#অথৈ জলের পুষ্পমাল্য
কামরুন নাহার মিশু
১৪)
হঠাৎ সীমার মধ্যে দৃশ্যমান পরিবর্তন দেখে আফসার উদ্দিন দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন।
যত কথাই বলেন, বলতে হয়। সব তো রাগ করেই
বলেন। সীমা, রীমা তো তারই মায়ের পেটের আপন দু’বোন। রীমাকে নিয়ে তিনি দুশ্চিন্তা করেন না। ভালো বর পেয়েছে, ঘর পেয়েছে। যত দুশ্চিন্তা সীমাকে নিয়ে। তার কপালে সংসার জুটল না। বাবা তো দেখে শুনে ভালো ঘর দেখেই বিয়ে দিয়েছিলেন।
বরটা যে এত খারাপ হবে কে জানত! তিনটা মাসও বোনটা সংসার করতে পারেনি।
ভাইয়ের সংসারে, বোনের সংসারে অনেকটা লাথি গুতো খেয়ে অনাদরে অবহেলায় বেঁচে ছিল এতগুলো বছর।
আফসার উদ্দিন কখনো ভাবেননি বোনটার একটা বিয়ে দেয়া দরকার। ভেবেছিলেন বিয়ে তো একটা হয়েছে, এবার বাকি জীবন ভাইয়ের সংসারে বিনা পয়সায় কাজ করে যাবে। এতে ভাইয়েরও একটা কাজের লোক হবে তারও একটা আশ্রয় হবে।
রীমা বিয়ের কথা বলার পর আফসার উদ্দিনের হুশ ফিরে এলো। তিনি নানান জায়গায় সীমার যোগ্যতা অনুযায়ী পাত্রের সন্ধান করলেন।
এর মধ্যে বেশ কয়েকটা প্রস্তাবও এলো।
কিন্তু সীমা নাছোড়বান্দা সে কোনোভাবেই আর বিয়ে করবে না। বিয়ে না করলে থাকবে কোথায়?
রীমা তো স্পষ্ঠ জানিয়ে দিয়েছে, সীমাকে সে আর তার বাসায় নেবে না। এদিকে রাহেলা বেগমও একবেলাও সীমাকে খাওয়াতে রাজি না।
আজ কয়েকদিন সীমা অবশ্য কোনো কিছু খাওয়ার জন্য বায়নাও করছে না।
বিয়েতে অস্বীকৃতি জানানোর পর রাহেলা বেগমের তো আর মুখ বন্ধ নেই। চব্বিশঘন্টা সে বকেই যাচ্ছে। সীমা কোনো কথায় প্রতিবাদ করছে না। কেউ কিছু বললে কেবল ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে।
মনে হচ্ছে কোনো কিছু নিয়ে গভীর চিন্তায় মগ্ন।
আজন্ম স্বামীর ঘরে থাকার স্বপ্ন নিয়ে শ্বশুর বাড়ি গিয়ে তিনমাস পর ফিরে আসার পরও সীমার মধ্যে এত পরিবর্তন দেখা যায়নি। হঠাৎ কী হলো!
রীমার ছেলেটার জন্য হয়তো মন খারাপ লাগছে। আফসার উদ্দিন স্ত্রীকে আড়াল করে একদিন বোনের মুখোমুখি হলেন,
” কী অইছে বইন তোর?”
” কিছু না ভাইজান।”
” আর না করিস না বইন আমার
একটা ভালা প্রস্তাব আছে, তুই রাজি অই যায়। যেভাবে হোক ধার,কর্জ করে আমি তোকে উঠাই দিমু। বাবা থাকলে তোরে এভাবে এতদিন থাকতে অইত না। একটা ব্যাবস্থা বাবা আরও আগে কইরতেন।”
” ভাইজান, এসব চিন্তা বাদ দেন। আমার কিছু ভালা লাগে না। আমি ঢাকা যাইতে চাই।”
” ঢাকা তুই কার কাছে যাবি?”
“লায়লা খালার কাছে যাই কয়দিন থাকি?”
” দাঁড়া, আমি রীমারে সাথে কতা কই দেখি।”
” না, ভাইজান। আল্লাহর দোহাই, আপনে রীমারে এহন কিছু জানাইয়েন না। আমি সুবিধামতো তারে জানামু।””
এদিকে রীমা ভাইয়ের সাথে কল দিয়ে কয়েবার কথা বললেও, রাগ করে একবারও সীমার কথা জানতে চায়নি। আফসার উদ্দিনও বিভিন্ন প্রয়োজনীয় কথা বলার পর সীমার কথা জানাতে রীমাকে ভুলে গেছে।
এদিকে রীমাও অনেকটা নিশ্চিন্তে সংসার করছে। শাওন নিয়ম করে অফিসে যাচ্ছে, নিয়ম করে বাসায় ফিরছে। স্ত্রী, সন্তানকে সময় দিচ্ছে। কোথাও কোনো ফাঁক আছে বলে মনে হচ্ছে না।
এদিকে শর্মিলি আহমেদও ছোট ছেলের ফোন পেয়ে জরুরি ভিত্তিতি কিছুদিনের জন্য গ্রামের বাড়ি গেলেন।
রীমাও সব ফিরে পাওয়ার আনন্দে বেশ নির্ভার ছিল।
বিপত্তিটা বাঁধাল রাজিব। গতকাল হঠাৎ ফোন করে জানতে চাইল,
” মামি তুমি কি গতকাল বসুন্ধরা সিটিতে গিয়েছেলে? রুপাইকে কার কাছে রেখে গেলে?”
” কেন?”
” কাল মনে হয় মামাকে দেখলাম বিকালের দিকে। ”
” তাই না-কি ”
” না আমি ছিলাম না। ভুল দেখেছ মনে হয়। কাল তোমার মামার অফিসে মিটিং ছিল।”
” মামা ছিল আমি নিশ্চিত। আমাদের চোখাচোখিও হয়েছিল। আমি কথা বলতে আসার আগেই হঠাৎ ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে গেলেন।”
” হবে হয়তো। বাদ দাও। তুমি বাসায় আসবে কবে? নানুমনি যাওয়ার পর তো বাসায়ই আসছ না।’
” ব্যস্ত থাকি মামি। আসব একদিন সময় করে।”
” আচ্ছা, শুক্রবারে এসো। তোমার পছন্দের বিরিয়ানি রান্না করব।”
” মামি একটা কথা বলি! আপনি একটু নিশ্চিত হইয়েন মামার সাথে কে ছিল!”
রাজিবের শেষ কথাটায় যেন কিছু একটা ছিল। রীমা স্বস্তি পাচ্ছিল না কোনোভাবেই। শাওন কি সত্যি খারাপ হয়ে গেছে। সে-কি সীমাকে না পেয়ে অন্য নারী নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে!
সীমাতো বাড়িতে। সে ঢাকায় শাওনের সাথে কিভাবে ঘুরে বেড়াবে!
শাওন আজ অফিস থেকে ফেরার পর রীমা রাগ করে আর একটা কথাও বলেনি। এটা রাগ নয়, ঘেন্না। তুমি কাকে সঙ্গে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছ?
শাওন বুঝতে পারেনি হঠাৎ স্ত্রীর রাগের কারণ কি!সে চেঞ্চ করে প্রতিদিনের মতো রুপাইর কাছে এলো। হাতে একটা সফট টয়। রুপাইয়ের জন্য কিনেছে। ছেলেটা এখন বড় হচ্ছে। হামাগুড়ি দিতে শিখেছে। খেলনা চিনে। নতুন নতুন খেলনা দিয়ে খেলতে পছন্দ করে। বাবাকে দেখলে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে।
যদিও রুপাইর সবচেয়ে বেশি পছন্দ জীবন্ত খেলনা তার বাবাকে। বাবাকে কাছে পেলে সে আর কোনো খেলনা ছুঁয়েও দেখে না। বাবার চুল ধরে, নাক ধরে, আঙ্গুল ধরে। হেসে হেসে কি কি যেন সারাক্ষণ বলে।
ছেলের প্রতি উদাসিন শাওনও ছেলের মায়ায় পড়ে গেছে। অফিস থেকে ফিরে চা খেতে খেতে রুপাইর সঙ্গে এক ঘণ্টা খেলা শাওনের রুটিন ওয়ার্ক।
এদিকে রীমাও ছেলেকে বাবার কাছে দিয়ে গৃহস্থালির টুকটাক কাজ সেরে ফেলে।
রীমা রুপাইর পি পরিষ্কার করতে এলে, শাওন রীমার কোমর জড়িয়ে ধরে বলল,
” কী মহারাণীর মুড অফ কেন? আজ কি চা নিজেকেই বানিয়ে নিতে হবে?”
রীমা আস্তে করে কোমর থেকে হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে রান্নাঘর থেকে এককাপ চা এনে শাওনের হাতে ধরিয়ে দিয়ে, মুখে কোনো কথা না বলে চলে যাচ্ছিল।
শাওন খপ করে রীমার হাত ধরে তাকে কোলে বসিয়ে দিল।
” কী হয়েছে? রেগে আছ কেন?”
” শাওন আমি কি দেখতে অসুন্দর? আমাকে দিয়ে কি সত্যি তোমার হচ্ছে না?”
” এটা কেমন কথা রীমা! তুমি আমার সন্তানের মা, আমার সংসারের রাণী। তোমাকে দিয়ে হচ্ছে না। এটা কেমন ভাষা।”
” বলব? শুনতে চাও আমার মুখে?”
” না, আমি কিছু শুনতে চাই না। শুধু বলব, আমাকে ভুল বুঝো না। তুমি আর রুপাই ছাড়া আমার জীবনে সত্য বলতে আর কিছু নেই।”
” শাওন প্লিজ চুপ কর। তোমার মুখ থেকে আর মিথ্যা শুনতে চাই না।”
” শুধু একটা কথাই বলব, আমি মিথ্যা বলছি না। বিশ্বাস, অবিশ্বাস করা তোমার দায়িত্ব।”
” আমাকে ছাড় শাওন। আমি তোমার সাথে তর্ক করতে চাচ্ছি না।”
” না ছাড়ব না।”
বলে শাওন জোর করে রীমাকে বুকে জড়িয়ে ধরল,
” প্লিজ সোনা আমাকে ভুল বুঝো না। আই রিয়েলি লাভ ইউ।”
” তাহলে সত্যি করে বলো, গতকাল বিকালে তোমার সাথে বসুন্ধরা সিটিতে কে ছিল? কাকে শপিং করে দিয়েছ?”
” সব বলব। তবে আজ নয়। আমাকে একটু সময় দিতে হবে। ”
চলবে…..