Game 2 Part-60 and Last Part

0
1125

#Game_2
#মিমি_মুসকান ( লেখনিতে )
#পর্ব_৬০ ( #শেষ_পর্ব )

মেহেরিন গাড়ি নিয়ে বের হয়ে গেল। প্রথমে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম অতঃপর সেখান থেকে রাঙামাটি গেলো সে। কাউকে না জানিয়ে সে চলে এসেছে রাঙামাটিতে! এমনকি ডেভিলও কিছু জানে না। মেহেরিন সবাইকে ছেড়ে পালিয়ে চলে এসেছে রাঙামাটিতে! নিজের অতীত থেকে পালাতে চায় সে।‌

মেহেরিন ভোরে এসে পৌঁছাল রাঙামাটিতে! গাড়ি থামাতেই তার চোখে পরল ঈশান কে।‌ তার জন্য’ই অপেক্ষা করছে সে। মেহেরিন কে এক গাল হাসি দিয়ে স্বাগতম জানাল সে। মেহেরিন হেসে গাড়ি থেকে নামল।

– কেমন আছিস?

– আলহামদুলিল্লাহ খুব ভালো, তুই!

– হুম ভালো! তা স্ত্রী সন্তান নিয়ে কি এখানেই থাকিস বরাবরের মতো!

– হুম! সরকারি চাকরি। বিয়ের এখানেই আমার ট্রান্সফার হয়েছে!

– তোর একটা মেয়ে আছে নাহ!

– হুম! সবে চার বছর। গাড়িতে বস, তোর বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছি। খুব সুন্দর বাড়ি, তোর ভালো লাগে। একটু উঁচু জায়গায় ওই একটা বাড়ি। ছোট একটা সাজানো গোছানো বাড়ি।

– হুম বুঝেছি, তা তোরা কোথায় থাকিস?

– আমি এখানেই থাকি। তোকে নিয়ে যেতাম আমার বাড়ি কিন্তু আমার বউ তার বাপের বাড়ি। তাই..

– ইট’স ওকে। তুই আমার এতো বড় উপকার করলি এই অনেক।

– ধুর পাগলি।
বলেই গাড়ি স্টার্ট দিল সে।

মেহেরিন আশপাশ তাকিয়ে আছে। সূর্যের আলো দেখা যাচ্ছে। সূর্যের চিকমিক আলো পড়ছে চারদিকে। পাখিরা ঘর থেকে বের হয়ে খাবারের সন্ধানে ঘুরছে। পরিবেশ টা একদম শান্ত, নিরব। মেহেরিন বলে উঠে..

– তোর মেয়েটার নাম কি?

– য্বোয়া!

মেহেরিন হেসে বলল..
– আমার নকল নাম টা!

– আমার বন্ধুর পরিচিতি এটা।

– অনেক জ্বালিয়েছে তোকে, দেখ এখন আবারো জ্বালাচ্ছি!

– তোর জ্বালানি গুলো খুব ভালো লাগে আমার।

জবাবে মেহেরিন হাসে। ঈশান বলে উঠে..
– তুই পালিয়ে এসেছিস নাহ মেহেরিন!

– হুম!

– আমি ঠিক’ই বুঝতে পেরেছি। আচ্ছা শোন তুই বরং একটু ঘুমিয়ে নে, সারারাত ড্রাইভ করেছিস পরে শরীর খারাপ করবে। আমি পৌঁছে গেলে তোকে জাগিয়ে দেবো।

– হুম!

বলেই বাইরে তাকিয়ে থাকল মেহেরিন। মনে পড়ে গেল কিছু স্মৃতি। নিজের পেটে হাত রাখল সে। এখানে কারো অস্তিত্ব আছে। শুধু তার না তার ভালোবাসার অস্তিত্ব আছে এখানে। তার আর নির্ঝরের সন্তান তার গর্ভে!

কথাটা কিছুদিন আগেই জেনেছে সে। নিজের দুর্বলতা আর স্বাভাবিক অবস্থা দেখে চেকআপ টা নিজেই করেছিল আর রির্পোট ছিল পজেটিভ। খুব আনন্দ হলো সেদিন। তার প্রথম বার মা হবার অনুভুতি নিতে যাবে সে, এর চেয়ে খুশির আর কি হতে পারে। সব মেয়ের জন্য এ এক অন্য রকম অনুভুতি!

সেদিন মেহেরিন’র চোখ থেকে খুশির অশ্রু ঝড়ে পড়েছিল। এর মাঝেও তার ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটল। কিন্তু! কিন্তু তার এই অতীত নিয়ে কিভাবে থাকবে তার এই সন্তান কে নিয়ে। তার অতীতের ছায়া কি পড়বে না এই সন্তানের উপর। নির্ঝর! সে যদি তার থেকে কেড়ে নেয় তার সন্তান। এই গেইম’র পরিণতি যদি তার বাচ্চা কে দিতে হয়! তখন..

এসব চিন্তা তার মাথা গ্রাস করে ফেলল। মেহেরিন কাউকে জানাল না তার প্রেগন্যান্সি’র কথা। লুকিয়ে রাখল সবার কাছ থেকে। কিন্তু এতেও তার মন শান্ত হলো না। মন চাইলো সবার থেকে দূরে কোথাও চলে যেতে। একা থাকতে তার এই সন্তান কে নিয়ে। শুধু সে আর তার এই সন্তান নিয়ে তার একটি দুনিয়া হবে। যেখানে কেউ থাকবে না, শুধু থাকবে সে আর তার এই সন্তান। তার বাচ্চা! তার অংশ! শুধু সেই হবে তার বাচ্চা’র একমাত্র অবলম্বন! আর তার বাচ্চা হবে তার অবলম্বন!

পালিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নিলেই আর পালিয়ে যাওয়া যায় না এটা সবাই জানে। এভাবে হুট করে পালিয়ে কিভাবে যাবে সে। আর নির্ঝর! সে তো আবারো তার জীবনে আসতে চাইলো। কিন্তু সে যে কাউকে চায় না। তাই সাহায্য নিল নিরবের। তার কথা চলছিল একটা মেয়ের সাথে বিয়ে হবার। মেহেরিন এই সুযোগ টা কাজে লাগল। তবে হ্যাঁ নিরব তাকে সাহায্য না করলে এসব কিছু হতো না। সত্যি অনেক ভালোবাসে ছেলে টা তাকে। কিন্তু কারো ভালোবাসার মর্যাদা দিতে পারল না সে। নিজের দা কে রেখে না বলে চলে এলো। স্বার্থপরের মতো কাজ করল।কেন সবাই তাকে বুঝতে চায় না। এটাই সে বুঝে না।

প্রথমে ভেবেছিল বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যাবে, কিন্তু এতে তার দা’র তাকে খুঁজতে সুবিধা হবে। সহজেই পেয়ে যাবে তাকে। তাই আর দেশ ছাড়লো না বরং শহর ছাড়ল। তার দা এটা ভাববে না সে শহর ছেড়েছে। ভাববে দেশ ছেড়েছে। বন্ধ চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ল। সবার কথা খুব মনে পড়ছে। শান্ত, অরনি,‌ দা, দি, মিষ্টি ভাবী , ভাইয়া, নীল ভাবী, রোদ্দুর, ইহান, কাব্য, আরিশা, ক্যাট সবাইকে! ইহানের কথাটা ভেবে খারাপ লাগছে আরো বেশি। বেচারার বিয়ে ছিল গতকাল আর সে এখন হয়তো আমার খোঁজেই পাগল হয়ে যাচ্ছে। খুব স্বার্থপর মনে হচ্ছে নিজেকে খুব স্বার্থপর! কিন্তু একটা মা তো শুধু তার সন্তানের জন্য’ই স্বার্থপর হয় তাই নাহ!

ঈশানের ডাকে ঘুম ভাঙল মেহেরিন’র। গাড়ি থেকে নামতে বলল সে। গাড়ি থেকে নেমে চোখ পড়ল একটা বাড়ির দিকে। বাড়িটা এতো বড় না আর না এতো ছোট্ট। তবে বেশ সুন্দর! চারদিক ফুলের ছোট্ট ছোট্ট টব‌ ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। সেখানে ফুল ও ফুটেছে।

– বাড়ি পছন্দ হয়েছে?

– খুব সুন্দর!

– তুই ভিতরে গিয়ে ফ্রেশ হ আমি খাবার নিয়ে আসছি তোর জন্য।

– হুম!

অতঃপর মেহেরিন ধীরে ধীরে পা বাড়ালো বাড়িটার দিকে।‌ এটাই তার আর তার সন্তানের ভবিষ্যৎ। এক গাল হাসি নিয়ে ঢুকল বাড়ির ভেতর। পুরো বাড়িটাই বাঁশ দিয়ে তৈরি। ব্যাপারটা বেশ মজার। এরকম একটা বাড়িতে এই প্রথমবার এসেছে সে। মেহেরিন বসার ঘরে আসতেই হঠাৎ একটা গান তার কানে ভেসে এলো।

‌‌ “কথা হবে দেখা হবে,
‌‌ ‌ ‌ প্রেমে প্রেমে মেলা হবে
কাছে আসা আসি আর হবে না
চোখে চোখে কথা হবে,
ঠোঁটে ঠোঁটে নাড়া দেবে
ভালবাসা-বাসি আর হবে না”…

গানটা কেউ গাইছে, গলাটা খুব চেনা। মেহেরিন’র বুকে কামড় দিয়ে উঠলো। সে গানের‌ স্বর ফলো করে রান্না ঘরে এলো। কেউ আছে রান্না ঘরে। কে এটা? নির্ঝর!
মেহেরিন দাঁড়িয়ে তাকে দেখছে। তখন সে পেছনে ফিরল। এক গাল হাসি নিয়ে মেহেরিন’র দিকে তাকাল নির্ঝর! তার দু’হাতে দুটো কফি মগ। তাকে দেখেই মেহেরিন এক পা পিছিয়ে গেল। তার কাছে যেন সব কিছু স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছিল। কিন্তু এটা তো স্বপ্ন থেকে কোন অংশে কম না।

নির্ঝর হেঁটে মেহেরিন’র সামনে এসে দাঁড়াল। মেহেরিন একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। নির্ঝর কফি মগ দুটো টি টেবিলে রেখে মেহেরিন কে ধরে সোফায় বসিয়ে বলল..

– অনেক জার্নি করে এসেছো রেস্ট নেও। এসময় এতো জার্নি করা তোমার জন্য ভালো না।

– এ..এসময় মানে!

নির্ঝর মেহেরিন’র হাত দুটো ধরে একটা চুমু কেটে বলে..
– যে আসছে তার খেয়াল তো রাখতে হবে বলো!

মেহেরিন চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। সে এক ঝাটকায় নির্ঝরের হাত দুটো ছাড়িয়ে দাঁড়িয়ে গেল। চিৎকার করে বলে উঠল..

– কি! কি বললেন আপনি!

– মেহু পাখি! রিলেক্স! শান্ত হও!

– কি শান্ত হবো। আপনি কি বলতে চান!

তখন পিছন থেকে দা’র গলা এলো। মেহেরিন তাকিয়ে দেখে অভ্র..

– আদুরী!

– দা!

শুধু দা না, দি, ভাইয়া, কাব্য, রোদ্দুর,‌ইহান আর তিশা। তারা সবাই ঘরের ভিতর থেকে আসছে। তার মানে এরা মেহেরিন’র আগেই চলে এসেছিল এখানে। নাহলে ঘরের ভিতর থেকে কিভাবে এলো। অভ্র এসেই মেহেরিন’কে জরিয়ে ধরল। মেহেরিন’র মনে অপরাধ বোধ ছিল। তাই সে কিছুই জিজ্ঞেস করার সাহস পেল না। কি বা জিজ্ঞেস করতো সে। অভ্র’র চোখে মুখে খুশি দেখতে পাচ্ছে মেহেরিন। শুধু অভ্র না, নিহা, নীল, রোদ্দুর ওদের সবার মুখে হাসি। অভ্র’র মেহেরিন’র দু’গালে হাত রেখে কপালে একটা চুমু খেয়ে বলল..

– তোমাকে বলে বোঝাতে পারব না আমি আজ ঠিক কতোটা খুশি। আমাদের আরেকটা আদুরী আসবে এখন।

– জুনিয়র আদুরী আসবে দেখো দা!

– কেন ছেলে হলে কি হবে?

– কিছুই না, হলে ভালো হবে।

অভ্র’র মেহেরিন’র চোখের দিকে তাকিয়ে বলে..
– আদুরী আসবে, আমার মন বলছে

অতঃপর অভ্র আবারো চুমু খায় তার কপালে। অতঃপর নিহা, নীল, রোদ্দুর ওরা সবাই একে একে এসে মেহেরিন কে আদর করে। মেহেরিন’র বুঝতে বাকি নেই এরা সব জানে। অবশেষে এলো ডেভিল।‌ ডেভিল”রং চোখেও খুশির সীমা নেই। সে মেহেরিন’র মাথায় হাত রেখে দোয়া করলো। কিন্তু মেহেরিন’র কাছে যেন সবকিছু গোলক ধাঁধা লাগছে। হুট করেই ইহান মেহেরিন’র গাল টেনে বলে..

– পঁচা মেয়ে, জানিস তোর জন্য কতোটা চিন্তা করছিলাম!

– এটা নিশ্চিত ছিল তুই বিয়ে ছেড়ে পালাবি কিন্তু কোথায় যাবি এটা তো বলে যাবি।

– ভাগ্যিস নির্ঝর বললো তুই এখানে না হলে তো আমরা জানতাম’ই না।

– বিয়ের পর’ই ছুটে চলে এলাম এখানে!

নিহা বলে উঠে…
– গেলি তো গেলি তার সাথে এই খুশির খবরটা নিয়েও গেলি!

– দি আসলে আমি!

নির্ঝর বলে উঠে..
– তোমরা কি শুরু করলে তো আমার বউ কে নিয়ে, দেখছো না কতোটা জার্নি করে এসেছে ও! রেস্ট নিতে দাও যা কথা বলার পরে হবে।

দরজার সামনে থেকে আহিয়ান বলে উঠে..
– ইশ রে কি চিন্তা ভাবনা বউয়ের প্রতি!

– জিজু!

– আদুরী!
বলেই মেহেরিন কে এক হাত দিয়ে হাগ করল। বলল..
– নির্ঝর ঠিক’ই বলেছে এসময় এতো জার্নি করা উচিত না।

অভ্র বলে উঠে..
– আচ্ছা তাহলে আমরা রির্সোটে ফিরে যাই সবাই। নির্ঝর!

– দা! মেহেরিন আর আমি কিছুদিন এখানে থাকি!

ইহান বলে উঠে..
– হুম জায়গাটা অনেক সুন্দর!

– হুম কিন্তু তোর হানিমুনে’র ব্যবস্থা আমি রির্সোটে করেছি। আপনি আপাতত ওখানে থাকেন!

– তুই তো ছেলেটা কে মিনিটে মিনিটে লজ্জা দিস। তোর বোনের সাথে বিয়ে হয়েছে এই খেয়াল আছে তোর।

– আছে বলেই এখনো সম্মান দিচ্ছি!

– কচু দিস!

অতঃপর সবাই হেসে উঠে। সবাই মেহেরিন’র থেকে কিছু আড়াল করছে। মেহেরিন’র উপর রেগে থাকলেও কেউ তাকে কিছু বলছে না এর কারন হলো ও প্রেগন্যান্ট!
তাই সবাই মানিয়ে নেবার চেষ্টা করছে কিন্তু বিয়ের দিন হয়েছিল টা কি। নির্ঝর এখানে কেন? কথার সাথে কি বিয়ে হয় নি উনার!

মেহেরিন কে এভাবে চিন্তিত দেখে আহিয়ান ওর হাত ধরে হাতে ভরসা দেয়। অতঃপর সবার থেকে লুকিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে..
– এসব নির্ঝর করেছে, আর কি হয়েছে তা নির্ঝর তোমাকে বলবে। এ সময় মাথার উপর এতো চাপ দিও না।

আহিয়ান’র কথা শুনে মেহেরিন শান্ত হলো। অতঃপর সবাই তাদের দুজনকে রেখে চলে গেল। নির্ঝর এসে মেহেরিন কে জরিয়ে ধরল। অনেকক্ষণ যাবত জরিয়ে ধরে রাখল তাকে। অতঃপর তার কপালে একটা ডিপ কিস করে বলল..

– তোমাকে বলে বোঝাতে পারব না আমি ঠিক কতোটা খুশি!

– আপনি কথা কে বিয়ে করেন নি!

– না!

– কেন?

– কারন একজন পাখি সবসময় একজন সঙ্গী নিয়েই সন্তুষ্ট থাকে আর আমার সেই সঙ্গী হলে তুমি মেহু পাখি!

– তাহলে এসব নাটক ছিল!

– না নাটক ছিল না। তুমি যা করলে আমিও তাই করলাম। তবে শেষে বাজিমাত টা আমি করলাম।

– কি করে?

– এভাবেই, নিরবের যেমন অন্য জনের সাথে বিয়ে হবার কথা ছিল তেমনি ভাবে কথা’র ও বিয়ে ঠিক হয়েছিল। আর বিয়েতে যেভাবে তুমি আড়ালে দাঁড়িয়ে ভেবেছিল কথার বর আমি ঠিকতেমনি আমি দূর থেকে তোমার উপর নজর রাখছিলাম। আমি জানতাম তুমি পালাবে।

– আপনাকে এসব কে বলল!

– কেউ বলে নি। আমি নিজেই শুধু তোমার উপর নজর রেখেছিলাম! যেদিন তুমি বিয়ের অ্যানাউসমেন্ট করো তার পরদিন’ই তুমি হসপিটালে গেছিলে আমিও তোমার পিছু পিছু সেদিন হসপিটালে গেলাম। আর সব জানলাম। তখনই বুঝে গেলাম তুমি বড় কিছু করছো। অতঃপর বিয়ের আগের দিন যখন তুমি ঈশান’র সাথে কথা বললে তখন আমি ডেভিল কে দিয়ে সব খোঁজ খবর নিলাম। আর তোমার প্ল্যান বুঝতে পারলাম। আর যাই বলো তোমার সাথে থেকে থেকে তোমাকে বুঝতে শিখেছি আমি।

– দা আর দি ওদের..

– তোমাকে বিয়ের আসরে না দেখে ওরা প্রায় পাগল হয়ে যাচ্ছিল। তখন আমি ওদের সবকিছু বলে শান্ত করি। বলতে হবে ওরা কিন্তু বেশ খুশি! কিন্তু মেহু পাখি তুমি!

মেহেরিন নির্ঝরের দিকে তাকাল। নির্ঝর মেহেরিন’র‌ গাল দুটো ধরে বলল..

– তুমি এটা কিভাবে ভেবে নিলে আমার সন্তান থেকে তুমি আমাকে দূরে রাখবে বলো তো!

– নির্ঝর ও আমার সন্তান!

– আমি ওর বাবা মেহু পাখি। এতো অবিশ্বাস করো তুমি আমায় যে নিজের বাবা’র থেকে নিজের সন্তান কে আলাদা করছো। কোন বাবা কখনো কি তার সন্তানের খারাপ চায় বলো তুমি!

মেহেরিন কেঁদে দিল। বলতে লাগল..

– আমি থাকবো না আপনার সাথে। খুব কষ্ট দিয়েছেন আপনি আমাকে, সবসময় আমাকে কষ্ট দিয়েছেন। কাঁদানোর চেষ্টা করেছেন বার বার!

– তোমাকে কষ্ট দিয়ে কি আমি ভালো ছিলাম মেহু পাখি!

বলেই নিজের কপালের সাথে মেহেরিন’র কপাল ঠেকাল। দুজনেই খুব কাছাকাছি। মেহেরিন নিঃশব্দে কাঁদছে। সে বলে উঠে..

– আমি ভালোবাসি না আপনাকে!

– তোমার ভালোবাসা লাগবে না আমি ভালোবাসলেই হবে!

– থাকবো না আমি আপনার সাথে!

– সমস্যা নেই আমি থাকবো তোমার সাথে!

– আপনার সাথে কোন কথা বলবো না!

– বলা লাগবে না আমার কথা শুনলেই হবে!

হঠাৎ মেহেরিন এই কান্না’র মাঝে মুচকি হেসে দেয়। নির্ঝর মেহেরিন’কে জরিয়ে ধরে বলে..

– তোমার আগলে রাখা লাগবে না, আমি আগলে রাখবো তোমায়। তুমি শুধু সারাজীবন আমার সাথে থাকলেই হবে মেহু পাখি!

– লেজ কাঁটা ব্যাঙ একটা হুহ!

নির্ঝর হেসে মেহেরিন’কে আরো শক্ত করে জরিয়ে ধরে!
.

৭ মাস পর..
সবাই অপারেশন থিয়েটারের সামনে দাঁড়ানো। নির্ঝর দাঁড়িয়ে আছে স্থীর হয়ে। সবার মাঝেই চিন্তা! কিছুক্ষণ আগেই মেহেরিন’র এক্সিডেন্ট হয়েছে। গাড়ি ড্রাইভ করছিল সে। তখন হুট করে আরেকটা গাড়ি এসে ধাক্কা মারে তাকে। মেহেরিন নিজেকে সামলাতে না পেরে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। প্রচুর রক্তক্ষরণ হয় তার। তার এই সময়ে এতো বড় দুর্ঘটনা সবাইকে স্থীর করে দিয়েছে।

নির্ঝর দাঁড়িয়ে ভাবছে, কিছুক্ষণ আগে কলে..

– মেহু পাখি কোথায় যাচ্ছ?

– এই তো এখানে!

– কাউকে নিলে না কেন? আমার জন্য তো অপেক্ষা করতে পারতে। আমি আসলে আমার সাথে যেতে।

– নির্ঝর আপনি…

আর বললো না মেহেরিন! তখন শুধু কিছু চিৎকার’র আওয়াজ আসল তার ফোনে। নির্ঝর তখন’ই ছুটে এলো!

অভ্র চুপচাপ বসে আছে, নিহা পায়চারি করছে। ইহান আর কাব্য দা আর নির্ঝর কে সামলাচ্ছে। কয়েকমাস আগেই ক্যাট আর‌ ছেলে কিহাফ আর নিশি’র মেয়ে নিলাদ্রী! আরিশা’র এখন ৮ মাস চলছে। রোদ্দুর তাকে সামলাচ্ছে। এর মাঝেই ওটি থেকে ডাক্তার বের হলো। সবাই তার কাছে ছুটে গেল।

– ডাক্তার আমার স্ত্রী আর বেবী ঠিক আছে তো! কিছু হবে না তো ওদের!

– আই’ম সরি!

অভ্র..
– মানে!

– মানে প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে। বাচ্চা’টার অনেক ক্ষতি হয়েছে। এখন’ই ডেলিভারী করতে হবে তবে..

নিহা বলে..
– তবে!

– আমরা শুধু একজন কেই বাঁচতে পারব হয়তো মা নয়তো বাচ্চা। এখন আপনারা ঠিক করুন কাকে বাঁচাবো। যা করবেন জলদি করেন।

বলেই সে চলে গেল। নির্ঝর ধপাস করে বসে পড়ল। কি করবে সে! এর মাঝেই একটা নার্স এসে পেপারে সাইন করতে বললো। এখানে লেখা আছে নির্ঝর কাকে বাঁচাতে চায়। নির্ঝর কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না। যে বাচ্চা তার দুনিয়ার মুখ টা এ পর্যন্ত দেখেনি তাকে মেরে ফেলবে নাকি তার স্ত্রী কে বাঁচাবে।‌কি করবে সে।

অভ্র’র খুব ইচ্ছা হলো বলতে যে তার আদুরী কে যেন বাঁচাতে বলে। আদুরীর কিছু হলে যে তারা বাঁচবে না। নিহা অভ্র’র ঘাড়ে হাত রেখে তাকে আশ্বাস দিচ্ছে।

নার্স বলছে তাড়াতাড়ি করতে, সময় বয়ে যাচ্ছে। নির্ঝর চোখ বন্ধ করতেই তার সামনে মেহেরিন’র হাসি মাখা মুখ টা ভেসে উঠলো। সে আর কিছু না ভেবে তার মেহু পাখিকে বাঁচানোর সিন্ধান্ত নিল।

৩ দিন পর…
মেহেরিন’র‌ জ্ঞান এখনো ফিরেনি। এক্সিডেন্ট হবার সময় জ্ঞান হারিয়েছিল! যখন জ্ঞান ফিরল তখন তাকে হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। অভ্র আর নির্ঝর কে দেখেছিল তখন। এখন পর্যন্ত তার জ্ঞান ফিরে নি।
নির্ঝর মেহেরিন’র পাশে বসে তার হাত দুটো জরিয়ে ধরে কাঁদতে লাগল! ভেবে কষ্ট হচ্ছে নিজের বাচ্চা কে মেরে ফেললো সে। কিভাবে পারল সে এটা করতে কিভাবে। আচ্ছা মেহেরিন জ্ঞান ফিরার পর যদি এসব জানে তাহলে কি তাকে বুঝবে। বুঝবে তার অসহায়ত্ব! তার হাতে যে কিছু ছিল না। এমন একটা পরিস্থিতি ছিল যে সে কিছুই করতে পারত না। এটা কি বুঝবে তার মেহু পাখি!

অতঃপর নির্ঝর বেরিয়ে বাইরে এসে দাঁড়াল। চোখ দিয়ে পানি ঝড়িয়ে পড়ছে তার। এদিকে মেহেরিন’র জ্ঞান ফিরল। জ্ঞান ফিরতেই পাশে নিশি , নীলাশা আর আনহা কে পেল সে। তিনজনেই মুখ মলিন। মেহেরিন পেটে হাত রাখতেই বুঝল তার বাচ্চা নেই। তার চোখ দুটি জলে ভরে আসছিল। তাকিয়ে রইল তাদের দিকে। দু’জনেই মাথা নিচু করে ফেলল।

মেহেরিন হাতের ক্যানেল টা খুলে দৌড়ে বের হয়ে গেল। বের হতেই অভ্র কে পেল সে। জরিয়ে ধরল তাকে। অতঃপর তাকে জিজ্ঞেস করল নির্ঝরের কথা। অভ্র তাকে ধরে নির্ঝরের কাছে নিয়ে গেল। মেহেরিন নির্ঝর কে দেখেই তার কাছে দৌড়ে গেল। জরিয়ে ধরল তাকে। তাকে আঁকড়ে ধরে কাঁদতে লাগলো সে। নির্ঝর কি বলে তাকে সান্ত্বনা দিবে বুঝে উঠতে পারল না। তবে মিথ্যে সান্ত্বনা দেবার প্রচেষ্টা!

– আই’ম সরি নির্ঝর,‌ আজ সবকিছু আমার জন্য’ই হলো!

– এভাবে বলো না মেহু পাখি! এখানে তোমার কোন দোষ নেই। ভাগ্যে যা ছিল তাই হয়েছে।

অতঃপর আবারো নির্ঝরের বুকের মাঝে মুখ লুকিয়ে কাঁদতে লাগলো!

দীর্ঘ ৮ বছর পর…
৬ বছরের একটা ছোট মেয়ে চকলেট হাতে নিয়ে আসছে ডায়নিং টেবিলে’র দিকে। অভ্র তখন মেহেরিন কে খাইয়ে দিচ্ছিল। সে অভ্র কে উদ্দেশ্য করে বলতে লাগল..

– মামা ওই মামা তুমি এতো বড় মেয়েকে খাইয়ে দিচ্ছে কেন?

অভ্র হা হয়ে তাকাল মেয়েটার দিকে। মেহেরিন বলে উঠে..
– হিংসা হচ্ছে নাকি তোমার!

– না হবার কি আছে। এতো বড় মেয়ে কে কেউ খাইয়ে দেই নাকি। আমি তো নিজের হাতে খাই!

তখন পিছন থেকে অরনি তার কান ধরে বলে..
– এতো ছোট্ট বয়সে এতো মিথ্যে কিভাবে বলিস তুই হুমম!

– দি, আমার লাগছে!

শান্ত এসে তাকে ছাড়িয়ে..
– এই আদুরী কে এভাবে মেরো না অরনি।

– দা তুমি জানো না, এই মেয়েটা ফুফি’র সাথে হিংসা মি করছে।

পেছন থেকে আহিয়ান এসে অরনি কে কোলে নিয়ে বলে..
– কার মেয়ে এটা দেখতে হবে তো মামনি! মেহেরিন বর্ষা খান নির্ঝর চৌধুরী’র মেয়ে মেহের নীরা চৌধুরী! ওরফে জুনিয়র আদুরী!

নীরা হেসে বলে..
– লাভ ইউ মামু!
আহিয়ান হেসে তার হাতে অনেকগুলো চকলেট দেয়।

নিশান’র কোলে চড়ে নিলাদ্রী এসে বলে..
– আমার বোন টাকে আবার সবাই জ্বালাচ্ছে নাকি।

হুট করেই রাইয়ান এসে তখন নীরার হাত থেকে কিছু চকলেট গুলো কেড়ে নেয়। নীরা তার পিছনে ছোটার আগেই কিহাফ তার হাত থেকে চকলেট কেড়ে নেয়। হাতে শুধু আর দুটো চকলেট থাকে। নীরা দুটো চকলেট কে দেখতে থাকে তখন ‌( রোদ্দুর আর আরিশা’র ছেলে ) রিহাত আর ( ইহান আর তিশা’র ছেলে ) ঈশান এসে দুটো চকলেট কেড়ে নেয়। নীরা ঠোঁট উল্টে মেঝেতে বসে ভ্যা ভ্যা করতে থাকে। তখন সব ভাই-বোন মিলে তার সামনে হাত পেতে চকলেট দেয়। নীরা খিলখিলিয়ে হেসে দেয়। সবাই তাকিয়ে সেই হাসি দেখতে থাকে। আসলেই হাসি টা অনেক সুন্দর।

মেহেরিন বলে উঠে..
– আমার মতো হাসি!

– জ্বি না এটা তোমার হাসি না বুঝলে।

– তোর কার হাসি!

– আমার হাসি! হি হি হি!

মেহেরিন কিছু না বলে দিয়ে অভ্র কে বলে খাইয়ে দিতে। অভ্র তাকে খাইয়াতে থাকে। তখন নীরা বলে..
– তুমি আবারো মামা’র হাতে খাচ্ছো।

– হ্যাঁ! কারন আমি মেহেরিন বর্ষা খান নির্ঝর চৌধুরী!

– মেহেরিন বর্ষা খান নির্ঝর চৌধুরী!

– হুম!

নীরা কিছু বলতে যাবে তখন নির্ঝরের আওয়াজ আসে। নীরা ছুটে যায় তার কাছে। নির্ঝর নীরা কে আদর করে তার কপালে চুমু খায়। বসার ঘরে সবাই বসে আছে। নিহা, আনহা আর নিশি মিলে সবার জন্য হালকা খাবার নিয়ে এলো। ক্যাট, আরিশা, তিশা , নীলাশা সব বাচ্চাদের জন্য মিল্ক শেক নিয়ে এলো। রোদ্দুর, ইহান,‌কাব্য আর নীল মাত্র অফিস থেকে ফিরল। কিহাফ, ঈশা, রিহাত আর রাইয়ান ছুটে যায় তাদের কাছে। নির্ঝর এসে মেহেরিন’র মাথায় টোকা মেরে বলে..

– এই অসময়ে খাচ্ছ তুমি, দা’র হাতে খাওয়া ছাড়া আর কোন কাজ নেই তোমার তাই না।

– না!

নীরা বলে উঠে..
– বাপি আমার নাম কি?

– এটা কেমন প্রশ্ন মামনি!

– বাপ যেমন মেয়েও তেমন!

– বলো না তুমি!

– মেহের নীরা চৌধুরী ওরফে জুনিয়র আদুরী! কেন?

– আম্মু’র নামে তো খান চৌধুরী দুটোই আছে তাহলে আমার নামে খান কোথায়?

নীরা’র কথা শুনে সবাই চুপ। একমাত্র কিহাফ, ঈশান আর রিহাত হাসতে শুরু করে দেয়। নীরা অভ্র’র দিকে করুন ভাবে তাকায়। অভ্র এসে তাকে কোলে নেয়। শান্ত আর অরনি এসে ‌তার মাথায় হাত বোলাতে থাকে। মেহেরিন বসে বসে শুধু সবার কান্ড দেখতে থাকে। সবাই তাকে বোঝাচ্ছে। তখন মেহেরিন বলে উঠে..

– কারন আমি খান বংশের মেয়ে তুমি না!

– দা আমি খান বংশের মেয়ে না কেন?

– আদুরী শোন।

– আমি তোমাদের কেউ না!

– দা আমার ক্ষুধা লেখেছে। তুমি অর্ধেক খাইয়ে ওর কথায় নাচতে লাগলে!
অভ্র পড়ল বিপদে! কি বলবে কিছুই বুঝলো না। তখন পিছন থেকে শুভ্র বলে উঠে..

– কে বললো তুমি খান বংশের কেউ না! অধরা খানের নাতনি তুমি! মেহের নীরা চৌধুরী! আমার আদুরীর মেয়ে জুনিয়র আদুরী বুঝলে!

নীরা শুভ্র কে দেখে দৌড়ে তার কাছে চলে যায়। কোলে উঠে পরে তার। মেহেরিন ও গিয়ে জরিয়ে ধরে। শুভ্র প্রথমে মেহেরিন কে পরে নীরা কে চকলেট দেয়। নীরা এখানেও অভিযোগ করে সে সবার ছোট হবার পর কেন মেহেরিন কে সবই আগে চকলেট দেয়। তার জ্বালায় অতিষ্ঠ সবাই শুধু মেহেরিন ছাড়া। কারন তার মতে সে নির্ঝরের মতোই লেজ বিহীন আর কি! বাড়ির বাকি বাচ্চা’রা না জ্বালায় তার চেয়ে বেশি জ্বালায় নীরা। কারো না কারো না কাছে তার বাহানা থাকবেই। তবে দিন শেষে মেহেরিন’র কোলে এসেই ঘুমায় সে।এভাবেই চলতে থাকে তাদের পরিবার।

মেহেরিন নীরা কে ঘুম পারিয়ে বিছানায় শুইয়ে দেয়। অতঃপর কপালে একটা চুমু দিয়ে বিছানার এক পাশে চকলেট রেখে দেয়। জানে নীরা মাঝ রাতে উঠে চকলেট খেতে চাইবে। অতঃপর আসে বেলকনিতে। নির্ঝর আকাশে দাঁড়িয়ে তারা দেখছে তখন। মেহেরিন তার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। নির্ঝর হেসে তাকে নিজের দিকে টেনে বলে..

“বুঝলে মেহু পাখি! তোমাকে ছাড়া আমি একটা তাঁরা হীন আকাশের মতো।‌ কারন রাতের বেলায় আকাশে তারা না থাকলে যেমন পুরো আকাশ অন্ধকার তেমনি তুমি ছাড়া আমার জীবন অন্ধকার!”

– তাই!

– হুম মেহু পাখি!
বলেই মেহেরিন’র ঘাড়ে থিতুনি রাখে!

#সমাপ্ত

[অবশেষে শেষ করলাম এই গল্পটা! সবার অনেক ভালোবাসা পেয়েছি গল্পটায়। জানি অনেকেই মন খারাপ করে আছেন। তাই সবার জন্য খুশির খবর খুব জলদি আসছে #ভালোবাসার_ফোড়ন_২। ধন্যবাদ সবাইকে! ]

Game সিজন-০১ পড়তে লেখাটি উপর ক্লিক করুন।