অথৈ জলের পুষ্পমাল্য পর্ব-১৩

0
302

#অথৈ জলের পুষ্পমাল্য
কামরুন নাহার মিশু

১৩)

সারাটা পথ শাওন রীমার সাথে একটা শব্দ কথাও বলেনি। রীমাও ইচ্ছে করে অন্যমনস্ক হয়ে ছিল।
দেখা যাক শাওন কী করতে চায়! কতক্ষণ চুপ করে থাকতে পারে।

গাড়িতে থেকে নামার আগে শুধু একবার বলেছে,

“সীমা কিন্তু তোমার বোন। তার ভালোটা আমার আগে তোমার ভাবার উচিত ছিল।”

” জানি শাওন। ”

তবে মনে মনে বিড় বিড় করে বলল,

” সীমাপার ভালোটা ভাবার আগে আমার নিজের ভালোটাও ভাবতে হবে। ”

বাসায় ফিরে রীমা স্বাভাবিকভাবে সব কাজ কর্ম করল। মনে হচ্ছে কোথাও কোনো সমস্যা নেই। অফিস টাইমে আগের মতো শাওনকে ফোন করে মায়ের বিভিন্ন প্রয়োজন ও ঘরের জন্য কি কি লাগবে সে ফর্দ দিলো।

বিপত্তি বাধল রাতে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা শাওন ল্যাপটপ নিয়ে টেবিলে বসে আছে। ঘুমাতে যাচ্ছে না বিছানায়। শাওন হয়তো ভেবেছে সারাদিনের কাজের ধকল সামলাতে না পেরে রীমা একসময় ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়বে। তারপর শাওন নিজের সুবিধামতো ঘুমাতে যাবে।

রীমাও ঘরের এটা সেটা কাজ করছে, শাওনের জন্য চা বানিয়ে ফ্ল্যাক্সে ভরে রাখছে। একটা বারও শাওনকে বিছানায় আসার জন্য আহবান করেনি।

এদিকে দশদিন পর স্ত্রীকে কাছে পেয়েও ছেলের বিছানায় যাওয়ার ব্যস্তাতা না দেখে শর্মিলি আহমেদ এসে ঘুমন্ত রুপাইকে কোলে করে নিয়ে গেল।

” রীমা আমার দাদাভাই আজ আমার সাথে ঘুমাইব। আমি রুপাইকে নিয়া গেলাম। ভালো কইরা ডায়াপার পরাই দাও।”

রীমা আপত্তি করল,

” মা রাতেরবেলা যদি খিদায় কাঁন্দে। ”

“আমি চাইর সন্তানের মা। বাচ্চা কাঁনলে কিভাবে থামাইতে অয় আমি জানি। তোমরা ছিলে না, শাওন ঘুমাতে পারেনি। তুমি ওরে একটু সময় দাও।”

শাশুড়ির উপর রীমা দিনদিন কৃতজ্ঞ হয়ে উঠল। তিন বছর আগে মারা যাওয়ার পর রীমা ভেবেছিল হয়তো সে মাতৃস্নেহে ছায়া থেকে চিরতরে বঞ্চিত হয়ে গেছে। কিন্তু না, তার সে ভাবনা মিথ্যা। শর্মিলি আহমেদ রীমার শাশুড়ি কম মা বেশি।
তার নিজের মা বেঁচে থাকলেও হয়তো এভাবে ভাবতে পারত না।

শাওন ল্যাপটপ নিয়ে ব্যস্ত থাকতেই রীমা ওয়াশরুমে গিয়ে নিজেকে ফ্রেশ করল। বিয়ের সময় হানিমুনে গিয়ে কক্সবাজার থেকে কেনা স্কিন প্রিন্টের ক্রীম কালারের নাইটিটা পরল। গত বছর দুবাই থেকে আনা ৪২ সাইজের লাল রঙের ব্রাটা পরে ইচ্ছে করে ফিতা বের করে দিলো।

খোঁপায় পেঁছানো চুলগুলো খুলে ছড়িয়ে দিল পুরো পিঠময়। একটা সময় শাওন এই গভীর কালো চুলের সমুদ্রে নিজেকে হারিয়ে ফেলত। এখন অবশ্য ছেলে হওয়ার পর চুলের ঘনত্ব কিছুটা কমেছে। গতছয়মাস তো চুল ছাড়ার সুযোগই পায়নি। আজ রীমা আরেকবার চেষ্টা করে দেখবে শাওন কতদূর হারিয়ে গেছে! ফেরার কি সত্যি আর কোনো পথ নেই?

রীমা এই সাজ পোশাকে শাওনের সামনে এসে দাঁড়াল। শাওন হঠাৎ এমন মোহনীয় সাজে স্ত্রীকে দেখেও কিছু বলল না। শুধু একবার আড়চোখে তাকাল।

রীমার হঠাৎ খুব কান্না পেল, তুমি আমার স্বামী, আমার সন্তানের পিতা, তোমাকে পটানোর জন্য আমাকে এত আয়োজন কেন করতে হবে?

আমাকে পটানোর জন্য তুমি কখন কী করেছে? রীমার হঠাৎ মনে পড়ল, তাকে পটানোর জন্য শাওন কি না করেছে। গলায় থাকা এই এক ভরি ওজনের চেইনটাও তো একদিন হুট করে রীমেকে সারপ্রাইজ দেয়ার জন্য কিনে এনেছিল।

শাওন যদি সত্যি হারিয়ে যায়, এখানে শাওনের অপরাধ যতটুকু রীমার অবহেলাও ঠিক ততটুকু।
স্বামী -স্ত্রীর সম্পর্ক হচ্ছে একটা স্বচ্ছ আয়নার মতো, প্রতিবেলায় এর যত্ন নিতে হয়। না হয় একসময় দাগ বসে যায়। সে দাগ আর মুছে না।

রীমার আর সহ্য হচ্ছিল না। কিছু না বলে সে আস্তে আগে রুমের লাইট অফ করে দিল।এবার শাওনের সামনে এসে ইচ্ছে করে চুলগুলো শাওনের মুখের কাছে,ছড়িয়ে দিয়ে ল্যাপটপটা অফ করে দিলো।

শাওন হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল,

” এই কি করছ? আমার এখনো কাজ শেষ হয়নি তো!”

রীমা ফিসফিস করে শাওনের কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল,
” কাজ জীবনেও শেষ হয় না। কিন্তু ভালোবাসা শেষ হয়ে যায়, অনাদরে, অবহেলায়। তাই কাজ অসমাপ্ত রেখে হলেও স্ত্রীকে ভালোবাসতে হয়।”

” তাই না-কি!”

” জি, জনাব! একটু দেখবেন, আমার গলার নিচে কী একটা উঠেছে।”

” লাইট জালাও, দেখি কি হয়েছে?”

” নো, এটা লাইট বন্ধ করে দেখতে হয়।”

শাওন সত্যি সত্যি বিছানায় গিয়ে বলল,

” ছেলে একটা বেস্ট ফিডিং করে, গলার নিচে আবার কী উঠেছে! মোবাইলটা দাও তো! টর্চ জালিয়ে দেখি।”

রীমা মোবাইল হাতে নিতেই দেখল বাড়ির নাম্বার থেকে মিস কল। সে সঙ্গে সঙ্গে নাম্বারটা ডিলেট করে দিল। তার বুঝতে মোটেও অসুবিধা হয়নি। শাওনের নাম্বারে বাড়ির নাম্বার থেকে কে কল দিয়েছে?

রোমান্টিক মুডে যে কাজটা শুরু করেছে, সেটায় হঠাৎ ভাটা পড়ে গেল। মোবাইল হাতে নিয়ে রীমা তোতলাতে থাকল,
” ভাইজানের সাথে কি তোমার কথা হয়েছে?”

” আরেহ্! ভাইজান,ফাইজান রাখ। আগে দেখি তোমার গলার নিচে কী হয়েছে!”

রীমাকে চিৎ করে শুইয়ে দিয়ে শাওন গলার নিচের সেই অদেখা কি খুঁজতে, খুঁজতে বেশ খানিকটা নিচে নেমে এলো।
রীমার চোখে দুষ্ট হাসি,

” কী পেয়েছ?”
শাওন মোবাইল অফ করে টেবিলের উপর ছুড়ে মেরে বলল,

” এত সহজে কি খুঁজে পাওয়া যাবে? আরও ভালো করে খুঁজতে হবে তো!”

রীমা এবার শাওনের মুখটা বুকের কাছে এনে চেপে ধরে বলল,
” ভালো করে খুঁজবে কিন্তু, কোথাও যেন কিছু বাদ পড়ে না যায়।”

শাওন রীমাকে উন্মুক্ত করতে করতে বলল,
” তুমি নিশ্চিত থাক, কিছুই বাদ পড়বে না।”

না, রীমা শাওনকে হারিয়ে ফেলেনি, যদি হারিয়েই যেত এত অবলীলায় স্ত্রীর কাছে নিজেকে ধরা দিত না।
আর নয়, রীমা আজ থেকে নিজের সম্পর্কের যত্ন নেবে, যেন কোথাও কোনো ফাঁক না থাকে। সেই ফাঁক দিয়ে যেন কেউ প্রবেশ করতে না পারে।
সবটা ঠিক আছে। শুধু মোবাইলের দিকে তাকালেই রীমার ভয় লাগে। শাওন অফিসে যাওয়ার পর যদি কোনো ফোন আসে!

রীমা ইচ্ছে করে শাওনের মোবাইল হাতে নিয়ে বাড়ির সবগুলো নাম্বার শাওনের মোবাইল থেকে ব্লক করে দিল।
রীমা শাওনকে এমনভাবে আগলে রাখবে,যেন স্ত্রী -সন্তানের ভালোবাসাকে উপেক্ষা করে যেন কোথাও ফোন দেয়ার সুযোগই না পায়। আর কেউ তো ফোন দিতেই পারবে না।

চলবে……