আঁধারিয়া অম্বর পর্ব-১৪

0
1181

#আঁধারিয়া_অম্বর
#সুরাইয়া_সাত্তার_ঊর্মি
১৪।

গাড়ির ভিতরে চুপচাপ বসে আছে ইজহান। বাহিরে টিপটিপ বৃষ্টি শুরু হয়েছে মুহূর্তেই। অধিরাজ তার পাশেই বসে আছে। দুজনের দৃষ্টি, সামনের বিশাল বড় স্বচ্ছ কাচে মোড়ানো একটি বিশাল ব্যয়বহুল রেস্টুরেন্টের দিকে। যেখানে বসে আছে শ্যামা। গায়ে লাল কূর্তি, অস্থির মুখ, এলোমেলো চুল। বার বার চোখ বুলিয়ে যাচ্ছে ঘড়ির কাঁটায়। বোঝাই যাচ্ছে কারো জন্য অধির আগ্রহ করে বসে আছে সে। ইজহান ফোঁস করে একটি শ্বাস ছাড়লো। চোখে পাতায় নাড়া দিলো সেই ১২ বছর আগের একটি স্মৃতি।

খবরের কাগজের সেই প্রেম করতে চাওয়া বিজ্ঞাপনটি তারই ছোট ভাই আরমান দিয়েছিলো। ভাইয়ের তখন নতুন নতুন মন ভাঙ্গে, ভাঙ্গে বন্ধুত্ব-ও। দশ বছরের বন্ধুত্ব একটি মেয়ের জন্য এক নিমেষে মিশে যায়। ইজহান খুব ভেঙে পরে। যদিও, বরাবরের মতোই তার অভিব্যক্তি কেউ বুঝতেই পারতো না। তার মনের ভেতরে কি চলছে, গম্ভীর শীতল মুখ দেখে কারো বোঝার ক্ষমতা ছিলো না। তবে গম্ভীর ইজহান যখন আরো গম্ভীর, চুপচাপ হযে গেলো, আরমান তার ভাইয়ের অগোচরে সবটা খোঁজ নিলো। সে জান্তে পারলো, তার ভাই শ্যামাকে পছন্দ করে, আর শ্যামা? তারই বন্ধু রিদের সাথে ডেট করছে। এটি শুনেই আরমানের মাথা হ্যাং হয়ে যায়। তার থেকে বেশি রাগ উঠে যখন শুনে, রিদ জানার পরেও যে ইজহান তাকে ভালোবাসে, শ্যামার সাথে নিজেকে তবুও জড়িয়ে নেয়। এতে যেমনটি ঘৃণা করে রিদকে, তার থেকে বেশি ঘৃণা করে সে শ্যামাকে। কিন্তু আরমান তো জানেই না। ইজহান যে শ্যামাকে ভালোবাসে, তা কখনোই বলেই শ্যামাকে। তারপরেই সে তার ভাইয়ের জীবনে নতুন কারো আগমনের জন্য বুদ্ধি ঘাটায়। এবং কাজেও লেগে পড়ে।

একদিন রাতে,
ইজহান কফি মগ হাতে রাতের আকাশ দেখছিলো। চোখের সামনে ভাসছিলো শ্যামার শুভ্র মুখ। এক রাশ নিস্তব্ধতা চিঁড়ে ফোনের রিং বাজতেই ইজহানের ভাবনার ছেদ পড়ে, কোনো কিছু না ভেবেই ফোন তুলে, তার গম্ভীর ঝংকার তোলা কন্ঠে,

“হ্যালো ”

বলে। আর তখনি ওপাশ থেকে ভয়ে জড়সড় হয়ে আসা একটি চিকন কন্ঠ.. ভেসে আসে। ইজহান প্রথমতো কিছুই বুঝে না…। মেয়েটি যখন তাকে সুফিয়ান দ্যা সিক্রেট বয় বলল,

তখনি ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো সে। কারণ সুফিয়ান নামটি তেমন কেউ জানে না, এই নামে তার মা ডাকতো সব সময়, মা চলে যাওয়ার পর, নামটিও মুছে যায়। ইজহান ঠান্ডা গলায় তখন বলেছিলো,

“কে আপনি?”

ওপাশ থেকে ভয় কাটিয়ে মেয়েটি বলল,

“আমি, আমি #আধাঁরিয়া-অম্বরের বুকের এক চিলতে চাঁদ…! ”

ইজহান থমকে গেছিলো সেদিন। মেয়েটির কন্ঠে এক প্রকার মাদকতা ছিলো। দ্বিতীয় বারের মতোই ওই কন্ঠের মানুষটি প্রেমে পড়ে সে। সেই থেকে কথা চলতে থাকে… একদিন তারা ঠিক করে দেখা করবে। এবং যেই ভাবা সেই কাজ ভালোবাসা দিবসের দিনটি তারা বেঁছে নেয়। এবং পার্কে চলে আসে, একে অপরকে কিভাবে চিনবে, সে ভেবেই ম্যামা বলে ছিলো,

“আমার হাতে, টকটকে লাল রুমাল থাকবে, আর আপনি, এক গুচ্ছ কদম নিয়ে আসবেন সেদিন!”

ইজহান সম্মতি দেয়। কাঙ্ক্ষিত দিনটি যেদিন চলে আসে, সে রেডি হয়ে ছুটে আসে একটি রেস্টুরেন্টে। আর সেখানে এসে, লাল টুকটুকে শাড়িতে, লাল রুমাল হাতে শ্যামাকে বসে থাকতে দেখে ইজহানের পুরো দুনিয়া উল্টে যায়। স্থীর হয়ে যায় পা জোড়া। যেই মানুষটিকে সে ভালোবাসতো, সেই #আধাঁরিয়া_অম্বরের এক ফালি চাঁদ….! যার সাথে এত দিন প্রেম করলো সে? তাহলে? তাহলে কি শ্যামা রিদকে চিট করলো? একই সাথে দুই বন্ধুকে আঙ্গুলে নাচিয়েছে সে??

শুভ্র আকাশে মূহুর্তেই ঝড় উঠে গেলো। তছনছ করে দিয়েছিলো ইজহানের বুক। আজ-ও তার ব্যতিক্রম হচ্ছে না… শ্যামা আজো কারো জন্য বসে আছে, অপেক্ষা করছে কারো জন্য। ইজহান জানে, সেই একজনটাকে, সে তার বড় দুশমন। কথায় আছে,

”এক কালে থেকে যাওয়া তোমার ঘনিষ্ঠ বন্ধুই শত্রু হয়ে উঠে!”

আজ বাক্যটি মনে পড়ে তাচ্ছিল্য হাসলো। ঠিক তখনি ইজহান দেখলো, ব্ল্যাক সুটে একটি যুবক এগিয়ে যাচ্ছে শ্যামার দিকে৷ তা দেখেই শ্যামা দাঁড়িয়ে গেলো। শক্ত তার মুখ। কেমন যেন থমকে গেছে পুরোনো ভালোবাসার মানুষটিকে সামনে দেখে, রিদ খুব সুদর্শন। সে হাসি হাসি মুখে এসে জড়িয়ে ধরলো শ্যামাকে। শ্যামা রোবটের মতো দাঁড়িয়ে রইলো। তার কোনো ভাবান্তর দেখা গেলো না। কিন্তু দূর থেকে এই দৃশ্য দেখে ইজহান হাতের মুঠো শক্ত করে ফেললো। ঠান্ডা শীতল মুখ খানা এক মনস্টারের মতো হয়ে গেলো। অধিরাজ এমন হিংস্র হয়ে উঠা তার স্যারকে ভয় পেতে লাগলো।
এদিকে এখনো ধরে আছে শ্যামাকে রিদ, যেন হারিয়ে যাওয়া কিছু সে আবার ফিরে পেয়ে এক বুক শান্তি পেয়েছে, সে বলল,

“ওহো মাই গড, ফাইনালি আমি তোমাকে পেলাম জান। ”

বলেই গালের মাঝে চুমু খেয়ে বসলো শব্দ করে রিদ। এতেই হুঁশ ফিরে শ্যামার। সে সাথে সাথে ছাঁড়িয়ে নেয় নিজেকে, দাঁতে দাঁত চেপে বলে,

“don’t ক্রস লিমিট! ”

রিদ হেসে ফেললো। চেয়ারে বসে বলল,

“তুমি আগের মতোই রয়ে গেলে জান!”

শ্যামা তার কথা উত্তর না দিয়ে বলল,

” তুমি ইজহানের পিছনে কেন লেগেছো?”

রিদ বলল,

“সে তোমাকে আমার থেকে কেড়ে নিয়েছে, তাই!”

শ্যামা চেঁচিয়ে বলল,

“ওহো সাট আপ, ও আমাকে কেড়ে নেয়নি, আমি তোমাকে ছেঁড়েছি, তাও ১২ বছর আগে, তাউ তোমার কারণেই, ভুলে গেছো? ভুলে গেছো, তুমি আমার সাথে ১২ বছর আগে কি করেছিলে?”

রিদের মুখের হাসি উড়ে গেলো। সে উঠে শ্যামাকে বসিয়ে দিলো। তার দিকে ঝুঁকে বলল,

” শ্যামা আ’ম রেইলে সরি, ফর দ্যাট… সেদিন.. সেদিন কি জানি হয়ে গেছিলো আমার, আমাকে ক্ষমা করেও দাও প্লিজ! ”

বলেই রিদ শ্যামা মুখ তার দু হাতে ধরে নিলো। তখনি ছিটকে দূরে সরে গেলো শ্যামা। আর এই সব কিছু গাড়িতে বসে থাকা ইজহানের শরীরে আরো রাগ তুলে দিচ্ছে, যখন রিদ শ্যামার দিকে ঝুঁকে পড়লো, তার পুরো শরীরে লুকিয়ে গেলো শ্যামার দেহ। তখন মনে হচ্ছিলো একে অপরের সাথে চুম্বনে ব্যস্ত দুই নর-নারী। ইজহান তা সহ্য করতে পারলো না। গাড়ির মাঝে থাকা অধিরাজ ও তখন বিস্ময়ে বিমূঢ়। ইজহান সেই মুহূর্তেই গাড়ি থেকে বেড়িয়ে পড়লো। পাবলিক প্লেসে নিজের মুখে মাস্ক আর ক্যাপ পড়ে নিতেও ভুললো না। বড় বড় পা ফেলে ডুকে গেলো রেস্টুরেন্টে। অধিরাজ নিজেও ছুঁটে এলো। অধিরাজের মনে হচ্ছে শত বছরের ঘুমিয়ে থাকা বণ্য হিংস্র পশু জেগে উঠছে। অধিরাজ এক মনে তার ঠাকুরকে ডেকে গেলো। শ্যামার কথা ভেবেই বুকে ধকধক করছে, মনে হচ্ছে হৃদপিণ্ড বেড়িয়ে আসবে এখনি।

এদিকে শ্যামা রিদকে আবারো দূরে ঠেলে দিয়ে, বলল,

“আমার থেকে দূরে থাকো, আমি তোমাকে এক রত্তি ও বিশ্বাস করি না, তখন ছোট ছিলাম, অবুঝ ছিলাম। কিন্তু এখন নই!”

রিদ বলল,

” শ্যামা গিভ মি এ চান্স! প্লিজ!”

বড্ড করুন শোনালো রিদের কথা। কিন্তু পাত্তা দিলো না শ্যামা। ছোট একটা শ্বাস ছেড়ে বলল,

” গো টু হ্যাল”

বলেই গট গট করে বেড়িয়ে যেতে লাগলো শ্যামা, তখনি পিছন থেকে হাত ধরে আটকে ফেললো রিদ, বলল,

“আমার কথাটা শোনো, তুমি এভাবে যেতে পারো না, তুমি জানো না,হিতে বিপরীত হবে কিন্তু!”

শ্যামা ক্রুদ্ধ হয়ে বলল,

“তোমার যা ইচ্ছে করো, আই ডোন্ট কেয়ার।”

“তাহলে ইজহানকে না হয় জেলের ভাত খাইয়ে আনি!”

শ্যামা থমকালো। দু পা এগিয়ে এসে, আঙ্গুল তুলে বরল,

“ডোন্ট ডেয়ার…নয়তো আমার থেকে খারাপ কেউ জবে না!”

বলেই শ্যামা রেস্টুরেন্ট থেকে বের হতে নিবে তখনি ধাক্কা খায়, এক দীর্ঘাকায় এক লোকের সাথে৷ শ্যামা তাকাবার আগেই পিছন থেকে রিদ শয়তানি েক হাসি দিয়ে বলল,

“কেমন আছিস ইজহান? ”

ইজহানের নাম শুনতেই শ্যামার শরীরের এক ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেলো শরীরে। চোখে মুখে ভয় নিয়ে তাকাতেই সম্মুখীন হলো ইজহানের হিংস্র দৃষ্টিতে। ইজহান ঠান্ডা বরফ অথচ তার চাহনি ভয়ঙ্কর। শ্যামার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে রিদকে বলল,

” আ’ম গুড। ”

তারপর শ্যামাকে কাছে টেনে নিয়ে ওর কোমড় জড়িয়ে ধরে নিজের সাথে মিশিয়ে নিয়ে হেসে বলল,

“বউকে কাছে পেয়ে এবার ফিট এন্ড ফাইন হয়ে গেছি!”

রিদের হাসি উবে গেলো। রাগি মুখে বলল,

” শ্যামা আমার ছিলো, অার থাকবেই। ”

ইজহান তাচ্ছিল্য ছুঁড়ে দিয়ে, বলল,

“তোর স্বপ্নে!”

বলেই শ্যামার হাত শক্ত করে চেপে ধরে বেড়িয়ে গেলো সেখান থেকে। এদিকে শ্যামার অবস্থা নাজে হাল।ইজহানের বলিষ্ঠ হাতের চাপ সে সহ্য করতে পারছে না, আবার মুখ ফুঁটে কিছু বলেও পারছে না। শুধু থরথর করে কাঁপছে । ইজহান গাড়িতে এসে শ্যামাকে ধাক্কা মেরে ভিতরে ঢুকিয়ে দিলো। এবং ড্রাইভিং সিটে নিজে বসে পড়লো। আর যতটা সম্ভব স্প্রীডে বাড়ির দিকে যেতে লাগলো। শ্যামা ভয়ে আধমরা। ইজহানের মুখের অভিব্যক্তি কিছুই বুঝতে পারছে নগাড়ির ভিতর এক অস্বাভাবিক ঠান্ডা বিচরণ করছে। শ্যামা পরিবেশ ঠিক করার জন্য মুখ খুললো,

“মি.. মি.. ইজহান..”

এইটুকুই বলতেই ইজহান এমন করে চাইলো। শ্যামা তাতেই কেঁপে উঠলো। যখন তারা বাসায় পৌছালো। ইজহান শ্যামাকে টানতে টানতে নিজের রুমে নিয়ে গিয়ে ফেলে দিলো বিছানায়, আর……

চলবে,

ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।