#অনুরিমা
#পর্ব_৬ (অন্তিম পর্ব)
#মেঘা_সুবাশ্রী (লেখিকা)
গ্রামের কোণে কোণে পৌঁছে গেছে। ফারিজের বদ উদ্দেশ্য আছে। তাই তো সে অনুরিমার পরিবারকে লোক দেখানো সাহায্যে করছে। দত্ত বাড়ির সুব্রত খুব সন্তুষ্টি নিয়ে চেয়ারম্যান বাড়ি থেকে বের হলেন। আজিজ শেখ উদ্বিগ্ন হয়ে বারান্দায় গা এলিয়ে বসে আছেন। হালিমা এসে দেখেন তার স্বামী উদ্বিগ্ন মুখে মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে। সে নিজেও বেশ চিন্তিত।
আজিজ স্ত্রীর দিকে চেয়ে নিজেকে ধাতস্থ করলেন। তারপর স্ত্রীর উদ্দেশ্য কিছু কথা বললেন যা শুনে হালিমা বেশ রাগান্বিত হয়ে গেলেন। শেষে কিনা এইদিন দেখতে হলো তাকে। তিনি স্বামীর সাথে একমত নয়। ক্রোধান্বিত হয়ে সে প্রস্থান করলো স্বামীর সামনে থেকে।
আজিজ ফারিজের কাছে আসলেন। ফারিজ তখন খাবার টেবিলে। সে পিছন থেকে গলা খাকারি দিয়ে নিজের আগমনের জানান দিলেন। ফারিজের উদ্দেশ্য বলে উঠলেন।
__ মান-সম্মান যা ছিল সব তো খেয়ে দিচ্ছো। এখন বাকি যা টুকু আছে তার মান টা রেখো। তোমার জন্য সমাজে চলা মুশকিল হয়ে যাচ্ছে আমার। শুধু নিজের কথা ভাবলে হয় না। সমাজে চলতে গেলে নিজের পরিবারের কথাও ভাবতে হয়।
__ কি বলবে সোজাসাপ্টা বলো। এত ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বলার কি দরকার।
__ সোজা কথা কি আর সোজাভাবে শুনবে তুমি। যাই হোক সন্ধ্যায় উপস্থিত থেকো বাসায়। তোমার আকদ হবে আজকে।
__ আচমকা আমার আকদ? মানে এসব কি?
__ তোমার তো মান-সম্মানের প্রয়োজন নেই। আমার আছে। তাই যা বলছি সেটাই করবে অন্যথায় এ গ্রামে তুমি এক কদমও রাখতে পারবে না।
ফারিজের মাথায় বিনা মেঘে বজ্রপাত। দিগবিদিক শূন্য সে। এভাবে তার বাবা তাকে শর্ত জুড়ে দেবে সে সত্যি ভাবতে পারেনি। সে খাবার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। বাবার পুরো কথা না শুনে সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো। এলোমেলো কদমে সে গ্রামের শেষ রাস্তায় এসে দপ করে বসে পড়লো। তাদের বাড়ির পাশের সোলাইমান কাকাও তার সাথে বসলেন। ফারিজকে তিনি একটা কথায় জিজ্ঞেস করলেন তোমার কি অনুরিমার সাথে কোনো সম্পর্ক আছে।
ফারিজ অদ্ভুত ভাবে তার দিকে তাকালেন। সে এই ধরনের চিন্তা মাথার মধ্যেও আনে নি। সম্পর্ক তো অনেক দূরের কথা। সোলাইমান কাকার দিকে তাকিয়ে বললো এমন কথা কেমনে বললেন কাকা? মেয়েটা আমার হাঁটু বয়সী। ওর সাথে আমার কিসের সম্পর্ক থাকবে? সোলাইমান কিঞ্চিৎ হাসলেন। তারপর আবার বললেন কিন্তু তুমি কি জানো গ্রামে এটা নিয়ে কত কুৎসা রটনা হইছে। বেবাকেই এটা নিয়ে কানাঘুষা করতেছে। আমি বলি কি তুমি বিয়ে কইরালো। তাইলে মানুষ তোমারে বাজে কথা রটাইবো না। আর মেয়েটাও এসব কথা থেকে বেঁচে যাবে। ফারিজ আকাশ পানে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস টানে। তার বিয়ে হলে যদি মেয়েটা ভালো থাকে তো তবে তাই করবে।
____________
স্কুল থেকে দ্রুতই বাড়ি ফিরে আসে অনুরিমা। সবাই তার দিকে কেমন বিকৃত লালসার দৃষ্টিতে তাকাচ্ছিলো। কারো মুখে তাচ্ছিল্য তো, কারো মুখে কামুকতার হাসি। কেউ কটাক্ষ করছে তো কেউবা মজা উড়াচ্ছে তার। সে সহ্য করতে না পেরে বাড়ি ফিরে আসে। কি লাভ হলো তার দ্বিতীয় সুযোগ পেয়ে। পুরুষহীন সমাজে বেঁচে থাকা যে নরক যন্ত্রণার মত। আজ তার বাবাকে খুব মনে পড়ছে। সে ঘর থেকে ছুটে যায় বাবার কবরের পাশে। দু’চোখের জল ছেড়ে দিয়ে শত অভিযোগ নিয়ে বসেছে সে।
ও বাবা এভাবে আমাদের মাঝ দরিয়ায় কেনো ছেড়ে গেলে? জানো সবাই তোমার মেয়েকে কেমন বিশ্রী নজরে দেখে। কেউ কেউ তো তোমার মেয়ের চরিত্র নিয়ে কথা বলে। আমার নাকি বাজে চরিত্র। আমি শরীর বেঁচে খাই। ও বাবা আমার তো মরে যেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু মরতেও পারি না। আমি যে মরণ’রে ভয় পাই। ও বাবা তুমি ফিরে আসো না। তোমার মেয়েদের বাঁচাতে। তুমি থাকলে কেউ খারাপ কথা বলতে পারবে না।
আড়ালে দাঁড়িয়ে ফারিজ অনুরিমার সব কথাই শুনলো। সে বুঝে গেছে তাকে কি করতে হবে। যা করার এখুনি করতে হবে। নয়তো সময় যত গড়াবে ততই জল ঘোলা হবে। সে তার পকেট থেকে মুঠোফোন বের করে নিজের বাবাকে কল দিলো। তিনি ফারিজের কথা নিরবে শুনলেন। হ্যাঁ বা না কিছুই বললেন না। ফারিজও আর কিছু না বলে ফোনকল রেখে দেন। সে এবার শরাফতকে কল দিলেন। তাকে বললেন সব ব্যবস্থা করতে। সন্ধ্যার মধ্যেই যেনো সব প্রস্তুত থাকে।
________________________
অনুরিমা এখনো অবিশ্বাস্য নজরে তাকিয়ে আছে মায়ের দিকে। জমিলা এসে নাতনিকে বিয়ের একটা বেনারসি শাড়ি পড়িয়ে দিলো। গলায় কিছু গহনা আর হাতে চুড়ি পরালো। মাথায় সিঁথি করে তার মাঝে একটা লম্বা ঝুলন্ত টিকলি পরালো তাকে। তারপর লাল রঙা ওড়না মাথায় দিয়ে বড়ো করে ঘোমটা টেনে দিলো। জমিলা খুশিতে বার বার দু’চোখের জল মুচ্ছিলেন। অনুরিমাকে জড়িয়ে ধরা গলায় বললেন তোর দুঃখের দিন শেষ’রে মুখপুড়ি। এবার তোর সুখের দিন আসবে দেখিস বোন। তোকে আর কাঁদতে হবে না, তুই এবার খিলখিল করে হাসবি।
অনুরিমা তপ্ত নিশ্বাস ছাড়লো। তার তো ভীষণ লজ্জা করছে। এখনো ভাবতেই পুরো শরীর কেমন কাঁটা দিয়ে উঠছে তার। আপ্তি মিটমিট করে হাসছে আর বোনের বেশ মজা উড়াচ্ছে। সে তো মনে মনে চাইতো এমন একজন মানুষ তার দুলাভাই হোক। কতবার বোনকে বলেছে সে এই কথা। সত্যিই তার মনের আশা পূর্ণ হয়েছে এখন।
সন্ধ্যার মধ্যেই মোটামুটি সব আয়োজন সম্পন্ন হয়েছে। গ্রামের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ আর পুলিশকেও ডাকা হয়েছে। কোনো ঝামেলা যাতে না হয় তাই এ ব্যবস্থা। চেয়্যারম্যান আজিজ শেখ চুপচাপ এককোণে বসে আছে। তার মুখে কোনে রা’ নেই। সে না চাইলেও এই বিয়েতে থাকতে হবে। সমাজে মাথা উঁচু করে বাঁচতে হলে তাকে এই কাজ করতেই হবে। যদিও তার নিজের ইচ্ছে নেই এমন মেয়েকে তার ঘরের বউ করার। কিন্তু তার ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে হলে এই বিয়ে দেয়া ছাড়া কোনো বিকল্প নেই তার কাছে। তার উপর তার সম্মান নিয়ে টানাটানি। এই বিয়ের মাধ্যমেই সব ধামাচাপা দিতে চাই সে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই কাজি সাহেবও এসে উপস্থিত হলেন। শরাফত তার টিমের কয়েকজন নিয়ে এসে পড়লেন। তার গায়ে পুলিশ ইউনিফর্ম নেই। কারণ বন্ধুর আকদ অনুষ্ঠান বলে কথা। তাই সিভিল পোশাকে সে উপস্থিত হয়েছে। বিয়ে’টা এখন আইনিভাবে সম্পন্ন হবে না। কারণ মেয়ের এখনো আটারো হয়নি। তাই আইনিভাবে রেজিষ্ট্রেশন হলেও তা বৈধতা পাবে মেয়ের আটারো পূর্ণ হলে। এজন্য তার বন্ধু তাকে আসতে বলেছে যাতে কোনো ঝামেলা না হয়।
কাজি এসে প্রথমেই খাবার খেলেন তারপর বিয়ে পড়ানোর কাজ শুরু করলেন। কালক্ষেপন না করেই কিছুক্ষণের মধ্যেই সাদা পাঞ্জাবি-পায়জামা পরিহিত, মাথায় সাদা টুপিতে আবৃত ফারিজও উপস্থিত হলেন। সেও বিয়ে পড়ানোর জন্য হ্যাঁ বলে সম্মতি দিলেন।
বিয়ে পড়ানো শেষ হলে সবাই আলহামদুলিল্লাহ বলে উঠলেন। কাজি চলে গেলেও বাকি মেহমান খাবার খেতে ব্যস্ত। আজিজ শেখের কাজ শেষ তাই তিনি বাড়ি যাওয়ার উঠে দাঁড়ালেন। ফারিজ দেখেও আর পিছু ডাকলো না। ঘন্টা খানেকের মধ্যে ঘর মোটামুটি খালি হয়ে গেলো। শরাফতও উঠে চলে যেতে চাইলো। কিন্তু ফারিজ তাকে আঁটকালো। আমিও তোর সাথে যাবো। তবে যাওয়ার আগে কিছু কাজ আছে সেরে আসছি। সে আলগোছে ঘরের ভিতরের রুমে প্রবেশ করলো। অনুরিমার রুম খুঁজতে খুব একটা বেগ পোহাতে হলো না। সে সোজা তার রুমে প্রবেশ করলো। রুমের মধ্যে যারা ছিলো তারা দ্রুত বের হয়ে গেলো ফারিজকে দেখে।
অনুরিমা আচমকা ফারিজকে তার রুমে দেখে সে আৎকে উঠলো। লজ্জায় আর অস্বস্তিতে কাঁচুমাচু করছিল সে। ফারিজ অনুরিমার অস্বস্তি বুঝতে পারলেন। তবুও সামনে এগিয়ে এসে অনুরিমার মুখোমুখি বসলেন। কোনো ভণিতা ছাড়াই বললো,
তোমার আমার বয়সের পার্থক্য প্রায় নয় বছরের। পনেরো বছরের একটা বাচ্চা মেয়ে বিয়ে করার কোনো ইচ্ছেই আমার ছিলো না। না তোমার প্রতি আমার কোনো অনুভূতি ছিল। কিন্তু তাও তোমার আর আমার মাঝে একটা পবিত্র সম্পর্ক হয়ে গেছে আজ থেকে। তাই আমি যা বলবো তা মনোযোগ দিয়ে শুনবে। আমার স্ত্রী হতে গেলে প্রথমেই তোমাকেই শিক্ষিত হতে হবে। সৎ-সাহসী হতে হবে। কারো ভয়ে নিজেকে গুটিয়ে নিবে না। সত্যি কথা বলতে কখনো ভয় পাবে না। যাই হয়ে যাক লক্ষ্য স্থির রাখবে। আমার এসব শর্ত যদি পালন করতে পারো’তো তাহলে আমার স্ত্রী হিসেবে স্বীকৃতি পাবে। অন্যথায় আমি কোনো অশিক্ষিত মেয়েকে নিজের স্ত্রীরূপে গ্রহণ করবো না। আসি।
কথাগুলো বলেই ফারিজ বের হয়ে যাই। কিন্তু কিয়ৎক্ষন বাদে আবার ফিরে আসে। অনুরিমা এখনো আগের মতই বসে আছে। ফারিজ এসেই আচমকা অনুরিমার কপালে একটা চুমু খেয়ে নিলো। তারপর মুচকি হেসে বলল এটা আমার দেয়া প্রথম উপহার। যত্ন করে রেখো। আসি অনুকণা।
অনুরিমা এখনো বাকরুদ্ধ হয়ে আছে। কিন্তু সেও মুচকি মুচকি হাসছে। ফারিজের দেয়া চুমুর জায়গায় হাত দিয়ে বসে আছে সে। এটা তার স্বামীর দেয়া প্রথম ছোঁয়া সে বিশেষ যত্ন করে রাখবে। এরকম একটা জামাইয়ের জন্য সে সব করতে রাজী। সে পড়বে খুব পড়াশোনা করবে। তার যে এই জামাইকে অবশ্যই চাই। জানালার গ্রিল ধরে সে আড়াল থেকে ফারিজের গাড়ি যাওয়ার দিকে একমনে তাকিয়ে আছে। বক্ষস্থল ভীষণ পুঁড়ছে তার সদ্য হওয়া জামাইয়ের জন্য। আনমনে তার মন বিড়বিড় করলো,
কবে আসবেন আবার? আপনার জন্য কত দীর্ঘ রজনী অপেক্ষা করতে হবে আমাকে? খুব কষ্ট হবে আমার ‘উকিল সাহেব’।
__________সমাপ্তি_________