অন্তরালে তুমি পর্ব-২৪

0
2128

#অন্তরালে_তুমি
#Part_24
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
?
আরিহা নিজের কেবিনে বসে আছে। বা হাতটা মাথায় চেপে ধরে গভীরভাবে কিছু একটা ভাবছে সে। ডান হাত দিয়ে পেপার হোল্ডার বলটি ঘুরাচ্ছে সে। মূলত কালকে রাতের জিসানের বলা কথাগুলোই ওকে ভাবাচ্ছে। ভীষণ ভাবাচ্ছে। দ্বিধাদ্বন্দে ভুগছে কি করবে সে। ঠিক এমনই সময় কেউ হুর হুর করে আরিহার কেবিনে ঢুকে পড়ে। কাউরো উপস্থিতি অনুভব করতে পেরে আরিহা মাথা তুলে তাকায়। মাথা তুলে তাকানোর সাথে সাথেই ওর ভ্রু কুচকে আসে। জিসান একটা কেলানি মার্কা হাসি দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। জিসান সেই হাসি মুখে ঝুলিয়ে রেখে আরিহার সামনের চেয়ারটা টেনে বসে। তারপর একটু দুষ্টুমি সুরে বলে,

— আমার কথা ভাবছিলে বুঝি? ইশশ! কত ভালবাসো আমায়। সারাদিন শুধু আমার কথাই ভাবো। এত ভালবাসা যে আমি কই রাখি, সকল জায়গা তো ফুরিয়ে আসলো। এখন কি করি?

এই বলে থামে জিসান তারপর কি যেন ভাবছে এমন অভিনয় করতে থাকে। জিসানের এমন উদ্ভট কথায় আরিহার ভ্রুকুটি আরও কুঞ্চিত হয়ে আসলো। সে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে জিসানের দিকে তাকিয়ে থাকে। জিসান সেইসব তোয়াক্কা না করে আরও কিছুক্ষণ ভাবার অভিনয় করে বলে,
— এক কাজ করো এইখান থেকে ৮০% ভালবাসা ইহান নামক জীবের অন্তরালে রেখে দাও। কেমন! এতে আমার একটু স্পেস ক্লিনাপ হলো সাথে নতুন এক রমণীর ভালবাসা রাখার জায়গাও।

আরিহা এইবার বিরক্তি মাখা কণ্ঠে বলে উঠে,
— এত এনিয়ে বিনিয়ে কিভাবে কথা বলিস বলতো? ডাক্তার হয়েছিস বলে কি নিজের সাথে সাথে অন্যের মাথাও গন্ডগোল পাকাবি? নিজে তো তুই হাফ মেন্টাল তার উপর আমাকে বানাচ্ছিস ফুল মেন্টাল।

জিসান এইবার হাল্কা হেসে বলে,
— মেন্টাল আমি বানাচ্ছি না বরং মেন্টাল যাতে না হতে পারিস তার ব্যবস্থা করছি। নিজের মধ্যে যে কষ্ট বয়ে বেড়াচ্ছিস তা তোকে যে দিনে দিনে হ্রাস করে দিচ্ছে। বার বার করে বলছি নিজের কষ্টটা ভাগ কর। এতে একটু হলেও তুই শান্তি পাবি। তুই যতই এগিয়ে যা কিন্তু এই তিক্ত ঘেরা পিছুটান রয়েই যাবে রে। যা তোকে আবার টেনে নিচে নামিয়ে নিয়ে আসবে।

জিসানের কথায় আরিহা কিছুটা শান্ত হয়ে যায়। জিসান আবার বলতে শুরু করে,

— একটা কথা সবসময় মনে রাখবি,
~~~ “যতক্ষণ না তুমি অতীতকে ভুলে যাচ্ছ, যতক্ষণ না তুমি ক্ষমা করতে পারছ, যতক্ষণ না তুমি মেনে নিচ্ছ অতীত চলে গেছে – ততক্ষণ তুমি নিজের এগিয়ে যাওয়ার ক্ষমতাকে কাজে লাগাচ্ছ না”

তোকে ক্ষমা করতে বলছি না। কারণ সেই বলার অধিকার আমার নেই আর না সেটা ক্ষমার যোগ্য। কিন্তু অতীতটা তো ভুলতেই পারিস তাই না। আর এর জন্য তোর এমন কাউকে প্রয়োজন যাকে তুই আঁকড়ে ধরে অতীতটা ভুলতে পারবি। আর এর জন্য আমার মতে ইহান ইজ রাইট চয়েস। ইহানকে একটা সুযোগ দে। ওকে সত্যিটা বলে দেখ। দেখবি ঠিক তোর হাতটা ধরে সেই কলঙ্কিত নামক কালো অধ্যায় থেকে বের করে নিয়ে আসবে।

জিসানের সকল কথা শুনে আরিহার ভিতর থেকে এক দীর্ঘ শ্বাস বেড়িয়ে আসে। সে জিসানের দিকে রুদ্ধস্বরে বলে,
— যাহ তোর কথাই রইলো। এত বছরে যখন তোর কোন কথা ফেলতে পারি নি এইটাও পারবো না। কিন্তু আমার কিছু সময় দরকার। নিজেকে শক্ত করতে হবে অতীতগুলোকে পুনরাবৃত্তি করার জন্য।

আরিহার কথায় জিসানের ঠোঁটের কোনে স্নিগ্ধ এক হাসি ফুটে উঠে। জিসান এইবার আহ্লাদি সুরে বলে,
— এই প্রথম তোর অফিসে আসলাম। কই একটু খাতির দারি করাবি, অফিসের মিনি ট্যুর করাবি, সকলের সাথে পরিচয় করাবি, সুন্দর সুন্দর রমণীদের সাথে একটু ইটিশ-পিটিশ করার সুযোগ দিবি তা না আলগা পেঁচাল নিয়ে বসে আছিস। রুচিহীন মানবী! রুদ্ধ সম্পূর্ণ বালিকা! হাতছাড়া কন্যা!

জিসানের কথায় আরিহা না হেসে পারলো না। ছেলেটার এইসব কথায় ওর রাগ হয় না বরং হাসি পায়। এমন উদ্ভট কথা যে একমাত্র এই জিসান নামক মানব কে দ্বারাই সম্ভব, এই নিয়ে আরিহার কোন সন্দেহ নেই। আরিহা এইবার কিছু বলতে যাবে তখনই নীরা ওর কেবিনে এসে হাজির হয়। একটা ফাইল চেক করতে করতে ভিতরে আসতে থাকে সে। অন্য কোন দিকে তার কোন ধ্যান নেই। ফাইলের দিকেই চোখ দুটো স্থির করে নীরা আরিহাকে উদ্দেশ্য করে বলতে থাকে,

— মিস্টার ক্লোরিন এসে পড়েছে। হি ইজ ওয়েটিং ফোর ইউ ইন দ্যা মিটিং রুম। আমি মিটিংয়ের সকল ইনফরমেশন এই ফাইলে গুছিয়ে দিয়েছি। বাকি তুই ডিজাইনের ফাইলটা নিয়ে নে। পুষ্পিতা কিন্তু মিটিং রুমেই আছে।
বাই দ্যা ওয়ে একটা মজার কথা জানিস কি? মিস্টার ক্লোরিন বিদেশী হয়েও তার ইয়া বড় ভুরি আছে। বিলাতী পুরুষ হয়েও বাঙ্গালী ঐতিহ্যবাহি পুরুষের মত ইয়া বড় ভুরি। দেখতে কি উদ্ভট লাগছে জানিস। আচ্ছা ভাবার বিষয় হলো তার এমন ভুরি হলো কিভাবে? তার বউ কি বাঙালি না..কি……

এই বলে মাথা তুলে জিসানকে দেখতেই নীরা এক ভো চিৎকার দিয়ে উঠে,
— আয়ায়ায়ায়া!

নীরার এমন চিৎকারে জিসান আর আরিহা দুইজনই হতভম্ব হয়ে যায় আর কানে হাত দিয়ে বসে। নীরা চুপ হতেই আরিহা কান থেকে হাত নামিয়ে বিরক্তিকর কণ্ঠে বলে উঠে,
— এইভাবে চিল্লানোর মানে কি হ্যাঁ? ভূত দেখেছিস নাকি জ্বীন?

নীরা এইবার মাথা নিচু করে বিরবির করে বলে,
— তার থেকেও ভয়ানক কিছু।

আরিহা এইবার রুদ্ধকন্ঠে বলে,
— এখন থম মেরে দাঁড়িয়ে আছিস কেন বল?

নীরা জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করে বলে,
— এনাকে দেখে ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।

নীরার কথা শুনে জিসান বিস্মিত কন্ঠে বলে,
— আমি বাঘ না ভাল্লুক? নাকি এমাজোন থেকে পালিয়া আসা এনাকোন্ডা যে আমাকে দেখে ভয়ে এমন বিকট চিৎকার দিতে হবে।

নীরা বিভ্রান্তিমূলক কণ্ঠ স্বরে বলে উঠে,
— আপনি কি এইসব প্রাণীর মতো দেখতে নাকি এদের সাথে আপনার কোন যোগ সূত্র আছে? না মানে এর বাদে অন্য কোন প্রাণীর উল্লেখ করলেন না যে।

নীরার এমন বোকা মার্কা কথায় আরিহা হো হো করে হেসে উঠে আর জিসান আহাম্মক বোনে যায়। এই প্রথম কেউ জিসানের প্রশ্নের এমন সেভেজ উত্তর দিল। অবশ্য তা ইচ্ছাকৃত ভাবে না বিভ্রান্তিতে পড়ে। আরিহা এইবার হাসতে হাসতে বলে,
— তোর এই কনফিউসিং ব্যাপারটা আজ সেই পরিমাণে কাজে লেগেছে। এই প্রথম জিসানের মুখ দেখার মত ছিল।

জিসান এইবার মুখ ফুলিয়ে বলে,
— এত বড় অপমান! আমার মত কিউট ইনোসেন্ট বাচ্চা ছেলেকে তুই অপমান করতে পারলি? একবারও বিবেকে বাঁধলো না তোর?

আরিহা কিছু বলতে যাবে তার আগেই নীরা বলে উঠে,
— আপনাকে দেখে তো বাচ্চা মনে হয় না। আর আমি যতটুকু জানি ৫-৬ বছর শিশুদের বাচ্চা বলে। কিন্তু আপনাকে দেখে তো ৫-৬ বছরের লাগে না। তাহলে অপমান করতে ওর বুক কাঁপবে কেন? আর এইটা অপমানই বা কিভাবে?

এইবারও জিসান মুখ চুপসে যায়। জিসান হারে হারে বুঝতে পারছে যে এই মেয়ে সবসময় বিভ্রান্তির মধ্যেই থাকে। যাকে সাধারণ ভাষায় বলে কনফিউজড পাবলিক। একে কাবু করা সহজ না। আরিহা এইবারও হেসে উঠে। হাসি মুখেই বলে,
— নীরা তুই ফাইলটা দে। আমি মিটিংয়ের জন্য লেট হচ্ছি। আর শুন তুই যেহেতু ফ্রি আছিস সেহেতু জিসানকে অফিসটা ঘুরিয়ে দেখা আর ওর জন্য একটু নাস্তার ব্যবস্থা কর। ততোক্ষণে আমি মিটিং শে করে আসি।

নীরা মাথা দুলিয়ে আরিহাকে ফাইলটা এগিয়ে দেয়। আরিহা সেটা নিয়ে চলে যায়। নীরা এইবার নিচু কন্ঠে বলে,
— চলুন আপনাকে অফিসটা ঘুড়িয়ে দেখাই।

জিসান দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলে,
— হ্যাঁ চলুন, তার সাথে মিস্টার ক্লোরিনের ভুরি কিভাবে হয়েছে তা নিয়ে রিসার্চও কমপ্লিট করে নেওয়া যাক।

জিসানের কথা বুঝতে নীরার কিছুটা সময় লাগে। অতঃপর বুঝতে পেরে লজ্জায় মাথা কাঁটা যেতে শুরু করে। নীরা আড়চোখে জিসানের দিকে তাকাতেই দেখে জিসান ঠোঁট কামড়ে হেসেই চলেছে। তা দেখে নীরা আরেক দফা সম্মোহনী হলো। নীরার কাছে জিসানের একেকটা হাসিই যেন ওকে ঘায়েল করে তুলে। নীরা বিরবির করে বলতে লাগলো,

— তার এই হাসির কারণে নির্ঘাত আমি একটি হার্ট ফেইল করে মারা যাব। এত মিষ্টি কেন ছেলেটার হাসি।

?

রাতে আরিহা ফ্রেশ হয়ে বের হতেই দেখে টেবিলের উপর খাবার সাজানো। আরিহা সেইদিকে ভ্রু কুচকে তাকাতেই হুট করে কোথ থেকে ইহান এসে ওর হাত ধরে টেনে বিছানার কাছে নিয়ে যায়। অতঃপর নিজে বিছানায় বসে আরিহাকে টান দিয়ে নিজের কোলে বসিয়ে দেয়। এমন আকস্মিক ঘটনায় আরিহা কিছুটা চমকে উঠে। সাথে সাথে ওর চোখ দুটো বড় হয়ে যায়। তা দেখে ইহান মিষ্টি সুরে আবৃত্তি করে বলে,

— “❤️তোমার গভীর কালো
দুই নয়নের গভীরতায়
তলিয়ে গেছি বহুদূর।
উদ্দেশ্যহীন হাঁটতে হাঁটতে
পৌঁছে গেছি বহুদূর।
এখন তুমিহীনা
জীবনটাই বিষন্নতায় ঘেরা❤️ ”

আরিহা এইবার বিস্মিত না হয় পারলো না। কেন না ইহানের এমন রুপ তার কাছে একদমই নতুন। সে আগে কখনো ইহানকে এতটা মায়া, ভালবাসা দিয়ে কথা বলতে দেখে নি। কখনো নিজের প্রতি ইহানের এমন টান দেখে নি। ইহান আরিহার বিস্মিত ভাবটা বুঝতে পেরে ওর কানের সামনে মুখ এনে ফিসফিসিয়ে বলে,

— চোখ এত বড় বড় করে দেখার কি আছে শুনি? চোখ দিয়েই গিলে খাবে বুঝি? তবে এতে আমার কিন্তু কোন প্রবলেম নেই। আফটার অল তুমি তোমার এত হ্যান্ডসাম বরকে দেখবে না তো কাকে দেখবে শুনি।

এই বলে ঠোঁট কামড়ে হেসে উঠে। আরিহা আজ যেন আরেক দফা বিস্মিত হলো। সে বিস্মিত কণ্ঠেই বলে উঠে,

— এইসব কি হচ্ছে?

ইহান ভাবান্তরহীন ভাবে বলে,
— বউকে সোহাগ করা হচ্ছে। কেন কম মনে হচ্ছে নাকি?
শেষের কথাটা বলে ইহান তার ভ্রু দুটি একটু উঁচু করে নাচায়। আরিহা তা দেখে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে উঠতে নিলে ইহান ওর কোমড় চেপে ধরে আর রুদ্ধকন্ঠে বলে,

— একদম নড়াচড়া করবে না বলছি। আগে আমার হাতে সকল খাবার শেষ করবে তারপর তুমি মুক্তি পাবে। এর আগে না। একদমই না! এইভাবেই তো নিজের খেয়াল নাও না তার উপর এখন রোজা বলে তো আরও নিচ্ছো না। শরীরে কি রোগের বস্তা ভরা বাসা বানাবে নাকি? এত যে কাজ কাজ করো অসুস্থ হলে সব জানালা দিয়ে দৌঁড়ে পালাবে বুঝলে। তো এখন এত ড্রামা না করে খাও তো।

এই বলে ভাতের প্লেটটা নিয়ে ভাতটুকু মেখে তা আরিহার মুখের সামনে ধরে। আরিহা এইবার যেন আরেক দফা অবাক হয়। ইহান ওর উপর অধিকার দেখাচ্ছে। আরিহার মনে এবার প্রশ্ন জাগতে শুরু করল যে,” ইহান এমন কেন করছে? হুট করে এত অধিকার দেখানো মানেটা কি?”
আরিহা যখন এসব নিয়ে ভাবছিল তখনই ইহানের ঝাঁজালো কন্ঠে কানে ভেসে আসতেই সে চমকে উঠে।

— আ করো বলছি এন্ড নো মোর ওয়ার্ডস।
আরিহা এইবার শান্ত চোখে ইহানের দিকে তাকায়। অতঃপর কিছু না বলে চুপচাপ হা করে নেয়। সাথে সাথে ইহানের মুখে বিশ্বজয়ী হাসি ফুটে সে। সে অতি যত্নে আরিহাকে খায়িয়ে দিতে শুরু করে। অতঃপর খাওয়া শেষে আরিহার প্রেশারের ঔষধ ওকে জোরপূর্বক খায়িয়ে দেয়। এরপর ইহান বাইরে চলে যায়।
এতক্ষণ ধরে দরজার পাশ থেকে জিসান সবটাই দেখছিল। সবশেষে তার মুখে তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠে। ইহানকে তখন আসতে দেখে জিসান আস্তে করে সেখান থেকে সরে চলে আসে।

?

দেখতে দেখতে সময় পানির স্রোতের ন্যায় অতিবাহিত হতে থাকে। বর্ষা চলে গিয়ে শরৎের আগমন হয়। শরৎ চলে আসায় বেশ জমজমাট এক পরিবেশ সৃষ্টি হয়। খালি জায়গায় বেরে উঠেছে ছোট ছোট নরম কচি ঘাস। কাশবনে ফুটতে শুরু করেছে কাশফুল। কথায় আছে শরৎের আসল সৌন্দর্যই হচ্ছে কাশফুল। তাই তো কাশফুলের এই সৌন্দর্য উপভোগ করতেই বিভিন্ন দলের তরুন-তরুনী আর নবদম্পতিরা ছুটে চলে দূর-দূরান্তের সেই কাশবনে। কাশফুল ব্যতীত গাছের চারায় ফুটে উঠেছে হরেক ধরনের ফুল। তার মধ্যে জুঁই, কেয়া, শিউলি জবা, মালতি, দোলনচাঁপা, নয়নতারা সকলের দৃষ্টি বিশেষ করে আকর্ষণ করে। এরা দেখতে যেমন হরেক রঙের তেমনই এরা প্রত্যেকই নিজ নিজ সৌন্দর্য বহন করে। শরৎের পুরো মাস জুড়েই যেন চারদিকটা ফুলের গন্ধে “ম ম” করে। পাখিরাও ডানা ঝাপ্টে উড়ে বেড়ায় মুক্ত আকাশে।
রোজা শেষে চলে আসে ঈদ। সকল মুসলিমদের চোখে মুখে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে খুশির আমেজ। দীর্ঘ এক মাস সিয়াম (রোজা) সাধনার পর তাদের কাছে এইদিনটি এসে ধরা দেয়।
” রমজানের ওই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ,” গানের চরণেও এই একই কথা প্রতিফলিত হয়। সকল মুসলিমদের বাসায় তৈরি হয় হরেক রকমের সুস্বাদু খাবার। আরিহাও আজ সকলের জন্য হরেক রকমের রান্না করেছে। ইহান আর জিসান ঈদগাহ থেকে নামাজ পড়ে আসতেই তাদের ফিরনীও খায়িয়ে দিয়েছে। সব কিছুই একদম ভালো যাচ্ছে। এই কয়েকদিনে অনেক কিছু পরিবর্তন না হলেও কিছুটা পরিবর্তন ঠিকই এসেছে।

এই কয়েকটি দিনে ইহান আরিহার উপর কড়া ভাবে শাসন চালিয়ে গিয়েছে। কিন্তু সেটা ভালবাসার মধ্য দিয়ে। ইহান আরিহার প্রত্যেকটা জিনিসের খেয়াল রেখেছে। প্রতিদিন রাতে নিজের কোলে বসিয়ে নিজ হাতে খায়িয়ে দেওয়া, ঔষধগুলো ঠিক দেওয়া, ওকে বুকে জড়িয়ে ঘুমানো সবই যেন ধীরে ধীরে আরিহার নিকট অভ্যাসে পরিণত হচ্ছে। আরিহার প্রতি ইহানের এত কেয়ার বাধ্য করছে আরিহাকে ইহানের নিকট মাথা নত করতে। তাই তো ইহান যা বলে তা বিনা বাক্যে মেনে নেয়। তর্ক করে না।কিন্তু এইসব যে সহজ ছিল তা কিন্তু না। অনেক কষ্ট পরিশ্রমের ফল এইটা। আসলে একটা কথা বলতে গেলে কি, যারা ভালবাসার কাঙ্গাল হয় তারা অল্পতেই গলে যায়। কিন্তু সেই অল্পটাই অনেক দূর্লভ। তারা সীমিত ভালবাসার মধ্যেই নিজের অস্তিত্ব খুঁজে বের করতে পারে। তারা চায় কেউ তাদের উপর জোর খাটাক, তাদের ভালবাসায় পূর্ণ শাসন করুক, তাদের সামান্য পরিমাণ যত্ন নিক। কিন্তু তাদের সকলের ভাগ্যে এইসব জোটে না আর যাদের ভাগ্যে জোটে তারা হয় অতি বিশেষ বা ভাগ্যবান।
আরিহার মনে আস্তে আস্তে ইহানের প্রতি টুকরো টুকরো বিশ্বাস জমতে শুরু করে। সাথে আরিহার ব্যবহার ও নমনীয় হয়ে এসেছে ইহানের সাথে। এরই মধ্যে আরিহার মন বার বার বলছে, “ইহানকে বিশ্বাস করতে। ওকে সব বলে দিতে অতঃপর ওকে আপন করে নিতে আর নতুন এক জীবন শুরু করার জন্য।” কিন্তু মস্তিষ্ক বলছে, “কাউকে বিশ্বাস না করতে। বিশ্বাস মানেই মন ভাঙ্গা। ইহানকে নিজের সাথে জড়ালে কষ্ট কমবে না বরং আরও বাড়বে।” আরিহা যে বিশাল এক দ্বিধাদ্বন্দে ভুগছে তার কোন সন্দেহ নেই। অতঃপর জিসানের বলা কথাগুলো মনে পড়ে যায় ওর। ও বলেছিল,

–” মস্তিষ্ক দ্বিধাগ্রস্ত আর মন দ্বিধাহীন।”

কথাটা মনে পড়তেই আরিহা সিন্ধান্ত নেয় যে সে এইবার মনের কথা শুনবে। সারাজীবন তো মস্তিষ্কের কথা শুনেই আসলো আজ না হয় মনের কথাটাই শুনে দেখা যাক। সে ঠিক করলো আজই ইহানকে নিজের অতীত ব্যাপারে সব জানাবে সে। এরপর পরিনতি কি হবে দেখাই যাবে। অবশ্য আরিহা নেগেটিভটাই ভেবে রেখেছে তাই সে কিছুটা দ্বিধাহীন হয়ে আছে।

?

বারান্দায় রাখা দুটো চেয়ারে বসে আছে আরিহা আর ইহান। খোলা আকাশে মিটিমিটি করে জ্বলে উঠছে অসংখ্য তারা। তাদের মাঝে পূর্ণ থালার ন্যায় দাঁড়িয়ে আছে পূর্ণাঙ্গ চাঁদটি। নিজের হাল্কা স্নিগ্ধ আলো চারদিকে ছড়িয়ে দিচ্ছে সে। গাছের ডালে, পাতায় ও ফুলের পাপড়ি গুলোর মধ্যে চাঁদের এই স্নিগ্ধ আলো পড়তেই তারা খিলখিলিয়ে হেসে উঠছে। মৃদু বাতাস বইছে চারদিকে যা শরীরে হীম শীতল ভাবে ছুঁয়ে যাচ্ছে। সাথে নাকে ভেসে আসছে হরেক রকম ফুলের মিষ্টি গন্ধ। বেশ আবেগপূর্ণ পরিবেশ। আজ পূর্ণিমার রাত হলে হয়তো রাতটা যেন সম্পূর্ণ রুপে পূর্ণতা পেত।
বারান্দার গ্রিলের ফাঁক দিয়ে এক মুঠো চাঁদের আলো আষ্টেপৃষ্টে পড়ছে ইহান আর আরিহার গায়ে। রুমে জ্বলতে থাকা কৃত্রিম আলোর কিছু অংশ বারান্দার মধ্যভাগে এসে পড়ছে। যার ফলে ইহানের নিকট আরিহার বিষন্নতায় মাখা চেহেরাটা বেশ স্পষ্ট। চোখ মুখ খিঁচে আছে সে। ইহানের কেন যেন মনে হচ্ছে আজ আরিহা তার কাছে কিছু কনফেশ কর‍তে চায়। কিন্তু সেটা কি? আরিহার অতীত নাকি অন্য কিছু? ইহান এইসব ভাবতে ভাবতেই আরিহা তিক্ত কন্ঠে বলে উঠে,

— তুমি জানতে চাইতে না আমি এমন কেন? হার্টলেস কেন? এতটা অনুভূতিহীন কেন? এত শক্ত কেন?

ইহান কিছু না বলে মাথা দুলায়। যার অর্থ হ্যাঁ। আরিহা তা বুঝতে পেরে বলে,
— সকল মানুষের স্বভাবের পিছনে একটা কারণ থাকে। ঠিক আমার এমন স্বভাবের পিছনেও একটা কারণ আছে। এক কালো অধ্যায় আছে যা কলঙ্ক দিয়ে ঘেরা। যা অতীতের পাতায় বন্দী।যার প্রতিফলে আজ আমি এমন। পাষাণ!

ইহাম এইবার ইতস্তত করে বলে,
— আমি জানতে চাই সেই কারণ। যানতে চাই তোমার সেই কালো অতীত।

আরিহা ইহানের দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে আলাশের পানে তাকিয়ে বলে,
— এ অতীত জানার পর হয়তো আমাকে মেনে নেওয়া তোমার পক্ষে সম্ভব না। আসলে কাউরো পক্ষেই সম্ভব না। এমনই এক অতীত আমার।

ইহান এইবার চোয়াল শক্ত করে বলে,
— সেটা পরে বুঝা যাবে সম্ভব কি না। আমরা পরিক্ষা দেই অনিশ্চিত ফলাফলের আশায়। এইটি এখন ভালোও হতে পারে আবার খারাপও। আগে থেকে জানাই থাকা ফলাফল কি তাহলে কেউ আর পরিক্ষা দিতই না। তাই তুমি যা ভাবছো তা নাও হতে পারে। আর কি বাই আছে তোমার অতীতে?

আরিহা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলে,
— যদি বলি আমি কলঙ্কিত। উপর থেকে নিচ পর্যন্ত। এমন কি ভিতর দিয়েও। এতটুকু শুনার পরও কি তুমি আমার অতীত জানতে চাইবে?

কথাটা ইহানের কানে প্রতিধ্বনি হতেই ইহান স্থির হয়ে যায়। অতঃপর নিজেকে সামলিয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,
— হ্যাঁ চাইবো! শুরু থেকে সব বলো। আই ওয়ান্ট টু নো এভরিথিং।

ইহানের জবাবে আরিহা একবার ইহানের মুখের পানে তাকিয়ে থেকে চোখ সরিয়ে দূর আকাশের দিকে স্থির করে। তারপর এক দীর্ঘ শ্বাস নিয়ে বলে,

— ঠিক আছে। তুমি যখন জানতেই চাইছো তখন ঠিক তাই হোক। ঘটনাটা ঘটে আজ থেকে ১৩ বছর আগে। যখন আমার বয়স ১১ কি ১২। তখন….

#চলবে