গল্প : অনুর উপাখ্যান
পর্ব : ১৪
— হসপিটাল ! হসপিটালে নিতে হবে মঈনকে । আপা মঈনকে হসপিটালে নিতে হবে তাড়াতাড়ি । ও আপা আমার কথা শোনেন । অনু, ঝুমা আপাকে বার বার করে বলছে ।
— ওহ ! হ্যাঁ, আমি যাইতাছি ওরে নিয়া । তুমি আসো ।
— আপনি তাড়াতাড়ি রওনা দেন । আমি নিহানকে রেখে আসছি ।
— রিনা নিহানকে রাখো । বাসায় থাকবা, কোথাও যাবানা কিন্তু । আর নিপাকে বলো এখানে নিহানের কাছে থাকতে ।
— ঐ কি অইছে রে ? তোরা কানতাছোস ক্যান ? বড় ভাবি অস্হির হয়ে জিজ্ঞেস করছেন ।
— মঈনকে কারা যেনো কুপিয়ে জখম করেছে, ভাবি । মুন্না ওরা কই ? ওদের বলেন নিহানের আব্বুকে খবর দিতে । আমি হসপিটালে গেলাম ।
— অনু একটু খাড়া, আমিও যামু তোর লগে ।
এরই মধ্যে হসপিটালে ইমার্জেন্সিতে ভীড় জমে গেছে । মফস্বল শহরের হসপিটাল, যতটুকু সম্ভব চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে । অনু বার বার মারুফের মুখের দিকে তাকাচ্ছে আর কাঁদছে । সে জীবনে কখনো এমন বিভৎস ঘটনা দেখেনি ! মারুফ অনুকে আর ঝুমা আপাকে নিষেধ করছে কাঁদতে । কিন্ত, মন কি আর নিষেধ মানে ?
— অনু, নিহানরে কার কাছে দিয়া আসছো ? মারুফ জিজ্ঞেস করল ।
— রিনার কাছে । আর নিপা আছে বাসায়, চিন্তার কিছু নেই ।
—হুনো, আমি আছি এইহানে । তুমি আপারে নিয়া বাইত যাওগা । এইহানে যে কোনো সময় হামলা অইতে পারে ।
— কি বলেন এসব ! নিহানের আব্বু, আপনি জানেন মঈনকে কারা মেরেছে ?
— হ, দল লইয়া যাগো লগে আগে মঈনের ঝগড়া ছিল, তারাই মারছে । এই কারণেই তো ওরে বিদেশ পাঠায় দিছিলাম । হারামিরা যে পাঁচ বছর পর ও মারব তা বুঝতে পারি নাই ।
— এখন কি করবেন ? যদি এখানেও আসে ওরা ? ঢাকা নিয়ে যাবেন মঈনকে ?
— না, কোথাও নেওন যাইতো না । সেলাই দেওয়া অইলেই বাসায় লইয়া যামু । যা চিকিৎসা লাগব বাসায় দিমু । হসপিটালে রাখলে ওরা মাইরা ফেলবো মঈনরে ।
— তাই বলে অপারেশন থিয়েটারে না নিয়ে এভাবে সেলাই দিবে ? ওর তো অনেক কষ্ট হচ্ছে ।
— বুঝতাছো না ক্যান ? বেশি দেরি করলে ওরা আইয়া পরবো । মুন্না কই ? আইছে ?
— হ্যাঁ, ঐ তো ঐ দিকে আছে ।
— ঐ মুন্না এদিকে আয় । শোন, তোর যত বন্ধু আছে সবাইরে ডাক । রাস্তার মাথায় বেরিকেট দে । হসপিটাল পর্যন্ত যেনো কেউ আইতে না পারে । তোরা সবাই বাঁধা দিবি । দাও,বটি যা যা পারছ নিয়া খাঁড়া । কে কামডা করছে জানস তো ? পাইলে মাতা ফালাইয়া দিবি । থানা পুলিশ যা লাগে আমি করমু ।
— আইচ্ছা কাকা, এহনি যাইতাছি ।
—ও আল্লাহ ! নিহানের আব্বু কী বললেন আপনি মুন্নাকে ? যদি সত্যি খুন করে ও ? আপনার কি মাথা ঠিক আছে ? ওরে না করেন প্লিজ ।
— একদম চুপ ! আমার ভাই যদি মইরা যাইত ? তহন ?
— তার জন্য আপনি পুলিশে ধরিয়ে দেন । উল্টা কেনো মারবেন ? এভাবে তো জীবনে ও সমাধান হবে না ! ভয় আর বিষ্ময় অনুর চোখে মুখে !
— আপা,আমনে অনুর লগে বাড়িত যান । এ্যাই বড় ভাবি, আমনেও যান বাড়িত । দেরি কইরেন না ।
অনু, ঝুমা আপাকে এক রকম জোড় করেই রিক্সায় উঠালো । আপার কান্না করেই যাচ্ছেন ।বাসার কাছে গিয়ে দেখে লোকজনে ভরা ! অনুর খুব ভয় করছে । যদি শত্রুরা কেউ এর মধ্যে লুকিয়ে থাকে ? কাছে গিয়ে দেখল আশে পাশের বাড়ির সবাই গলির মুখে দাড়িয়ে আছে । সবার একই প্রশ্ন : মঈন বেঁচে আছে কিনা ?
বেচারা মঈনের জন্য খারাপ লাগছে অনুর । কিন্তু, আর একটা কারনে ও অনুর কান্না পাচ্ছে । এ কেমন পরিবারে সে এসে পড়ল ? এমন খুনাখুনি, রক্তারক্তি শুধু টিভির পর্দায় দেখেছে অনু । বাস্তবে যে এগুলো হয় ; তা এই প্রথম দেখল সে । এ বাড়িতে তার ছেলের ভবিষ্যত কি ? ও আল্লাহ ! আপনি আমার ছেলেকে রক্ষা করুন ।
আধা ঘন্টা পরেই মারুফ মঈনকে নিয়ে বাসায় চলে আসল । ছেলেটার সহ্য ক্ষমতা দেখে আশ্চর্য লাগছে অনুর ! ওর জায়গায় অন্য কেউ হলে দাঁড়াতে ও পারতো না । অথচ মঈন দিব্যি গলি থেকে হেঁটে বাসায় এসেছে !
সারা রাত বড় ভাসুর , মারুফ ও তার বন্ধুরা, ঝুমা আপার দেবর সবাই মিলে ড্রয়িংরুমে বসা । কীভাবে কি হলো ? কী ব্যবস্হা নিবে ? এসব আলোচনা করছে সবাই । মঈনকে একটু আগে ঘুমের ইনজেকশন দেয়া হয়েছে । আপা মঈনের পাশে ঘুমাবেন এখন থেকে । ডাক্তার অনুকে সব মেডিসিন বুঝিয়ে দিয়ে গেছে । মঈনের সবকিছু অনুকেই করতে হবে ।
প্রতিদিন সকাল থেকে অনুর কাজ শুরু হয় । মঈনের শরীরের সেলাই ড্রেসিং করা , অয়েন্টমেন্ট লাগিয়ে দেয়া, সময় মতো মেডিসিন দেয়া । আর পাশাপাশি মঈনের জন্য স্পেশাল রান্না করা । এক সপ্তাহ পরেই ঝুমা আপাকে চলে যেতে হয়েছে ফরিদপুর । লীমা শ্বশুড়বাড়ি থেকে এসে মঈনকে দেখে আবার চলে যায় । সীমা এখন এ বাড়িতেই থাকছে। অনুর পাশাপাশি মঈনের খেয়াল রাখছে সে ।
সুজন ভাইয়ের আচরণ এখন অনেক পাল্টে গেছে । ইদানীং উনি চোখ নামিয়ে কথা বলেন । শাশুড়ি মা মারা যাওয়ার পর থেকে সুজন ভাই নিয়মিত নামাজ পড়েন । কথা বার্তায় অনেক সংযত এখন । বেশির ভাগ সময় উনার তাবলীগ জামাতে কাটে । আর সীমা তার নিজের সংসারেই বেশি থাকে । কারণ, ওর সাথে এখন ওর ছোট ননদ থাকে । তাই এ বাড়িতে কম আসে এখন ।
সংসারে যতই দিন দিন অনুর দায়িত্ব বাড়ছে ;
মারুফ ততই দিন দিন কেমন যেনো হয়ে যাচ্ছে ।সে একটা মোবাইল ফোন কিনেছে ,একটা নকিয়া সেট । সেটা হাতে নিয়ে ভাব দেখিয়ে চলে মারুফ । সে নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত । অনুর প্রতি তার কোনো খেয়াল নেই । অনু যেনো ঘরের কোনো একটা ফার্নিচার ! না, ফার্নিচার কি এত কাজ করতে পারে ? তবে কি ? অনু হচ্ছে বিনা বেতনের কর্মচারী । যার কার্য দিবস সপ্তাহে সাত দিনই । কোনো ছুটির দিন নেই !
হঠাৎ করেই খবর আসল রিনার নাকি বিয়ে ঠিক হয়েছে । ওকে নিতে আসবে ওর মামা । কিন্তু, সমস্যা হলো এখন অন্য কাজের মেয়ে পাবে কোথায় ? আম্মুকে বলবে কাজের লোকের কথা ? হ্যাঁ, বললে একটা ব্যবস্হা হবেই । আর বড় আপুর বাসায় দুই তিনটা করে কাজের লোক থাকে । কাজেই অনুর জন্য নিশ্চই জোগাড় করে দিতে পারবেন ।
— হ্যালো, আম্মু আসসালামু আলাইকুম ।কেমন আছো তুমি ? আব্বু কেমন আছেন ?ভাইয়া ও ঝিনু কেমন আছে ?
— ওয়াআলাইকুমুস সালাম । আলহামদুলিল্লাহ আমরা সবাই ভালো আছি মা । তোমরা ভালো আছো তো মা ? নিহান কেমন আছে ?
— হ্যাঁ, আম্মু ভালো আছি আমরা চিন্তা করো না । আম্মু শোনো রিনার বিয়ে ঠিক হয়েছে, ও চলে যাচ্ছে । আমি কি করব মা ? আমার জন্য একটা কাজের মেয়ে পাও কিনা দেখো, প্লিজ । নইলে আমার লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যাবে । নিহানকে কার কাছে রাখব ?
— আহা, আগেই এমন করো না । দেখি রেনুকে বলে । ওর শাশুড়ির কাছে বললে কাজ হতে পারে । তবে এসব বুয়াদের বেতন কিন্তু একটু বেশি হয় ।
— হোক, তুমি বলো জোগাড় করে দিতে ।
— হুম, বুঝতে পেরেছি । চিন্তা করো না ।
— আচ্ছা মা এখন রাখি, আল্লাহ হাফেজ ।
— আল্লাহ হাফেজ ।
অনুর মন প্রচুর খারাপ । রিনা একটু আগে চলে গেছে । এই মেয়েটা নিহানকে অনেক আদর করেছে । নিহানের কাঁথা;কাপড় সব রিনাই ধুয়ে দিতো । অনু রিনাকে বলেছিল : “তুমি আমার ছেলের জন্য যা করেছ, তার ঋন কোনোদিন শোধ করতে পারব না ।তবে গিফট হিসেবে তোমার বিয়েতে আমি একটা স্বর্নের গলার চেইন দিব।” অনু তার কথা রেখেছে । একটা প্যাঁচানো স্বর্নের চেইন আর ওর মাসের বেতন যা জমে ছিল সব দিয়ে দিয়েছে । এত বছর মেয়েটা এখানে ছিল, যদি বেতনের টাকা তিন মাস পর পর ওর মামা এসে না নিয়ে যেতো, তবে অনেক টাকা জমতো মেয়েটার । এভাবেই বুঝি এতিমরা ঠকে দুনিয়াতে !
প্রায় প্রতি রাতেই মারুফ দেরি করে আসে এখন । অনুর সাথে কথা বলার মতো কেউ নেই, একা একা ভালো লাগে না তার । মঈন বেশির ভাগ সময় ওর ঘরেই থাকে । বাহিরে বের হয় না খুব একটা । সারাদিন ঘুমায় । আচ্ছা সারাদিন একটা মানুষ কীভাবে ঘুমায় ? অনু কোনো ভাবে হিসেব মেলাতে পারে না । তবে মঈনের জন্য অনুর ভাঙা রেকর্ড চলতেই থাকে : মঈন উঠো খাবার রেডি । তবুও মঈনের কোনো উত্তর নেই । আর মারুফ ? রাতের খাবার শেষে তার আর হুস থাকে না । নাক ডেকে ঘুম ।
— কই গেলা তুমি ? এদিকে আইয়ো ।মারুফ বাসায় এসেই অনুকে ডাকছে ।
— এইতো কিচেনে আমি, আসছি ।
— বড় আপু ফোন দিছিল, কাইলকা বিকালে যাইতে কইছে । কাজের লোক পাওয়া গেছে ।আমারে গিয়া নিয়া আইতে কইছে । কি করতাম আমি ?
— যাবেন, গিয়ে নিয়ে আসবেন । কাজের লোক পাওয়া যায় না, দেখেন না ? এত বড় বাড়িতে আমার একা ভালো লাগে না ।
— আইচ্ছা, যামুনে । কাইলকা তাইলে আর সকালে বাইর হমু না । তাড়াতাড়ি রানবা । ভাত খাইয়া রওনা দিমুনে ।
— ঠিক আছে, সমস্যা নেই ।
আজ মঈন একটু তাড়াতাড়ি উঠেছে । হয়তো মারুফ বাসায় তাই । দুই ভাই এক সাথে নাস্তা করতে বসেছে । অনুর কেনো জানি মনে হচ্ছে মঈন কিছু বলতে চাচ্ছে ।
— মঈন, কিছু বলবা তুমি ? কোনো সমস্যা হয়েছে ?
— না ভাবি, সমস্যা না । ভাইরে একটা কথা কইতে চাইছিলাম ।
— কি কথা কবি ? ক, এত ভয় পাওয়ার কি আছে ?
— ভায়ে, আমার শরীলের যে অবস্হা তাতে তো ভারী কোনো কাম করতে পারমু না । তাই বাজারে একটা ফার্মেসি দিতে চাইতাছি । দোকান ও পাইছি । পজিশনটা ভালো ।
— তাই ! খুবই ভালো কথা মঈন । এর চেয়ে ভালো বিজনেস আর নেই । তুমি শুরু করে দাও । খুশি হয়ে অনু বলে উঠল ।
— এ্যাই তুমি চুপ করো । আজাইরা কতা । মারুফ ধমকে উঠল অনুকে ।
— দোকান করবি টেকা পাবি কই ?
— ক্যান, আমার টেকা তো ভায়ে সব আমনের কাছে । আমনে আমার টেকা দিবেন না ?
— তোর কি ধারণা টেকা লইয়া আমি বইয়া থাকি ? এহন কোনো টেকা নাই আমার কাছে । পরে নিছ ।
— পরে নিয়া কি করমু ? এমন দোকান তো পরে পামু না ভায়ে ।
— ঠিকই তো বলেছে মঈন । সব সময় কি দোকানের পজিশন পাওয়া যায় ? আর টাকা যেহেতু মঈন পায়, আপনাকে তো ফেরত দিতেই হবে । কাজেই এখনই দেন ।
— কইছি না আমার কাছে এহন টেকা নাই ।
মঈন রাগ করে টেবিল থেকে উঠে গেল । অনুর খুব খারাপ লাগছে মঈনের জন্য । বাপ মা কেউ নেই যে, ওর সাপোর্টে একটু কথা বলবে । আর মারুফ ? লোকটার নীতিবোধ এত খারাপ !
— আপনি কিন্তু কাজটা ভালো করছেন না নিহানের আব্বু । মঈন দিন দিন মানসিক রোগী হয়ে যাচ্ছে । আপনার উচিত ওরে এখন সাহায্য করা । আর আপনি কি ওরে টাকা লোন দিচ্ছেন ? না তো , ওর টাকা ওরে ফেরত দিবেন তাতে সমস্যা কি ?
— তুমি আমার বউ অইয়া ওর ওকালতি করো ক্যা ?
—কারণ, আমি ওরে কথা দিয়েছিলাম যে, মা থাকলে যা যা করত মঈনের জন্য , আমিও তাই করব । এখন যদি শাশুড়ি মা বেঁচে থাকতেন তবে কি আপনি পারতেন এমন করতে ?
— কতা দিছো বালা করছ । আমি টেকা দিতে পারতাম না । এহন ও না, কোনো দিনও দিমু না । অইছে ?
— ছি: আপনি এত খারাপ ! এতিমের হক মেরে খেলে কি হয় আপনি জানেন না ? আল্লাহ সহ্য করবেন না । এমন জুলুম কইরেন না আপনি ।
— বেশি কতা কইতাছো কিন্তু ! চুপ করো এহন ।
নিজের সম্মান রক্ষার্থে অনু চুপ করল । এই লোক যে কোনো সময়ই গায়ে হাত তুলতে পারে । তাই সে চুপচাপ কিচেনে চলে গেল । তাড়াতাড়ি রান্না শেষ করে মারুফকে বিদায় দিলো । কেমন হবে নতুন কাজের মেয়েটা ? এটা এখন চিন্তার বিষয় । যদি ভালো না হয় রিনার মতো ?
সব কাজ সেরে দরজা আটকে অনু নিহানকে নিয়ে একটা ঘুম দিলো । বিকেলে চা বানিয়ে মঈনকে দিয়ে নিজে বারান্দায় গিয়ে বসল । আশে পাশের ভাবিরা নিচে সবাই আড্ডা দিচ্ছে । অনু ইচ্ছে করেই নিচে যায় না বেশি । তাদের আলোচনায় ঘুরে ফিরে একই টপিক : স্বামী কেমন আদর করে, কি গিফট করল, শাশুড়ি খারাপ, ননদ বেশি জালায় ইত্যাদি । অনুর রাগ হয় কেনো কেউ বই নিয়ে কিছু বলে না ? বই তার এত পছন্দ ! সেই ক্লাস ফোর থেকে অনুর বই পড়ার অভ্যাস ।ছোটদের বই দিয়ে পড়া শুরু হয় । তারপর ধীরে ধীরে তিন গোয়েন্দা, শার্লক হোমস থেকে শুরু করে শরৎচন্দ্র, বঙ্কিমচন্দ্র সবই তার পছন্দের তালিকায় ।মনে আছে তার, সমরেশ মজুমদারের সাতকাহন উপন্যাস পড়ে নিজেকে যে কত দিন পর্যন্ত দীপাবলির মতো কল্পনা করেছে ! অনুর সারা স্বত্ত্বা জুড়ে যেনো শুধু বই আর বই ।
— নিহান , তোমার আম্মু কই ? এই দ্যাহো এইডা কে আইছে ? এইডা তোমার একটা আন্টি ।
— আব্বু ! কে আন্তি ? নিহানের ভাঙা ভাঙা কথা ।
মারফের গলা শুনে অনু ঘর থেকে বের হলো । কাজের মেয়েকে দেখে অনু একটু ঢোক গিলল । এই মেয়ে কাজ করবে ? স্টাইল করেই তো কুল পায় না ! মেয়েটা বয়সে অনুর বড় হবে । নাক বেশ ভালো বোঁচা, গায়ের রং শ্যামলা ,স্বাভাবিক লম্বা, স্বাস্হ্য মিডিয়াম । মেরুন রং এর তাঁতের শাড়ি পরেছে বেশ সুন্দর করে ।
— এদিকে আসো, এখানে বসো । অনু মেয়েটাকে সোফায় বসিয়ে নিজে ও বসল ।
— তোমার নাম কি ? তুমি কি বিবাহিতা ?
— আমার নাম রেখা । হ, বিয়া হইছে । আমার হাজব্যান্ড একটু অসুস্হ তো তাই কাজে আসছি টাকার জন্য । সে কাজ করতে পারে না । একটা মরা বাচ্চা হইছিল । এর পর আর বাচ্চা নেই নাই ।
— ওহ, আচ্ছা কোনো টেনশন করো না তুমি । এখানে তোমার কোনো অযত্ন হবে না । আমাকে আপা ডেকেছ না ? মনে করবা আমি তোমার আপা হই । রেখার কষ্টের কথা শুনে অনুর মন গলে পানি !
— রেখা হুনো, তুমি কিন্তু পরিস্কার থাকবা । যেহেতু তুমি রান্না করবা, আমার ছেলেরে রাখবা । একদম ফিটফাট থাকবা । তোমার শ্যাম্পু, সাবান যা লাগব আমি আইনা দিমু নে ।
— জি দুলাভাই, থাকবো ।
অনু, শালি-দুলাভাইয়ের কথার ধরন দেখে রাগে মারুফকে ইশারায় যেতে বলল ।মারুফ নিজের রুমে চলে গেল ।
— আমার সাথে আসো রেখা । এইটা তোমার ঘর । আর এদিকে আসো । এইটা আমার দেবরের ঘর । আগে শাশুড়ি মায়ের ঘর ছিল ।
— মঈন কই তুমি ?
— এই যে ভাবি আমি বারান্দায় ।
— এ হলো আমার এক মাত্র দেবর, মঈন ।
—আর মঈন, ওর নাম রেখা । বড় আপুর শাশুড়ি ঠিক করে দিয়েছেন, এখানে থাকবে ও । ওর হাজব্যান্ড মাঝে মাঝে আসবে এখানে ।
— আইচ্ছা ভাবি ।
— রেখা তুমি তোমার রুমে গিয়ে ফ্রেশ হও ।রেখা যাওয়ার পর অনু মঈনের দিকে তাকাল ।
— ভাবি, এইডা কী রাখছেন বাড়িত ? ঠিক করেন নাই । এই বেডি কাজ করার মতো না ।
— কেনো কি সমস্যা ? কার সমস্যা ভাই ? একটু কও তো ।
— আমনে দেখি আমাগো মতো কতা কন !
— ক্যা মঈন, তুমি ও তো আমাগো মতো শুদ্ধ ভাষা কও । হা হা হা ।
ঘরে গিয়ে অনু মারুফের গাল চেপে ধরল । মারুফ মনে করেছে অনু মজা করে গাল ধরেছে ।কিন্তু, অনুর মাথায় তখনকার রাগ । সেই শোধ নিচ্ছে এখন ।
— এ্যাই বুইড়া বেটা, তোর হুস কবে হবে বল ? তুই কিনে দিবি শ্যাম্পু ? আমি কি মরে গেছি ?
— না, তুমিই কিনা দিবা । কতার কতা কইছি আমি ।
— মনে থাকবে তো ? আর কোনো বেফাস কথা যেনো শুনি না । আর আপুর শ্বশুড়বাড়ির সাথে জড়িত সে , কাজেই এমন কিছু যেনো না হয় যাতে আমার বোন ছোট হয় । মনে থাকবে ভালো মতো ?
— হ, থাকব । এবার ছাড়ো আমারে । তুমি আমারে বুইড়া কইলা ক্যা ?
— বুইড়াকে বুইড়া না বলে কি বলব ? ওহ মনে পড়েছে: বুইডা খাটাশ । এটা ঝিনুর দেয়া নাম ।
— হা হা হা । আগে কও নাই ক্যা ?
— কেনো বললে কি ?
— শালিকারে ধন্যবাদ দিতাম ।
— বেশরম কোথাকার !
এখন আর মারুফ রাত করে বাসায় ফেরে না ।বেশ তাড়াতাড়িই আসে । এসে ফ্রেস হয়ে ড্রয়িংরুমে বসে টিভি দেখে । যদিও আগে সে টিভি দেখার প্রতি এত মনোযোগী ছিল না ।কেনো মারুফের এত পরিবর্তন অনু বুঝতে পারে না । একদিন তাই অনু মারুফকে জিজ্ঞেস করে ।
— আপনি যে এখন বাসায় আগেই চলে আসেন ! ফার্মে কি কোনো সমস্যা হয়েছে ? সব ঠিক আছে তো ?
— হ, সব ঠিক আছে । কাজ কম তাই আইয়া পড়ি । ক্যা তুমি খুশি হও না ?
— কেনো খুশি হবো না ? আর খুশি হবোই বা কেনো বলেন ? আপনি বাসায় এসে কি আমাকে সময় দেন ? সারাক্ষণ তো জি সিনেমা নিয়েই থাকেন ।
মারুফ কোনো কতার উত্তর দেয় না । তার উত্তর দেয়ার কোনো পথ নাই আইজকা । অনু তো সত্য কতাই কইছে । সে ড্রয়িংরুমে থাকেই রেখারে দেখার লাইগা । বেড রুমের দরজায় পর্দা দেওয়া, কেমনে রেখারে দেইখা সুখ নিমু ? আর রেখারে ভাও করতে অইবো না ? চোখের ইশারা না করলে বুঝমু কেমনে যে, ও রাজি আছে ? কয়দিন ধইরা হের লাইগাই তো আগে বাড়িত আহি ।
চলবে…..
✍?নায়না দিনা