অল্প থেকে গল্প পর্ব-১৬+১৭

0
563

অল্প থেকে গল্প🍁
অরিত্রিকা আহানা
পর্ব:১৬

ছবি অনেক্ষন ধরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বারান্দায় বসে আছে।হস্পিটালে এলেই ওর গা গুলিয়ে আসে।তারওপর সরকারী হাসপাতাল।গিঞ্জি গিঞ্জি অবস্থা।ডিউটি ডাক্তাররা রাউন্ড দিচ্ছে।ও আউট ডোরে বসে আছে।ক্লাস শেষে ওর এক বান্ধবীর সাথে এসেছে বান্ধবীর মামাকে দেখতে।তিনি অসুস্থ হয়ে এখানে চিকিৎসাধীন আছেন।ছবি ভেতরে ঢোকে কিছুক্ষন থেকে বেরিয়ে এসেছে।দম বন্ধ হয়ে আসছিলো তার।বারান্দায় বসে বান্ধবীর জন্য অপেক্ষা করছিলো সে।

হঠাৎ সামনে চোখ পড়তেই দেখলো শুদ্ধ একটা পেশেন্টের মেডিকেল হিস্ট্রি পড়তে পড়ত বেরোচ্ছিলো,ওর পেছন পেছন দুজন ইন্টার্নি ডাক্তারও আছে।ইন্টার্নি ডাক্তার দুজনের মধ্যে একজন ছেলে অপরজন মেয়ে।ছবি হাঁ করে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে আছে।বয়সে ওর চেয়ে দুএকবছরের বড় হবে।সাদা ধবধবে ফর্সা,লম্বা,অসম্ভব সুন্দর চেহারা।চোখা নাক,কাজল নয়না,লালগোলাপি ঠোঁট!ছবির লাইফে দেখা সবচেয়ে সুন্দরি মেয়ে।সুমনা যদি সুচিত্রা সেন হয় এ হবে ডাবল,ত্রিপল সুচিত্রার কম্বিনেশন।এত পারফেকশন একটা মেয়ের হয় কি করে? ছবি কান্না পাচ্ছে।ভীষণ কান্না পাচ্ছে,অস্থির অস্থির লাগছে। এই মেয়েকেই কেন শুদ্ধর সাথে কাজ করতে হলো?

শুদ্ধ তাদের সাথে কিছু একটা নিয়ে আলাপ করছে।কথার মাঝখানে হঠাৎ ছবির দিকে চোখ পড়লো।প্রথমে খেয়াল করে নি।চোখ সরিয়ে নিলো।তার পরপরই আবার বিস্ময় কৌতুহলী দৃষ্টিতে তাকালো।ছবিকে একটা টুল এর ওপর বসে আছে। শুদ্ধ হাতের ফাইলটা ওদের হাতে ধরিয়ে দিয়ে ছবির কাছে এগিয়ে এলো।ছবি ওকে দেখে বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে গেছে।
শুদ্ধর চোখেমুখে উদ্বেগ।জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে বললো,
–তুমি এখানে?কোন সমস্যা?
ছবির এইমুহূর্তে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।ভীষণ কাঁদতে ইচ্ছে করছে।শুদ্ধকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে পারলে ভালো হত!শুদ্ধ আবারও জিজ্ঞেস করলো,
—ছবি?..এনিথিং রং?
—না।আসলে আমার এক বান্ধবীর সাথে এসেছিলাম।ওর মামা অসুস্থ।দেখতে এসেছে।
—কেবিনে?
—জ্বী।
—তুমি এই গরমের মধ্যে এখানে বসে আছো কেন?চলো আমার রুমে চলো।
—না সমস্যা নেই।ও বোধহয় এক্ষুনি চলে আসবে।
—ও কত নাম্বার কেবিনে আছে আমাকে বলো আমি ওয়ার্ডবয়কে বলে দিচ্ছি ওকে আমার রুমে নিয়ে আসবে।
—এত ব্যস্ত হওয়ার দরকার নেই।আপনি কাজ ফেলে শুধু শুধু ঝামেলা করছেন।
—আমার কাজ শেষ।তুমি চলো আমার সাথে।
ছবি আর কথা বাড়ালো না।শুদ্ধর পেছন পেছন ওর রুমে ঢুকলো।সরকারি কেবিন যদিও বেশ আহামরি না তবে বেশ গোছালো।
শুদ্ধ ওর চেয়ারে বসে বললো,
—কি খাবে বলো।আমি ওর্ডার করছি।
—আমি কিছু খাবো না।
—কেন?
—আসলে হাসপাতালের পরিবেশ আমার সহ্য হয় না। বমি বমি লাগে।
শুদ্ধ ওর কথা শুনে একটু হাসলো।সেই হাসিতেই ছবির হৃদয়টা দ্বিখণ্ডিত হয়ে গেলো।সাদা এপ্রোনে শুদ্ধকে বেশ লাগছে।এপ্রোনের ভেতরে কালো,নীল ফুলহাতা চেকশার্ট ইন করে পরেছে।হাতে ঘড়ি!চোখে চশমা একবারে পার্ফেক্টলি ম্যাচড সবকিছু। ছবি মনে হচ্ছে ওর এই মায়া মায়া চেহারা দেখে রোগী এমনিতেই ভালো হয়ে যাবে।
শুদ্ধ ওর কথায় তাল মিলিয়ে বললো,
—প্রথম প্রথম আমারও এমন হতো।মেডিকেলে পড়ার সময় হস্পিটালে এলেই আমার মাথা ঘুরতো।এখন অবশ্য সয়ে গেছে।রোজ থাকতে হয়।তবে আমি লন্ডনে যখন ট্রেনিং করতে গিয়েছিলাম ওখানকার পরিবেশ খুবই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ছিলো।এখানকার মত গিঞ্জি গিঞ্জি না।
—আমাদের দেশে তো হস্পিটালের সংকট।
—হস্পিটালের সংকট না,আসলে আমাদের সরকারি হস্পিটালের সংকট।বেসরকারি হাস্পাতালে চিকিৎসা নেওয়ার মত সামর্থ্য অনেকেরই নেই।
ওরা কথা বলছিলো এমন সময় ছবির বান্ধবী এসে ভেতরে ঢুকলো।ছবি পরিচয় করিয়ে দিলো।
—আমার বান্ধবী শিলা।
শুদ্ধ হাসিমুখে ওকে স্বাগত জানালো।শিলার স্বভাব হচ্ছে বেশি কথা বলা।শুদ্ধকে দেখেই ওর বিমোহিত হয়ে গেছে।শুদ্ধর দিকে তাকিয়ে বললো,
—ডাক্তার যদি এমন হ্যান্ডসাম হয় তাহলে তো রোগী উলটো অসুস্থ হয়ে যাবে।
শুদ্ধ ওর কথা শুনে একটু হাসলো।ছবি এই জন্যই শিলাকে নিয়ে ভেতরে ঢুকতে চাইছিলো না।প্রথম দেখাতেই কেউ এমন আচরন করতে পারে সেটা এই তারছেঁড়া মেয়েটাকে না দেখলে ওর মাথায় ঢুকতো না।
শিলা শুদ্ধর দিকে তাকিয়ে একটা হাসি দিয়ে বললো,
—আপনি দয়া করে আমার পালসটা একটু চেক করে দেখবেন?
শুদ্ধ হাসিমুখেই শিলার বামহাতটা নিয়ে ওর পাল চেক করলো।ছবির চোখেমুখে অস্বস্তি।এই মুহূর্তে শিলার গালে কষে একটা চড় বসাতে ইচ্ছে করছে।কিন্তু সেটা আপাতত সম্ভব না।
পালস চেক করা শেষ হতেই শুদ্ধ শিলাকে জিজ্ঞেস করলো ওর জন্য কিছু অর্ডার করবে কি না।শিলাও লাজ লজ্জার মাথা খেয়ে বললো,
—আপনি বললে না করতে পারবো না।
ছবি চুপচাপ বসে শিলার কান্ড দেখছে।শিলা লাজলজ্জার ধারে কাছে দিয়েও গেলো না।বকবক করেই যাচ্ছে।

একটু পরেই শুদ্ধর একটা কল এলো।ব্যস্ত ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়িলো সে।আন্তরিক হাসি দিয়ে বললো,
—সরি,আমাকে যেতে হবে। ইমার্জেন্সি।তোমাদের সমস্যা না হলে কিছুক্ষণ বসতে পারো।
শিলার যদিও মত ছিলো,সুযোগ পেয়ে ছবি উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
—আমরাও আজকে আসি।এমনিতেই অনেক দেরী হয়ে গিয়েছে।
ছবির মুখ থেকে এমন কথা শুনে শিলার মন খারাপ হয়ে গেলো।তবুও না করতে পারলো না।শুদ্ধ ওর দিকে তাকিয়ে হাসি মুখে বললো,
—আসি।হস্পিটালে তো আবার আসতে বলতে পারি না।তবে সময় পেলে ছবি সাথে আমাদের বাসায় অবশ্যই যাবেন।
শিলা খুশিতে গদগদ হয়ে বললো,
—যাবো যাবো।অবশ্যই যাবো।তবে তার আগে আমাকে তুমি করে বলতে হবে।আমার বয়স ছবির চেয়ে বেশি হবে না।
ওর কথা শুনে শুদ্ধ আবারও একটা অমায়িক হাসি দিয়ে বললো,
—আসি।ভালো থেকো।

শুদ্ধ বেরিয়ে যেতেই ওরাও বেরিয়ে গেলো।ছবির মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে।সবার কেন শুদ্ধকে নিয়েই টানাটানি করতে হবে।দেশে কি ছেলের অভাব পড়েছে যে সবাই ওর জামাইকে নিয়েই টানাটানি করছে।শুদ্ধর ওপর আরো বেশি মেজাজ খারাপ হচ্ছে।ও না বিয়ে করছে?তাহলে সব মেয়েদের সাথে অত হেসেহেসে কথা বলার কি আছে।তারওপর হস্পিটালের ঐ মেয়েটা?ওর কথা ভাবলেই ছবির কান্না পাচ্ছে।
শিলা খুব আগ্রহ নিয়ে বললো,
—হি ইজ রিয়েলি ড্যাম সুইট।
ওর কথা শুনে ছবির মেজাজ আরো বিগড়ে গেলো।ও দাঁতেদাঁত চেপে বললো,
–তুই এমন অসভ্যতা করলি কেন উনার সামনে?
শিলা ওকে পালটা প্রশ্ন করে বললো,
—তুই আগে বল।তোর সাথে যে এত হ্যান্ডসাম একজন ডাক্তারের পরিচয় আছে তুই আমাকে বলিস নি কেন?বাই দ্যা ওয়ে উনি তোর কি হয়?মানে উনার সাথে তোর পরিচয় কীভাবে?
শিলার কথা শুনে ছবি রাগ চেপে রাখতে পারলো না।ব্যাগ দিয়ে ওকে একটা বাড়ি মেরে বললো,
—আমার জামাই হয়।বুঝলি।
শিলা ওর কথায় পাত্তা না দিয়ে হো হো করে হেসে উঠলো।তারপর হাসতে হাসতেই বললো,
—জেলাস না?এইজন্যই আমাকে এতদিন বলিস নি!
—বেশ করিছি।তুই উনার দিকে একদম নজর দিবি না।ও গটগট করে বেরিয়ে গেলো।শিলাও ওর পেছন পেছন দৌঁড়ে বেরোলো।

সপ্তাহ খানেক বাদে একদিন বিকেলবেলা ছবি বিরক্ত হয়ে খাটের ওপর বসে আছে।শিলা ওর মাথা খারাপ করে দিচ্ছে শুদ্ধর সাথে দেখা করার জন্য।এই মেয়েকে কতবার বলেছে শুদ্ধর সাথে ওর বিয়ে হয়েছে।কিন্তু কিছুতেই বিশ্বাস করলো না।তবুও বলছে আজকে নাকি ওর কোন দূরসম্পর্কের খালাকে দেখতে হস্পিটালে যাবে।অথচ সেদিন ওর নিজের মামাকে দেখতে যাওয়ার আগে কত বাহানা করেছে।শেষমেশ মায়ের বকুনির ভয়ে ছবিকে নিয়ে গিয়েছিল।অথচ আজকে ওর দূরসম্পর্কের খালাকে দেখতে যাওয়ার জন্য ও উতলা হয়ে গিয়েছে।তারওপর দুনিয়ার সাজগোজ করেছে।আসল ঘটনাটা বুঝতে পেরে ছবি কিছুতেই ওকে নিয়ে যেতে রাজী না।বিরক্ত হয় বললো,
—তুই যদি এমন বিরক্ত করিস আমি আর কখনো সকালবেলা রোকেয়া ম্যামের ক্লাসে তোর ফক্সি দিবো না বলে দিলাম।এটেন্ডেন্স মিস হলে আমার দোষ দিতে পারবি না।
—লাগবে না দোস্ত।আমার এটেডেন্স লাগবে না।তুই শুধু একবার আমাকে উনার সাথে দেখা করইয়ে দে প্লিজ।তুই জানিস উনাকে দেখার পর থেকে আমার সবকিছু কেমন এলোমেলো হয়ে গেছে?আমি রাত দিন চোখের সামনে শুধু উনাকে দেখি।
ছবি বিড়বিড় করে বললো,
—অসভ্য!বেয়াদপ!

হস্পিটালে এসে ওরা জানতে পারলো শুদ্ধ নেই।খুলনা মেডিকেলের এক্সটারনাল এক্সমিনার হিসেবে এটেন্ড করার জন্য কালরাতেই খুলনা রওনা গিয়েছে।
শিলা চোখমুখ বিকৃত করে বললো,
—কি রে তুই না উনার বউ।উনি যে খুলনা গেছে সেটাও জানিস না?
শুদ্ধ নেই শুনে ছবি মনটা খারাপ হয়ে গিয়েছিলো।যতই শিলাকে না করুক না কেন ভেতরে ভেতরে শুদ্ধকে দেখার জন্য সে নিজেও ছটফট করছিলো।শিলার কথা শুনে মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো।শিলাকে ধমক দিয়ে বললো,
—আর একটা কথা বললে একটা বাড়ি মেরে তোকে এখানে ভর্তি করিয়ে দিয়ে যাবো।তারপর যত খুশি উনাকে দেখিস।
ছবিকে রেগে যেতে দেখে শিলা বেলুনের মত চুপসে গেলো।এইমুহূর্তে ছবিকে চটানো যাবে না।হাতে রাখতে হবে। চুপচাপ ছবির পেছন পেছন বেরিয়ে গেলো সে।ছবি রাগে গজগজ করছে।শিলা চুপচাপ সেগুলো শুনে যাচ্ছে।ছবির কোন কথার প্রতিবাদ করছে না।ছবি ওর সাজগোজ নিয়েও খুব ঝাড়লো।

গেট দিয়ে বেরোনোর সময় সেদিনের সেই সুন্দরি মেয়েটা ওদের থামিয়ে দিলো।মিষ্টি হেসে ছবিকে উদ্দেশ্য করে বলল,
—আপনি মিসেস ইফতেখার না?
ছবি থতমত খেয়ে গেলো।মেয়েটা উত্তরের অপেক্ষায় হাসিমুখে চেয়ে আছে।ছবি নিজেকে সামলে নিয়ে কাঁপাকাঁপা কন্ঠে বলল,
—জ্বী!
—আমাকে আপনি চিনবেন না।আমি এই মেডিকেলেরই স্টুডেন্ট।স্যার এর ছাত্রী।এখন ইন্টার্নি করছি।আমি কিন্তু আপনাকে চিনি।

বয়সে বড় একটা মেয়ে ছবিকে আপনি করে বলছে প্রথমে অস্বস্তি হচ্ছিলো ছবির।তবে এতক্ষনে মেয়েটার কথাবার্তা গুলো ওর মাথায় ঢুকেছে।নিজেকে স্বাভাবিক রাখার জন্য ঠোঁটে মৃদু হাসি ফোটালো সে।যতই স্থির থাকার চেষ্টা করুক না কেন বুকের ভেতর তোলপাড় হচ্ছে,আনন্দের জোয়ার বইছে।সেই জোয়ারে ডুবে মরতে ইচ্ছে করছে ছবির!
—স্যার এর খোঁজে এসেছেন?
—জ্বী।
মেয়েটা আরো কিছু বলতে চাইছিলো হঠাৎ একজন নার্স এসে মেয়েটকে উদ্দেশ্য করে বলল,
—তিন নাম্বার বেডের পেশেন্টের অবস্থা ভালো না আপু।জলদি চলেন!
মেয়েটা ছবিকে উদ্দেশ্য করে আবারও সেই মিষ্টি হাসি দিয়ে বলল,
—আসি ম্যাম।আপনার সাথে পরিচিত হয়ে খুব ভালো লাগলো।
তারপর ব্যস্ত ভঙ্গিতে হস্পিটালের দিকে পা বাড়ালো।
শিলা অবাক হয়ে বলল,
—এই তুই মিসেস হলি কবে থেকে?
ওর কথা ছবির কানে ঢুকতে ইচ্ছে করছে না।কানে শুধু একটাই কথা বাজছে,’আপনি মিসেস ইফতেখার না?’ বুকের ধুকপুকানিটা ক্রমশ বেড়ে চলেছে স্পষ্ট টের পাচ্ছে সে।’মিসেস ইফতেখার!’ উফফ!সারা শরীরে কাঁপন ধরিয়ে দিচ্ছে।হ্যাঁ মিসেস ইফতেখার সে! মিসেস ইফতেখার হোসাইন শুদ্ধ!অদ্ভুত এক শিহরণ!
.
.
চলবে

অল্প থেকে গল্প🍁
অরিত্রিকা আহানা
পর্ব:১৭

ছবির পরনে একটা হাফ হাতা টপস আর একটা ফ্লাজু।টফসের হাতাটা বেশ ঢিলা অনেকটা ম্যাগি হাতার মত।শুদ্ধ ওর পা থেকে মাথা পর্যন্ত চোখ বুলিয়ে নিল।তারপর কোন কথা না ছাড়াই ভেতরে ঢুকে গেলো।ছবি লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে আছে।ওর ভীষণ আনইজি লাগছে শুদ্ধকে দেখে।শুদ্ধ বাসায় থাকলে ও কখনোই এসব পরে না।আজকে শুদ্ধর আরো দেরীতে আসার কথা ছিলো।তাড়াতাড়িই চলে এসেছে।ছবি রুমে ঢুকে দ্রুত চেইঞ্জ করে নিলো।হালকা বেগুনী রংয়ের সুতি একটা থ্রিপিস পরে বেরিয়ে এলো সে।ওড়নাটা কোমরে বেধে কিচেনে ঢুকলো কফি করার জন্য।

কফি হাতে নিয়ে শুদ্ধর ঘরে ঢুকে দেখলো শুদ্ধ ফ্যানের নিচে বসে টাওয়েল দিয়ে মুখ মুছছে।
ছবি কফিটা এগিয়ে দিয়ে বললো,
—সাথে বিস্কিট দেবো?
—না।
শুদ্ধ কফিতে চুমুক দিলো। চুমুক শেষ করে জিজ্ঞেস করলো,
—ভাবীরা ফিরবে কবে?
—আমাকে তো কিছু বলে যায় নি।
—আশ্চর্য!
অনুরা চিটাগাং গেছে শুদ্ধর বাবার বন্ধু ইমরান আহমেদ মারা গেছেন তাকে দেখতে।শুদ্ধ সেমিনার এটেন্ড করতে দুদিনের জন্য নেপালে গিয়েছিলো।আজকে সন্ধার ফ্লাইটেই ফিরেছে।ছবির ক্যাম্পাস বন্ধ থাকায় গতকাল বাসায় এসেছিলো।হুট করে ইমরান সাহেবের মারা যাওয়ার খবর পেয়ে অনুরা ওকে রেখেই চিটাগাং রওনা দেয়।
শুদ্ধ জিজ্ঞেস করল বললো,
—কখন রওনা দিয়েছে?
—ভোরেই।দশটায় মাটি হবে।
—তুমি যাও নি?
—না মানে আমি ভেবেছিলাম আবার ক্লাস শুরু হয়ে যাবে তাই।আর আপনি তো আসছেন ই।
—বোকার মত কথা বলো না তো ছবি।ধরো, কোন কারনে যদি আমি না আসতে পারতাম অথবা আমার ফ্লাইট মিস হয়ে যেত?
–তাহলে শিলাকে ফোন করে এখানে চলে আসতে বলতাম।
ছবির জবাবটা যদিও শুদ্ধর পছন্দ হয় নি তবুও আর কিছু বললো না।
কফিতে চুমুক দিতে দিতেই বামহাতে ল্যাপটপ অন করলো।চশমা চোখে দিয়ে টানা দুইঘন্টা জন্য সেটা নিয়ে বসে পড়লো।ছবি খালি কফির মগ নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিলো।শুদ্ধ হঠাৎ ডাক দিলো,
—ছবি শোনো?
—জ্বী কিছু বলবেন?
—আমি রাতে কিছু খাবো না।শুধু একমগ কফি দিয়ে যেও কেমন?
—জ্বী!
শুদ্ধর ঘর থেকে বেরিয়ে ধারা রান্নাঘরে ঢুকলো রাতের খাবারে ব্যবস্থা করার জন্য।

বুয়া চলে গেছে।বাসায় শুধু ওরা দুজন।রান্না শেষ হতেই ছবি শুদ্ধকে খাওয়ার জন্য ডাকতে গেলো।একা একা খেতে ইচ্ছে করছে না। রুমে ঢুকে দেখলো শুদ্ধ ঘুমিয়ে পড়েছে।মাথার পাশে চশমাটা ভাঁজ করে রাখা।শুদ্ধর মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে ভীষণ টায়ার্ড।ছবি চুপচাপ চশমাটা টেবিলের ওপর রেখে লাইট অফ করে নিঃশব্দে বেরিয়ে এলো।

সকাল বেলা শুদ্ধর ঘুম ভাংলো দেরীতে।ফ্রেশ হয়ে বেরোতে দেখলো ঘরে দরজায় ছবি কফি হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।চোখে চশমা নেই।ফোলা ফোলা চোখদুটোটে শুদ্ধকে ভীষণ কিউট লাগছে।ছবি ড্যাবড্যাব করে ওর দিকে তাকিয়ে আছে।
শুদ্ধ টেবিলের ওপর থেকে চশমার ভাঁজ খুলে চোখে দিলো। মিষ্টি হেসে বলল,
—গুড মর্নিং!
—গুড মর্নিং!নাশতা কি টেবিলে দেবো নাকি এখানে নিয়ে আসবো?
—টেবিলে দাও আমি আসছি।
পরোটা আর ডিমভাজি করেছে ছবি।সাথে শুদ্ধর ব্ল্যাক কফি!শুদ্ধ চেয়ার টেনে খেতে বসে গেলো।খেতে খেতে ছবি বললো,
—আপনি কি আজকে হস্পিটালে যাবেন?
—নাহ।
—ছুটি নিয়েছেন?
—নাহ।
—তাহলে?
—সেমিনার তিন দিনের ছিলো।তার আগেই আমার কাজ শেষ।তাই চলে এসে,
—আমি একটু বেরোবো।
—এখনই?
—হ্যাঁ।
—ফিরবেন কখন?
—দুপুরের আগে ফিরতে পারবো বলে মনে হয় না।
—লাঞ্চ কোথায় করবেন?
—বাসায় এসেই করবো।
—ঠিক আছে।
—তোমাকে যেটা বলতে চাইছি,সেটা হলো তোমার রান্নাবান্না করা লাগবে না।আমি বাইরে থেকে খাবার নিয়ে আসবো।একা একা বাসায় থাকবে চুলার কাছে যাওয়ার দরকার নেই।দরজা জানালা সব ভালো মত বন্ধ করে রাখবে।ম্যাজিক আই এ না দেখে দরজা খুলবে না বুঝেছো?
—আমি কি বাচ্চা নাকি?
—আমি জানি আপনি বাচ্চা না!
—তো?
—তো কিছু না।আমি যা বলেছি তুমি শুধু তা মনে রাখবে।কি মনে থাকবে?
—থাকবে।
—কি থাকবে?
—আপনি যা বলেছেন তা মনে থাকবে।
—কি বলেছি আমি?
—দরজা জানালা ভালো মত আটকে রাখতে।আর ম্যাজিক আই এ না দেখে দরজা খুলতে না।
—গুড!আর কি বলেছি?.
ছবি বোকার মত তাকিয়ে আছে।শুদ্ধ আর কি বলেছে মনে করতে পারছে না সে।জোর দিয়ে মনে করার চেষ্টা করল আর কি বলেছে শুদ্ধ? কিন্তু কিছুতেই মনে পড়লো না।
শুদ্ধ চামচ দিয়ে ওর আঙ্গুলের ওপর হালকা টোকা দিয়ে বললো,
—আমি না আসা পর্যন্ত একা একা কিচেনে যাবে না।মনে থাকবে?
—থাকবে।
—ঠিক আছে।

শুদ্ধ ড্রেসিংটেবিলের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বডি স্প্রে করছে।ছবি দরজার কাছে ঘেঁষে ওড়নার সাথে আঙ্গুল পেঁচাচ্ছে।শুদ্ধ আয়নার ভেতর দিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল,
—কিছু বলবে?
—না।
—তাহলে কাঁচুমাচু করছো কেন?
শুদ্ধর কথা শুনে ছবি লজ্জায় দরজার কাছ থেকে সরে এলো।”তাড়াতাড়ি চলে আসবেন।” হাজার চেষ্টা করেও কথাটা বলতে পারে নি সে।
শুদ্ধ আলমারি থেকে কিসব কাগজপত্র বের করে সেগুলো একটা ফাইলে ভরে নিলো।তারপর আলমারিটা বন্ধ করে চাবিটা আলমারির ওপরে রেখে বেরিয়ে গেলো।
বেরোনোর সময় ছবিকে ডেকে আবার সতর্ক করে দিলো একা একা চুলার কাছে যাওয়ার দরকার নেই।সে ছাড়া অন্য যেই হোক ছবি যেন দরজা না খুলে। ছবি বাধ্য মেয়ের মত মাথা নাড়িয়ে শুদ্ধকে আশ্বস্ত করলো যাওয়ার সময় বলল,
—আমার বেশি দেরী হবে না।ভয় করবে?
—না।
—ভয় করলে আমাকে ফোন করো, আমি চলে আসবো।
—আপনি যান আমার ভয় করবে না।
—সত্যি তো?
—হুম!
—ঠিক আছে।আসি?
—খোদা হাফেজ।
শুদ্ধ চলে যেতেই ছবি দরজা আটকে টিভি চালু করে দিলো।টিভি দেখতে ভালো লাগছে না।টিভি বন্ধ করে রুমে এসে টুকটাক কাজ গুলো সেরে নিলো সে।এর মধ্যেই অনু ফোন দিয়েছে।
—হ্যালো ছবি? উঠেছিস?
—হ্যাঁ আপু অনেক আগেই উঠেছি।
— উঠে গেছিস? ভালো হয়েছে।আমি ভাবলাম একা বাসায় দুজনেই হয়ত নাওয়া খাওয়া ছেড়ে পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছিস।
—উনি তো নেই।
—নেই মানে?
—উনার কি কাজ আছে তাই বেরিয়েছেন।
—আমাকে তো বললো আজকে হস্পিটালে যাবে না।
—হস্পিটালে যায় নি, অন্য কি কাজ আছে বললো।
—তুই কি এখন বাসায় একা?বুয়া আসে নি?
—না।
—এই মহিলাকে আর বেশিদিন রাখা যাবে না।কাজের সময় একে পাওয়া যায় না।ভালো কথা তোর রান্নাঘরে যাওয়ার দরকার নেই।আমি শুদ্ধকে বলে দিচ্ছি ও আসার সময় খাবার নিয়ে আসবে।
—তার আর দরকার নেই।উনি নিজেই আমাকে নিষেধ করে গেছেন।
—তাহলে তো ভালোই হলো।তুই আবার কারবারি করে রান্নাঘরে ঢুকে পড়িস না।
—না যাবো না।তোমরা ফিরবে কবে?
—আর বলিস না।এখানে পরিবহণ ধর্মঘট চলছে।তোর ভাইয়া বললো আরো দু তিন দিন নাকি চলবে।
—তারমানে তো তোমরা আজকেও ফিরতে পারবে না।
—তো আর বলছি কি? আজকে নয় আরো দু তিনদিনেও ফিরতে পারবো কি না কে জানে।এদিকে অনুপলার জ্বর,সর্দি এক অবস্থা।
—সর্বনাশ।ডাক্তার দেখিয়েছো?
—হ্যাঁ।তোর ভাইয়া সঙ্গে করে নিয়ে গিয়ে দেখিয়ে এনেছে।
—এখন কি করছে ও?
—ঘুমাচ্ছে।
—আন্টি কেমন আছেন?
—উনি বেশ ভালোই আছে।কথাবার্তা বলার মানুষ পেয়েছেন।বাসায় তো সারাদিন একাই থাকেন।এখানে মানুষ পেয়ে সারাদিন গল্পে গুজবে সময় কাটে উনার।
—ঠিক আছে রাখছি।
—কোন সমস্যা হলে সাথে সাথে শুদ্ধকে ফোন করে বলবি।
—আচ্ছা ঠিক আছে।
—রাখছি।খোদা হাফেজ।

একা একা ভীষণ বোর লাগছে ছবির।কিছুক্ষণ বারান্দায় গিয়ে বসলো।বারান্দা থেকে উঠে ওয়াশরুমে ঢুকে গোসল সেরে নিলো।গোসল শেষে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে কিছুক্ষন দেখলো। আলমারি থেকে একটা লাল খয়েরী রংয়ের একটা শাড়ি বের করলো।শাড়িটা গায়ে জড়িয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষন নিজেকে দেখলো।সাতপাঁচ না ভেবে চট করে শাড়িটা পরে নিলো।ভেজা চুলগুলো আঁচড়ে কপালে গাঢ় লাল রংয়ের একটা টিপ দিলো।গাঢ় করে চোখে কাজল দিলো।
আয়নার নিজেকে দেখে নিজেই হাসছে।জীবনে এই নিয়ে দুইবার উঁহু! তিনবার শাড়ি পরেছে সে। একবার অনুর হলুদে,আজকে ছাড়া সবশেষে যেবার ওকে দেখতে এসেছিলো সেবার পরেছে। বড় হওয়ার পর থেকে আর কখনো শাড়ি পরে নি।শাড়ি পরলে নাকি মেয়েদের অদ্ভুত সুন্দর লাগে তাই সে ঘুরেফিরে আয়নার নিজেকে বারবার দেখছে।

কলিংবেল আওয়াজ শুনেই ওর মনে পড়লো শুদ্ধ আসার সময় হয়ে গেছে।শুদ্ধ গেছে অনেক্ষন হয়ে গেছে।সময় কীভাবে কেটে গেছে টেরই পায় নি সে।একলাফে শাড়িটা খুলে ব্লাউজের ওপর দিয়েই একটা জামা পরে নিলো।কপলের টিপ খুলে ফেললো,কাজল মোছা হয় নি,কিন্তু এখন এসব ভাবার সময় নেই।শুদ্ধ অনেক্ষনযাবত বেল বাজিয়ে যাচ্ছে।দৌঁড়ে গিয়ে দরজা খুলে দিলো।
দরজার বাইরে শুদ্ধ দাঁড়িয়ে আছে।গতকাল রাতের মতই ছবিকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করলো ওর পরনে একটা জামা তার নিচে পেটিকোট।প্রেগেন্যান্সির সময় অনু প্রায়ই পেটিকোটের সাথে জামা পরতো।
ছবি দরজা থেকে সরে শুদ্ধকে ভেতরে ঢুকার জন্য জায়গা করে দিতেই শুদ্ধ ভেতরে ঢুকলো।তারপর গলার টাই টা ঢিলে করতে করতে বললো,
—এটা কোন দেশি পোশাক পরেছো তুমি? কামিজের সাথে পেটিকোট!
—মানে?
—মানে বাইরের দেশে কাউকে স্বাগতম জানানোর জন্য নতুন পোষাক পরে অভিবাদন জানানো হয়।আমি ভাবলাম তুমি আমাকে ওয়েলকাম করার জন্য এই উদ্ভট পোষাক পরে দাঁড়িয়ে আছো।
নিজের দিকে তাকিয়ে ছবি গাল দুটো লজ্জায় লাল হয়ে গেলো।শুদ্ধর সামনে এমন অস্বস্তিতে পড়তে হবে জানলে এই জীবনে শাড়ি পরার নামও মুখে নিতো না।ইশশ!কি লজ্জা!
শুদ্ধ ওকে টেবিলের ওপর রাখা খাবারের প্যাকেট গুলো দেখিয়ে বললো,
—তুমি টেবিলে খাবার রেডি করো।আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।
ছবি প্যাকেট গুলো হাতে নিয়ে দেখলো অনেকগুলো প্যাকেট।প্যাকেট গুলো নিয়ে দ্রুত রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ালো।
টেবিলে খাবার সাজানো শেষ।খেতে বসে শুদ্ধ একবার খাবারের দিকে তাকাচ্ছে একবার ছবির দিকে।
—আসলে…
ছবি ইতস্তত করছে।শুদ্ধ ওকে অনুসরণ করে বলল,
—আসলে?
—মানে…
—মানে?
ছবি অসহায়ভাবে বসে রইলো।শুদ্ধ দুষ্টি হেসে বলল,
—বাকি খাবার কই ছবি?একা একা খেয়ে ফেলেছো?
ছবি ভীষণ অস্বস্তিতে পড়ে গেলো।খাবারের প্যাকেট বেশি দেখে ও রাতের জন্য রেখে দিয়েছিলো।
শুদ্ধ আবারও হাসলো। বললো,
–সরি!আমার এভাবে বলা ঠিক হয় নি।খিদে পেলে খাবে এতে লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই।
—না মানে এত খাবার কে খাবে।বাসায় মাত্র আমরা দুটো মানুষ।তাই রাতের জন্য কিছু রেখে দিয়েছি।
শুদ্ধ ছবির দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ হাসলো।তারপর ঠান্ডা গলায় বললো,
—খাবার গুলো আমি শুধু দুপুরের জন্য এনেছি।রাতেরটা অর্ডার দেওয়া হয়ে গেছে।ওরা এসে দিয়ে যাবে।জলদি করে বাকি খাবার নিয়ে এসো।
—এখন?
—তো আর কখন?
—এত খাবার কে খাবে?
—কেন আমরা?
—শেষ করতে পারবেন?
শুদ্ধ মুখটা সিরিয়াস সিরিয়াস ভাব করে বলল,
—না পারলে তুমি তো আছই।তোমার এমনিতেও ভিটামিনের অভাব।পুষ্টিকর খাদ্য খাওয়া উচিৎ।যদিও এখন লম্বা হওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু ঠিক জানি না।তারপরও মেডিকেল সাইন্স যেহেতু বলে পঁচিশ বছর পর্যন্ত লম্বা হওয়ার সম্ভাবনা আছে তাই চেষ্টা করতে দোষ কি?
ছবি অগ্নিচোখে শুদ্ধর দিকে তাকিয়ে আছে।
—কি হলো বসে আছো কেন?
মিটিমিটি হাসছে শুদ্ধ।ছবি ভেংচি কেটে বলল,
—আমার কি? কথায় আছে ,” কম্পানিকা মাল, দরিয়া মে ঢাল।” যে এনেছে সে বুঝবে।নষ্ট হলে তার হবে।
—তার নষ্ট হলে কিন্তু তোমারও হবে!
.
.
চলবে