আসক্তিময়_ভালবাসা পর্ব-২৫

0
3175

#আসক্তিময়_ভালবাসা
#Part_25
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat

— রিয়ান!!

সে সাথে সাথে পিছে ঘুরে দাঁড়ায়। চোখ দুইটিতে তার বিষ্ময় ভরা। মুখ ভঙ্গি না বুঝলেও তার চোখ জোড়ার ভাষা আমি ঠিকই বুঝে গিয়েছি। আমি কোন মতে বিছানা থেকে নেমে দাঁড়াই। ধীর পায়ে তার দিকে এগিয়ে যাই। সে এখনো স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমি এক পা দুই পা এগিয়ে তার সামনে গিয়ে দাঁড়াই। বাঁধা হাত দুইটি উঁচু করে মাস্কটা টেনে নিচে নামাই। সাথে সাথে সে চোখ বন্ধ করে ফেলে। আর আমি এক ধ্যানে তার মুখপানে তাকিয়ে থাকি। চোখ দুটো বন্ধ অবস্থায়ও নড়ছে। যার ফলে তার ছোট ছোট চোখের পাপড়ি নরছে। সরু নাকের ডগায় বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে আছে। বা গালের সেই তিলটা যেন বার বার চোখে বাজছে৷ আমি আর কিছু না বলে তার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ি। হাত বাঁধা থাকার কারণে চেয়ে তাকে জড়িয়ে ধরতে পারছি না। তার বুকে চুপচাপ মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে নেই। হুট করে রিয়ান আমায় তার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। আর লম্বা লম্বা নিঃশ্বাস নিতে থাকে। আমি তার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি। রিয়ান নিজেকে সামলিয়ে আমার দিকে তাকায়। অতি সুক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে কাঠ কাঠ গলায় বলে,

— তাহলে শেষ পর্যন্ত চিনেই ফেললে আমায়? ওয়েল! ওয়েল! ভালোই হয়েছে। এখন আর এই লুকোচুরি খেলতে হবে না। এই মাস্কের আড়ালে লুকিয়ে থাকতে হবে না।

এই বলে রিয়ান মাস্কটা টেনে খুলে দূরে ছুঁড়ে মারে। আমি কিছুই বলছি না। শুধু শীতল দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছি। সে আমার দিকে তাকিয়ে কঠোর গলায় বলে,

— তা এখন তো আমার পরিচয় জেনেই গিয়েছ। সাথে কাজটাও সহজ করে দিয়েছ। তোমাকে ডোমিনেট করা আমার জন্য ইজি হবে।

আমি তাও কোন কথা বলছি না। শান্ত চোখে তার দেখছি। সে আমার অতিকাছে এসে চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞেস করে,

— এখন বলো সেই মেডিসিনটা কোথায় রেখেছ। সাথে বাকি জিনিসগুলো।

বরাবরের মত আমি এখনো চুপ। শান্ত দৃষ্টিতে আমি তার চোখের দিকে তাকিয়ে আছি। সে এইবার রাগান্বিত কন্ঠে বলে,

— স্পিক আপ ডেমিট! আ’ম আস্কিং ইউ সামথিং।

আমি তাও চুপ। সে এইবার রেগে আমার বাহু দুটি চেপে বলে,

— সে সামথিং! ইউর সাইলেন্স ইজ কিলিং…

বাক্যটি সে সম্পূর্ণ করলো না। শেষ দিকে এসে থেমে গেল। এইবার আমি গিয়ে মুখ খুলি। অতি শান্ত কন্ঠে বলি,

— কেন করছেন এইসব? এইসবের সাথে কেন জড়িয়েছেন আপনি? হোয়াট ইজ দ্যা রিজন?

আমার কথা শুনে হয়তো বা তিনি বিস্মিত হলেন। তার বিস্ময়ের কারণ হয়তো বা আমি হাল্কা পাতলা আন্দাজ করতে পারছি। সে আমার বাহুদ্বয় ছেড়ে দিয়ে একটু দূরে গিয়ে দাঁড়ায়। কিছুক্ষণ চুপ থেকে কাঠ কাঠ গলায় বলে,

— টাকার জন্য করছি এইসব। টাকার লোভ কার না থাকে? আর যদি এতগুলো টাকার ব্যাপার হয় তাহলে তো কথাই নেই।

আমি শান্ত কন্ঠে বলি,

— মিথ্যে যখন বলতে পারেন না তখন কেন বলেন?

— হোয়াট রাবিশ ইজ দিস। আমি কেন মিথ্যে বলতে যাব? তাও আবার তোমার কাছে যেখানে আমার পরিচয় অলরেডি ফাঁস হয়েই গিয়েছে।

— ক্ষণেকের মাঝে মানুষ পরিবর্তন হতে পারে কিন্তু অভ্যাসগুলো না। আর তা যদি হয় বদভ্যাস তাহলে তো কোনদিনও না। আর সেই বদভ্যাসগুলোই দুই একসময় মানুষকে চিনিয়ে দিতে সাহায্য করে। আপনার বেলায়ও তাই।

মিথ্যে যদি নাই বলেন তাহলে নিজের বা পা-টি দিয়ে বার বার মেঝেতে শব্দ কেন করছেন? এইটা তো আপনি তখনই করেন যখন আপনি মিথ্যে বলেন।

কথাটা বলার সাথে সাথে রিয়ান অপ্রস্তুত হয়ে যায়। কিন্তু পরক্ষনেই সে নিজেকে সামলে বলে,

— আর ইউ আউট অফ ইউর মাইন্ড? এমন ষ্টুপিড এক্টিভিটিস দিয়ে তুমি আমার কথাগুলো মিথ্যে বলছ? রিডিকুলাস!

— আচ্ছা সেইগুলো বাদ দিন। যদি বলি আপনার কথা আমি বিশ্বাসই করি না। আমি রিয়ানকে খুব ভালো মত চিনি। সে কখনোই টাকার জন্য এইসব করবে না।

— তাহলে বলবো তুমি রিয়ানকে কখনো চিন্তেই পারোনি।

— যাকে না দেখে চিনা যায় তাকে চিন্তে সে কখনো ভুল করতে পারে না।

— নিজের এইসব থার্ডক্লাশ কথা নিজের কাছেই রাখো। তোমার এইসব কথায় আমার কোন ইন্টারেস্ট নেই। তাই নিজের এইসব কথা বন্ধ কর। আর চুপচাপ বলে দাও সেই মেডিসিন আর পেনড্রাইভটা কই?

— যদি বলি বলবি না তখন?

— এমন করুণ অবস্থা করবো যে তুমি বলতে বাধ্য হবে। আর যদি না বলো তাহলে একদম মেরে ফেলবো।

আমি এতক্ষণ শান্ত ভঙ্গিতে তাকে পর্যবেক্ষণ করছিলাম। তিনি কথাটা বলার সময় আবার বা পা দিয়ে মেঝেতে শব্দ করছিলেন। ঠিকই বলে অনেকে, “বদভ্যাস সবসময় মানুষকে ফাঁসিয়ে দেয়।”
আমি রিয়ানের দিকে তাকিয়ে বলি,

— তাহলে মেরে ফেলুন। কেন না আমি কখনোই বলবো না সেটা কোথায়।

রিয়ান এইবার রাগান্বিত হয়ে পাশের ছোট টেবিলে রাখা কাঁচের গ্লাসটা আমার অবস্থান থেকে প্রায় দুইহাত দূরে ছুঁড়ে মারে আর রাগে ফুসতে থাকে। চোখ বন্ধ করে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করে৷ আমি একবার রিয়ানের দিকে তাকিয়ে কাঁচের টুকরোর দিকে তাকাই। কাঁচের অজস্র টুকরো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে চারদিকে। আমি কিছু না বলে কাঁচের সাইডে এগিয়ে যাই আর একটা বড় কাঁচের টুকরোর মধ্যে পা বসিয়ে দেই। সাথে সাথে “আহহ” বলে আর্তনাদ করে উঠি। আর একটু পিছিয়ে খাটে গিয়ে বসে পড়ি। আমার আর্তনাদ শুনে রিয়ান চটজলদি পিছে ঘুরে দাঁড়ায়। আমাকে খাটে বসে থাকতে দেখতে ভ্রু কুঁচকে তাকায়। অতঃপর মেঝেতে হাল্কা রক্ত দেখতে পেয়ে তড়িৎ গতি ছুটে আসে আমার কাছে। মেঝেতে হাটু গেড়ে বসে আমার পা দুটো তার কোলে তুলে নেন। অতঃপর আমার এক পায়ে বড় একটি কাঁচের টুকরো বিঁধে থাকতে দেখে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। সে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আমার পা-টা দেখতে থাকেন। চোখে মুখে তার অস্থিরতা ফুটে উঠেছে। বার বার হাঁস-ফাঁস করছেন। মাঝে মধ্যেই কি যেন বির বির করছেন। আর আমি শান্ত দৃষ্টিতে তার কর্মকাণ্ড দেখছি। সে পা-টা ভালো ভাবে দেখে নিয়ে কাঁচের টুকরোটা ধরে একটানে কাঁচটা বের করে আনেন। সাথে সাথে আমার মুখ দিয়ে চাপা আর্তনাদ বেড়িয়ে আসে। পায়ের তালু বেয়ে গলগল করে রক্ত পড়তে শুরু করে। এতে যেন রিয়ান আরও অস্থির হয়ে পড়েন। সে আমার পায়ে অনবরত ফুঁ দিতে থাকে। আর কেমন হাঁস-ফাঁস করতে থাকেন। যেন ব্যথাটা আমি না বরং তিনিই পেয়েছেন। অতঃপর নিজের পকেট থেকে রুমালটা বের করে আমার পায়ের রক্তক্ষরণ স্থানে চেপে ধরেন। উদ্বিগ্ন গলায় বলে,

— খুব ব্যথা করছে তাই না?

তার কথা শুনে আমি মুচকি হেসে বলি,

— যেই ছেলে কিছুক্ষণ আগেই আমাকে নিজ হাতে মারতে চাইছিল, সেই এখন আমার সামন্য আঘাত সহ্য করতে পারছে না। বিষয়টা হাস্যকর না?

কথাগুলো শুনে রিয়ান আমার দিকে করুন চোখে তাকায়। বেশ কিছুক্ষণ এইভাবে তাকিয়ে থেকে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। তা দেখে আমি বলি,

— আমি আবার জিজ্ঞেস করছি, বলুন না কেন করছেন এইসব? এইসবের সাথে কেন জড়িয়েছেন আপনি? সেই মেডিসিন দিয়েই বা কি করবেন আপনি?

রিয়ান এইবার আমার দিকে তাকিয়ে বলে,

— যদি বলি খারাপ কিছু করবো। আমার উদ্দেশ্য খারাপ। তাহলে কি বিশ্বাস করবে?

আমি মাথা নাড়িয়ে বললাম,

— না! বিশ্বাস করবো না। কেন না আপনাকে আমি খুব কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করছি। খুব ভালো করে জানি আমি আপনাকে। আপনার উদ্দেশ্য কখনো খারাপ হতে পারে না। আপনি আমায় বার বার প্রশ্ন করতেন না, আমি কেন সব জেনে-বুঝেও এমন অবুঝের মত হয়ে থাকি? এর কারণ আমি আজ আপনাকে বলবো।
কারণ আমি আপনাকে কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করতে চেয়েছিলাম। আপনাকে ভালো-ভাবে জানতে চেয়েছিলাম। তাই তো সব কিছু জেনে শুনেও বার বার আপনাকে প্রশ্ন করতাম। শুধুমাত্র আপনার মুখে কথাগুলো শুনবো বলে। বার বার চাইতাম আপনি যেন আমায় সব বলেন। আপনার কি মনে হয় আমি শুভ এর এক্সিডেন্ট সম্পর্কে কিছু জানতাম না? জানতাম! সব জানতাম। তাও আমি বার বার আপনাকে জিজ্ঞেস করেছি। যদি আমি বুঝদারের মত আচরণ করতাম তাহলে আমি আমায় কখনো এইসব কথা বলতেন না। বুঝাতেনও না।
আপনি খেয়াল করেছেন কি না জানি না, আমি কিন্তু আপনার সাথে কথা বলার সময় প্রায়ই চুপ হয়ে যেতাম। এর কারণ এই না যে, আমার কাছে কোন উত্তর ছিল না বা আমি উত্তর দিতে চাই নি৷ বরং আপনাকে পর্যবেক্ষণ করবো আমি চুপ হয়ে যেতাম।আপনার কথা বলা ভঙ্গিমা,আচরণ সব কিছু আমি সুক্ষ্ম ভাবে পর্যবেক্ষণ করতাম। আপনার না বলা কথা গুলিও আমি বুঝে যেতাম। কিন্তু কখনো তা প্রকাশ করতাম না। মাঝে মধ্যে আপনি কি বলেন তা দেখার জন্যও চুপ রইতাম। এই অবুঝ আচরণের জন্যই আজ আমি আপনাকে এতটা জানতে পেরেছি। আপনাকে মুখস্থ করতে পেরেছি।
এই যে কিছুক্ষণ আগে, আমি কিন্তু চুপ ছিলাম। নিশ্চয়ই বুঝেছেন কেন চুপ ছিলাম। আমি যখন আপনার নাম ধরে ডাকি আর আপনার মাস্ক খুলি তখন কিন্তু আপনার চোখের নিজের পরিচয় বেড়িয়ে আসার ভয় ছিল না। বরং ছিল কাউকে হারিয়ে ফেলার ভয়। আপনার মনের মধ্যে ছিল না কোন কঠোরতা বরং ছিল জড়তা। আপনার কথার মধ্যে ছিল এক রাশ দায়িত্ববোধ। আমাকে থাপ্পড় মারার পর আপনাকে অনুতপ্ত হতে দেখেছি।
তাই বলছি, আপনাকে চিন্তে আমি ভুল করতে পারি না। আমার বিশ্বাস আছে আপনার উপর। আপনি কখনো এমন কাজ করবেন না যার জন্য অন্য কাউরো ক্ষতি হয়। অবশ্য আমার এই বিশ্বাসের আরেকটা কারণ আছে। তা না হয় অজানা থাক।

রিয়ান আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,

— বিশ্বাস ভালো কিন্তু অন্ধবিশ্বাস না। যার সাথে তোমার কোন সম্পর্কই নেই তাকে কি এতটা বিশ্বাস করা ঠিক? এতটাও বিশ্বাস করো না যে যখন বিশ্বাসটা ভাঙ্গবে তখন সইতে না পারো।

আমি হেসে বলি,

— আমাকে কি বিশ্বাস করা যায় না?

— কথা ঘুরাচ্ছ কেন?

— আপনি আমার প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিচ্ছেন না কেন?

— গুটিয়ে নাও এইসব থেকে নিজেকে। মেডিসিনটা আমায় দিয়ে দাও।

— আগে প্রশ্নগুলোর উত্তরটা দিন।

রিয়ান এইবার চুপ হয়ে যায়। আমিও চুপ করে রই। অতঃপর আমি বলি,

— বুঝতে পারছি আপনি কোন না কোনভাবে পরিস্থিতির মায়াজালে আবদ্ধ। যার জন্য আপনার ভাব-ভঙ্গি বলছে আরেক কথা আর আপনি বলছেন অন্য কথা। যদি সত্যিটা এখন বলতে না চান তাহলে আমাকে অন্য ভাবে বুঝিয়ে দিন।

রিয়ান আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলে,

— অপেক্ষা করতে পারবে? দীর্ঘ অপেক্ষা! কথা দিচ্ছি এই অপেক্ষার শেষ প্রহরে গিয়ে তুমি তোমার প্রশ্নের সকল উত্তর পাবে। আপাতত যা যেভাবে চলছে তা চলতে দাও।

— বিশ্বাস করতে বলছেন তাহলে?

— হুম!

আমি আর কিছু না বলে চুপ থাকি। বেশ কিছুক্ষণ এইভাবে থাকার পর রিয়ান আমার দিকে প্রশ্ন ছুড়ে মারে,

— আমাকে বিশ্বাস করার অন্য কারণটা কি?

— যেদিন আমি আমার করা প্রশ্নের উত্তরগুলো পাব সেইদিন আমিও এই প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিব। আপাতত প্রশ্নটা তুলা থাকলো।

রিয়ান বেশ কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে উঠে দাঁড়ায়। দ্রুত পায়ে রুম থেকে বেড়িয়ে যায়। ক্ষণেকের মাঝেই আবার ফিরে আসে। হাতে তার ফাস্ট এইড বক্স। তা দেখে আমি দীর্ঘ নিঃশ্বাস নেই।

#চলবে