#আড়ালে_আবডালে
#পর্ব_২৪
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
__________________
পরেরদিন নিজাম ইসলাম, লিয়াকত শিকদার, নীলম, তরু আর নিহি তরুর কলেজে যায়। ভর্তির সব কার্যক্রম সম্পূর্ণ করে বাড়িতে ফিরে আসেন। নিজাম ইসলাম আর নীলম আজই ঢাকায় ফিরে যাবে, তাই নিহি আজ ক্লাস করেনি। বাড়িতে আসার পর নিহির মনটা খারাপ হয়ে যায়। কান্না চলে আসে। নিজাম ইসলাম বুঝতে পারেন। এক হাতে নিহিকে জড়িয়ে ধরে, মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,
“মন খারাপ করিস না মা। তোর কলেজ ছুটি হলে আমি নয়তো নীলম এসে তোকে নিয়ে যাব। আর আমরাও মাঝে মাঝে আসব। তুই কিন্তু মন দিয়ে পড়াশোনা করবি।”
নিহি এবার বাচ্চাদের মতোন কেঁদে ফেলে। নিজাম ইসলাম আর নীলমের চোখেও পানি চলে আসে। এক মুহূর্তের জন্য মনে হয়েছিল, নিহিকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে। পরে নিজেরাই মনকে ধাতস্থ করেন। আবেগকে প্রশ্রয় দিলে চলবে না। তারা নিহিকে বুঝিয়ে, শুনিয়ে রেখে সময় থাকতেই ঢাকার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে। মামি নিহির চোখের পানি মুছে দিয়ে বলে,
“মন খারাপ করিস না মা। আমার ঘরে আয়।”
মামি সঙ্গে করে নিহিকে নিয়ে যায়। গল্পগুজব করে। মজার মজার কথা বলে নিহিকে হাসায়।
.
অপরপ্রান্তে সুখ নেই আমানের মনে। কালকের দিনটা ঘোরের মধ্যে কাটলেও রাতের সঙ্গে সঙ্গে ঘোরের রেশ কমে এসেছে। নিহির শূন্যতা আমানকে আঁকড়ে ধরেছে। পুরো বাড়িটায় শূন্যতা বিরাজমান। নিহির রাগের ধমক এখন আর বাড়িতে প্রতিধ্বনি হয় না। নিহির খিলখিল করা হাসির শব্দও প্রতিধ্বনি হয় না। শুধু চোখ বন্ধ করলেই নিহির হাসিমাখা মুখটা ভেসে ওঠে। কেমন আছে নিহি? ভালো আছে তো? নিজের অস্থিরতায় নিজের ওপরই রাগ হচ্ছে আমানের। শত চেষ্টা করেও অস্থিরতা কমাতে পারছে না।
অফিসে থাকতেও আজ ভালো লাগছে না। নিরবকে অফিসের বাকি কাজ বুঝিয়ে দিয়ে আমান বাড়িতে চলে যায়। টুকটুকি আর আবুল এখন আবার আগের ন্যায় শুধু রাতের রান্না করতে আসে। বাড়ি পুরো ফাঁকা। ঘরে ঢুকতেই দম বন্ধ হয়ে আসে। নিহির স্মৃতিরা জড়িয়ে ধরে আমানকে। এভাবে চলতে থাকলে আমান মানসিক রোগী হয়ে যাবে। বিছানায় গা এলিয়ে দেয় আমান। ফোনটা হাতে নিয়ে গ্যালারীতে যায়। নিহির ঘুমন্ত ছবি দেখে। চলে যাওয়ার আগেরদিন যে ঘুরতে গিয়েছিল তখন বেশকিছু ছবি তুলেছিল দুজনে। সেই ছবিও দেখে। নিঁখুতভাবে নিহির ছবি পর্যবেক্ষণ করে। মেয়েটা এত সুন্দর করে হাসে কেন? চোখ দুটো এত স্বচ্ছ কেন? একদম কাচের ন্যায়! মাঝে মাঝে আমানের ইচ্ছে করে নিহিকে খেয়েই ফেলতে। আমান হাসে। নিহির ছবিটা বুকের মধ্যে জড়িয়ে রাখে। একটু প্রশান্তি লাগছে এখন।
আমান শোয়া থেকে উঠে বসে। মাকে ফোন করে। অনামিকা রহমান তখন কলেজে ছিলেন। আমানের কল দেখে তিনি ফোন রিসিভ করেন। আমান বলে,
“আসসালামু আলাইকুম মা।”
“ওয়ালাইকুম আসসালাম। কেমন আছো আব্বু?”
“ভালো নেই মা!”
অনামিকা রহমান অস্থির হয়ে বলেন,
“ভালো নেই! কী হয়েছে আব্বু? শরীর ঠিক আছে?”
“শরীর ঠিক আছে। কিন্তু মন ভালো নেই। তুমি কি একটু বাসায় আসবে?”
“আমার আর একটা ক্লাস আছে। আমি ক্লাসটা শেষ করেই আসছি।”
“ঠিকাছে।”
ব্যবসার কাজে আমানের বাবা বেশিরভাগ সময়টাই বাহিরে থাকেন এটা সবাই জানেন। তাই দেশের অফিসের সব কাজকর্ম আমানকেই দেখতে হয়। অফিসের দূরত্ব বাড়ি থেকে অনেক দূরে হওয়ায় আমান আলাদা বাড়িতে থাকে। এবং সেই বাড়িওটা ওদের নিজের। মাধ্যমিক পর্যন্ত বাবা-মায়ের কাছে থেকেই স্কুলে পড়লেও উচ্চ-মাধ্যমিক শেষ করেছে হোস্টেলে। এরপর অনার্স, মাস্টার্স কমপ্লিট করেছে কানাডাতে। পড়াশোনার পার্ট শেষ করেই আমান বাবার অফিসের কাজে হাত দিয়েছে। আমান স্বভাবে যতটা শান্তশিষ্ট আসলে তা নয়। তবে আমান শান্তিপ্রিয় লোক। সহজে রাগে না। তবে একবার রেগে গেলে খবর আছে। সবসময় নিজেও হাসিখুশি থাকে এবং অন্যদেরও হাসাতে পছন্দ করে। ছোট থেকেই আমান গানটা ভালো করে। তবে সিরিয়াসলি কখনো নেয়নি। সিরিয়াসলি নিলে নিঃসন্দেহে বড় গায়কও হতে পারত।
.
আমান ফ্রেশ হয়ে এসে দেখে নিহি দু’বার ফোন করেছিল। ওয়াশরুমে ছিল বলে পানির শব্দে রিংটোনের শব্দ শুনতে পায়নি। আমান কল ব্যাক করে। অদ্ভুত বিষয়! আমানেরও বুক ধুকপুক করছে। নিহি ফোন রিসিভ করে সালাম দেয়। অজানা প্রশান্তিতে বুকের ভেতরটা ঠান্ডা হয়ে যায় আমানের। হয়তো নিহির কণ্ঠ শুনেই! আমান নিহির সালামের উত্তর নিয়ে বলে,
“কেমন আছেন?”
“আলহামদুলিল্লাহ্। আপনি?”
“যেমন রেখেছেন।”
“কেমন রেখেছি?”
“শূন্যতায়।”
“পূর্ণতা কীভাবে পাবে?”
“আপনাকে পেলে।”
নিহি নিঃশব্দে হাসে। আমান বুঝতে পারে তবুও। নিজেও নিঃশব্দে মুচকি হাসে। আমান জিজ্ঞেস করে,
“তারপর?”
“তারপর কী?”
“কেমন যাচ্ছে দিনকাল?”
“আসলামই তো কাল।”
“তবুও। কেমন লাগছে ওখানে?”
“খুব ভালো। তবে বাড়ির কথা মনে পড়লে খুব খারাপ লাগে।”
“স্বাভাবিক। ধীরে ধীরে ঠিক হয়ে যাবে।”
“অভ্যস্ত মনে হচ্ছে?”
“তাই-তো। বাবা-মাকে ছাড়াই তো থাকছি। আর এখন…”
“আর এখন?”
“আপনাকে ছাড়া!”
নিহি লজ্জা পায়। আমান সামনে নেই। তবুও মনে হচ্ছে আমান সামনেই আছে। নিহিকে লজ্জার হাত থেকে বাঁচাতে আমান বলে,
“মামার বাড়িতে কে কে আছে?”
“মামা-মামি, মামাতো ভাই আর বোন।”
“মামাতো ভাই বড় নাকি বোন?”
“ভাই।”
“বোন সিঙ্গেল?”
“মনে হয়। কেন?”
“রিলেশন করতাম। করিয়ে দিবেন?”
“খুব শখ?”
“বউ তার মামাতো বোনের সাথে প্রেম করিয়ে দিলে, শখ করা যেতেই পারে।”
“আমি কী বলেছি রিলেশন করিয়ে দেবো?”
“দেবেন না? হিংসে হয়?”
“মোটেও না। হিংসে কেন হবে?”
“থাক, জানি।”
“কী জানেন?”
“মেয়েরা স্বামীর ভাগ কাউকে দিতে পারে না।”
“কচু জানেন।”
“তাই না?”
“হু, তাই! শুনুন, আমিও রিলেশন করব।”
“কার সাথে?”
“এখানে কি ছেলের অভাব আছে নাকি?”
আমান ধমক দিয়ে বলে,
“মেরে ফেলব একদম।”
নিহি এবার শব্দ করেই হাসে। আমান রাগ করলে নিহির ভালো লাগে। নিহি হাসছে আর আমান চুপ করে আছে। হাসতে হাসতেই নিহি বলে,
“রাগ করলেন?”
“না, খুশিতে নাচতেছি।”
“তাই নাকি? ভিডিও কল দেই? আমিও একটু দেখি।”
“দেন।”
“না, থাক।”
“দেন। আমি আপনাকে দেখব।”
“দেখা লাগবে না।”
“কেন?”
“এমনিই।”
কিছুক্ষণ নিরব থাকে দুজনই। নিরবতা কাটিয়ে আমান নিহিকে ডাকে।
“নিহু!”
আমানের মুখে ‘নিহু’ ডাক শুনলে বুকের ভেতরটা মোচর দিয়ে ওঠে নিহির। অজানা ভালো লাগায় খুশিতে মন ভরে যায়। এত মায়া, এত ভালোবাসা এই ডাকে! যা শুধু নিহি অনুভবই করতে পারে, প্রকাশ করতে নয়। সব অনুভূতি প্রকাশও করতে নেই। অপ্রকাশিত অনুভূতিটুকি নিজের করে থাক মনের ছোট্ট কুঠুরিতে।
নিহিকে চুপ থাকতে দেখে আমান আবার বলে,
“নিহু? আছেন?”
“হু।” ছোট করে উত্তর দেয় নিহি।
“আমার খুব কষ্ট হয় নিহু। ঘরে আসলে আমি শান্তি পাই না। আপনি ঠিকই বলেছিলেন। আপনি আড়ালে-আবডালে রয়ে গেছেন। সরাসরি আমি আপনাকে দেখতে না পেলেও অনুভব করতে পারি। চোখ বন্ধ করলেই মনে হয় আপনি আমার সামনে। মনে হয়, এইতো হাত বাড়ালেই আমার নিহুকে আমি ধরতে পারব।”
আমানের অগোচরে নিহি দীর্ঘনিঃশ্বাস ছাড়ে। ঘরের বাইরে কারো পায়ের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। মামির গলার শব্দও শুনতে পায়। ‘মামি আসছে। রাখছি।’ বলে ফোন রেখে দেয় নিহি। মামি ঘরে এসে বলে,
“কীরে একা একা কী করছিস?”
নিহি আমতা আমতা করে বলে,
“কিছু না মামি। ফোনে গেমস খেলছিলাম।”
“একা বোর লাগছে না?”
“না মামি।” হেসে বলে নিহি।
মামি বলেন,
“মিথ্যা বলবি না একদম। আয় আমি লিমনকে বলছি তোকে নিয়ে ঘুরে আসতে।”
“না, মামি। ঘরেই ঠিক আছি।”
“আয় তো তুই।”
মামি জোর করেই নিহিকে টেনে নিয়ে যান। মামির জোড়াজুড়িতে নিহি ঘুরতে যেতে রাজি হয়। তবে দূরে কোথাও নয়। একটু হাঁটাহাঁটি করার জন্য চা বাগানে যাবে। লিমন বাইকে উঠে বলে,
“নিহি দোয়া কর।”
“কেন? তুমি বাইক চালাতে পারো না? না পারলে নেমে যাই বাবা! আমার এত তাড়াতাড়ি মরার শখ নেই। জামাই বিধবা হয়ে যাবে।”
শেষের কথাটা বলে নিহি নিজেই বোকা বনে যায়। লিমনের অগোচরে জিভ কাটে। লিমন চোখ দুটো বড় বড় করে তাকিয়ে বলে,
“কী বললি? জামাই বিধবা হবে মানে?”
নিহি হাসার চেষ্টা করে বলে,
“মানে হবু জামাই আরকি!”
“বুঝলাম। কিন্তু ছেলেরা কীভাবে বিধবা হয়?”
নিহি এবার তাড়া দিয়ে বলে,
“তোমার এতকিছু বুঝতে হবে না। চলো তো!”
বাইক স্টার্ট দিয়ে লিমন বলে,
“দোয়া করতে বললাম কেন জিজ্ঞেস করলি না তো!”
“ওহ হ্যাঁ, তাইতো! কেন?”
“তোর সঙ্গে আমাকে গার্লফ্রেন্ড দেখে ফেললে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। এজন্যই বলছি।”
“ওমা! কেন? আমি তো তোমার বোন হই।”
“ও তো আর জানে না।”
“জানিয়ে দেবে।”
“দিলেও! প্রচুর ত্যাঁদড়।”
“তোমার মতো?” জিজ্ঞেস করে হাসে নিহি।
লিমন রাগ দেখিয়ে বলে,
“আমার মতো? আমি ত্যাঁদড়? একদম ধাক্কা দিয়ে বাইক থেকে ফেলে দেবো।”
“জামাই মরে যাবে রে ভাই!”
আবারও একটা উদ্ভট কথা বলে নিহি নিজের ওপরই এবার রেগে যায়। লিমন বলে,
“এত জামাই জামাই করিস কেন? ফুপাকে বলব নাকি তোর বিয়ের কথা?”
“এই না! আমি তো মজা করে বলি।”
লিমন হাসে। জোর করে হাসে নিহিও।
____________________
নিহি নিয়মিত কলেজে যাওয়া শুরু করেছে। কলেজ থেকে এসে আবার প্রাইভেট পড়ছে। কোচিং করছে। মোট কথা, নিহির পুরোটা সময়ের বেশি সময়টাই যাচ্ছে পড়তে পড়তে। অবশ্য নিহি তো এখানে এসেছে পড়তেই। অবসর সময়ে একটু ঘুমিয়ে নেয়। বাড়িতে সবার সঙ্গে প্রতিদিন কথা হয়। আমানের সঙ্গে একবার কি দু’বার কথা হয়। তবে সেটাও খুব কম। আমানের খুব ইচ্ছে করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা নিহির সঙ্গে কথা বলতে। কিন্তু সেটা তো সম্ভব নয়। আমান জানে নিহির ব্যস্ততা। তাছাড়া আমান নিজেও চায় না, পড়া থেকে নিহির মনোযোগ অন্যদিকে যাক। নিহির অনুভূতি আমানের প্রতি যে পজিটিভ এটা বুঝেই আমান শান্ত। নিহি মন দিয়ে পড়ুক, ভালো রেজাল্ট করুক। তারপরই না বাবার মন জয় হবে। এরপর নিহিকে বউ সাজিয়ে বাড়িতে নিয়ে আসবে। তখন আর চোখের আড়াল করবে না। বাকিটা জীবন সুখে কাটানোর জন্য এতটুকু সময়ে কষ্ট তো সহ্য করা যেতেই পারে। এছাড়া অফিসের কাজে আমানও নিজেকে ব্যস্ত রাখছে। তবে নিহির মতো করে নয়।
লাঞ্চ সবসময় আমান নিরবের সঙ্গেই করে। ঐসময়ে নিরব জিজ্ঞেস করে,
“ম্যাম কেমন আছে স্যার?”
“ভালো আছে। তিনি তো পড়াশোনা নিয়ে খুব ব্যস্ত।”
নিরব মুচকি মুচকি হাসে। আমান খেতে খেতে প্রশ্ন করে,
“হাসো কেন?”
“না, স্যার। এমনি। ম্যামকে খুব মিস করেন তাই না?”
“মিস করাটা কি অস্বাভাবিক?”
“না, স্যার। একটা কথা বলব?”
“বলো।”
“চলুন সিলেটে যাই।”
আমান খাওয়া বন্ধ করে কিছুক্ষণ নিরবের দিকে তাকিয়ে থাকে। জিজ্ঞেস করে,
“কেন?”
“সিলেটে আমার খালার বাড়ি। ম্যামও তো সিলেটে থাকে। ম্যামের সঙ্গে দেখা করতে পারবেন।”
আমান হেসে বলে,
“না, নিরব! নিহুকে বিরক্ত করতে চাচ্ছি না।”
নিরবের মুখটা অন্ধকারে ছেঁয়ে যায়। হুট করে নিরবের মন খারাপের কারণ ধরতে পারে না আমান। আর যখন বুঝতে পারে তখন বলে,
“ওয়েট, ওয়েট! সিলেটে কার বাড়ি বললে? খালার বাড়ি?”
“জি স্যার।”
“যেই খালার মেয়েকে তুমি ভালোবাসো সেই খালার বাড়ি?”
নিরব এবার লজ্জা পায়। আমানের প্রশ্নে অপ্রতিভত হয়ে পড়ে। নিরব লজ্জামিশ্রিত কণ্ঠে বলে,
“জি স্যার।”
আমান এবার শব্দ করে হাসতে হাসতে বলে,
“তাহলে এই হলো কাহিনী! আমার নাম আর তোমার কাম?”
“না, না স্যার। আপনার কথা ভেবেই বলেছি।”
আমান আগের ন্যায় হেসে বলে,
“আচ্ছা হয়েছে। শোনো, তোমার খুব ইচ্ছে হলে যেতে পারো। আমি ছুটি দিয়ে দিচ্ছি। তার সঙ্গে দেখা করে আসো।”
“না, স্যার একা যাব না।”
“ভেবে বলো।”
“ভেবেই বলেছি।”
“আচ্ছা। তবুও পরে যদি মত বদলাও আমায় জানিও। ছুটি দিয়ে দেবো।”
“মত পাল্টাব না স্যার।”
.
ক্যান্টিনে বসে আছে নিহি। বোতলের ওপর হাত রেখে মাথা ভর দিয়ে রেখেছে। দৃষ্টি জানালার বাইরে। এখান থেকে মেইন রাস্তা দেখা যায়। কাপল দেখা যাচ্ছে। নিহির আমানের কথা মনে পড়ে যায়। পড়াশোনা নিয়ে যতই ব্যস্ত থাকুক না কেন, আমানের কথা ঠিক মনে পড়ে। নিহি দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। সামনের চেয়ারে বসে তরু ফিসফিস করে ওর বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে কথা বলছে। নিহি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।
পরক্ষণেই মনে হয় আমানকে তো একটা কল করা যায় এখন! যেই ভাবা সেই কাজ। ব্যাগটা নিয়ে একদম পেছনের দিকে জানালার পাশে গিয়ে বসে। ক্যান্টিন এখন মোটামুটি ফাঁকা প্রায়। যারা আছে সবাই সামনে বসে আছে। কেউ খাচ্ছে, কেউ আড্ডা দিচ্ছে, কেউ ফোন চাপছে। আবার কেউ ওদের মতোই ফোনে কথা বলছে। নিহি আমানের নাম্বারে ডায়াল করে। আমান তখনও নিরবের সঙ্গে বসে খাচ্ছিল। নিহির নাম্বার দেখে কেটে দিয়ে ব্যাক করে। নিহির হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়। আমান কথা বলছে অথচ নিহি নিশ্চুপ। এত বেশি কেন মিস করছে আমানকে তা নিহি জানে না! কথা হয় কিছুক্ষণ। ঘণ্টা পড়ে যায় এর মাঝেই। টিফিনের সময় শেষ। নিহি তখন বলে,
“একটা দামী জিনিস চাই।”
“বলুন কী চান?”
“অনেক দামী কিন্তু।”
“সমস্যা নেই।”
“দিতে পারবেন তো?”
“আপনি মুখ ফুঁটে একবার বলেই দেখুন।”
নিহি কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে বলে,
“আপনাকে চাই।”
আমান বুকে দিয়ে বলে,
“হায়ে! এ তুনে ক্যায়া কিয়া? ম্যায় তো মার জায়ুঙ্গি মেরি জান!”
নিহি শব্দ করে হেসে ফেলে। তরু ডাকছে। নিহি কিছু না বলেই খট করে কল কেটে দিয়ে ক্লাসে চলে যায়। আমান তখনও হাসছে। আমানের শেষ কথা শুনে নিরবও মুচকি মুচকি হাসছে।
.
.
সকাল আট’টা বাজে। তরু আর নিহি কলেজের সরু রাস্তায় হাঁটছে। চারপাশ কুয়াশায় ঢেকে আছে। দূর থেকে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। ক্লাস শুরু হবে নয়টায়। এক ঘণ্টা আগেই এসেছে। তার কারণ হচ্ছে তরুর বয়ফ্রেন্ড। এই সময়টা-ই শুধু দুজন দেখা করে। আর নিহি পাশে বসার মতো কোনো জায়গায় বসে পড়ে। আজও তার ব্যতিক্রম হলো না। কলেজের বামদিকে রাস্তায় দুজনে হেঁটে চলে গেল। এখান থেকে কিছুটা দূরেই একটা পার্কের মতো জায়গা আছে। জগিং করতে আসে অনেকেই। বিশেষ করে বিকেলের দিকটায় সবাই সময় কাটাতে আসে। এখন শীত বলে কেউ সকালে আসে না। তরু আর ওর বয়ফ্রেন্ডকে আলাদা স্পেস দিয়ে নিহি অন্যদিকে যায়। আজ পড়তেও ইচ্ছে করছে না। শীতে শরীর কাঁপুনী দিয়ে উঠছে। হাঁটতে হাঁটতে ভাবে আমানকে একটা কল করবে। যখনই আমানের নাম্বারে কল করতে যাবে তখনই নিহির ডান হাতে টান লাগে। নিহি ভয় পায়। আৎকে উঠে চোখ বন্ধ করে ফেলে। ঠান্ডা দুটো হাত নিহিকে বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করে রেখেছে। নিহি চোখ মেলে তাকায়। বিস্ময়ে মুখ হা হয়ে যায়। দু’হাতে মুখ ঢাকে। চোখ দুটো স্থির সামনের মানুষটির দিকে। আমান! চোখে-মুখে দুষ্টুমির হাসি। হেসে বলে,
“সারপ্রাইজ!”
এতটাই অবাক হয়েছে যে নিহি কথাই বলতে পারছে না। সেই সঙ্গে খুশিতে চোখে পানি চিকচিক করছে। খুশিগুলো মুখে প্রকাশ করার দরকার নেই। আমান নিহির চোখ দেখেই বুঝে ফেলেছে। নিহি কোনরকমভাবে বলে,
“আমার বিশ্বাস হচ্ছে না!”
নিহিকে অবাক করে দিয়ে আমান শীতল ওষ্ঠদ্বয় দ্বারা নিহির কপাল ছুঁয়ে দেয়। আবেশে নিহির চোখ বন্ধ হয়ে যায়। আমান বলে,
“বিশ্বাস হয়েছে?”
“না।” নিহির উত্তর।
“তাহলে আবার দেবো?”
নিহি আমানের ঠোঁটের ওপর হাত রেখে বলে,
“নাহ্!”
আমান হাসে। তখনো নিহি আমানের বাহুবন্ধনে। নিহি জিজ্ঞেস করে,
“কীভাবে সম্ভব!”
“এভাবেই। আপনার ভাবির থেকে ঠিকানা নিয়েছি। তারপর কাল বিকেলেই সিলেটে রওনা দিয়েছি। এখানে উঠেছি নিরবের খালার বাসায়। কলেজের ঠিকানা নিয়ে আরো এক ঘণ্টা আগে থেকে এসেই অপেক্ষা করছি। আপনাকে এখানে আসতে দেখে আমি আর নিরবও চলে এসেছি।”
নিহি এবার চারপাশে চোখ বুলায়। আমান হেসে বলে,
“নিরব গাড়িতে এখন। আমাদের দেখছে না।”
নিহি লজ্জা পায়। চোখ দুটো নামিয়ে নিয়ে নিজেকে আমানের থেকে ছাড়িয়ে নেয়। মনে মনে খুশিও হয়। ভাগ্যিস তরুর বয়ফ্রেন্ড আছে। এজন্যই তো এখানে আসা। কলেজের সামনে দেখা হলে তো এমন কিছু হতো না। এসব ভেবে নিজে নিজেই নিহি আরো বেশি লজ্জা পায়। গাল দুটো লাল হয়ে যায়। আমান হাসছে মুচকি মুচকি। আবারও একটানে নিহিকে বুকের সাথে জড়িয়ে বলে,
“এখন এত লজ্জা পাচ্ছেন কেন? কাল না আমাকে চাইলেন? আমি বলেছিলাম, দেবো। এইতো দিলাম আপনার দামী জিনিস। আমাকে। আগলে রাখুন এবার!”
চলবে…
#আড়ালে_আবডালে
#পর্ব_২৫
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
____________________
শিশিরবিন্দু পাতা থেকে নিচের দিকে পড়লে যেরকম কিছু অংশ নিয়ে ছেঁয়ে পড়ে, নিহির মনের ভেতরও আমানের কথাগুলো অনেকখানি জায়গা নিয়ে বিস্তৃতি রূপ ধারণ করেছে। একদিকে যেমন ভালোলাগা শুরু হয়েছে অন্যদিকে লজ্জায় লাল-নীল আকার ধারণ করেছে মুখমণ্ডল। সুমিষ্টঘ্রাণ নিহিকে শিহরিত করছে। ঘ্রাণটা আমানের শরীরের থেকে আসছে। আমান তখনো মুগ্ধকর দৃষ্টিতে নিহির দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে। নিহি লজ্জা পেলে যখন গাল দুটো লাল হয়ে যায়, মসৃণ পাতলা ঠোঁট দুটো যখন অনবরত কাঁপে তখন আমানের মনে সুখেরা দোলা দিয়ে যায়। নিহি নিশ্চুপ। শুধু লজ্জায় মাথা নুইয়ে রেখেছে। আমান জিজ্ঞেস করে,
“আগলে রাখবেন না?”
নিহির ঠোঁট তখনো কাঁপছে অনবরত। শীতল হাতে আমান নিহির ঠোঁট ছুঁয়ে দেয়। নিহি কেঁপে চোখ তুলে তাকায় আমানের দিকে। বলে,
“ইশ! ঠান্ডা।”
আমান হাসে। বলে,
“বললেন না তো?”
“কী বলব?”
“আগলে রাখবেন না?”
“আগলে না রাখলে কি চলে যাবেন?”
“সেই উপায় তো আমার নেই।”
“তার মানে উপায় থাকলে চলে যাবেন?”
“কিছু উপায়কে উপেক্ষা করতে হয়। যেখানে আপনার জন্য আমি সবকিছুই উপেক্ষা করতে পারি সেখানে উপায় আর তেমন কী?”
নিহি তৃপ্তির হাসি হাসে। মনটা শান্তিতে ভরে গেছে। আমানের জ্যাকেট আলতো করে খাঁমচে ধরে নিহি প্রশ্ন করে,
“আপনার কথায় এত ভালোবাসা মেশানো কেন?”
“আপনাকে ভালোবাসি তাই।”
নিহির ফোন বাজছে। রিংটোনের শব্দ পেয়ে আমানের আলিঙ্গন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয় নিহি। ব্যাগ থেকে ফোন বের করে দেখে তরু ফোন করেছে। নিহি ফোন রিসিভ করে বলে,
“হ্যাঁ, তরু বল।”
“কোথায় তুই? রাস্তায় আয়।”
“আসছি।”
নিহি ফোন কেটে দিয়ে ফোন ব্যাগে রাখতে রাখতে ব্যস্তভঙ্গিতে বলে,
“আমায় এখন যেতে হবে।”
আমান একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। ফোন ব্যাগে রেখে আমানের দিকে তাকিয়ে নিহিও থমকে যায়। এভাবে তাকিয়ে আছে কেন? নিহি বলে,
“যাই?”
“উঁহু। আসি।”
নিহি মুচকি হেসে বলে,
“আসি।”
কিছুদূর এগিয়ে আবারও ফিরে তাকায়। জিজ্ঞেস করে,
“আজই চলে যাবেন?”
“না। আছি কিছুদিন।”
“ঠিকাছে। টিফিন টাইমে কল করব।”
“আচ্ছা।”
আমান হাত নাড়িয়ে নিহিকে বিদায় দেয়। নিহিও বিদায় দিয়ে সামনে এগিয়ে যায়। কুয়াশার মাঝে নিহিকে আর দেখা যাচ্ছে না। আমান তখনো সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে। নিহি চলে যাওয়ার পর থেকে শূন্য শূন্য লাগছে। ইচ্ছে করে সারাক্ষণ চোখের সামনে নিহিকে বসিয়ে রাখতে। আমান দীর্ঘশ্বাস নিয়ে চলে যাওয়ার জন্য একটু নড়েচড়ে দাঁড়াতেই সামনে তাকিয়ে দেখতে পায় কেউ একজন ছুঁটে আসছে কুয়াশা ভেদ করে। কুয়াশা ভেদ করে আসা কন্যাটি আর কেউ নয়। আমানের নিহু! কিছু বুঝে উঠার আগেই দৌঁড়ে এসে নিহি আমানকে জড়িয়ে ধরে। এক মুহূর্তের জন্য থমকে যায় আমান। নিহি পা সামান্য উঁচু করে আমানের গলা জড়িয়ে ধরে ঘাড়ে মুখ লুকিয়েছে। নিহির উত্তপ্ত নিঃশ্বাস আমানের ঘাড়ে আছড়ে পড়ছে। হাত দুটো কাঁপছে। আজ প্রথম নিহি আমানকে জড়িয়ে ধরেছে। এতটা কাছে এসেছে। আমানের কী করা উচিত ভেবে পাচ্ছে না। আপাতত কিছু ভাবতেও চাচ্ছে না। শুধু ভালোবাসাময় দুটি হাতে নিজের সাথে আবদ্ধ করে নেয় নিজের ভালোবাসাকে। এতক্ষণ যেই শূন্যতা বুকের মাঝে দানা বাঁধতে শুরু করেছিল, সেই শূন্যতাকে উপড়ে ফেলে দিয়েছে নিহির কাছে আসা। বুকের কানায় কানায় এখন শুধু পূর্ণতা। নিহির ভালোবাসার পূর্ণতা। এতটুকু জায়গাও ফাঁকা রাখেনি যেখানে শূন্যতা বিরাজ করতে পারবে। নিহি কথা বলছে না কোনো। শুধু যতটুকু শক্তি আছে নিজের শরীরে ততটুকু শক্তি দিয়েই জড়িয়ে ধরে রেখেছে। মিনিট দুয়েক আলিঙ্গনাবদ্ধ থাকার পর নিহি আমানকে ছেড়ে দেয়। আমান ছাড়ে না। নিহি দৃষ্টি নত করে পিছনে হাত নিয়ে আমানের হাত সরিয়ে দেয়। একবার লজ্জার দৃষ্টিতে আমানের চোখের দিকে তাকিয়ে আবার দৌঁড়ে চলে যায়। একবারও পিছু ফিরে তাকায় না। আমান জানে নিহি কেন পিছনে ফিরে তাকায়নি। মাথার পিছনে হাত নিয়ে মাথা নত করে চুলে হাত বুলায় আমান। কী এক অনুভূতির প্রকাশ ঘটিয়ে গেল নিহু! এভাবে এক পা, দু’পা করে পিছাতে গিয়ে নিরবের সঙ্গে ধাক্কা খায়। নিরব যে বামদিকের রাস্তা দিয়ে এখানেই এসেছে দেখতে পায়নি আমান। নিরবও বুঝতে পারেনি আমান এদিকে আসছে। ধাক্কা খেয়ে নিরব নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,
“স্যরি স্যার, স্যরি। আমি দেখিনি।”
আমান নিজেও বলে,
“স্যরি নিরব। আমি দেখিনি। তুমি কি ব্যথা পেয়েছ?”
“জি না স্যার। ম্যাম কোথায়?”
“চলে গেল এইমাত্র।”
নিরব মনঃক্ষুণ্ণ হয়ে বলল,
“একবার আমার সঙ্গে দেখাও করল না! ভেবেছিলাম দেখা হলে, ম্যামের মুখে ক্যাবলাকান্ত ডাকটা শুনব।”
“ক্যাবলাকান্ত নাম তোমার ভালো লেগেছে?” অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে আমান।
নিরব উত্তরে সলজ্জিত হেসে বলে,
“ম্যাম নাম দিয়েছে বলে কথা!”
আমান নিরবের কাঁধে হাত রেখে হেসে বলে,
“আছি তো আরো কয়েকদিন। দেখা হবেই। এখন বাড়িতে চলো।”
“চলেন স্যার।”
.
.
টিফিন টাইমে আমানকে কল করার কথা থাকলেও কল করতে পারেনি নিহি। তার কারণ হচ্ছে তরু আজ ওর বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে কথা বলেনি। সারাক্ষণ নিহির সাথেই ছিল। তাই ক্লাসের ফাঁকে আমানকে টেক্সট করে জানিয়ে দিয়েছে। বিকেলে কলেজ ছুটির পরও কলেজের সামনে আমান আর নিরবকে গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছে। স্কুলে থাকতে যখন নিহির বান্ধবীরা প্রেম করত তখন ওদের বয়ফ্রেন্ডরাও স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকত ছুটির সময়। নিহি আর ওর বাকি বান্ধবীরা তখন শুধু হাসতো। আর যেই বান্ধবীর বয়ফ্রেন্ড আসতো সেই বান্ধবী লজ্জায় নুইয়ে যেত। মুখে ছড়িয়ে পড়ত খুশির আভা। এই খুশিটুকু নিহি তখন উপলব্ধি করতে না পারলেও এখন পারছে। এবং সেটা খুব ভালোভাবেই অনুভব করতে পারছে। বিয়ের পরও এভাবে লুকিয়ে লুকিয়ে প্রেম করার মাঝেও যেন অনন্য সুখ। আচ্ছা এটা কি সত্যিই প্রেম? কই আমান তো কখনো ঘটা করে প্রপোজ করেনি! নিহিও বলেনি ভালোবাসি! না বলুক! ঢাক ঢোল পেটানোর দরকার হয় না ভালোবাসার জন্য। দুজন দুজনকে বুঝে, দুজনের অনুভূতি এক। এটাই যথেষ্ট! নিহি আড়চোখে তাকাচ্ছে আর মুচকি মুচকি হাসছে। আমান গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে চিবুকে হাত বুলাচ্ছে আর নিহিকে দেখছে। আমানের ঠোঁটেও হাসি বিরাজমান। তরু আর সকলের দৃষ্টির অগোচরে নিরবকে ইশারায় ‘হাই ক্যাবলাকান্ত’ বলে নিহি। ‘ হাই ক্যাবলাকান্ত’ কথাটি শোনা না গেলেও ঠোঁটের উচ্চারণে বোঝা গেছে। নিরব এক গাল হাসি দেয়। আমান নিজেও ফিক করে হেসে ফেলে। কিছুদূর এগিয়ে গিয়ে তরু আর নিহি রিক্সা নেয়। নিহি রিক্সায় বসে হাত বাইরে নিয়ে না তাকিয়েই আমানকে টাটা দেয়। আমান হাসে।
নিহি চলে যাওয়ার পর নিরব জিজ্ঞেস করে,
“ম্যামের সঙ্গে কথা বললেন না স্যার?”
আমান গাড়িতে বসতে বসতে বলল,
“সঙ্গে ওর কাজিন আছে। গাড়িতে উঠো।”
নিরব গাড়িতে বসে বলে,
“তাহলে কি কথা হবে না আর সামনাসামনি?”
“হবে। আজই। সন্ধ্যায়।”
“সন্ধ্যায়? কী করে?”
“সময় হলেই দেখিও। এখন যাওয়া যাক?”
“জি স্যার।”
আমান গাড়ি স্টার্ট দেয়। বাজার দিয়ে যাওয়ার সময় ফুলের দোকান দেখে গাড়ি থামায় সেখানে। নিরবের দিকে তাকিয়ে বলে,
“ফুলের দোকানে যাও।”
“কেন স্যার?”
“দশটা গোলাপ কিনে আনো। টাকা আছে তো?”
“আছে স্যার। কিন্তু ফুল দিয়ে কী করবেন স্যার?”
“ভর্তা বানিয়ে খাব। যাও।”
বেশি কথা বাড়ালে আমান রেগে যেতে পারে বিধায় নিরব আর কথা বাড়ায় না। দোকানে গিয়ে গুনে গুনে দশটা লাল টকটকে তাজা গোলাপ নিয়ে এসে গাড়িতে বসে। আমান আবার গাড়ি স্টার্ট দেয়। সোজা নিরবের খালার বাড়ি গিয়ে গাড়ি থামায়। বলে রাখা ভালো, নিরবের খালা-খালু ভীষণ মিশুক আর ভালো মানুষ। আমানকে পেয়ে তারা আনন্দিত। আপ্যায়নের কোনো ত্রুটিও রাখেন না তারা। বাড়ির সামনে গিয়ে নিরব বলে,
“স্যার ফুলগুলো?”
“বাড়িতে চলো।”
“খালা দেখলে কী ভাববে?”
“যা ভাবার ভাববে। চলো।”
নিরব অগত্যা ফুল নিয়ে আমানের সঙ্গে ভেতরে যায়। মনে মনে বলছে খালার সঙ্গে যেন দেখা না হয়। কিন্তু মনের কথা শোনেনি আল্লাহ্। খালা সামনে এসে হাজির। সঙ্গে সঙ্গে নিরব আড়ালে লুকিয়ে যায়। খালা আমানকে দেখে হেসে বলে,
“কোথায় গিয়েছিলে বাবা?”
“এইতো একটু বাহিরে গিয়েছিলাম।”
“আচ্ছা তুমি গিয়ে ঘরে বসো। আমি পিঠা বানিয়েছি। নিয়ে আসছি।”
“ঠিকাছে।”
খালা চলে যাওয়ার পর নিরব আড়াল থেকে বের হয়। হাঁফ ছেড়ে যেন বাঁচল এমনভাবে নিঃশ্বাস নিল। নিরব আর আমানকে যেই ঘরে থাকতে দিয়েছে সেই ঘরে গিয়ে আমান বলে,
“তোমার তাকে ডাকে নিয়ে আসো।”
“তাকে?”
“বোঝো না? জান্নাতকে।”
নিরব মাথা চুলকিয়ে বলে,
“কিন্তু কেন স্যার?”
“আগে ডাকো তো!”
নিরব জান্নাতের ঘরের সামনে গিয়ে ডেকে বলে, আমান ডেকেছে। জান্নাত আমানের সামনে গিয়ে জিজ্ঞেস করে,
“ডেকেছন ভাই? কিছু লাগবে?”
“না বোন। তোমায় একটা কথা বলব।”
“হ্যাঁ, বলেন।”
নিরব দরজার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। ফুলগুলো বিছানার ওপর রাখা। আমান একবার নিরবের দিকে তাকিয়ে বলে,
“কাণ্ড তো হয়ে গেছে।”
“মানে? বুঝলাম না ভাই।” বলল জান্নাত।
আমান মৃদু হেসে বলে,
“এইযে ফুলগুলো দেখছ? এগুলো নিরব এনেছে তোমার জন্য। কিন্তু দিতে সাহস পাচ্ছে না।”
নিরব বড় বড় চোখ করে আমানের দিকে তাকায়। মনে মনে বলছে, “এসব কী বলছেন স্যার? পর্দা এমন ফাঁস করে দিচ্ছেন কেন?” জান্নাত অবাক হয়ে একবার আমানের দিকে তাকায়। আরেকবার নিরবের দিকে তাকায়। নিরব তখন হাসার চেষ্টা করে বলে,
“না, না জান্নাত। স্যার মজা করছে।”
আমান চোখে-মুখে গাম্ভীর্য এনে বলে,
“মজা করছি মানে? এই ফুলগুলো তোমার টাকায় কেনা না?”
“জি স্যার।”
“তুমিই কিনেছিলে না?”
“জি স্যার।”
“তাহলে মজা করলাম কীভাবে?”
নিজের কথায় নিজেই ধরা খেয়ে নিরব আমতা আমতা করে। চোর চুরি করে ধরা পড়লে মুখের এক্সপ্রেশন যেমন হয়, নিরবেরও একই অবস্থা। মনে মনে একটু ক্ষুব্ধও হয় আমানের প্রতি। যদি জান্নাত রাগ করে কথা না বলে? ভয় হয় নিরবের। নিরব অতি গোপনে নিজেকে সামলে নেওয়ার চেষ্টা করে বলে,
“কিন্তু আমি তো ওর জন্য ফুলগুলো আনিনি স্যার।”
“তাই নাকি? তাহলে কার জন্য এনেছ? গার্লফ্রেন্ড আছে?” ভারী অবাক হওয়ার ভান ধরে বলল আমান। এই প্রশ্নে জান্নাতও যেন একটু আঁৎকে উঠল। শঙ্কা নিয়ে তাকালো নিরবের দিকে। নিরবের হয়েছে এখন মরার ওপর খাড়া ঘা! যেদিকে যাচ্ছে সেদিকেই বিপদ। আমান মুচকি মুচকি হাসছে। নিরবকে চুপ থাকতে দেখে আমান আবার বলে,
“আছে নাকি গার্লফ্রেন্ড?”
“না স্যার। জান্নাতের জন্যই এনেছি আমি ফুলগুলো।” চোখমুখ খিঁচে বলে নিরব। জান্নাতের চোখেমুখে অভিমানের আভাস। আমান বলে,
“শুনলে তো জান্নাত?”
জান্নাত নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। নিরব বলে,
“ফুলগুলো নিয়ে ঘরে যাও।”
“লাগবে না।” দাঁত কিড়মিড় করে বলে চলে যাওয়ার জন্য উদ্যত হতেই আমান পেছন থেকে বলে,
“নিরব তোমাকে ভালোবাসে।”
জান্নাত থেমে যায়। নিরব মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকে। এমনভাবে ফাঁসিয়ে দিলো? জান্নাত বিস্ময় নিয়ে তাকালো আমানের দিকে। আমান চোখের ইশারায় বোঝালো, ‘ঠিকই শুনেছ।’ জান্নাত নিরবের দিকে তীর্যকদৃষ্টি নিক্ষেপ করে সেখান থেকে চলে যায়। ও চলে যাওয়ার পরই যেন নিরব ঘোর থেকে বের হয়। আমানের পাশে বসে আক্ষেপের স্বরে বলে,
“কাজটা আপনি একদম ঠিক করেননি স্যার। এই কথাটা বলা একদম উচিত হয়নি। ও যদি এখন আর আমার সঙ্গে কথা না বলে? আমার কী হবে স্যার?”
“সে তোমাকে ভালোবাসে।”
জান্নাতের মতো নিরবও এবার বিস্ময় নিয়ে আমানের দিকে তাকায়। উৎফুল্ল হয়ে জিজ্ঞেস করে,
“কী করে বুঝলেন স্যার?”
“তুমি কখনো ওর চোখের দিকে তাকিয়েছ?”
“না স্যার। আমার লজ্জা লাগে।”
আমান হাসে। নিরবের পিঠে কয়েকটা চাপড় দিয়ে বলে,
“এবার থেকে তাকিয়ে দেখো। ঐ চোখে তোমার জন্য ভালোবাসা রয়েছে। সময় বিলম্ব না করে ভালোবাসার কথা জানিয়ে দাও।”
“ভয় করে স্যার। যদি ফিরিয়ে দেয়?”
“উঁহু। দেবে না।”
“ঠিকাছে। তাহলে বলে দেবো। তবে এখন নয়। কিছুটা সময় নিয়ে। এমনভাবে ভালোবাসার কথা জানাতে চাই যাতে ওর স্মৃতি হয়ে থাকে মুহূর্তটা।”
আমান হেসে বলে,
“ক্যারি অন।”
বিকেলের দিকে আমান একটু ঘুমিয়ে নেয়। সকাল সকাল উঠেছিল বলে ঘুমটা সম্পূর্ণ হয়নি। সকালের ঘুমটুকুই এখন পূরণ করে নিলো। ঘুম ভাঙে সন্ধ্যার আজানের সময়। ফ্রেশ হয়ে নিরবকে নিয়ে মসজিদে গেল নামাজ পড়তে। নামাজ পড়ে এসে দুজনে একটা চায়ের দোকানে বসে। চা অর্ডার দিয়ে ফোন করে নিহিকে। নিহি তখন পড়ছিল। পাশেই তরু আর মামী বসে আছে। ফোন সাইলেন্ট করা। মামী কিছুক্ষণ বসে থেকে নিজের রুমে চলে যায়। মামী চলে যেতেই তরু লাফিয়ে ব্যাগ থেকে ফোন বের করে। ঘরের দরজা লাগিয়ে দিয়ে বারান্দায় চলে যায়। নিশ্চয়ই এখন বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে ফুসুরফাসুর করবে। অযথাই আমানের ওপর রাগ হয় নিহির। বান্ধবীর বয়ফ্রেন্ডরা কী সুন্দর সারাক্ষণ ফোন করে, কথা বলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। আর এদিকে আমি! স্বামী আমার সে। তবুও বলবে, আগে ভালোমতো পড়ো। সময় অনেক পড়ে আছে প্রেম করার জন্য। পারেও লোকটা!
রাগ করে পরে আবার নিজেই হাসে। আর যাই হোক, ভালো তো বাসে ভীষণ। এটা অস্বীকার করার জো নেই।
টেবিলের ওপর থেকে ফোন নিয়ে থেকে ১০+ মিসডকল। সবগুলো কল আমানের। নিহি ব্যাক করতে যাবে তখন আমান নিজেই কল করে। নিহির বুকের ভেতর আবারও হাতুড়ী পেটা শব্দ হচ্ছে। নিহি ফোন রিসিভ করে বিছানায় এসে জানালার পাশে বসে। আমান জিজ্ঞেস করে,
“পড়ছিলে এতক্ষণ?”
“কী করে বুঝলেন?” উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করে নিহি।
আমান শব্দ করে হেসে বলে,
“পড়ার জন্যই তো আজ বউ আমার থেকে এত দূরে। তাহলে তো তার সর্বক্ষণ পড়ারই কথা।”
নিহি শব্দ করে হাসতে গিয়ে অন্য হাতে মুখ চেপে ধরে। পাছে আবার তরু বা মামী শুনতে পায়! মুখ টিপে টিপে হাসছে নিহি।
নিহির নিরবতা আমানের মাঝেও বিরাজ করছে। মুখ চেপে হাসিটাও অনুভব করতে পারছে আমান। আমান বলে,
“হয়েছে? হাসি শেষ?”
নিহি অনেক কষ্টে হাসি থামিয়ে বলে,
“হুম, বলুন।”
“দেখা করব।”
নিহি কথাটি শুনলেও শিওর হওয়ার জন্য অবাক হয়ে বলে,
“কী?”
“বলেছি। দেখা করব। আর এখনই।”
“এখন কীভাবে সম্ভব?”
“জানি না আমি। আপনি বাজারের দোকানে আসুন।”
“পাগল হয়ে গেছেন আপনি? সন্ধ্যা পেড়িয়ে রাত হতে চলল। এখন আমি কীভাবে বের হব? কেউ আসতে দেবে না।”
“বাজার থেকে তো বাড়ি খুব বেশি দূরে নয়। আপনার বোনকে নিয়ে আসেন।”
“হুহ! ও এখন আসবে না। ওর বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে কথা বলছে।”
“আমি এতকিছু জানি না।” বলে আমান যেই চায়ের দোকানে বসে আছে সেই দোকানের সাইনবোর্ডের দিকে তাকায়। একটু থেমে আবার বলে,
“বাহারী চায়ের দোকানে আছি আমি। দশ মিনিটের মধ্যে না আসলে সোজা আপনার মামার বাড়িতে গিয়ে উঠব। আর বলব, আমি আমার বউয়ের কাছে এসেছি।”
“এই নাহ্!”
“না আসলে এমনটাই হবে। আমি এখন রাখছি।”
খট করে আমান কল কেটে দেয়। নিহি কোনো দিক-দিশা খুঁজে পাচ্ছে না। সত্যিই কি না গেলে আমান বাড়িতে চলে আসবে? এমনটা করতে পারবে সে? নিহির তো এমনকিছু মনে হয় না। তবুও মনের মাঝে শঙ্কা থেকেই যায়। যদি দেখার আগ্রহে সত্যিই চলে আসে? বলা তো যায় না। প্রেমে পড়লে মানুষ কতকিছুই না করে। তাছাড়া আমানকে এক নজর দেখার ইচ্ছে নিহিও আটকে রাখতে পারছে না। নিহি বারান্দায় গিয়ে ফিসফিস করে তরুকে বলে,
“তরু চা খেতে যাবি?”
তরু ফোনটা কান থেকে নামিয়ে ভ্র কুঁচকে বলে,
“কী? চা খেতে?”
“হু। বাহারী চায়ের দোকানটা আছে না? সেখানে।”
তরু একটু সহাস্যমুখে বলে,
“পাগল হলি তুই? বাড়িতে বললে পিটিয়ে পা ভেঙে দেবে। মাকে বল চা বানিয়ে দিতে।”
নিহির আর কোনো কথা না শুনে তরু কথা বলায় মনোযোগ দিলো। নিহি বিড়বিড় করে বলে,
“ঘরে চা খেলে কি জামাইরে দেখতে পারব? বেদ্দপ!”
কথা বলার ধ্যানে থাকায় নিহির বিড়বিড় করে বলা কথাগুলো তরুর কান পর্যন্ত পৌঁছালো না। কিছুক্ষণ নিষ্পলকভাবে তরুর দিকে তাকিয়ে থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। কীভাবে যাবে এখন বাইরে? উদাসীনভাবে নিহি ঘরে চলে আসে। সোজা হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে। ঘরের ছাদের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে উপায় বের করার চেষ্টা করছে। তৎক্ষণাৎ মাথায় আসে লিমনের কথা। মনে পড়তে দেড়ি নিহির দৌঁড় দিতে দেড়ি হয় না। এক দৌঁড়ে লিমনের ঘরে চলে যায়। লিমন তখন সাউন্ডবক্সে অল্প সাউন্ড দিয়ে শুয়ে শুয়ে গান শুনছিল। চোখ বন্ধ ছিল বলে নিহিকে দেখেনি আর নিহির উপস্থিতিও টের পায়নি। এমন দারুণ একটা আইডিয়া মাথায় আসায় নিহি যেন খুশিতে আত্মহারা। পড়ি কি মরি করে লিমনকে ধাক্কিয়ে বলে,
“ভাইয়া!”
আচমকা শীতল হাতের স্পর্শে ধাক্কা খেয়ে হুড়মুড়িয়ে বসে লিমন। নিহিকে দেখে একটু ধাতস্থ হয়ে নিজ বুকে থু থু দেয়। এর নিহিকে ধমক দিয়ে বলে,
“মেরে ফেলতে আসছিস?”
নিহির মুখটা পাংশু আকার ধারণ করে। ক্ষণেই আবার মুখটা হাসিতে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। লিমনের হাত ধরে আবদারের স্বরে বলে,
“ও ভাইয়া চলো না বাজার থেকে চা খেয়ে আসি।”
লিমন চিবিয়ে চিবিয়ে বলে,
“আগে তোর সাপের মতো ঠান্ডা হাত দুটো সরা। তারপর কথা বল।”
নিহি এক পলক হাতের দিকে তাকিয়ে ঝড়ের গতিতে হাত সরিয়ে নিয়ে বলে,
“সরিয়েছি। এবার চলো।”
“কোথায় যাবি? চা খেতে?”
“হুম।”
“মাকে গিয়ে বল। দোকানের চায়ের থেকে মায়ের হাতের চা আরো বেশি মজা।” এতটুকু বলে লিমন আবার শুয়ে কম্বলের ভেতর ঢুকে যায়। নিহি আহতস্বরে বলে,
“প্লিজ ভাইয়া! চা খাব না আমি আইসক্রিম খাব।”
কম্বলের ভেতর থেকে লিমন মাথা বের করে বলে,
“পাগলে পাইছে তো আমারে তাই না? শীতের মধ্যে তোরে আইসক্রিম খাওয়াব!”
নিহি বুঝে যায় সোজা কথায় কাজ হবে না। তাই অভিমানি কণ্ঠে বলে,
“আমি তো আর আপন না! তরু বললে তখন ঠিকই নিয়ে যেতে। নীলম ভাইয়া থাকলে এতবার বলতে হতো না। আমার এক কথাতেই নিয়ে যেত।”
লিমন এবার চোখমুখ খিঁচে নিহির দিকে তাকায়। লিমনের চাহনী দেখে নিহির হাসি চলে আসছে। তবে হাসলে তো হবে না। তাহলে সব প্ল্যান শেষ হয়ে যাবে। তাই হাসিটাকে জোরপূর্বক আটকে রাখার চেষ্টা করছে নিহি। লিমন বিছানা থেকে নামতে নামতে বলে,
“ইমোশোনাল ব্ল্যাকমেইল ভালোই শিখেছিস। চল।”
নিহির মনে হলো তরু চাইলেই নিহির সঙ্গে যেতে পারত। তরু মূলত বয়ফ্রেন্ডকে সময় দেওয়ার জন্যই নিহিকে অজুহাত দেখিয়েছে। তাই তরুকে একটা উপযুক্ত শাস্তি দিতে নিহি বলে,
“ভাইয়া তরুও যেতে চেয়েছে। ওকে’ও ডাকো।”
“দুজনে প্ল্যান করেই রেখেছিলি না?”
নিহি মুখ টিপে হাসে। লিমন তরুকে এক ডাক দিতেই ফোন রেখে তরু ড্রয়িংরুমে আসে। তখন লিমন বলে,
“চল।”
তরু একবার নিহির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,
“কোথায় ভাইয়া?”
“ন্যাকামি! চল।”
তরু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে নিহির দিকে তাকায়। কী ন্যাকামি করল আবার? নিহি তরুর প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টিকে উপেক্ষা করে হাত টেনে ধরে বলে,
“চল তো।”
তিনজনে মিলে বাজারে যায়। যেতে যেতে নিহি তরুকে ফিসফিস করে বলে,
“বয়ফ্রেন্ডকে রেখে আসতে কেমন লাগল?”
তরু চোখদুটো বড় বড় করে বলে,
“তার মানে…”
নিহি নিজ ঠোঁটের ওপর এক আঙুল রেখে বলে,
“শসস! ভাইয়া জেনে যাবে।”
তরু দমে যায়। তবে রাগ হয় নিহির ওপর। নিহির হাত ছাড়িয়ে নিয়ে আগে আগে হাঁটা ধরে। বাহারী চায়ের দোকানটা রাস্তার ঐপাশে। তরু রাগের চোটে একাই রাস্তা পার হয়ে যায়। পিছন থেকে লিমন অনেকবার ডাকলেও শুনে না। এখানে কিছু না বললেও যে বাড়িতে গিয়ে তরুর খবর করবে এটা নিহি, তরু দুজনেরই জানা। লিমন নিহির হাত ধরে বলে,
“তোরও একা রাস্তা পার হওয়ার শখ আছে নাকি?”
লিমনের কথার ধরণ বুঝতে পারে নিহি। তড়িঘড়ি করে বলে,
“না, না।”
লিমন নিহির হাত ধরে গাড়ি দেখে দেখে রাস্তা পার করে নেয়। রাস্তা পার হতেই দেখতে পায় আমানকে। বুকের ভেতর আবারও ঢিপঢিপ আওয়াজ হচ্ছে। হাত-পা কাঁপছে। আমানের সামনে যাওয়ার জন্য পা চলছে না। লিমন পাশের দোকান থেকে আইসক্রিম কিনে তরু আর নিহিকে দিয়ে রাস্তা পার করে দেয়। দুজনকে বাড়ির সামনে পৌঁছে দিয়ে আবার বাজারে আসে। নিরব গিয়েছিল বাজারের টয়লেটে প্রাকৃতিক কাজ সারতে। এসে আমানকে জিজ্ঞেস করে,
“ম্যাম এখনো আসেনি স্যার?”
“তোমার এতক্ষণে আসার সময় হলো? এসে চলেও গেল।”
“কী বলেন? চড়ুইপাখির মতো দেখি! ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ করে এই উড়ে আসে আবার এই চলে যায়।”
আমান শরীর কাঁপিয়ে হেসে বলে,
“উঁহু! চড়ুইপাখি না। সে আমার নিহু পাখি।”
লিমন আবারও সেই পাশের দোকানটিতেই এসেছে। একটা সিগারেট নিয়ে দোকানের গ্যাস ম্যাচ দিয়ে সিগারেট জ্বালায়। প্রতিদিনকার অভ্যাস না হলেও মাঝে মাঝে সিগারেট খায় লিমন। নিরব আমানের সঙ্গে হাসতে হাসতে কথা বলার সময় দৃষ্টি যায় লিমনের দিকে। নিরব একটু জোরেই বলে,
“আরে, লিমন না?”
কারো কণ্ঠে নিজের নাম শুনে চকিতে লিমন পাশ ফিরে তাকায়। সিগারেটের ধোঁয়া নাকমুখ দিয়ে বের করে প্রায় আস্ত সিগারেটটাই মাটিতে ফেলে পা দিয়ে পিষে দেয়। তারপর এগিয়ে যায় চায়ের দোকানে। দুজন দুজনকে আলিঙ্গন করে। লিমন বলে,
“আরে ভাই তুই সিলেট আসছিস কবে?”
“কালকেই আসছি রে।”
“আমায় বলিস নাই ক্যান? বলছিলাম না এরপর সিলেট আসলে আমায় জানাবি?”
“রাগ করিস না। একটু ব্যস্ত ছিলাম তাই জানানো হয়নি। তারপর কেমন আছিস বল?”
“আমি তো ভালো। তোর কী খবর?”
“আলহামদুলিল্লাহ্।” বলে নিরব আমানকে দেখিয়ে বলে,
“উনি হচ্ছে আমার অফিসের স্যার। একটু দরকারি কাজে সিলেটে এসেছে।”
লিমন হাত বাড়িয়ে আমানের সাথে হ্যান্ডশেক করে কিছুক্ষণ কথাবার্তা চালায়। নিরব পরিচয় করিয়ে দেয় দুজনের।
লিমনের সঙ্গে নিরবের ফেসবুকে পরিচয়। কথা বলতে বলতে একটা সময়ে ভালো সম্পর্ক হয়ে যায়। লিমন এর আগে যখন ঢাকায় গিয়েছিল তখন নিরবের সঙ্গে দেখা করেছিল। কথা ছিল সিলেটে আসলে একবার ওদের বাড়িতেও আসতে হবে। নিরবও কথা দিয়েছিল। সব শুনে তো আমান সোনায় সোহাগা। এ যেন মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি! সিলেট আসাটা আমানের বৃথা যায়নি একদম। নিরবকে একটা বড়সড় ট্রিট দিতে হবে। নিহির কাজিন নিরবের বন্ধু! এরচেয়ে খুশির খবর আর কী হয়? লিমন নিরবকে অনেক জোড়াজুড়ি করে বাড়িতে যাওয়ার জন্য। নিরব ‘না’ করতে চাইলে আমান চোখের ইশারায় রাজি হতে বলে। যেখানে আমান নিজেই রাজি সেখানে তো নিরবের না বলার কোনো কারণ থাকতেই পারে না। তিনজন একত্রে বাড়িতে যায়। বাড়ির সামনে গিয়ে আমান নিরবকে ফিসফিস করে বলে,
“বাড়িতে কাউকে দেখে শকড খেলে নিজেকে সামলে নিয়ো। কিছু ফাঁস করে দিও না আবার।”
নিরব প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টিতে আমানের দিকে তাকায়। নিরব পিছন ফিরে বলে,
“কীরে? ভেতরে আয়।”
আমানের দিকে তাকিয়ে বলে,
“আসেন ভাই।”
আমান নিরবকে নিয়ে ভেতরে যায়। দরজা খুলে দেন মামী। ভেতরে গিয়ে লিমন ওদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। দুজনই মামীকে সালাম দেয়। মামী হাসিমুখে সালামের উত্তর নিয়ে ওদেরকে বসতে বলে। লিমন ওদের নিয়ে ড্রয়িংরুমে বসে গল্পগুজব করে। মামী রান্নাঘর থেকে নিহি আর তরুকে ডাকে। তরু নিহিকে বলে,
“একটু আগে যে ফাইজলামিটা করছিস তার জন্য আমি তোরে মাফ করে দেবো। তবে এক শর্তে। তুই মাকে গিয়ে বলবি, তরু ঘুমাচ্ছে।”
নিহি অবাক হয়ে বলে,
“আমি মাফ কখন চাইলাম? আর মিথ্যা বলব কেন? তুই তো বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে কথা বলছিস।”
তরু এবার আহ্লাদী হয়ে নিহির গালে চুমু খেয়ে বলে,
“আমার লক্ষী বোন!”
নিহি হেসে বলে,
“ঠিকাছে।”
তারপর রান্নাঘরে গিয়ে মামীকে বলে,
“তরু ঘুমিয়েছে। আমায় বলো কী করতে হবে।”
“এত তাড়াতাড়ি ঘুমিয়েছে ও? কাজে ফাঁকিবাজি করার ধান্দা শুধু।”
“আচ্ছা বাদ দাও না! কী করতে হবে আমায় বলো।”
“ফ্রিজ থেকে আপেল, আঙুর, কমলা বের করে কেটে সুন্দর করে সাজা। আমি চা বানাচ্ছি।” বৈয়াম থেকে বিস্কুট বের করে পিরিজে সাজাতে সাজাতে বলেন মামী।
নিহি মামীর আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করে। কমলা ছিলে আপেল কাটতে গেলে মামী বলে,
“থাক, আপেল রাখ। তোর হাত কেঁটে যেতে পারে। তুই চা দিয়ে আয়। আমি আপেল কাঁটছি।”
“ঠিকাছে।”
নিহি চায়ের ট্রে নিয়ে ড্রয়িংরুমে যায়। আমান আর নিরবকে দেখে চমকে যায়। হাত থেকে ট্রে পরে নিতে গেলে সামলে নেয় দ্রুত। কিন্তু নিরব সামলে নিতে পারেনি নিজেকে। ভূত দেখার মতো চমকে যায়। লিমন জিজ্ঞেস করে,
“কী হলো নিরব?”
নিহি টি-টেবিলের ওপর ট্রে রেখেই দৌঁড়ে রান্নাঘরে চলে আসে। নিরবের হেঁচকি উঠে গেছে। আমান পরিস্থিতি সামলে নিতে বলে,
“মাঝে মাঝে ওর এমন হয়। খুব ক্লান্ত থাকলে এরকম করে। ঘুম চলে আসে ওর।”
“তাই নাকি? তাহলে মাকে বলছি খাবার দিতে। আজকের রাত এখানেই থাক। খালাকে ফোন করে বলে দিস আজ যাবি না।”
নিরব কিছু বলতে পারছে না হেঁচকির জন্য। লিমন নিহিকে ডেকে পানি দিয়ে যেতে বলে। ঐদিকে নিহির হাত-পা কাঁপাকাঁপি শুরু হয়েছে। নিহি তো আমানের কথা রেখেছে তাহলে আমান কেন এসেছে বাড়িতে? মামী নিহিকে আলতো ধাক্কা দিয়ে বলে,
“কীরে? পানিটা দিয়ে আয়।”
নিহি সম্মতি ফিরে পেয়ে পানির গ্লাস হাতে নিয়ে বলে,
“মামী ওরা কারা?”
“লিমনের বন্ধু।”
‘লিমনের বন্ধু’ বলে বিড়বিড় করতে করতে আবার ড্রয়িংরুমে যায়। কাঁপাকাঁপা হাতে পানির গ্লাস এগিয়ে দেয়। গ্লাসটা হাতে নেয় আমান। নিহির হাতে ইচ্ছে করে স্পর্শ করতেই নিহি চমকে আমানের দিকে তাকায়। আমান তখন সকলের অগোচরে চোখ মারে নিহিকে। এবার নিহির হেঁচকি উঠে যায়। কী মুশকিল! লিমন বলে,
“হলো কী রে তোদের?”
নিহির দিকে তাকিয়ে বলে,
“যা পানি খা।”
নিহি এক দৌঁড়ে রান্নাঘরে চলে আসে। জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢেলে ঢকঢক করে পান করে। এমনভাবে পানি পান করেছে যে জামার কিছুটা অংশ ভিজে গিয়েছে। শীতের মধ্যে শীত আরো বাড়িয়ে দিল! নিহি দম নিতে পারছে না। ওরা লিমনের বন্ধু? কী করে সম্ভব? এ কেমন মীরাক্কেল?
.
রাত ১২টা পার হয়েছে। ডিনার করতে যায়নি নিহি। ঘরেই বসে ছিল। সবার খাওয়া শেষ হওয়ার পর চুপিচুপি খাবার নিয়ে ঘরে চলে এসেছে। ফোনও দিতে পারেনি। লিমন সাথেই ছিল। তরু ঘুমিয়েছে। নিহির চোখে ঘুম নেই। তখন ফোনে একটা টেক্সট আসে আমানে।
‘ছাদে আসো।’
কী মুসিবত! এখন আবার ছাদে যেতে বলে। যদি কেউ দেখে ফেলে? অবশ্য যাওয়াটাও জরুরী। এসবের মানে কী আমানকে জিজ্ঞেস করতে হবে। অনেক লুকিয়ে চুরি করে নিহি নিঃশব্দে ছাদে প্রবেশ করে। সিঁড়ি বেয়ে ছাদে পা রাখতেই হাতে টান পড়ে। নিহি গিয়ে আছড়ে পড়ে আমানের বুকে। হকচকিয়ে যায় নিহি। যেই রাগ নিয়ে ছাদে এসেছিল তা নিমিষেই উধাও হয়ে গেছে। তবুও মেকি রাগ দেখিয়ে নিহি জিজ্ঞেস করে,
“এসবের মানে কী? বাসায় কেন এসেছেন?”
“কেন? খুশি হননি?”
“কথাটা খুশি হওয়ার বিষয় না। আপনারা লিমন ভাইয়ার বন্ধু?”
“উঁহু! আমি না। নিরব।”
“কীভাবে সম্ভব?”
“আল্লাহ্ চাইলে কী না সম্ভব?”
“তাই বলে এত বড় মীরাক্কেল?”
“হয়তো কোনো পূন্য করেছিলাম তাই আল্লাহ্ বার বার এত সুযোগ করে দিচ্ছে আমার নিহু পাখির কাছে আসার।”
নিহি লজ্জা পেয়ে আমানের বাহুবন্ধন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়। তাড়া দিয়ে বলে,
“কেউ জেগে গেলে সমস্যা হবে। আর আমায় না পেলে তো কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে।”
“কিচ্ছু হবে না। সবাই এখন ঘুমে। আর এমনকিছু হলেও নিরব সামলে নিবে। আমি নিরবকে বলে এসেছি।”
“প্রি-প্ল্যান হু?”
“ভালোবাসার প্ল্যান।”
“হয়েছে। আমি যাই। ঠান্ডা লাগছে।”
আমান আচমকা নিহিকে ঘুরিয়ে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে। গায়ের জ্যাকেট টেনে নিহিকে নিজের সাথে জড়িয়ে দু’হাতে জ্যাকেটসহ নিহিকে আবদ্ধ করে নেয়। কাঁধে মুখ রেখে ফিসফিস করে বলে,
“আমি থাকতে আমার বউয়ের ঠান্ডা লাগবে? অসম্ভব!”
আমানের উত্তপ্ত নিঃশ্বাস নিহির কাঁধে আছড়ে পড়ছে। নিহি শিউড়ে উঠছে প্রতিটি ক্ষণে ক্ষণে। আমানের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার ইচ্ছাও পোষণ করতে পারছে না। মুখ দিয়ে কথাও বের হচ্ছে না। শুধু মনে হচ্ছে আকাশসমান ভালোবাসা আজ নিহির আঁচলে এসে পড়েছে।”
আমান নিহির কাঁধে মুখ রেখেই গান ধরে,
“Tu hi ye mujhko bata de
Chahun main ya naa
Apne tu dil ka pata de
Chahun main ya naa
Tu hi ye mujhko bata de
Chahun main ya naa
Apne tu dil ka pata de
Chahun main ya naa
Itna bata doon tujhko
Chaahat pe apni mujhko
Yun tto nahi ikhtiyaar
Phir bhi yeh socha dil ne
Ab jo laga hoon milne
Poochhu tujhe ek baar
Tu hi ye mujhko bata de
Chahun main ya naa
Apne tu dil ka pata de
Chahun main ya naa.”
চলবে…
[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ। ]