অনুর উপাখ্যান
পর্ব: ১
✍? নায়না দিনা
শ্বশুর বাড়ির গেটে সেই কখন থেকে অনু বউ সাজে দাঁড়িয়ে আছে ! শাশুড়ি মা তাদের বরণ করে ঘরে তুলবেন,তাই হয়ত এত দেরি হচ্ছে । কিন্তু না, অনুর ধারণা ভুল । বরণ করার পরও কেউ তাকে বাসার ভিতরে নিয়ে যাচ্ছে না । কি সমস্যা ? অনু সমস্যার কারণটা বুঝার চেষ্টা করছে । হঠাৎ কারণটা বুঝতে পেরেই ভয়ে অনু আঁতকে উঠল !
— এ্যাই শোনেন, আমি কিন্তু উনার কোলে উঠব না।আপনি বলেন তাদেরকে ; আমি নিজেই হেঁটে ঘরে যাব ।
— চুপ করো ! এটাই নিয়ম আমগো । মায়ে যা কয়, তাই করতে অইবো ।
অনু যেনো আকাশ থেকে পড়লো ! কি বলে লোকটা ! এর সাথে আমার কয় ঘন্টা আগে বিয়ে হয়েছে ! এ কেমন পুরুষ ! নিজের বউকে তুলে দিচ্ছে বোন জামাই এর কোলে ! এরা কি মানুষ ! ওহ আল্লাহ এ আমি কোথায় এসে পড়লাম । পিছনে তাকিয়ে ছোট বোন ঝিনুকে খুঁজতে লাগলাম । দেখি আমার দিকে করুণ ভাবে তাকিয়ে আছে সে । আমার ভিতরের দহন ও বুঝতে পারছে । অনেক কান্না পাচ্ছে আমার । কেনো অন্যের স্বামী আমাকে স্পর্শ করবে ? আর এই যে আমার বর নামক লোকটার তাতে কোনো বিকার’ই নেই ! এর কাছে আমার বাবা আমাকে বিয়ে দিয়েছেন !
— কই, সুজন কই তুমি ? এদিকে আইয়্যো । নেও ছোড বউরে কোলে কইরা গরো নেও ।
শাশুড়ি মায়ের আদেশ শুনে রাগে,কষ্টে,লজ্জায় অনুর গাল বেয়ে পানি পড়তে লাগল । তাকে কোলে তুলে নিলে শরীরের কোথায় কোথায় স্পর্শ লাগতে পারে এটা ভেবেই বমি আসছে তার ।কে বাঁচাবে তাকে এই নোংরামি থেকে ? কান্না পাচ্ছে অনেক । আর কান্না ছাড়াই বা কি করতে পারে অনু ? ছোটবেলা থেকেই শান্ত, লাজুক একটা মেয়ে সে। প্রতিবাদ করার মতো সাহস যদি তার হতো, তবে তো এত অল্প বয়সে বিয়েই করতো না ।
কুৎসিত এক হাসি লুকিয়ে ছোট ননদ সীমার জামাই সুজন, অনুকে কোলে তুলে নিলো ।সুজনের নি:শ্বাসের তীব্রতা অনু টের পাচ্ছে ।লজ্জা,অপমানে অনু চোখ বন্ধ করে ফেললো । নিজের বাসর ঘরে ঢুকতে হলো অন্য পুরুষের কোলে চড়ে ! এটা কেমন নিয়ম ? কে বানিয়েছে এ নিয়ম ? কই ইসলাম তো এই শিক্ষা দেয়নি ? কোনো হাদিসে কি আছে নিজের স্ত্রীকে অন্য কারো কোলে দেয়া যাবে ? না, কোনো হাদিসে নেই এমন জঘন্য নিয়ম । এ যেনো জাহিলি যুগকে ও হার মানায় ! আর সহ্য করতে পারছি না। ও আম্মু তুমি কই ? তোমরা আমার কি সর্বনাশ করলে দেখে যাও ।একা একা বাসর ঘরে বসে আরও কত কি যে ভাবছে সে ।
“এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি সাপ্তাহে জিতে নিন বই সামগ্রী উপহার।
আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এখানে ক্লিক করুন
দরজায় শব্দ হতেই অনু চমকে উঠল । লোকটা মানে মারুফ এসেছে । আমার কি ভয় করছে ? হুম।সত্যি ? না, শুধু ভয় না, ঘৃনা ও আছে সাথে । অনু মনে মনে দোয়া করছে, মারুফ যেনো নিজেকে নির্দোষ প্রমান করার চেষ্টা করে । তাকে ঘৃনা করে সারাজীবন কীভাবে কাটাব ? কিন্ত,আমার সব আশা, ধারণা পাল্টে মারুফ আলমারি থেকে একটা ম্যাক্সি বের করে শাড়ি পাল্টে সেটা পরতে বলল ।আমি তার মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি !
—কি অইলো ? তাড়াতাড়ি করো না । রাইত তো শেষ হয়ে গেলো !
জীবনের প্রায় পঁয়ত্রিশ বছর যে পুরুষ বউ ছাড়া পার করেছে, সে আজ তার নতুন বউকে পঁয়ত্রিশ সেকেন্ড সময় ও দিতে পারেনা একটু স্বাভাবিক হওয়ার জন্য ! বউ এর ঘোমটা টা খুলে বলতে পারেনা ; আমার বউটা এত সুন্দর ! একটু অভয় দিয়ে বলতে পারে না দু’টো কথা । কারণ, সময় কম,রাত শেষ হয়ে যাচ্ছে । কথা বলে শুধু শুধু মূল্যবান রাতটা নষ্ট করার কোনো মানেই হয় না তার । সামান্য সময় পরই অনু বুঝতে পারলো বাসর রাত মানে নাটক, সিনেমার মতো হাতে হাত রেখে প্রতিশ্রুতি দেয়া না ।বাসর রাত মানে ক্ষুধার্ত এক বাঘের সামনে নিজেকে মাংসের দলার মতো সঁপে দেয়া !
অবশেষে এই বিভীষিকাময় রাত শেষে সকাল হলো । অনু আয়নায় নিজেকে দেখছে । তার ফর্সা গাল গোলাপী আভা ছড়াচ্ছে । হাঁটু সমান লম্বা ভেজা চুল গুলো সে বার বার মুছে শুকানোর বৃথা চেষ্টা করছে । সব মিলিয়ে অপরুপ সুন্দর দেখাচ্ছে তাকে ।কিন্তু, তার চোখ ? হ্যাঁ, চোখ দুটোতে তার স্পষ্ট অজানা আতঙ্কের ছাপ !
আজ এ বাড়িতে অনুর প্রথম দিন ।তার শাশুড়ি মায়ের বয়স নানুর মতো । বড় জা’র বয়স আম্মুর কাছাকাছি, বড় ভাসুর ও আব্বুর মতোই হবেন ।সবকিছু কেমন যেনো বেমানান লাগেছে ! কিন্তু, কি করার আছে আমার, নিজেকে মানিয়ে নেয়া ছাড়া ? আচ্ছা এত অল্প সময়ে মানিয়ে নেয়া শিখে গেলাম কীভাবে ? দু’ দিন আগে ও তো আমি আম্মুর সেই ছোট অনু ছিলাম। এখানে সবাই আমার চেয়ে কত বড় ! ভাসুরের ছেলেটা আমার ভাইয়ার চেয়ে ও বড় ।অথচ এরা আমাকে আপনি করে ডাকে । আমাকে আবার এদের তুমি করে বলতে হবে । পারবো তো আমি ? পারতে হবে, কিছুই যে করার নেই আমার !
পরের দিন সকালে বৌভাতের জন্য রেডি হয়ে বসে আছি । শাশুড়ি মা মারুফকে ডেকে কি যেনো বললেন । মারুফ ঘরে এসে মুখ কালো করে বসে আছে । তার মুখ দেখে কান্না পাচ্ছে । এত সুন্দর করে সেজে বসে আছি অথচ মানুষটা একটু তাকিয়ে দেখেও না । উল্টো মুখ কালো করে বসে আছে ।
— শোনো অনু, আমি তোমারে বিয়া করছি আমার মায় বিয়া করতে কইছে তাই ।কাজেই আমার মা যা যা কইবো তোমারে তাই করতে অইবো। আর সীমা আমার অনেক আদরের বইন । কাজেই ওরে কোনো কষ্ট দিবানা । যা কইবো তা হুনবা । কি বললাম মনে থাকবে তো?
— কী বললেন ! তার মানে আপনি আমাকে নিজে পছন্দ করেন নি ? তাহলে বিয়ে করলেন কেনো আমাকে ?
— মায় কইছে তাই বিয়া করছি তোমারে ।
আমার নিজের চোখ যেনো আমার সাথেই বেঈমানি শুরু করে দিলো ! প্রাণ ভরে তারা কাঁদছে । এটাকে বিয়ে বলে ? এত স্বপ্ন আমি এ জন্য দেখেছিলাম ?এদের সম্পর্কে যা শুনেছি তার বেশির ভাগ’ই মিথ্যে । একদিনেই যদি আমি এতটা মিথ্যে ধরে ফেলতে পারি,তবে বাকি জীবন আরও কত কি যে দেখব ! আশা, আকাঙ্ক্ষা সব পালিয়ে মনের মধ্যে ভর করল শুধু ভয় আর ভয় ।
বিয়ের পর থেকে প্রায় বিকেলে এলাকার মহিলারা আমাকে দেখতে আসতে লাগল ।মফস্বল শহরে এটাই নিয়ম মনে হয় । আচ্ছা নতুন বউকে শুধু মহিলারা’ই কেনো দেখতে আসে ? আমার মনে হয় এ জন্য যে : কার কপালটা পুড়ল , বাবার বাড়ি থেকে কি কি যৌতুক দিলো, আর বউ দেখতে কেমন এসব দেখার জন্য । কারণ, কারো দোষ ধরতে আর তা প্রচার করতে তো আবার মেয়েদের জুড়ি নেই । অনুর ক্ষেত্রে ও তাই হলো । সুযোগ পেলেই সবার একই কথা; বাবার বাড়ি থেকে কোন হারটা দিলো ? বউ এত সুন্দর ! এই লোকের সাথে আমাকে কিভাবে বিয়ে দিলো ? আমার বাবা-মা কি ছেলের বিষয়ে সব জেনে আমাকে বিয়ে দিয়েছেন ? সব কিছু হাসি মুখে মেনে নিলেও শেষের প্রশ্নটা শুনে অনু চমকে উঠল ! তার মানে কি ? উনারা কেনো একই প্রশ্ন করছেন ? মারুফের সম্পর্কে কেনো এমন কথা বলছেন উনারা ?
—ভাবি, কি জানার কথা বলছেন ? আমাকে একটু বলেন, প্লিজ ।এলাকার এক ভাবিকে সাহস করে কথাটা জিজ্ঞেস করলাম ।
— তার মানে আমনেরা না জাইন্নাই কাম করছেন ! তাই তো কই আমনের মতো এত সুন্দর মেয়েরে কেমতে এর সাথে বিয়া দিছে ! সব জানলে তো আর বিয়া অইতো না । থাউক, এখন আর জাইন্না কি করবেন ?
চলবে……..