In_The_Depths_Of_Love Part-20

0
9458

#In_The_Depths_Of_Love
#Mizuki_Aura
#Part_20

“রাই………..” একটা কণ্ঠস্বর কনে এলো। ইতোমধ্যেই ঘুম ভেংগে গিয়েছে রাই। এর কন্ঠটা শুনে মনে হলো খুব পরিচিত স্বর। রাই এর মাথায় প্রথমেই আবিরের কথা এলো। রাই মনে মনেই খুশি হয়ে গেল।

__________________

ওদিকে………..
ভেতরে কেবিনে শুয়ে আছে সৌরভ। ডক্টর চেকআপ শেষে দরজা খুলে বেরিয়ে আসতেই আবির এগিয়ে গেলো “ডক্টর পেশেন্ট এর কী অবস্থা?”

“বেশি গভীরভাবে আঘাত পায়নি, বলে বেঁচে গেছে। খুব ভারী লোহার রড ধরনের কিছু দিয়েই মাথায় আঘাত করা হয়েছে। ”

“এখন কি দেখা করা সম্ভব? ”

“উম, জ্ঞান ফিরলেই পারবেন। তবে স্ট্রেস দেওয়া যাবেনা”

“জ্বী। থ্যাংক ইউ ডক্টর” ডক্টর চলে গেলেন।

প্রায় আধা ঘণ্টা পর নার্স ও বেরিয়ে এলেন “পেশেন্ট এর বাড়ির লোক কে?” আবির এগিয়ে গেলো ।
“হ্যাঁ , দেখা করতে পারবেন তবে কিছুক্ষণের জন্য”

আবির সম্মতি দিলো।
ভেতরে গিয়ে দেখে সৌরভ চোখ বন্ধ করে আছে। কারো আসার শব্দে ও চোখ খুলে তাকালো। অস্ফুট স্বরে বলল “ভাই….”

আবির গিয়ে পাশে বসলো “আমাকে তো একটা ফোন করা যেত নাকি? তোর কিছু হলে আমি????”
সৌরভ কিছু বলতে গিয়েও পারলো না। মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে।
আবির ও চুপ রইলো।

(আসলে তখন সন্ধ্যায় যখন আবির বাসায় ধকে তখনি একটা লোকের কল আসে, লোকটা বলে একজন রাস্তায় রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে ছিল। তাকে হাসপাতালে পৌঁছনো হয়েছে। তার ফোন থেকে প্রথম নম্বর নাকি আবিরের ছিলো।তাই ওটায় ফোন করেছে। এজন্য আবির তাড়াহুড়োয় বাসা থেকে বেরিয়ে যায়)

“সরি ভাই…..” অস্ফুট স্বরে।

“ঠিক কি হয়েছিল?”

সৌরভ একটা নিশ্বাস ফেললো “ভাই , গতকালকের ওই লোকটার আস্তানা খুঁজে পেয়েছিলাম। তাই ,,,,,,, (একটু থেমে ) তাই, ভাবলাম যে সময় নষ্ট না করে আগে ওকে গিয়ে ধরি। তারপর ,,,,,,,,,, আপনার কাছে। কিন্তু …….………… ঐখানে পৌঁছনোর পর, ও কোনোভাবে টের পায়। ধরতে গিয়ে হাতাহাতি হয়। আর শেষে রাস্তার পাশের একটা লোহার পাইপ পড়ে ছিল। ঐটা…….”

আবির হাতের ইশারায় ওকে থামিয়ে দিল “লোকটা কে?”

“এখনও পরিচয় পাইনি। শুধু , ওকে খুঁজে পেয়েছিলাম সিসিটিভি, দিয়ে”

আবির একটু গভীর চিন্তায় ডুবে গেলো। গণিতবিদদের মতো করে কতগুলো হিসাব মিটিয়ে সৌরভের দিকে তাকালো “রেস্ট কর। সুস্থ হওয়া পর্যন্ত আর উঠতে হবেনা। ”
সৌরভ আর কিছু বললো না। ওর মাথার ব্যথাটা যেনো বেড়ে যাচ্ছে।
আবির কেবিন থেকে বেরিয়ে নার্সকে বলে গেলো।

হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে আবির একটু স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো । হাত ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখে এখন রাত ২ টা। তখনি ফোনের মেসেজটার দিকে আবারো নজর গেলো। রাই এর মেসেজটা। আবির প্রায় ভুলেই গিয়েছিল…………….. কিন্তু ছাদে কেনো? যাইহোক সেদিকে আবিরের মাথা ব্যাথা নেই। গাড়িতে উঠে আবির গাড়ি স্টার্ট করলো।

বাড়িতে পৌঁছতে পৌঁছতে আবিরের প্রায় আধ ঘন্টা লেগে গেলো।
ফ্ল্যাটে না ঢুকে আবির সরাসরি ছাদের দিকে গেলো। অবশ্য মেসেজে ১২ টার কথা উল্লেখ থাকলেও , একবার দেখে আসতে চায় রাই আছে কিনা। না থাকলে তো ভালো। বাসায় চলে যাবে।

কিন্তু আশ্চর্য বিষয় যে ছাদ থেকে একটা শব্দ একাধারে ভেসে আসছে। আর ১০ টা সিড়ি পার করেই ছাদ। কিন্তু কিসের শব্দ! যত সিড়ি উপরে উঠছে , ততই যেনো আবিরের কানে শব্দটা তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে।
যেনো কারো কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছে। আবির এর খটকা লাগলো। সোজা দৌড়ে উপরে উঠে গেলো।

দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতেই আবির থমকে গেলো।
ঠিক তার সামনে মাটিতে বসে আছে রাই। লাল শাড়িতে। কিন্তু বাকি চারিদিকের অবস্থা দেখে আবিরের বিস্ময়ের শেষ রইলো না। চারদিকের অবস্থা খারাপ। মনে হচ্ছে ছাদে বেলুন আর অন্যান্য কিছু দিয়ে সাজানো হয়েছিল যেগুলো কেউ ছিড়ে মাটিতে ফেলেছে, সবকিছু উলোট পালোট। একটা টেবিল ও উল্টে পড়ে আছে। কিন্তু এরই মধ্যে আবিরের চোখ গেলো রাই এর হাতের দিকে। আবির দৌড়ে গেলো “রাই……”

“তোমার হাত থেকে রক্ত পড়ছে কেনো? রাই,?” আবির দেখলো মেঝেতে ভাঙ্গা কাছের চুড়ি পড়ে আছে। আর রাই এর হাতেও সেই একই কাচের চুড়ি। রাই শুধু কান্না করছে। ওর চোখের কাজল ও কান্নার জন্য লেপ্টে গেছে, চুলগুলো এলোমেলো। আবিরের বুকে যেনো কেউ হাজার টনের পাথর চাপা দিচ্ছে ক্রমশ। এতটা ব্যাথা করছে।

“রাই ……..”

রাই আবিরের দিকে ভালো করে তাকালো “দুর হন আমার থেকে ” বলে আবিরকে ঠেলে সরিয়ে দিলো রাই। উঠে দাড়ালো। আবির অবাক।

“রাই…..!”

“আমার নাম নিজের মুখে আনবেন না” কান্নার জন্য ভাঙ্গা ভাঙ্গা শব্দে বললো রাই। “আমার……… কাছেও……. আসবেন না”
আবির উঠে দাড়ালো “কিন্তু কি হয়েছে তোমার?” আবির এগিয়ে গেলেই রাই পিছিয়ে গেলো আর নিজের সর্বোচ্চ দিয়ে চিৎকার করলো “বলেছিনা……… দু দূরে থ থাকুন…….. বলেছিনা”

“দেখো সব কথা পরে। তোমার হাত থেকে রক্ত পড়ছে “…….

রাই আবারো চেঁচিয়ে উঠলো “আপনার দেখা লাগবে না……… এখন থেকে চলে যান”

আবির স্পষ্ট বুঝতে পারলো এই রাগটা কোনো অভিমান নয় । বা রাই ওর দেরিতে আসার জন্য রেগে নেই। অন্য কোনো কিছু হয়েছে…….. আবির বিস্ময় চোখে তাকিয়ে রইলো।

রাই একহাতে মাথা চেপে ধরে নিজের কান্না থামানোর প্রচুর চেষ্টা করছে। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছেনা। ওর কান্নার বেগ শুধু বেড়েই চলেছে।
ও হটাৎ আবিরের দিকে তাকালো। আবির সত্যিই জানেনা ওর কি করা উচিৎ।

রাই একপা একপা করে আবিরের দিকে এগোলো । আর গিয়ে ওর শার্ট এর কলার চেপে ধরলো “কেনো করলেন আমার সাথে এমন? ”

“আমি…….”

“কেনো করলেন? কিসের প্রতিশোধ চান? আমি আপনার কোন ক্ষতিটা করেছি?” বলে রাই গর্জে উঠলো।
আবির যেনো একের পর এক শক খাচ্ছে “কি করেছি আমি?”

রাই রেগে গেলো তবে তুচ্ছ হেসে বললো “ওহ, হ্যাঁ জানেনই তো না কি করেছেন। কিভাবে জানবেন ? আপনি তো স্বীকার ই করেন না । জানবেন কি?”

আবির রাই এর দুবাহু ধরলো “স্পষ্ট করে বলো কি বলতে চাচ্ছো?”

রাই কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলো। তারপর কান্নাজড়িত গলায় বলল “আমাদের বিয়েটা ঠিক কি আবির?”

আবির এর চোখ মুখ সংকুচিত হয়ে এলো এই কথার অর্থ ওর মস্তিষ্কে ধারণ হচ্ছেনা “মানে?”

“বোঝেন না? ” বলে রাই ওর হাত ঝাড়া দিয়ে সরিয়ে দিলো “আপনার এই মিথ্যে ভালোবাসা , কতগুলো বানানো কথা আমার আর জাস্ট সহ্য হচ্ছেনা।”

“বানানো!”

“হ্যাঁ বানানো। সব মিথ্যে। সব। আমি বুঝি না আপনারা ছেলেরা আমাকে কি পেয়েছেন? কি আমি? ননীর পুতুল? এতই সস্তা যে যখন যে ধাঁচে ফেলবেন তার মধ্যেই আমাকে সীমাবদ্ধ থাকতে হবে? আপনাদের দুই ভাই এর মিথ্যে কিছু কথার জালে পড়ে আজ আমি শেষ। আমার আমিই আজ শেষ। কেনো আমার সাথে এই মিথ্যে খেলাগুলো খেললেন?”

আবিরের রক্ত গরম হয়ে আসছে। এসব কি উল্টোপাল্টা বলছে রাই । ও চেঁচিয়ে উঠলো “রাই,।।।”

“হ্যাঁ এক্সাক্টলী। এখন চিল্লাবেন। এটা ছাড়া কোনো উপায় আপনার জানা আছে কি?”

“রাই তুমি কি সোজাভাবে বলবে কি হয়েছে?”

রাই নিজের কান্না থামানোর চেষ্টা করছে “কি হয়েছে? সত্যিটা জেনে গেছি……. আর কি হবে? (চোখ মুখ কঠিন হয়ে এলো রাই এর) নিশান আমাকে সবটা বলে দিয়েছে , সেদিন ঠিক কি হয়েছিল”

আবির মুহূর্তেই থমকে গেলো। নিশান বলে দিয়েছে মানে! অর্থাৎ সেদিন সুরাইয়াদের বাড়িতে যা হয়েছে সেটাই বলে দিয়েছে?

রাই বাকা হাসলো “কিহলো? মিস্টার চৌধুরী….. এখন কথা নেই কেনো? ”

আবির আর কিছু বললো না। ও শুধু রাই এর কথা শোনার জন্য তাকিয়ে রইলো। পিনপতন নিরবতা ভেঙে রাই আবারো বলতে শুরু করলো

“কেনো এরকম একটা আঘাত আমাকেই সইতে হলো বলবেন? আমি তো শুধুই একজনকে চেয়েছিলাম মাত্র। হ্যাঁ এখন চাই না। কিন্তু একটা সময় তো আমি নিশান কে চেয়েছিলাম। ওকে পছন্দ করতাম। ভালোবাসার কথা নাই বলি। কিন্তু আপনি সেটুকু ও কেড়ে নিয়েছিলেন।
ঠিকাছে মেনে নিলাম ।
আপনার কিছু বানানো কথার জন্য সেদিন আমার বাবা মা আমাকে …. (চোখ বুজে নিলো রাই ) তাও মেনে নিলাম।
আপনাকে বিয়ে করতে হয়েছে? যেখানে আপনাকে আমি কখনো চিন্তাই করিনি। মেনে নিলাম।
এবাড়িতে আসলাম , একে একে আপনার পরিবারের প্রত্যেকে আমাকে যতটুকু কথা শুনিয়েছে যা অসম্মান করেছে
তাও মেনে নিলাম।
আপনার সব অত্যাচার , (আবির ভ্রু কুঁচকে তাকালো , রাই জোর দিয়ে বললো) হ্যাঁ অত্যাচার সেটাও মেনেই নিলাম।
অবশেষে , সব ভুলে সব সব কিছু ভুলে আপনাকেও মেনেই নিচ্ছিলাম….. হ্যাঁ নিচ্ছিলাম। কিন্তু গেস হোয়াট?

আজ এসে আমি জানতে পারলাম আপনি , আপনার ভালোবাসা, আপনার কেয়ারিং, আপনার সবটুকু শুধুই একটা মিথ্যে। একটা সাজানো সুন্দর মিথ্যে। ” এটুকু বলে রাই থামলো। আবিরের হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়ে এলো। কিন্তু আবির শুনতে চায় রাই ঠিক কেনো এসব বলছে। রাই আবারো বলতে শুরু করলো

“আজ এসে নাকি জানলাম যে আপনিই আমাকে আর নিশানকে একটা মিথ্যে খেলায় ফাঁসিয়ে নিয়েছিলেন। আপনিই।
সেদিন যখন মিহির ভাইয়ের বাবা এতসব বলছিল তখন নাকি নিশান ছিলো সেখানে। নিশান হয়ত বলতেই যাচ্ছিলো যে আসলে ওর আর আমার ……. যাইহোক। ঠিক সেই মুহূর্তে আপনি ওখানে গিয়ে উপস্থিত হন । আর কথা ঘুরিয়ে দেন। আর নিজের মিথ্যে সাজান।
নিশান কিছু বলবে তার আগেই আপনি ওকে অন্যদিকে নিয়ে গিয়ে আমার (ঘৃণায় মাথা নাড়লো) আমার নামে হুমকি দেন যে নিশান কিছু বললেই আপনি আমাকে মেরে ফেলবেন ? ছি………”

আবির এর হাত আলগা হয়ে এলো। ও রাই এর মুখ থেকে অন্ততপক্ষে একথা আশা করেনি।

“আর এই একটা কারণেই নিশান কিচ্ছু বলতে পারেনি….? কিছুনা।” রাই একহাতে চোখের পানি মুছে নিল “হ্যা যদিও নিশান এর সাথে আমার সব সম্পর্কই একটা ঘৃণার বিষয় ছিল আমিও মানছি। ওকে তো সেদিনই মন থেকে মিটিয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু……. কিন্তু এই শূন্য মনে পুনরায় সতেজতা ফিরিয়ে এভাবে ভেঙে ফেললেন? আজ যদি আপনি আমার জীবনে এই মোড়টা না ঘুরতেন হ্যাঁ নিশান কে পেতাম না তবে অন্তত এই মিথ্যে জগতের বাসিন্দা তো হতে হতো না।
শেষ পর্যন্ত , আমার আমিটুকুও তো সেরাতে আপনি দখল করে নিয়েছেন। আর কি বাকি ? আর কি?

কেনো করলেন এটা? শুধুই একটা প্রতিশোধের জন্য? শুধুই নিজের ভাইকে সহ্য করতে পারেন না তাই? নাকি নিজের লালসার জন্য?”

আবির সজোরে রাই এর গালে একটা চড় বসিয়ে দিল। রাই কিছুটা সরে গেলো। অঝোরে ওর চোখ থেকে পানি পড়ছে। এই আবির ই কি সে? আজ পর্যন্ত তো ওর গায়ে হাত তোলে নি।তবে আজ?
রাই সোজা হয়ে দাড়াল। কাঁপা কাঁপা গলায় বলল “এখন ,,,,,,, তো…… এটাও সইতেই হবে ।।।।।।। হুম…… সয়ে নিবো।।।।।। অন্তত একটা বার বলে দেখতেন ……. আপনার ….. পায়ে পড়ে……. খো ক্ষমা চেয়ে….. নিতাম”

সাথে সাথে রাই এর আরেক গালে একটা চড় পড়লো। আবির নিজের সর্বশক্তি দিয়ে চড় দিয়েছে। সত্যিই কি এই কথাগুলো ওর শোনার কথা ছিল? এই ধরনের বিষাক্ত কথা ওর সহ্যসীমার বাইরে।
পর যদি আপনাকে খুন করে যায় তাও আপনি সইতে পারবেন। কিন্তু আপনজন যখন অবিশ্বাস করে সেটা কিভাবে সইবেন?

রাই এর মাথাটা ঘুরছে। একেই এতক্ষণ কান্না , তারপর এই অবস্থা। ওর আর সহ্য হলো না। রাই আবিরকে ধাক্কা দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে ছাদ ছেড়ে নিচে চলে গেলো।
আবির রাগের মাথায় দেওয়ালে দুটো ঘুষি দিলো। ওর মাথা কাজ করছে না। দেওয়ালে মাথা ঠেকিয়ে কিছু একটা ভাবলো।
আবিরের চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে উঠলো। ও ঘুরেই দ্রুতবেগে সিড়ি দিয়ে নিচে নেমে গেলো।

গাড়িতে উঠেই সর্বোচ্চ গতিতে গাড়ি চালানো শুরু করলো । আর শুধু রাই এর কথাগুলোই কানে বাজছিল।
আবিরের চোখের সামনে ভেসে উঠলো একটা দৃশ্য ______________

অতীতে…………………

সেদিন মিহিরের বাড়িতে আবির নিশান এর ঘরের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলো , তখনি ওর কানে কিছু কথা ভেসে এলো।
আবির অনিচ্ছাসত্ত্বেও ভালো করে শোনার জন্য নিশানের ঘরের দিকে তাকালো । ভেতরে নিশান দাড়িয়ে কারো সাথে কথা বলছিল।

“কিসের টাকা? তুমি তো এখনও আমার কাজটাই শেষ করনি। আবার কিসের টাকা?”

…………………..

“ওহ হ্যালো…… তোমাকে আমি আরো ২ মাস আগেই বলেছিলাম , আবির ভাই এর কাছে যাওয়ার মিথ্যে নাটক করো। আর সেই ছবিগুলো ফাঁস করে দাও। তুমি এখনও…. মানে এখনও পর্যন্ত এই কাজটাই করতে পারোনি। আবার টাকা!” রেগে গেলো নিশান।

আবির চরম অবাক। নিশান কাকে বলছে এটা? নিশান আবারো বললো “কখনো যেনো আমাকে ফোন করতে না দেখি” বলে ফোন কেটে দিল। আর খাটে বসে পড়লো।

“এর আগের বারও ওই মেয়েটা এই কাজটা করতে পারেনি। আর এইবারের এইটা তো শুরুই করেনি। উফফ….. আবির ভাই কে কোনোভাবেই সরানো যাচ্ছে না ব্যবসা থেকে। কোনোভাবেই না”

আবির এর সব এ টু জেড সব ক্লিয়ার হয়ে গেল। ওর আর বুঝতে বাকি রইলো না যে ১ বছর আগেও একটা মেয়ে ওর নামে মিথ্যে গুজব ছড়িয়েছিলো। ওর চরিত্রহীন হওয়ার। কিন্তু সেবারের মেয়ে টাকে আবির খুব ভালোমতই শিক্ষা দিয়েছিল নিজের মিথ্যে বলার। আর তখন থেকেই আবিরের কোনো মেয়েকে সহ্য হইনা। এবারেও নিশান একই কাজ করছিল! এটা জেনে যতটা না ধাক্কা লেগেছে তার থেকে বেশি আবিরের ঘৃণা হচ্ছে নিশানের মতো ভাই পেঁয়ে।

______________________বর্তমানে

আবির গাড়ি চালাচ্ছে।
“এই একটা কারণেই তোমাকেও (রাই কে) আমার শুরুতে সহ্য হতো না। ভাবতাম সব মেয়েরাই এমন খারাপ। কিন্তু……”

গাড়িটা ডান দিকে মোচড় দিলো ।
নিশান যে কতগুলো মেয়ের সাথে সম্পর্ক করেছে সেটা আবির এর মিহির বাদে কেউ জানেনা। ওর স্বভাব ব্যবহার আবিরের এতটাই পরিচিত যে রীতিমত ওকে না পছন্দ করার অনেক কারণ আছে সবার। যার জন্য এই কথাটা নিশানের মুখে জানার পরই আবিরের একটা ধারণা বদলে যায়, যে রাই ও আবিরের মতই।

নিশান একটা বারে , মদের নেশায় মক্ত। পুরো বারে শুধু বড়লকদের নেশাখোর ছেলেমেয়েরা । কার গায়ের ওপরে কে পড়ছে। কে কোনদিকে যাচ্ছে কোনো খেয়াল নেই। নিশান একগ্লাস মদ সাবার করে যেই না পেছনে ঘুরতে গেলো কেউ ওর গালে সজোরে চড় মারলো। আর ওর টিশার্ট এর কলার চেপে ধরে টেনে নিয়ে ফ্লোরে ছুড়ে মারলো। নিশান কিছু বুঝবে তার আগেই ওকে বেধরে কেউ মারতে লাগলো। বারের গান বাজনা বন্ধ হয়ে গেলো। সবাই নিজের দৃষ্টি এই দৃশ্যে কেন্দ্রীভূত করলো।

একটা পর্যায়ে গিয়ে নিশান নিজেকে বাঁচিয়ে ঢুলতে ঢুলতে একদিকে চেপে চিৎকার করে উঠলো “কেহ.?? কে”

আবির দাড়িয়ে। চোখে মুখে এমন হিংস্রতা, এমন এক আগুন যা সহজেই কাওকে ঝলসে দিতে পারে। এই মুহূর্তে ওর পথে কেউ আসা মানেই প্রাণ হারানো। নিশান ঢুলতে ঢুলতে বললো “ভাই….. তুই!”

আবির এক ছুটে গিয়ে আবারো নিশানকে টেনে মারতে যাবে নিশান ভয় পেয়ে গেল “ভাই ভাই ভাই….. মারবি না প্লিজ প্লিজ …….” আবির ওকে ধরে আবারো মাটিতে ছুড়ে ফেললো।

নিশান মুখ থুবড়ে পড়ল “ভাই…… বলবি তো কি হয়েছে?”

মুখে বলে যদি নিজের মধ্যকার আগুন মেটানো যেত সেটা আবির আগেই করে নিত। কিন্তু তা সম্ভব না।

“ভাই….. বলবি?”

আবির আস্তে আস্তে গিয়ে নিশানের পাশে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো …
গলাটা চেপে ধরে ক্রোধান্বিত স্বরে বলল
“কাপুরুষ শব্দটা ও তোর সাথে যায়না। নিকৃষ্টের সীমাটুকুতেও নেই তুই। ”

নিশানের দম আটকে আসছে “ওহ তাই নাকি ব্রো? আমি?”
বলে আবিরকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে কাশতে কাশতে উঠে দাড়ালো নিশান। সাথে আবির ও । নিশান গর্জন করে উঠলো

“নিকৃষ্ট! হাহ, ভাইয়ের প্রেমিকার সাথে ঘর আমি বাধি নি। আর না মিথ্যে ষড়যন্ত্র করে কাওকে হাতিয়ে নিয়েছি। আর না অন্য কারো লাভ ওয়ান্স কে নিজের সম্পত্তির মত করে আত্মসাৎ করেছি….. তাহলে?”

আবির এর রাগ তুঙ্গে। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা মনে এখন ধ্বংস।
আবির গিয়ে নিশানের গলা চেপে ধরে দেওয়ালের সাথে ধাক্কা দিলো,

“অগণিত মেয়েদের সাথে সম্পর্ক করা, নিজের ভাইয়ের ফিয়নসে এর সাথে অবৈধ সম্পর্ক , ভাই কে ক্যারেকটারলেস বানানোর চেষ্টা। একবার না…… তার ওপর (গলা আরো শক্ত করে চেপে) রাই এর ওপরে নজর……”

নিশান কোনোভাবে ধাক্কা দিয়ে আবিরকে নিজের থেকে সরিয়ে নিলো “হ্যাঁ….. ছি ছিলাম খারাপ। এইসব করেছি। করতে চেয়েছি। রাই এর দিকেও নজর দিয়েছি। হ্যাঁ আমি খারাপ।
কিন্তু কি জানিস তো…… জীবনের এই প্রথম নিশান …. এই প্লেবয় নিশান চৌধুরী কারো প্রেমে পাগল হয়েছিল , অজান্তেই। কিন্তু হয়েছি। আমি রাই কে শুরু থেকেই ভালবাসতাম। বুঝতেই যেটুকু দেরি হয়ে গেছে। ”

আবির তাচ্ছিল্যের স্বরে বলল “ভালোবাসা! ”

“হ্যাঁ ভালোবাসি ” গর্জে উঠল নিশান “প্রচণ্ড ভালোবাসি। ওকে হারানোর পর বুঝেছি আমি ওকে কতটা ভালোবাসি। সেদিন শুধু মাত্র তোর ম্যানিপুলেশন এর জন্যই আমি কাওকে বলতে পারিনি আমি ওকে কতটা ভালোবাসি। ”

দুজনের মনে ভেসে উঠলো সেদিনকার ঘটনা______________

মিহিরের বাবা সবাইকে রাই এর নামে যা ইচ্ছে তাই বলছে। পুরনো ধারণার মানুষ । স্বাভাবিক উনি বিষয়টা উল্টোভাবে নিয়েছেন। না বুঝেই। কিন্তু যেটা ঘটেছে সেটাকেও অস্বীকার করা যায়না। নিশানের এসব কথা সহ্য হচ্ছিল না। যদিও ও রাই কে ভালোবাসে না বলে ওর ধারণা। কিন্তু কথাগুলো ওর নিজেরই বিচ্ছিরি লাগছে।

ওদিকে আবির মিহিরদের বাড়িতে নিজের ঘরে বসে ছিল। তখনি সৌরভের ফোন এলো।

“হ্যালো ভাই…..”

“হুম , বল”

“ভাই….. আসলে….”

“কথা বলার পাসপোর্ট লাগবে তোর?”

“হেহ না ভাই। আসলে খবরটা….”

“……” আবির শোনার অপেক্ষায়

সৌরভ খুব দ্বিধাবোধ নিয়েই বললো “হ্যা ভাই। আমি ক্রস চেক করেছি। সেদিন হোটেলে নিশানের সাথে নীলা ও ছিলো। ওদের ছবি সবাই কনফার্ম করেছে”

আবির এর হাতে আর কিছুই থাকলো না। বাকা হাসলো “আর যদি খবরটা ভুল হয়? ”

“আমার গলা আপনার গুলি”

আবির ফোনটা কেটে দিলো। এইবারে আর আবির মস্তিষ্কের কথায় মনকে হারতে দিতে চায়না। ও বেরিয়ে গেলো সুরাইয়ার বাড়ির উদ্দেশ্যে।

ওদিকে নিশান যখন কিছু বলতে যাবে ঠিক তখনই বাড়ির বাইরে গাড়ির হর্ণ।
সবাই জানালা ভেদ করে বাহিরে তাকালো। আবির গাড়ি থেকে বেরিয়ে এই বাড়ির দিকেই আসছে। সবাই মোটামুটি অবাক ছিলো।

আবির ভেতরে এসে এই অবস্থা দেখে সত্যিই অবাক ছিলো। ও তো ভেবেছিল নিশানকে এনে শাস্তি দিবে, কিন্তু যখন মিহিরের বাবার মুখে সেই রাতের কথা শুনলো। তখন আবিরের মাথাটা জাস্ট হ্যাং হয়ে গেল। ও খুব কষ্টে নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করেছিল সেদিন। আর কোনো প্রস্তুতি বাদেই রাই এর সাথে নিজের সম্পর্কের কথা বলে ফেলেছিল।

আর নিশান কে টেনে অন্যত্রে নিয়ে গিয়েছিল “তোর বিদেশ যাওয়ার ভিসা রেডি। আগামী তিনমাসের মধ্যেই যাবি”

“কিন্তু ভাই …..”

“রাই এর সাথে তোর কি হয়েছে না হয়েছে সেটা গুরুত্বপূর্ণ না। আর তোর নিজের সপ্ন , বিদেশ যাওয়া ইত্যাদির মাঝে নিশ্চই তৃতীয় কেউ নেই বলে বাবা জানে। আশা করি সুযোগের সদ্যব্যবহার তোর জানা আছে। ”

নিশান সেই মুহূর্তে অনেকটাই বিভ্রমে পড়ে যায়। হ্যাঁ আউট অফ কান্ট্রি ওর সপ্ন, কিন্তু রাই কে ও ও নিজে ভালোবাসে না। সেক্ষেত্রে তো ওর এই সম্পর্কে চিন্তা করার কিছুই নেই। তাহলে? তবুও নিশানের মনে একটা খচখচ রয়েই যাচ্ছে।

আবির সেখান থেকে বেরিয়ে গেলো , ওদিকে রাই ততক্ষণে এসে গিয়েছে। আর বাহিরের হট্টগোলে নিশান ও বেরিয়ে গেলো।

_______________বর্তমানে

নিশান এর চোখে পানি “আমার অজান্তেই আমি আমার ভালোবাসার মানুষটাকে হারিয়েছি। শুধু তোর জন্য। নাহলে আজ রাই আমার কাছে থাকতো। হ্যা দেরিতে হলেও বুঝতে পেরেছি , আমি কাকে হারিয়েছি। শুধু তোর কথার জালে । হ্যা আমার ভুল স্বীকার করে আমি ক্ষমা চাইতাম কিন্তু সেই সুযোগটুকু ও শেষমেষ আমার রইলো না।
হেহ…. আর কি? কি বলছিলি তোর ফিয়ন্সে? ওর থেকে চরিত্রহীন এই দুনিয়ায় কেউ নেই। আমি ওকে অফার করিনি…. ও নিজেই এসেছিল। হ্যা নিজেই। তবে ওর মতো মেয়ের গায়ে হাত দিতেও আমার ঘিন্না হয়। ব্রো ব্রো, যতই রিলেশন করিনা কেনো জীবনে কেউ বলতে পারবে না ওদের সাথে রাত পার করেছি।
আর তোর টা! ” হেসে উঠলো নিশান “ওর থেকে মার্কামারা বোকা আর দ্বিতীয় কেউ নেই। রুমে ঢুকে নেশাপানি করেই ফিট….. (আবারো হাসলো নিশান। অট্টহাসিতে) ওকে ছুবে এই নিশান? হেহ…. আমার লেভেল এ পড়ে ওর মতো মেয়ে !?”

আবির এর রাগ কমে নি এক শতাংশ । এইসব বেকার কথায় আবিরের কিচ্ছু যায় আসেনা “এতই ভালো তুই? তাহলে নিজের পাপ নিজ মুখে স্বীকার করতে কোথায় বাঁধলো?”

নিশান রেগে তাকালো “বাঁধবে না? তুই আমাকে রাই এর কাছ থেকে দুর করেছিস। তুই……. আর কেউ না। তো নে, তোর সুখের সংসার….. ওহ সরি রাই তো তোকে শুরু থেকেই ঘৃণাই করতো। এখন নাহয় আরেকটু বেড়ে গেলো সে মাত্রা…..”

আবির নিজের জিন্সের পকেটে দুহাত গুজে নিশানের কাছে এগোলো। ওর ঠিক মুখ বরাবর দাড়ালো আবির

“ঘৃণা থেকে ভালোবাসা……. পথটার মতো অসম্ভব আর কোনো কিছুই হতে পারে না।
তুই ওর পছন্দ কেও নিজের করতে পারিস নি।
আমি ওর ঘৃণাটুকু কেও নিজের নামে করে নিয়েছি।
ভালোবাসা লাগবে না।
কিন্তু ওর গায়ে লেখা প্রতিটি স্পর্শে এই ঘৃণা নামক আবিরেরই অস্তিত্ব , খুঁজে পাবি। (কণ্ঠস্বর নিচু করে) বারংবার”

নিশান এর যেনো অস্তিত্বটাই মিটে গেলো। বিলুপ্ত হয়ে গেলো ওর ভালোবাসার অনুভূতি। এর থেকে জঘন্য কেউ মৃত্যুকেও বলবে না।

চলবে……………🖤🖤🖤🖤🖤