অনুভূতিহীন পর্ব-১৭

0
514

#অনুভূতিহীন (পর্ব ১৭)
#মেহেদী_হাসান_রিয়াদ

মায়ের কোলে মাথা রেখে চুপটি মেরে শুয়ে আছি আমি। না চাইতেও চোখ দিয়ে এক ফোটা জল গড়িয়ে পরলো। মা তার হাতের আঙুল দিয়ে আমার চুলে বিলি কে**টে দিচ্ছে। আমি কাঁদু স্বরে মাকে বললাম,
– আমার সাথেই কেন এমন হলো মা। আমি তো চাইনি এমন টা। এমন টা তো আমার মাথাতেই ছিলো না। কালকে যখন শেষ এক্সাম টা দিতে যাচ্ছিলাম। তখন বাবার মাঝে খুশির কতো উত্তেজনা দেখতে পেয়েছিলাম। আমি এক্সাম দিয়ে বের হওয়ার পর কেমন যেন অদ্ভুত অনুভুতি হচ্ছিলো আমার। এই বুঝি বিদায়ের সময় এসে গেছে। তুমি বাবা আপু সবাইকে ছেরে চলে যাবো ঢাকায়। কিন্তু হুট করে কি হয়ে গেলো আমি নিজেই বুঝতে পারিনি। ওখানে যতক্ষন বসে ছিলাম, এক মুহুর্তের জন্য হলেও আমার মনে হয়েছিলো, তোমাদের আর দেখতে পাবো না। রিদ ভাইয়ার মুখটা বার বার ভেষে উঠছিলো। এমন টা কেন হলো বলতে পারো মা?
মা আমার চুলে বিলি কা**টতে কা**টতে বললো,
– কিছুই হয় নি। ভেবে নে ওটা একটা দুঃস্বপ্ন। দুঃস্বপ্ন দেখার পর সকালে উঠলে যেমন অনুভূতি হয় ওটা অনুভব কর।
আমি কেঁদে মাকে জড়িয়ে ধরে বললাম,
– এমনটা চাইলেও পারছি না মা। ওনার কাছে গেলেই লজ্জায় ও আত্ম সম্মানের কথা ভাবতেই মাথা নিচু হয়ে আসে আমার।
– এগুলো মাত্রই তোর মনের ধারণা। মাথা থেকে ঝেড়ে ফেল ওসব।
– মা জানো ঢাকায় ওদের অনেক নাম ডাক। খবর টা ওখানে জানাজানি হয়ে গেলে ওদের মান সম্মান টা কোথায় যাবে বুঝতে পারছো মা।
মা আর কিছু না বলে চুপচাপ আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।
,
,
কথা ছিলো এক্সামের পর বড় করে অনুষ্ঠান করে আমায় এখান থেকে নিয়ে যাবে। কিন্তু পরিস্থিতির চাপে তা আর হচ্ছে না। আমাকে আর এক মুহুর্তের জন্যও এখানে রেখে যেতে চায় না সে। আজ বিকেলেই ওদের সাথে নিয়ে যাবে আমাকে। ওখানে একটা পার্টির আয়োজন করে রিলেটিভ সবাইকে জানিয়ে দিবে।

সোফায় বসে ফোন টিপছিলো রিদ ভাইয়া। আমি দরজার পাশে দাড়িয়ে তার দিকে কিছুক্ষন চেয়ে রইলাম। আমাকে দেখেই ডাক দিলো সে। আমি বিষণ্ন মনে তার পাশে গিয়ে দাড়ালাম। একটা আবদার আছে তার কাছে।
সে আমার এক হাত ধরে টেনে তার কোলে বসিয়ে নিলো। গাল টেনে বললো,
– কি ব্যাপার গত কাল থেকে এবাবে লুকিয়ে লুকিয়ে আছো কেন? এমন ভাব দেখাচ্ছে মনে হয় আমাকে আজ প্রথম দেখছো।
এভাবে কোলে বসিয়ে গাল টেনে দেওয়াটা একটু অপমান জনক মনে হলো আমার কাছে। সাধারণত ছোট গুলুমুলু বাচ্চাদের আমরা এভাবে কোলে নিয়ে গাল টেনে দিয়ে থাকি। সেই হিসেবে সে এখন আমায় বাচ্চাদের সাথে মিলিয়ে ফেললো।
আমি গম্ভির কন্ঠে তার দিকে চেয়ে বললাম,
– আমার একটা ফোন লাগবে।
আমার কথায় একটু ভ্রু কুচকালো সে। হয়তো এতো গম্ভির ভাবে এমন একটা কথা বলবো সে ভাবতে পারেনি। সে আমার দিয়ে চেয়ে বললো,
– হটাৎ ফোন কেন?
আমি এখনও গম্ভির ভাবে বললাম,
– আপনি দিবেন কিনা ওটা বলেন। আমি চাইলে বাবার থেকে নিতে পারতাম, বাট স্বামী থাকতে বাবার কাছে চাইতে বিবেকে বাধছিলো তাই চাইনি।
– আচ্ছা, ঢাকায় পিরে ওখান থেকে একটা আইফোন নিয়ে দিবো, হ্যাপি?
– আইফোন লাগবে না। ২০-২৫ হাজারে একটা ফোন হলেই হবে। আর তা এখনই লাগবে।
– এখনই, মানে আজকেই?
– আজকে না, এই মুহুর্তেই লাগবে আমার।
,
,
বিকেলে ডাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিবো আমরা। দুপুরে খাওয়া দাওয়া শেষে রুমে বসে আছি আমি। আমার পাশে সাবিহা। আমাদের বিদায় দিয়ে তারপর বাসায় যাবে। আমি তার পাশে বসে বললাম,
– আমাকে ভুলে যাবি?
– এর আগেও তো গেলি, তখন কি ভুলে গেছি?
আমি কিছু বললাম না। চুপচাপ ফোনের বক্সটা তার দিকে এগিয়ে দিলাম। যেটা আনার জন্য রিদ ভাইকে বলেছিলাম। উপরে গিপ্ট পেপার মোড়ানো। সে আমায় বললো,
– কি এটা?
– বাড়িতে গিয়ে খুলবি। আর শুন এবার তো অনেক দিনের জন্য চলে যাচ্ছি,, যোগাযোগ রাখিস।
– আচ্ছা মাঝে মাঝে বাবা বাসায় থাকলে তার ফোন থেকে কথা বলবো তোর সাথে।
আমি একটু হেসে বললাম,
– আচ্ছা।
সে আবার তৎক্ষনাৎ আমার দিকে চেয়ে বললো,
– আবার কবে দেখা হবে আমাদের?
– সৃষ্টি কর্তা যখন চাইবে। ওহ্ হ্যা, তোর বিয়েতে আসবো। সাব্বির ভাই একটা চাকরি পেলেই বিয়েটা করে নিবি। তখন দেখবি আমি আবার তোর সামনে।
সাবিহা মাথা নিচু করে বললো,
– আমি বুঝতে পারছি না বাবা আমাদের সম্পর্ক টা মেনে নিবে কি না। তাকে না পেলে আমিও বা*চবো না। ম*রে গিয়ে সবাইকে মুক্ত করে দিবো।
আমার একটু রাগ হলো। তাকে বললাম,
– ঠা*সিয়ে একটা চ**র খা*বি এমন আরেক বার বললে। পাওয়া না পাওয়ার সাথে বা*চা ম*রার কোনো সম্পর্ক নেই। আল্লাহর সিদ্ধান্তই উত্তম সিদ্ধান্ত।
,
,
ওই দিন এই বারিতে আসার সময় মামা মামি বিদায় দিয়েছিলো বাবা মায়ের সাথে এসেছি। আর আজ বাবা মা বিদায় দিচ্ছে, মামা মামির সাথে আবার ওই বাড়িতে চলে যাচ্ছি। পার্থক্যটা শুধু আমি আর আমার গন্তব্য।
বাবা মায়ের থেকে দুরে চলে গেলে সব সময় আমার চোখ ভিজে উঠতো। কিন্তু আজ আমার একটু কাঁন্না আসছে না। একজন স্বাভাবিক মানুষের মতো দাড়িয়ে আছি আমি। রিদ ভাই তাড়া দিচ্ছে বার বার গাড়িতে উঠার জন্য। সে নিজেও হয়তো এখন এই জেলার মাটির উপর থাকতে বিরক্ত বোধ করছে। আমি বাবা মায়ের দিকে চেয়ে বললাম,
– আসি,, তোমরা নিজের যত্ন নিও।
আর সাবিহার দিকে চেয়ে বললাম,
– তোর জন্য আমি নতুন জীবন ফিরে ফেলাম। তোর মতো বন্ধু পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। নিজের খেয়াল রাখিস আর সাবধানে থাকিস। আবার দেখা হবে, আসি।

গাড়িতে উঠেই চমকে গেলাম আমি। কারণ গাড়ির সামনে থাকা রাতের সে মাস্ক পরা লোকটা। যে আমাকে আর সাবিহাকে বাড়ি পৌছে দিয়েছিলো। এবার বুজলাম, তাকেও হয়তো রিদ ভাই পাঠিয়েছিলো। ওকে কিছু না বলে রিদ ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে গম্ভির ভাবে বললাম,
– ও কি সব সময় এভাবে মাস্ক আর হুডি পরে থাকে?
– হুম, তার নাম নির্জন। তার চেহারা আমি আর বাবা ছারা কেও দেখতে পাই নি। তবে সেই অনেক আগে একবার দেখেছিলাম। এর পর আর দেখা হয় নি। আমি তো হসপিটালে থাকি সারা দিন। আর নির্জন থাকে বাবার সাথে। বাবার অনুপস্থিতিতে সেই সব সামলায়। বলতে পারো ও একেবারে আমার ভাইয়ের মতো। বাবাও নিজের ছেলের মতো ভাবে তাকে।
আমি কিচু না বলে চুপচাপ বসে রইলাম। একটা মানুষ কাওকে চেহারা না দেখানোর মাঝে কি কারণ থাকতে পারে? আমরা মানব জাতির সব সময় নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি আগ্রহটা একটু বেশি থাকে। আর আমার আগ্রহটা জেগে উঠলো তার চেহারা টা দেখার।

এর পর সামনে থেকে এগিয়ে এসে গাড়িতে উঠে বসলো নির্জন। আমার হুট করে একটা কথা মনে পরলো। গাড়ি থেকে নেমে দৌড়ে বাড়ির ভেতরে চলে গেলাম। খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা জিনিস ফেলে এসেছি।
সবাই হা করে আমার দিকে তাকিয়ে ছিলো। আমি ওদিকে না তাকিয়ে সোজা রুমের ভেতর গিয়ে খাতার ভেতর থেকে পেজ টা ছি*ড়ে নিলাম। তার পর তা ভাজ করে বেগে ঢুকিয়ে নিলাম। সময় হলে রিদ ভাইকে দিবো তা। এটা খুব যত্ন করে বানানো।
,
,
আমাদের আসতে আসতে সন্ধা পেরিয়ে রাত ঘনিয়ে এলো। আমাদের বাসায় নামিয়ে দিয়ে গাড়ি নিয়ে চলে গেলো নির্জন।
বাসায় এসে রুমে গিয়ে চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষন শুয়ে রইলাম। এর পর চোখ গেলো দেওয়ালের মাঝে। আমার ছবি গুলো সেই আগের মতোই রয়েছে। কত হাসি খুশি পিক গুলো। যেই হাসি গুলো এই মুহুর্তে একধমই বেমানান লাগছে আমার কাছে। তাই চুপচাও ওগুলো দেওয়াল থেকে আলাদা করে ভাজ করে এক জায়গায় রেখে দিলাম। শুধু একটা ছবি খুললাম না। আর তা হলো আমাদের ছোট বেলার ছবি টা। ছবি তে রিদ ভাইয়ের গলা জড়িয়ে কাধে চড়ে খেলা করছিলাম আমি। ছবির দিকে আর নিজের দিকে তাকালে পার্থক্য টা বুঝা যায়। কত বড় হয়ে গেছি আমরা।
,
,
আরশি তখন ঘুমিয়ে আছে। রুমে প্রবেশ করে কিছুক্ষন দেওয়ালের দিকে চোখ বুলালো রিদ। রুমটা খুব ফাকা ফাকা লাগছে। সে কিছু না বলে চুপচাপ গিয়ে শুয়ে পরলো। কারণ সে বুজতেই পারছে এটা আরশির কাজ। যাই হোক এটা কোনো বিষয় না, কারণ মেয়েটার মন মেজাজ ভালো নেই এখন তাই হয়তো এমন টা করেছে। এই ব্যাপারে তাকে কিছু জিজ্ঞেস করলেও তার কাছে বিরক্তিকর মনে হবে তা।

মাঝ রাতে হুট করে ঘুম ভেঙে গেলো রিদের। পাশে তাকিয়ে দেখে আরশি নেই। বেলকনি থেকে কারো গুন গুন কান্নার আওয়াজ ভেষে আসে। বেলকনির দিকে এগিয়ে গেলো রিদ। দেখে বেলকনির এক কোনে বসে দেওয়ালের সাথে হেলান দিয়ে কাঁন্না করছে আরশি। বুকটা আৎকে উঠলো তার। হুট করে আরশিকে এমন কাঁদতে দেখে খুব চাপা কষ্ট জেগে উঠলো বুকের ভেতর।

To be continue…..