My First Crush part-3+4

0
250

#My_First_Crush
#পর্ব-০৩
Writer: ইশরাত জাহান সুপ্তি

প্রত্যেকটা মেয়ের কাছেই বিয়ে একটা অর্থ বহুল অনুভূতি প্রকাশ করে। ছোটবেলায় ঘোড়ায় চড়া রাজপুত্রের গল্প শুনিয়েই আমাদের মনে একটি স্বপ্নের বীজ বুনে দেওয়া হয়। যার ভাব তখন প্রকাশিত না হলেও আস্তে আস্তে বীজটি অঙ্কুরিত হয়ে তার ডালপালা ছড়াতে ছড়াতে বড় হয়ে আমাদের জীবনের একটা বিরাট অংশকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে। যার প্রভাব থেকে যায় বাকিটা জীবন জুড়েই। প্রতিটা মেয়েই বিয়ের মাধ্যমে একটা বিশ্বস্ত হাত চায়। যে তাকে সম্মান করবে, সবসময় তার পাশে থাকবে, তাকে ভালোবাসবে। তার জীবনের রাজকুমার হয়ে উঠবে। হয়তো এ কারণেই বিয়ের দিন একধরনের উৎকণ্ঠা, ব্যাকুলতা তার মধ্যে কাজ করে। আর থাকে স্বপ্ন পূরণের আকাঙ্ক্ষায় লুকায়িত একধরণের চাপা খুশি। আমিও আমার বিয়ে নিয়ে অনেক খুশি। কারণ আমি তাকেই পেতে চলেছি যাকে নিয়ে এতোদিন কল্পিত সুতোয় গল্প গেঁথেছি আমি। বিয়ের জন্য আমাকে যখন রাইয়ানের দাদীমার দেওয়া গোলাপি বেনারসি শাড়িটা গায়ে জড়িয়ে আয়নার সামনে সাজানো হচ্ছিল তখন আমার মনে হচ্ছিল আমার সামনে বুঝি বসে আছে চৌদ্দ বছরের হৃদি নামের কিশোরী মেয়েটা। মেয়েটা মুগ্ধ হয়ে আমাকে দেখছে। কারণ আমি রাইয়ানের বউ হবার জন্যই সাজছি। সেই রাইয়ান, যাকে প্রথম দেখায় এক মুহুর্তের জন্য পৃথিবী অন্যরকম ভাবে থমকে গিয়েছিল তার। সেই সাড়ে আট বছর আগে তাকে আমার প্রথম দেখা, এই সাড়ে আট বছর ধরে তাকে লুকিয়ে লুকিয়ে ভালোবেসে যাওয়া, আর আজ অবশেষে তার সাথে আমার বিয়ে হওয়া সবকিছু যেন একটা স্বপ্নের মতো বলেই মনে হচ্ছে আমার। বিশেষ করে বিগত কয়েকদিন, বিয়ের প্রস্তাব পাওয়া থেকে বিয়ের দিন পর্যন্ত দিনগুলো এতো দ্রুত কাটছে যে আমি ঠাওর করতে পারছি না। এর মাঝে একদিন আমার রাইয়ানের সাথে কথা হয়েছে। কথা বলতে ঐ একটু হাই হ্যালো। রাইয়ানের দাদীমাও ছিলেন পাশে। হয়তো একারণেই কথা বেশি বাড়েনি। আর আমি তো জানিই রাইয়ান একটু কম কথাই বলে। আমি সেদিন খুব হাসিখুশি ছিলাম। হয়তো রাইয়ানও ছিল। আসলে তার মুখ দেখে মনের ভাব বোঝা একটু শক্ত।

আমাকে সাজানো হলে রাইয়ানদের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হলো। বিয়ের আয়োজনটা সেখানেই করা হয়েছে। খুব বড় আনুষ্ঠানিকতা করা হচ্ছে না। ঘরোয়া ভাবেই বিয়েটা হচ্ছে। এটা রাইয়ানের ইচ্ছা। সে এই মুহুর্তে কাজের চাপের কারণে বড় আয়োজনের মধ্যে যেতে চাচ্ছে না। তবে দাদীমা বলেছেন, রাইয়ানের ব্যস্ততা কমলে দেরিতে হলেও তিনি এই বিয়ের একটা বড় করে রিসিপশন করবেন। আপাতত আমাদের ঘনিষ্ঠ কিছু বন্ধু আর নেইবারদের নিয়েই বিয়েটা সম্পন্ন হবে। যাই হোক, অনুষ্ঠান বড় করে হলো নাকি ছোট করে এসব নিয়ে আমার কোন মাথাব্যথা নেই। আমি তো রাইয়ানকে বিয়ে করতে পেরেই খুশি। রাইয়ানদের পুরো বাড়িটা সাদা ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে। ফুলের শুভ্র রঙে সম্পূর্ণ বাড়িটা যেন আজ বহন করছে পবিত্রতার প্রতিফলক। বাতাসে অন্য রকম সুভাস ছড়িয়ে আছে। কিছু আত্মীয় স্বজনের হাসিমুখে তাকানো সতেজ করে রেখেছে পরিবেশটাকে। দাদীমা আমাকে দেখে এগিয়ে এসে একবার পা থেকে মাথা পর্যন্ত গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, ‘বাহ! তোমাকে শাড়িতে খুব সুন্দর লাগছে।’
আমার পাশ থেকে বৃদ্ধ মিসেস পিটারও দাদীমার কথায় সমর্থন করলেন। আমি এর আগে কখনো শাড়ি পরিনি। আজই প্রথম। দাদীমার প্রশংসায় কিঞ্চিৎ লাজুক হয়ে উঠলো আমার মুখ। আমাকে নিয়ে বাড়ির মাঝখানটিতে রাখা সোফায় বসানো হলো। আমি আড়চোখে একবার চারপাশে চোখ বুলিয়ে নিলাম। যাকে দেখার আকাঙ্ক্ষায় দৃষ্টি ঘুরলো সে আসলো কিছুক্ষণ পর। সাদা শার্টের উপর অ্যাশ রঙের ব্লেজার স্যুটে তাকে কি দারুণই না মানিয়েছে! রাইয়ান যখন এসে আমার ডান পাশে বসলো….মনে হচ্ছিলো হৃদয়ে একশো এক রঙিন প্রজাপতি তাদের ডানা মেলে দিলো। সোফায় বসে একবার আমার দিকে তাকালো সে। আমিও তার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে ঠোঁটে হাসি আঁকলাম। সে দৃষ্টি ঘুরিয়ে চারপাশ দেখতে লাগলো। মিসেস পিটার বললেন,
‘রাইয়ান কি তোমার অ্যাপার্টমেন্ট থেকে এলে?’
রাইয়ান আস্তে করে মাথা নেড়ে বলল, ‘হুম।’
ওহ! একটা কথা বলতে তো ভুলেই গেছি। আজ চার মাস হলো অফিসের সুবিধার জন্য রাইয়ান তার নিজের কেনা অ্যাপার্টমেন্টে শিফট করেছে। এর জন্য আমার কতো অসুবিধা হয়েছে! প্রতিদিন তাকে দেখতে পারিনি। জগিংয়ে যেতে পারিনি। দেখতে পেতাম শুধু প্রতি উইকেন্ডের সময়। যখন সে দাদীমার সাথে দেখা করতে আসতো। তবে এখন আর অসুবিধা নেই। কারণ এখন আমিও তো রাইয়ানের সাথে তার অ্যাপার্টমেন্টেই থাকবো।

বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হলো। খানিকবাদে আমাদের এক নেইবার মিস স্যামান ওয়েডিং রিং এর কথা তুললেন। দাদীমা রাইয়ানের দিকে ঝুঁকে বললেন, ‘আংটি এনেছিস?’
রাইয়ান পকেট থেকে একটা নীল রঙের আংটির বাক্স বের করে দাদীমাকে খুলে দেখালেন। সেখানে দেখা গেলো স্বর্ণের কারুকার্য খচিত একটি আংটি। দাদীমা রাইয়ানের কাঁধে একটা চাপর দিয়ে আস্তে আস্তে বললেন, ‘হীরার একটা আংটি আনতে পারলে না?’
রাইয়ান মুখ ফুলিয়ে বলল,
‘আমি এখন গরিব। আমার টাকা সঞ্চয় করা দরকার।’
দাদীমা আবারও রাইয়ানের কাঁধে একটা বারি দিয়ে আশেপাশে তাকিয়ে সৌজন্যতা মূলক হাসি দিলেন। তারপর এলো সেই সময় যখন আমার চারপাশে ভেসে উঠলো রংধনুর সবকটা রং। আংটির বাক্স থেকে আংটি বের করে আমার আঙ্গুলে পরিয়ে দিলো রাইয়ান। আমি আবেগি চোখে তার দিকে তাকালাম। সেই মুহুর্তে পৃথিবীর সবটুকু আনন্দ, সবটুকু সুখ আমার হাতের সেই মধ্যমা আঙ্গুলটিতে জমা হলো। একে একে সব রীতি শেষ হলে সবার পরে আমাদের সামনে বিয়ের রেজিষ্ট্রি পেপার রাখা হলো। প্রথমে দেওয়া হলো রাইয়ানের সামনে। হাতে কলমটি নিয়ে কিছুক্ষণ নাড়াচাড়া করে সে তাকালো দাদীমার দিকে। তারপর নিজের সিগনেচার দেওয়ার পর আমার দিকে রেজিষ্ট্রি পেপার আস্তে করে ঠেলে দিলো সে। কলমটি হাতে নিয়ে আমি একবার জোরে দম নিলাম। তারপর এক নিঃশ্বাসে সিগনেচার করে দিলাম। কাজী সাহেব স্পষ্ট গলায় বললেন, ‘আপনারা দুজন এখন থেকে স্বামী স্ত্রী।’
আমি ঝট করে উঠে দাঁড়ালাম। সবাই অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালো। রাইয়ানও। আমার পাশে যেই মধ্য বয়স্ক ইংরেজ মহিলা দাঁড়িয়ে ছিলেন আমি তাকে দম আটকে রাখা অবস্থার মতো আস্তে করে বললাম, ‘আমি ওয়াশরুমে যাবো।’
তিনি ফিসফিস করে আমার কানে বললেন, ‘তোমার মাত্রই বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে। এখনই যাবে! হোল্ড করতে পারবে না?’

আমি ইঞ্জিনের মতো দ্রুত মাথা নাড়ালাম। তিনি আমাকে ওয়াশরুমের রাস্তা দেখিয়ে দিলেন। ওয়াশরুমে ঢুকেই আমি দ্রুত দরজা বন্ধ করে সেভাবেই দরজার সাথে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। এতক্ষণে আটকে রাখা দম ছাড়া পেতেই আমার বুক দ্রুত ধড়ফড় করতে লাগলো। হঠাৎ আমার চোখ পড়লো ওয়াশরুমের আয়নার উপর। তার সামনে দাঁড়িয়ে আমি দু হাত মুখে চেপে ধরলাম। আমার সাড়ে আট বছরের ভালোবাসার মানুষটির সাথে আমার এই, এই মাত্রই বিয়ে হলো! আমার জীবনের ফার্স্ট ক্রাশ এখন আমার…স্বামী!
আয়নায় আমার হাতের বিয়ের আংটি টা মনে হলো যেনো একটা ঝিলিক দিয়ে উঠলো। আংটি ধরেই আমি হঠাৎ তীব্র উত্তেজনায় ফেটে পড়লাম। দু হাত মুঠো করে বিশ্বকাপ জেতার ন্যায় ইয়েস! ইয়েস! করে লাফাতে লাগলাম। হাসি ফুটে ঠোঁট প্রশস্ত হতে হতে চেহারা অতিক্রম করে বেড়িয়ে যাবার উপক্রম হলো। আমি লাফাতে লাগলাম। নাচতে লাগলাম। হাত পা নেড়ে চাপা আনন্দের সুর করতে লাগলাম। উল্লাসে যেনো আমি ফেটে যাবার মতো অবস্থা। আমি আবারো আমার হাতের আংটির দিকে তাকালাম। এটা আমার বিয়ের স্বীকৃতি, অ্যান্ড….ইট লুকস লাইক মাই লাইফ’স বিগগেস্ট এচিভমেন্ট।

নিজেকে ধাতস্থ করে কিছুক্ষণ পর বের হতেই দেখলাম একজন বৃদ্ধ মহিলা দরজার সামনে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। আমি বের হতেই একবার ওয়াশরুমের ভেতরে দৃষ্টি বুলিয়ে পুনরায় আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন তিনি। আমি শান্ত মেয়েটির মতো চেহারায় একটা নির্দোষ ভাব নিয়ে দ্রুত সেখান থেকে কেটে পড়লাম।
________________________________________________

অ্যাপার্টমেন্টের সামনের গার্ডেনে অন্ধকারে একাই দাঁড়িয়েছিল রাইয়ান। বিল্ডিংয়ের ভেতর থেকে আসা সাদা লাইটের আলো ঝোপ গাছগুলোর মধ্যে কিছুটা আলোর আভা এনেছে। রাইয়ানকে একা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এগিয়ে এলো জিশান। একটু আগেই তারা রাইয়ানের নিজের অ্যাপার্টমেন্টে পৌঁছেছে। আজকের জন্য জিশান ছিল ওদের ড্রাইভার। রাইয়ান যখন বুকে হাত গুঁজে নিজের ভাবনায় ব্যস্ত তখন জিশান এসে রাইয়ানের কাঁধে হাত রেখে মজা করার ভঙ্গিমায় বলল,
‘আর কতক্ষণ এখানে দাঁড়িয়ে থাকবি? তোর নিউলি ব্রাইড তোর জন্য অপেক্ষা করছে না?’
রাইয়ান শীতল দৃষ্টিতে জিশানের দিকে তাকাতেই জিশান একটু চেপে যাওয়ার ভাণ ধরলো। তারপর ঠোঁটে হাসি চেপে বলল,
‘বিয়ে হলো মাত্র কোথায় একটু হাসিখুশি থাকবি তা না! মুখটাকে এমন ভালুকের মতো করে রেখেছিস কেন?’ তারপর গলার আওয়াজ একটু নামিয়ে জিশান বলল,
‘কাম অন ব্রো! প্রথমবার কোন মেয়ের সাথে এক ছাদের নিচে থাকতে যাচ্ছিস। ইনজয় ইট!’
কনুই দিয়ে জিশানের পেটে জোরে একটা গুঁতা দিলো রাইয়ান। জিশান পেটে হাত রেখে সেখান থেকে আস্তে আস্তে চলে যেতে লাগলো। রাইয়ান আবারো আগের মতো ঘুরে দাঁড়াতেই জিশান ঝট করে দৌড়ে কানের কাছে এসে বলল,
‘বলা তো যায় না, কখন কি হয়ে যায়?’
রাইয়ান কংক্রিটের একটা বড় টুকরো তুলে জিশানকে মারতে উদ্যত হলো। তার আগেই সেখান থেকে দৌড়ে পালালো জিশান।

একটুপর বাসার ভেতরে ঢুকলো রাইয়ান। নিজের রুমের দিকে উঁকি দিতে দিতে আস্তে আস্তে করে ভেতরে ঢুকলো। ভেতরে ঢুকে দেখে রুম ফাঁকা। বিছানায় কিছু গোলাপ ফুলের পাপড়ি ছিটানো। এটা নিশ্চয়ই জিশান বদমাশটার কাজ। রাইয়ান ভেবেছিল হৃদি আছে ভেতরে। কিন্তু মেয়েটা গেলো কই! ভাবতে ভাবতে পা টিপে টিপে এদিক ওদিক চোখ বুলাতে বুলাতে রাইয়ান বিছানার কাছে চলে এলো। হৃদিকে কোথাও দেখতে না পেয়ে গায়ের ব্লেজারটি খুলে ফেললো রাইয়ান। হঠাৎ রুমের লাইট শর্ট সার্কিটের মতো কাঁপতে লাগতো। আকস্মিকতায় রাইয়ান পেছনে ঘুরতেই হঠাৎ কারো পায়ে বেজে তাকে নিয়ে একসাথে বিছানায় পরে গেলো। তৎক্ষনাৎ লাইট ঠিক হয়ে গেলো। পুরো রুম আলোকিত হতেই রাইয়ান দেখতে পেলো তার উপরেই হৃদি। একে অপরের দিকে তাকিয়ে দুজনেই স্ট্যাচুর মতো হয়ে গেলো কিছুক্ষণের জন্য। রাইয়ানের হুট করে মনে পড়লো জিশানের আজ বলা একটা কথা,

‘এই পৃথিবীতে সবথেকে রিস্কি জিনিসটা হলো একটা ছেলে আর একটা মেয়ের একা একরুমে থাকা।’

আস্তে করে গলা খুক করে উঠলো রাইয়ান। হৃদি তাড়াতাড়ি ওর উপর থেকে সরে যেতেই রাইয়ান গলার টাই ঠিক করতে করতে উঠে বসলো। তারপর বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। চুপচাপ সেভাবেই বসে রইলো হৃদি। রাইয়ান ব্লেজারটি নিয়ে সোফার উপর রাখলো। রুমের পুরো পরিবেশটা যেনো হঠাৎ অস্বস্তি নামক গ্যাসে ভরে গেছে। গলার টাই খুলে ফেললো রাইয়ান আর আড়চোখে বারবার হৃদির দিকে তাকাতে লাগলো। একটা মেয়ের সাথে একা এক রুমে থাকা আসলেই খুব অস্বস্তিকর। ইতস্তত করতে করতে রুমের দরজাটা লাগাতে গিয়েই আবারো মাথার মধ্যে জিশানের বলা কথা বাজতে লাগলো,
‘বলা তো যায় না, কখন কি হয়ে যায়!’
মাথা ঝাঁকিয়ে জিশানের কথা মাথা থেকে বের করার চেষ্টা করলো রাইয়ান। হৃদি অবাক হয়ে রাইয়ানের দিকে তাকিয়ে রইলো। দম বন্ধের মতো বোধ হতে লাগলো রাইয়ানের। শার্টের কলার একটু আলগা করতে করতে আবারো হৃদির দিকে আড়চোখে তাকালো সে। আর যতবারই ওর দিকে চোখ যেতে লাগলো ততবারই অস্বস্তি ঢাকতে গলায় খুক খুক করে শব্দ করতে লাগলো। হৃদি ভাবলো রাইয়ানের বুঝি ঠান্ডা লেগেছে। তাই টেবিলে থাকা ফ্লাক্স থেকে একটা মগে রাইয়ানের বেখেয়ালে তার জন্য গরম পানি ঢেলে নিলো হৃদি। হৃদির দিকে পিঠ ঘুরিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল রাইয়ান। তাই হৃদি যখন গরম পানির মগটি রাইয়ানের কাছে নিয়ে যাবে ঠিক তখনই হঠাৎ সে পেছনে ঘুরে ফেলায় আংশিক বাঁধার মতো পেয়ে রাইয়ান ঝট করে বিছানায় বসে পরে। ফলে খানিক গরম পানি ছিটকে পরে রাইয়ানের বুকে। রাইয়ান শব্দ করে উঠে। তৎক্ষনাৎ বিচলিত হয়ে হৃদি হাত থেকে মগ রেখে ‘সরি, সরি’ বলতে বলতে রাইয়ানের শার্টের বোতাম খুলতে থাকে। রাইয়ান হতভম্ব হয়ে শার্টে হাত রেখে আটকে দ্রুত বলে, ‘কি করছো?’
বুঝতে পেরে হৃদি স্বাভাবিক হয়ে হাত সরিয়ে আবারো বলে, ‘ও! সরি!’
রাইয়ান খুক করে গলায় শব্দ করে বলল, ‘আমি ঠিক আছি। ইটস ওকে।’
তারপর পাশ থেকে বালিশ হাতে নিয়ে ইতস্তত ভঙ্গিতে আস্তে আস্তে সরতে সরতে বলল,
‘আমার আসলে কারো সাথে বেড শেয়ার করার অভ্যাস নেই। তাই আমি বরং সোফায়….
রাইয়ানের কথা শেষ হবার আগেই হৃদি বলে উঠলো, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ সমস্যা নেই। ঠিক আছে। ঠিক আছে।’
রাইয়ান গিয়ে সোফায় বালিশ রেখে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়লো। হৃদিও একটুপর বিছানায় শুয়ে পরে রাইয়ানের দিকে তাকিয়ে রইলো। তার মনে পড়লো এই বাড়িতে আসার আগে দাদীমা তাকে এক কোণায় ডেকে নিয়ে বলেছিল,
‘রাইয়ান ভেতর থেকে একটু চাপা স্বভাবের। নতুন কারো সাথে স্বাভাবিক হতে ওর একটু সময় লাগে। ছোট থেকেই ওঁ এমন। তুমি কিছু মনে করো না। ‘
বৃদ্ধ মানুষটি খুবই ইতস্তত করতে করতে কথাগুলো বলছিল। তার এই অস্বস্তি কাটাতে হৃদি মিষ্টি করে একগাল হেসে বলেছিল,
‘সমস্যা নেই। আমি বুঝতে পারছি।’
হৃদি বাস্তবে ফিরে এলো। সামনে খানিক দূরত্বেই ঘুমন্ত রাইয়ান। হৃদির মুখে হাসি ভেসে উঠলো। দাদীমা তো আর জানেন না হৃদির জন্য এতটুকু দৃশ্যই কত বেশি।

চলবে,

#My_First_Crush
#পর্ব-০৪
Writer: ইশরাত জাহান সুপ্তি

ঘুমের ঘোরেই কিছুটা সুড়সুড়ি বোধ হতে লাগলো রাইয়ানের। মনে হলো তার শরীরের উপর কিছু একটা নড়াচড়া করছে এবং সেটি পেট থেকে ক্রমশ উপরের দিকে উঠে আসছে। মুখের কাছে চলে আসতেই রাইয়ান ঝট করে সেটিকে তুলে উঠে বসলো। দেখলো সেটি একটি বিড়াল। রাইয়ানের ঘুমু ঘুমু বিস্ফোরিত মুখ পানে বিড়ালটি ডেকে উঠলো, ‘মিঁয়াও!’
দ্রুত সেটিকে সোফায় রেখে দিলো রাইয়ান। সোফায় বসে বিড়ালটি রাইয়ানের দিকে তাকিয়ে লেজ নাড়তে লাগলো। বিড়ালটির পুরো শরীর একদম ধবধবে সাদা। গলায় জড়ানো একটা লাল রঙের ফিতা। খুবই কিউট।
তবে যতই কিউট হোক না কেন বিড়াল খুব একটা পছন্দ নয় রাইয়ানের। রাইয়ান ওর শার্ট ধরে দেখে সেখানে বিড়ালের লোমে ভরে গেছে। একটু নাক কুঁচকে বিড়ালের দিকে তাকালো রাইয়ান। দেখলো সে আয়েশি ভঙ্গিতে তার দিকে তাকিয়ে শুধু লেজ নেড়ে চলেছে। একটু ঝুঁকে বিড়ালকে উদ্দেশ্য করে রাইয়ান গলার স্বর নামিয়ে বলতে লাগলো,
‘এই, তুমি ভেতরে আসলে কিভাবে? এভাবে যে কারো বাসায় চলে আসা ভেরি ব্যাড ম্যানার। আমার সোফায় লোম ভরাবে না। নিচে নামো।’
এরপর বিড়ালটিকে তাড়ানোর জন্য রাইয়ান দূর থেকেই হাত নাড়িয়ে হুশ হুশ করে শব্দ করতে লাগলো। বিড়ালটির মধ্যে কোন ভাবান্তর দেখা গেলো না। নিজের শাসন চালিয়ে যেতে লাগলো রাইয়ান। এমন সময় হালকা আকাশি রঙের টপস আর ব্লু জিন্স গায়ে রুমে দৌড়ে এলো হৃদি। বাসার মধ্যে হঠাৎ একটা মেয়েকে দেখে রাইয়ান চকিত স্বরে বলল, ‘তুমি!’
হৃদি অবাক হয়ে তাকালো। পরক্ষণেই রাইয়ানের মনে পড়লো এই বাসায় সে আর এখন সিঙ্গেল নেই। গতকালই তার বিয়ে হয়েছে। এই মেয়েটি তার বউ। মনে পড়তেই নিজেকে ধাতস্থ করলো রাইয়ান। রাইয়ানকে স্বাভাবিক হতে দেখে হৃদিও ঠিক হয়ে সোফার কাছে গিয়ে বিড়ালকে কোলে নিয়ে নরম গলায় বলল, ‘সরি! এটা আমার পোষা বিড়াল।’
রাইয়ান বলল, ‘তোমার বিড়াল?’
হৃদি মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, ‘হুম। সকালে আমার একটা ফ্রেন্ড ড্রপ করে গেছে।’
রাইয়ান সন্দিহান গলায় আস্তে আস্তে প্রশ্ন করলো,
‘ও কি এখন থেকে এখানেই থাকবে?’
হৃদি কাঁচুমাচু স্বরে বলল,
‘আসলে ও আমার সাথেই সবসময় থাকে তাই….
বুঝতে পেরে রাইয়ান জোর করে হাসার চেষ্টা করে বলল, ‘আচ্ছা! তাহলে একটু আমার থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করো। আমার আসলে বিড়ালের লোমে একটু সমস্যা বোধ হয়।’
হৃদি প্রফুল্লিত হয়ে ঝটপট মাথা নেড়ে সায় দিলো। রাইয়ান একটা হাই তুলে এলোমেলো চুলে হাত বুলিয়ে বলল, ‘নাম কি ওর?’
হৃদি হাসিমুখে বলল, ‘মিঁয়ো।’
রাইয়ান অবাক স্বরে বলল, ‘মিঁয়ো?’
ভাবতে লাগলো মিঁয়াও…. মিঁয়ো! তারপর নকল হেসে বলল, ‘খুবই অদ্ভুত নাম।’
হৃদির মুখে আগের মতোই হাসি ফুটেই রইলো। ওদের দিকে তাকিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো রাইয়ান। হৃদি মিঁয়োর গায়ে হাত বুলিয়ে আদুরে গলায় বলল,
‘পারমিশন পেয়ে গেছো মিঁয়ো। চলো তোমাকে আমাদের নতুন বাসা ঘুরে দেখাই।’
________________________________________________

রাইয়ানের বাসায় আজ আমার প্রথমদিন। আমি খুব ভোরেই ঘুম থেকে উঠে বাসা ঘুরে ঘুরে দেখে ফেলেছি। অনেক বড় অ্যাপার্টমেন্ট। তিনটা বেডরুম। একটা স্টাডিরুম। মাঝখানে বড় লিভিং এরিয়া। তার পাশেই কিচেন। কিচেনের সামনের অংশে চারকোনা আকৃতির ছোট ডাইনিং টেবিল বসানো। দুটো বড় বড় বারান্দাও আছে। মেঝের টাইলস থেকে শুরু করে দেয়ালের রং দুটোই ধবধবে সাদা। বাসার ইন্টেরিয়র ডিজাইনে হোয়াইট এবং চারকোল কালারের কম্বিনেশন দেওয়া হয়েছে। ফার্নিচার গুলোর রংও সেই অনুসারেই সিলেক্ট করা। আমার বেশ পছন্দ হয়েছে। মিঁয়োকেও একবার আমি ঘুরিয়ে দেখালাম। মিঁয়োর কথা যদি বলা হয় তা হলো মিঁয়ো আমার সবথেকে কাছের। চার বছর ধরে সে আমার কাছে আছে। বাবা মায়ের মৃত্যুর পর ফাঁকা বাড়িতে আমার একাকীত্বের জীবনে মিঁয়োই আমাকে সবথেকে বেশি সঙ্গ দিয়েছে। আমি ওকে খুব আদর করি। এ বাড়িতে মিঁয়োকে রাখা নিয়ে রাইয়ান আপত্তি করবে কিনা এ নিয়ে আমি কিঞ্চিৎ শঙ্কায় ছিলাম। তবে আমার শঙ্কা দূর করে রাইয়ানও সম্মতি দিয়ে আমার মনকে আরো একবার প্রসন্ন করেছে।

কিছুক্ষণ বাদে রাইয়ান ঘাড় টিপতে টিপতে রুম থেকে বেড়িয়ে এলো। অলক্ষ্যে দৃষ্টি ডাইনিং টেবিলের উপর পড়তেই খানিক অবাক হলো সে। এর কারণ হয়তো টেবিলে পরিপাটি করে সাজিয়ে রাখা বহু পদের সকালের নাস্তা। এ সব কিছু আমি নিজের হাতে বানিয়েছি। দাদীমার থেকে শুনেছিলাম রাইয়ান নাকি বাইরে থেকেই খাবার এনে খায়। এখন যখন আমি আছি রাইয়ানকে আর বাইরের খাবার খেতে দেবো না। এতোদিন আমি তাকে শুধু দূর থেকেই ভালোবেসে গিয়েছি। কাছে গিয়ে তার জন্য কিছু করার সুযোগ পাইনি। এখন যখন পাচ্ছি সেই সুযোগ আমি হাতছাড়া করবো না।

দু হাতে ইশারা করে রাইয়ানকে নাস্তার টেবিলে আমন্ত্রণ জানালাম আমি। রাইয়ান টেবিলের কাছে আসতেই আমি আগে গিয়ে হাসিমুখে তার সামনে চেয়ার টেনে দিলাম। রাইয়ান খেতে বসলো। বিপরীত পাশে গিয়ে তার মুখোমুখি আমিও বসে পড়লাম। রাইয়ান খাওয়া শুরু করলো। আর আমি একটা ব্রেডে বাটার মাখাতে মাখাতে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। খাওয়ায় মগ্ন তাকে দেখতেও কি সুন্দর লাগছে! গায়ে তার সাদা টি শার্ট। ফর্সা মুখটিতে একধরনের সতেজতার আভাস ছড়িয়ে আছে। বোধ হয় এই মাত্রই গোসল সেরে বেরিয়েছে সে। এলোমেলো ভেজা চুল থেকে একটু পর পর টপ টপ করে পানি পরছে। আমি অপলক গভীর নিরীক্ষণের দৃষ্টিতে তার চেহারার প্রতিটা কোণা কোণা দেখতে লাগলাম। ঘন মোটা ভ্রু জোড়া বিশিষ্ট চোখগুলো নামিয়ে সে যখন একটু একটু করে চিকেন রোল খাওয়ায় নিমগ্ন তখন আমি আস্তে করে আমার হাতের বাটার মাখা ব্রেডটি তার দিকে বাড়িয়ে ধরলাম। সে চোখ তুলে আমার দিকে তাকালো। ব্রেড ধরে রাখা আমার হাতটি হঠাৎ ধরে বসলো সে। মিষ্টি করে হেসে উঠলো। বুকের মধ্যে ধকধক করতে লাগলো আমার। সে খানিক উঠে নিজের মুখটি এগিয়ে নিয়ে এসে আমার হাত থেকেই ব্রেড কামড় দিয়ে খেলো। আমি বিগলিত হয়ে তাকিয়ে রইলাম। তারপর সে নিজের চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে আমার পাশের চেয়ারটি টেনে একদম আমার কাছে ঘেঁষে বসলো। আমার চোখের দিকে তাকিয়ে আমার প্লেট থেকে একটা ব্রেড তুলে আমাকে খাইয়ে দিতে এগিয়ে আসতেই হঠাৎ জোরে জোরে ডাকতে লাগলো, ‘হৃদি! হৃদি!’
কল্পনা ভাঙতেই দেখতে পেলাম রাইয়ান অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আর আমি একটা স্টুপিডের মতো এতক্ষণ চোখ বন্ধ করে মুখ হা করেছিলাম। সম্বিৎ ফিরে পেতেই চরম বিব্রত হয়ে আমি ভীষণ চমকে উঠলাম। যার দরুন আমার হাতে লেগে প্লেটের পাশে থাকা স্টিলের চামচটি ঝনঝন শব্দ তুলে টেবিলের নিচে পরে গেলো। নিচু হয়ে বসে সেটিকে দ্রুত তুলে উঠতে গিয়েই টেবিলের সাথে মাথার জোরে একটা বারি খেলাম আমি। রাইয়ানের অবাকের মাত্রা আরো বেড়ে গেলো। মাথা হাত দিয়ে ডলতে ডলতে উঠতেই রাইয়ান বিভ্রান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করলো, ‘তুমি কি ঠিক আছো?’
আমি হাসতে হাসতে বললাম, ‘হ্যাঁ, একদম।’
রাইয়ান আবারো জিজ্ঞেস করলো, ‘শিওর?’
আমি হাসির রেখা আরো বাড়িয়ে মাথা নাড়ালাম। খাওয়া শেষ হওয়ায় রাইয়ান বিভ্রান্ত মুখেই টেবিল ছেড়ে উঠে গেলো। আর আমি চেয়ারে বসে মাথা ডলতে থাকা অবস্থাতেই হাত দিয়ে আবারো দুটো বারি দিয়ে নিজেকে শাসালাম। কখন থেকে কি স্টুপিডের মতো বিহেভ করে যাচ্ছি। না জানি রাইয়ান আমাকে নিয়ে কি ভাবছে!

এই দিনটির কথা যদি খুব বিশেষ ভাবে সংজ্ঞায়িত করতে চাই তাহলে বলতে হয় আমার জীবনের যতগুলো ভালো দিনের সংখ্যা আছে তার মধ্যে আজকের দিনটি একটি। আজ আমি এই প্রথম সকালে ঘুম থেকে উঠে রাইয়ানকে দেখতে পেয়েছি। নিঃসন্দেহে সেই সকালটা আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সকাল। আজই আমি প্রথম রাইয়ানের সাথে একসাথে বসে খাবার খেয়েছি। স্নান শেষে রাইয়ানের স্নিগ্ধ মুখ দেখেছি। নিজের উদ্ভট কর্মকাণ্ড দিয়ে তাকে শুধু বিভ্রান্ত করেছি। অনেকগুলো প্রথম জিনিসের অভিজ্ঞতালব্ধ হয়ে মনে মনে আনন্দিত হয়েছি। এই সবকিছুর অনুভূতিই অন্যরকম। আমার সুখানুভূতির ধারায় এভাবেই আমার সম্পূর্ণ দিনটা কাটে।

এরপর রাত হয়। ডিনার শেষ হবার পর রাইয়ান সোফায় বসে ল্যাপটপে কাজ করছিলো আর আমি বিছানায় হেলান দিয়ে বসে একটা ইংরেজি উপন্যাসের বই পড়ছিলাম। বই হাতে নিয়েছি নামে। আসলে পুরোটা সময় অগোচরে আমার সমস্ত দৃষ্টি রাইয়ানের দিকেই ছিলো। এরপর দেখলাম রাইয়ান ল্যাপটপ রেখে উঠে বাথরুমে গেলো। খানিকবাদে বের হয়ে একটা হাই তুলে আমার পাশ থেকে একটা বালিশ নিয়ে সোফার দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো সে। আমি দ্রুত বিছানা ছেড়ে উঠে তার কাছে গিয়ে বললাম, ‘তুমি বিছানায় গিয়ে ঘুমাও রাইয়ান। আমি এখানে ঘুমাচ্ছি।’
রাইয়ান ঘুম ঘুম চোখে বলল, ‘না ঠিক আছে। আমিই ঘুমাচ্ছি।’
আমি তার হাত থেকে বালিশ টেনে ধরে বললাম,
‘না আমিই ঘুমাবো। আমার সোফায় ঘুমাতেই ভালো লাগে। ইনফ্যাক্ট আমি তো সোফাতেই বেশি ঘুমাই।’
রাইয়ান অবাক স্বরে বলল, ‘সোফায় ঘুমাতে ভালো লাগে?’
আমি বালিশটি পুরোপুরি টেনে বুকে জড়িয়ে ধরে হেসে মাথা নাড়ালাম। রাইয়ান আবারো হাই তুলে পেছনে যেতে যেতে বলল, ‘ওকে।’
বিছানায় গা এলিয়ে চোখ বন্ধ করে শুয়ে পড়লো সে। খানিক বাদে আমি নিঃশব্দে পা টিপে টিপে গিয়ে রুমের লাইট বন্ধ করে দিলাম। এরপর আস্তে আস্তে সাবধানে সোফায় বালিশ রেখে শুয়ে পড়লাম। রাইয়ান নিশ্চয়ই এতক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েছে। তার ঘুমটা শান্তিময় হোক। সকালেই দেখলাম গতরাতে সোফায় ঘুমানোর জন্য তার ঘাড়ে খারাপ লাগছে। এখন নিশ্চয়ই তার একটু ভালো বোধ হচ্ছে!
___________________________________________________

ফ্রোরিডার সকাল ঝলমলে, উজ্জ্বল। বেলা খানিক বাড়তেই ঝকঝকে পিচ ঢালা রাস্তায় শুরু হয়ে গেছে লোকজনের আনাগোনা। উইকেন্ড ছাড়া প্রতিটা সকালই তাদের কাছে ব্যস্তমুখর। এমনই এক ব্যস্তমুখর দিনে গরম ধোঁয়া ওঠা কফির মগ সামনে নিয়ে জেরিন বসে আছে তাদের কফিশপে উদাস মুখে। খানিক বাদে বাদে তার মুখ থেকে গভীর দীর্ঘশ্বাস বেরোচ্ছে। কফিশপ এখন নির্জন। সকালে তাদের খুব একটা তেমন কাস্টমার আসে না। যাই আসে বেশিরভাগ সন্ধ্যের পর। জেরিনের উদাস হওয়ার কারণটা ঠিক সেটা নয়। পুরো কফিশপে শুধুমাত্র একজন যেই কাস্টমারটি আছেন কারণটা আসলে তিনিই। তিনি বলতে তার বৃহদাকার দেহে পরিধিত টি-শার্টটি। যার পেছনে লেখা “ইউ উইল বি অলওয়েজ সিংগেল।” লোকটি বসেছে পেছনে ঘুরে। একদম জেরিনের দিকেই পিঠ বরাবর করে। জেরিনের মনে হলো লেখাটা যেন তাকে উদ্দেশ্য করেই ফুটে আছে। তা নয়তো কি, হৃদিরও বিয়ে হয়ে গেলো। শুধুমাত্র সেই একমাত্র সিঙ্গেলের ট্যাগ ধারণ করে বসে আছে। এমন নয় যে সে কখনো রিলেশনশিপে যায় নি। কিছুদিন আগেই তার ব্রেকআপ হয়েছে। এক্সের কথা মনে পড়তেই জেরিন বিড়বিড় করে একটা গালি আওড়ালো। ঐ লম্পটটার জন্য মন খারাপের কোন মানেই হয় না। একসাথে দু নৌকায় পা রাখতে চেয়েছিল। ব্রেকআপের দিন জেরিন ব্যাগে করে একটা ডিম নিয়ে গিয়ে লম্পটটার মুখে ছুঁড়ে মেরে এসেছে। জেরিনের সাথে চালাকি একদমই চলবে না।

জেরিন যখন মনে মনে তার এক্সের চৌদ্দগুষ্ঠি উদ্ধার করতে ব্যস্ত, এমন সময় হৃদি এলো কফিশপে। ঘাড়ে এক হাত রেখে ডলতে ডলতে জেরিনের পাশের চেয়ারে বসে বলল,
‘একটা কফি বানিয়ে খাওয়াতে পারবি জেরিন। ঘাড়টা এমন ব্যাথা করছে না!’
জেরিন নিজের কফির মগটা হৃদির দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘এটা খা। একটু আগেই বানিয়েছি। চুমুকও দেইনি। তোর ঘাড়ে আবার কি হয়েছে?’
প্রশ্নটা করেই জেরিন মুচকি হেসে যখনই একটা দুষ্ট বাক্য যোগ করতে যাবে তার আগেই অন্যমনষ্ক হৃদি কফির মগে চুমুক দিয়েই বলে উঠলো, ‘আর বলিস না, গতরাতে সোফায় ঘুমিয়ে…..
হৃদি থেমে গেলো। তৎক্ষনাৎ উঠে দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে উঠলো জেরিন,
‘কি! হাজবেন্ড থাকতে তুই সোফায় ঘুমাস?’
জেরিনের জোরালো গলার আওয়াজে কফিশপের সেই কাস্টমারটিও পর্যন্ত ঘুরে তাকালো। হৃদি তাড়াতাড়ি জেরিনকে বসিয়ে ফিসফিস করে বলল, ‘আস্তে!’
জেরিন বলল, ‘আগে খুলে বল।’
নিতান্তই কথায় কথায় হৃদির মুখ ফসকে বেরিয়ে এসেছিল। তবুও হৃদি আর কিছু বলতে চাইলো না। কিন্তু জেরিনের জেরার মুখে পরে আর না বলে পারলো না। সবটা শুনে জেরিন বলল,
‘এটা কোন কথা! অভ্যেস নেই বলে এক বিছানায় ঘুমাতে পারবে না। তাই বলে তুই কষ্ট করে সোফায় ঘুমাবি?’
হৃদি মুখে ঈষৎ ‘চ’ সূচক শব্দ করে বলল, ‘রাইয়ান তো আর আমাকে বলেনি সোফায় ঘুমাতে! আমি নিজ ইচ্ছায় ঘুমিয়েছি। তুই একটা জিনিস বুঝতে পারছিস না। রাইয়ান একটু চাপা স্বভাবের। আমি না হয় রাইয়ানকে অনেকদিন ধরে ভালোবাসি, সে তো আর বাসতো না। সে তো হয়তো চিনতোও না আমাকে ঠিকমতো। এখন একদিনেই তো আর নিশ্চয়ই একজনের জন্য ভালোবাসা হয়ে যাবে না! একটু সময় লাগবে। সেই সময়টা দিতে ক্ষতি কি? রাইয়ান তো আর আমার থেকে পালিয়ে যাচ্ছে না। আমরা এখন ম্যারিড। অন্তত, আমার তো কোন সমস্যা নেই।’
জেরিন নিরস গলায় বলল, ‘কি জানি ভাই, আমি অতো বুঝি না।’
জেরিনের মুখের দিকে তাকিয়ে হৃদি স্মিত হেসে উঠলো।

চলবে,