#আমার_হিয়ার_মাঝে
লেখিকা: তাহসীন নাওয়ার রীতি
পর্ব:২০
আয়নার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নিজের চুল আঁচড়ে নিচ্ছে অধরা। আরশি পাশে দাঁড়িয়ে তাকে এটা সেটা বলে যাচ্ছে। অধরা তার কথাগুলো শুনে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
‘আরশি সব তো বুঝেছি, কিন্তু সেখানে গিয়ে যদি কোন সমস্যা হয়ে যায়?’
‘আরে কিচ্ছু হবে না ভাবি। এতো ভয় কিসের? আমি আমার কিছু ফ্রেন্ডদের আগেই বলে রেখেছি, তারা সুন্দর করে ডেকুরেশন করে রেখেছে।’
‘হুম। তোমার ভাই এতো রাতে আমার সাথে ঘুরতে যেতে রাজি হলেই হয়। মহাশয় হয়তো এখনি চলে আসবেন। বাই দ্য ওয়ে, বাসার সবাইকে কি বলে যাবো?’
‘এসব নিয়ে তুমি টেনশন করো না। আমি কিছু একটা বলে সব সামলে নিবো।’
আরশির কথায় মাথা নেড়ে সম্মতি দেয় অধরা। আয়নায় একবার নিজেকে পরখ করে নেয় সে। শ্যামবর্ণ গায়ের রঙ, টানাটানা কালো চোখ। সৌন্দর্য বলতে খুব আহামরি কিছু নেই তার, তবুও আশ্বিন বলে সে মায়াবী। কি জানি সত্য কি না?
‘কি ভাবছো ভাবি?’
‘হুম? না কিছু না। এমনি…।’
————
তাড়াহুড়ো করে আশ্বিন চলে এসেছে বাসায় কাছে। আজ দীর্ঘদিন পর অধরার বাধহীন, অনিয়ন্ত্রীত কথা শুনে কিছুটা হতভম্ব হয়েছে সে। কেননা এই কদিন অধরা প্রয়োজন ছাড়া তেমন একটা কথা বলেনি তার সাথে।
বাসার দরজার কাছে এসে কলিং বেল বাজাতেই আরশি এসে দরজা খুলে দেয়।
‘তাহলে আমার ভাইয়া বাসার পথ ভুলে যায়নি। আমি আর ভাবি তো ভেবেছিলাম তুমি হয়তো পথ হারিয়ে ফেলেছো ভাইয়া।’
‘বেশি কথা বলিস তুই। ঘুমাসনি কেনো এখনও? আমি বলেছি না পরীক্ষার আগে তোর রাত জেগে বসে থাকা নিষেধ?’
‘মাত্র তো দশটা বাজে। একটু পর ঘুমাবো।’
আর কথা বারায় না আশ্বিন। বাসায় প্রবেশ করতেই নিজের ঘর থেকে তেড়ে আসে অধরা। বিস্মিত হয়ে গোল গোল চোখে তাকিয়ে আছে আশ্বিন অধরার পানে। গাঢ় গোলাপি রঙের একটি থ্রি-পিস পরিহিত, চুল ছেড়ে দিয়ে হালকা করে সেজে আছে সে। মাথা থেকে পা পর্যন্ত একবার পরখ করে দেখে আশ্বিন।
‘কোথাও যাচ্ছো নাকি? এভাবে সেজে আছো যে?’
‘হ্যা। যাবো বলেই তো রেডি হয়ে আপনার অপেক্ষায় ছিলাম। চলুন এবার যাওয়া যাক।’
অধরা আর কথা না বলে আশ্বিনের হাত ধরে বেরিয়ে যেতে যেতে আরশিকে এক চোখের ইশারা দেয়। আরশি কথা মতো মাথা নেড়ে হ্যা বোঝায়।
রিকশায় পাশাপাশি বসে রাতের শহর ঘুরে দেখছে দুজন। মাথার উপর খোলা আকাশ, এক ফালি চাঁদ এসে উঁকি দিচ্ছে এর মাঝে। রিকশা চলার গতিতে বাতাসে চুল এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে অধরার। আশ্বিনের হাতের মুঠোয় হাত রেখে পরিবেশ উপভোগ করতে ব্যস্ত সে।
এদিকে,
আশ্বিন মুগ্ধ নয়নে শুধু দেখে চলেছে অধরাকে। হুট করেই অধরার এতো পরিবর্তনে কিছুটা বিস্মিত সে। কি এমন হলো তার? অধরা কি তার সব রাগ ভুলে গিয়েছে? নাকি কেবল তার জন্মদিন উপলক্ষে দিনটি উপভোগ করতে চাইছে? উত্তর সব অজানা। তবে আজ এর উত্তর জানতে আগ্রহী নয় সে, অধরার সান্নিধ্যে থাকতে পারাই যেন তার কাছে সবচেয়ে বড় পাওয়া।
‘তাহলে এ কারণে আমায় এভাবে জরুরি বাসায় আসতে বলেছো? একসাথে ঘুরতে যাওয়ার জন্যে?’
‘হঠাৎ আপনাকে নিয়ে রাতের শহর ঘুরে দেখার ইচ্ছে হলো।’
‘হুম, কিন্তু সেটা তো আমরা ঢাকা ফিরে পরেও ঘুরতে পারতাম। এতো তাড়া ছিল কিসের?’
ফিরে তাকায় অধরা। জবাবের আশায় অধরার মুখ পানে চেয়ে আছে আশ্বিন।
‘আপনি জানেন আশ্বিন? এই ময়মনসিংহ শহরকে মায়ার শহর বলা হয়। দূর-দুরন্ত থেকে ক্ষণিকের জন্য আসা মানুষও মায়ার জড়িয়ে যায় এই শহরের। আর আমি তো জন্মেছি এখানে। আমার শৈশব, বেড়ে ওঠা অনেক সুন্দর স্মৃতি জড়িয়ে আছে এই শহরে, তাই ভাবলাম আর একটি সুন্দর স্মৃতি রেখে যাই এখানে।’
হেসে উঠে অধরা। আশ্বিনের ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি। ভালোই লাগছে তার এই মুহূর্ত উপভোগ করতে। খুব ইচ্ছে করছে অধরার দিকে তাকিয়ে একটি গান গেয়ে যেতে,
-এই পথ যদি না শেষ হয়, তবে কেমন হতো তুমি বলো তো?
অধরার হাতের মুঠোয় থাকা নিজের হাত শক্ত করে আঁকড়ে ধরে নীরবে হেসে উঠে সে।
রিকশা ভাড়া মিটিয়ে অধরার হাত ধরে পার্কে হেঁটে যাচ্ছে আশ্বিন। রাতের অন্ধকারেও পার্কের চারপাশ লাল নীল হলুদ রঙের বাতিতে আলোকিত। সারাদিন জনবহুল থাকা এই পার্ক এখন কেমন নির্জন হয়ে আছে।
‘এখানেই আসতে হলো আমাদের অধরা? আমার বন্ধুরা আছে হয়তো এখানে। এক তো তোমার কথায় কোনরকম বাহানা দেখিয়ে তাদের থেকে উঠে বাসায় গিয়েছি। এখন যদি কেউ দেখে নেয় আমায়, তাহলে তো আমি শেষ।’
‘আরে ভয় নেই আশ্বিন। আপনার বউ আপনার পাশে আছে।’
ভ্রু কুঁচকে আশ্বিন ফিরে তাকায় অধরার দিকে। কলেজে থাকা কালে অধরা ঠিক এভাবেই আশ্বিনকে বলতো,
-ভয় নেই আশ্বিন ভাইয়া, যখন অধরা আছে আপনার পাশে।
কিন্তু প্রতিবারই অঘটন ঘটিয়ে সে নিজেই ভয়ে আশ্বিনের পিছন লুকিয়ে থাকতো। কথাগুলো মনে হতেই একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দেয় সে।
‘আচ্ছা তো আমার বউ আমার পাশে আছে?’
মাথা নেড়ে সম্মতি জানায় অধরা। সে ঠিকই বুঝতে পারছে মহাশয় কলেজের সেই কথাগুলো মনে করে তাকে খোঁচা দিতে চাইছে।
‘দেখুন আশ্বিন, আপনি যদি ভেবে থাকেন আমি এখনও ভয় পেয়ে আপনার পিছু লুকিয়ে থাকবো তাহলে আপনি ভুল। এখন আমি অনেক সাহসী মেয়ে, কাউকে ভয় পাইনা আমি।’
প্রতিউত্তর দেয় না আশ্বিন। অনেক কষ্টে হাসি থামিয়ে রেখেছে সে। আশেপাশে একবার তাকিয়ে দেখে সে।
‘শুনেছি পার্কে থাকা এই গাছগুলো অনেক বছর পুরনো। দেখো কেমন বিশাল বিশাল গাছ।’
আশ্বিনের কথায় আড়চোখে একবার গাছগুলোর দিকে চোখ বুলিয়ে দেয় অধরা।
‘হুম পুরনো। তো কি হয়েছে?’
‘নাহ, কিছু হয়নি। তবে কোথায় যেন শুনেছিলাম এমন পুরনো বট গাছে নাকি জ্বিন ভূত থাকে।’
বিস্ফারিত দৃষ্টিতে ফিরে তাকায় অধরা গাছগুলোর দিকে। ছোট বেলা বাবার কাছেও একবার শুনেছিলো এই বিশাল গাছগুলোর কথা। ভয়ে গলা শুকিয়ে আসছে অধরার। আশ্বিনের কথায় মুহূর্তেই কলিজা কাঠ হয়ে গিয়েছে।
‘আরে ক..ক..কিছু ন..নেই এখানে। এসব তো রূপকথার গল্প।’
অধরার কথার ভঙ্গিতে মনে মনে হেসে উঠে আশ্বিন। কিন্তু তা প্রকাশ করে না।
‘কি জানি, হতেও তো পারে। বাই দ্য ওয়ে, তোমার তো ভূত প্রেত ভয় পাওয়ার কথা না, কেননা তুমি অনেক সাহসী। আর তাছাড়া যে কড়া লিপস্টিক লাগিয়ে এসেছো, তোমাকে ভয় দেখাতে পেত্নী এসে তো নিজেই ভয়ে পালাবে?’
‘এই কি বললেন আপনি?’
হেসে ফেলে আশ্বিন। রাগে কড়াভাবে তাকিয়ে আছে অধরা। এতো বড় অপমান? একটু নাহয় লিপস্টিক দিয়েছিলোই। তাই বলে এমন বলবে?
রাগে আশ্বিনকে ফেলেই হনহন করে ছুটে গিয়ে দূরে একটি বেঞ্চে এসে বসে সে।
তার পিছু পিছু আশ্বিন গিয়ে বসেছে তার পাশে।
‘রাগ করেছো? আমি তো মজা করে বলেছি।’
‘যা সত্যি তাই তো বলেছেন। মিথ্যে তো বলেননি।’
আশ্বিনের আর বুঝতে বাকি নেই বিবি সাহেবা রাগ করেছেন। তাই আশ্বিন অধরার দিকে একটু এগিয়ে গিয়ে অধরার কোমরে হাত রেখে এক টানে তাকে কাছে নিয়ে আসে সে। চমকে উঠে অধরা। গা ঘেঁষে বসে আছে দুজন দুজনের। অধরা হতভম্ব নয়নে তাকিয়ে আছে আশ্বিনের দিকে। আশ্বিনের চোখ মুখে চাঞ্চল্য।
‘কি করছেন? ছাড়ুন।’
‘কিভাবে ছেড়ে দিবো? এমন রোমান্টিক একটা আবহাওয়া, পাশে সুন্দরী বউ বসে, পার্কে শুধু আমি আর তুমি..।’
চোখ নামিয়ে নেয় অধরা। একরাশ লাজুক ভাব এসে ভর করছে তার চোখ মুখে। বুকের ভেতর হাতুড়ি পিটা করছে, ঠিক যেন উত্তাল সমুদ্রের ঢেউ।
‘লজ্জা পেলে তোমাকে অনেক কিউট লাগে অধরা। গাল দুটো গোলাপি হয়ে যায়, কান লাল হয়ে আসে, আর চোখ মুখে লাজুকতা এসে ভর করে তোমার। এতো মায়াবী কেনো তুমি?’
মুহূর্তেই এক শীতল হাওয়া বেয়ে যায় অধরার পুরো রম্ভে রম্ভে। আশ্বিনের থেকে চোখ সরিয়ে রেখেছে সে, তবুও অস্বস্তি ভাব যেন বেড়েই চলেছে তার।
আড়চোখে একবার তাকাতেই আশ্বিনের সাথে চোখ মিলে যেতেই উঠে যেতে নেয় অধরা। তখনই হাত ধরে আটকে নেয় আশ্বিন। ধীরে পায়ে এসে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে তাকে।
‘আকাশের ওই চাঁদ কি আমার অধরার থেকেও সুন্দর? বাগানে ফোঁটা লাল গোলাপ ফুলটি কি তোমার থেকেও সুন্দর?’
জবাব দেয় না অধরা। আশ্বিন ধ্যান ছাড়া হয়ে অধরার খোলা চুলের ঘ্রাণ নিতে থাকে। মুহূর্তেই কেঁপে উঠে অধরা। পেটের ভেতর মোচর দিয়ে উঠছে তার। আর বেশিক্ষণ এখানে থাকলে কখন যেন জ্ঞান হারায় সে।
তাই একটি দীর্ঘশ্বাস নিয়ে এক ঝাকটায় দূরে সরে যায় অধরা। ঘোর থেকে বেরিয়ে আসে আশ্বিন।
নিজেকে সামলে নিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা দুজন।
‘সব দোকান তো বন্ধ। আপনি বলেছিলেন আমায় আইসক্রিম খাওয়াবেন।’
‘হুম, বাসার সামনের দোকান থেকে কিনে দিতে হবে।’
একটা ভেংচি কাঁটে অধরা। এই সুন্দর মুহূর্ত ফেলে মহাশয় বাসায় যাওয়ার পথে আইসক্রিম কিনবেন? হঠাত তার মনে আসে আরশির কথা। আরশি বলেছিলো সব ব্যবস্থা করা আছে এখানে।
‘চলুন। সামনে একটু হেঁটে আসি। তারপর নাহয় ফিরে যাবো।’
রাজি হয়ে অধরার পাশাপাশি যেতে থাকে আশ্বিন।
–চলবে।
#আমার_হিয়ার_মাঝে
লেখিকা: তাহসীন নাওয়ার রীতি
পর্ব:২১
অধরার হাত ধরে পাশাপাশি হেঁটে যাচ্ছে আশ্বিন। একটু সামনে আসতেই লাল নীল বাতির মাঝে চেয়ার টেবিল ক্যান্ডেল দিয়ে সুন্দর করে সাজানো অবস্থায় দেখতে পায় দুজন।
আশ্বিন হতভম্ব। অধরার দিকে একনজর তাকিয়ে চিন্তায় পড়ে যায় সে। এসব কি তবে অধরা তার জন্য আয়োজন করেছে?
কিন্তু কিছুক্ষণ আগেও তো সে বন্ধুদের সাথে এখানে এসেছিলো, তখন তো এসব ডেকুরেশন ছিলো না। তবে কি করে..?
‘এসব কিছু তুমি করেছো অধরা?’
আশ্বিনের কথায় হুশ ফিরে আসে অধরার। এতোক্ষণ ধরে বিস্মিত নয়নে সে নিজেই তাকিয়ে ছিলো সামনে।
‘না মানে..। আমি কখন..?’
কথাগুলো বলতে গিয়েও থেমে যায় অধরা। আরশি তো বলেছিলো তার বন্ধু সব ঠিকঠাক করে রেখেছে। তবে কি এসব তারই কাজ? কথাগুলো মনে হতেই একনজর ফিরে তাকায় আশ্বিনের দিকে। আশ্বিন স্বাভাবিক।
‘হয়তো কোন দম্পতি আজ আমাদের মতোই ঘুরতে এসেছিলো এখানে। এসব হয়তো তাদের জন্যই ছিলো।’
কথাগুলো বলে আশ্বিন ফিরে তাকায় অধরার দিকে। বেচারি অধরা কি বলবে ভেবে না পেয়ে একটা মুচকি হাসি দেয়। আশ্বিন কথা না বাড়িয়ে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নিতেই হঠাত কেউ একজন পেছন থেকে তাকে ডেকে উঠে।
‘আশ্বিন কোথায় যাচ্ছিস তুই?
এত কম সময়ের মাঝে তোদের জন্য এত কষ্ট করে এতোসব আয়োজন করলাম। এখন সব ব্যার্থ যাবে না কি?’
মুহূর্তেই থেমে গিয়ে কপাল কুঁচকে ফেলে আশ্বিন। কণ্ঠস্বর তার অতি পরিচিত। কিন্তু সে এখানে কি করে আসবে?
তাই সন্দেহ দূর করতে অধরা সহ দুজন একসাথে পিছনে ফিরে তাকিয়ে অবাক হয়ে যায়।
‘রোদ! তুই?’
‘তো? আর কাকে আশা করেছিলি? আমার বেস্ট ফ্রেন্ড তুই। তোর জন্য ঢাকা থেকে এসে এই রাতেরবেলা পার্কে ডেকুরেশন করেছি এই আমি। আর তুই কিনা চলে যাচ্ছিলি?’
রোদ্দুরের কথায় হেসে উঠে আশ্বিন। ছোট থেকে সবসময় রোদ্দুর তার প্রতিটি মুহূর্তে পাশে থেকেছে। তার খুশির জন্যই সব ঝামেলা উপেক্ষা করে চলে আসতে প্রস্তুত সে।
তাই তো ছোট থেকেই আশ্বিনের কাছে রোদ্দুর তার বন্ধু কম, ভাই বেশি ছিলো।
এগিয়ে গিয়ে রোদকে জড়িয়ে ধরে আশ্বিন।
‘কখন এসেছিস? একবার বলবি তো যে ময়মনসিংহ আসছিস। বিকাল থেকে তোকে ফোন দিচ্ছি আমি, ফোন রিসিভ করিসনি।’
‘আরে শান্তি, শান্তি। ঘন্টা খানেক আগেই এসেছি। আর আসতে না আসতেই আমার মহারাণীর নির্দেশ পেয়েছি উনার ভাইয়া আর ভাবির জন্য সারপ্রাইজ ডেকুরেশন করার।’
‘আচ্ছা তো আরশির কথায় করেছিস এসব?’
একটা বাঁকা হাসি দেয় রোদ্দুর। যদিও সে নিজ থেকেই এসব করেছে। শুধু মাত্র তার জন্য হওয়া অধরা আশ্বিনের মাঝে এই ভুল বোঝাবুঝি ভেঙে দিয়ে আবারও দুজনের মিল করাতে। সে চায় না তার প্রিয় বন্ধুকে কষ্ট পেতে দেখতে। তাইতো আরশির মাধ্যমে তারই এতসব আয়োজন। তবে এই মুহূর্তে কথাগুলো স্বীকার করতে চাইছে না সে।
‘তো আর কি? ভবিষ্যত বউয়ের কথা শুনতে হবে না? নয়তো তোর জন্য আমার এতো সময় কোথায় আছে?’
একটা ভাব নিয়ে কথাগুলো বলতেই পিঠে এক চাপড় পরে রোদ্দুরের।
এদিকে,
তাদের কথাগুলো দূর থেকে শুনছে অধরা। খানিকটা এগিয়ে সামনে চলে আসে সে।
‘আমার ভাইকে মা/র/বে/ন না আশ্বিন। খবরদার।’
মুহূর্তেই ভ্রু যুগল কুঁচকে ফেললো আশ্বিন। আর হেসে উঠে রোদ্দুর।
‘এইতো, ভাইয়ের জন্য তার বোন চলে এসেছে। এখন দেখি তুই কি করিস..।
যাই হোক, অধরা এখন তুমিই সামলাও একে। আমি যাচ্ছি বাসায়, সারাদিন ডিউটি করেছি আবার এই জার্নি। এখন না ঘুমাতে গেলে মাথাই নষ্ট হয়ে যাবে আমার।’
অধরা আশ্বিনের সাথে টুকটাক আরো কথা বলে সেখান থেকে চলে যায় রোদ্দুর।
রোদ্দুর যাওয়ার পর আশ্বিন অধরার হাত ধরে এসে বসে পড়ে। টেবিলে রাখা আছে অধরার পছন্দের নুডুলস আর আইসক্রিম। অধরা তো এসব দেখেই দিক-বেদিক হারিয়ে খুশিতে খেতে শুরু করেছে। আর আশ্বিন দেখে যাচ্ছে অধরাকে। কীভাবে বাচ্চাদের মতো করে খেয়ে যাচ্ছে সে।
একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে আশ্বিন, এই মেয়ে হয়তো কোনদিন সিরিয়াস হবে না। তবে ভালো লাগছে তার অধরাকে আগের মতো এমন হাসি খুশি থাকতে দেখে। তাই তো কথা না বাড়িয়ে শুধু একমনে নয়ন ভরে দেখে যাচ্ছে সে অধরাকে।
শুধু চাইছে যেন এই রাত এখানেই থমকে যাক, তার অধরার হাসির মাঝে।
————
সকাল সকাল উঠেই আশ্বিন রেডি হচ্ছে ঢাকা ফিরে যাওয়ার জন্য। রুমের একপাশে থাকা সোফায় বসে অধরা ঘুমঘুম চোখে পিটপিট করে তাকিয়ে তার কান্ড দেখছে।
ঘুমে চোখ লেগে আসছে তার। সে শুধু পারছে না দৌড়ে গিয়ে খাটে শুয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়তে। এমনিতেই গতকাল অনেকটা রাত করেই তারা ফিরে এসেছে, এখন আশ্বিনের ফিরে যাওয়ার জন্য এই ভোর বেলা উঠতে হলো তাদের।
‘আপনার আজই ফিরে যাওয়া কি খুব দরকার ছিলো আশ্বিন?’
‘হুম। ফোন করে বললো একজন ইমার্জেন্সি রোগী এসেছে। সিনিয়র ডাক্তাররা অন্য এক জটিল কেইস নিয়ে ব্যস্ত আছেন। রোদ্দুরও সেখানে নেই, এখন আমাকেই তো যেতে হবে নাকি?’
‘হুম।’
ছোট্ট করে একটি জবাব দেয় অধরা। একটা হামি তুলে উঠে দাঁড়িয়ে চুপচাপ এসে হাজির হয় আশ্বিনের পিছু। আশ্বিন তখন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে।
‘তাহলে আমিও যাচ্ছি আপনার সাথে।’
‘প্রয়োজন নেই। তোমার সাতদিন ছুটি আছে তাই কদিন বাবা মায়ের সাথেই থাকো। তাদের ভালো লাগবে। তাছাড়া তুমি যেতে চাইলে তোমার সাথে রাশেদা খালা আর টুসিও যেতে চাইবে। এমনিতেই তারা অনেক দিন পর এখানে এসেছে, কিছুদিন থাকুক।’
‘কিন্তু আমি বলছিলাম কি, আপনি একা সেখানে কিভাবে থাকবেন? রান্না খাওয়ার তো একটা ব্যাপার আছে।’
অধরার কথায় আশ্বিন আয়নার মাঝেই অধরার দিকে ফিরে তাকায়। অধরা তখনও আশ্বিনের জবাবের অপেক্ষায়। একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে আশ্বিন পেছনে ফিরে।
‘আমি রান্না করতে পারি অধরা। ব্যাচেলর লাইফে একাই থেকেছি আমি। আমার মনে হচ্ছে না কোন সমস্যা হবে।’
‘তবুও ভাবছিলাম কি..।’
‘আজকাল দেখছি আমাকে নিয়ে অনেক ভাবতে শুরু করেছো।’
ভড়কে যায় অধরা। সে কি এমন বললো যে আশ্বিন এসব বলছেন?
তাছাড়া উনার তো বোঝা উচিত, বউকে একা ফেলে উনি কিভাবে চলে যেতে চাইছেন?
‘ভাবতে পারি না নাকি? বউ আমি আপনার। আমার অধিকার আছে আপনার..।’
কথাটা বলতে গিয়েও চুপ হয়ে যায় অধরা। কেননা আশ্বিন গোল গোল চোখে এমনভাবে তাকিয়ে থাকা তাকে মুহূর্তেই অস্বস্তিতে ফেলে দিচ্ছে। কি থেকে কি বলছে তার ধারণা নেই। শুধু জানে আশ্বিনের চোখের দিকে তাকিয়ে ভুলভাল বলে যাচ্ছে সে।
আশ্বিন হয়তো বুঝতে পারছে অধরার মনের অবস্থা। তাই মনে মনে একটা হাসি দিয়ে অধরাকে একটানে কাছে নিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে তাকে।
‘আমার বউটাকে অনেক মিস করবো। কতোদিন দেখা হবে না আমাদের। কিন্তু আমি ভাবছি তুমি আমাকে ছাড়া একা থাকবে কিভাবে? এখনই যেভাবে অস্থির হয়ে যাচ্ছো যাওয়ার জন্য!’
হতভম্ব অধরা। কি বললো মহাশয়? তার নামে এতবড় মিথ্যা অপবাদ? এক ধাক্কায় দূরে সরে দাঁড়ায় সে।
‘আপনি বেশি জানেন আমি থাকতে পারবো কিনা? আপনার ভালোর জন্য একটু জিজ্ঞেস কি করেছি আপনি তো উল্টো আমাকেই দোষ দিচ্ছেন। ভালোই।’
‘তাহলে বলতে চাইছো তুমি থাকতে পারবে?’
‘অবশ্যই পারবো।’
‘ভেরি গুড। থাকো তাহলে। আমি আসছি।’
কথাটা বলতে দেরি কিন্তু আশ্বিন আর এক মুহূর্ত দেরি না করে বেরিয়ে যায় রুম থেকে। এদিকে অধরা বোকার মতো দাঁড়িয়ে আছে সেখানে। কি হলো এটা? সত্যিই রেখে চলে গেলো? কথাটা ভেবে সেও বেরিয়ে যায় রুম থেকে আশ্বিনের পিছু পিছু।
পড়ন্ত বিকেল,
ঝিরঝির বৃষ্টিতে পরিবেশ বেশ ঠান্ডা আজ। বারান্দায় বসে আকাশ দেখতে ব্যস্ত অধরা। কালো মেঘাচ্ছন্ন আকাশ সেই সাথে শেষ বিকেল! মুহূর্তটা উপভোগ করার মতো। চারদিকে বয়ে বেড়ানো মৃদু ঠান্ডা বাতাস উপভোগ করতে করতে হঠাত ফোনে কল আসে অধরার।
অধরা চরম বিরক্তি নিয়ে ফোন হাতে তুলে দেখে জারিফের ফোন।
‘হ্যালো জারিফ, কি খবর তোদের?’
‘খবরের হিসেব রাখ। আগে আসল কাহিনী শোন।’
‘কি কাহিনী?’
‘কলেজে আজ হাসান স্যার এসেছিলেন।’
‘কিহ? স্যারের রিট্রায়ার্ডের পর তো কখনো আসেননি। তাহলে হঠাত আজ?’
‘জানি না। হয়তো কোন প্রয়োজনে এসেছেন। যাই হোক, আমরা সুযোগ বুঝে কথা বলেছি স্যারের সাথে। তারপর স্যারের কথায় আমি আর অনিক স্যারের বাসায় যাই।’
‘তারপর?’
‘স্যার আমাদের রাফিন ভাইয়ার মেডিকেল রিপোর্টগুলো দেখান। রিপোর্ট দেখে তো আমরা দুজন আকাশ থেকে পড়েছি। তুই দেখলে তুইও অবাক হবি। দাঁড়া আমি তোকে ছবি পাঠিয়ে দিচ্ছি। আর চেষ্টা করিস দ্রুত ফিরে আসার। আমরা এতদিন যেটা একটা এক্সিডেন্ট ভেবে এসেছি, এখন দেখছি এর পিছনে গভীর রহস্য।’
‘এসব কি বলছিস তুই? কি হয়েছে?’
‘তুই আগে রিপোর্ট দেখ। তাহলে নিজেই বুঝতে পারবি।’
কথাগুলো বলে ফোন কেটে দেয় জারিফ। অবাক হয় অধরা। কি এমন আছে এই রিপোর্টে? তখনই তার ফোনে কতগুলো ছবি আসে। অধরা এক এক করে সেগুলো খেয়াল করে বিস্ময়ের চরম পর্যায়ে চলে যায়। নিজের চোখকে বিশ্বাস হচ্ছে না তার।
‘রাফিন ভাইয়া তাহলে এই কারণেই…।’
কথাগুলো বলতে গিয়েও কথা আটকে যাচ্ছে তার। এতোগুলো কড়া পাহারা, নজর বন্দি থাকার মাঝে কে তাকে ভুল ঔষধ খাওয়াতে পারে? কথাগুলো মনে হতেই মাথা ঘুরে উঠেছে অধরার।
–চলবে।