#অন্তরালে_তুমি
#Part_16
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
?
আরিহা এইবার মুখ তুলে তাকাতেই এক অনাকাঙ্ক্ষিত মানুষের চেহারা তার চোখের সামনে ভেসে উঠে। সে বরং আর কেউ নয় ইহান। আরিহা অপলক দৃষ্টিতে ইহানের মুখের পানে তাকিয়ে থাকে। ইহান ওকে নিজের কাছ থেকে সরিয়ে নিয়ে রাস্তার ও পারে নিয়ে আসে। তারপর কর্কশ কণ্ঠে বলে,
— এত তো জ্ঞানী জ্ঞানী কথা বলো আর ম্যাচুরিটি দেখাও। তো রাস্তা পার হওয়ার সময় কি এইসব জানালা দিয়ে দৌঁড়ে পালায়?
এখনই তো অঘটন ঘটে যেত। আমি ঠিক সময়ে না আসলে কি হতো বুঝতাসো?
আরিহা কিছু না বলে শুধু ইহানের মুখের পানে তাকিয়ে থাকে। বুঝার চেষ্টা করতে থাকে একটু আগে ঠিক কি হয়েছিল ওর সাথে। অতঃপর বুঝতে পেরে কিছু না বলে দ্রুত সেখান থেকে চলে যায়। ইহান এইবার হ্যাবলার মত দাঁড়িয়ে থাকে। আর বিরবির করতে থাকে,
— কি হলো এইটা? আমি ওকে বাঁচালাম আর ও থেংক্স না বলেই চলে গেল? ইজ সি মেড ওর হোয়াট? যদি আমি না বাঁচাতাম তখন কি হতো?
বাই দ্যা ওয়ে আমি ওর ব্যাপারে এত ভাবছি কেন? হু দ্যা হেল ইজ সি টু মি? এইসব ফালতু বিষয়ের প্রতি গুরুত্ব না দিয়ে আসল কাজে লেগে পর। বেশি সময় নেই আর।
____________________________________
আরিহা রকিং চেয়ারে হেলান দিয়ে শুয়ে আছে। চোখ দুটো বন্ধ তার। মনের মধ্যে হাজারো প্রশ্ন উঁকি ঝুঁকি করছে। কিন্তু কোনটির উত্তরই তার কাছে নেই। সবই যেন ধোঁয়াশা। এই প্রথম আরিহা এত দ্বিধাদ্বন্দের মধ্যে ভুগছে। হিসাবের সমীকরণ যেন আজ তার মিলছেই না। আরিহা এইবার তার মাথাটা চেপে বসে আর বিরবির করতে থাকে,
— কি হচ্ছে আমার সাথে এইসব? কেন আমি আমার প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাচ্ছি না? কেন বুঝতে পারছি না ইহানের বুকে মাথা রাখতেই আমার অশান্ত মন শান্ত হয়ে গেল? ছোট বেলা থেকে যে ঝড় আমার মধ্যে বইছে তা পরক্ষণে কিভাবে শান্ত হলো?
যে শান্তিটা এতটা বছর ধরে খুঁজে আসছি আজ তা কয়েক মিনিটের ব্যবধানে আমার শরীরে শীতল বায়ুর মত বয়ে গেল। আমার অন্তরালে কি তাহলে অন্যের বসবাস তৈরি হতে শুরু করেছে?
আরিহা কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকে। আরিহার মন এতটা বছর ধরে যতটা না অশান্ত ছিল এখন তার চেয়ে বেশি অশান্ত হয়ে উঠেছে। নিজের মধ্যে সেই শান্তিটা আবার অনুভব করার তীব্র আকাঙ্খা যেন বার বার এসে হানা দিচ্ছে ওর মনে। পারছে না নিজেকে সামলাতে।
____________________________________
আজকে ফ্যাশন শোটি হোস্ট করা হয়েছে৷ চারদিকে মানুষের অনাগনা শুরু হয়ে গিয়েছে। মডেলরাও রেডি। আরিহা সবকিছু ভালো ভাবে চেক করছে কোন জায়গায় কোন কমতি আছে নাকি। দেখতে দেখতে অনুষ্ঠানটি শুরু হয়ে যায়।
একে একে সকলে এসে মডেলিং করে। আরিহার ডিজাইন করা জামাগুলো প্রদর্শন হতে থাকে।ড্রেসের ডিজাইন দেখে সকলেই মুগ্ধ হয়ে যায়। এইদিকে ইন্সপেকশন করতে কয়েকজন লোক আসে। আরিহা ড্রেসগুলো আগে থেকেই একটা রুমে সাজিয়ে রেখেছিল। ইন্সপেকশন অফিসাররা ড্রেসগুলো দেখতে থাকে। ড্রেসের কোয়ালিটি, মান, ফেব্রিক্স সকল কিছু চেক করতে থাকে। সকল ড্রেস দেখার শেষে যখন লাস্ট ড্রেসটা তারা দেখতে যায় তখন কিছু ত্রুটি বেড়িয়ে আসে। সাথে ফেব্রিক্স আর মানও নিম্ন মানের বের হয়। তা দেখে সকলে রেগে যায় আর আরিহাকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে। মাঝে একজন বলে উঠে আরিহা ফ্রোড। ও অসৎ উপায়ে ব্যবসা করছে। জনগনদের ঠোকাচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই এই নিয়ে মাতামাতি শুরু হয়ে গেল।
এইদিকে আরিহা বুঝে উঠতে পারছিল না এইসব কিভাবে হলো। সে তো সব কিছু নিজ হাতে চেক করেছিল। আরিহা এইবার আমার চেক করে এইসব কিভাবে হলো। অতঃপর চেক করে বুঝতে পারলো এইটা ট্রায়াল দেখার জন্য বানানো ড্রেসটি। ট্রায়াল এর জন্য বানানো বলে এইটি নিম্ন মানের কাপড় দিয়ে বানানো হয়েছিল।
কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর আগে ডিজাইনারকে একটা ট্রায়াল ড্রেস বানাতে হয়। যাতে সে পরক্ষ করতে পারে যে ড্রেসটা আসলে বানালে কেমন লাগবে। এর মধ্যে কোন পরিবর্তন করতে হবে কিনা। অতঃপর সব ঠিক হলেই ড্রেসটি চূড়ান্ত পর্যায়ে যায় আর পরিকল্পনা মাফিক বানানো হয়।
কিন্তু এইখানে এই ড্রেসটি কিভাবে আসলো সেটাই আরিহা বুঝছে না। তার উপর যে ড্রেসটা সকলকে প্রদর্শনের জন্য আনা হয়েছিল ওইটি বা কই। এইদিকে পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে। সকলেই আরিহাকে দোষারোপ করা শুরু করেছে। কিভাবে যেন প্রেস মিডিয়ার কানে নিউজটি চলে যায়। আর তারাও এই নিউজটি নিয়ে মেতে উঠে।
আরিহা অনেক কষ্টে সবকিছু সামাল দেয়। ইন্সপেকশন অফিসারদের বুঝায় এইখানে সামান্য ভুল হয়েছে। ড্রেসটা এক্সচেঞ্জ হয়ে গিয়েছে। আরিহা একটু টাইম চায় সব কিছু ঠিক করার। তারা আরিহাকে অনেক আগে থেকে চিনে বলে তারা আরিহাকে একটু টাইম দেয়।
আরিহা সেই সময়ের মধ্যেই সব মেনেজ করে ফেলে। ভাগিস ও সকল ড্রেস ডাবল করে বানিয়ে রেখেছিল যার জন্য সে দ্রুত সব কিছু নিজের আয়ত্তে নিয়ে আসতে পারে।
অতঃপর অফিসাররা এপ্রুভ করে আর আরিহাকে বলে এইসব বিষয় নিয়ে আরও কেয়ারফুল হতে। এইসব বিষয়ে এত হেলামি না করতে। এইদিকে প্রেসের সামনেও সব ক্লিয়ার হয়ে যায় আর তারাও শান্ত হয়ে যায়।বআজ একটুর জন্য আরিহার মান-সম্মান ধুলোয় মিশে নি। যদি আজকে এইসব ক্লিয়ার না হতো তাহলে হয়তো আরিহার গড়া এত কষ্টে প্রতিষ্ঠান চোখের পলকে মাটিতে মিশে যেত।
সকলের যাওয়ার পর আরিহা নিজের কেবিনে মাথা চেপে বসে থাকে। আজকের কথাগুলো বেশ পিরা দিচ্ছে ওকে। কিভাবে এইসব হলো সে তাই বুঝতে পারছে না। আজ যে সে পুরোপুরি ভাবে নিঃস্ব হয়ে যেত এই নিয়ে আরিহার কোন সন্দেহ নেই। এইসব ভেবেই আরিহার মাথা ফেটে যাচ্ছে।
এমন সময় ইহান ওর কেবিনে আসে। তারপর তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলে,
— তো মিস আরিহা এমন এক ভয়াবহ পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়ে কেমন লাগছে তোমার? নিশ্চয়ই অনেক ভালো। এইবার বুঝলে সময়ের সামান্য ব্যবধান জীবনের অনেক কিছু কেড়ে নিতে পারে?
ইহানের আওয়াজ কানে আসতেই আরিহা মাথা তুলে ইহানের দিকে তাকায়। তারপর কিছুক্ষণ শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলে,
— তার মানে তুমি এই ড্রেসের অদলবদল করেছিলে? কিন্তু কেন?
ইহান এইবার রেগে গিয়ে বলে,
— নিজেকে জিজ্ঞেস করো না কেন? এই সময়ের ব্যবধানের জন্যই আমায় পুরো ১ সপ্তাহ অনেক কিছু সাফার করতে হয়েছিল। নিজের মান-সম্মান ধুলোয় মিশতে দেখতে হয়েছিল। অপদস্ত হতে হয়েছিল। তুমি যদি আগেই সব ক্লিয়ার করতে তাহলে আমায় এতকিছু সহ্য করতে হতো না।
তাই তোমাকেও বুঝাতে চেয়েছিলাম সামান্য সময়ের ব্যবধানে মানুষের জীবন পুরোপুরি পালটে যেতে পারে। তাই আমি ইচ্ছে করেই ড্রেসটা সরিয়ে দিয়েছিলাম যাতে তুমি সামান্য হলেও বুঝতে পারো মিথ্যে অপবাদ বহন করতে কেমন লাগে। আর এতে আমি সক্ষমও।
তুমি যে এই অপবাদ থেকে উঠে যেতে পারবে তা আমি জানতাম। কেন না তুমি সকল ড্রেস ডাবল করে বানাও। যার জন্য তুমি নিজেকে প্রুভ করতে পারতে। আমি শুধু তোমাকে সেই অনুভূতিটা অনুভব করাতে চেয়েছিলাম যা আমি পেরেছি। যতই হোক একটা মেয়ের সম্মান তো পুরোপুরি ভাবে মিশিয়ে দিতে পারি না।
আরিহা এইবার শান্ত ভাবেই বলে,
— তো আমার পিছে এতদিন ঘুর ঘুর করে আমার মাইন্ড ডাইভাড করতে চেয়েছিলেন তাই তো? যাতে আমি মনে করো ইউ লাইক মি অর ইউ লাভ মি। আর আপনার আসল মতলবের দিকে আমার নজর না যায়। রাইট!
ইহান হেসে বলে,
— একদম ঠিক। তোমাকে আর আমি ভালবাসবো? দ্যাট ইজ ইম্পসিবল। আই জাস্ট হেট ইউ৷ তোমার ছাঁয়াও আমার সহ্য হয় না সেখানে তোমাকে ভালবাসা তো দূরের কথা। আমি যা করেছি সবই ছিল প্রতিশোধের অংশ।
কিন্তু তাও আমি তুলনামূলক ভাবেই কমই নিয়েছি। আমার মত তোমায় এতকিছু সহ্য করতে হয় নি। সো থেংকড মি।
আরিহা এইবার মুচকি হেসে বলে,
— তা তো দিবই ইহান বেবি। এত কষ্ট যখন করেছ তার ফল তো তুমি অবশ্যই পাবে। একটু সবুর ধরো। কিন্তু আজ শুধু এতটুকু জেনে নাও যে, আই লাভ ইউ এন্ড ইউ হ্যাভ টু ওলসো লাভ মি। নাও বাই!
এই বলে আরিহা আর কিছু না বলে নিজের ব্যাগ আর গাড়ির চাবি নিয়ে বেড়িয়ে পড়ে। আর ইহান হতভম্ব হয়ে আরিহার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। কি বলে গেল সে? মানে কি?
এইদিকে আরিহা ড্রাইভ করছে আর মনে মনে বলছে,
— কাজটা ঠিক করো নি। আজ তুমি আমার সেল্ফ রেস্পেক্টের উপর আঘাত করেছ। আমি সব কিছু সহ্য করতে পারি কিন্তু নিজের সেল্ফ রেস্পেক্টের উপর কোন আঘাত আমার সহ্য নয়। এর ফল তো তুমি পাবেই।
যে গল্পের সূচনা তুমি করেছো তার ইতি আমি টানবো। স্বেচ্ছায় আমার জীবনে এসেছো তুমি। ভালবাসা নিয়ে যখন অধিকার দেখিয়েছ তখন তো আর পিছ পা হতে পারবে না তুমি। গেট রেডি ইহান মাহমুদ আরিহা নামক পিঞ্জরাতে বন্দী হওয়ার জন্য।
_________________________________________
এই কিছুদিন পরেই আরিহা ইহানকে কিডন্যাপ করে আর তাকে নিয়ে সোজা হাজির হয় কাজি অফিসে। এর পরের কাহিনী আপনাদের সকলের জানা।
?
নিজের শরীরে তরল জাতীয় কিছু অনুভব করতেই ইহান অতীতের তীক্ত স্মৃতি থেকে বেড়িয়ে আসে। চারপাশে তাকিয়ে দেখে সে ছাদে। চারদিকে মুশলধারে বৃষ্টি শুরু হয়ে গিয়েছে। ইহান এইবার আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবতে থাকে,
— আসলেই কি ভুলটা তোমার ছিল নাকি আমি কি ভুল বুঝেছিলাম তোমায়?
হ্যাঁ আমিই ভুল বুঝেছিলাম তোমায়। সেইদিন তোমার দোষ ছিল না কিন্তু তাও আমি তোমায় দোষ দিয়ে গিয়েছিলাম। তুমি যদি সেইদিন সত্যিটা সবাইকে না জানাতে তাহলে আমার ক্যারিয়ার তো সেখানেই শেষ হয়ে যেত। লাইফ টাইমের জন্য রেপিস্টের ট্যাগ লেগে যেত আমার গায়ে। সারাজীবনের জন্য কলঙ্কিত হয়ে বেরাতো হতো আমায়। এইটা কখনো ভাবি নি যে, যেখানে আমি সামন্যটুকু অপবাদ, অপমান, অপদস্ততাই নিতে পারছিলাম না সেখানে সারাজীবন কিভাবে এইসব বয়ে বেরাতাম?
রাগ আর ঘৃণায় অন্ধ হয়ে গিয়েছিলাম যার জন্য ভালো মন্দ বুঝার ক্ষমতা হারিয়ে ফলেছিলাম। খুব অন্যায় করে ফেলেছি তাই না। দিনের পর দিন ঘৃণাই তো করে গেলাম। অথচ তুমি ঘৃণা পাওয়ার মত কোন কাজই করো নি। প্রথম দিন হতে তোমার জন্য পুষে রাখা ক্ষোপ থেকেই এতকিছু।
আচ্ছা সব ভুলে কি নতুন করে সব শুরু করা যায় না? হ্যাঁ যায়! অবশ্যই যায়। কালকে থেকে নতুন এক অধ্যায়ের শুরু হবে। ইহানের নতুন রুপ দেখবে তুমি।
এই বলে হাল্কা হাসে সে। বৃষ্টিতে ভিজার ফলে গায়ের শার্টটি পুরো লেপ্টে গিয়েছে। চুল বেয়ে টুপটুপ করে পানি পড়ছে। হুট করেই ইহানের মাথায় একটু প্রশ্ন জেগে উঠে আর সে ভাবতে শুরু করে।
— আরিহা আমায় বিয়ে কেন করেছিল? ভালবেসে নাকি প্রতিশোধ নিতে? নাকি অন্যকিছুর জন্য? আরিহা কি আদো আমায় ভালবাসে?
#চলবে