আমার আকাশে তারা নেই ২ পর্ব-১৫ এবং শেষ পর্ব

0
455

#আমার_আকাশে_তারা_নেই ২
#লাবিবা_আল_তাসফি

১৫. (অন্তিম পর্ব–প্রথমাংশ)

কথায় আছে আবেগের বশীভূত হয়ে মানুষ সর্বদা ভুল সিদ্ধিন্তটাই গ্রহণ করে। এমনকি তাদের মাঝে এই চেতনাটুকুও লোপ পায় যে তার নেওয়া সিদ্ধান্তটা কতটুকু সঠিক। এই সিদ্ধান্ত তার জীবনে কতটুকু প্রভাব ফেলতে পারে। ইহানের ক্ষেত্রেও তেমনটাই হয়েছিল। তার ভেতর জেগে ওঠা অপরাধ বোধ তাকে ভুল সিদ্ধান্তকে বেছে নিতেই বাধ্য করেছিল। নুহাশের বিয়ে ইহান আর রুশা মিলেই ভেঙে দিয়েছিল। রুশার সাথে থাকা নুহাশের কিছু ক্লোজ ছবির মাধ্যমে। এতে হয়তো এক দিক থেকে ভালোও হয়েছিল। যে মেয়েটা নুহাশের নামে তিন কবুল পড়তো সেই মেয়েটা হাজার স্বপ্ন নিয়েই পা বাড়াতো নুহাশের জীবনে। তার আগমনের পর নুহাশের এমন তিক্ত অতীত কি মেনে নিতে পারতো মেয়েটা? কখনোই পারতো না। আর না পারতো স্বপ্নের মতো করে তার সংসারকে সাজিয়ে তুলতে। তাই আগে থেকেই জানিয়ে দেওয়াটা তারা প্রয়োজন মনে করেছিল। ওখান থেকে ফিরে আসার পর ইহান মাঝে মধ্যেই রুশার সাথে দেখা করে তার খোঁজ খবর নিতো। মাঝে মাঝে নিজে সাথে থেকে ডাক্তার চেকাপ করাতো। এগুলো সে নিজের দায়িত্ব বলেই মনে করতো। তবে সে এই ব্যাপারটা সকলের কাছ থেকে চেপে গেছিলো। বিশেষ করে ইচ্ছের থেকে। ভয় একটাই ইচ্ছে যদি রুশার এমন পরিনতির জন্য তাকে দোষারোপ করে! সে ইচ্ছের থেকে এমন কোনো অপবাদ নিতে চায়নি। সে চাইনি ইচ্ছে তাকে অবিশ্বাস করুক। আসলেই কি তাই? এখানে সে ইচ্ছের অবিশ্বাস এর কথা ভাবছিল কিন্তু সে নিজেই পারলো না নিজের অর্ধাঙ্গিনীকে বিশ্বাস করে সবটা খুলে বলতে। এতবড় একটা কথা লুকিয়ে গেছ স্ত্রীর থেকে। কথায় আছে সম্পর্কের ভিত মজবুত হয় বিশ্বাসের দ্বারা। যে সম্পর্কে আস্থা নেই, বিশ্বাস নেই, একে অপরকে সব খুলে বলার সাহস নেই সে সম্পর্ক নড়বড়ে হয়ে যায়। সামান্য হাওয়ায় হেলে পড়ে তার নীড়।

রুশা বরাবর কঠোর আত্মসম্মানবোধী। নিজেকে সেই ছোট থেকেই সে এভাবেই গড়েছে। পড়াশোনা প্রতি বিশেষ ফোকাস করেছে। সুন্দর একটা ক্যারিয়ার গড়ার স্বপ্ন সে বহুআগেই দেগে নিয়েছিল। খুব অল্প বয়সেই মেয়েটা ম্যাচিয়ুর হয়ে উঠেছিল। অনেক কষ্ট পরিশ্রমের পর সে আজ যখন সময় এলো নিজের জীবনকে গড়ার দ্বিরে পৌছালো ঠিক সে সময় নুহাশ নামক ঝড় সব কেড়ে নিলো তার থেকে। সর্ব হারা করে দিল তাকে। তার চাওয়াটাতো খুব বেশি কিছু ছিল না। নিজের সুন্দর একটা ভবিষ্যত গড়তে চেয়েছিল। অতঃপর ভালোবাসার একজন মানুষের সাথে সুন্দর একটা সংসার। ছোট্ট একটা পরিবার হবে তার। তার নিজস্ব পরিবার। এ সামান্য চাওয়াইতো ছিল তার। তবে কেন তা এভাবে নষ্ট হয়ে গেল? ছোট থেকে বাবা মা ছাড়া একাই এ পরিবেশে নিজেকে বড় করেছে রুশা। সে জানে একটা পরিবার ছাড়া বেঁচে থাকা কতটা কষ্টের। মাথার ওপর বাবা মেআয়ের ছায়া সন্তানের জন্য কতটা দরকার তা সে জানে। অন্যদিকে তার নিজের সন্তানকেও তার মতো করেই বাঁচতে হবে এ কথা ভাবতেই ভিষণ ভাবে ভেঙে পড়ে সে। সে তো এমনটা চায়নি। তার পাপের ফল তার সন্তান কেন ভোগ করবে? অতিরিক্ত চিন্তার ফলে ডিপ্রেশনে চলে যায় সে। বার কয়েক আত্মহত্যা করার চেষ্টাও করেছে। কিন্তু বাচ্চার কথা ভেবে আবারও থেমে গেছে। হাজার হলেও মায়ের মন তো! একজন মা কিভাবে তার সন্তানকে হত্যা করতে পারে? তার এমন খারাপ সময়ে ইহান তাকে বুঝিয়েছে। তার পাশে থেকে সাহস জুগিয়েছে। নিজের জন্য না হোক বাচ্চাটার জন্য হলেও তাকে বেঁচে থাকতে হবে এটাই বুঝিয়েছে ইহান তাকে। ইহান এটাও বলেছিল এই বাচ্চাটাকে সে তার নাম দিবে। তার পরিচয়েই বেড়ে উঠবে বাচ্চাটা। ইহানের কথাগুলো সে মেনে নিয়েছে। কারণ এ মুহূর্তে ইহানের এমন কথা তার কাছে স্বর্গীয় বার্তা বৈ কিছুই নয়। নিজেকে আবার গুছিয়ে নিলো রুশা। এর মাঝেই রুশা তার সন্তানকে পৃথিবীতে আনলো। ফুটফুটে একটা বাচ্চা ছেলে। বাচ্চাটার ছোট মুখে সুন্দর হাসি দেখেই তো সে তার সব কষ্ট ভুলে গিয়েছিল। ছোট ছোট হাত পা ছুটে যখন বাচ্চাটা খেলতো তখন মনে হতো এইতো তার বেঁচে থাকার কারণ। এর জন্যইতো সে বেঁচে আছে। সপ্তাহ খানেক বেশ ভালোই চলছিল কিন্তু হঠাৎ করেই রুশার মাথার ব্যাথাটা বেড়ে গেছে। অসহ্য যন্ত্রণা সহ্য করার বাইরে। রুশা একাই ডাক্তার দেখিয়ে আসলো। ইহানকে এ ব্যাপারে আর কিছুই জানায়নি সে। একটা মানুষকে আর কতই বা বিরক্ত করা যায়? রিপোর্ট আসলো ঠিক একদিন পর। রিপোর্ট দেখে ভেঙে পড়লো রুশা। এত এত অপূর্ণতা তাকে গ্রাস করে নিচ্ছিলো ক্রমাগত। ব্রেন টিউমার ধরা পড়েছে তার। ইহানকে কল করে বাসায় ডাকে। অন্যদিনের মতোই ইহান দেখা করতে আসে। কিন্তু রুশা অন্যদিনের মতো ব্যাবোহার করেনা। সে ইহানকে অবাক করে দিয়ে তাকে বিয়ে করার জন্য প্রপোজাল দেয়। এটা অনাকাঙ্খিত ছিল। ইহান এটা কখনোই আসা করেনি। ইহান রেগে যায়। রুশাকে আজেবাজে কথা শোনায়। কিন্তু রুশা যখন তার রিপোর্ট দেখায় তখন ইহান থেমে যায়।

–”অল্প কিছুদিনের অতিথি হিসেবে তোমার জীবনে পা রাখতে চাইছি। নিজের একটা পরিবার দেখতে চাইছি। বেশি কিছুনা শুধু মাত্র তুমি আমি আর এই বাচ্চাটা মিলে একটা পরিবার হবে কিছুদিনের জন্য? তোমার থেকে ইচ্ছের অধিকার আমি কখনোই কেড়ে নিব না প্রমিস। এই মৃত্যু পথযাত্রীর শেষ ইচ্ছাটা কি রাখার মতো?”

রুশার ব্যাপার নিয়ে ইহান প্রথম থেকেই নিজেকে দোষারোপ করে যাচ্ছিলো। আর এখন এমন কথায় সে মানা করতে পারে না। হয়তো রুশার জন্য তার মনেও একটা সফট্ কর্ণার তৈরি হয়ে গিয়েছিল বলেই।
তিন কবুল পড়ে ইহান নিজের স্ত্রী রূপে গ্রহণ করে নিলো রুশাকে। কবুল বলার সময় ইহানের চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা পানি ঝড়ে পড়েছিলো। ইচ্ছে তার ভালোবাসা ছিল। ইচ্ছেকে এভাবে ঠকাতে তার মন কিছুতেই সায় দিচ্ছিলো না। কিন্তু সে হেল্পলেস। রুশার নজর এড়ায়নি ইহানের চোখের পানি। খারাপ লেগেছিল ভিষণ। তার নিজেকে ভিষণ লোভী মনে হয়েছিল সে মুহূর্তে। যে মানুষটা তার জন্য এত কিছু করলো তার সাথে এমন করাটা তার কি ঠিক হলো? কিন্তু পরক্ষনেই নিজেকে স্বভাবিক করে নিলো। নিজের জন্য এতটুকু অন্যায় করাই যায়। অন্যায়তো সর্বদা তার সাথেই হলো। এবার নাহয় সে কারো সাথে অন্যায় করলো! একটু ভালো থাকার অধিকারতো তারও আছে।

কেটে যায় দুদিন। ইহান এ দুদিনে কোনো প্রকার যোগাযোগ করেনি রুশার সাথে‌। রুশা অনেকবার কল করেও যখন ইহানের খোঁজ পায়না তখন সে বাধ্য হয়ে অফিসের নম্বরে কল করে। এভাবে অফিসের নাম্বারে কল করার জন্য ইহান প্রথমে প্রচন্ড রেগে যায়। কিন্তু পরক্ষনেই রুশার বলা একটা কথায় সে চুপ হয়ে যায়।

–”আমার এখানে ভালো লাগছেনা। তুমি আমায় তোমার বাড়িতে নিয়ে যাবে নাকি আমি একাই যাব?”

রুশার ব্লাকমেলে বাধ্য হয়ে ইহান রুশাকে বাড়িতে নিয়ে যায়। সে এতটাই ডিপ্রেসড হয়ে পড়েছিল যে কাকে কিভাবে কি বলবে কিছু বুঝে উঠতে পারছিল না। তার নেওয়া পদক্ষেপগুলো কতটা ভুল ছিল সেটা সে তখন বুঝতে পেরেছিল যখন ইচ্ছে তাকে ছেড়ে দূরে চলে গেল। তখন বুঝেও কিছু করার ছিল না। পরিস্থিতি তার সাথে নেই। না তখন ছিল আর না এখন।

সকল কিছু জানার পর শারমিন বেগম রুশার উপর ভিষণ রেগে যান। তার প্রথম থেকেই সন্দেহ ছিল এমন মিষ্টি মুখের পেছনে নিশ্চই কোনো দানবিয় রূপ আছে মেয়েটার। শেষ পর্যন্ত সেটাই প্রমাণ হলো। সে কিছুতেই রুশাকে তাদের সাথে রাখতে রাজি ছিল না। কিন্তু ততদিনে রুশার ফিজিকাল কন্ডিশন আরো খারাপের দিকে চলে গেছিলো। তাই মানুষ হিসেবে এমন অসুস্থ মেয়েটাকে বের করে দিতে পিরেননি তিনি। নাজমুল সাহেব বরাবরের মতো চুপ করেই ছিলেন। কারণ ইহান এ ব্যাপারে তাকে আগেই জানিয়েছিল।

চলবে……….

(ভুল ত্রুটি ক্ষমা সুন্দর চোখে দেখবেন।)

#আমার_আকাশে_তারা_নেই ২
#লাবিবা_আল_তাসফি

১৫. (অন্তিম পর্ব-শেষ)

–’ডিউক! আপনাকে ভিষণ হ্যান্ডসাম লাগছে। কিন্তু এই রাতের বেলা সানগ্লাস পড়ার থিওরিটা ঠিক বুঝলাম না। একটু বুঝিয়ে বলবেন কি?’

বর্তমানে ইচ্ছের সাথে ডিউকের বেশ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। ডিউক যদিও সম্পর্কটাকে বন্ধুত্ব থেকে এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যেতে চায় কিন্তু ইচ্ছের এ ব্যাপারে কোনো আগ্রহ না দেখানোতে সে আর কিছু বলার সাহস পায়না। তবুও সে সর্বদা ইচ্ছের সামনে নিজেকে পরিপাটি হিসেবে তুলে ধরতে পছন্দ করে। চেষ্টা করে ইচ্ছের একটু দৃষ্টি আকর্ষণ করার। কিন্তু আবেগের বশে এমন বোকামি করে ফেলবে সেটা বুঝতে পারেনি। ইচ্ছের কথায় সে ভিষণ লজ্জা পেল। কিন্তু তাও পরিবেশ স্বাভাবিক করতে সে হেসে বলল,

–’আরে না না আমি এটা নতুন কিনেছি তাই তোমাকে দেখাচ্ছিলাম। কেমন মানিয়েছে আমায়?’

–’নতুন?’

–’হ্যাঁ। আজ-ই কিনলাম।’

–’কিন্তু আমিতো এর আগে বহুবার এই গ্লাসটা আপনায় পড়তে দেখেছি।’

–’না দেখোনি। মানে দেখেছো বাট এটানা। আসলে এই মডেলটা আমার অনেক পছন্দতো তাই বারবার এই মডেলটাই কিনি।’

–’ওহহ আচ্ছা! তাহলেতো দোকানদার আপনায় ঠকিয়েছে। চলুন ঐ দোকানে। বেটাকে ধরে আচ্ছা ধোলাই দিতে হবে।’

–’আরে! এই! কেন কেন?’

–’কারণ সে আপনায় ঠকিয়ে একটা পুরোনো গ্লাস দিয়েছে। ইসস কত ইনোসেন্ট আপনি!’

ডিউক বুঝতে পারছেনা এখন তার কি করা উচিত। এভাবে ফাসাবে ইচ্ছে তাকে সেটা সে বুঝতে পারেনি। এই মেয়ে যদি সত্যিই শপে যায় তাহলে সম্মানের কানা কড়িও টিকে থাকবে না। সব ধুয়ে মুছে সমুদ্রে ভেসে যাবে। ডিউক কিছু ভেবে না পেয়ে কল আসার বিহানা দেখিয়ে দ্রুত বেকারি থেকে বের হয়ে যায়। ডিউক চলে যেতেই ইচ্ছে দম ফাটানো হাসিতে মেতে ওঠে। সে ইচ্ছে করেই ডিউককে এমন অস্বস্তিতে ফেলেছে যাতে সে দ্রুত চলে যায়। খুব বেশিই বাচাল লোকটা। কিন্তু সহজ-সরল মাইন্ডের। ইচ্ছে জানে ডিউক তার উপর দুর্বল। হয়তো ভালোওবাসে। কিন্তু এই ভালোবাসার উপর যে তির আস্থা নেই। সে আনমনেই বলে,

–’এক সমুদ্র সমান ভালোবাসা পেয়েছি আমি। উপোভোগ করেছি কাছ থেকে। পরিমাপ করেছি তার গভীরতা। বিলিন করেছি নিজেকে। আবার নিজ চোখেই সেই ভালোবাসার বিনাশ হতে দেখেছি। সবকিছু হারিয়ে গেল। রেখে গেলো কেবল কিছু তিক্ত স্মৃতি। যা আমাকে রোজ কাঁদায়। এমন ভালোবাসা আমি আর পেতে চাইনা। আমি মুক্ত পাখির ন্যায় বাঁচতে চাই। কোনো মায়ার বাহুডোরে আর আটকাবো না নিজেকে।’

____________

ইচ্ছে ইহানের জীবন থেকে হারিয়ে গেছে আজ দুবছর হয়ে গেলো। দুবছর পরও তাদের রুমটা সেই আগের মতোই আছে যেমনটা ইচ্ছে রেখে গিয়েছিলো। এ রুমটাতে কারো ঢোকার পারমিশন নেই। এখানে মাঝে মাঝে ইহান এসে সময় কাটায়। ইচ্ছের রেখে যাওয়া স্মৃতি গুলোতে বিচরণ করে। কোথাও একটা শান্তি খুঁজে পায় সে। এই জনমানব পূর্ণ শহরে সে রোবটের মতো ছুটে চলে। যখন এ সকল থেকে দূরে এসে এই রুমটিতে ঢোকে তখন সকল ক্লান্তি‌ নিমিষেই উধাও হয়ে যায়। দেয়ালে টাঙ্গানো ইচ্ছের ছবিটাতে সে কখনো ধুলা জমতে দেয়না। খুব যতনে সে ছবিটাকে আগলে রাখে। ছোট্ট ইরফান যখন খুব কাদে তখন ইচ্ছের এই ছবিটা দিয়েই তার কান্না থামাতে হয়। ইচ্ছের ছবিটা দেখলেই বাচ্চাটা আদো আদো কন্ঠে মা বলে ডাকে। ভারী সুন্দর লাগে তখন। ইচ্ছেও কি খুশি হতো এটা দেখলে?
ইহান একজন সিঙ্গেল ফাদার। রুশা মারা গেছে মাস বারো আগে। শেষ মুহূর্তে এসে মেয়েটা খুব অনুতপ্ত হয়েছিল। মৃত্যুর সময় এলে বোধহয় সবাই সবার ভুল বুঝতে পারে। রুশা মারা যাওয়ার পর থেকে ইরফানকে ইহান একা হাতে সামলাচ্ছে। ইচ্ছে চলে যাওয়ার পরথেকে ইহান নিজেকে ঘরবন্ধী করে নিয়েছিলো। পাগল পাগল বিহেব করতে শুরু করেছিলো। কোনো ভাবেই যখন তাকে বোঝানো যাচ্ছিলো না তখন ইরফানের ভবিষ্যত নিয়ে প্রশ্ন করেন নাজমুল সাহেব। এটাও জানতে চান সে এই ছোট বাচ্চাটার জীবনটাও নষ্ট করতে চায় কিনা। এ কথাটা ওষুধের মতো কাজ করেছিল। এতগুলো জীবন তোস সে নষ্ট করলো। এবার নাহয় একটা জীবন গড়ে দিলো! এরপর আবার আগের গতিতে কাজ শুরু করে। একজন বেষ্ট বাবা হয়ে ওঠার প্রচেষ্টায়।

বর্তমানে ইহান ইচ্ছের হাস্যজ্জল মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। ছবিটা যেন একদম জীবন্ত। তার দিকেই হাসি মুখে তাকিয়ে আছে‌। কি মায়াবী সে মুখ, সে মুখের হাসি। ইচ্ছের ছবিটা দেখতে দেখতেই ইহান বলল,

–’তুমি আকাশের উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো ইচ্ছে। যাকে উজ্জ্বলতায় মানায়। যাকে খোলা আকাশে জ্বলতে দেখতে সবাই পছন্দ করে। তোমার এই উজ্জ্বলতা মলিন না হোক কখনো। ইমার আকাশের মেঘ তোমায় গ্রাস করে নিয়েছিলো। অন্ধকারে টেনে নিয়েছিলো তোমায়। তুমি সে মেঘের বেড়াজাল থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পেরেছো। আমি তাতে কষ্ট পেলেও অভিমান করিনি। আর না কোনো অভিযোগ। তোমার সামনে দাঁড়ানোর মতো সাহস আমার নেই। তাই আমি তোমায় খুজবোনা। শুধু বলবো যেখানেই থাকো ভালো থেকো। আর আমায় কখনো ক্ষমা করোনা। যেটার যোগ্য আমি নই সেটা আমায় কখনোই দিয়ো না।’

ইহান কাঁদে নিঃশব্দে। তার এই কান্নার শব্দ কারো কানে পৌছায় না। কেবল এই চার দেয়াল তার কান্নার সাক্ষী হয়। হঠাৎ ছবির পেছনে গুজে রাখা পেপারটা নিচে পড়ে যায়। ইহান আলগোছে হাতে তুলে নেয় পেপারটি। পেপারটি খুলতেই উপরের লেখা দেখে বোঝা যায় এটা তাদের ডিভোর্সের পেপার। পেপারটির এক কোনে ইচ্ছের নাম জ্বলজ্বল করছে। কিন্তু ইহানের সাইন নেই সেখানে। এই পেপারে সাইন করার মতো এতটা সাহস তার নেই যে!
_______________

ওয়াশিংটন এর রিফলেকটিং পুলের সামনে দাঁড়িয়ে ইচ্ছে তার নিজের প্রতিবিম্বকে দেখছে। সেখানে সে নিজেকে নয় বরং নিজের অতীতকে যেন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। মানুষ সুন্দর সময়, সুন্দর মুহূর্ত গুলোকে ভুলতে পারলেও জীবনের কালো অধ্যায়গুলো থেকে কখনোই চিরতরে মুক্ত হতে পারেনা। এগুলো আজীবন তাড়া করে বেড়ায়। ইচ্ছে এসব ভাবছিলো ঠিক তখনি পাশ থেকে ডিউক বলে উঠলো,

–’তোমার কি মনে হয় তুমি সারাটা জীবন একা কাটিয়ে দিতে পারবে?’

ইচ্ছে আলতো হাসে। হাসি মুখেই বলে,’ নিজেকে নিয়ে এতটুকু গ্যারান্টি আপনাকে দিতেই পারি। ভরসা করি আমি নিজেকে।’

ইচ্ছের কথায় ডিউক তাচ্ছিল্য হাসলো। আজ তার হৃদয় ভেঙেছে। অনেক আলা নিয়ে সে ইচ্ছেকে মনের কথা জানিয়েছিল। ভরসা ছিল ইচ্ছে তাকে নিরাশ করবে না। কিন্তু তার ধারণা সম্পূর্ণ ভুল করে দিয়ে ইচ্ছে তাকে না করে দিল।

–’একটা মেয়ের জীবনে একা চলা কতটা কষ্টের তুমি জানো? আজ বলছো একা থাকবে কিন্তু দুদিন বাদেই তোমার একজন পার্টনার এর প্রয়োজন ফিল হবে। তবে সে পার্টনার আমি কেন নই?’

–’একজন মেয়েকে আপনি যতটা দুর্বল ভাবছেন ততটা দুর্বল ও কিন্তু নই। আমরা মেয়েরা মায়ের জাত। আর মায়ের থেকে সমর্থবান এ পৃথিবীতে আর কেউ নেই। আমাকে নিয়ে ভাববেন না। আমি ঠিক নিজেকে গুছিয়ে নিবো।’

_______________

লাল রঙের একটা শাড়ি তমার হাতে তুলে দিয়ে তার মা রেগে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। যাওয়ার আগে বারবার বলে গেছেন দশ মিনিটের মাঝেই যেন তমা শাড়ি পড়ে তৈরি হয়ে নেয়। তমা মায়ের যাওয়ার দিকে হতিশ চোখে তাকিয়ে থাকে। এতটা কঠোর তার মা কিভাবে হতে পারে? তার মা কেন বুঝতে পারছে না এই বিয়েটা সে করতে চায়না। যেই মানুষটিকে সে পাগলের মতো ভালোবাসে তার ছোট ভাইয়ের সাথেই কিনা তার বিয়ে! সে কিভাবে এ বিয়ে করতে পারে? তমা দ্রুত তার সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়। একটা কাগজে তার মাকে উদ্দেশ্য করে ছোট একটা চিঠি লিখে বেডের উপর রাখা লাল শাড়ির ভাঁজে রেখে দেয়। ফেলে রাখা পুরোনো জামাকাপর খুঁজে তার মায়ের একটা বোরকা পেলে সেটা গায়ে জড়িয়ে চুপিসারে রুম থেকে বেরিয়ে পড়ে তমা। হাতে তার জমানো অল্প কিছু টাকাও নিয়ে নেয়। জীবনে এটার প্রয়োজন ভিষণ। বাড়িতে অনেক মানুষ থাকায় তাকে কেউ সেভাবে খেয়াল করলো না। মেইন রোডে পৌঁছাতেই এতক্ষণ চেপে রখখখ শ্বাস ছাড়লো সে। উদ্দেশ্যহীন ভাবে সে একটা বাসে উঠে বসলো। এতবড় প্রথিবীতে তার থাকার মতো একটা কোণ ঠিক পেয়ে যাবে সে।

_______________

কেটেছে সময় পেরিয়েছে বছর। ইচ্ছে বাংলাদেশে ফিরেছে ছমাস হয়ে গেছে। বাংলাদেশে ফিরেই সে সকলের খোঁজ নিয়েছে। দূর থেকে ইহানকেও দেখে এসেছে সে। ইহান তাকে ছাড়া বেশ আছে। এতে ইচ্ছের খারাপ লাগেনা। এটা সে অনেক আগেই মেনে নিয়েছিল। কেবল নিজ চোখে দেখার বাকি ছিল মানুষটা কেমন আছে। ইরার বিয়ে হয়ে গেছে। সে বেশ সুখেই আছে। নাজমুল সাহেব বয়সের ভারে অনেকটা দুর্বল হয়ে পড়েছেন। ইচ্ছের খুব মন চায় তার সাথে একবার দেখা করতে কিন্তু অতীতকে সে আর সামনে আনতে চায়না। তির থেকে যেভাবে চলছে সেভাবেই নাহয় চলতে থাকুক।
ইচ্ছে একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে উচ্চপদে চাকরি করছে। পাশাপাশি সে ছোট একটা গার্মেন্টস ওপেন করেছে অসহায় মেয়েদের কাজের সুযোগ করে দেওয়ার জন্য। বর্তমানে তার এই গার্মেন্টসে পয়ত্রিশ জন মেয়ে কাজ করে। তার বিশ্বাস একসময় তার এই সংখ্যা বেড়ে পাঁচশততে দাড়াবে।

______________

–’এবার ছুটিতে কোথায় যাওয়ার প্লান আছে?’

এই প্রশ্নে ইচ্ছে বেশ উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল,’ স্কাই ডাইভিং করলে কেমন হয়? পাখির মতো আকাশে উড়বো। ইশশ ভাবতেই নিজেকে পাখির মতো মনে হচ্ছে।’

তমা হাসে। ইচ্ছের এতো আগ্রহ দেখে সে মানা করতে পারেনা। যদিও সে উচ্চতায় অনেক ভয় পায়। তবুও সে ইচ্ছেকে বলে সে ব্যবস্থা করে ফেলবে। তমা আবারো ভাবে ইচ্ছে তার জন্য ঠিক কতটা লাকি। ইচ্ছে না থাকলে আজ হয়তো তাকে পথে পথে ঘুরে বেড়াতে হতো। বাড়ি থেকে বেরিয়ে সেদিন সে ঢাকায় চলে এসেছিলো। ভেবেছিলো এতবড় শহরে একটা কাজের ব্যবস্থা ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু ভাবনার মতো বাস্তবতা সহজ ছিলোনা। অবশেষে এক বাড়িতে ঝি এর কাজ নেয়। মাস খানেক পর একদিন বাজারে এক দোকানদারের সাথে তার ভিষণ তর্কাতর্কি লেগে যায়। সেদিন ইচ্ছেও বাজারে গিয়েছিলো সবজি কিনতে। তর্কাতর্কির মাঝেই ইচ্ছের সাথে তার দেখা হয়। ইচ্ছে তাকে দেখে অনেকটাই অবাক হয়েছিলো। কারণ তার পোশাক চলাফেরা পুরোটাই অন্যরকম ছিলো। সেদিন থেকেই সে ইচ্ছের সাথেই আছে। বর্তমানে সেই ইচ্ছের গার্মেন্টস দেখাশোনা করে। তাদের দুজনের জীবনের গতি একই। তারা দুজন-ই আছে দুজনের জন্য। বেশ আছে তারা। কাজের ফাঁকে ফাঁকে গল্প করা। মাঝে মাঝে উদ্দেশ্যহীন ভাবে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে খোলা আকাশের নিচে হাতে হাত রেখে ঠান্ডা বাতাস উপোভোগ করা। কখনোবা ছোট্ট চায়ের দোকান থেকে মাটির কাপে চা খেতে খেতে আকাশের তারা গোনার প্রতিযোগিতা করা। ছুটি পেলেই সমুদ্র, বন কিংবা পাহাড়ে চড়ে বেরানো। এইতো বেশ আছে তারা তাদের জীবনে। কে বলেছে পুরুষ ছাড়া নারী জীবন বৃথা?

সমাপ্ত

আমার আকাশে তারা নেই সিজন-০১ গল্পটি পড়তে লেখাটি উপর ক্লিক করুন।