#অনুরিমা
#পর্ব_৫
#মেঘা_সুবাশ্রী (লেখিকা)
[[যারা কপি করবেন অন্তত আমি পোষ্ট করার ৬ ঘন্টা পরে করবেন। অন্যথায় কপি করা নিষিদ্ধ।]]
লাল রঙা মোটা প্রলেপের সিঁদুরে ললাটের সিঁথির উপরিভাগ আবৃত, গায়ে তার লাল টুকটুকে শাড়ি আর দু’হাত ভর্তি চুড়ির সাথে লাল সাদায় দু’খানা শাখা পরিহিত। শাড়ির আঁচল গোল করে মাথায় ঘোমটা দিয়ে গুটি গুটি পায়ে বেরিয়ে আসে ষোড়শী নববধূটি।
এখনো বাইরে আবছা আলোয় ডেকে রাখা। চারদিকে ভোরের আলো ফুটছে বলেই। উদ্দেশ্য তার প্রিয় বন্ধুর সাথে দেখা করা। তাকে আবার সূয্যিমামার আলোয় আলোকিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বাড়ি ফিরতে হবে। খোলা মাঠের আইল ধরে ত্রস্তপায়ে সে ধীরে ধীরে এগিয়ে যায়। আশেপাশে সর্তক দৃষ্টি রাখে সে। তার শ্বশুরবাড়ির লোকজন একবার দেখলে সে মহাবিপদে পতিত হবে।
অনুরিমার মাত্রই ঘুম ভেঙেছে। জায়েদা নামায পড়ার জন্য তাগাদা দিলেন। কিন্তু তার আজ নামাজ পড়তে হবে না। তাই সে পুনরায় বিছানায় গা এলিয়ে শুয়ে পড়লো। কিছুক্ষণের মাঝে তার আঁখিপল্লব ঘুমের দেশে পাড়ি জমিয়েছে। আচমকাই কারো খিলখিল শব্দে তার ঘুম ভেঙে যায়। অনুরিমা যারপরনাই অবাক তার প্রিয় বান্ধুবীকে ভোর সকালে দেখে। উচ্ছ্বসিত হয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে। আহ্লাদী কন্ঠে বলে উঠল,
_এত ভোরবেলায় কি মনে করে এলি?
সবিতার মুখে বিষন্নতার ছায়া। সে চাইলেও তার বান্ধুবীর সাথে যখন তখন দেখা করতে কি আর পারবে। সে এখন নতুন বউ হয়েছে। নতুন বউরা মনের খেয়াল খুশি মত কি আর চলতে পারে। তার উপর অনুরিমাদের সাথে তার শ্বশুর বাড়ির দাঁ-কুমড়ো সম্পর্ক এখন। তার চোখেমুখে উৎকন্ঠার ছাপ। কিন্তু মুখে মলিনতার হাসি ঝুলিয়ে বলে উঠল,
_কেনো? আমি আসতে পারি না। বান্ধুবীর বাড়ি আসতে কি এবার থেকে অনুমতি নিতে হবে।
_আমি কখন বললাম, অনুমতি নিতে হবে। তোর সংসারজীবন কেমন যাচ্ছে’রে? তোর শাশুড়ী তোকে আদর করে? সূর্য’দা নিশ্চয় তোকে খুব ভালোবাসে তাই না।
সবিতা মলিন হাসির সাথে দীর্ঘশ্বাস টানলো। নেত্রকোনা ছলছল করে উঠলো তার। অধর কামড়ে নিজের চাপা কান্না আটকাতে চাইলো। হা’ করে নিশ্বাস ছেড়ে বলে উঠল,
মাঝে মাঝে ভাবি আমার জন্মটাই যদি না হতো আমার বাবা-মায়ের জন্য অনেক ভালো হত। অন্তত আমার জন্য তাদের উঠতে বসতে কারো গালমন্দ শুনতে হতো না। কেউ নিজের নাক উঁচিয়ে বলতে পারতো না মেয়ে বিয়ে দিয়েছে ভিখারির মত। মেয়ের গায়ে অলংকারে মোড়াতে না পারলে মেয়ে বিয়ে দেয়ার কি দরকার। মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে যে পণ দিতে হয়, তাদের আচার অনুষ্ঠানে মেয়ের বাবার হাত খরচ করতে হয়, সব রীতিতে জামাইয়ের পরিবারকে জামা-কাপড় দিতে হয় সেটা মেয়ে জন্মের সময় মনে ছিল না। এখন কেনো মেয়ের বাড়ি থেকে ঠিকঠাক তত্ত্ব আসে না। মেয়ে বিয়ে দিয়ে তারা আমার ছেলের ঘাড়ে তুলে দিয়েছে সব। মেয়ের খাওয়া-দাওয়া, কাপড়-চোপড়, এসব কোত্থেকে আসে? আমার ছেলে কি দাওয়াখানা খুলে রেখেছে না’কি?
সবিতা শাশুড়ীর বলা তিক্ত কথাগুলো মনে করে ঠুকরে কেঁদে উঠল। দু’চোখ ঝাঁপিয়ে অশ্রুপাত ঘটে তার মুখশ্রীতে। অনুরিমাকে ঝাপ্টে ধরে সে। মনের ভিতর তার একটা বাক্যেই নিঃসৃত হয় তার,
শাশুড়ী খুব ভালোবাসে’রে। এতটাই যে নিজের বাবা-মায়ের কথাও মনে করার সময় দেয় না। আর সে’তো স্বামীর রাতের শয্যাসঙ্গী শুধুমাত্র। রাতের শয্যাসঙ্গীর হৃদপিণ্ড বলে একটা অংশ যে আছে সেই কথা তার স্বামী দিনের আলোয় বেমালুম ভুলে যায়। তার কাছেও অনুভূতি আছে, ভালো মন্দের তফাৎ সেও বুঝে। এ কথা কখনো তার স্বামী নামক ব্যক্তি বুঝেইনি। এটাই তো তার সংসারজীবন। মুখে তার নিষ্করুণ হাসি। কিন্তু তাচ্ছিল্যর স্বরে বললো,
_বাদ দেয় আমার কথা। তোর কথা বল। শুনলাম তুই না’কি স্কুলে আবার যাচ্ছিস?
অনুরিমার চোখে-মুখে হাসির ঝিলিক। হুম বলে মাথা নাড়াই। কিন্তু বান্ধুবীর করুণ অবস্থা দেখে তার মনেও বড্ড বিষাদে পরিপূর্ণ হলো। সে ব্যগ্রকন্ঠে বলল,
_সূর্য’দা সত্যিই তোকে ভালোবাসে না?
হ্যাঁ’ বাসে তো, রাতের বিছানার অন্তরঙ্গতায়। যেখানে সে ভালোবাসার একচ্ছত্র ক্ষমতার মোহমায়ায় আমাকে ডুবিয়ে রাখে। সেখানে চলে তার একক আধিপত্য, তার একান্তই সেচ্ছারিতা। দুটো মনের মিল হোক আর না হোক কিন্তু দু’টো শরীরের মিল হতেই হবে। এই ভালোবাসা রাতের আঁধারের মত দিনের বেলায়ও আমার কাছে বিষাক্ত লাগে। বিয়ের পাঁচ মাসেও এই স্বামী নামক প্রাণী আমার কাছে এখনো বড্ড অচেনা। আমি আগে আফসোস করতাম, হতাশায় জর্জরিত হতাম। কিন্তু এখন আর হইনা। নিজের অদৃষ্টের লিখন বলে মেনে নিয়েছি। কপালে যা হবার তাই হবে। কিছু তো আর করতে পারবো না। তবে এখন আবার নতুন একটা ইস্যু যোগ হয়েছে। তাদের বাচ্চা চাই। বিয়ের পাঁচ মাসেও আমার বাচ্চা হওয়ার লক্ষণ নেই দেখে শাশুড়ী মা’ অলক্ষী, অপয়া, বন্ধ্যা বলে সম্মোধন করেন। অবশ্য এতেও আমার কোনো আফসোস নেই। কিন্তু আফসোস তো তখন লাগে যখন আমার স্বামী আমাকে বলে বাচ্চা না হলে তোর মত একটা বন্ধ্যাকে রেখে আমার কি লাভ। তোকে তোর বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দেবো।
_তুই কাকা আর কাকী’মাকে বলিস নি এসব কথা।
_কি লাভ বলে? আধো কিছু করতে পারবে? তাছাড়া শাস্তি তো তারাই আমাকে দিয়েছে। আমরণ শাস্তি যা আমি গ্রহণ করতে বাধ্য। থাক না আমার কথা। তোর কথা বল? ফারিজ ভাই তোকে কত বড়ো সুযোগ করে দিলে পড়াশোনা করার জন্য। এবার ঠিক করে পড়িস কিন্তু? আরেক’টা কথা বলবো। একটু সাবধানে থাকিস।
_সাবধানে? কিছু হয়েছে বল?
_তুই তো জানিস তোদের সাথে আমার শ্বশুরবাড়ির সম্পর্ক ভালো নয় তাই বলছি কখন কি ঘটে যায়। ফারিজ ভাইকেও সাবধানে থাকতে বলিস। এখন চলি আমি। ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে চারদিকে। তার আগেই বাড়ি ফিরতে হবে আমাকে।
_তোকে খুব মিস করি’রে। আর কখনো তুই স্কুলে যেতে পারবি না তাই না সবিতা? তোর জীবন’টা এমন না হলেও পারতো।
_আমার জীবনে যে ফারিজ নামক কোনো মহানায়কের আগমন ঘটেনি। যদি ঘটত তাহলে হয়তো আজ আমিও তোর মত খোলা আকাশে ঘুরে বেড়াতাম। আমার অদম্য ইচ্ছেগুলোকে মেরে দিয়েছি অনেক আগেই। তাই এখন এগুলো নিয়ে আর ভাবি না। তবে তুই ভালো করে পড়িস। ভালো কিছু করার চেষ্টা করিস। সুযোগ কিন্তু বারবার আসে না’রে অনু। তোর দৈব কপাল তাই হয়তো এই দ্বিতীয় সুযোগ পেয়েছিস নিজেকে প্রমাণ করতে।
_জানি। আমি চেষ্টা করবো নিজেকে প্রমাণ করার। দোয়া করিস। তোর মোবাইল নাম্বার’টা দিয়ে যা সবিতা।
_ নাম্বার তো দিবো তবে তুই নিজ থেকে কল দিস না। আমি তোকে মেসেজ পাঠালে তাহলে দিস। আমার শ্বশুর বাড়ির লোকজন তোদের নাম শুনলে আবার ক্ষেপে যাবে। তখন আরেক ক্ষ্যাচাল হবে আমার সাথে।
_আচ্ছা, মনে থাকবে।
সবিতার মলিন মুখে প্রিয় বান্ধুবীর থেকে বিদায় নিয়ে যায়। মনের আকাশ তার তিমিরাচ্ছন্ন। সেখানে আলো নামক বস্তুটার কোনো অস্তিত্ব নেই। না কখনো নতুন সূর্যোদয়ের আগমন ঘটবে।
সকালের নাস্তা সেরে অনুরিমা স্কুলের উদ্দেশ্য রওনা দেয়। আজকে তার নতুন প্রাইভেট গণিত শিক্ষকের কাছে। হাতঘড়িতে সময় দেখে ঘড়ির কাটা সকাল ৭:৪০ এর ঘরে। প্রফুল্লচিত্তে ছুটে চলে তার পায়ের কদম। নতুন আরেক সকাল তার জীবনে আসবে সে ঘুণাক্ষরেও কি ভেবেছিলো। দৈবচক্রে হয়তো সে এই সকাল পেয়েছে। কিন্তু তার প্রিয় বান্ধুবীর এমন একটা ভোর যেনো আসে। সে দোয়ায় করে মনে মনে। নিজচিত্তে সে সামনে এগিয়ে যায়। কিন্তু কারো বিকৃত বিদ্রুপাচ্ছলে বলা কথায় তার পায়ের কদম থমকে দাঁড়ায়। চায়ের দোকানে টুংটাং শব্দের সাথে সাথে তাদের হাস্যোরসের যোগান দিচ্ছে তাকে নিয়ে কুৎসা রটনায়।
__আকবর মরলেও টাক্যার অভাব পড়ে নাই। মেয়ের গায়ের রঙ বেইচ্যাও সংসার ভালোই চালাইতে পারে। চেয়ারম্যানের পোলার মত মালদার পাইছে এজন্যই সলিলরে বিয়া করে নাই এ ম্যাইয়া। মেয়ের মা’ও পল্টি খাইছে শেষে মেয়ের বিয়া ভাইঙ্গা দিছে। পুরো পরিবার চেয়্যারম্যান পোলার লগে সেই ভাব। ভাই’রে আমার তো মনে হয় এ পোলারে তাবিজ করছে এই পরিবার।
আরেকজন বিজ্ঞের মত ঠাট্রাচ্ছলে বলে উঠল,
_আরে না’রে। তাবিজ লাগে নে। ম্যাইয়ার শরীর বিছাইয়া দিছে হের ল্যাইগা তো এই পোলা দিওয়ানা হই গেছে। ম্যাইয়ার রূপ দেইখ্যা পোলা নিজের ধৈর্য্য ধরে রাখতে পারে নাই। ভালোই আমোদ ফুর্তি চলে তাদের মধ্যে। দিন নাই রাত নাই, এই পোলারে দেখি ঐ বাড়িতে সারাক্ষণ ঘুরঘুর করে।
এসব হাস্যরসে চায়ের দোকানে বসা সবাই বিদ্রুপের সুরে দাঁত কেলিয়ে হেসে উঠে।
অনুরিমা থমকে দাঁড়ায়। পায়ের কদম বাড়াতেই গিয়েও ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকে। ঘৃণায় নিজের শরীর রি রি করে উঠলো। মানুষ কত জগন্য হলে অন্য মানুষকে নিয়ে এমন কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করতে পারে। স্কুলে না যাওয়ার জন্য মনস্থির করলো সে। কিন্তু পরক্ষণে সবিতার বলা একটা কথায় তার মাথায় ঘুরলো।
“সুযোগ একবার আসে বার বার নয়। তাই নিজেকে প্রমাণ করিস অনু।”
অনুরিমা তপ্ত নিশ্বাস ছাড়লো। যাই হয়ে যাক তার পিছনে থাকানোর সুযোগ নেই। সে এবার থেকে সামনে তাকাবে।
_______________________
ফারিজ টেবিলে বসে মাত্রই মুখে খাবার দিচ্ছিলো। সহসাই তার মুঠোফোন কর্কশ শব্দে কম্পিত হলো। সে স্ক্রিনে একবার চোখ বুলালো। ত্বরিত কল রিসিভ করলো। হ্যালো বলতেই যা শুনলো তাতেই স্তব্ধ হয়ে গেলো।
শরাফত ব্যগ্রকন্ঠে বলে উঠল,
_সলিলকে ধরতে পারলেও জসিম মিয়া জামিনে ছাড়া পেয়ে গেছে। জানিস, চৌদ্দ লক্ষ টাকা খরচ করে জসিম মিয়া ছাড়া পেয়েছে। আইন টাকার কাছে বিক্রি হয়ে যাই কত সহজে। বন্ধু তুই সাবধানে থাকিস। ওরা তোর কোনো ক্ষতি করতে পারে। আমি তোকে সাবধান করতে কল দিলাম। তবে জসিম মিয়ার মামলা চলবে।
তিমিরাচ্ছন্ন তার চারপাশ। ফারিজ কপালে হাত দিয়ে বিমর্ষচিত্তে বসে থাকলো। তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে অনুরিমাকে নিয়ে। মেয়েটাকে তার সকল আশংকামূলক বিপদ থেকে বাঁচাতে হবে। সে যখন হতাশায় নিমজ্জিত আচমকা তার কাঁধে কারো ছোঁয়ায় সে আৎকে উঠলো।
চলবে,,,,,,,