত টান সবাইকে অবাক করেছিলো। তাই সে ছোট থেকে সাগরের সবকিছুর উপর উনার অধিকার। তিনি দ্বিতীয়বার বাচ্চা নিতে চান নি। সাগরের আট বছর বয়সে শিফা তার গর্ভে চলে আসে, তিনি বাচ্চা টা রাখতে চান নি কিন্তু সাগরের দাদীর আর শফিক সাহেবের জেদের কাছে হার মেনে যান। শিফা জন্ম হওয়ার পরেও সাগরের প্রতি উনার একফোঁটা টান কমে নি। উল্টো সব বাচ্চা থেকে সাগরকে তিনি অধিক স্নেহ করতেন। যে বিষয়টা সবার চোখে পড়ত, কৌতুহল বশত সাগর তার ফুফিকে এর কারণ জিজ্ঞেস করেছিলো তখন সে এসব জানতে পারে।
★★★
শিফার শশুড়বাড়ীর লোক চলে গিয়েছেন শিফাকে রেখে। শাহিনুর বেগম শিফাকে যেতে দেন নি, তিনি বলেছেন মেয়ে সুস্থ হলে পাঠিয়ে দিবে। তুষারের মা আর জোর করেন নি। কী দরকার? এখন নিলে শুধু শুধু কতগুলো টাকা ওর পেছনে খরচ করতে হবে। তাই তারা রেখেই চলে গিয়েছেন। রাত্রি এক মনে শিফার সেবা করছে। তা দেখে রেহানা বেগমের মুখটা উজ্জ্বল করে উঠলো। বড় বউকে তার মেয়ের জন্য এক গ্লাস পানির কথা বললেও সে নানা অযুহাত দেখিয়ে চলে যায়। আর মেঝো বউ সে তো তার স্বামী নিয়ে শহরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বাড়ীতে কী হচ্ছে না হচ্ছে তার আদৌ কোনো খবর তাদের কান পর্যন্ত পৌঁছাচ্ছে কী না কে জানে? এসব ভেবে শাহিনুর দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।
.
রাত্রি ফাইল আর সার্টিফিকেট নিয়ে বসে আছে শাশুড়ির সামনে। এ নিয়ে তিনবার সে শাহিনুরকে সব বুঝিয়ে বলেছে। শাহিনুর আড় চোখে কাগজ পত্র দেখছেন। পানের কৌটো টা টেবিলে রেখে রাত্রিকে প্রশ্ন করলেন, —” তা, চাকরী হইবো তো?”
রাত্রি কিছুটা আশা নিয়ে বলে,–“আম্মা, সঠিক জানি না। আমি আমার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি।”
শাহিনুর বেগম হেলাফেলা করে বললেন,–” কী দরকার এসব ইস্কুল,ফিস্কুল করার? এর থেকে ভালো তো আমাগো কম্পানি।”
রাত্রি মলিন হাসলো। শাশুড়িকে কয়েক টা কড়া কথা শুনাতে ইচ্ছা করলো তার। কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বললো না। কী লাভ হবে বলে?
সম্পূর্ণ বিষয়টা এড়িয়ে বলে,–” আসলে মা, আমি নিজের যোগ্যতায় কিছু করতে চাই।”
চলবে?
রিচেক করি নি। ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন।