Game 2 Part-58+59

0
502

#Game_2
#মিমি_মুসকান ( লেখনিতে )
#পর্ব_৫৮

নীল আর নীলাশা কে একা রেখে সবাই বাইরে চলে গেলো। কিন্তু তারা দুজনেই চুপ! নীলাশা মাথা নিচু করে কাঁদতে থাকল। নীল নীলাশা’র চোখের পানি মুছে দিল। নীলাশা তখন দু’হাত দিয়ে নীলের হাত টা জরিয়ে ধরে তার উপর মাথা রেখে কাঁদতে লাগল। বলতে শুরু করল..

– নীল! নীল আপনি আমাকে ডির্ভোস দিয়েন না প্লিজ।আমাকে আমার ছেলে থেকে আপনি আলাদা করবেন না। আমি পারবো না ওকে ছাড়া থাকতে। আমি মানছি আমি অনেক অন্যায় করেছি। আমি ক্ষমা চাইছি তার জন্য। কিন্তু আপনি আমাকে রাইয়ান’র থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েন না। আমার বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন সে। প্লিজ নীল প্লিজ! আমি মরে যাবো বেঁচে থাকতে পারবে না ওকে। প্লিজ আপনি ডির্ভোস দিয়েন না কেন আমাকে।

নীল চুপ হয়ে আছে। কোন কথা বলছে না। সে কি বলবে সেটাই বুঝে উঠতে পারছে না। নীলাশা নীলের দিকে তাকাল। সে মাথা নিচু করে আছে। নীলাশা দুই হাত দিয়ে চোখের জ্বল মুছে নীলের কাছে এসে বসল। অতঃপর দু’হাত নীলের মুখটা ধরে ‌তার‌ দিকে ধরে বলল..

– এখনো রেগে থাকবেন! আপনি কথা বলবেন না আপনার হাতি বাচ্চার সাথে।‌ আপনার হাতি বাচ্চা টা কাঁদছে নীল। খুব কষ্ট পাচ্ছে আমি এসব মেনে নিবেন। কথা বলুন না আপনি! কথা বলুন!

নীলাশা নীলকে জরিয়ে ধরে কাঁদতে লাগল। কাঁদতে কাঁদতে তার শার্ট ভিজিয়ে ফেলছে সে। নীল এখনো চুপ। কিছুই বলছে না।

কিছুক্ষণ পর নীলাশা কান্না বন্ধ করল। অতঃপর নীলের বুক থেকে উঁকি মেরে তার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল..

– নীল আমি পারবো না আপনাকে ছাড়া থাকতে,‌ রাইয়ান কে ছাড়া আমার জীবন নিরর্থক! আপনি আমাকে ডির্ভোস দেবার পর আমার লাশ টা নিয়ে ‌বাড়ি‌ থেকে বের হবেন!

নীল চমকে উঠে! সে নীলাশা’র দিকে তাকায়। নীলাশা’র চোখ মুখ সব লাল হয়ে গেছে কাঁদতে কাঁদতে! অনেক কষ্ট শ্বাস নিচ্ছে সে।‌ নীল নীলাশা কে দু’হাত জরিয়ে বলল..

– কি বলছো এসব! পাগল হয়ে গেছো তুমি!

নীলাশা নীলের শার্ট আঁকড়ে ধরে আবারো কেঁদে উঠলো। নীল ওকে অনেক কষ্টে সামলালো। নীলাশা নীলের হাত ধরে ধরে বলল..
– আপনি আমাকে ছুঁয়ে বলুন! বলুন আপনি আমাকে ডির্ভোস দিবেন না!

নীল হাত টা ছাড়িয়ে নীলাশা’র গালে হাত রেগে বলল..
– আমি তোমায় ডির্ভোস দেবো না। করব না নিজের হাতি বাচ্চা কে নিজের থেকে আলাদা।‌ সারাজীবন আগলে রাখবে তুমি আমাকে আর রাইয়ান কে!

নীলাশা এক কাঁদো কাঁদো মুখে হেসে দিল। তার ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটল। সে উঠে নীলের কপালে একটা চুমু খেল। অতঃপর নীলের পুরো মুখে চুমু খেয়ে তাকে জরিয়ে ধরে বলল..

– ভালোবাসি নীল! অনেক ভালোবাসি আপনাকে! আর কখনো আঙুল তুলবে না কেউ এই ভালোবাসায় কথা দিলাম আমি আপনাকে!

নীল নীলাশা’ল কপালে একটা চুমু খেয়ে বলল..

– হুম আমিও অনেক ভালোবাসি তোমায়!
.
– ইহান!

– হুম বলো!

– তোমার মনে হচ্ছে না বিয়েটা অনেক তাড়াতাড়ি হচ্ছে!

– জানি। কিন্তু কিছু করার নেই

– আচ্ছা এই কষ্ট কি কখনো শেষ হবে না। ভাবী, ভাইয়া, আপু, জিজু তারা কি কখনো এক হবে না।

– অপেক্ষা করো হবে!

– কিন্তু আমি তো আর নিতে পারছি না এসব। এতোবছর পর নিজে বাবা কে পেয়েও খুশি হতে পারছি না। আনন্দ নেই বাড়িতে। পুরো বাড়ি মনমরা হয়ে আছে। বাড়ির প্রাণটাই যেন চলে গেছো।

– কি করব বলো এটাই তো নিয়তি!

তিশা ইহানের বুক থেকে মাথা টা উঠিয়ে তার দিকে তাকাল। দুজনেই খোলা আকাশের নিচে গাড়ির উপর বসে আছে। তিশা ইহানকে জরিয়ে ধরে তার বুকে মাথা বসে আছে।

– কিছু বলব

– আমরা কি কিছু করতে পারি না বলো

– ( ইহান নিশ্চুপ )

– তোমার নিশ্চুপতার কারন কি? তার মানে তুমিই ও কি মনে করো..

– এখন মনে করার কোন কারন নেই। তবে যা করেছে সেটাও ভুলে যাবার মতো নয়।

– তাই বলে কি ক্ষমা করবে না।

– নীল ভাইয়া ক্ষমা করবে‌ আমি জানি! কিন্তু মেহেরিন! ও একটু বেশিই জেদি!

– কিন্তু ভালো তো বাসে ভাইয়া কে। আচ্ছা ভাবী কি কষ্ট পাচ্ছে না তুমি বলো আমায়।

– আমি জানি ও কষ্ট পাচ্ছে। কিন্তু সেটা মুখে স্বীকার করার মেয়ে ও না।

– তাহলে.. তুমি ও বুঝতে পারছো সে কষ্ট পাচ্ছে। তাহলে একবার চেষ্টা করতে দোষ কি।

– আচ্ছা আমি আজ দা’র সাথে কথা বলবো এই ব্যাপারে!

– সত্যি!

– হুম!

অতঃপর তিশা খুশি হয়ে ইহানের গালে একটা চুমু খেয়ে বলে..
– আই লাভ ইউ আমার বর মশাই!

– আই লাভ ইউ টু!

অতঃপর তিশা আবারো তাকে জরিয়ে ধরে আকাশ দেখতে থাকে!
.
মেহেরিন অফিস থেকে মাত্র গাড়ি নিয়ে বের হয়েছে। হঠাৎ তার সামনে একটা গাড়ি এসে তার পথ আটকায়। মেহেরিন তাকিয়ে দেখে ওই গাড়িতে নির্ঝর! দুজনের চোখাচোখি হলো। আজ প্রায় অনেকদিন পর হলো দুজনের চোখাচোখি! মেহেরিন গাড়ি টা ঘুরিয়ে অন্যদিকে যেতে নিলে নির্ঝর আবারো তার পথ আটকায়। অতঃপর মেহেরিন রেগে গাড়ির হ্যান্ডেল’র থেকে হাত দুটো সরিয়ে তার বাহুতে গুঁজে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বসে থাকে।

নির্ঝর মেহেরিন’র গাড়ির পাশে এসে দাঁড়ায়। বলে “মেহু পাখি নামো”!

মেহেরিন মুখটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে নেয়। নির্ঝর গাড়ির দরজা খুলতে যাবে মেহেরিন তখন তার দরজা লক করে করে। গাড়ির আয়নাটা খোলাই ছিল। নির্ঝর সুযোগ বুঝে গাড়ির চাবিটা নিয়ে ফেলে। মেহেরিন রেগে তার দিকে তাকায়। নির্ঝর আবারো বলে..

– মেহু পাখি নামো! কথা আছে।

অতঃপর মেহেরিন গাড়ি থেকে চাবি টা নিতে গেলে নির্ঝর মেহেরিন’র দুই বাহু ধরে নিজের কাছে টেনে বলে..

– কি করছো তুমি কথা বলছো না!

– ( নিশ্চুপ )

– এতো কল , এতো মেসেজ বোঝ না কথা বলতে চাই আমি।

– যেদিন ডির্ভোস পেপার দিয়েছি কথা সেদিন শেষ হয়ে গেছে।

– না শেষ হয় নি। আমি দেইনি তোমাকে ডির্ভোস!

– চিন্তা করবেন না তিশা’র বিয়ের পর এটা কোর্টে উঠবে তখন আপনি দিতে বাধ্য থাকবেন।

নির্ঝর মেহেরিন’র হাত দুটো আরো শক্ত করে চেপে নিজের কাছে টেনে দাঁতে দাঁত চেপে বলে..
– কি বললে আবার বলো।

মেহেরিন মুখ ঘুরিয়ে বলে..
– যা আপনি শুনলেন!

– আমার দিকে তাকাও

– কোন ইচ্ছে নেই আমার!

নির্ঝর একহাত দিয়ে মেহেরিন’র কোমর ধরে অন্য হাত দিয়ে মেহেরিন’র গালে হাত রেখে নিজের দিকে ঘুরিয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। অতঃপর তার কপালে একটা চুমু খেয়ে তার কপালের সাথে নিজের কপাল ঠেকিয়ে বলে…

– আই এম সরি মেহু পাখি! আমি জানি আমি তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি। তোমার দুর্বলতায় বার বার আঘাত করেছি। তোমাকে কাঁদিয়েছি। অনেক কিছু করেছি আমি! তুমিও আমাকে কষ্ট দেও, মারো আমি মেনে নেবো। প্লিজ ছেড়ে যাবার কথা বলো না। আমি পারবো না তোমাকে ছাড়া থাকতে! তোমাকে ছাড়া বেঁচে থাকা আমার কাছে অর্থহীন মেহু পাখি! মেহু পাখি আমি পারবো না। এমনটা করো না। আমি বেঁচে থেকেও মরে যাবো তোমাকে ছাড়া!

বলতে বলতে নির্ঝরের চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পরল। সে খুব শক্ত করে ধরে আছে মেহেরিন কে। মনে হচ্ছে মেহেরিন কে ছাড়লেই সে পালিয়ে যাবে। মেহেরিন’র শরীর কাঁপছে। চোখ লাল হয়ে আসছে। সে পারছে না এভাবে থাকতে। মনে হচ্ছে এখনি কেঁদে দেবে সে। সে একটা বড় নিঃশ্বাস ফেলে বলে..

– নির্ঝর ছাড়ুন!

– না মেহু পাখি আমি ছাড়বো না তোমায়!

কিছুক্ষণ পর মেহেরিন তার সর্বস্ব দিয়ে ধাক্কা মারল নির্ঝর কে। নির্ঝর তার থেকে দূরে সরে গেল। মেহেরিন বলল..
– দূরে থাকুন আমার থেকে। আমি ভালোবাসি না আপনাকে!

বলেই গাড়ির ভেতর ঢুকল। নির্ঝর তাকিয়ে দেখল তার হাতে চাবি টা নেই। সে চাবিটা নিয়ে নিয়েছে। অতঃপর মেহেরিন চলে গেল।
.
এখন বর্ষাকাল! বৃষ্টি প্রতিনিয়ত আকাশ থেকে ঝড়ছে। এই বৃষ্টি তার খুব পছন্দ। তার খারাপ লাগলেও সে বৃষ্টিতে ভিজে আবার খুশি হলেও ভিজে। তবে আজ কারন দুটোই। একটা হলো নীল আর নীলাশা’র ঝামেলা মিটে গেছে এই খুশিতে। আর মন খারাপের কারন হলো এখন সবাই তাকে আর নির্ঝর কে নিয়ে পড়বে। তারা চাইবে তারা দুজন যেনো আবারো এক হয়ে যায়। কিন্তু এটা কি সত্যি’ই এতো সহজ। মেহেরিন দু চোখ বন্ধ হাত ছাড়িয়ে বৃষ্টির মাঝে দাঁড়িয়ে আছে। ভালোই লাগে এভাবে তার বৃষ্টিতে ভিজতে।

গাড়ির আওয়াজ আসায় মেহেরিন ছাদের কোনায় এসে দাঁড়াল। মেহেরিন দেখল এটা নির্ঝরের গাড়ি। সে তাকিয়ে রইল। নির্ঝর গাড়ি থেকে বের হয়ে উপরে তাকিয়ে দেখল মেহেরিন ছাদে দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজছে। এখন তারা দুজনেই ভিজছে। দুজনেই তাকাল দুজনের দিকে। আর তখনই মেঘ গর্জন করল।

#চলবে….

#Game_2
#মিমি_মুসকান ( লেখনিতে )
#পর্ব_৫৯

মেহেরিন নির্ঝরকে দেখেই নিচে নেমে চলে যায়। অতঃপর চেঞ্জ করে এসে দেখে নির্ঝরের অনেক কর তার ফোনে। মেহেরিন ফোন টা রেখে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখে নির্ঝর এখনো দাঁড়িয়ে আছে বৃষ্টিতে। কিন্তু এভাবে এখানে দাঁড়িয়ে থাকার কারন কি?

বৃষ্টি কমছে না আরো বাড়ছে, আচ্ছা নির্ঝর কি এভাবেই দাঁড়িয়ে থাকবে এখানে! হঠাৎ করেই ফোনটায় টুং টুং শব্দ হলো। নির্ঝরের মেসেজ! শুধু একটাই শব্দ..”মেহু পাখি”!

মেহেরিন কিছুক্ষণ ফোনের দিকে তাকিয়ে অতঃপর রিপ্লাই দিলো..

– হুম!

– একটু কথা ছিলো তোমার সাথে।

– বৃষ্টিতে না ভিজে বাসায় যান। অনেকক্ষণ ভিজেছেন বৃষ্টিতে!

– না তুমি দেখা না করলে আমি এখান থেকে যাবো না। তোমার সাথে দেখা করেই আমি যাবো। এখন বৃষ্টিতে ভিজতে হলে ভিজবো।

ওপাশ থেকে আর কোন রিপ্লাই এলো না। নির্ঝর নিজেই আবার মেসেজ করল..

– মেহু পাখি!

মেহেরিন ফোন টা রেখে দিল। অতঃপর উঁকি দিয়ে দেখল নির্ঝর বৃষ্টিতে ভিজছে আর ফোন হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।‌ হয়তো তার মেসেজ’র আশায় আছে।মেহেরিন ডেভিল কে পাঠিয়ে নির্ঝর কে যেতে বলল কিন্তু সে না বলে দিলো।

কিছুক্ষণ এভাবে থাকার পর নির্ঝর সামনে তাকাল। অতঃপর দেখলো মেহেরিন আসছে।‌ তার হাতে একটা ছাতা।‌ খুব জোরে বৃষ্টি পড়ছে। দু’জন দু’জনের সামনে দাঁড়ানো। মেহেরিন নির্ঝরের উপর ছাতা টা এগিয়ে দিল। নির্ঝর তাকিয়ে আছে মেহেরিন’র দিকে।‌সে মেহেরিন’র গালে হাত দিতেই মেহেরিন ছাতা টা ছেড়ে দিল। ছাতাটি বাতাসের জোরে উড়ে গেল। এখন দুজনেই ভিজছে। পানির গতিতে চোখ খুলে রাখা মুশকিল। এর মাঝেই ভয়ংকর ভাবে ডাকছে মেঘ!

– কি বলবেন আবার এখন!

নির্ঝর মেহেরিন’র হাত ধরে হাটু গেড়ে বসে বলে…
– মেহু পাখি আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাইতে এসেছি। আজ পর্যন্ত আমি তোমার সাথে যা অন্যায় করেছি, তোমাকে যত কষ্ট দিয়েছি তার সব কিছুর জন্য ক্ষমা চাইতে এসেছি। প্লিজ মেহেরিন আমাকে ফিরিয়ে দিও না।

মেহেরিন নিজের হাতটা ছাড়িয়ে বলে..
– আজ বাড়িতে যান, নাহলে অসুখ করবে। আমি যা বলার কাল বলবো। আর ভেবেচিন্তে বলবো।

– মেহু পাখি!

অতঃপর মেহেরিন চলে যায়। নির্ঝর উঠে দাঁড়ায়। সে বুঝতে পারছে না মেহেরিন কি বলবে।

দূর থেকে এসব দেখতে থাকে ইহান আর কাব্য। অতঃপর এসব কথা তারা অভ্র, নীল আর আহিয়ান কে জানায় ।

– আমার মনে হয় নির্ঝর যথেষ্ট তার কর্মের ফল‌ এবার তাকে ক্ষমা করে দেওয়া উচিত।

– হ্যাঁ নির্ঝর যা করেছে তা তো জেনে বুঝে করে নি।

– না করুক কিন্তু ওর জন্য মেহেরিন কম কষ্ট পায় নি।

– এখন কি পাচ্ছে না। নির্ঝর কে ছাড়া সে ভালো নেই এটা কি সত্যি নয়।

– মেহেরিন সবসময় নিজের রাগ কে প্রাধান্য দেয়।

– এবার ও কি তাই হবে। সে জিতে যাবে তার রাগের কাছে। হারিয়ে ফেলবে ভালোবাসা কে।

– আমাদের মেহেরিন কে বোঝানো উচিত। নির্ঝর কে আরেকবার সুযোগ ওর দেওয়া।

– মেহেরিন কি তা মানবে

– মানবে বলে মনে হচ্ছে না। কিন্তু তাই বলে এভাবে কষ্ট পাবে এটাও আমরা মেনে নিতে পারবো না। কিছু একটা আমাদের করতেই হবে।

– মেহেরিন বিশ্বাসঘাতকতা পছন্দ করে না।

– তাই বলে কি ভালোবাসতে ভুলে যাবে।

– কি বলতে চাইছ তুমি!

– সেটাই যেটা তোরা বুঝেছিস, আমি চাই নির্ঝর আর মেহেরিন এক হোক!
কথাটা বলার পর’ই দরজার ওপাশ থেকে আওয়াজ আসল। সবাই পিছনে ঘুরল।‌দেখল মেহেরিন দাঁড়ানো। মেহেরিন শুধু অভ্র’র দিকেই তাকিয়ে আছে। কারন কথাটা অভ্র বলেছে।‌ এতো কিছুর পর ও‌ সে চায় আমি নির্ঝরের সাথে থাকবো!

এই কথাটাই তার মনে বিঁধে গেল। মেহেরিন আর দাঁড়াল না সে ছুটে চলে গেল নিজের ঘরের দিকে।‌ অভ্র’র ছুটল তার পিছনে।

মেহেরিন ঘরে এসে বিছানার উপর বসে পড়ল। অতঃপর চকলেট’র প্যাকেট টা ছিঁড়ে খেতে লাগল। হাত পা কাঁপছে তার। কষ্ট হচ্ছে তার দা তার কষ্ট টা বুঝছে না।
দরজা টা খোলা পেয়ে অভ্র ভিতরে চলে আসে। অতঃপর মেহেরিন’র পাশে গিয়ে বসে।‌ মেহেরিন বসে বসতে যাবে এর আগেই অভ্র তাকে এক হাত দিয়ে জরিয়ে ধরে। মেহেরিন আরো বেশি বেশি করে চকলেট খেতে। অভ্র কিছু না বলে শুধু ওর মাথায় হাত বোলাতে থাকে।

অনেকক্ষণ পর, মেহেরিন এখন শান্ত হয়েছে। কারন এখন সে দুহাত দিয়ে অভ্র’র পেট জরিয়ে আছে। অভ্র বলে উঠে..

– সরি আদুরী!

– কথা নেই তোমার সাথে।

– দা’র সাথে কথা বলবে না!

– হুহ!

– আচ্ছা আমি কি ভুল কিছু বলেছিলাম বলোতো। তুমি কি কষ্ট পাচ্ছো না।

– হ্যাঁ পাচ্ছি কিন্তু উনাকে ক্ষমা করে দেওয়াটা আমার পক্ষে সম্ভব না।

– মস্তিষ্কের কথা না শুনে মনের কথা শোন।

– একবার শুনে আমি ঠকেছি দা।

– একবার ঠকেছ বলেই কি বার বার ঠকবে। তুমি নীলাশা কে ফিরিয়ে আনতে পারো নীলের জন অথচ নির্ঝরের কাছে যেতে চাও না। যেখানে তুমি সেখানে যাওয়ার জন্য ছটফট করছো।

– আর কষ্ট দিতে চাই না তোমাদের।

– এখন কষ্ট কেন দিবে, কারন কি?

– কারন উনি হেরে গেছেন।

– এই কথা বলেছে একবারও। বার বার তোমার কাছে এসে ক্ষমা চাইছে।

– এসব উনার নাটক। তুমি জানো না খুব ভাল অভিনেতা সে।

– এখনো ভালো মতো ঘৃণা করতে শিখো নি তুমি। আজ পর্যন্ত তোমার কোন কিছুতে আমি বাধা দেই নি আর না আজ দিবো।

মেহেরিন এই কথা শুনে অভ্র কে আরো শক্ত করে জরিয়ে ধরে। অতঃপর তার কোলেই ঘুমিয়ে পড়ে। অভ্র সারারাত মেহেরিন কে তার নিয়ে কোলে নিয়ে জেগে থাকে!
.
নির্ঝরের এসে বসে আছে বসার ঘরে। তার সাথে তিশাও এসেছে। মেহেরিন বলেছে আজ সে কিছু বলবে আর সে সেটাই জানার জন্য এসেছে। অভ্র, নীল, নীলাশা, আহিয়ান সবাই এখানে। মেহেরিন আসার আগেই নির্ঝর সবার কাছ থেকে ক্ষমা চেয়েছে। নির্ঝর আজ একটু হলেও আশা করছি হয়তো কিছু না কিছু ভালো ঘটবে বলে।

কলিং বেল বেজে উঠলো। দরজা খুলে ওপাশ থেকে নিরব কে দেখা গেল। সেও এসেছে কিন্তু কারন কি? নির্ঝর তাকে দেখেই রেগে গেল। কিন্তু কিছু বললো না।‌অভ্র তাকে বসতে বলল। তখন মেহেরিন এসে বলল..

– তুই এসে গেছিস!

নিরব না বসে মেহেরিন’র দিকে তাকাল। মেহেরিন এসে নিরবের হাত ধরে দাঁড়াল। নির্ঝর তাকিয়ে দেখছে। তার মনটা হঠাৎ করেই অস্থির হতে লাগল।‌আজ আবার মেহেরিন কে হারাবে বলে তার মনে হচ্ছে। মেহেরিন’র এমন কাজে সবাই অবাক। অভ্র কিছুটা হলেও ধরতে পেরেছে মেহেরিন কি করবে। আর ঠিক সেটাই হলো। মেহেরিন তার আর নিরবের বিয়ের অ্যানাউসমেন্ট করল এখানে। তার এই কথা শুনে যেখানে সবাই অবাক ছিল নির্ঝর সেখানে এক গাল হেসে তাকে কনগ্রেচুলেশন করল। অতঃপর উঠে তিশা কে নিয়ে চলে গেল।‌ বিয়ের তারিখ তিশা’র বিয়ের দিন’ই ধার্য হলো। একসাথে দুই বিয়ে হবে!

নির্ঝর তিশা কে গাড়িতে উঠল। তিশা বুঝতে পারছে নির্ঝরের খুব কষ্ট হচ্ছে কিন্তু সে সেটা আড়ালে রাখতে চাইছে।‌ নির্ঝর বেশ স্বাভাবিক ভাবে গাড়ি চালিয়ে তিশা কে বাড়িতে পৌঁছে দিল। অতঃপর নিজে আর বাসায় এলো না।

নির্ঝর যেতেই নিরব ও খানিকক্ষণ পর চলে গেল। মেহেরিনও নিজের ঘরে চলে এলো।‌ নির্ঝর তাকে কনগ্রেচুলেশন বলল, হাসিমুখে বের হয়ে গেল এর মানে ব্যাপার টা স্বাভাবিক না। কিছু না কিছু তো ঘাপলা আছেই এখানে!

রাত অনেকটা হয়েছে, নির্ঝর এখনো বাসায় পৌঁছায় নি। তিশা অনেক কল করছে কিন্তু নির্ঝর তার কল ধরছে না। তিশা’র অনেক চিন্তা হতে লাগলো। এদিকে মেহেরিন বিছানায় শুয়ে শুয়ে কার্টুন দেখছে আর চিপস খাচ্ছে। হঠাৎ করেই বেলকনিতে থেকে কিছু একটা আওয়াজ আসল। মেহেরিন উঠে দরজার কাছে যেতেই দেখল নির্ঝর সেখানে দাঁড়ানো।

নির্ঝর কে কিছু না বলে সে সেখান থেকে চলে আসতে চাইলে নির্ঝর তার হাত ধরে নিজের দিকে টানল। নির্ঝর ড্রিংক করেছিল। হয়তো এক্সিডেন্ট! কারন তার হাতে আর মাথায় ব্যান্ডেজ। মেহেরিন এতোক্ষণে এটা খেয়াল করল। সে নির্ঝরের কপালে হাত সেই আঘাতের জায়গায় হাত দিল। নির্ঝর চোখ বন্ধ করে নিল। তার চোখ থেকে পানি গড়িয়ে বলল। নির্ঝরের গলা ভারী হয়ে আসছিল। তবুও সে বলল..

– মেহু পাখি!

– নির্ঝর আপনার…

নির্ঝর মেহেরিন’র মুখে হাত দিল। বলল..
– চুপ কথা বলবে না তুমি। আমি বলবো তুমি শুনবে। বলো কেন করলে এরকম! খুব কি দরকার ছিল এটার। এভাবে কষ্ট দিয়ে আমাকে মারতে চাও তুমি।

– মারতে চাই না। কিন্তু এটাতেই সবার ভালো‌ নির্ঝর তাই!

– কিসের ভালো, কে ভালো থাকবে তুমি!

– আপনি ভালো থাকবেন নির্ঝর!

নির্ঝর হেসে বলল..
– আমি! আমি ভালো থাকবো, কিন্তু আমার ভালো থাকার একমাত্র ঔষধ যে তুমি মেহু পাখি। আমি কিভাবে ভালো থাকবো তোমাকে ছাড়া বলো তুমি। তোমার বিরহে আমি যে জ্বলে পুড়ে মরে যাবো। একথা জানো না তুমি!

– নির্ঝর আমি শুধু সবকিছু নতুন করে শুরু করে চাই!

– তাই বলে অন্য কারো সাথে

– বিশ্বস্ত কারো সাথে, যে আমার বিশ্বাস ভাঙবে না

নির্ঝর মেহেরিন’র গালে হাত রেখে তার দিকে তাকিয়ে রইল।‌‌ অতঃপর বলল..

– একবার বিশ্বাস ভাঙলে খুব কঠিন তাকে জোড়া লাগানো আমি জানি,‌ কিন্তু যদি সেই বিশ্বাসে ভালোবাসা থাকে তাহলে তা তেমন একটা কঠিন না মেহু পাখি!

– আমি আপনাকে ভালোবাসি না নির্ঝর!

– কথাটা আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলো না। আমি তাহলে চলে যাবো!

– ওকে ফাইন! ( নির্ঝরের চোখের দিকে তাকিয়ে ) আমি আপনাকে ভালোবাসি না। শুনলেন আপনি আমি আপনাকে ভালোবাসি না।

নির্ঝর মেহেরিন’র কপালে একটা চুমু খেয়ে বলল..
– সেদিন দুই বিয়ে একসাথে হবে না মেহু পাখি! তিনটা বিয়ে হবে সেদিন। আর তৃতীয় বিয়েটা হবে আমার আর কথা’র। আর এখন এই বিয়েতে আসতে তুমি বাধ্য!

বলেই মেহেরিন হাতে একটা চুমু খেয়ে বলল..
– আমি তোমাকে ভালবাসি! খুব ভালোবাসি! তোমার ভালোবাসায় পাগল আমি।যেভাবে তোমার ভালোবাসা আমায় পাগল করে তোমার বিরহে ঠিক সেভাবেই আমাকে পাগল করবে। কিন্তু একটা কথা মনে রেখো, সেই বিরহের আগুনে আমি একা না বরং তুমিও জ্বলবে আর এটার একমাত্র কারন শুধু তুমি হবে মেহু পাখি! শুধু তুমি!

অতঃপর নির্ঝর চলে গেলো। মেহেরিন বলতে চেয়েছিল অনেক কিছু! কিন্তু আর বলতে পারল না। সে ধপাস করে নিচে বসে পরল। তার দু চোখ দিয়ে আজ আবারো অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। নির্ঝরের কথাটা ঠিক ছিল। বিরহের আগুন শুধু নির্ঝর কে একা না মেহেরিন কেও একসাথে জ্বালিয়ে দিল!

৭ দিন পর বিয়ে..

বিয়ের সব জোগাড়যন্ত্র শুরু হয়ে গেছে। অবাক করার বিষয় হলো মেহেরিন নিজেই এবার তার বিয়ের শপিং করছে। মেহেরিন আর নিরব দু’জনে মিলে তাদের বিয়ের শপিং করতে ব্যস্ত। একটা দোকানে গিয়ে দুজনেই একটা শাড়ি পছন্দ করছিল। মেহেরিন নিরব কে জিজ্ঞেস করল শাড়িটা তাকে মানাচ্ছে কি না তখন পেছন থেকে নির্ঝর বলে উঠলো..

– তোমাকে এইবার মেরুন রঙের লেহেঙ্গায় অনেক ভালো মানাবে কথা!

মেহেরিন তাকিয়ে দেখল কথা নির্ঝর হাত ধরে তার গা ঘেঁষে আসছে। মেহেরিন এটা দেখে একটা কিঞ্চিত হাসি দিয়ে বলল..

– নির্ঝরের পছন্দ কিন্তু আপনার জন্য দারুন কথা!

অতঃপর সে তার শাড়ি টা কিনে নিরব কে নিয়ে দোকান থেকে বের হয়ে গেল!

দেখতে দেখতে ৭ দিন ধরে সবাই শুধু শপিং করল। বিয়ের আয়োজন করা হচ্ছে। আজ গায়ে হলুদ,
তিন বর আর তিন কনের গায়ে হলুদ একসাথেই হবে। নির্ঝর মেহেরিন’কে দেখছে, একটা হলুদ রঙের শাড়ি পড়া সে। তাদের বিয়ের সময় লেহেঙ্গা পড়েছিল মেহেরিন তবে এইবার শাড়ি। কোন সাজগোজ নেই মুখে। অনেকটাই অন্যরকম এই বার সে। নির্ঝরের বার বার শুধু তার আর মেহেরিন’র বিয়ের কথাই মনে হতে লাগল।

নির্ঝর রেগে কথাকে নিয়ে খুব সুন্দর করে নাচল‌। মেহেরিন এবার বেশি একটা নাচানাচি করল না। সে শুধু বসে বসে হাত তালি দিতে থাকল। নিহা এসব দেখে অভ্র কে বলল..

– দুজনের কি অভিমান!

– অভিমান এখন চরম শিখরে! এটাকে ঠিক করা এতো সহজ না আর মজার ব্যাপার হলো কেউ’ই এই অভিমান ঠিক করতে চায় না।

– কি হবে দা এই দুজনের। এতো ভালোবেসেও দুজন আজ কতো দূরে!

– ভালোবাসা সবসময় মানুষ কে মিলিয়ে দেয় না নিহা। তাদের আলাদা করতে সক্ষম!

অভ্র কথায় নিহা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। কাকে বোঝাবে সে? কেউই বুঝতে চায় না। শান্ত আর অরনি এই গায়ে হলুদে নেই। মেহেরিন’র জন্য’ই নেই। মেহেরিন চায় না তারা থাকুক। তিশা আর ইহানের বিয়ে কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তারা কেউ সুখী না কারনটা হল নির্ঝর আর মেহেরিন। দু’জন কেমন পাথর হয়ে গেছে বলে তাদের ধারনা!
.
রাতে..

– কনগ্রেচুলেশন! কাল তোমার বিয়ে সেই মানুষটার সাথে যে তোমাকে কখনো ঠকাবে না।

– ধন্যবাদ! আর আপনার বিয়ে সেই মানুষটার সাথে যে আপনাকে অনেক ভালোবাসবে।

– কিন্তু আমি তো তোমায় ভালোবাসতাম মেহু পাখি!

মেহেরিন কিছু না বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। নির্ঝর আর কিছু না বলে চলে গেল। মেহেরিন তখন ফোনটা বের করে একজন কে কল করল। ওপাশ থেকে কলটা কেউ ধরল। মেহেরিন বলে উঠে..

– ঈশান!
.
আজ বিয়ে..
প্রেস মিডিয়া, বিজনেস কলিগ সবাই আছে এখানে। সবাই মেহেরিন আর নির্ঝরের বিয়ে নিয়ে বলাবলি করছে। এটা সত্যি অদ্ভুত!

– এসব কি শুনছি বলেন তো, যাদের ডির্ভোস হয়ে গেল তারা নাকি আবার বিয়ে করবে কিন্তু তাকে না অন্য কাউকে!

– কি আর বলব। বড় লোকদের বড় কারবার!

– তবে আমি শুনেছিলাম দুজনের মাঝে অনেক ভালোবাসা ছিল তাহলে আজ এই পরিনতি তাদের! কিভাবে?

– টাকা বুঝলেন টাকা। এর জন্য সবকিছুই হারিয়ে যায়।‌

– আচ্ছা বাদ দিন আমাদের কি এসবে। দেখুন দেখুন বর চলে এসেছে!
বর চলে এসেছে, আর বর রা তাদের বউ দের হাত ধরে নিয়ে আসছে। বর আর বউ কারো মুখ’ই দেখা যাচ্ছে না। বউরা বড় করে ঘোমটা দিয়েছে আর বর রা মাথায় ফুলের টোপর যার কারনে কারোই মুখ দেখা যাচ্ছে না। মেহেরিন দূর থেকে দাঁড়িয়ে দেখছে বউ আর বর দের। সে হেসে বলে..

– বেস্ট অফ লাক আপনাকে নির্ঝর! নিজের জীবন আবারো নতুন ভাবে শুরু করার জন্য!

অতঃপর হুডি’র টুপি টা মাথায় দিয়ে বেরিয়ে যায় সে।

#চলবে….