পর্ব ১৩+১৪
#আমার_আসক্তি_যে_তুমি
#Part_13
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
.
?
গান শেষে যখন চুপ করে বসে থাকি তখন কাউরো আওয়াজে চমকে যাই হুট পিছে ঘুরতে নিলেই ভারসাম্য রাখতে না পেরে টিলা থেকে পড়ে যেতে নেই ঠিক তখনই কেউ আমার হাত টান দিয়ে নিজের কাছে নিয়ে আসে। টানটা জোরে হওয়ায় আমি তার উপরে পড়ে যাই যার ফলে সে তাল সামলাতে না পেরে দুইজনই নিচে পড়ে যাই। দুইজনে গড়িয়ে পড়ি নিচে। সে নিচে পড়ে আর আমি তার উপরে। এতক্ষণ আমি ভয়ে চোখ খিঁচে বন্ধ করে ছিলাম। আমি পিটি পিটি করে চোখ খুলেই যাকে দেখতে পাই তাতে আমার চোখ ছানাবড়া। কেন না আমি যার উপর পড়েছি সে আর কেউ নয় বরং রিয়ান। তিনি চোখ বড় বড় করে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। আমার ঝুটি করা চুলগুলো তার মুখের উপর এসে পড়েছে। আমি তারাতাড়ি তার উপর থেকে উঠতে নিলে পা পিছলে আবার তার উপর পড়ে যাই। তিনি কিছুটা মুখ কুচকিয়ে নিলে কিন্তু আওয়াজ করলেন না। বুঝতে পারলাম তিনি হয়তো হাল্কা ব্যথা পেয়েছে। এইবার আমি খুব সাবধানে উঠে দাড়াই আর তার দিকে হাত বাড়িয়ে দেই। সে কিছুক্ষণ আমার হাতের দিকে তাকিয়ে থেকে হাতটা ধরে নেয়। আমি তাকে উঠে দাড়াতে সাহায্য করি।
রিয়ান উঠে গিয়ে নিজের জামা থেকে ময়লা মানে মাটিগুলা ঝাড়ছেন। আমি নিজের দিকে তাকিয়ে দেখি আমার গায়েও মাটি লেগে আছে। তাই আমিও আমার গায়ে লেগে থাকা মাটিগুলা ঝেড়ে ফেলি। তিনি নিজের জামা ঝাড়তে ঝাড়তে বলে।
.
— তুমি ঠিক আছো তহ?? কোথাও ব্যথা পাও নি তহ??
.
— না আমি একদম ঠিক আছি। আপনি কোথাও ব্যথা পান নি তহ??
.
— না।
.
তারপর আমরা আর কিছু বলি না। চারদিক একদম নিস্তব্ধ। দূর থেকে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক কানে আসছে। এক দামকা হাওয়া এসে শরীরটাকে ঝুড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছে। আমি আড়চোখে একবার রিয়ানের দিকে তাকালাম। চাঁদের স্নিগ্ধ আলো এসে পড়েছে তার উপর। স্নিগ্ধ আলোয় তার মুখটা একদম ঝলঝল করে উঠেছে।
আমার কেন জানি রিয়ানকে দেখে লজ্জা লাগছিল। হৃদয়ের মাঝে এক অন্যরকম অনুভূতি নাড়া দিচ্ছিল যা আগে কখনো দেই নি। হুট করেই এই নিরবতা পেড়িয়ে রিয়ান বলে উঠে।
.
— তুমি এত রাতে এইখানে কি করছিলে??
.
— আবব.. হঠাৎই ঘুমটা ভেঙে গেল! আর ঘুম আসছিল না তাই বাইরে হাটাহাটির জন্য বেড়িয়ে ছিলাম। কিন্তু বাইরে এসে যে এত সুন্দর মনোরম পরিবেশ উপভোগ করতে পারবো তা বুঝতে পারি নি। তাই এইখানে এসে বসে পড়লাম এই সুন্দর জোৎস্নাময় রাতটিকে পর্যবেক্ষণ করতে। আচ্ছা আপনি এইখানে কি করছিলেন??
.
— ওই একই তুমি যা করছিলে। ঘুম আসছিল না তাই এই সুন্দর স্নিগ্ধময় রাত দেখতে বেড়িয়েছিলাম আর কি!! হঠাৎ এক মধুর ধ্বনি কানে আসতেই থমকে গিয়েছিলাম। ধ্বনিটাকে অনুসরণ করতে করতেই এইখানে চলে আসলাম। আর এসে তোমাকে দেখতে পেলাম।
.
— অহহ আচ্ছা।
.
— তুমি কিন্তু অনেক সুন্দর গান গাও। কোথাও শিখেছিলে বুঝি?
.
— তেমন না। মাঝে মধ্যে মন ভালো থাকলে এমনেই গাওয়া হয় আরকি। লজ্জা মাখা কন্ঠে।
.
— অহ আচ্ছা। তা এখন কি আরও থাকবে নাকি যাবে??
.
— আরেকটু থাকতে ইচ্ছে করছে।
.
— তহ চল এক সাথেই থাকি।
.
আমিও মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ সূচক উত্তর দিলাম। আবার সেই টিলার উপরে গিয়ে দুইজনে বসলাম। দুই হাত পিছে নিয়ে ভর দিয়ে বসে চাঁদের দিকে আনমনে তাকিয়ে আছি। আকাশে যে কত শত তারা। আমার কাছে মনে আকাশের তারা গুলো যেন প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে। মেঘের আড়ালে কিছু তারা যেন চাঁদের সাথে লুকোচুরি খেলা খেলছে। মাঝে মধ্যে এক দমকা হাওয়া এসে শরীরে এক শিহরণ তৈরি করে দিয়ে যাচ্ছে। চারদিকে এই নিরবতা পেড়িয়ে রিয়ান বলে উঠে।
.
— সকালের ঘটনার জন্য বুঝি আজ সারাদিন আমার পাশে আসো নি!!
.
তার এমন কথায় আমি বেশ অবাক হয়ে গেলাম আর সাথে সাথে একটু নড়ে চড়ে বসলাম। গুলাটা পরিষ্কার করে মুখে মিথ্যা হাসি টেনে বললাম।
.
— না তেমন কিছু না। কাজে ব্যস্ত ছিলাম তাই আর অন্য কোন দিকে মন ছিল না। কিছুটা অপ্রস্তুত গলায়।
.
— কাজের অজুহাত দেখাচ্ছো??
.
— না মানে!!
.
— আমি তোমায় ভালো ভাবে না চিনলেও মোটামুটি চিনি। তোমার স্বভাব সম্পর্কে আমার কিছুটা হলেও ধারণা আছে। তুমি চুপ থাকার মেয়ে না। অনেকটা চঞ্চল প্রকৃতির। আর আমার সাথে তোমার চঞ্চলতা একটু বেশি প্রকাশ পায়। তাই আমাকে এইসব অজুহাত দেখিও না।
.
আমি অবাক চোখে তাকে দেখতে লাগলাম। তাঁর মানে তিনি আমায় লক্ষ করেছে আমার কাজ গুলো সে পর্যবেক্ষণ করেছে। ভাবতেই এক প্রশান্তির হাসি ফুটে উঠলো আমার মুখে কিন্তু তাও আমি কিছু বলতে পারলাম না শুধু ছোট করে “হুম” বলে কথাটা এড়ানোর বৃথা চেষ্টা করলাম।
.
— দেখ এত অনুশোচনা বোধ করে লাভ নেই। আমাদের মধ্যে তেমন কোন সম্পর্ক নেই যে তোমাকে এমন অনুশোচনা বোধ করতে হবে না। যে সম্পর্ক আছে তা শুধু টিচার আর স্টুডেন্টের। আর এর মধ্যে এমন অনুশোচনাবোধটা না আনলে খুশি হবো। আমাদের যা পেশা তাতেই এমন জিনিস মানায় না।
.
তার কথা শেষে আমি শুধু মাথা নাড়ালাম। কেন জানি তার কথা শুনে বুকের ভিতরটা চিন চিন করে ব্যথা করে উঠলো। গলাটা ধরে আসলো। কেন জানি ইচ্ছা করলো অধিকার খাটিয়ে জিজ্ঞেস করতে!!
” আমাদের মধ্যে কেন তেমন সম্পর্ক নেই?? কেন আমাদের মধ্যে অনুশোচনা আসতে পারবে না?? কেন?? ”
কিন্তু তা আর মুখ পর্যন্ত আনতে পারলাম না। আমি বেশ বুঝতে পারছি তার প্রতি আমার এক অদৃশ্য অনুভূতি সৃষ্টি হয়েছে কিন্তু তা প্রকাশ্য না।
আমি একবার আড়চোখে তার দিকে তাকালাম। সে একমনে আকাশের পানে তাকিয়ে আছে। তার মানে কথাগুলাও সে ওইদিকে তাকিয়েই বলেছে। চাঁদের স্নিগ্ধ আলোয় তার মুখে এসে পড়ছে যা তাকে আরও স্নিগ্ধ করে তুলছে। আমি চোখ সরিয়ে নিলাম।
কখন যে আমাদের হাত এতটা কাছাকাছি চলে এসেছে বুঝতে পারি নি। আমি হাত নাড়াতেই তার হাতের সাথে আমার হাতের সংঘর্ষ হয়। সাথে সাথে দুইজনের শরীরে এক শীতল শিহরণ বয়ে যায়। আমি দ্রুত নিজের হাত সরিয়ে নেই আর উঠে যেতে নেই কিন্তু আমার সেই পা বেঝে পড়ে যেতে নিলে রিয়ান আবার আমার হাত ধরে টান দেয় যার ফলে আমি একদম তার সাথে ঘেষে বসে পড়ি। সে কিছুটা চোখ গরম করে বলে।
.
— সাবধানে চলাফেরা করতে পারো না?? এখনই তহ আবার পড়ে যেতে নিচ্ছিলে। এইখানে কি তুমি নিজের চিকিৎসা করার সুবুদ্ধি নিয়ে এসছো নাকি?? নাকি কাজ থেকে বাঁচতে চেয়ে এমন করছো?? ধমকের সুরে।।
.
আমার কেন জানি তার এমন কথায় খুব অভিমান হলো। খুব!! পড়লেও তহ ব্যথা আমি পেতাম ক্ষতি তো আমার হতো তাতে তিনি এত রিয়েক্ট কেন করছে?? কিন্তু বলতে আর পারলাম না।
পাহাড় সমান এক অভিমান নিয়ে মুখ ঘুড়াতে নিলেই তার ডান হাতটার দিকে নজর গেল। হাতের কেনু এর একটু অংশ দেখা যাচ্ছে আর তাতে শুকনো রক্তের দাগ স্পষ্ট। আমি কিছু না ভেবে তার ডান হাতটা নিজের সামনে টেনে ধরলাম। এতে তিনি কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন। আমি তার হাত সামনে এনে দেখি তার ডান হাতটা বেশখানিকটা ছিলে গেছে। আর তাতে শুকনো রক্ত লেগে আছে। এক পাশের রক্ত এখনো সতেজ।
আমার আর বুঝতে দেরি নেই তখন পড়ে যাওয়ার সময় তিনি হাতে আঘাত পেয়েছেন। আমি আর কিছু না ভেবে দ্রুত তার হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলাম ক্যাম্পের দিকে। তিনি কিছু বলতে নিয়েছিলেন আমি ধমক দিয়ে চুপ করিয়ে দেই। সেই থেকে তিনি আমার দিকে বিষ্ময়কর দৃষ্টিতে তাকিয়েই আছেন। আমি সেসব তোক্কোয়া না করে ক্যাম্পে গিয়ে তাকে বসিয়ে ফাস্ট এড বক্স এনে তার হাত ক্লিন করতে শুরু করি।
বেন্ডেজ করে তার দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলি।
— ব্যথা পেয়েছেন বললেন না কেন??
.
— এত ব্যথা পাই নি যে বলে ঢোল পিটায়ে সকলকে জানাতে হবে।
.
আমি কিছু না বলে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। তার মনে যে আমার জন্য কোন অনুভূতি নেই তা বেশ বুঝতে পারছি। আমাকে নিয়ে যে তার কোন চিন্তা ভাবনা তাও বেশ বুঝতে পারছি। যা আছে তা শুরু একতরফা। কেন জানি আমার চোখ মুখ টলমল করে উঠে।
রিয়ান এতক্ষণ অন্যদিকে মুখ করে তাকিয়ে ছিল আমার দিকে মুখ আনতেই আমার সেই টলমল চোখে তার চোখাচোখি হয়। সে স্থির দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। আমি চোখ নামিয়ে দ্রুত সব গুছিয়ে নিতে থাকি। সে কিছু বলতে যাবে তার আগেই আমি বলে উঠি।
.
— শুভ রাত্রি।
.
বলে দ্রুত পা চালিয়ে চলে আসি। বুকের মধ্যে এক রাশ অভিমান নিয়ে যা হয়তো তিনি কখনোই বুঝবে না।
আমি চলে যেতে রিয়ান এক দীর্ঘ শ্বাস নেয়। কথাটা সে এইভাবে বলতে চাই নি। কিন্তু কিভাবে জানি কথাটা কড়া ভাবেই বলে ফেলে সে। রিয়ানার সেই টলমলে চোখ বার বার ওর চোখের সামনে ভাসছে যা ওকে ঠিক রাখতে পারছে না। অবশেষে ঠিক করলো কাল সকালে তাকে সরি বলে দিবে সে।
।
?
।
এইদিকে,
রিয়ানা চুপচাপ শুয়ে আছে। চোখ দিয়ে না চেতেও পানি গড়িয়ে পড়ছে তার। মনটা যেন তার কালো মেঘে আচ্ছন্ন।
.
— কেনই বা আপনি আশেপাশে থাকলে এক অজানা অনুভূতি গুলো আমায় আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে। আমি জানি আমার এই অজানা অনুভূতির নাম কি? আর এখন জানতেও চাই না। এই অজানা অনুভূতির সন্ধানের আগেই আপনি আমায় বুঝিয়ে দিয়েছে আপনার কাছে এই অনুভূতি গুলার কোন দাম নেই। ভালোই হয়েছে আগে এই কথাটা বুঝিয়ে দিয়েছেন। তা না হলে পরবর্তীতে এই অনুভূতিগুলো বড্ড তাড়া করতো আমায়।
আজ এখন এইখান থেকেই আমি আমার সেই অজানা অনুভূতির ইতি টানলাম। আজ থেকে আমাদের শুধু এই পেশা জড়িত সম্পর্কই থাকবে। এর বাদে অন্যকিছু নয়। কিছু নয়!!
.
এই বলে বালিশে মুখ গুজে শুয়ে পড়লো সে।
.
.
.
???
.
.
সকাল থেকেই সকলে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। গ্রামবাসীদের লাইন লেগে গিয়েছে। কালকেই সকল গ্রামবাসীকে ক্যাম্পের কথা জানানো হয়েছিল। তাদের বিনামূল্যে চিকিৎসা দেওয়া হবে তা শুনে তাদের মুখটা চকচক করে উঠেছিল। তারা হয়তো কখনো আশা করে নি যে তারা এমন সেবা পেয়ে থাকবেন। তাই তহ সকাল হতে না হতেই তারা এইখানে এসে হাজির।
সকলেই তাদের সেবাতে লেগে পড়েছি। এর মধ্যে আমি সর্বদা ড. রিয়ানকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করেছি।। দরকার ছাড়া বারতি কোন কথা বলতে যায় নি। তিনি কিছু একটা বলতে চাচ্ছিল কিন্তু আমি তা শুনতে চাই নি। কেন জানি তা প্রতি এক অনিহা সৃষ্টি হয়ে গেছে। তার চেহারা দেখলেই কাল রাতের ব্যবহারটা বার বার চোখের সামনে ভেসে উঠে। তাই যথাসম্ভব এড়িয়ে চলছি আর নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।
সেখানে আসা সকল গ্রামবাসীদের ভালোভাবে পরিক্ষা নিরিক্ষা করছি। তাদের সাথে মিশতে চেষ্টা করছি যাতে তারা নির্ভয়ে আমাদের সাথে সব কথা খুলে বলতে পারে।
?
.
লাঞ্চ ব্রেকে সকলেই ঘাসের উপর বসে আছি। কিছুক্ষণ আগেই গ্রামবাসীরা আমাদের কাজ আর ব্যবহারের প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে আমাদের জন্য রান্না করে পাঠিয়েছে। প্রায় হরেক রকমের রান্না। নাম বলে যেন শেষ করা যাবে না।
ভাত, পাজন, বেম্বো চিকেন, চাপিলা ফ্রাই,কাচকি ফ্রাই, মাছের কেবাং, ডিম কেবাং, কলা মোচার ভর্তা, ডাল। আরও কত!!
সকলেই আহার করে খাওয়া শুরু করলো। খাবার শেষে সকলেই খাবারের স্বাদে পঞ্চমুখ।
সত্যি খাবার গুলো অসাধারণ ছিল। এই খাবার গুলা যেন ঢাকার শহরের নামিদামী খাবারকেও হার মানবে।
আমি খাওয়া শেষে একটু হাটতে বের হলাম। কিছুদূর গিয়ে দেখি রিয়ান সকল ছোট ছোট বাচ্চাদের সাথে খেলছেন। মাঝে মধ্যে তাদের সকলের সমস্যার কথাও জেনে নিচ্ছেন। বাচ্চারা মন খুলে হাসছে। বুঝাই যাচ্ছে তার সঙ্গ তাদের বেশ পছন্দ হয়েছে। কেন জানি তা দেখের নিজের মনের মধ্যেই ভালো লাগা কাজ করলো কিন্তু তা পরক্ষণে মাটি চাপা দিয়ে অন্যদিকে হাটা ধরলাম। তার প্রতি নতুন করে আমি আর কোন অনুভূতি তৈরি করতে চাই না। সে থাকুক তার মত আর আমি আমার মত।
হাটতে হাটতে নদীর দিকে চলে আসলাম। সচ্ছ পানি তার। এই পানি দেখে কেন জানি লোভ হলো পানিতে পা ভিজিয়ে রাখার। লোভটাকে সামলাতে না পেরে নেমে পড়ি পানিতে।
নদীর পারে বসে সচ্ছ পানিতে পা দুটো নাচিয়ে চলেছি সমান তালে। নদীতে হাল্কা স্রোত। বেশ গভীরও বটে।
চোখ বন্ধ করে সেই স্রোতের প্রভাব উপভোগ করছি। ঠিক তখনই কেউ পিছন থেকে আমায় ধাক্কা দেয়। আমি তাল সামলাতে না নদীতে গিয়ে পড়ি। ধাক্কাটা বেশ জোরেই ছিল তাই আমি ছিটকে কিছুটা দূরে পড়ি। সাতার না জানার ফলে ডুবে যেতে থাকি। হাবুডুবু খেতে থাকি। গলা পানি চলে যাওয়ার ফলে আওয়াজও করতে পারছিলাম না। যতটা সম্ভব নিজেকে পানিতে ভাসিয়ে রাখার চেষ্টা করছে কিন্তু স্রোতের জন্য পারছি না। অবশেষে না পেরে তলিয়ে যাই এই সচ্ছ পানির অন্তরে। চোখ প্রায় বন্ধ হয়ে এসেছে। শ্বাস নেওয়াও প্রায় দায় হয়ে উঠেছে। এখন যে আমার আর কিছু করার নেই। ডুবে যেতে থাকি গভীর থেকে গভীরে।
হয়তো এইখানেই শেষ আমার জীবন। সত্যি হয়তো ইতি হতে চলেছে আমার সেই না বলা অনুভূতিগুলার সাথেই!!
।
#Part_14
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
.
?
সচ্ছ পানির অন্তরে গভীর হতে গভীরে তলিয়ে যাচ্ছিলাম আমি। ঠিক সে সময় কোথ থেকে এক জোরা হাত এসে আমায় আগলে ধরলো আর উপর দিকে টেনে নিয়ে যেতে লাগলো।
.
অচেতন অবস্থায় মাটিতে শুয়ে আছি আমি। পাশেই আবির আমার দুই গালে আলতো করে থাপ্পড় মারছে আর “রিয়ু রিয়ু” বলে ডেকে চলেছে। অবশেষে আমায় সজাগ করতে না পেরে আমার পেটে চাপ দেয়। দুই তিনবার চাপ দেওয়ার পরই আমার মুখ দিয়ে পানি বেড়িয়ে আসে। আবির আবার আমায় ডাকতে শুরু করে।
.
— রিয়ু! রিয়ু! রিয়ু চোখ খুলো!! এই রিয়ু!! তোমার কিছু হবে না!! এই রিয়ু!! কিছুটা উত্তেজিত সুরে।
.
আমি পিটিপিটি করে চোখ খুলি, সামনে তাকিয়ে দেখি আবির বেশ চিন্তিত সুরেই আমায় ডেকে চলেছে। কিন্তু আমি তার কথার প্রতিত্তোরে কিছু বলতে পারলাম না। চোখ দুটো আবার লেগে আসলো। জ্ঞান হারালাম আবার!!
.
?
.
যখন জ্ঞান ফিরলো তখন নিজেকে ক্যাম্পের বেডে আবিষ্কার করলাম। হাত উঠাতে নিলেই হাতে টান অনুভব করলাম সাথে এক অসহ্যনীয় ব্যথা। আমি সাথে সাথে চোখ মুখ খিঁচে বন্ধ করে নিলাম। বেশ কিছুক্ষণ পর আস্তে আস্তে চোখ খুলাম। হাতের দিকে তাকিয়ে দেখি হাতে ক্যানাল লাগানো আর মাথার উপরেই স্যালাইন ঝুলানো। একবার মনে করার চেষ্টা করলাম আমি এইখানে কিভাবে আসলাম? অতঃপর মনে পড়লো আমি পানিতে ডুবে গিয়েছিলাম আর তখন আবির আমায় বাঁচিয়েছিল। আর আবির এই হয়তো আমায় ক্যাম্পে নিয়ে এসেছিল।
এইবার আমি চারদিকে চোখ বুলিয়ে দেখতে লাগলাম। রাত হয়ে এসেছে। তার মানে সেই দুপুর থেকে আমি অচেতন অবস্থায় পড়ে আছি।
পাশের বেডে চোখ পড়তেই চমকে গেলাম। কেন না সেখান থেকে প্রায় এক হাত দূরেই ড. রিয়ান দাড়িয়ে আছে আর আমার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। চোখ গুলো হাল্কা লাল, চুল গুলো উষ্কখুষ্ক। মুখটা কেমন মলিন হয়ে আছে। দেখেই বুকটা ধক করে উঠলো। আমি সাথে সাথে নিজের চোখ সরিয়ে ফেললাম আর উঠে বসার চেষ্টা করতে লাগলাম। পরে যেতে নিলেই কেউ আমায় আগলে ধরলো আর আমায় ঠিক করে বসিয়ে দিল।
আমি উপরে তাকিয়ে দেখি রিয়ান। এক পলক তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিলাম। হয়তো তাকিয়ে থাকলে মায়া বারবে তাই। সে ধমকের সুরে বলে।
.
— তোমাকে উঠতে কে বলেছে স্টুপিড!! শুয়ে থাকা যায় না!! এমনেই শরীর দূর্বল এখন আমি না ধরলে তহ পড়ে যেতে!!
.
আমি আহত চোখে তার দিকে তাকালাম। কেন যেন তার ধমকে আজ নিজের জন্য চিন্তা অনুভব করছি। কিন্তু তারপরও সব কিছু উপেক্ষা করে কঠোর গলায় বলি।
.
— পড়লে পড়তাম। ক্ষতি হলে তো আমার হতো আপনার না!! তাহলে আপনি এত রিয়েক্ট করছেন কেন?? শান্ত ভাবেই।
.
— বেশি কথা বলা শিখে গিয়েছ দেখছি!! তা আমার সাথে এইভাবে কথা বলার সাহস পাও কিভাবে?? দাঁতে দাঁত চেপে।
.
— কিছু কি ভুল বলছি স্যার?? আর আমার মতে আমি বেশ নম্রভাবেই কথাটা বলেছিলাম। এখন তাতে যদি আপনার খারাপ লেগে থাকে তাহলে মাফ করবেন। আমি আপনাকে অসম্মান করে কিছু বলতে চাই নি। বলে মুখ ঘুরিয়ে নিলাম।
.
রিয়ান আমার দিকে চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে রইলো। হয়তো বুঝে উঠতে পারছে না কি বলবে?? অথবা কি বলা উচিৎ তার!! আমি কখনো তার সাথে এমন ভাবে কথা বলি না। তাই হয়তো তিনি একটি হতবাক।
আমি আড়চোখে একবার রিয়ানের দিকে তাকালাম সে স্থির দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। চোখে চোখ পড়তেই আমি চোখ সরিয়ে নেই।
রিয়ান যে এখনো আমার দিকে তাকিয়ে আছে তা বেশ বুঝতে পারছি। তাই আমি বলে উঠি।
.
— এইভাবে তাকিয়ে থাকবেন না প্লিজ। আমার অস্বস্তি লাগছে।
.
সে কিছু বলতে নেয় কিন্তু তার আগেই কোথ থেকে আবির এসে হাজির হয় আর আমার কাছে আসে।রিয়ানকে ক্রস করে আমার বেডের পাশে এসে বসে এতে রিয়ান কিছুটা দূরে সরে দাড়ালো। আবির আমার গালে হাত রেখে বলে,
.
— রিয়ু তুমি ঠিক আছো তহ??
.
— হাম। বলে আলতো করে হাতটা সরিয়ে দিলাম।
.
— শরীর খারাপ লাগছে কি?? কখন জ্ঞান ফিরেছে তোমার?? কিছু খেয়েছো কি??
.
— Take a breathe Abir. এক সাথে এত প্রশ্ন এক সাথে করলে কোনটা রেখে কোনটার উত্তর দিব শুনি??
.
— সরি!!
.
— হুহ! আমি ঠিক আছি আর একটু আগেই জ্ঞান ফিরেছে আমার। এখনো কিছু খাই নি। এন্ড বাই দ্যা ওয়ে থেংক্স।
.
— কেন??
.
— For saving my life. নিজের লাইফ রিক্সে রেখে আমায় সেভ করার জন্য।
.
— অহহ কামন রিয়ু!! এইসব ফরমালিটি করবা না তো। ফ্রেন্ডশিপে এইসব চলে না। আর এমনেও আমি তোমাকে নয় নিজেকে বাঁচিয়েছি।
.
— মানে!! অবাক হয়ে।
.
— আব তা কিছু না। কিন্তু তুমি নদীর পারে কি করছিলে আর পড়লেই বা কি করে??
.
— হাঁটতে হাঁটতে ওইদিকে চলে গিয়েছিলাম পরে নদী দেখে পা ভিজিয়ে রাখতে ইচ্ছা করলো তাই নদীর পারে বসে পা ভিজিয়ে রেখেছিলাম। হুট করে মনে হলো কেউ আমায় ধাক্কা দিল যার ফলে আমি পানিতে গিয়ে পড়লাম।
.
— ধাক্কা দিয়েছে মানে?? কে এমন করেছে?? চেহেরা দেখেছো তুমি?? নাম বলো একবার সে কে?? তার এমন অবস্থা করবো না!!
.
— আরেহ আরেহ হাইপার হচ্ছো কেন?? হয়তো কাউরে থেকে ভুল বসতো ধাক্কা লেগে গিয়েছিল!! আর আপনেও পাশে অনেকগুলো পিচ্চি বাচ্চারা খেলা করছিল হয়তো খেলতে খেলতে ধাক্কা লেগে গিয়েছিল। আর এমনেও আমাকেই সাবধান থাকা উচিৎ ছিল।
.
— সাবধানে থাকবে না?? নেক্সট টাইম খেয়াল রেখো।
.
— হুম।
.
আবিরের হঠাৎ রিয়ানের কথা মনে পড়তেই পাশেই তাকায়। রিয়ানকে দেখে সে চোয়াল শক্ত করে ফেলে। একবার আমার দিকে তাকিয়ে রিয়ানের দিকে সরু চোখে তাকায়। তারপর মুখে এক মিথ্যা হাসি টেনে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
.
— ড. সাদাত খান রিয়ান, কেমন আছেন??
.
— আল্লাহের রহমতে অনেক ভালো আপনি। চোখ মুখ শক্ত করে।
.
— হু এতক্ষণ ভালো ছিলাম বাট এখন অনেক ভালো।দাঁতে দাঁত চেপে।
।
তারপর আবির রিয়ানের থেকে নজর সরিয়ে আমার সাথে কথায় মেতে উঠলো। আবির এই সেই বলেই চলেছে আর আমিও হা হু তে উত্তর দিয়েই চলেছি। মাঝে মধ্যে মুচকি হেসে চলেছি।
এইদিকে রিয়ান আবিরের দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। হাত দুটো মুষ্টিবদ্ধ করে রয়েছে। কেন জানি তার আমাদের দুইজনকে এক সাথে সহ্য হচ্ছে না। সে কিছু না বলে দ্রুত পায়ে সেখান থেকে বেড়িয়ে আসে।
ক্যাম্প থেকে বের হয়ে সেই টিলাটার পাশে চলে যায় সে। জোরে জোরে শ্বাস নিতে থাকে আর নিজের রাগকে নিয়ন্ত্রণ করার বৃথা চেষ্টা করতে থাকে। পাশে পড়ে থাকা পাথর গুলো উঠিয়ে একের পর এক দূর আকাশের দিকে ছুঁড়ে মারছে আর নিজের রাগ সংযত করছে।
সে কোন মতেই রিয়ানার সাথে আবিরকে সহ্য করতে পারছে না। কেন পারছে না তা তার জানা নেই। দুপুর বেলায়ও রিয়ানাকে আবিরের কোলে দেখে রিয়ান জ্বলে পুড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছিল। সে রিয়ানাকে কোন মতেই অন্যের বাহুদ্বয়ে সহ্য করতে পারছিল না। ভিতরটা তার জ্বলে পুড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছিল।
কিন্তু যখন রিয়ানের মলিন মুখ দেখতে তখন তার বুকের বা পাশটা মোচড় দিয়ে উঠে। রাগ ভুলে সে দৌড়ে গিয়েছিল রিয়ানার কাছে। ব্যাকুল হয়ে পড়েছিল রিয়ানার জন্য। সে পারছিল না রিয়ানার এমন মুখটা দেখতে। কেন এমন হচ্ছে তা তার জানা নেই।
.
— কেন এমন হচ্ছে আমার সাথে?? কেন?? এ কোন অনুভূতি আকড়ে ধরেছে আমায়?? রিয়ানার প্রতি এ কেমন আকুলতা আমার?? রিয়ানাকে অন্য ছেলের সাথে দেখলে আমার কেন রাগ হয় কেন?? আবিরের সাথে রিয়ানাকে দেখলে কেন আমার মধ্যে ওকে হারানোর ভয় আকড়ে ধরে?? কেন তখন আবিরকে খুন করতে ইচ্ছে হয় আমার?? কেন!!কেন!! আই ওয়ান্ট এন্সার ডেমিট!! আই ওয়ান্ট এন্সার!!
.
এই বলে রিয়ান হাটুর উপর বসে পড়ে। হাত দিয়ে মাথাটা চেপে ধরে। সে পারছে না নিজেকে ঠিক রাখতে। তার মনে ভর করেছে হাজারো প্রশ্নের মেলা। যার একটারও উত্তর সে মিলাতে পারছে না।
.
.
???
.
.
দেখতে দেখতে বেশ কয়েকদিন কেটে যায়। আমিও এখন পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠেছি। এতদিন শরীরটা হাল্কা দূর্বল ছিল বলে কাজ করতে পারে নি। কিন্তু এখন একদম পার্ফেক্ট তাই আগের ন্যায় কাজে লেগে পড়েছি।
কিন্তু এর মধ্যেও আমি সর্বদা ড. রিয়ানকে এড়িয়ে চলেছি। প্রয়োজনীয় কথ্য ছাড়া আর কোন বাড়তি কথাই তার সাথে বলি নি আমি। রিয়ান এই কয়েকদিনে বেশ কয়েকবার এসেছিল কি জানি কথা বলতে কিন্তু আমি বলে নি। বার বার মনে হচ্ছিল তার সাথে কথা বললে আমি হয়তো নিজের অনুভূতিগুলোর উপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারবো না। সেই অনুভূতি গুলো হয়তো আবার আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরবে আমায়। সেই ভয়ে তার থেকে আমি বেশ দূরত্ব বাজিয়ে রেখেছি। এর মধ্যে আবিরের সাথে আমার বেশ ভাব হয়ে যায়। আবির যখন সময় পায় হুট করেই আমার ক্যাম্পে এসে হাজির হয়ে যায়। তারপর সকলের সাথে জমিয়ে আড্ডা দেয়। সকলে তো আবির বলতে পাগল। আমার সাথে যে মেয়েরা আছে তারা তো ওর জাবরা ফ্যান। যখনই আবির আশে তখন তাকে গান গাওয়ার জন্য ঝাঁকড়ে ধরে সবাই। সেও সকলের ইচ্ছা রাখতে গান গায়।
অনেক সময় আমায় নিয়ে নদীর পারে হাটে আর এই সেই কথায় মেতে উঠে। আমিও তার কথার সাথে তাল মিলানোর বৃথা চেষ্টা করি। এইভাবে চলছে দিন।
অন্যদিকে রিয়ান কেন জানি রিয়ানার এমন এড়িয়ে চলাটা মেনে নিতে পারছে না। তার মনটা প্রচন্ড বেকুল হয়ে আছে রিয়ানার সাথে একবার প্রাণ খুলে কথা বলার জন্য। রিয়ানার সাথে আগের ন্যায় ঝগড়া করার জন্য। বার বার মন চায় রিয়ানা তার পাশে থাকুক তার সাথে থাকুক। ওই আবিরের সাথে রিয়ানাকে তার একদম সহ্য হয় না।
হঠাৎ কেন তার এমন অনুভূতি জাগ্রত হলো তা তার জানা নেই। কিন্তু তার যে এই অনুভূতি গুলার নাম জানা নেই। তাহলে কি একেই বলে ভালবাসার অনুভূতি!!
.
.
???
.
অন্যদিকে নিস্তব্ধ এক প্রহরে রাতের অন্ধকারে কেউ একজন পৈচাশিক হাঁসিতে মেতে উঠেছে। স্তব্ধ পরিবেশটিও যেন তার হাসিতে কেঁপে উঠছে। দূর থেকে হিংস্র শেয়ালের হাঁকটিও যেন এই হাসির সাথে তাল মিলাচ্ছে।
হাতে থাকা ড্রিংকসের গ্লাসটি সমান তালে ঘুরিয়েই চলেছে আর হেসে চলেছে। চোখ মুখে এক তৃপ্তির ছোঁয়া।
সে আর কেউ নয় বরং… [বলুম না? কালকে জাইনেন কে এই ব্যক্তি?]
.
.
.
#চলবে