আরশি পর্ব-২৪

0
1854

#আরশি
#Part_24
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat

চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি। নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে আছি সামনের দিকে। কেমন জড়তা কাজ করছে আমার মধ্যে। অস্বস্তি লাগছে। বার বার চোখের সামনে ভেসে উঠছে আমার সাথে করা ফাহাদের ব্যবহার গুলো। অহনার প্রতি তার নির্দয়তা। সবকিছু মনে পড়তেই গা আমার রি রি করে উঠে। মনের মাঝে এক তীব্র বাসনা জেগে উঠে, এখন এই প্রহরে এই মূহুর্তে ফাহাদের গালে কষিয়ে এক চড় মারার। তার কাছে প্রশ্ন করার, “ছেড়েই যখন দেওয়ার ছিল তাহলে কেন আমার জীবনের ১০ টা বছর কেড়ে নিল? কেন অহনাকে পিতৃহীন জীবন দিল? কেন? আমার কথা না হয় বাদই দিলাম কিন্তু অহনা? সে কি জানে না, একটি সন্তানের মায়ের ভালবাসা পাশাপাশি তার বাবার ভালবাসাও চাই। মা যতই চেষ্টা করুক সন্তানের বাবা হয়ে উঠার কিন্তু দিন শেষে তো সে মা এই থাকে৷ তাহলে কেন সে বঞ্চিত করলো অহনাকে তার ভালবাসা থেকে? মেয়েটা তো তারই রক্তের। নিজের রক্তকেই বা কিভাবে অবজ্ঞা করলো সে? কিভাবে?”

কিন্তু না! আমি আমার ইচ্ছাটিকে প্রশ্রয় দিলাম না। থাকুক না কিছু প্রশ্ন অজানা। দরকার কি পুরোনো জিনিসকে ঘাটার? আর মোট কথা, এই কথাগুলো যে ফাহদের নিকট অতি তুচ্ছ। বলেও কি আদৌ কোন লাভ আছে? যা হওয়ার তা তো হয়েই গিয়েছে। বুক চিরে বেরিয়ে এলো এক গুচ্ছ দীর্ঘ নিঃশ্বাস। আমি পিছে ঘুরে দাঁড়ালাম। এই মানুষটি সামনে থাকতেও গা ঘিন ঘিন করছে। এই মানুষটা নিতান্তই আমার এক কালো অতীতের পৃষ্ঠা মাত্র। যা অতি তুচ্ছ। একে কেন্দ্রবিন্দু করে এত চিন্তা ভাবনার কোন মানেই হয় না। যে আমার জীবনের এক কালো অংশ তাকে নিয়ে মাথা ঘামানো নেহাৎ বোকামি। আমি সামনের দিকে পা বাড়াতে যাব তার আগেই পিছ থেকে ডাক পড়ে,

— এই তুমি আরশি না?

সাথে সাথে আমি চমকে উঠি। বিষ্ময়ে চোখ দুইটি বড় হয়ে আসে। কেন না এই কন্ঠের অধিকারী লোকটিকে যে আমি জানি। এতো সেই যাকে নিয়ে আমি এতক্ষণ জল্পনা-কল্পনায় স্থির ছিলাম। এ যে ফাহাদ। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছো সে আমাকে চিনলোই বা কিভাবে? আমি তো উপর থেকে নিচ পর্যন্ত ঢাকা। গায়ে বোরখা,মাথায় হিজাব আর নিকাব। আমাকে চিনবার তো কথা না। ফাহাদের তো একদমই না। আমার এই ভাবনার মাঝেই ফাহাদ সামনে এসে দাঁড়ায়। সৌজন্য মূলক হাসি দিয়ে বলে,

— হ্যাঁ আরশি এই তো।

আমি চকিতে চাই তার দিকে। বেশ হাস্যজ্বল তার মুখখানি। যা রীতিমতো আমার মধ্যে অস্বস্তি সৃষ্টি করছে৷ আমি বেশ জড়তা নিয়ে বলি,

— আসসালামু আলাইকুম!

ফাহাদ আমার কথা শুনে কিছুক্ষণ থম মেরে দাঁড়িয়ে রইলো। বেশ কিছুক্ষণ পর ঠোঁটের কোনে সেই মিষ্টি হাসি ঝুলিয়ে বলে,

— ওয়ালাইকুম আসসালাম।

অতঃপর দুইজনের মাঝে নীরবতা। আমার মধ্যকার অস্বস্তি ধীরে ধীরে গাঢ় হয়ে আসছে। গা রি রি করছে। ক্ষোভে দুঃখে আমি নিজের হেদায়েত-জ্ঞান সব হারাচ্ছি। বিগত ১০ বছর ৫ মাসেরও অধিক সময়ের পুষে রাখা জীদগুলো যেন বেড়িয়ে আসতে চাইছে। হয়তো কোন ফাঁকফুকুর পেলে ঠিকই বেড়িয়ে এসে সামনের মানুষটি ভস্ম করে দিবে। কিন্তু না! তা তো হওয়া দেওয়া যাবে না। এমনটা হলে সামনে থাকা ব্যক্তিটি আমার রাগকে আমার দূর্বলতা ধরে নিবে। এমনটাই ধারণা করে নিবে আমি তার ছাড়া একদম অচল। সে ছেড়ে দিয়েছে বিধায় আমি নিঃস্ব হয়ে গিয়েছি। কিন্তু এইটা তো সত্য না। সবসময় সব জায়গায় রাগকে প্রশ্রয় দেওয়া ঠিক নয়। আমি দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে নিজেকে সংযত করছি। যতটা সম্ভব মাথা ঠান্ডা করার চেষ্টা করছি। ঠিক এমন সময় ফাহাদ নীরবতা পেড়িয়ে বলে উঠে,

— তা কেমন চলছে দিন কাল?

আমি যতটা সম্ভব শীতল কণ্ঠে বলি,

— আলহামদুলিল্লাহ ভালো।

ফাহাদ এইবার একটু তাচ্ছিল্যের সুরেই বলে উঠলো,

— থাকছো কোথায়? কোথাও কি ঠাই হয়েছে? নাকি দ্বিতীয় বিয়ে করে নিয়েছ?

কথাটা কর্ণপাত হতেই রাগে আমার শরীর জ্বলে উঠে। হাত দুইটি মুষ্টি বদ্ধ হয়ে আসে। আমি রক্তিম চোখে তাকাই ফাহাদের দিকে। কিছু কড়া কথা মুখ দিয়ে বেড়িয়ে আসতে নিলে মামার একটি কথা টনক নাড়ে, “রেগে গেলে তো হেরে গেলে৷ রাগ বিষয়টা হচ্ছেই মূল্যহীন। তো সেটা কখনো নিজের উপর ভারী হতে দিবি না। মাথা ঠান্ডা রেখেও কিন্তু কড়া কথা শুনানো যায়। আর ঠান্ডা মাথায় বলা কথার ধার বেশি৷ এতে সহজেই প্রতিপক্ষকে বিপর্যস্ত করা যায়।” কথাটা মনে হতেই আমি চুপ বনে যায়। দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে শান্ত কন্ঠে বলি,

— সকলে আপনার মত হয় না মি. ফাহাদ হোসেন। তাই সকলকে নিজের মত ভাবা বন্ধ করুন।

— হুম তাও ঠিক। যার যার যে স্বভাব। যেমন তোমার! আগেও এমন ছিলে, এখনো তেমনই আছো। মিডেলক্লাস!

— তা এই মিডেলক্লাস মেয়েকে এক দেখায় চিনে গেলেন কিভাবে? আমার মতে আমি তো আপনার স্মৃতি ক্ষুদ্র অংশটুকুতে জায়গা পাওয়ার যোগ্য নয়। তাহলে?

ফাহাদ আমার কথা ভড়কে উঠে। কিছুক্ষণের জন্য তব্দা মেরে দাঁড়িয়ে থাকে। অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে তাকিয়ে রয় আমার দিকে। হয়তো সে এই প্রশ্নটা আশা করে নি অথবা প্রশ্নটা শুনে সেও হতভম্ব। আমি তা দেখে বলি,

— আপনার কি আর কিছু বলার আছে? আমার আবার একটু তাড়া আছে।

ফাহাদ এইবার ফুঁসে উঠে বলে,

— আমাকে দেমাগ দেখাচ্ছ?

আমি তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলি,

— সে যোগ্যতা আমার নেই।

— কি বুঝাতে চাইছো?

— তার কৈফিয়ত আমি আপনাকে দিতে বাধ্য নই। এখন সরুন যেতে দিন। দেরি হচ্ছে আমার।

ফাহাদ হয়তো কিছু বলতে নিচ্ছিল কিন্তু তা তোয়াক্কা না করে পাশ কাটিয়ে চলে আসি। অসহ্য লাগছে লোকটাকে। খানিকটা দূরে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। ঘাড় ঘুরিয়ে পিছে তাকালাম একবার৷ কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে সামনের দিকে পা বাড়ালাম। মনে মনে বললাম,

— আপনি সত্যি বাবা হওয়ার যোগ্য না। স্বামী তো হতে পারেনই নি, সেই সাথে না একজন বাবা হতে পেরেছেন। একবারের জন্যও জানতে চাইলেন না অহনা কেমন আছে। যতটুকু সময় ছিলাম ততটুকু সময় কম ছিল এই ছোট প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করার জন্য? ধিক্কার জানাতেও ইচ্ছা করে না আপনাকে। কেন না এতে ওই শব্দটিকেই অপমান করা হবে। আপনি তো আমার ঘৃণার ও যোগ্য না।

______________________

রাত প্রায় নেমে এসেছে। চারদিকে অন্ধকারে হাতছানি। শা শা করে তীব্র বাতাস বইছে। ফাহাদ বাসের সিটে গা এলিয়ে দিয়ে সেই বাতাসের স্বাদ গ্রহণ করছে। সেই বিকেল থেকেই মনের মাঝে ঘাপটি মেরে বসে আছে একটি তিক্ত প্রশ্ন। যার উত্তর সে কোন ভাবেই মিলাতে পারছে না। বার বার বিরবির করে উঠছে সে, ” আসলেই কিভাবে আমি এক দেখায় আরশিকে চিনলাম? ওকে তো চিনার কথা নয়। তাহলে? ” কিন্তু উত্তরটা যে তাকে ধরা দিতে নারাজ।

ব্যাংকের কাজে ঢাকা এসেছিল সে। দু’দিন যাবৎ ধরে এইখানেই আছে। আজ অবশেষে ফিরে যাচ্ছে। তা সে ফিরে যাওয়ার আগে ভাবলো ঢাকা থেকে জুঁই আর আগন্তুক বাচ্চাটির জন্য কিছু কেনা কাটা করা যাক। সেই চিন্তা ধারাই মাথায় স্থির রেখে ছুটেছিল মার্কেটের দিকে। মার্কেটিং করার এক পর্যায় বোরকা পরিহিত এক নারীকে দেখে হঠাৎ তার টনক নেড়ে উঠে যে, “এইটা আরশি।” কেন মনে হলো জানে না সে। তাই সে কনফার্ম করার জন্য এগিয়ে যায়। আর এর পরবর্তীর কাহিনী তো সকলেরই জানা।

ফাহাদ নিজের মনের সাথে যুদ্ধ করেই চলেছে এই অনাকাঙ্ক্ষিত প্রশ্নের সামান্য উত্তর পাবার জন্য। কিন্তু সে যে প্রতিবার ব্যর্থ হচ্ছে। অবশেষে নিজের সাথে আর না পেরে সে দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে এই যুক্তি পেস করে,

— আরশির সাথে আমি ১০ বছর থেকেছি। এত কাছ থেকে দেখেছি ওকে, চেনাটাই তো স্বাভাবিক ব্যাপার। হুদাই ফাও একটা প্রশ্নের পিছে এতটা সময় ব্যয় করলাম আমি। ডিসগাস্টিং!

বলেই চোখ খুলে তাকালো সে। জানালার বাইরে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয় সে। আনমনে কি যেন ভাবে। হঠাৎ মনের মাঝে ছোট একটি নাম উঁকি দিয়ে যায়। অহনা! নামটা মনের মাঝে আসতেই ফাহাদের ভ্রু কুটি কুঞ্চিত হয়ে আসে। সে বিরবির করে উঠে,

— অহনা! সে কেমন আছে?

অতঃপর আর কিছু ভাবনা মনের মাঝে বিচরণ করতে দিবে তার আগেই ফাহাদের মুঠোফোনটা বেজে উঠে। সে চকিতে চায়। মুঠোফোনটা বের করে দেখে জুঁই ফোন করেছে। ফাহাদ সকল চিন্তা-ভাবনা ফেলে ফোন তুলে। মুহূর্তেই তার মন-মস্তিষ্ক থেকে বেরিয়েই যায় সেই দুটি নাম। অহনা আর আরশি। হারিয়ে যায় নিজের ফোনালাপের গহীনে।

___________________________

সময় যে কিভাবে কিভাবে গড়িয়ে যায় তা বুঝাই যায় না। নদীর স্রোতের ন্যায় সে অতিবাহিত হতেই থাকে। ফাহাদের সাথে আমার সাক্ষাৎ এর আজ দুই সপ্তাহ কেটে গেল। এতে যে আমার মধ্যে প্রভাব ফেলেছিল বা আমার মধ্যে কোন ছাঁপ ফেলেছিল তা কিন্তু নয়। বরং বেশ সাচ্ছন্দ্যেই ছিলাম আমি। নিজেকে সেইদিনের পর হালকা লাগছিল। হয়তো মনের কিছুটা ঝাঁজ মিটাতে পেরিছিলাম বলে। ফাহাদকে দেখাতে পেরেছিল যে আমি অসহায় নই। সকলের এই সময় আসে নিজেকে প্রুভ করার। হয়তো আমিও সেইদিন এই সুযোগটাই পেয়েছিলাম।

নিজের ব্যাগ গুছাচ্ছি আর টাইম দেখছি। রাত সাতটার বেশি বাজে। কাজের চাপ আজকে বেশি হওয়ায় লেট হয়ে গেল। ইতিমধ্যে মোহাম্মদপুর যাওয়ার শেষ বাসটি ছেড়ে দিয়েছে। এখন বাসায় যেতে হলে রিকশা ছাড়া গতি নেই। আমি দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে বের হতে যাব এমন সময় কানে কিছু শব্দ এসে বারি খায়। আমি দাঁড়িয়ে পড়ি। সর্তক দৃষ্টিতে চারদিকে চোখ বুলাই। আমি যে ফ্লোরে কাজ করি সেই ফ্লোর এখন পুরো ফাঁকা। অফিস আওয়ার শেষ প্রায় দেড় ঘন্টা আগে। যে যার মত চলে গিয়েছে। আর যারা ওভারটাইম করার জন্য ছিল তারা গিয়েছে উপরের তালায়। কি যেন ঝামেলা হয়েছে। সেটাই দেখতে গিয়েছে। শব্দটা আবার এসে বারি খেল কানে। আমি এইবার একটু চমকে উঠে। আশেপাশে ভালো মত তাকাই। ভয় না করলেও মনের মাঝে জন্ম নিচ্ছে সংশয়। বেশ কিছুক্ষণ পর বুঝতে পারি শব্দটা সাদের কেবিনের থেকে আসছে। কিন্তু সাদের তো এইসময় থাকার কথা না। সে তো দুপুরের লাঞ্চ টাইমের আগেই বেড়িয়ে পড়েছিল আর আসে নি। যার জন্য আমার কিছু কাজ পেন্ডিং এ পরে গিয়েছে। যেহেতু সাদ অফিসে নেই সেহেতু সাদের কেবিনে কে? আর যেই বা আছে তার কোন অনৈতিক উদ্দেশ্য নেই তো? আমি পা টিপে টিপে সাদের কেবিনের দিকে যাই। যাওয়ার পথে চোখে সাইডে ফ্লোর ক্লিনিং স্টিক দেখে দাঁড়িয়ে পড়ি। হয়তো পিওন দাদা ফ্লোর মুছার পর এইটা সরাতে ভুলে গিয়েছেন। আমি দ্রুত সেটা হাতে নিয়ে নেই আর সাদের কেবিনের দিকে এগিয়ে যায়। এইদিকটার লাইট ডিস্টার্ব করছে। বার বার অন অফ হচ্ছে। পুরাই ভুতুড়ে পরিবেশ লাগছে। যার ফলে ভয় নামক জিনিসটি বাসা বাঁধছে মনে। আমি দরজার সামনে যেতেই ক্যাঁচ করে দরজা খুলে কেউ বেড়িয়ে আসে৷ আমি তা দেখে ভয়ে হাতে থাকা স্টিকটা দিকে সামনের মানুষটির দিকে আঘাত করি। সাথে সাথে ভেসে আসে এক চিৎকার…

#চলবে