#আমার_আসক্তি_যে_তুমি
#Part_47
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
.
?
আমি রিয়ানের ঘাড়ে মাথা ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছি। রিয়ান এক হাত দিয়ে আমায় আগলে রেখেছে। আমি বেশ নিশ্চিন্তেই শুয়ে আছি ঠিক তখনই গাড়িতে এক বিকট শব্দ হয় আর গাড়ি সাইডে ইলেক্ট্রিক পোলের সাথে গিয়ে বারি খায়। সাথে সাথে গাড়ির হেডলাইট ভেঙ্গে গিয়ে সাইলেন বাজা শুরু হয়ে যায়।
গাড়িটি বেশ জোরে ধাক্কা খাওয়ায় আমি আর রিয়ান সামনে দিকে হেলে পড়ি। কিন্তু রিয়ান আমায় আগলে রাখায় আমি তেমন ব্যথা পাই নি। কিন্তু আমাকে ঠিক রাখতে গিয়ে রিয়ান সিটের এককোনে মাথায় হাল্কা বারি খায়। কিন্তু রিয়ান সেইসব তোক্কোয়া না করে দ্রুত নিজে ও আমাকে গাড়ি থেকে বের করে। তারপর আমাকে একবার ভালো মত দেখে নেয় কোথাও আমার লেগেছে কিনা। তখনই আমার চোখ যায় ড্রাইভার কাকার দিকে। আকস্মিক এমন একটি দূর্ঘটনা হওয়ায় সেও প্রস্তুত ছিল না। গাড়িটি সামাল দিতে ব্যর্থ হওয়ায় গাড়িটি গিয়ে ইলেক্ট্রিক পোলের সাথে বারি খায় আর তিনি স্টেয়ারিং এর কোনে বারি খায়। যার ফলে তার মাথার কোনে বেয়ে চুয়ে চুয়ে রক্ত পড়ছে। কিন্তু তাও সে কোন মতে তা চেঁপে ধরে রেখে চোখ বন্ধ করে ব্যথাটা সহ্য করার চেষ্টা করছেন। তা দেখে আমি দ্রুত রিয়ানকে ফাস্টএইড বক্স আনতে বলি। রিয়ানও ইতিমধ্যে ড্রাইভার কাকার অবস্থাটা লক্ষ্য করেছে। রিয়ান এইবার দ্রুত গাড়ির পিছন থেকে ফাস্টএইড বক্স বের করে এনে আমায় দেয় এবং আমি তার চিকিৎসা শুরু করে দেই।
রিয়ান এইবার পর্যবেক্ষণ করা শুরু করে এইসব হলো কিভাবে। তারপর সে লক্ষ্য করে গাড়ির টায়ার পাঙ্কচার হয়ে আছে। রিয়ান এইবার পিছনের দিকে এগিয়ে যায়। আর রাস্তার মাঝে একটি কাঠ পড়ে আছে যার মধ্যে অজস্র পেরেকঠোকা। এইটা থেকে একটা জিনিস খুব ভালোভাবেই পরিষ্কার হচ্ছে যে, কেউ গাড়িটির এক্সিডেন্ট করানোর জন্যই এমনটা করেছে। গাড়িটি সঠিক সময়ে সাইড হয়ে গিয়েছিল বলে তেমন একটা ক্ষতি হয় নি। এমনটা না হলে হয়তো বা অনেক বড় কোন দূর্ঘটনা হয়ে যেতে পারতো।
এইসব দেখে রিয়ানের চোখ দুটো লাল হয়ে উঠে। পায়ের রক্ত মাথায় টগবগ করতে থাকে। কপালের রগটা ফুলে উঠে। যদি সেই ব্যক্তিকে এখন সামনে পেত তাহলে হয়তো বা জিন্দাই তার শ’খানে টুকরো করে কুকুরদের খায়িয়ে দিত। রিয়ান এইবার কোন মতে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করে আর পকেট থেকে একটা ঔষধ বের করে মুখে দিয়ে নেয়। অতঃপর গাড়ির কাছে গিয়ে পানির বোতল নিয়ে পানি খেয়ে নেয়।
তারপর কাকে যেন ফোন করে আরেকটি গাড়ির ব্যবস্থা করে আর দ্রুত সেটিকে আসতে বলে। রিয়ান একবার রিয়ানার দিকে তাকায়। সে খুব সুন্দর করে ড্রাইভার কাকার মাথার বেন্ডেজটা করে দিয়েছে আর কিছু মেডিসিন লিখে দিয়েছে। আপাতত সে এখন সেই ড্রাইভার কাকার সাথে কুশল বিনিময় করতে ব্যস্ত। তাই রিয়ান এইবার একটু দূরে গিয়ে একজনকে ফোন দেয়। কথা শেষে রিয়ান ফিরার পথে একটা সিএনজি নিয়ে আসে আর তাতে ড্রাইভারটিকে বসিয়ে দিয়ে তার হাতে ৩০০০ টাকা ধরিয়ে দেয়। আর বলে,
.
— আপনি বাসায় চলে যান। আর এই কিছু টাকা রাখেন আপনার কাজে লাগবে। নিজের খেয়াল রেখেন আর ঔষধগুলো ঠিক মত খেয়েন।
.
এই কথাটা শুনে ড্রাইভারটির চোখ ছলছল করে উঠে। সে খুশি মনে আমার আর রিয়ানের জন্য দোয়া করে দিয়ে গেলেন এবং আশির্বাদ করে গেলেন।
রিয়ান এইবার আমার পাশে এসে দাড়িয়ে বলে,
.
— এমন এক দূর্ঘটনা ঘটে গেল তোমার কি তাকে ভয় করছে?
.
আমি রিয়ানের দিকে তাকিয়ে বলি,
— কিছুটা। আজ যদি আমার বা আপনার কিছু হয়ে যেত তখন? ভেবেই শরীরটা কেঁপে উঠছে।
.
— চিন্তা করো না সব ঠিক আছে। আমি থাকতে তোমার কিছু হবে না। আই প্রমিসড ইউ দ্যাট। শান্ত চোখে।
.
রিয়ানের সাথে কথা বলতে গিয়ে আমার রিয়ানের কপালের দিকে দিকে চোখ যায়। ডান সাইডটা কিছুটা নীলচে হয়ে ফুলে উঠেছে। তা দেখে আমি দ্রুত এন্টিসেপ্টিক বের করে রিয়ানের কপালে আলতো করে লাগিয়ে দিতে থাকি।
কিছুক্ষণের মধ্যেই অন্য গাড়ি চলে আসে আর আমরা সেটিতে উঠে রওনা দেই বাসার উদ্দেশ্যে।
.
.
?
.
বাসায় এসেছি প্রায় ঘন্টা খানিক আগে। ঘরে প্রবেশ করতে না করতেই রিংকি আর আরিশা ঝাপিয়ে পড়ে দেরি হওয়ার কারণ জানার জন্য। অতঃপর সব শুনার পর সকলের মধ্যে যেন এক আতঙ্ক সৃষ্টি হয়ে যায়। আমাদের দুইজনকে উল্টিয়ে পাল্টিয়ে দেখতে শুরু করে। ভালো মত যাচাই বাছাই করার পর যখন তারা নিশ্চিত হলো আমরা দুইজন ঠিক আছি তখন গিয়ে তারা এক স্বস্তির নিশ্বাস নিল। তারপর আমাদের ফ্রেশ হতে পাঠিয়ে দেয় আর রিংকির আম্মু আরিশার হাতে গরম দুই গ্লাস দুধ আমাদের জন্য পাঠিয়ে দেয়। ফ্রেশ হয়ে এসে দুধটুকু খেয়ে আমি আর রিয়ান ক্লান্ত শরীর নিয়ে শুয়ে পড়ি।
বেশ কিছুক্ষন পার হতেই রিংকি আর আরিশা এসে হাজির হয় আড্ডা দিতে। অতঃপর সকলেই মিলে আড্ডার আসর জমিয়ে দেই।
.
রাতের খাবার শেষে আমি আর রিয়ান ছাদে একটু হাটতে যাই। আকাশে আজ অজস্র তারার মেলা। মেঘগুলো ছুটে চলেছে ধীর গতিতে। শা শা শব্দ করে বয়ে চলেছে বাতাস। গাছের পাতারাও মচমচ শব্দ করে দোল খাচ্ছে বাতাসের স্রোতের সাথে। একদম মনোরম পরিবেশ। শুধু মাত্র একটি জিনিসের কমতি। আর তা হলো চাঁদ মামারটি। তার দেখা মিলছে না প্রায় বেশ কিছুদিন ধরে।
হয়তো রাগ করে কোন এক কোনে ঘাপটি মেরে বসে আছে।
ছাদের এক কিনারে একটি দোলনা রাখা আছে। আমার কোলে রিয়ানের মাথা। আমি তার চুলগুলো আলতো হাতে টেনে দিচ্ছি। রিয়ান এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। হুট করেই আমি বলে উঠি,
.
— আজ না আপনার কণ্ঠে গান শুনতে বড্ড ইচ্ছে করছে। প্লিজ শুনান না একটা গান।
.
রিয়ান কিছুটা অপ্রস্তুত সুরে বলে,
— এখনই!
.
— হ্যাঁ, প্লিজ মানা করবেন না। প্লিজ রিয়ান। কিউট একটা চেহারা করে।
.
রিয়ান আর আমার মুখের পানে তাকিয়ে মানা করতে পারলো না। বাধ্য হয়ে সে গানের সুর ধরলো।
.
.
?
সে কি জানে আজও তুই কথা বলিস
আমার সাথে মনে মনে প্রতিদিন, বেরঙিন
সে কি তোর কথা ভাবে আমার মতন করে?
তোর চিঠি কি সে পড়ে? এক মনে মাঝরাতে?
একটু মুচকি হেসে!
তার কাছে চলে যাওয়া সে তো যাওয়া নয়
দেখা হবে স্মৃতির গভীরে
সে কি জানে, অভিমানে তোকে হাসাতে?
সে কি পারে, বুকে ধরে তোকে ভোলাতে?
তোর প্রিয় গান কে গেয়ে শোনাবে?
বল আমার থেকে কে তোকে ভালো জানে!
[ বাকিটা নিজ দ্বায়িত্বে শুনে নিবেন। আমার খুব পছন্দের একটি গান। ]
?
.
.
?
.
আরিশা আর রিংকি এতক্ষণ ধরে রিয়ানার রুম সাজাচ্ছিল। কিছুক্ষণ আগেই রুম সাজিয়ে নিজের রুমে এসে স্বস্তির নিশ্বাস নেয়। ঠিক তখনই আরিশার ফোনটা বেজে উঠে। আরিশা ফোন তুলতেই ওপাশ হতে একজন মিষ্টি কন্ঠে বলে উঠে,
.
— আমার বউটা কি করছে?
.
আরিশার আর বুঝতে দেরি নেই এইটা ড. সিয়াম। আরিশা এভাবেই ক্লান্ত তার উপর এমন প্রশ্নে কিছুটা চটে যায় সে। তারপর দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
— তাল গাছে না অনেক সুন্দর নারিকেল হয়েছে তাই সেই গাছে উঠেছি নারিকেল গুলো পারতে।
.
সিয়াম এইবার হেসে বলে,
— তাল গাছে নারিকেল! লাইক সিরিয়াসলি আরু?
.
— ওই মিয়া হাসবেন না তো। এইভাবে মেজাজ গরম আছে।
.
— আচ্ছা আচ্ছা বুঝলাম। আচ্ছা শুনো আমি কিছুদিনের জন্য নিউইয়র্ক যাচ্ছি।
.
— কেন?
.
— মেডিক্যালের কিছু কাজে।
.
— কবে যাচ্ছেন?
.
— কালকে রাতে ফ্লাইট। তো কালকে যাওয়ার আগে তোমার সাথে দেখা করে যেতে চাই। করবে দেখা কালকে?
.
— এইটা আবার জিজ্ঞেস করতে হয়। অবশ্যই আসবো।
.
.
?
.
রিংকি বেলকনিতে দাড়িয়ে কানে ইয়ারফোন গুজে মনের সুখে কফি খাচ্ছে আর ফাটা গলায় গান গাইছে,
.
— স্টেটাস আমার সিঙ্গেল দেখে,প্রেমের ছড়াছড়ি ।হায়রে কী যে করি,হায়রে কী যে করি,আমি ডানাকাটা পরী, আমি ডানাকাটা পরী।
.
তখনই রিংকির ফোন বেজে উঠে। রিংকি মোবাইল স্ক্রিনে অচেনা নাম্বার দেখে বলে,
.
— আমার সিঙ্গেল স্টেটাস ওয়ালা গান শুনে আমার কেউ লাইন মারতে ফোন দিল নাকি?
.
এই বলতে বলতে ফোন ও রিসিভ করে নেয়। তারপর বলে,
— আসসালামু আলাইকুম। আপনি কে? কোথা থেকে বলছেন? কেন ফোন করেছেন? কোন কাজে ফোন দিয়েছেন? কাকে চাচ্ছেন? এক নাগাড়ে বলে দম নেয়।
.
— আরেহ মিস বকবক স্টোপ ইউর বকবক। একটা মানুষ যে ঠিক এতটা বকবক করতে তা তোমাকে না দেখলে জানতাম এই না।
.
— কে বলছেন! লন্ডন থেকে আশা ওই ইশান দ্যা ব্রিটিশ বান্দর। সন্দেহভরা কণ্ঠে।
.
— Unfortunately yess!
.
— এত রাতে ফোন দিয়েছো কেন? আমার সিঙ্গেল স্টেটাস ওয়ালা গান শুনে দিয়েছো নিশ্চয়ই।
.
— মানে! অবাক হয়ে।
.
— থাক থাক বুঝা লাগবে না। এমনেই তোমার ঘিলু কম তুমি বুঝতা না।
.
— হোয়াট ইজ ঘিলু?
.
— ঘিলু মিন্স মগজ। মানে তোমার ব্রিটিশ স্টাইলে ব্রেইন যাকে বলে। ভেংচি কেটে।
.
— এলিয়েন একটা। বিরবির করে।
.
— কেন ফোন করেছেন তা বলেন?
.
— কালকে বিকালে একটু বের হবো তোমাকে আমার সাথে বের হতে হবে।
.
— হ্যাভ আই ঠেকা? আপনার সাথে আমি কোন দুঃখে মরতে যাব।
.
— মরতে বলি নি আমার সাথে বের হতে বলেছি। আর তুমি ভুলে যাচ্ছ তুমি প্রমিস করেছো যে আমায় ঢাকা শহর ঘুরাবে।
.
— কবে বলেছিলাম? আদো কি এমন কোন কথা বলেছিলাম? আমার তো মনে পড়ছে না।
.
— তোমার টিকটোক গুলো কিন্তু এখনো আমার কাছে আর আমি কিন্তু সেই গুলো দেই নি। তো এখন যদি আমি সেগুলো ডিলিট করে দেই তাহলে তোমার এত সুন্দর সুন্দর টিকটোক গুলার কি হবে?
.
— এই না না। মনে পড়েছে,মনে পড়েছে! একটু মজা করছিলাম আরকি। হেহে! কালকে কখন বের হতে হবে বলেন। আমি এক পায়ে রাজী।
.
— গুড, টুমোরো শার্প ফোর ও’ক্লোক। গোট ইট।
.
— হুহ! [ শালা ব্রিটিশ বান্দর! আমাকে ব্ল্যাকমেইল করোস। তোর উপর টিকটিকি পায়খানা করুক, তেলাপোকা ডিম পারুক, পিঁপড়া তোকে খোঁচা মেরে মেরে বর্তা বানাক, হাতি তোকে উস্টা দিয়ে উগান্ডা পাঠাক। তোর জীবনেও ভালো হয়তো না। এইটা আমার মত নিরিহ সিঙ্গেল কিউট ইনোসেন্ট মাসুম বাচ্চা মেয়ের অভিশাপ। মনে মনে।]
.
.
?
.
ছাদে প্রায় অনেকক্ষণ সময় কাটানোর পর আমরা দুইজন নিচে নেমে আসি। নিচে রুমে ঢুকতে যাব তখন দেখি দরজা বন্ধ। আর দরজার উপর একটা লাল কাগজ লাগানো। আমি সেটি হাতে নিয়ে পড়া শুরু করি,
.
” আমাদের পক্ষ থেকে ছোট একটি সাপ্রাইস তোর আর ভাইয়ার জন্য । আশা করি ভালো লাগবে।
ইতি
আরিশা এন্ড রিংকি ❤”
.
কথাটা আমি ঠিকমত বুঝতে পারলাম না। কিছুক্ষণ অবাক চোখে চিঠিটির দিকে তাকিয়ে রইলাম। তখন পাশ থেকে রিয়ান বলে উঠে,
.
— মনে হচ্ছে যে আমার শালিকারা কিছু একটা সাপ্রাইস প্লেন করেছেন।
.
— তাই তো মনে হচ্ছে।
.
— তাহলে রুমে চল দেখা যাক কি সাপ্রাইস প্লেন করেছে ওরা আমাদের জন্য।
.
— হুহ!
অতঃপর আমি দরজা ঠেলে খুলে ভিতরে প্রবেশ করি। আমি পিছু পিছু ভিতরে চলে আসে। রুমে ভিতরে এসে আমি যা দেখি তাতে হা হয়ে থাকি।
.
.
#চলবে