#আড়ালে_আবডালে
#পর্ব_১৪
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
___________________
আজও নিহির নামে একটা উড়োচিঠি এসেছে। আজ চিঠিটা গ্রহণ করেছে নিহির ভাবি তমা। নিহি তখনো ঘুমিয়ে ছিল। তমা এসে নিহিকে ডেকে বলে,
“দেখো আজও চিঠি এসেছে। তাও আবার কোনো নাম-ঠিকানা ছাড়াই।”
নিহি ধড়ফড়িয়ে বিছানা ছেড়ে ওঠে। উৎকণ্ঠা নিয়ে জিজ্ঞেস করে,
“পিওন আছে নাকি চলে গেছে?”
“সে তো চিঠি দিয়েই চলে গেছে। আজ আর তোমায় চায়নি। আমায় দিয়েই চলে গেল।”
নিহি গায়ের থেকে ল্যাপ সরিয়ে দৌঁড় দেয়। ড্রয়িংরুম পর্যন্ত গিয়ে আবার ঘরে ফিরে আসে। মানুষটা কে তা জানার উত্তেজনায় ওড়না ছাড়াই দৌঁড় দিয়েছিল। তাড়াহুড়া করে ওড়না খুঁজতে গিয়েও ওড়না খুঁজে পায় না। এদিকে পিওনকে ধরার জন্য মন-প্রাণ ছুটে যাচ্ছে। নিহিকে ব্যস্ত হতে দেখে তমা জিজ্ঞেস করে,
“কী খুঁজছ?”
“আরে ভাবি, ওড়না খুঁজে পাচ্ছি না।”
ওড়না খোঁজার মতো কোনো ধৈর্য না পেয়ে একটা জামা গলায় ঝুলিয়ে বের হয়। পেছন থেকে ভাবি বলে,
“এই নিহি, তুমি ওড়না না নিয়ে জামা নিয়ে যাচ্ছ তো!”
“কিছু হবে না ভাবি। এত সকালে মানুষজন সবাই ঘুমিয়ে আছে।” যেতে যেতে উত্তর দেয় নিহি। নিচ তলায় এসে আর পিওনের দেখা মেলে না। তাছাড়া বাম দিকে গেছে নাকি ডান দিকে গেছে সেটাও তো নিহি জানে না। নিহি মনকে প্রশ্ন করে, ‘আচ্ছা বলতো পিওন কোনদিকে গেছে? ডানদিকে না বামদিকে?’
মন বলেছে ডান দিকে। মনের ওপর ভরসা করেই নিহি ডানদিকের রাস্তা ধরে। কুয়াশার জন্য সামনের কিছুই দেখা যাচ্ছে না। আস্তে আস্তে কুয়াশা ভেদ করে নিহি এগিয়ে যায়। কুয়াশার মাঝে নিহি নিজেও হারিয়ে যায়। নোখ কামড়াতে কামড়াতে চারপাশে তাকায়। কয়েকজন রিক্সাওয়ালা পেটের দায়ে শীতের আরামের ঘুম বাদ দিয়েই রিক্সা নিয়ে বের হয়েছে। চায়ের টং দোকানগুলোতে চা বসানো হয়েছে। কয়েকটা দোকান খুলেছে মাত্র। ‘শালা পিওন ব্যাটা কোথায় যে হারিয়ে গেল!’
পাশ থেকে একটা ছেলের হাসির শব্দ পেয়ে নিহি চকিতে ফিরে তাকায়। ছেলেটির গায়ে টকটকে গাঢ় লাল রং এর একটা সুয়েটার। মাথায়ও লাল রং এর একটা টুপি। বয়স আনুমানিক ১০/১১ হবে। এর আগে কখনোই এখানে এই ছেলেকে নিহি দেখেনি। আর দেখলেও বোধ হয় চিনেনা। তাছাড়া সবাইকে চেনার দায়িত্বও নিহির নয়। নিহি কোমরে হাত দিয়ে জিজ্ঞেস করে,
“হাসছ কেন তুমি?”
মুখ টিপে হেসে ছেলেটা উত্তরে বলে,
“আমি দেখেছি, শীতে মানুষ সুয়েটার পরে। আর তুমি দেখি ডাবল জামা পরেছ।”
নিহি কিছু বলতে গিয়ে থেমে যায়। নিজের দিকে তাকিয়ে দেখে আসলেই তো তাই! নিশ্চয়ই খুব হাস্যকর লাগছে। তবুও ঈষৎ ভাব নিয়ে বলে,
“হু। তো?”
“রাগলে তোমায় দারুণ লাগে।”
নিহি হা হয়ে যায় ছেলেটার কথা শুনে। শেষে কী-না পিচ্চিপুচ্চি ছেলে নিহিকে লাইন মারছে! ওহ মাই গড! বাই এনি চান্স, এই উড়োচিঠিগুলো এই পিচ্চিটাই আবার দেয়নি তো? প্রশ্ন সব জমাট বেঁধে পেটের মধ্যে আকুপাকু করছে। গড়গড় করে প্রশ্ন না করা পর্যন্ত শান্তি নেই। চোখ দুটো ছোট ছোট করে নিহি মেকি দাম্ভিকতা নিয়ে প্রশ্ন করে।
“নাম কী তোমার?”
“নাম দিয়ে কাম কী?”
এইটুকু ছেলের ভাব দেখেছ? বাপ্রে বাপ! নিহি রাগ দেখিয়ে বলে,
“বেয়াদব! বড়দের সঙ্গে কীভাবে কথা বলতে হয় জানো না?”
“জানি তো! কিন্তু তুমি বড় হলেও আমার ভাবি। আর ভাবির সঙ্গে বেয়াদবি করলে কিছু হয় না। তাছাড়া এটাকে তুমি বেয়াদবি বলছ কেন? এটা ফান। ফান মানে বুঝো? মানে মজা।”
ওরে ছেলে! এইটুকুন পিচ্চি আমাকে শেখাচ্ছে ফান মানে কী? লাইক সিরিয়াসলি! নিহি পূণরায় রাগ দেখিয়ে বলে,
“দেবো না কান মলে!”
ছেলেটা কান এগিয়ে দিয়ে বলে,
“দাও মলে। ভাবি হয়ে একটা আশা করেছ। পূরণ তো করা উচিত।”
“কী আজব! কীসের ভাবি? কার ভাবি?”
“তুমি ভাবি। আমার ভাবি। আর শুনো, আজ বেশি কথা বলার সময় নেই। স্কুলে যেতে হবে।”
তারপর পকেট থেকে একটা সূর্যমুখী বের করে দিয়ে বলে,
“এই নাও। আমি দেইনি। ভাইয়া দিয়েছে।”
ফুলটা নিহির হাতে ধরিয়ে দিয়েই ছেলেটা দৌঁড়ে কুয়াশার মাঝে হারিয়ে যায়। নিহিও পিছু পিছু দৌঁড় দেবে নাকি দেবে না তা নিয়ে কিছুক্ষণ দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভোগে। পরক্ষণেই ভাবল, এত বড় ধিঙ্গি মেয়ে রাস্তায় দৌঁড়ালে বিষয়টা খারাপ দেখা যায়। ফুলটার দিকে একবার তাকিয়ে বিড়বিড় করে বাড়িতে চলে আসে। নিহিকে হতাশ হতে দেখে ভাবি জিজ্ঞেস করে,
“পেলে?”
“না গো! পিওনকে তো পাইনি। তবে এক ইঁচড়েপাকা ছেলের সঙ্গে দেখা হয়েছে।”
“সে আবার কে?”
“চিনি না। ছোট ছেলে। আমায় ভাবি ডাকল। এই দেখো ফুল। এটা ঐ ছেলেটাই দিয়েছে। বলল ওর ভাই নাকি দিয়েছে।”
“কোন ভাই? জিজ্ঞেস করোনি?”
“তা আর পারলাম কোথায়? ফুলটা দিয়েই তো দৌঁড় দিয়েছে।”
“কোন পাগলের আমদানি হলো আবার!”
নিহি সোফায় বসে বলে,
“জানি না ভাবি। একজন উড়োচিঠি পাঠিয়ে আমায় চিন্তায় ফেলছে। এখন আবার আরেকজন ফুল পাঠিয়ে! আমি বুঝি এবার সত্যি সত্যিই ডিপ্রেশনে চলে যাব।”
তমা নিহির পাশে বসে। নিহির কাঁধে হাত রেখে বলে,
“আচ্ছা নিহি, এই উড়োচিঠি আর ফুলের মালিক একজনই নয় তো?”
নিহি উত্তেজনা নিয়ে নড়েচড়ে বসে। বলে,
“জানিনা তো! দাঁড়াও চিঠিটা নিয়ে আসি।”
নিহি ঘরে গিয়ে খামটা হাতে নেয়। আজও আকাশী রঙের খামে শুভ্র চিঠি। একই হাতের লেখা। চিঠির শুরুতেই লেখা,
‘এলোকেশী,
এত সকালে বিরক্ত করার ইচ্ছে হয়নি। কিন্তু কী করব বলো? আজ খুব ইচ্ছে হলো তোমায় সকালের উইশ করতে। তাই তো এত সকালে পিওনকে ঘুষ দিয়ে পাঠিয়েছি। তুমি আবার ভেবো না, আমি ঘুষের কথা বলে টাকার জোর দেখিয়েছি। আমি শুধু বোঝাতে চাচ্ছি, তোমার প্রতি আমার আগ্রহটা। তুমি কিন্তু ভুল বুঝো না আমায়!
এই এলোকেশী,
ওমন কপাল ভাঁজ করে চিঠি পড়ো কেন? মুচকি মুচকি হেসে চিঠি পড়তে পারো না? অবশ্য, তুমি তো এখনো জানোই না আমি কে! জানলে কি হাসবে? আচ্ছা শোনো, আমার না একটা ইচ্ছে আছে। জানো কী সেই ইচ্ছে? তুমি হয়তো ভাবছ আর বলছ, ‘আরে উল্লুক, না বললে জানব কী করে?’ আসলেই তো! না বললে জানবে কী করে? এই দেখো, নিজেকে উল্লুক বলায় তুমি কিন্তু হেসেছ। কী হেসেছ তো? বিশ্বাস না হলে আয়নার সামনে দাঁড়িয়েই দেখো। আচ্ছা সে না হয় পরে তুমি প্রমাণ করে নিও। উল্লুক বললাম বলে আবার ভেবো না আমি সত্যিই উল্লুক! মেয়েরা তো এসব বকাই বেশি দেয়। তাই আমি তোমার হয়ে বলে দিলাম। আচ্ছা এবার ইচ্ছের কথাটা শোনো। আমার ইচ্ছে, একদিন তোমার ঘুমন্ত মায়াময় মুখটা দেবো। তোমার এলোকেশ যখন মুখের ওপর ছড়িয়ে পড়ে তোমায় বিরক্ত করবে, তখন আমি যত্ন করে চুলগুলো সরিয়ে দেবো। তোমাকে একদম টের পেতে দেবো না। খুব বেশি কিছুই কি চেয়েছি এলোকেশী?
এলোকেশী,
তুমি সুন্দর। ভীষণ সুন্দর তুমি। আমার চোখে দেখা একমাত্র সুন্দর তুমি। তুমি পরীর জগতের কোনো অপ্সরী নও। তুমি আমার হৃদয়ের অপ্সরী। যাকে একটা পলক দেখলেই আমার হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়। যাকে নিয়ে আমার ভয় হয় ভীষণ। হ্যাঁ, আমার একমাত্র ভীতি তোমায় নিয়ে। আমার ভয় হয়, তোমার ওপর যেন কারো নজর না পড়ে। এই শোনো, তুমি চোখে কাজল দেবে। এই, কাজল দিতে বললাম বলে আবার ভেবো না কাজল তোমার ওপর সকল নজর দূর করতে সাহায্য করবে। কাজল কখনো কাউকে কোনো বদ নজর থেকে দূরে রাখতে পারে না। কারো ভালো বলো অথবা মন্দ এসবকিছু একমাত্র আল্লাহ্-র হাতে। আমি জানি তুমি নামাজ পড়ো। কমবেশি এসব তুমি জানো। তবুও আমি বলে দিলাম। আর কাজল দিতে বললাম এ কারণেই, যাতে তোমার ডাগর চোখে কাজল ঠিক সূর্যের ন্যায় দীপ্তি ছড়ায়। এই তুমি হবে আমার ডাগরিনী এলোকেশী?
এই যা! এতকিছু বললাম, আর যেটার জন্য এত বড় রচনা লেখা সেটাই বলা হয়নি।
শুভ সকাল এলোকেশী”
চিঠিটা পড়ে দম নেয় নিহি। একটা মানুষ কী করে এত সুন্দর চিঠি লিখতে পারে? এত সাজিয়ে-গুছিয়ে! প্রতিটা লাইন যেকোনো মেয়ের মন কাড়তে বাধ্য। কিন্তু বারবার মনে প্রশ্ন জাগে একটাই। কে এই লোক?
নিহি চিঠিটা নিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ায়। প্রথম থেকে আবারও চিঠিটা পড়তে শুরু করে। পড়তে পড়তেই হুট করে আয়নার দিকে তাকায় দেখার জন্য যে, আসলেই কপালে ভাঁজ পড়ে নাকি। নিহি বিস্মিত! আসলেই কপালে ভাঁজ পড়ে রয়েছে। জানলো কীভাবে সে? প্রশ্ন করা বাদ দিয়ে নিহি আবারও পড়া শুরু করে। ‘আরে উল্লুক, না বললে জানব কী করে?’ এই লাইনটা পড়ে আবার আয়নার দিকে তাকায়। কী অদ্ভুত! নিহির ঠোঁটে মুচকি হাসি। এবার নিহি আনমনেই হেসে ফেলে শব্দ করে।
তমা নিহির রুমে এসে দেখে নিহি হাসছে। জিজ্ঞেস করে,
“ভূতে ধরল নাকি? হাসছ কেন?”
নিহি উত্তর দেয় না। হেসেই চলেছে। ভাবি আবার জিজ্ঞেস করে,
“আরে হলো কী? সেই যে চিঠি আনতে এলে। আর তো গেলে না।”
নিহি চিঠিটা ভাবির হাতে দিয়ে হাসতে হাসতে বলে,
“পড়ো।”
তমা খাটের ওপর বসে চিঠি পড়তে শুরু করে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে মনোযোগ দিয়ে প্রতিটি লাইন পড়ছে। ঐ কাঙ্ক্ষিত লাইনটি পড়ে ভাবি নিজেও হাসে। চিঠি পড়া শেষ হলে নিহি জিজ্ঞেস করে,
“কী বুঝলে?”
“বুঝলাম তো অনেক কিছুই। শুধু এটাই বুঝলাম না চিঠির এই মালিক কে!”
নিহি দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলে,
“আমায় আর কেউ ডিপ্রেশন থেকে বাঁচাতে পারবে না ভাবি।”
তমা দৃঢ়তা নিয়ে বলে,
“তবে যাই বলো নিহি, এই চিঠির জন্যই কিন্তু তুমি অনলের কথা চিন্তা করার সময় পাচ্ছ না। অনলকে নিয়ে ভাবার সময়টা দখল করে নিয়েছে এই চিঠির মালিক। অনলের কথা ভাবার চেয়ে চিঠির মালিককে নিয়ে ভাবা অনেক বেশিই ভালো। কারণ, অনলকে নিয়ে ভাবলেই তুমি শুধু কষ্ট পাবে। আগের কথা মনে পড়বে। আর অন্যদিকে, চিঠির মালিককে নিয়ে ভাবলে হয়তো অস্থিরতা বাড়বে। জানতে ইচ্ছে হবে কে সে! তবে কষ্ট তুমি পাবে না। তবে একটা কথাই বলব, যেকোন পদক্ষেপ নেওয়ার আগে নিজেকে সময় দেবে। ভাববে তারপর সিদ্ধান্ত নেবে।”
নিহি এবার দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,
“হুম!”
.
নিহি রেডি হয়ে কলেজে আসে। সঙ্গে নিয়ে আসে ঐ চিঠি দুটো উপমাকে দেখানোর জন্য। রিক্সায় বসেই উপমা চিঠি দুটো পড়েছে। তবে নিহি আর তমার মতো উপমাও বুঝতে সক্ষম হয়নি কে এই লোক? নিহি হতাশ মানুষটিকে চিনতে না পারার জন্য। উপমা বলে,
“আচ্ছা নিহি একটা কথা বল তো, এর আগে তুই কোনো চিঠি পেয়েছিস?”
“সে তো কত চিঠিই পেয়েছি স্কুল লাইফে। কিন্তু এরকম নামহীন উড়োচিঠি তো পাইনি।”
“এটা অনল নয় তো?”
“ধুর যা! কী বলিস?”
“ওমন করিস না বেদ্দপ! হতেও তো পারে। নয়তো তুই-ই বল, এতদিন কেন এই উড়োচিঠি আসেনি? যেই অনলের সঙ্গে তোর ঝামেলা শুরু হলো সেই তারপরই চিঠি আসা শুরু করল।”
“উপমা! অনলের সঙ্গে চিঠির কোনো সম্পর্ক কী করে থাকতে পারে? তার সঙ্গে আমার ঝামেলার কিন্তু অনেকদিন কেটে গেছে অলরেডি।”
“হতে পারে সে তার ভুল বুঝতে পেরেছে। কিন্তু তোর সামনে দাঁড়ানোর মতো মুখ তার নেই। এজন্যই নামহীন চিঠি পাঠাচ্ছে। হতে পারে না এমন?”
নিহি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ভেবে বলে,
“পারে। কিন্তু…”
“কোনো কিন্তু নয়। খবরদার এই চিঠি নিয়ে আর মাথা ঘামাবি না। তার ফাঁদে ভুলেও আর পা দিবি না। হতেই পারে তোর ঘুরে দাঁড়ানোটা তাকে পীড়া দিচ্ছে। এজন্য সে তোকে আবার ভেঙে গুড়িয়ে দিতে চাচ্ছে। তুই কিন্তু তাকে কোনো সুযোগ দিবি না।”
“রিল্যাক্স! উপমা শান্ত হ।”
“চুপ কর। কীসের শান্ত হব? আমি তো পারলে তাকে খুন-ই করে ফেলি।”
“হয়েছে। খুন-খারাবি করতে হবে না। কলেজে এসে পড়েছি। রিক্সা থেকে নাম।”
উপমা রিক্সা থেকে নামতে নামতেও একই কথা বলছে। নিহি চিঠি দুটো ব্যাগে ভরে ভাড়া মিটিয়ে দেয়। দুজনে হাঁটছে একসঙ্গে। কথা হচ্ছে সেই চিঠির মালিককে নিয়ে। কলেজে যাওয়ার পথে অনলের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। এতক্ষণ চিঠি নিয়ে ভাবলেও অনলকে দেখে নিহির অস্থিরতা শুরু হয়ে যায়। যত যাই হোক, মনের এক কোণে এখনো অনলের জন্য সুপ্ত ভালোবাসা রয়েছে। যা কখনোই নিহি অনলকে বলতে পারবে না। শুধু অনলই বা বলছি কেন? অন্য কাউকে বলার সাহসও করে উঠতে পারবে না। এই সুপ্ত ভালোবাসা অনন্তজীবন আড়ালে-আবডালেই বোধ হয় থেকে যাবে। থাক! সব ভালোবাসা প্রকাশ করতে নেই। সবাই ভালোবাসার যোগ্য সম্মান দিতে পারে না। সবাই ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্যও নয়। যেতে যেতে অনলের সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে যায় নিহির। দ্রুত নিহি অনলের থেকে চোখ সরিয়ে নেয়। উপমার হাত ধরে জোরে জোরে পা চালিয়ে কলেজে চলে যায়। এভাবে আর থাকা যায় না। কবে সাতদিন পূরণ হবে? আর কবে মুক্তি পাবে নিহি এই যন্ত্রণা থেকে? আদৌ হবে তো মুক্তি?
_______________________
দু’দিন কেটে গেছে নিহি আর কোনো উড়োচিঠি পায়নি। এ নিয়ে কোনো মাথাব্যথাও নেই নিহির। তাছাড়া নিহি এখন বরাবর-ই এসব থেকে দূরে থাকতে চায়। সব কল্পনা-জল্পনা জুড়ে শুধু পড়াশোনাকেই রাখতে চায়। বাবার মনে একটু হলেও যেন নিহির জন্য মায়া হয়। একটাবারের জন্য হলেও যেন বাবা ক্ষমা করে দেয়। সাতদিন পূরণ হতে আর মাত্র দু’দিন বাকি আছে। এরপরই অনলের মায়া থেকেও মুক্তি মিলে যাবে।চোখে দেখার মায়া-ই বড় মায়া। চোখের আড়াল হলেই মায়া ছায়ায় মিলিয়ে যায়। নিহিরও সময় এসে পড়েছে চোখে দেখার আড়াল হওয়ার।
আজ শুক্রবার। কলেজ বন্ধ। বাবা বাজারে যাবেন আজও। নিহি মাথা নত করে বলে,
“আব্বু আমিও যাব তোমার সঙ্গে।”
তিনি কোনো উত্তর দেননি। নিঃশব্দে একাই বাজারে চলে গেছেন। এটা আজ নতুন নয়। সেদিনের পর থেকে বাবা আর কখনোই নিহির সঙ্গে কথা বলেনি। নিহির কষ্ট হয়। খুব কষ্ট হয়। তবুও নিহিকে সব মেনে নিতে হয়। না, না মেনে নয় বরং মানিয়ে নিতে হয়। নিহি ছাদে যায়। খালি পায়ে ঠান্ডা ফ্লোরে কিছুক্ষণ হাঁটে। ঠান্ডা লাগলেও ভালো লাগছে। গাছগুলোর পাতায় হাত ছুঁয়ে দেয়। হাতে লেগে যায় কয়েক ফোঁটা শিশিরের ছোঁয়া। নিহি ছাদের রেলিং ধরে দাঁড়ায়। নিচে দাঁড়িয়ে থাকা সেই ছেলেটিকে দেখতে পায়। আজও গায়ে লাল সুয়েটার। মজার ব্যাপার হলো এই সুয়েটারের জন্যই নিহি ছেলেটাকে চিনতে পেরেছে। ছেলেটা নিহির রুমের ব্যলকোনির দিকে তাকিয়ে আছে। হয়তো নিহির দেখা পাওয়ার জন্যই অপেক্ষা করছে। নিহি ছাদ থেকেই ছেলেটাকে ডাকে,
“এই।”
ছাদের দিকে তাকিয়ে ছেলেটা কপালে হাত দিয়ে কী যেন বলে। নিহি শুনতে পায় না কিন্তু বুঝতে পারে। হয়তো অপেক্ষার জন্য আক্ষেপ করেই কপালে হাত রেখেছে। তবে যাই হোক, আজ তো এই ইঁচড়েপাকা ছেলেকে ধরতেই হবে। এই উড়োচিঠির মালিক কে তা আজ জানবই জানব! আজই চিঠির চ্যাপ্টার ক্লোজ করব। ইট’স ফাইনাল!
নিহি দ্রুত পায়ে ছাদ থেকে নামে। দৌঁড়ে দৌঁড়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে নিচে এসে দেখে ছেলেটা নেই। যাহ্, বাবা! এর মাঝেই চলে গেল? এসেছিল কেন তাহলে? নিহি মন খারাপ করে চলে যাওয়ার সময় মেইন দরজার সামনে একটা খাম দেখতে পায়। তখন দৌঁড় দেওয়ার কারণে একদম খেয়াল করেনি। উৎসুক হয়ে খাম থেকে চিঠি বের করে নিহি পড়তে শুরু করে,
“এলোকেশী,
তুমি নিশ্চয়ই জানতে চাও আমি কে? আচ্ছা, জানার পর কী করবে তুমি? আজ বেশ কিছু বলব না। শুধু গানের কয়েকটা লাইন তোমায় বলতে চাই।
‘যদি গো তোমায় বলি
আমি তার নাম;
তুমি কি বাসবে ভালো,
দেবে তার দাম?’
শুভ সকাল এলোকেশী।”
চলবে…
#আড়ালে_আবডালে
#পর্ব_১৫
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
____________________
সকালের মৃদু রোদে মাঠে ঘাসের ওপর বসে আছে নিহি, উপমা আর দীপ্ত। তিনজনের হাতেই বই। রোদের মধ্যে বসে পড়ার মাঝে অন্য রকম আনন্দ রয়েছে। কিছু দূরত্বে আরো অনেকেই গোল হয়ে বসে আছে। কেউ বা আড্ডা দিচ্ছে আবার কেউ কেউ ওদের মতোই পড়ছে। কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে বসে আছে সাকিব, মিলন, সুমাইয়া আর লিসা। অনল আজকে এখনো আসেনি। বই পড়ার মাঝেই হুট করে উপমার চোখ গেল সামনের দিকে। অনল বাইকে করে আসছে। পেছনে একটি মেয়ে রয়েছে। মেয়েটির এক হাত অনলের গায়ের জ্যাকেট শক্ত ধরে রেখেছে। উপমা নিহিকে ইশারায় পিছনে তাকাতে বলে। নিহি উপমার দৃষ্টি অনুসরণ করে পিছনে তাকিয়ে দেখে অনল বাইকে করে একটি মেয়েকে নিয়ে এসেছে। বাইক এনে থামায় কৃষ্ণচূড়া গাছটির নিচে। নিহিদের মতো অনলের বন্ধুদের অবস্থাও এক। ওদের সবার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে, কেউই এমনটা আশা করেনি। কারণ অনল বাইকের পেছনে নিহি ব্যতীত আর কোনো মেয়েকে বসায়নি। নিহিকে তো বসিয়েছিল অভিনয়ে সফল হওয়ার জন্য। কিন্তু এই মেয়ে কে? নিহির বুকের ভেতর মোচর দিয়ে ওঠে। অজানা কষ্টগুলো বুকের ভেতর হাতুড়ী পেটাচ্ছে। অজানাই বা কেন বলছি? কষ্টগুলো কি সত্যিই অজানা?
নিহি দ্রুত চোখ সরিয়ে নেয়। পড়ায় মনোযোগ দেওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু মন তো আর পড়ায় বসছে না। ব্যথিত মন চোখকে বাধ্য করছে অশ্রু ঝড়াতে। কিন্তু নিহি মোটেও চাইছে না দুর্বল হতে। উপমা কড়া গলায় বলে,
“দেখেছিস নিহি? বেয়াদবটার পেটে কত শয়তানি? মানুষকে দেখে আসলেই কখনো বুঝা যায় না সে কেমন। প্রথম প্রথম ভালো মানুষী দেখায়। আর পরে শয়তানগুলোর আসল চেহারা বের হয়। অসভ্য একটা!”
নিহির মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হচ্ছে না। তবুও জোর করে বলে,
“আহা! চুপ কর।”
নিহির ধমকে উপমা দমে যায় না। উল্টো রাগ দেখিয়ে বলে,
“সবসময়ই তুই আমায় চুপ করতে বলিস কেন? এটা কি চুপ থাকার মতো কোনো সিচুয়েশন? তোর সাথে এতকিছু করার পরও মনে একটু হলেও তার জন্য আমার রেস্পেক্ট ছিল। কারণ আমার ধারণা ছিল, সে একদিন ঠিকই তার ভুল বুঝতে পারবে। কিন্তু ভুল বুঝবে আর কী? নতুন গার্লফ্রেন্ড জুটিয়েছে। আবার শো অফ করার জন্য ঢ্যাঙ ঢ্যাঙ করতে কলেজেও নিয়ে এসেছে।”
“তোর সমস্যা কী বুঝি না আমি।” বই বন্ধ করে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলে নিহি। ক্লাসে যাওয়ার জন্য উদ্যত হতেই উপমা পেছন পেছন এসে বলে,
“তুই কি আমার ওপর রাগ করলি?”
নিহি কিছু বলে না। নিশ্চুপ হয়ে সিঁড়ি ভেঙে ওপরে ওঠে। একেকটা সিঁড়ি যেন একেকটা পাহাড় মনে হচ্ছে। চোখ ছাপিয়ে পানি আসছে। অনেক কষ্টে এদিক-ওদিক তাকিয়ে পানিগুলো আটকানোর চেষ্টা করছে। ঠোঁট কামড়ে ধরে মনে মনে বলে,
“কী করে বলব তোকে, তোর ওপর রাগ হয়নি আমার! বরং ওখানে আমি বসে থাকতে পারছিলাম না। না তাকিয়েও যেন আমি বুঝতে পারছিলাম, ওরা হেসে হেসে কথা বলছে। মানুষটা আর কতভাবে কষ্ট দেবে?”
বইটা দীপ্তর হাতে দিয়ে নিহি ওয়াশরুমে চলে যায়। দরজা আটকে দিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ায়। চোখ দুটো লাল হয়ে আছে। নাকও লাল হয়ে আছে। নিহি হাসার চেষ্টা করে। হাসি আসছে না। বরং বুকচিরে বেরিয়ে আসছে লুকিয়ে রাখা আর্তনাদ। পানির ট্যাপ ছেড়ে দিয়ে নিহি শব্দ করে কাঁদে। এত কষ্ট আর সহ্য করা যায় না। সবকিছুরই তো একটা সীমা রয়েছে। সীমা যখন লঙ্ঘন হয়ে যায় তখন কী করে মানুষ? সুইসাইড? সুইসাইড কি কোনো সমাধান হতে পারে কখনো? একটা মানুষ কেন জীবনের সবটা জুড়ে থাকবে? যেখানে এত এত মানুষ আমায় ভালোবাসে সেখানে কেন ঐ একটা মানুষকে ঘিরেই আমার সব অনুভূতি? কেন ঐ একটা মানুষের জন্যই আমার এত কষ্ট হবে! কেন ঐ একটা মানুষের জন্য আমি ঠিকমতো খেতে পারি না, পড়তে পারি না, ঘুমাতে পারি না! কেন ঐ একটা মানুষের জন্যই আমার ঘুম হারাম হয়ে যাবে? কেন ঐ একটা মানুষের জন্যই আমায় ভালো না থেকেও ভালো থাকার অভিনয় করতে হবে?কেন? কেন? কেন?
মুখ দু’হাতে ঢেকে নিহি দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়ায়। চিৎকার করে কান্না করায় গলা শুকিয়ে গেছে। দম আটকে আসছে কেমন। নিহি অশ্রুশিক্ত চোখে ওপরের দিকে তাকিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলে,
“কবে আল্লাহ্ কবে? কবে আমি মুক্তি পাব এই কষ্ট থেকে? আমি যে আর সইতে পারছি না!”
দরজায় নক করার শব্দ হচ্ছে। উপমা দরজা ধাক্কাতে ধাক্কাতে বলে,
“নিহি? এই নিহি? এতক্ষণ ওয়াশরুমে কী করছিস তুই? বের হ তাড়াতাড়ি।”
নিহি কোনো উত্তর করে না। চোখের পানি মুছে নিয়ে চোখে-মুখে পানির ঝাপটা দেয় ইচ্ছেমতো। চোখ, নাক লাল টকটকে হয়ে আছে। ফ্রেশ হয়ে ওয়াশরুম থেকে বের হতেই উপমা আৎকে উঠে বলে,
“একী! তোর চোখমুখ এত লাল কেন? আবার কেঁদেছিস ঐ ফাজিলটার জন্য?”
“তুই বড্ড বেশিই প্রশ্ন করিস উপমা।”
নিহি ক্লাসে গিয়ে বসে। ব্যাগ থেকে টিস্যু বের করে মুখটা মুছে নেয়। ক্লাসের পুরোটা সময় নিহি চুপচাপ ছিল। কোনো কথা বলেনি। টিচাররা যা লিখতে দিয়েছে, লিখে উপমাকে দিয়ে খাতা জমা দিয়েছে। মুখে পড়া ধরেনি কেউ। চোখমুখ লাল দেখে কী হয়েছে জানতে চাইলে নিহি বলেছে, ঠান্ডা লেগেছে। শীতের মধ্যে ঠান্ডা লাগাটা অস্বাভাবিকও কিছু না। তাই স্যার-ম্যামও নিহির কথা বিশ্বাস করেছে। নিহিকে ছুটি নিয়ে বাড়িতেও চলে যেতে বলেছিল। নিহি যায়নি। বাড়িতে গেলেই নিহি আরো ভেঙে পড়বে। যতটা সময় কলেজে কাটিয়ে যাবে ততটা সময়ই বাসায় কম পাবে। একটু পর পর ব্যাগের ওপর মাথা রেখে নিশ্চুপ কেঁদেছে। উপমার কোনো কথাই শুনেনি। শুনবে কী করে? কান্না কি আর কারো কথায় মানে? বরং কাঁদতে বারণ করলে আরো বেশি করে কান্না পায়।
.
কলেজ ছুটির পর বাড়িতে যাওয়ার সময় নিহিকে ডাকে অনল। অনলের ডাকে নিহি থেমে যায়। পিছনে ফিরে তাকায়। অনলের সঙ্গে মেয়েটি এখনো আছে। মেয়েটিকে নিয়ে অনল এগিয়ে যায়। নিহিকে জিজ্ঞেস করে,
“কেমন আছো?”
নিহি নিশ্চুপ। অনল বলে,
“ওহ আচ্ছা, কথা বলবে না?”
এরপর মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বলে,
“ইরা, ও হলো নিহি। যার কথা এতক্ষণ আমার বন্ধুরা তোমায় বলছিল।”
ইরা হেসে বলে,
“ওহ, তুমিই তাহলে সেই বোকা মেয়ে?”
ইরার সঙ্গে হাসিতে যোগ দেয় অনলও। নিহি এতক্ষণ নিচের দিকে তাকিয়ে ছিল। ইরার কথা শুনে মুখের দিকে তাকায়। চোখ দুটো কেমন ছলছল করছে। ইরা বলে,
“তোমার চোখ দুটো এমন ভেজা ভেজা কেন গো? কেঁদেছ বুঝি? কেঁদেও লাভ নেই। অনল আমার। এটাই তোমায় মেনে নিতে হবে। আমাদের কেমন মানিয়েছে সেটা তো বলো?”
ভেজা নয়নে তাকিয়ে তাচ্ছিল্য করে হেসে নিহি বলে,
“দারুণ মানিয়েছে আপনাদের। কী বলুন তো, যে যেমন আল্লাহ্ তার জন্য তেমন কাউকেই তৈরি করেন। সেক্ষেত্রে আপনারা দুজনই এক। আল্লাহ্ তো আমায় বাঁচিয়ে দিয়েছে এমন একজন প্রতারকের হাত থেকে। এখন মনে হচ্ছে, নিশ্চয়ই আমি বা আমার মা এমন কোনো পূণ্য করেছিল যার ফল আমি এখন পাচ্ছি। বেঁচে গেছি উনার হাত থেকে। এনিওয়ে, সময় হলে আমার সঠিক মানুষটিও নিশ্চয়ই আমার কাছে চলে আসবে। শুভকামনা আপনাদের জন্য।”
উল্টোপথে হাঁটা ধরে আরো কয়েক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে নিহির গাল বেয়ে। লোকচক্ষুর আড়ালে আলতো করে চোখের পানিটুকু মুছে নেয় নিহি। রিক্সায় করে নিহিকে বাড়ির সামনে নামিয়ে দিয়ে উপমা নিজের বাড়িতে চলে যায়।
বাড়িতে গিয়ে আগে ফ্রেশ হয়ে নেয়। এরপর চুপচাপ বিছানার মধ্যে গুটিসুটি হয়ে শুয়ে থাকে। সালেহা বেগম নিহির ঘরে এসে বলেন,
“কীরে না খেয়ে শুয়ে পড়লি যে?”
“পেট ভরা আছে আমার। পরে খাব। ভাবি কোথায়?”
“তমা নীলমকে নিয়ে হাসপাতালে গেছে।”
নিহি শোয়া থেকে উঠে বসে। ভীতিস্বরে বলে,
“কেন? কী হয়েছে?”
“তমার বাবার অবস্থা ভালো নয়। আইসিইউতে আছে। নীলমকে দিয়ে তমাকে পাঠিয়ে দিয়েছি। তোর জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। এখন আমি আর তোর বাবা-ও যাব।”
“আমিও যাব মা।”
“না। তুই বাড়িতে থাক। তিতিরের শরীরটা ভালো নয়। অন্যদিকে তমার অবস্থাও ভালো না। তিতিরকে নিয়ে হাসপাতালে গেলে নিজেকেই সামলাবে নাকি তিতিরকে? তাই তিতিরকে রেখে দিয়েছি। নিলুফা বাসায় থাকবে। তুই তিতিরের সাথে থাকিস। দরজা আটকে রাখবি। তেমন কিছু হলে আমি ফোন দিয়ে জানাব।”
“আচ্ছা। তিতির কোথায়?”
“তোর বাবার কাছে। ঘুমিয়ে আছে।”
“যাওয়ার সময় আমার কাছে দিয়ে যেও।”
“এখনই বের হব।”
সালেহা বেগম ঘরে গিয়ে তিতিরকে নিয়ে আসে। নিহি তিতিরকে কোলে নিয়ে নিজের বিছানায় শুইয়ে দেয়। কপালে আলতো করে চুমু খায়। সালেহা বেগম যাওয়ার আগে নিলুফাকে ভালো করে বলে গেছেন সাথে সাথে থাকতে। নিহিকেও সাবধানে থাকতে বলেছেন। নিলুফা ওদের বাড়িতে কাজ করে। বয়স ২১/২২ হবে। নিজাম ইসলাম আর সালেহা বেগম যাওয়ার পর নিহি মেইন দরজা লক করে দেয়। নিলুফা নিহির থেকে বয়সে বড় বলে আপা বলেই ডাকে নিহি। ওদের বাড়িতে কাজ নিয়েছে বেশিদিন হয়নি। মাস দুয়েক হবে। প্রচণ্ড লাজুক আর সবাইকে ভয় পায়। নিহির খুব ভালো লাগে নিলুফাকে। ঘরে এসে দেখে নিলুফা দাঁড়িয়ে আছে। নিহি জিজ্ঞেস করে,
“দাঁড়িয়ে আছো কেন আপা? বসো।”
নিলুফা মাথা নাড়িয়ে বলে,
“না। সমস্যা নাই।”
নিহি হাত ধরে টেনে নিলুফাকে বিছানায় বসিয়ে দেয়। নিলুফা কাচুমুচু হয়ে বসে যেন সামনে অপরিচিত কোনো ছেলে বসে আছে। ভাঙা মন নিয়েই নিহি শব্দ করে হাসে। জিজ্ঞেস করে,
“এমন করছ কেন? আমি কি তোমায় খেয়ে ফেলব?”
নিলুফা হাসার চেষ্টা করে। কিন্তু কিছু বলে না। নিহি জিজ্ঞেস করে,
“আচ্ছা আপা, আমাকে তোমার কেমন লাগে?”
“ভালো।” নিলুফার সহজ ও ছোট্ট উত্তর।
নিহি নিলুফার কিছুটা কাছে এগিয়ে বসে। কাঁধ ধরে নিজের মুখোমুখি করে বলে,
“আমার দিকে তাকাও। সহজ হও। এমন আড়ষ্ট হয়ে থাকার কিছু নেই। তাকাও আমার দিকে।”
নিলুফা তাকায়। আবার মাথা নিচু করে ফেলে। বলে,
“আপনের দিকে তাকাইতে আমার ভয় করে আপা।”
নিহি অবাক হয়ে বলে,
“কেন?”
“আপনে মেলা সুন্দর।”
“তাতে ভয় পাওয়ার কী আছে?”
“জানিনা।”
“আচ্ছা জানতে হবে না। চলো গল্প করি। করবে আমার সঙ্গে গল্প?”
নিলুফা মাথা নাড়ায়। নিহি বলে,
“তাহলে তুমিই শুরু করো। ভাবির কাছে শুনেছি তুমি গ্রাম থেকে এসেছ। গ্রামে তোমার কে কে আছে?”
“আব্বা, মা আর ছোড বইন।”
“বোন পড়ে?”
“হুম।”
“কীসে পড়ে?”
“ফাইভে পড়ে। অনেক বুদ্ধি ওর। আর…”
“আর?”
“আর আপনের মতোই সুন্দর।”
নিহি হাসে। হেসে হেসেই বলে,
“ভালোই তো। আচ্ছা তুমি আমায় আপনি আপনি বলো কেন? আমি তো তোমার ছোট বয়সে। তুমি করে বলবে।”
“না আপা। মুখ দিয়া আসব না।”
“আসবে। চেষ্টা করলেই হবে। এরপর থেকে নাম ধরে ডাকবে আর তুমি বলবে। এখনই একবার বলো দেখি!”
“আপনে অনেক ভালো।”
নিহি মেকি রাগ দেখিয়ে বলে,
“আবার আপনি?”
নিলুফা জিহ্বা বের করে বলে,
“আর হইব না। তুমি অনেক ভালো ”
নিহি এবারও হাসে। গল্প করতে করতে নিলুফাকে আরো সহজ করে। এরপর নিজে থেকেই কতশত গল্প বলে। বাবা-মায়ের কথা, বোনের কথা, ছোটবেলার কথা, স্কুলে পড়ার সময়ের কথা সব বলে। বলতে বলতে নিলুফার চোখগুলো ছলছল করে ওঠে। নিহি মুগ্ধ হয়ে শোনে নিলুফার কথা। বাবা-মাকে ছাড়া, পরিবার ছাড়া যারা থাকে একমাত্র তারাই এই কষ্ট উপলব্ধি করতে পারে। গল্প করার মাঝেই তিতিরের ঘুম ভেঙে যায়। নিলুফা খাবার গরম করে আনে। নিহি তিতিরকে খাইয়ে দেয়। তারপর তিনজনে মিলে কার্টুন দেখে।
রাতঃ ১০টা
তিতির কার্টুন দেখতে দেখতেই সোফায় ঘুমিয়ে পড়েছে। নিহি তিতিরকে ঘরে নিয়ে যাবে বলে কোলে নিতে যায়। দেখে শরীর খুব গরম। তিতিরের ঘুম ভেঙে যায়। নিহি তাড়াতাড়ি তিতিরকে কোলে নিয়ে কপালে, গলায় হাত রাখে। নিহিকে জড়িয়ে ধরে তিতির বলে,
“মাথা ব্যথা করছে ফুপি।”
“মাথা ব্যথা করছে সোনা? ওষুধ খেলেই ঠিক হয়ে যাবে লক্ষী।” পিঠে হাত বু্লিয়ে বলে নিহি।
থার্মোমিটার দিয়ে জ্বর মেপে দেখে জ্বর ১০৩ ডিগ্রি ছাড়িয়েছে। নিহি আৎকে ওঠে। ডাক্তার দেখানোটা এখন জরুরী অনেক। নিহি নীলমকে ফোন করে। নীলম ফোন তুলছে না। উপায় না দেখে নিহি নিলুফাকে বলে,
“আপা তুমি ডাক্তারের দোকানে যেতে পারবে?”
“আমি তো এইখানকার কিছুই চিনি না।”
নিহি কিছুক্ষণ ভাবে কী করা যায়। যেভাবেই হোক ডাক্তার তো দেখাতেই হবে। উপায় না পেয়ে নিহি বলে,
“তাহলে তুমি তিতিরের কাছে থাকো। আমি গিয়ে ডাক্তার নিয়ে আসি। শোনো, দরজা ভালো করে লক করে রাখবে। আমি বা ঘরের লোকজন ছাড়া কেউ আসলে দরজা খুলবে না। তিতিরের কাছে কাছে থাকবে। আর এইযে বাড়ির ফোন। হাসপাতাল থেকে কেউ ফোন করলে কথা বলিও। আমি যাচ্ছি।”
“আচ্ছা।”
পার্স আর ফোন নিয়ে নিহি বেরিয়ে পড়ে। যাওয়ার সময় দরজা বাহির থেকেও লক করে দেয়। বাড়ি থেকে পাঁচ মিনিটের দূরত্বে একটা ডাক্তারের দোকান ছিল। সেই দোকানেই যায় নিহি। কিন্তু সেখানে গিয়ে হতাশ হতে হয় নিহিকে। দোকান বন্ধ। সাড়ে দশটার মতো বাজে। তার মধ্যে আরো শীতের সময়। দোকান-পাট সব বন্ধ। চারপাশে শুধু কুয়াশা আর কুয়াশা। এখন মেইন বাজারে যেতে হবে। অর্ধেক পথে নীলম ফোন করে। নিহি ফোন রিসিভ করে বলে,
“কয়বার ফোন দিয়েছি তোমায়?”
“একটু ব্যস্ত ছিলাম। তমার বাবার অবস্থা খুব খারাপ। ফোন দিয়েছিলি কেন?”
“তিতিরের জ্বর বেড়েছে খুব। তাই ফোন দিয়েছিলাম। তুমি তো ফোন ধরলে না। তাই আমিই বের হয়েছি ডাক্তার আনতে।”
“এত রাতে তুই একা বের হয়েছিস? এখনই বাড়িতে যা। আমি আমার বন্ধুকে ফোন দিয়ে পাঠাচ্ছি। এখনই যা। আমি ফোন রাখছি।”
“আচ্ছা।”
নিহি ফোন কেটে রিক্সাওয়ালাকে বলে,
“মামা রিক্সা ঘুরান। বাজারে যাব না।”
“আমি তো বাজারেই যামু। আমার বাড়ি বাজারেই। অন্য কুনো জায়গায় আমি যামু না এহন।”
“ভাড়া বাড়িয়ে দেবো মামা। চলেন।”
“না। ঘরে মাইয়া অসুস্থ আমার। তাড়াতাড়ি যাইতে কইছে। তাও তো দেরি কইরা ফেলছি।”
মেয়ে অসুস্থ শুনে নিহি আর কিছু বলতে পারে না। এতটা পথ একা একা কীভাবে যাবে সেটা ভেবেই ভয় লাগছে। রাস্তাঘাটও ভালো নয়। ভূতের ভয় তো নেই তবে বখাটে ছেলেদের ভয় আছে। নিহি ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে হাঁটা শুরু করে। মনে মনে দোয়া-দুরুদ পড়ছে আর মনে মনে বলছে পরিচিত কারো সঙ্গে যেন দেখা হয়ে যায়। তিন রাস্তার মোড়ে এসে নিহির কলিজা কেঁপে উঠে। মানুষ নেই তেমন। কিছুক্ষণ পর পর ঝড়ের গতিতে ট্রাক যাচ্ছে। আর কয়েকজন রিক্সায় করে যাচ্ছে। নিহি খালি রিক্সা খুঁজছে। কপাল খারাপ হলে যা হয় আরকি! নিহির থেকে কিছুটা দূরে কয়েকটা ছেলে বসে আছে। দেখে মনে হচ্ছে তাস খেলছে। নিহির কেন জানি খুব ভয় করছে ওদের দেখে। ডান পাশের রাস্তা থেকে আমানকে হেঁটে আসতে দেখে নিহি। আল্লাহ্ বোধ হয় নিহির মনের কথা শুনেছে। মনে মনে অসংখ্য ধন্যবাদ দেয় নিহি আল্লাহ্কে। আমান ফোন চাপতে চাপতে হাঁটছে। নিহি দৌঁড়ে গিয়ে আমানের সামনে দাঁড়িয়ে বলে,
“হাই!”
আমান চমকে তাকায়। বলে,
“আরে আপনি?”
“হু। খুব বিপদে পড়েছি। একটু সাহায্য করতেন যদি?”
আমান কিছু বলার আগেই বসে থাকা ঐ ছেলেগুলো ওদের ঘিরে ধরে। ওদের মধ্যে একজন কাকে যেন ফোন করে আসতে বলে। সবাইকে দেখে নিহি ভয় পেয়ে যায়। আমান ওদের বলে,
“কী সমস্যা ভাই? এভাবে ঘিরে আছেন কেন?”
“বুঝোস না কী সমস্যা? এত রাইতে মাইয়া মানুষের লগে কী?”
আরেকজনকে উদ্দেশ্য করে বলে,
“ঐ ধর দুইটারে। ক্লাবে নিয়া চল।”
“আশ্চর্য! ক্লাবে কেন যাব আমরা?” বলে আমান।
আমানের কথা শুনে একজন আমানকে মারতে গেলে নিহি বলে,
“আপনারা উনাকে মারছেন কেন?”
সবাই হাসে নিহির কথা শুনে। জোর-জবরদস্তি করে দুজনকে বাজারের ক্লাবে নিয়ে যায়। ক্লাবে ওরা ছেলেপেলেরা আছে। আরো কয়েকজন মুরুব্বিও এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করে,
“কী হয়েছে আবার?”
ওদের মধ্য থেকে একজন বলে,
“রাইতের বেলা মাইয়া মানুষরের লগে কী করে বুঝেন না কাকা?”
নিহির গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে এমন বিচ্ছিরি কথা শুনে। কান্না চলে আসে তখনই। ওরা ওদের মাঝে কথা বলছে। সিদ্ধান্ত নেয় দুজনকে বিয়ে পড়িয়ে দেবে। মুরুব্বি একজন বলে,
“কাজীরে ফোন দাও। বিয়া পড়াই দেই।”
নিহি এবার কেঁদে ফেলে। কাঁদতে কাঁদতে বলে,
“আপনারা যা ভাবছেন তার কিছুই নেই আমাদের মধ্যে। বিশ্বাস করুন।”
কেউই নিহি বা আমানের কথা বিশ্বাস করে না। আমান অনেক চেষ্টা করেও কাউকে বুঝাতে সক্ষম হয় না। নিহি কী করবে বুঝতে পারছে না। এই মুহূর্তে মাথা কাজও করছে না। ফোন দিয়ে কারো সঙ্গে কথা তো নিশ্চয়ই বলতে দেবে না!
ক্লাবে দুজনকে বসিয়ে রাখা হয়েছে। আমানকে বিভিন্ন প্রশ্ন করছে মুরুব্বিরা। কোথায় থাকে, কী করে ইত্যাদি। নিহি কাঁদছে তখনো। সকলের চোখের আড়ালে পার্স থেকে ফোন বের করে নীলমকে টেক্সট করে,
“ভাইয়া হেল্প মি!”
এতটুকু লিখেই সেন্ড করে। ফোন সাইলেন্ট করে রাখে যেন ফোন আসলে কেউ বুঝতে না পারে। সঙ্গে সঙ্গে নীলম ফোন করে। নিহি রিসিভ করে রেখে দেয়। ওপাশ থেকে নীলম হ্যালো হ্যালো করছে। নিহি কল কেটে দিয়ে বাজারে এই ক্লাবের ঠিকানা ম্যাসেজ করে।
.
.
হাসপাতালের কোরিডরে দাঁড়িয়ে বারবার নিহিকে ফোন করছে নীলম। রিং হচ্ছে। কিন্তু নিহি ফোন তুলছে। এদিকে নীলমের খুব ভয় হচ্ছে। নিশ্চয়ই নিহির কোনো বিপদ হয়েছে। ম্যাসেজে ঠিকানা পেয়ে নীলম নিজাম ইসলামের কাছে গিয়ে বলে,
“আব্বু আমি আসছি।”
“এত রাতে কোথায় যাস তুই?”
“নিহির কোনো বিপদ হয়েছে মনে হচ্ছে। তুমি মাকে কিছু বলো না। আমি যাচ্ছি।”
নিহির বিপদের কথা শুনে নিজাম ইসলাম আৎকে উঠেন। যতই মেয়ের ওপর রাগ করে থাকুক না কেন, মেয়ের বিপদের কথা শুনে তো আর ঠিক থাকা যায় না। তিনি বলেন,
“কোথায় যাবি? আমিও যাব তোর সঙ্গে।”
“নিহি একটা এড্রেস টেক্সট করেছে।”
“চল তাড়াতাড়ি।”
সালেহা বেগমকে তমার কাছে রেখে দুজনে চলে আসে। নিহির যে বিপদ হয়েছে এসব কিছু আগেই জানায় না। মায়ের মন বলে কথা! নীলমের বাইক আছে। বাবা, ছেলে বাইকে করেই যায়। পথও যেন আজ ফুরাতে চাচ্ছে না। অনেক প্রতিক্ষার সময় পার করে যখন ক্লাবের সামনে পৌঁছায় ততক্ষণে দুজনের বিয়ে হয়ে গেছে। আমানের থেকে সাত হাজার টাকা নিয়েছে ওরা। আমান আড়ালে ওদের বলেছেও টাকাটা আমান দিয়ে দেবে। তবুও এভাবে বিয়ে যেন না করায়। ওরা আমানের কোনো কথা শুনেনি। উল্টো মারতে গিয়েছে।
নীলম আগে এসে ক্লাবে ঢোকে। নীলমকে দেখে নিহি দৌঁড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে। নীলম নিহিকে থামানোর চেষ্টা করে বলে,
“কী হয়েছে বোন? কাঁদছিস কেন? বল আমায়।”
নিহি কেঁদেই চলেছে। কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি উঠে গেছে নিহির। নীলমের পিছনে এসে নিজাম ইসলামও দাঁড়ান। বয়স্ক মুরুব্বি জিজ্ঞেস করেন,
“আপনারা কারা?”
“আমি নিহির ভাই। উনি আমাদের বাবা। এখানে কী হচ্ছে?” জিজ্ঞেস করে নীলম।
“ওহ আচ্ছা। আপনারাই মেয়ের গার্জিয়ান তাহলে? ভালোই করেছেন এসে। নিজ চক্ষে মেয়ের অবনতি দেখে যান। হাতেনাতে ধরেছে আপনাদের মেয়েকে এই ছেলের সাথে।”
“কী যা তা বলছেন?” ক্ষেপে বলে নীলম।
“যা তা বলতে যাব কেন? যা সত্যি তাই বলছি। সমাজের একটা নিয়ম আছে। এসব লাফাঙ্গা ছেলে-মেয়েদের জন্য তো আর সমাজের বদনাম করা যায় না। তাই দুজনরে বিয়ে দিয়ে দিছি। মাইয়া আর জামাই নিয়ে এবার বাড়িতে যান।”
সবাই কমবেশি অনেক কথা শুনায় নিহির বাবা আর ভাইকে। অপমানে নিজাম ইসলাম নুয়ে পড়েছেন। আস্তে আস্তে ক্লাব খালি হয়ে যায়। নীলম নিহিকে বাইরে নিয়ে বলে,
“আমায় সব খুলে বল তো বোন। কী হয়েছে?”
“কিচ্ছু বলতে হবে না ওর। যা বলার এবার আমি বলছি।” পেছন থেকে বলেন নিজাম ইসলাম।
তিনি নিহির সামনে দাঁড়িয়ে বলেন,
“আজ তুই সত্যিই প্রমাণ করে দিলি যে, তোর জন্মদাতা হয়ে আমি জীবনে সবচেয়ে বড় ভুল করেছি। কলেজে আমার সম্মান শেষ করেও তোর শান্তি হয়নি? শেষমেশ…”
কথা বলতে গিয়ে নিজাম ইসলামের কান্না চলে আসে। নিজেকে সামলে নিয়ে বলেন,
“তোকে আর কিছুই বলার নেই আমার। আজকে থেকে আমি ভুলে যাব আমার কোনো ছোট মেয়ে আছে। আজ থেকে তুই আমার কাছে মরে গেছিস। তোর এই মুখটাও আমি আর দেখতে চাই না।”
নিহি নিজাম ইসলামের পা ধরে বলে,
“আব্বু আমার কথা শোনো তুমি। তোমার ভুল হচ্ছে। আব্বু ও আব্বু।”
“পা ছাড় আমার। গালে জুতা মেরেও বলছিস ভুল হয়েছে? ঐ বাড়িতে তুই আর কখনো ফিরে আসবি না। আমাকে আব্বু বলেও ডাকবি না। নয়তো আমার মরা মুখ দেখবি আমি বলে রাখলাম।”
পা ছাড়িয়ে নিয়ে নীলমকে বলেন,
“চল আমার সঙ্গে।”
“আব্বু নিহির কথাটা একবার শুনি?”
“একটু আগে কী বললাম শুনিসনি তুই? আমার একটাই মেয়ে এখন থেকে। ও কেউ নয় আমার। আমার কেউ না মানে তোরও কেউ না। তুই এখনই আমার সঙ্গে যাবি নাকি…”
“আব্বু!”
“চল।”
জোর করেই তিনি নীলমকে সঙ্গে করে নিয়ে যান। নিহি মাটিতে বসে চিৎকার করে করে কাঁদছে। পাশেই আমান দাঁড়িয়ে আছে। এমন পরিস্থিতিতে কী করা উচিত আমান বুঝতে পারছে না। বাজারে তেমন মানুষজন নেই। যারা আছে তারাও দেখে মজা নিচ্ছে। আমান হাঁটু গেড়ে নিহির সামনে বসে বলে,
“প্লিজ কাঁদবেন না। মানুষজন দেখছে। চলুন এখান থেকে।”
নিহির কানে কোনো কথা যাচ্ছে না। চোখের পানিও কোনো বাঁধ মানছে না। আমান আর কোনো উপায় না পেয়ে নিহির কাঁধে হাত রেখে দাঁড় করায়। নিহিকে নিয়ে একটা গ্যারেজে যায়। আমানের গাড়ি মাঝপথে নষ্ট হয়ে যাওয়ায় ম্যাকানিক খুঁজতে বের হয়েছিল। আর এর মাঝেই ঘটে গেল এত বড় ঘটনা। ম্যাকানিক আর নিহিকে নিয়ে গাড়ি যেখানে সেখানে যায় আমান। গাড়ির লক খুলে নিহিকে ভেতরে বসতে বলে। নিহি চুপচাপ গাড়িতে বসে। কাঁদছে তখনও অনবরত। গাড়ি ঠিক হয়ে গেলে ম্যাকানিককে টাকা দিয়ে আমান গাড়িতে ওঠে। নিহি জানালার দিকে মুখ করে নিশ্চুপে চোখের পানি ফেলছে। কাঁদতে কাঁদতে নিহির শরীর হালকা হয়ে যায়। জ্ঞান হারিয়ে শরীর ভার ছেড়ে দিলে গাড়ির কাঁচের সঙ্গে মাথায় বারি খায়। আমান চকিতে তাকায় নিহির দিকে। নিহিকে কয়েকবার ডেকেও যখন কোনো সাড়াশব্দ পায় না তখন নিজেই মাথাটা ধরে গাড়ির সীটের সাথে এলিয়ে দেয়। সীট বেল্টটাও আমানই বেঁধে দেয়। সীট থেকে মাথা বারবার সরে যাচ্ছে দেখে আমান নিজেই নিহির মাথাটা ওর কাঁধে রাখে। আমানের সাইডের জানালা খোলা ছিল। ঠান্ডা বাতাসে শরীর কুঁকরে যাচ্ছে। আমান জানালা বন্ধ করে দেয়। ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে একটা দীর্ঘশ্বাস। কী থেকে কী হয়ে গেল?”
চলবে…
[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ।]