আষাঢ়ে শ্রাবণের বর্ষণ পর্ব-৪৮

0
1106

#আষাঢ়ে_শ্রাবণের_বর্ষণ
#মাইশাতুল_মিহির

[পর্ব-৪৮]

হৈহুল্লোড় চলছে পুরো শান্তি নিবাসে। বড় থেকে শুরু করে ছোটরা পর্যন্ত ভিষণ ভাবে ব্যস্ত। দায়িত্ব সহকারে পরিবারের সবাই নিজেদের কাজকর্ম সম্পন্ন করছে। কারণ একটাই। আজ সন্ধ্যা রাতেই রাইমার গায়ের হলুদ। অভ্র এখানের মেহমান। তবুও সাবিত ও আরিয়ানকে সঙ্গ দিয়ে রোশান ও হোসেন কে সাহায্য করছে। তার এমন সৌহার্দপূর্ণ ব্যাবহারে নিশিতা অনেক খুশি। সঙ্গে অন্যরাও। কিন্তু ভাবলেশহীন আবরার। সে কাজে হাত লাগাচ্ছে না। চরম লেভেলের অসল সে। শুধু কিভাবে কি করবে তা জানিয়ে দিচ্ছে আর বসে বসে কফি খাচ্ছে। যদিও তার থেকে অন্যান্য কাজের সাহায্য কেউ আশা করে না। পরিবারের সবাই তার স্বভাব চরিত্র সম্পর্কে অবগত।

সূর্য পশ্চিমাকাশে ডুব দিয়ে ধরনী করেছে অন্ধকারাচ্ছন্ন। দূরের ওই আকাশটা আজ অদ্ভুত ভাবে একদম স্বচ্ছ। অথচ গতকালও ভারি বর্ষণ ও ঘন কালো মেঘে আবৃত ছিলো। পরিবেশ কোলাহলপূর্ণ থাকলেও নুরা একদম নিরব। বারান্দার রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে থেকে আকাশটা দেখছে। মৃদু শীতল বাতাসে ভেসের সাথে আসছে ভেজা মাটির ভ্যাঁপসা ঘ্রাণ। শ্রাবণের সুন্দর সন্ধ্যায় মুগ্ধ না হয়ে রাজকে নিয়ে ভাবছে সে। ভাবছে কোনো এক সন্ধ্যাবেলায় রাজের সঙ্গে পাশাপাশি বসে সূর্যাস্ত দেখছে। দুজনের হাতে হাত রাখা। রাজের কাধে তার মাথা। হাতে দীবার বানানো এক কাপ রঙ চা। দীবা নামটা মাথায় আসতেই ভাবনা থেকে বেড়িয়ে এলো নুরা। নিজের মনের এই অদ্ভুত ভাসনা কোনো কালেই পূরণ হবার নয়। তবুও কেন অবুঝ মন বারংবার রাজ কে নিয়ে ভাবছে? রাজ তাকে চায় না, তাকে ভালোবাসে না, তবুও কেন সে রাজের প্রেমে মাতোয়ারা হয়ে বেহায়া হচ্ছে? কেন? চোখ বন্ধ করে লম্বা করে একটা শ্বাস নিয়ে নিশ্বাস ফেললো। তখুনি পিছনে কারোর অস্তিত্ব টের পেলো। কে এসেছে তা পিছু না ফিরেও বুঝতে বাকি নেই। তাই চুপচাপ নির্বিকার ভাবে রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে রইলো নুরা।

ধীর পায়ের কদম ফেলে নুরার পাশে এসে দাঁড়ালো রিমি। নুরার দৃষ্টি অনুসরণ করে আকাশের দিকে তাকালো। আনমনে সেদিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে প্রশ্ন করলো, ‘আকাশের রঙ কি জানিস?’

নির্লিপ্ত নুরা মলিন চোখে আকাশের পানে চেয়ে থেকেই শুধাল, ‘হ্যাঁ জানি তো। আকাশের না অনেক রঙ হয়। ঠিক মানুষের মনের মতো। কখনো নীল। কখনো সাদা। আবারো কখনো অভিমানী কালো মেঘেদের মেলা।’

রিমি আকাশ থেকে চোখ ফিরিয়ে নুরার দিকে তাকালো। মৃদু কন্ঠে আবারো প্রশ্ন করলো, ‘তোর কোনটা প্রিয়?’

তাচ্ছিল্য হাসলো নুরা। নিষ্প্রভ কন্ঠে ঠোঁট নাড়িয়ে বলে উঠলো, ‘স্বচ্ছ নীল আকাশটা আমার ভীষণ প্রিয় ছিলো। যেখানে ছিলো না কোনো ক্লান্তি, বেদনা, হারানোর যন্ত্রণা। সময় পরিবর্তনশীল জানিস তো। তাই সময়ের সঙ্গে আমার প্রিয় আকাশটাও পরিবর্তন হলো। অভিমানের কালো মেঘ এসে জড়ো হলো। এখন আর আমার প্রিয় নেই। যা আছে প্রিয় তা কেবল আমার একাকিত্ব।’

নুরার কথা গুলো শুনে বাকহারা রিমি। কথাগুলোর অর্থোদ্ধান করতে খুব বেশি সময় লাগে নি। তাই ভাবলো না কিছু। এতোদিন মনে লুকিয়ে রাখা প্রশ্নটা সময় বুঝে করেই ফেললো, ‘তোর মন খারাপের কারণটা রাজ স্যার। তাই না?’

রাজের নামটা শুনতেই কলিজাটা কেঁপে উঠলো নুরার। নিরবে মাথা নত করে চোখ বন্ধ করে ফেললো। ঠোঁট কামড়ে কান্না থামানোর চেষ্টা করলো। তবুও আঁখি যুগলের কার্নিশ বেয়ে গড়িয়ে পরলো এক ফোঁটা তপ্ত জল। নজর এড়ালো না রিমির। নুরাকে কাঁদতে দেখে স্তব্ধ হয়ে গেলো। শান্ত্বনা দিতে এক হাত এগিয়ে নুরার কাধে রাখলো। বহুদিন পর নিজের দুঃখ গুলো প্রকাশ করার বিশ্বস্ত একটা জায়গা পেতেই ভেঙ্গে পরলো নুরা। রিমিকে ঝাপটে জড়িয়ে ধরে বাচ্চাদের মতো ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। কান্নায় ভাঙ্গা গলায় বলে উঠলো, ‘আমার সাথে কেন এমন হলো? আমি তো মন থেকেই রাজকে ভালোবেসেছিলাম। তাহলে রাজ কেন আমাকে ভালোবাসলো না? কি এমন ক্ষতি হতো যদি রাজ আমার হতো?’

রিমি নুরার মাথায় হাত বুলাতে লাগলো। নুরাকে শান্ত করে বলে উঠলো, ‘স্যার তো আর জানে না তুই উনাকে ভালোবাসিস। জানলে ফিরাবে না। জানিয়ে দে তুই।’

রিমিকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো নুরা। কান্না থামিয়ে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললো, ‘রাজ একজন কে ভালোবাসে। রাজ কখনো আমার ভালোবাসা মেনে নিবে না।’

বিস্মিত হলো রিমি। নুরার ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে অবাক চোখে তাকালো। রিমির প্রশ্নাতীত চাহনি দেখে চোখের পানি মুছলো নুরা। কান্না থামিয়ে রেলিংয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়ালো। চোখের পানি মুছে বললো, ‘রাজ দীবাকে ভালোবাসে। বহু বছর আগে থেকেই।’

কথাটা কর্ণপাত হতেই রিমির মাথাটা ঝাঁঝাঁ করে উঠলো। মাথা চক্কর দিয়ে উঠার উপক্রম প্রায়। এর আগে কখনো এতোটা বিস্মিত হয় নি সে যতোটা আজ নুরার কাছ থেকে হয়েছে। এটা কিভাবে সম্ভব? চোখেমুখে হাজারো প্রশ্ন নিয়ে নুরার দিকে তাকিয়ে রইলো। নুরা সব খুলে বললো তাকে। ফটিকছড়িতে আবরারের সঙ্গে রাজের বিবাদ, নুরার সঙ্গে রাজের বলা কথা গুলো, দীবাকে হারানোর যন্ত্রণায় রাজের দেশ ছাড়ার কথাসহ সব কিছুই বললো। এতো এতো ঘটনা জানার পর রিমি প্রায় প্রতিক্রিয়াহীন হয়ে পরেছে। বলার মতো কোনো ভাষা খুঁজে পেলো না। কিংকর্তব্যবিমূঢ়তার সঙ্গে দাঁড়িয়ে রইলো কেবল। হতভম্ব হয়ে বলে উঠলো, ‘স্যার যে দীবাকে ভালোবাসে সেটা দীবা জানে না।’

নুরা মাথাটা এপাশ থেকে ওপাশ নাড়িয়ে ‘ না ‘ বুঝালো। অর্থাৎ দীবা জানে না। স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো রিমি। নিচের ঠোঁট কামড়ে নুরার দিকে তাকালো। দেখলো নুরা চোখের চাহনি নিষ্প্রভ। মলিন চেহারায় চোখ দুটো তার অস্বাভাবিক ভাবে লাল হয়ে আছে। কাঁপছে শরির, পুড়ছে বুক। তবুও নিজেকে শক্ত রাখার চেষ্টা করছে নুরা। রাজকে হারানোর যন্ত্রণা তাকে গ্রাস করছে প্রতিনিয়ত। কোনো উপায় খুঁজে পাচ্ছে না। চোখের পানি মুছে কান্না মিশ্রিত গলায় বললো, ‘আমি কি করবো বল না রিমি। কিভাবে রাজকে আটকাবো? আমার কিছু ভালো লাগছে না। কিছু না।’

‘তুই স্যারকে জানিয়ে দে তাহলেই সমস্যা সমাধান।’

রিমির সহজসরল উক্তিবাক্য টা শুনে তাচ্ছিল্য হাসলো নুরা। অন্য দিকে তাকিয়ে আড়ষ্ট কন্ঠে শুধাল, ‘সত্যিকারের ভালোবাসা অনেক অদ্ভুত জানিস। একজনকে ভুলে অন্যজনকে অনুভব করা যায় না। আর সে যদি হয় ভালোবাসার মানুষ তাহলে তো প্রশ্নই আসে না।’

হতাশার নিশ্বাস ছুড়লো রিমি। নুরাকে বুঝাতে বলে উঠলো, ‘পাগল তুই যে স্যারকে ভালোবাসিস সেটা তো আর স্যার জানে না। উনি তো দীবাকে ভুলার জন্যই দেশ ছাড়ছে। আমার মনে হয় তুই স্যারকে প্রপোজ করলে স্যার তোকে নিয়ে ভাববে। থেকে যাওয়ার জন্য হলেও একবার ভাববে। আর তা নাহলেও…!’

রেলিংয়ের উপর হেলান দিয়ে শরিরের সম্পূর্ণ ভর ছেড়ে দিলো নুরা। চোখ দুটো বন্ধ করে নিষ্প্রভ কন্ঠে বললো, ‘ব্যাপার টা তুই খুব সহজ ভাবে নিচ্ছিস।’

চুপ হয়ে গেলো রিমি। নিরবে দীর্ঘশ্বাস ফেললো শুধু। মনে মনে ভাবলো নুরার এই কষ্টটা যেন আল্লাহ খুব তাড়াতাড়ি দূর করে দেয়। নুরা তার আপন বোনের মতো। নুরার কষ্টে সে নিজেও কষ্ট পায় এবং পাচ্ছে। নুরার দিকে তাকাতেই বুকটা ভার হয়ে আসলো তার। নুরাকে শান্ত করতে নুরার কাধে এক হাত রাখলো। তখুনি নুরা আনমনে সামনে তাকিয়ে বলে উঠলো,

‘জীবনের প্রথম যাকে ভালোবাসলাম তাকে কাছে পাবার আগেই হারিয়ে ফেললাম। আসলে আমার কপালটাই খারাপ।’

আহত চোখে তাকালো রিমি। বললো, ‘এভাবে বলিস না প্লিজ। তুই স্যারকে তোর মনের কথা জানা। দেখিস স্যার রাজি হবে।’

নুরা আর কথা বাড়ালো না। মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বুঝিয়ে বললো, ‘একটু পরেই তো অনুষ্ঠান শুরু হবে। তৈরি হবি না?’

‘হবো তো। তোকে দেখতে এসেছিলাম। বোইন প্লিজ, যা হবার হয়েছে। এইসব চিন্তা করে শরির খারাপ করিস না। তকদিরে যা থাকবে তাই হবে। যা তৈরি হয়ে নিচে আয়। আমি যাচ্ছি।’

নুরা বাধ্য মেয়ের মতো মাথা এক পাশে কাত করে সম্মতি দিলো। খুশি মনে চলে গেল রিমি। সে যেতেই দীর্ঘশ্বাস ফেললো নুরা। নিজেকে স্বাভাবিক করে রুমে এসে হলুদ রঙ্গের লেহেঙ্গা পরে তৈরি হয়ে নিলো। প্রসাধনী বেশি ব্যবহার করেনি। মুখে শুধু ক্রিম আর ঠোঁটে লিপজেল ইউজ করলো। আয়নায় নিজেকে ভালো ভাবে একবার দেখে মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে রুম থেকে বেরুলো। কিছুক্ষণ আগের বিষণ্ণ মন দূর করে নিজেকে হাসিখুশি রাখলো। কেউ টেরও পেলো না।
____________________

কানে ঝুমকা পরতে পরতে দ্রুত হাঁটছে দীবা। ধ্যাৎ! অনেক দেরি করে ফেলেছে। এতোক্ষণে নিশ্চয় অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেছে? ভাবতেই আরো অস্থির হয়ে উঠলো সে। হাত দিয়ে লেহেঙ্গা হালকা উঠিয়ে দ্রুত পা চালাতে লাগলো। তখুনি হাতে খেচকা টান পরলো তার। ভড়কে গেলো দীবা। ভয়ে চোখমুখ খিঁচে ফেলল একদম। বেশ কিছুক্ষণ ধরে কোনো কিছুর সাড়াশব্দ না পেয়ে পিটপিট করে চোখ মেলে তাকালো দীবা। চোখ খুলতেই আবরারের মুখখানি নিজের খুব কাছে আবিষ্কার করলো। চোখ ঘুরিয়ে আশেপাশে তাকিয়ে বুঝতে পারলো দুজন একটা বদ্ধ রুমের ভিতরে আছে। স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো দীবা। হঠাৎ এভাবে টান দিয়ে আনায় বড্ড রাগ হলো তার। মুখ শক্ত করে আবরারের বক্ষস্থলে ধা’ক্কা দিয়ে কাটকাট গলায় বললো, ‘এখানে আনলেন কেন?’

দীবা রাগের ধা’ক্কাট আবরারের জন্য একদম তুচ্ছ। সে জায়গা থেকে নড়লো না। উল্টো দীবার দিকে এগিয়ে আরেকটু নিবিড় হলো। দীবার কোমড়ে এক রেখে অপর হাত দীবার গালে রেখে কপালে কপাল ঠেকালো। চোখে চোখ রেখে মৃদু গলায় বললো, ‘ভালোবাসি বউ।’

রাগটা মুহূর্তেই কর্পূরের ন্যায় উড়ে গেলো। লজ্জাভূতি হলো মন। গাল লাল হয়ে এলো। লজ্জায় আবরারের থেকে চোখ ফিরিয়ে মাথা নত করে ফেললো। দীবার এই লজ্জা মাখা মুখখানি দেখে নেশা জাগলো আবরারের মনে। দীবার দিকে অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে বলল, ‘শাড়ি পড়ো না? ভেবেছিলাম হলুদে শাড়ি-টাড়ি পরবে বোধহয়।’

‘শাড়ি পরতে ঝামেলা লাগে।’

‘আমি তোমাকে কখনো শাড়িতে দেখিনি।’

আবরারের কথা শুনে চোখ তুলে তাকালো দীবা। মেহেদী রাঙ্গা হাত তুলে আবরারের ডান গাল টিপে দিয়ে মিষ্টি হেসে বললো, ‘একদিন পড়ে দেখাবো।’

দীবার প্রত্যুত্তর শুনে প্রফুল্লিত হয়ে হাসলো আবরার। দীবার সঙ্গে আরো নিবিড় হতে চাইলে দীবা অস্থির কন্ঠে বলে উঠলো, ‘দেরি হয়ে যাচ্ছে। অনুষ্ঠান শুরু হয়ে যাবে। আমি যাই ছাড়ুন।’

কে শুনে কার কথা! আবরার তো একদম নির্বিকার। নিজের মতোই দীবার কাছাকাছি থেকে আলতোভাবে বললো, ‘যাবার আগে একটু আদর দাও।’

হতভম্ব হয়ে গেলো দীবা। চোখ বড়বড় করে আবরারের দিকে তাকালো। তাকে এভাবে তাকাতে দেখে আবরার আবারো বলে উঠলো, ‘আশ্চর্য আমি কোনো পাহাড় পর্বত এনে দিয়ে বলি নাই। এভাবে তাকানোর কি আছে? জাস্ট একটু আদর চেয়েছি। কিপটামি করছো কেন? জামাইটার প্রতি মায়া নেই তোমার? নির্দয় মেয়ে!’

দীবা একদম কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলো। ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে থেকে কয়েকবার চোখের পলক ফেললো। বিস্মিত হয়ে অস্ফুটিত কন্ঠে বলে উঠলো, ‘আমি কি একবারো বলেছি আদর দিবো না?’

নিচের ঠোঁট কামড়ে হাসি দিলো আবরার। মাথাটা দীবার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো, ‘তাহলে দাও।’

আবরারের মাথা এগুতেই দীবা নিজের মাথা পিছালো। ভ্রুঁ কুঁচকে ত্যাছড়া ভাবে বললো, ‘দিবো বলেছি নাকি?’

মুহূর্তে হাসি খানা মুখ থেকে গায়েব হয়ে গেলো আবরারের। ক্রোধ বাড়লো দীবার উপর। চোয়াল শক্ত করে দীবাকে ছেড়ে দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। তীক্ষ্ণ চোখে দীবার তাকিয়ে রাগ দেখিয়ে বলে উঠলো, ‘লাগবে না আমার।’

দাঁড়ালো না আর। গটগট পায়ে বেড়িয়ে গেলো রুম থেকে। আবরার যেতেই উচ্চস্বরে হেসে উঠলো দীবা। ভদ্রলোক কে রাগাতে ভীষণ ভালো লাগে। ইশ! রেগে গেলে নাক লাল হয়ে যায়। ভাবতেই আবারো হাসি পেলো। নিজেও দ্রুত রুম থেকে বেরিয়ে গেল।
__________________

বাড়ির সামনে বিশাল আঙ্গিনায় হলুদ স্টেজ করা হয়েছে। চারপাশে জ্বলছে রঙবেরঙের বাত্তি। সম্পূর্ণ স্টেজটা করা হয়েছে কাচা ফুল দিয়ে। ফুলের সৌরভে চারপাশ মু-মু করছে। অবশ্য ডেকুরেশনের আইডিয়াটা অভ্রের। তার এই আইডিয়াটা বরাবরই প্রশংসা যোগ্য।

স্টেজের মাঝে বসে আছে রাইমা। পরনে তার হলুদ শাড়ি। গাঁদাফুল ও গোলাপ ফুলের সংমিলিত গয়না রাঙ্গিয়ে রেখেছে তাকে। ঠোঁটে তার মিষ্টি আমোদিত হাসি। আশেপাশের আত্মীয়, কাজিন সবাই উল্লাসিত। হাসি আনন্দের সঙ্গে শুরু হলো রাইমার ইয়েলো নাইট। মেয়েরা একই ডিজাইনের লেহেঙ্গা আর ছেলেরা একই ডিজাইনের পাঞ্জাবি পরলো। হলুদে হলুদে একদম পারফেক্ট কম্বিনেশন!

সবার থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে দীবা ও রিমি। নুরার বিষণ্ণ মনের কারণটা দীবাকে বললো রিমি। তবে রাজ যে দীবাকে পছন্দ করে, দীবার জন্য যে রাজ আর আবরারের মাঝে ঝামেলা হয়েছে তা লুকিয়ে রেখেছে। সম্পূর্ণ ঘটনা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেলো দীবা। রাজ অন্য একটা মেয়েকে ভালোবাসে শুনে মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পরলো। রাজের জন্য নুরার এমন অবস্থা? রাজের জন্য নুরা কষ্ট পাচ্ছে। ভাবতেই রাজের প্রতি ক্ষোভ জন্মালো তার মনে। বিরক্ত হয়ে রাজের প্রতি ক্ষোভ নিয়ে বলে উঠলো, ‘ইচ্ছে করছে রাজের মাথাটা দেয়ালে টোকা খাওয়াতে।’

সিরিয়াস মুহূর্তে এমন মন্তব্য শুনে কিংকর্তব্য রিমি। হাসি পেলো তার। বললো, ‘কেন?’

দীবা চেহারায় বিরক্তি নিয়ে বললো, ‘বাংলা সিনেমার মতো স্মৃতিশক্তি হারিয়ে ব্যাটা তার পুরনো প্রেমিকা কে ভুলে যেতো। তারপর নুরার সঙ্গে লাইন ক্লিয়ার হয়ে যেতো। ভালো হতো না?’

হেসে ফেললো রিমি। দীবার বাহুতে আলতোভাবে থা’প্প’ড় মে’রে বললো, ‘সিরিয়াস মুহূর্তেও তোর দুষ্টুমি যায় না? কি করবি তা ভাব আগে। রাজের সঙ্গে নুরার রিলেশন সেট করবি নাকি নুরাকে মুভ অন করতে বলবি?’

দীবা হঠাৎ-ই ক্ষেপে উঠলো। কপাট রাগ দেখিয়ে বলে উঠলো, ‘আশ্চর্য নুরা মুভ অন করবে কেন? মুভ অন ওই শ’য়’তা’ন রাজকে করতে হবে। পুরনো প্রেমিকা কে ভুলে গিয়ে নুরার কাছেই আসতে হবে। ব্যাটা ইচ্ছে করে আসলে আসবে নাহলে ধরে বেধে নিয়ে আসবো। হাহ্!!’

আরো কিছু বলতে যাবে দুজন তখুনি ডাক আসলো তাদের। বরপক্ষ থেকে হলুদের তথ্য এসেছে। চিন্তাভাবনা সব এক পাশে রেখে দুইজন উল্লাসিত হয়ে গেল সবাইকে আমন্ত্রণ জানাতে। বরের বাড়ি থেকে আসা কাচা হলুদ ভাটা স্টেজের সামনে রাখা হলো। এবার কনের গায়ে হলুদ লাগানোর পালা। প্রথমে স্টেজে গেলো রোশান ও নিশিতা। রাইমাকে হলুদ লাগিয়ে দিয়ে নিশিতা তার হাতের চুড়ি খুলে রাইমাকে পরিয়ে দিয়ে স্টেজ থেকে নেমে গেলো। তারপর আসলো হোসেন ও আয়েশা। দুজন মেয়ের গালে হলুদ লাগিয়ে দিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পরলো। আয়েশা মেয়ের গলায় নিজের প্রিয় হারটা পরিয়ে দিয়ে প্রাণ ভরে দোয়া করলো। নিজেদের সামলে স্টেজ থেকে নেমে গেলো। তারপর নিশিতা সাবিত ও আবরারকে বললো হলুদ দিতে। দুইজন হাসি হাসি চেহারায় স্টেজে উঠলো। সাবিত রাইমার পাশে বসলেও আবরার বসলো না। সামনে দাঁড়িয়ে থেকেই তর্জনী আঙ্গুলে অল্প করে হলুদ নিলো। সাবিত আর আবরার দুজন একইসঙ্গে রাইমার দুই গালে হলুদ লাগালো। রাইমার ঠোঁটে মিষ্টি হাসি। চোখ লাল হয়ে এলো তার। ঠোঁট ভেঙ্গে কেঁদে ফেললো রাইমা। তাকে কাঁদতে দেখে দুই ভাইয়ের বুক ভার হয়ে এলো। আবরার এগিয়ে এসে রাইমার পাশে বসে মাথায় হাত বুলাতে লাগলো। শান্ত্বনা দিতে লাগলো সাবিত। রাইমাকে নিয়ে শৈশবে কতশত স্মৃতি জড়িয়ে আছে। সেই ছোট রাইমার আজ গায়ের হলুদ। কাল যাবে শ্বশুর বাড়ি। দুইজন রাইমাকে জড়িয়ে ধরে শান্ত্বনা দিতে লাগলো। তিন ভাই বোনের এই সুন্দর মুহূর্ত গুলো ফ্রেমে বন্দি করে নিলো ক্যামেরা ম্যান।
.

নুরা এক পাশে দাঁড়িয়ে রাইমাকে দেখছে। রাইমার হাসির সঙ্গে সঙ্গে মাঝে মাঝে নিজেও খিলখিলিয়ে হাসছে। রাইমার থেকে চোখ সরিয়ে অন্যত্র তাকাতেই রাজকে দেখে বুকটা ধক করে উঠলো। অসাড় হয়ে এলো শরির। এতোদিন পর মানুষটাকে স্বচক্ষে দেখতে পেলো। অশান্ত মনে প্রশান্তির ভেলা ভাসতে লাগলো। প্রথমের মতোই চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। রাজ এগিয়ে এলো তার দিকে। নুরার সামনে দাঁড়িয়ে মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে বললো, ‘কেমন আছো?’

প্রত্যুত্তরে নুরাও হাসলো। সাবলীল ভাবে জবাব দিলো, ‘এইতো ভালো। আপনি?’

‘ভালো।’

‘কখন এসেছেন? দেখলাম না তো আপনাকে।’

রাজ হাত ঘড়িতে সময় দেখতে দেখতে বলে উঠলো, ‘হলুদ নিয়েই এসেছি। আসলে আসতে চাইনি আম্মু জোর করে পাঠিয়েছে। বলে একমাত্র ভাই তুই যাবি না তো কে যাবে। তাই বাধ্য হয়েই এলাম।’

ভ্রুঁ জোড়া কুঁচকে এলো নুরার। কারণ জানতে চাইলে রাজ মাথা চুলকে বললো, ‘আসলে বেশি মানুষজনের মাঝে আমার কেমন জানি লাগে। এইসব থেকে আমি সবসময় দূরে থাকি।’

রাজের কথা শুনে হেসে ফেললো নুরা। ঠোঁটে হাসি রেখেই বললো, ‘আপনি তাহলে একঘেয়ে মানুষ।’

‘হ্যাঁ!’ এইটুকু বলেই থেমে গেলো রাজ। কি বলবে বুঝে পেলো না সে। কিংবা নুরার কাছে কেন এসেছে সেটাও জানে না সে। আড় চোখে নুরার দিকে তাকালো একবার। হালকা সাজে ভীষণ মিষ্টি লাগছে মেয়েটাকে। কেন জানি নুরার প্রশংসা করতে ইচ্ছে করলো তার। তাই নুরার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো, ‘তোমাকে আজ সুন্দর লাগছে।’

লজ্জা পেলো নুরা।রাজের থেকে চোখ ফিরিয়ে অন্যদিকে তাকালো। নুরার লজ্জা মাখা মুখ দেখে রাজও স্মিতি হাসলো। তখুনি সেখানে আবরারের আগমন ঘটলো। তীক্ষ্ণ চোখে রাজের দিকে তাকালো আবরার। তার চোখের চাহনি দেখে ভয় পেয়ে গেলো নুরা। দুজনের মাঝে যদি এখন ঝামেলা বেধে যায়? ভাবতেই আত্মা কেঁপে উঠলো তার। ভয়ে শুকনো ঢোক গিললো নুরা। মনে মনে আল্লাহকে ডাকতে লাগলো।

চলমান…