আমার আসক্তি যে তুমি Part-41+42

0
3079

পর্ব ৪১+৪২
#আমার_আসক্তি_যে_তুমি
#Part_41
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
.
?
কানে কিছু শব্দ এসে বারি খেতেই উপরের দিকে তাকাই। হুট করেই চারদিকে এক চাঁপা আর্তনাদ ছড়িয়ে পড়ে,
.
— “আয়ায়ায়ায়া”
.
বেশ কিছুক্ষণ পার হয়ে যায় আমি চোখ বন্ধ করে বসে আছি। আমার কোন কিছু না হওয়ায় আমি পিটি পিটি করে চোখ খুলি আর উপরে তাকিয়ে দেখি ঝুমুরটা আমার থেকে প্রায় ২ ইঞ্চি উপরে ঝুলছে। তা দেখে ভয়ে আমার হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছিল।
তখন ঝুমুরটি নিচে নামতে দেখে ভয়ে আমি চিৎকার দিয়ে উঠি আর চোখ বন্ধ করে বসে থাকি।
রিয়ান এতক্ষণ মূর্তির ন্যায় দাড়িয়ে ছিল। ওর চোখের সামনে যেন এতক্ষণ অন্ধকার ছেঁয়ে ছিল। সময়টা যেন থেমে গিয়েছিল। ড. সিয়াম ধাক্কা দিতেই রিয়ানের হোস হয় আর সে দৌড়ে রিয়ানার কাছে যায়।
রিয়ান আমার কাছে এসে আমার হাত ধরে টান দিয়ে সেই জায়গা থেকে সরিয়ে নিয়ে আসে তারপর সকলের সামনেই জড়িয়ে ধরে। আর বলতে থাকে,
.
— রিয়ুপাখি তুমি ঠিক আছো তো? কিছু হয় নি তো তোমার!
.
আমি এতক্ষণ ভয়ে থরথর করে কাঁপছিলাম। কিন্তু রিয়ানের ছোঁয়া পেতেই সকল ভয় দূর হয়ে যায়। আমি কোন মতে নিজেকে সামলিয়ে ধীর কণ্ঠে বলি,
.
— আমি ঠিক আছি রিয়ান। আপনি শান্ত হন।
.
রিয়ান এইবার আমায় ছেড়ে আমাকে ভালভাবে পর্যবেক্ষণ করে নেয়। আমাকে ঠিক দেখে সে এক দীর্ঘ শ্বাস নেয়। তখনই আরিশা আর রিংকি এসে জিজ্ঞেস করতে শুরু করে,” আমি ঠিক আছি কিনা? কোথাও লেগেছে কিনা? ”
আমি দুইজনকেই সম্মতি জানাই। ওরা দুইজন আমায় দ্রুত নিচে নিতে এসে একটা চেয়ারে বসায় আর ওয়েটারকে পানি আনতে বলে।
এই দিকে রিয়ান চেঁচিয়ে বলতে থাকে,
.
— ড. সিয়াম!! ইশান!!
.
রিয়ানের ডাকে ড. সিয়াম আর ইশান দ্রুত ওর কাছে চলে আসে৷ রিয়ান তাদের দেখে কড়া গলায় বলে,
.
— পার্টি মেনেজমেন্টের লোকদের ২ মিনিটের মধ্যে আমার চোখের সামনে হাজির করো। তা না হলে খুব খারাপ হবে।
.
সিয়াম আর ইশান বেশি কথা বলে তাদের আনতে চলে যায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই ওরা দুইজন পার্টি মেনেজমেন্টের লোকদের নিয়ে হাজির হয়। রিয়ান তাদের দেখে চেঁচিয়ে বলে,
.
— হোয়াট দ্যা হেল ইজ দিস? এই আপনাদের ব্যবস্থাপনা! আজ আরেকটু হলে এইখানে কি ঘটতে যাচ্ছিল আপনারাও বুঝতে ও পারছেন? আপনাদের আমি ঠিক কি হাল করতে তা আপনারা জানেনও??
.
— উই আর সরি স্যার। এইটা কিভাবে হলো কে জানে? আমরা তো বার বার সব কিছু চেক করেছিল। বিশেষ করে ঝুমুরটা। এর মধ্যে আমরা ৩ টা প্যাঁচ দিয়েছিলাম যাতে না ছুটে কিন্তু ভাগ্য বসতো ২ টা প্যাঁচই খুলে যায় যার জন্য ঝুমুরটা নিচে নেমে আসে। ভাগ্যবসত ৩ নাম্বার প্যাঁচটি খোলার আগেই আমাদের টিম এসে তা ধরে ফেলে। (মেনেজার)
.
রিয়ান রাগের মাথায় তাকে কষিয়ে একটা চড় মেরে দেয়। তারপর রাগে ফুসফুস করতে করতে বলে,
— আপনারা জানেন আজ আপনাদের এই কেয়ারলেসনেসের জন্য ঠিক কি হতে চলেছিল? আরেকটু দেরি হলেই আমি আমার রিয়ুপাখিকে চিরতরের জন্য হারিয়ে ফেলতাম। বুঝতে পারছেন আপনি??? বলে মেনেজারের কলার ধরে টানে।
.
এইসব দেখে সিয়াম এসে রিয়ানকে সরিয়ে আনে। তারপর মেনেজার আর সেই লোকদের চলে যেতে বলে। তারপর রিয়ানকে শান্ত করতে থাকে,
.
— রিয়ান নিজেকে ঠান্ডা কর। যা হয় নি তা নিয়ে ভেবে লাভ নেই। দেখ রিয়ানা ঠিক আছে। তাই এখন তুই শুধু ওর নিয়ে ভাব। যা হওয়ার ছিল তা হয়েছে এখন তা একটা দুঃস্বপ্ন ভেবে ভুলে যা। আর এমনেও দেখ রিয়ানা কেমন ভয় পেয়ে আছে। তুই যদি এখন এমন বিহ্যাভ করিস তাহলে তো ও আরও ভয় পেয়ে যাবে। তাই নিজেকে শান্ত কর।
.
সিয়ামের কথায় রিয়ান এইবার রিয়ানের দিকে তাকায়। দেখে রিয়ানা ভিতু চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। রিয়ান নিজের রাগকে সংযত করার চেষ্টা করতে থাকে। তা দেখে সিয়াম বলে,
.
— Take a deep breathe and relax. Calm down your mind.
.
রিয়ান এইবার নিজেকে সামলিয়ে নিয়ে তারপর রিয়ানার দিকে অগ্রসর হলো।
আমি এতক্ষন অবাক চোখে রিয়ানের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। রিয়ানকে আমি কখনো এতটা রাগতে দেখি নি। কেমন হিংস্র হয়ে উঠেছিল সে। রিয়ানের সেই রুপের কথা মনে করতেই শরীরে কাটা দিয়ে উঠছিল। কিন্তু অতঃপর নিজেকে এই বলে শান্তনা দিতে থাকি যে,
— ” তিনি আমায় প্রচন্ড রকমের ভালবাসেন বলেই তার মধ্যে আমাকে হারানোর ভয় ঢুকে গিয়েছিল। যার ফলে তিনি এমন হিংস্র হয়ে উঠেন। আর এমন বিহ্যাভটা করে ফেলেন। এইখানে তার রাগ করাটা জায়েজ। ভুল তো তাদের ছিলই।”
.
রিয়ান আমার কাছে এসে আমার হাতটা ধরে বলে,
— তুমি সত্যি ঠিক আছো তো?
.
আমি কিছু না বলে শুধু মাথা দুলিয়ে হ্যাঁ সূচক উত্তর দেই। রিয়ান তা দেখে এক স্বস্তির নিশ্বাস নেয়।
.
.
?
.
দেখতে দেখতে বিদায়ের সময় এসে পড়লো আর চোখের কোনে এসে ভীড় করলো অজস্র অশ্রু। যা কিছুক্ষণের মধ্যেই বাধ ভেঙে বন্যার স্রোতে বইতে থাকলো।
আরিশা আর রিংকিকে দেখে কে? দুইজনের যে পরিমানে কান্না। রিয়ানাকে ধরে তারা কেঁদেই চলেছে। আরিশা আর রিংকির বাবা-মার চোখেও পানি। তারা সবসময়ই রিয়ানাকে নিজের মেয়ের চোখে দেখেছে। রিয়ানার চলে যাওয়াতে তাদেরও অনেক কষ্ট হচ্ছে।
আরিশার বাবা এসে এইবার রিয়ানার হাত রিয়ানের হাতে রাখে এবং ওর হাতে তুলে দেয় আর বলে রিয়ানাকে যেন সে সবসময় আগলে রাখে। রিয়ান তাকে আশ্বস্ত করে যে সে সবসময় রিয়ানাকে আগলে রাখবে। তারপর রিয়ান ওকে নিয়ে গাড়িতে উঠে। রিয়ানা গাড়ির জানালা দিয়ে সকলকে শেষ বিদাই জানায়।
গাড়ি এইবার চলতে শুরু করে। রিয়ানা গাড়ির জানালা দিয়ে শেষবারের মত সকলকে দেখে নেয়। গাড়িটি এইবার নিজের গতি বাড়িয়ে দিয়ে দ্রুত গতিতে ছুটতে শুরু করে।
রিয়ানা ফুপিয়ে ফুপিয়ে কেঁদেই চলেছে। তা দেখে রিয়ান রিয়ানার দুইগালে হাত রেখে বৃদ্ধা আঙুল দিয়ে চোখের পানি গুলো মুছে দেয়। তারপর বলে,
.
— বলেছি না যে তোমার অশ্রু আমার দূর্বলতা। সহ্য হয় না তোমার চোখে অশ্রুগুলো। তোমার প্রত্যেকটা অশ্রু ঠিক বুকে গিয়ে লাগে। সো প্লিজ ডোন্ট ক্রায়।
.
— আমি বা কি করবো বলুন! চোখে আপনা আপনি পানি এসে পড়ছে। কেন যেন বুকের ভিতরে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। পারছি না সেটা সহ্য করতে।
.
— কষ্ট হওয়ারই কথা। এই সময়টা সকল মেয়ের জন্যই কষ্ট দায়ক হয়। নিজের আপনজনকে ছেড়ে চিরতরের জন্য ভিন্ন মানুষের মধ্যে থাকাটা সহজ কথা নয়। মনের মধ্যে আপনজনকে ছেড়ে আসার কষ্টটা অনেক। তাই আমি যাই বলি না কেন তোমার এই কষ্ট লাঘব হবে না। কিন্তু আমি চেষ্টা করবো সময় তোমার পাশে দাড়াতে। তোমার এই কষ্টে ভাগ বসাতে। এই বলে রিয়ানার চোখে দুই পাতাতে নিজের ঠোঁট ছুঁয়ে দেয়।
.
— আপনার মত করে কে আমায় বুঝবে বলুন? আপনি আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি।
.
রিয়ান এইবার আমায় পাশ দিয়ে জড়িয়ে ধরে বলে,
— আর তুমি আমার সব। ভালবাসি প্রিয়! খুব বেশি ভালবাসি।
.
— আমিও। বলে তার কাধে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে থাকি।
.
.
?
.
— অহহ হো সুইটহার্ট! আর কত কান্না করবে বলো? তুমি এমনভাবে কান্না করছো যেম কেউ মরে গিয়েছে।
.
— চুপ একদম চুপ!! সব সময় বাজে কথা। আপনি কি বুঝবেন যখন নিজের আপন কেউ পর হয়ে যায়। আরিশা নাক টানতে টানতে বলে।
.
— হ্যাঁ আমি তো আর আমার বোনকে বিয়ে দেই নি। তো কিভাবে বুঝবো?
.
— মজা নিচ্ছেন তাই না? দেইখেন আপনার উপর আল্লাহ গজব দিব। গজব!
.
— ইশশ কি মেয়েরে বাবা! নিজের স্বামীকেই এইভাবে অভিশাপ দেয়। কি যুগ আসলো রে বাবা! ইনোসেন্ট ফেশ করে।
.
— ওই ওই আপনি আমার স্বামী কিভাবে?আপনারে আমি কবে বিয়ে করেছি হ্যাঁ?? কিছুটা চেঁচিয়ে।
.
— মানে হবু স্বামী আরকি। আর এমনে হবু স্বামী আর স্বামী একই।
.
— কুচভি! ভেংচি কেটে।
.
সিয়াম এইবার নিজের পকেট থেকে রুমাল বের করে আরিশার কাজলে লেপ্টে যাওয়া চোখ মুছে দিয়ে থাকে। আর বলে,
.
— কান্নাতে তোমায় একদম মানায় না বুঝলা। একদম শাকচুন্নি লাগে। তাই আমার সামনে আর কখনো কান্না করবা না কেমন?
.
আরিশা এই কথা শুনে ছিটকে দূরে গিয়ে বসে বলে,
— বাজে লোক একটা। যান এইখান থেকে আপনার সাথে কথা নেই।
.
সিয়াম এইবার আরিশার আরও কাছে এসে ঘেষে বলে,
— এহহ বললেই হলো নাকি? তোমাকে ছেড়ে আমি কোথাও যাচ্ছি না। না এখন না পরে। সবসময় তোমার কাছেই থাকবো আমি। বুঝলা??
.
— কেন?
.
— ভালবাসি তাই। বলেই আরিশার নাক টেনে দেয়।
.
— হুহ!!
.
— বাই দ্যা ওয়ে আজকে কিন্তু রিয়ানের বাসর রাত।
.
— তো?
.
— তোমার আমার বিয়ের পর আমাদের বাসর রাত হবে আর আমি.. আর বলতে পারলো না আরিশা সিয়ামের মুখে হাত রেখে বলে,
.
— আপনি আসলেই অসভ্য। অসভ্য লোক একটা।
.
.
?
.
রিংকি ফুপিয়ে ফুপিয়ে কেঁদেই চলেছে। আর বকবক করেই চলছে।
.
— পঁচা মেয়ে একটা। তুই গেলি তো গেলি আমাকে কাঁদিয়ে গেলি। এখন পুরো মেকাপ নষ্ট হয়ে গেল। এএএএ!! আমাকে নিশ্চয়ই পেত্নি লাগছে এখন। সব দোষ রিয়ানুর। ওই কেন গেল? না ও যেত, না আমি কান্না করতাম আর না আমার মেকাপ নষ্ট হতো। এএএ!! বাচ্চাদের মত কেঁদেই চলেছে।
তখনই একজন এসে রিংকির সামনে টিস্যুর বক্স এগিয়ে দেয় আর বলে,
.
— এই যে মিস বকবক। টেক দ্যা টিস্যু এন্ড স্টোপ ইউর বকবক প্লাস ক্রায় ওলসো।
.
— এই কে রে! পাশে তাকিয়ে দেখে ব্রিটিশ বান্দর। রিংকি ইশানকে দেখে একটা ভেংচি কাটলো।
তা দেখে ইশান বলে,
.
— হোয়াট?
.
— ওই ব্রিটিশ বান্দর চুপ! যেখানে সেখানেই ইংরেজিতে পকর পকর শুরু। আরেহ ভাই মোরা বাঙালি জাতি। একটু তো বাংলাতে কথা বলো।
.
— অহ মাই গোড। মিস বকবক তুমি কত বকবক করো? মাথাটা ধরে গেল।
.
— হুহ! তাতে আমার কি? বাই দ্যা রাস্তা আপনি কেমন মানুষ হ্যাঁ? একটা মেয়ে এইখানে কাঁদছে কই তুমি এসে তাকে থামাবে তা না তার সাথে ঝগড়া করতে লেগে পড়লে?
.
— আমি কোথায় ঝগড়া করলাম? অবাক হয়ে।
.
— এই যে এতক্ষণ করছিলে। এইটা ঝগড়া না তো কি?
.
— উফফ ইয়ার! তোমার সাথে আমি পারবো না। আচ্ছা এখন যদি তোমার বকবক শেষ হয় তাহলে কান্নাটা মুছে নাও। তোমার চোখের নিচে কালি ছড়িয়ে গিয়েছে।
.
— অহহ নো!! ওই ব্রিটিশ বান্দর তারাতারি টিস্যু দাও। এইটা না মুছলে আমি রাস্তা দিয়ে যাব কিভাবে?
.
— এই নাও? বাই দ্যা ওয়ে তোমায় কাদলে না অনেক কিউট লাগে।
.
— হুহ! আমি জানি। তাই তো এতক্ষণ কাঁদছিলাম। ভাব নিয়ে।
.
— মিথ্যুক! তুমি না রিয়ানা ভাবির জন্য কাঁদছিলে?
.
— হুহ বলছে! আমি কেন কাঁদছিলাম তা আমি বেশি জানি নাকি আপনি? নিশ্চয়ই আমি! তাহলে তর্ক করেন কেন?
.
— আমি তর্ক কোথায় করলাম? অবাক হয়ে।
.
— এই যে মুখে মুখে কথা বললা এইটাই তর্ক। আপনি এত বড় হয়ে এটাও জানেন না? সেম অন ইউ! সবাই ঠিকই বলে,” বান্দার কেয়া জানে আন্দার কি বাদ।”
.
— এক মিনিট! আমি যতটুকু জানি এইটা তো এমন না। সবাই তো বলে, ” বান্দার কেয়া জানে আদরাক কা সোয়াদ।”
.
— এইটা রিংকির নিউ ক্রিয়েশন। ইউ হ্যাভ টু বুঝতে হবে। ভাব নিয়ে।
.
— আমিও ভুলে গিয়েছিলাম তুই নরমাল কোন মানুষ না। প্লিজ কেরি অন! বাই।
.
— হুহ!

#Part_42
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
.
?
সোফার মধ্যে বসে আছি। পাশেই রিয়ানের দীদা বসা। অন্যপাশে রিয়ানের ছোট ফুপু। সামনে বসে আছে রিয়ানের বড় আর ছোট খালা। নিলা,রিনা,মাইশা মিলে রিয়ানের রুম সাজাচ্ছে। দোলন ভাবি এক কিনারে বসে রাইশাকে খাওয়াচ্ছে। ছাদের রিয়ান, শুভ ভাইয়া, হিমেল, জ্যাক, ইশান, সিয়াম (ছোট খালার ছেলে) মিলে আড্ডা দিচ্ছে।
দীদা আমার থুতনিটা টেনে বলে,
.
— মাশাল্লাহ! তোর থেকে আজ চোখই সরানো যাচ্ছে না৷ কাউরো নজর না লাগুক। এই বলে আমার নজর তেরে দেন। তারপর মুচকি হেসে বলে,
.
— বুঝলি রাহেলা (ছোট ফুপু) আমার নাতী এমনে এমনেই আমার নাতবৌ এর জন্য পাগল না। কিছু তো আছে ওর মধ্যে।
.
দীদার কথা শুনে আমি লজ্জায় লাল হয়ে যাই। দীদা এইবার নিজের ব্যাগ থেকে দুটি চিকন সোনার চুড়ি বের করলেন। তারমধ্যে হাল্কা সরুকাজ করা। দীদা আমার হাতটা টেনে ধরে চুড়িটা পড়িয়ে দিতে দিতে বলে,
.
— এইটা আমি আমার নাতবৌ এর অনেক আগে থেকে বানিয়ে রেখেছিলাম বুঝলি। আজ যেহেতু আমার নাতবৌকে আমি পেয়ে গিয়েছি তাই আজ আমি তোকে দিয়ে দিচ্ছি। এইটা কখনো নিজের হাত থেকে খুলবি না কেমন।
.
— আচ্ছা দীদা।
.
— সবসময়ই এইভাবে হাসি খুশি থাক। এখন যাও রুমে গিয়ে একটু বিশ্রাম নাও। রিনা, নিলা এইদিকে আয় তো। তোদের ভাবিকে নিয়ে রুমে যা।
.
.
তখনই হুর হুর করে নিলা, রিনা আর মাইশা সোফার রুমে এসে হাজির হলো। তারপর আমার সামনে এসে বলে,
.
নিলাঃ ভাবি চল তোমায় নিয়ে যাই। রুম কেমন সাজিয়েছি তা দেখবে না?
.
মাইশাঃ হ্যাঁ ভাবি তারাতারি চল। তুমি আবার আগে রুমে না গেলে তো আমাদের ভাইয়া রুমে আসবে না। দুষ্টু হাসি দিয়ে।
.
রিনাঃ উফফ তোরাও না কি শুরু করেছিস এইসব? ভাবি তুমি আসো তো। রেস্ট নিয়ে নাও একটু।
.
.
আমি কিছু না বলে মুচকি হেসে তাদের সাথে রুমের দিকে অগ্রসর হই।
.
.
?
.
বিছানার এক কিনারে বসে আছি। কিছুক্ষণ আগেই রিনা, নিলা ও মাইশা মিলে আমায় রুমে বসিয়ে দিতে গিয়েছে। ওরা বেশ কিছুক্ষণ ছিল। আমার সাথে দুষ্টুমি করছিল। পরে দীদার ডাক পড়তেই সকলে দৌড়ে পালায়। অতঃপর আমি চোখ বুলিয়ে চারপাশটা দেখতে থাকি।
চারদিকটা কাঠগোলাপের ঘ্রাণে মো মো করছে। তার সাথে নাকে এসে বারি খাচ্ছে রক্তগোলাপের মিষ্টি গন্ধ৷
বিছানার চারপাশটাতে কাঠগোলাপ দিয়ে সাজানো। বিছানার মাঝে লাল গোলাপের নরম পাপড়ি দিয়ে হার্ট সেপ করা। ড্রেসিংটেবিল ও মেঝেতেও লাল গোলাপের পাপড়ি ছড়ানো। বেশ লাগছে সব কিছু।
আমি চুপচাপ বসে আছি। তখনই দরজা খুলার আওয়াজ আসে। আমি চোখ তুলে তাকিয়ে দেখি রিয়ান। রিয়ান দরজা বন্ধ করে সামনে আসে। আমি এইবার দাড়িয়ে যাই তারপর তার সামনে গিয়ে সালাম করতে নেই। আমাকে নিচু হতে দেখেই রিয়ান আমার বাহু দুটো ধরে থামিয়ো দেয় তারপর আমাকে তার বুকের সাথে আলতো করে জড়িয়ে ধরে বলে,
.
— রিয়ুপাখি তোমার জায়গা আমায় পায়ে না আমার হৃদয়ে। তুমি আমার এই অসীম হৃদয়কে রেখে পায়ে কেন যেতে চাচ্ছো হ্যাঁ?
.
আমি এইবার ধীর কন্ঠে বলি,
— নিয়ম বলে তাই।
.
— এত নিয়ম তোমায় মানতে হবে না বুঝলে। এইসব নিয়ম অন্যের জন্য হবে কিন্তু আমার রিয়ুপাখির জন্য না। এখন যাও ফ্রেশ হয়ে ওযু করে আসো। নফল নামাজটা সেরে নেই। আমাকে ছেড়ে দিয়ে।
.
— আচ্ছা। মুচকি হেসে।
.
আমি লাগেজটা থেকে একটা লাল রঙের সুতি কামিজ নিয়ে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়াই।
.
.
?
.
নামাজ পড়ে উঠতেই রিয়ান বাইরে গিয়ে দুই কাপ কফি নিয়ে আসে। আর আমার হাতে এক কাপ কফি দিয়ে বলে,
.
— আজ সারাদিন অনেক ধকল গিয়েছে তোমার উপর দিয়ে তাই নাও গরম গরম কফি। ইউ উইল ফিল বেটার।
.
আমি তখন মুগ্ধ নয়নে রিয়ানের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। একটা মানুষ ঠিক কতটা ভালবাসতে পারলে এতটা কেয়ার করতে পারে তা রিয়ানকে না দেখলে বুঝতেই পারতাম না। যে ভালবাসাকে আমি একসময় অবজ্ঞা করতাম আজ আমিই এই ভালবাসার মায়াজালে আবদ্ধ। কখনো ভাবতেও পারি নি যে আমাকে কেউ ঠিক এতটা ভালবাসবে।
রিয়ান আমার দিকে তাকিয়ে বলে,
.
— চল বারান্দায় গিয়ে দাড়াই।
.
আমিও ত সম্মতি জানিয়ে তার পিছে পিছে বারান্দায় যাই। এক হাতে কফি নিয়ে বারান্দার এক পাশে আমি আর রিয়ান দাড়িয়ে আছি। বাইরে হাল্কা বাতাস বইছে। আকাশটা আজ পরিষ্কার। খানিকটা স্বচ্ছ পানির মত। তার মধ্যে পিটিপিটি করে জ্বলে উঠছে অসংখ্য ঝিকিমিকি তারা। কিন্তু আজ এই আকাশটা পুরিপূর্ণ না। কেন না রাত আকাশের আসল সৌন্দর্য চাঁদ মামাটাই আজ নিখোঁজ।
আমি আনমনে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছি। হাল্কা বাতাসে চুল গুলো দোল খাচ্ছে। চুল ভিজা বলে নিচ দিয়ে টুপটুপ করে পানি গড়িয়ে পড়ছে। আমি রিয়ানের দিকে না তাকিয়ে বলি,
.
— আজকে আকাশে চাঁদ থাকলে কতটাই না ভালো হতো। সব কিছুই একদম পুরিপূর্ণ হতো। তাই না?
.
— আমার চাঁদ তো আমার সামনেই।
.
কথাটা শুনার সাথে সাথে আমি রিয়ানের দিকে তাকাই। দেখি তিনি পাশের রেলিং এ পিঠ ঠেকিয়ে দাড়িয়ে আছে আর ঘোর লাগা দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। মাঝে মাঝে মধ্যে কফির কাপটিতে চুমুক দিচ্ছে। আমি রিয়ানের দিকে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নেই। কেন যেন আজ তার দিকে তাকাতে ভীষণ লজ্জা করছে। আমি কিছু না বলে চুপ করেই থাকি।
রিয়ান তার কফির মগটা রেলিং এর উপর রেখে উপরের দড়ি থেকে তোয়েলা নিয়ে আমার কাছে আসে। তারপর আমায় ধরে একটা মিনি চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে আমার চুল মুছে দিতে শুরু করে। আর বলতে থাকে,
.
— নিজের প্রতি তোমার একটুও খেয়াল নেই তাই না। দেখো চুল দিয়ে কিভাবে পানি পড়ছে! একে তো এত রাতে শাওয়ার নিয়েছো তার উপর চুলটাও ঠিক মত মুছো নি। ঠান্ডা লাগলে কি করতে?
.
এইবার আমি নিজেকে স্বাভাবিক করে নেই। তারপর বলি,
— আপনার সেবা উপভোগ করতাম। দুষ্টুমির সুরে।
.
— অহহ আচ্ছা এই ধান্দা তাই না! তা মেডাম আমি কি সব জায়গায় সেবা করে যাব নাকি? বাইরে রোগীদের সেবা আর বাসায় বউয়ের সেবা।
.
— বউয়ের সেবা করা স্বামীর কর্তব্য। বুঝলেম মি. সাদাত খান রিয়ান ওরফে মি. খারুস।
.
— সবই বুঝলাম কিন্তু এখন এই খারুস নামটা কোথা থেকে উদোয় হলো?
.
— বহুত আগে থেকেই। শুধু মাঝে একটু বেরাতে গিয়েছিল। এখন আবার এসে পড়েছে।
.
— ইউ আর জাস্ট ইম্পসিবল।
.
— হেহে!
.
— এই নাও তোমার চুল মুছা হয়ে গিয়েছে। এখন কফিটা শেষ করে ঘুমাতে চল। অনেক রাত হয়ে গিয়েছে। তোমার এখন রেস্ট নেয়া উচিৎ।
.
আমি কিছু না বলে রিয়ানকে জড়িয়ে ধরি আর বলি,
— জানেন রিয়ান আমি না সত্যি অনেক ভাগ্যবতী যে আমি আপনার মত একজন জীবনসঙ্গীকে পেয়েছি। যে নাকি নিজের আগে আমার কথা ভাবে। আমাকে নিয়েই তার যত চিন্তা ভাবনা। আপনার মত করে না ভালবাসতে পারলেও আপনার থেকে কম ভালবাসি না আপনায়। ভালবাসি মি. খারুস আপনাকে।
.
রিয়ান এইবার আমার কপালে ভালবাসার এক ছোঁয়া দিয়ে আমায় আলতো করে জড়িয়ে ধরে বলে,
— তুমি আমার ভালবাসা নয় আমার আসক্তি। যা আমি কখনোই ছাড়তে পারবো না। ভালবাসা ছাড়া যায় কিন্তু আসক্তি না। তাই তো আমার আসক্তি যে তুমি। মুখে তৃপ্তির হাসি হেসে।
.
.
?
.
রাত ৩ টা বেজে ২৯ মিনিট,
রিয়ানের ফোনটা ক্রিং ক্রিং করে বেজে চলেছে। রিয়ান আদো আদো চোখে মোবাইলটা হাতে নেয়। মোবাইলটা হাতে নিতেই চোখের সামনে একটি প্রাইভেট নাম্বার ভেসে উঠে। রিয়ান এইবার কলটি কেটে গিয়ে একবার রিয়ানার দিকে তাকায়। রিয়ানা ঘাপটি মেরে রিয়ানের বুকে মুখ গুজে শুয়ে আছে। শীতে খানিকটা কুকড়িয়ে আছে। ঠোঁট দুটো উল্টানো। ফেরি লাইটের আলোয় রিয়ানা মুখটা একদম নিষ্পাপ বাচ্চার মত লাগছে। রিয়ান এইবার রিয়ানার দিকে একটু ঝুঁকে ওর কপালে এক ভালবাসার স্পর্শ একে ওকে খুব আলতো ভাবে পাশের বালিশে শুয়ে দেয়। আর ওর গায়ে একটি চাদর জড়িয়ে দেয়। রিয়ানা গরম উষ্ণতা পেয়ে চাদরটি ভালো মত আঁকড়ে ধরে।
রিয়ান এইবার মোবাইলটি নিয়ে বারান্দায় চলে যায়। তারপর সেই নাম্বারে আবার ফোন দেয়। তারপর গম্ভীর গলায় বলে উঠে,
.
— এনি নিউজ?
.
_______________________________________________________________
.
— ফাইন্ড হিম এস সুন এস পসিবেল। গোট ইট। হিংস্র হয়ে।
.
রিয়ান জিদে ফোন কেটে দেয়। তারপর রাগে ফুসতে ফুসতে বলে,
.
— তুই যেই হোস না কেন তোকে তো আমি খুঁজে বের করবোই। আমার কলিজায় হাত দেওয়ার মত দুঃসাহস করিছিস তুই। তোর তো আমি যে অবস্থা করবো তা তুই স্বপ্নেও ভাবতে পারবি না। ইউ হ্যাভ টু পে ফোর দিস।
.
— রিয়ান!!
.
.
#চলবে