#আড়ালে_আবডালে
#পর্ব_২৮
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
____________________
নির্ঘুম রাত কাটিয়ে ফোলা ফোলা চোখে ঘুম জড়িয়ে এসেছে আমানের। তবুও সময় বিলম্ব করেনি। ভোরের দিকে ঢাকায় পৌঁছে গেছে। নিরবকে বাড়ির সামনে নামিয়ে দিয়েছে। মিটিং শুরু হওয়ার দশ মিনিট আগেই অফিসে যেন আসে সেটাও জানিয়ে দিয়েছে। তারপর চলে যায় সোজা বাড়িতে। কলিংবেল বাজানোর পর দরজা খুলে দেন অনামিকা রহমান। সারা রাস্তা নিজে ড্রাইভ করে এসেছে। একটুও ঘুমানোর সুযোগ হয়নি বলে বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে আমানকে। অনামিকা রহমান অস্থির হয়ে বলেন,
“তুমি কাল রাতেই রওনা দিয়েছ?”
“হ্যাঁ।”
আমান ভেতরে যেতে যেতে প্রশ্ন করে,
“আব্বু কোথায়?”
“ঘুমাচ্ছে এখন। আমি রাতে আসতে বারণ করেছিলাম।”
আমান কোনো প্রতুত্তর না করে বাবা-মায়ের ঘরে যায়। বাবা আসিফ আহমেদকে একনজর দেখে ড্রয়িংরুমে ফিরে আসে। সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে বসে। অনামিকা রহমান কফি নিয়ে আসেন। আমান চোখ বন্ধ করে আধশোয়া হয়ে বসে ছিল। মায়ের ডাকে চোখ মেলে তাকায়। এক গাল হেসে কফিটা হাতে নিয়ে মাকে পাশে বসায়। অনামিকা রহমান একটু রাগীস্বরেই বলেন,
“তুমি আমার কথা কেন শোনো না ইদানীং?”
“কোন কথা শুনিনি?” কফিতে চুমুক দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করে আমান।
অনামিকা রহমানের রাগ হয়। আমানকে তিনি বকতে পারেন না। অনলের মতো আমান এত দুষ্টু নয়। অগোছালোও নয়। সবকিছু নিয়মমাফিক করে এবং বেশ গুছালো। তাই কখনোই আমানকে শাসন করার প্রয়োজন হয়নি। অনামিকা রহমান যে রাগ করেছে আমান বুঝতে পারে। মুচকি হেসে কফির মগ টেবিলের ওপর রেখে একহাতে মাকে বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করে মাথায় চুমু খেয়ে বলে,
“এত রাগ কেন হয়েছে আমার জানের?”
রাগ গলে পানি হয়ে যায় মায়ের। আমানের এক হাত নিজের হাতে নিয়ে চুমু খান। বলেন,
“এইযে সারা রাত ঘুম হয়নি। মাথা ব্যথা করবে না?”
“উঁহু! তবে করতো। এখন করবে না।”
“কেন করবে না?”
“এইযে আমার আম্মাজানের হাতের কড়া কফি খেয়েছি। মাথা ব্যথা এখন বাপ বাপ বলে পালাবে।”
তিনি হেসে ফেলেন। আমানের গালে হাত রেখে বলেন,
“কেন যে তোমার ওপর রাগ করে থাকতে পারি না!”
“সেই সুযোগ দিলে তো।”
“আমার রাজপুত্র।” কপালে চুমু খেয়ে বলেন তিনি।
আমান জিজ্ঞেস করে,
“তা তোমার ছোট রাজপুত্র কোথায়?”
“অনল তো সিলেটে গেছে।”
“কবে?”
“কাল সন্ধ্যায় বাড়ি থেকে বের হয়েছিল। গাড়ি নাকি ছেড়েছে আরো রাতে।”
“আব্বু অসুস্থ অনল জানে?”
“নাহ্। তোমার আব্বু বলতে বারণ করেছে। অনেকদিন হলো ও তো কোথাও ঘুরতে যায় না। উনি অসুস্থ জানলে তো মাঝরাস্তায় থাকলেও ব্যাক করত।”
“ভালোই হয়েছে। একটু ঘুরুক। মন ফ্রেশ হোক। অফিসের মিটিং ও করতেও পারতো না।”
“ও তো বলেই দিয়েছে, অফিসের সব কাজ তোমার।”
“সে আমার ছোট নবাব ভাই বলে কথা!” বলে আমান ও মা দুজনই হেসে ফেলেন।
মায়ের সঙ্গে আরো কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে অফিসে চলে যায়। সকালের নাস্তা ওখানেই করবে। ঘুম না হওয়ায় একটু টায়ার্ড লাগছে। তবে মিটিং সাক্সেসফুল করবেই।
.
.
আলস্য শীতের সকালে নিহির ঘুম ভাঙে সকাল দশটা নাগাদ। তরু তখনো ঘুমাচ্ছে। আগের চেয়ে শীত এখন কমে এসেছে। তেমন শীত লাগছে না এখন। নিহি কিছুক্ষণ চোখ বুজেই শুয়ে থাকে। তারপর আমানের কথা মনে আসতেই বালিশের পাশ থেকে ফোন বের করে। আমানের দুইটা ম্যাসেজ এসেছে। একটা রাতে এবং আরেকটা সকালে। আমান ঢাকায় ফিরে গেছে জেনে ভীষণ খারাপ লাগছে নিহির। হুট করেই চলে যেতে হলো তাকে? প্রথম ম্যাসেজ দেখে মন খারাপ হলেও পরের ম্যাসেজটা দেখে ঠোঁটে হাসি ফুটে ওঠে।
‘শুভ সকাল মিষ্টি বউ।’ ম্যাসেজটা বারবার পরে নিহি। আর মুচকি মুচকি হাসে। ফোনের রিংটোন বাজে। তরুর ফোন বাজছে। নিশ্চয়ই শিশির ফোন করেছে। তরুর ঘুম এখন কর্পূরের ন্যায় উড়ে যাবে। নিহি ওয়াশরুমে চলে যায় ফ্রেশ হতে।
দরজায় কড়াঘাত করছেন মামী। নিহি আর তরুকে ডাকছেন আর বলছেন,
“কীরে? আর কত ঘুমাবি? উঠ এবার।”
তরু তখন তড়িঘড়ি করে ফোন কেটে দিয়ে দরজা খুলে দেয়। মামী ঘরে প্রবেশ করে বলেন,
“নিহি কোথায়?”
“ওয়াশরুমে।” হাই তুলতে তুলতে উত্তর দেয় তরু।
“তুইও ফ্রেশ হ। সকালের নাস্তা কি দুপুরে খাবি?”
“আসছি যাও।”
মামী ঘর গুছাতে গুছাতেই নিহি ওয়াশরুম থেকে বের হয়। তারপর তরু ঢোকে। দুজনে একসঙ্গেই নাস্তা করতে আসে। টেবিলে এখন শুধু মামী আর লিমন। মামা সকালেই বাইরে চলে গেছেন। লিমনও মাত্রই ঘুম থেকে উঠেছে। মামী খাবার সাজিয়ে দিচ্ছেন। তরু আর নিহি গোমড়ামুখে লিমনের সামনের চেয়ারে বসে। লিমন এক পলক তাকিয়ে খেতে খেতে বলে,
“মুখে কী হইছে তোদের?”
দুজনই নিশ্চুপ। লিমন তখন মামীর দিকে তাকিয়ে বলে,
“দেখছো ওদের? যুক্তি করে আসছে।”
মামী হাসেন। লিমন আবার বলে,
“কীরে কথা বলবি না?”
“না।” তরুর উত্তর।
“তুইও বলবি না?” নিহিকে প্রশ্ন করে সে।
নিহির উত্তরও,
“না।”
লিমন আর কিছু বলে না। চুপচাপ খায়। খাওয়া প্রায় শেষ হলে তখন বলে,
“যা দুজনই রেডি হয়ে নে।”
অবাক হয়ে দুজন ওর দিকে তাকায়। তারপর নিজেদের দিকে চাওয়া-চাওয়ি করে জিজ্ঞেস করে,
“কোথায় যাব?”
“জাফলং না যেতে চাইলি?”
নিহি ভেংচি কেটে বলে,
“না,এখন আর যাব না।”
“হয়েছে। আর রাগ দেখাতে হবে না। তোরা কি ভেবেছিস তোদের একা যেতে দেবো?”
তখন তরু বলে,
“একাও যাব না। তোমার সাথেও যাব না। আমরা যাবই না।”
লিমন ধমক দিয়ে বলে,
“বেশি কথা বলবি না। যা বলছি তাই কর। যা।”
আর কথা বাড়ানোর সাহস হয় না কারো। খাবার শেষ করে রেডি হতে চলে যায়।
_____________________
আড়মোড়া ভেঙে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায় অনল। ভোরে সিলেটে পৌঁছেই ঘুম দিয়েছে। এখনো সবাই মরার মতো ঘুমাচ্ছে। কখন ঘুম ভাঙবে আর কখন যাবে? কিছুক্ষণ পায়চারি করে আবার ঘরে ফিরে আসে। মিলনের পিঠে আস্তে লাথি দিয়ে বলে,
“শালা ওঠ! আর কত ঘুমাবি?”
“দোস্ত আর একটু ঘুমাই!” ঘুম ঘুম কণ্ঠে বলে মিলন।
গায়ের থেকে লেপ টেনে সরিয়ে বলে,
“উঠবি নাকি পানি ঢালব? আমি ফ্রেশ হতে যাচ্ছি। এসে যেন দেখি সবাই উঠেছিস। উঠ! লিসা, সুমু ওদের কল দিয়ে দেখ উঠেছে নাকি।”
এক রুমে ওরা তিনজন ছিল। অনল ফ্রেশ হতে চলে যায়। বাকি দুজন বসে বসে ঝিমায় কিছুক্ষণ। তারপর কল করে সুমাইয়াকে। ওরা-ও এখনো ঘুমাচ্ছে। সবাইকে তাড়াতাড়ি রেডি হতে বলে সাকিব কল কেটে দেয়। অনল ফ্রেশ হয়ে বের হলে ওরা-ও ফ্রেশ হয়ে নেয়। তারপর সবাই একসঙ্গে খেয়ে প্রথমে চা বাগান দেখতে চলে যায়।
চা বাগানের প্রতিটি কচি সবুজ চা-পাতায় যেন মুগ্ধকর সৌন্দর্য। উঁচু নিচু পাহাড়ের গায়ে চা-পাতার চাষ। প্রতিটি পাতার ডগায় ডগায় শিশিরবিন্দু। পাহাড়ি মেয়েরা পিঠে ঝুড়ি বেঁধে পাতা সংগ্রহ করছে। অনল ক্যামেরা নিয়ে এসেছিল। এত সুন্দর দৃশ্যকে ক্যামেরাবন্দি করতে ভুলে না। কিছুক্ষণ চা-বাগানের ভেতর হাঁটাহাঁটি করে, সবাই মিলে ছবি তোলে। পাহাড়ি দোকানে একসঙ্গে ধোঁয়া ওঠা গরম চা পান করে। সবকিছুকেই বড্ড আপন আপন লাগছে অনলের। মনের ভেতর প্রশান্তি লাগছে। কাল রাত পর্যন্তও যেই অস্বস্তি, অস্থিরতা তাকে চেপে ধরেছিল আজ যেন সব চলে গেছে। মনে মনে দাম্ভিকতার সাথে হাসে অনল। নিহির থেকে নিজের মন ফেরাতে পেরেছে। শান্তি লাগছে। সিলেটে আসা বৃথা যায়নি একদম। বন্ধুদের জড়িয়ে ধরে ভালোবাসা প্রকাশ করতে ইচ্ছে করছে। ওদের জন্যই তো নিহি নামক অস্বস্তি থেকে বের হতে পারল। চোখ বন্ধ করে বড় বড় শ্বাস নেয় কিছুক্ষণ। এরপরের গন্তব্য জাফলং…
চলবে…
#আড়ালে_আবডালে
#পর্ব_২৯
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
____________________
শিশির ফোন করেছে। যেভাবেই হোক আজ তরুকে দেখা করতে হবে। ঐদিকে লিমনের সঙ্গে জাফলং যাওয়ার কথা। ভাইকে বারণ করার মতো সাহস তো তরুর নেই। আর সে বাসায় থাকলে বাইরে যাওয়াও অসম্ভব! কোনো দিকদিশা খুঁজে না পেয়ে তরু চিন্তিত হয়ে খাটের ওপর বসে আছে। নিহির রেডি হওয়া শেষ হলে চোখ যায় তরুর দিকে। রেডি হয়েছে বলতে শুধু খিমারটাই পরেছে নিহি। তরু তখন গালে হাত দিয়ে বসে আছে। বোঝাই যাচ্ছে কিছু একটা ভাবছে। নিহি পাশে বসে জিজ্ঞেস করে,
“কীরে? রেডি হবি না?”
সে এক পলক নিহির দিকে তাকায়। উপায় পেয়ে গেছে! চোখ দুটো উজ্জ্বল হয়ে ওঠে তার। নিহির হাত ধরে ফিসফিস করে বলে,
“একটা হেল্প করবি নিহি?”
“অবশ্যই। বল।”
“শিশির ফোন করেছিল।”
“দেখলাম তো।”
“বলল অনেক গুরুত্বপূর্ণ নাকি কথা আছে। যে করেই হোক আজ দেখা করতে হবে।”
“কিন্তু কী করে সম্ভব?”
“আছে একটা উপায়। কিন্তু তাতে তোর সাহায্য লাগবে।”
“আচ্ছা বল।”
“তুই ভাইয়ার সাথে জাফলং-এ যাবি।”
“আর তুই?”
“আমি বলব আমার পেট ব্যথা করছে। তুইও সাথে তাল মেলাবি।”
“তুই না গেলে আমি যাব না।”
“প্লিজ নিহি! বোঝার চেষ্টা কর। ভাইয়া বাসায় থাকলে আমি বের হতে পারব না। মাকে কোনোভাবে ঠিকই ম্যানেজ করতে পারব।”
নিহি অসহায়ভাবে তাকায় তরুর দিকে। এমনিতেই তো যাওয়ার ইচ্ছে ছিল না। এখন আবার তরুটাও যাবে না! নিহিকে চুপ থাকতে দেখে তরু শক্ত করে তার চেপে ধরে বলে,
“আর ভাবিস না! প্লিজ হেল্পটা কর।”
যেহেতু এই একটা উপায়ই ছিল তরুকে সাহায্য করার তাই অগত্যা বাধ্য হয়ে নিহিকে রাজি হতে হয়।
_______________
মাঝরাস্তায় অনলদের গাড়ি খারাপ হয়েছে। এমনিতেই লেট হয়েছে এখন আবার আরেক সমস্যা। এখানে গাড়ির ম্যাকানিক কোথায় পাওয়া যাবে তা কারোরই জানা নেই। রাগে গজগজ করছে অনল। মিলন তখন অনলকে ঠান্ডা করার চেষ্টা করে বলে,
“রাগ করিস না। আমি মামুকে ফোন করে জিজ্ঞেস করছি।”
“তোর আবার মামু আসলো কোথা থেকে? তোর তো কোনো মামা-ই নেই।” সুধালো সুমাইয়া।
মিলন তখন ফোনের কন্টাক্ট লিস্টে নাম্বার খুঁজতে খুঁজতে উত্তর দেয়,
“মায়ের সৎ ভাই! সিলেটেই বাড়ি।”
অনল গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ায়। খোলা রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে খুব একটা মন্দ লাগছে না। ধুলোবালি তেমন নেই। চারপাশে চাষ করা শাকসবজির জমি। কচি কচি শাকপাতা, টমেটো, লাউ আরও অনেক সবজি রয়েছে। মিলন এসে জানায় ‘ম্যাকানিকের ব্যবস্থা হয়েছে। তবে একটু সময় লাগবে।’
অনল বিরক্তির স্বরে বলে, “কী আর করার!”
.
.
প্রকৃতি কন্যা হিসেবে সিলেটের জাফলং সারাদেশে পরিচিত। খাসিয়া জৈন্তা পাহাড়ের পাদদেশে জাফলং অবস্থিত। এক কথায় সৌন্দর্যের লীলাভূমি যাকে বলে। পিয়াইন নদীর তীরে স্তরে স্তরে পাহাড়ের স্তূপ। সীমান্তের ঐ পাড়ে ইন্ডিয়ান পাহাড় টিলা, ডাউকি পাহাড় থেকে অবিরামধারায় প্রবাহিত হচ্ছে জলের ধারা। সিলেট নগরী থেকে ৬২ কিলোমিটার উত্তর পূর্বদিকে গোয়াইনঘাট উপজেলায় জাফলং-এর অবস্থান।
লিমন আর নিহি জাফলং-এ এসে পৌঁছিয়েছে মিনিট ত্রিশেক হবে। পানির ওপর ছোট ছোট পাথরের ওপর হাঁটছে নিহি। দু’হাতে বোরকাও ঠিকমতো সামলাতে পারছে না। যার দরুণ নিচের অংশটুকু পানিতে ভিজে যাচ্ছে। লিমন বলে,
“আরে আস্তে হাট! কিছু কিছু পাথর কিন্তু পিচ্ছিল। পড়ে যেতে পারিস।”
লিমনের বলতেই যতটুকু দেরি হয়, নিহির স্লিপ খেতে এক সেকেন্ডও দেরি হয় না। তৎক্ষণাৎ ভাগ্যিস লিমন ধরে ফেলেছিল। নিহি তখন ভয়ে জড়োসড়ো! সকলের সামনে না আবার বকাঝকা করে! কিন্তু নিহির ধারণা ভুল প্রমাণিত হলো। লিমন নিহির এক হাত ধরে বলে,
“বোরকা ভালো করে ধরে, এবার হাট!”
মুহূর্তেই নিহি আবেগপ্রবণ হয়ে যায়। নীলমের কথা বড্ড মনে হয়। সবসময় সব পরিস্থিতিতে নীলম ভাইয়াও ঠিক এভাবেই নিহিকে আগলে রাখতো। আজ ভাইয়া কতদূর! মাসে একবার দেখা হয় ঠিকই তবে আগের মতো কাছে তো আর পায় না! নিহিকে অন্যমনস্ক দেখে লিমন জিজ্ঞেস করে,
“রাগ করেছিস নাকি?”
অশ্রুসজল চোখে নিহি হেসে ফেলে। নিকাব পরার কারণে হাসিটা দৃশ্যমান না হলেও ভাসা ভাসা চোখের হাসিতে সব স্পষ্ট। লিমন নিজেও মৃদু হাসে। নিহি লিমনের হাত ধরে পানির ভেতরের পাথরের ওপর হাঁটছে। পড়তে নিলেই আবার খিলখিল করে হাসছে। তখন লিমন নিজেও হেসে ফেলে। হঠাৎ-ই হাসতে হাসতে লিমন থেমে যায়। নিহির হাত ধরে রেখেছিল বলে নিহিকেও সঙ্গে থামতে হয়। এক হাত সামনেই একটি সুন্দরী মেয়ে হাত দুটো বগলদাবা করে অগ্নিদৃষ্টিতে লিমনের দিকে তাকিয়ে আছে। দৃষ্টির নড়চড় হচ্ছে একটু পরপর। লিমনের থেকে ধরে রাখা হাতের দিকেও মেয়েটি বিস্ফোরিত দৃষ্টিনিপাত করছে। লিমন তখন হেসে বলে,
“আরে স্মৃতি! তুমি কখন এসেছ? তুমি যে আসবে আমায় বলোনি তো?”
লিমনের কণ্ঠ অবাকও বোঝালো। মেয়েটি এবার ওদের একেবারে কাছাকাছি এগিয়ে আসে। খুবই ঠান্ডা কণ্ঠে বলে,
“কেন? তোমার এসব কীর্তিকলাপ লুকানোর জন্য? আমি আসব জানলে তুমি আসতে?”
“কী বলছো এসব? তুমি আসবে জানলে তোমাকেও সঙ্গে করে নিয়ে আসতাম।”
“নাটক বন্ধ করো লিমন! কে এই মেয়ে?”
“আমার বোন।”
স্মৃতি নামের মেয়েটি এবার তাচ্ছিল্য করে হাসলো। বলল,
“মিথ্যাটা এখনো ঠিক রপ্ত করতে পারোনি তুমি। আর আমায় কি তোমার বোকা মনে হয়?”
“বোকা মনে হবে কেন?”
“সেটাই তো মনে হচ্ছে। আমি তরুকে বাইরে দেখেছি। আমার ফ্রেন্ড তোমায় এই মেয়ের সঙ্গে দেখে আমায় জানিয়েছে। আমি কিছু না জেনে এমনি এমনিই এসেছি ভেবেছো?”
“তোমার ভুল হচ্ছে স্মৃতি। ও আমার বোন ঠিকই। তবে ফুপাতো বোন।”
স্মৃতি এবার হাত তালি দিতে দিতে বলে,
“বাহ্! বাহ্! আর কত নাটক করবি তুই? প্রথমে বোন, এখন ফুপাতো বোন! আর কিছু বাকি নেই? তুই আমায় বিয়ে করে এখন আবার আরেক মেয়ের সাথে ঘুরে বেড়াচ্ছিস!”
বিয়ে! লিমন ভাইয়া বিয়ে করেছে? তার মানে এই মেয়েটিকেই ভাইয়া ভালোবাসে? পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে। অলরেডি মানুষ জড়ো হতে শুরু করেছে। পর্যটকমহল এলাকায় এভাবে সিনক্রিয়েট করার তো কোনো মানেই হয় না। নিহির ভাবনায় ছেদ পড়ে।
লিমন স্মৃতিকে শান্ত করার চেষ্টা করে বলল,
“প্লিজ স্মৃতি! উত্তেজিত না হয়ে চলো আমরা কোথাও বসি। পুরো বিষয়টা আমি তোমায় ক্লিয়ার করব।”
স্মৃতি এবার দ্বিগুণ রেগে বলে,
“কীসের কথা আমার তোর সাথে? অন্য মেয়ের হাত ধরে তুই ঘুরবি, আমি এসব সহ্য করব?”
স্মৃতি কিছুতেই লিমনের কোনো কথা শুনতে চাচ্ছে না। তখন নিহি বলে,
“আপু আপনি শান্ত হোন। আমরা বসে কথা বলি?”
আগুনে ঘি ঢালার মতো অগ্নিশিখার ন্যায় জ্বলে ওঠে স্মৃতি। নিহির দিকে তেড়ে এসে বলে,
“তুমি চুপ করো! তুমি কে হ্যাঁ? কে তুমি আমাদের মাঝে কথা বলার? একটা কথাও তুমি বলবে না।” এটা বলেই একটানে নিহির নিকাব খুলে ফেলে। হকচকিয়ে যায় নিহি, লিমন দুজনই।
নিহির ইচ্ছে করছে কতকগুলো কথা শুনিয়ে দিতে। এইটা কোনো কাজ করল? পুরো বিষয়টা না জেনে-বুঝেই লাফানো মেয়েদের ইচ্ছেমতো থাপ্রাতে ইচ্ছে করে নিহির। স্মৃতির মনের অবস্থাটা নিহি বুঝতে পারছে। আমানের সঙ্গে হুট করে কাউকে দেখলে নিহিও রাগ করবে। তবে পুরো বিষয়টা তো শোনা উচিত তাই না?
লিমন স্মৃতিকে বাঁধা দিয়ে বলে,
“তোমার যা বলার আমায় বলো। ওকে কিছু বলবে না।”
“বাঃ, বাঃ! কী দরদ! খুব দরদ তাই না? খুব জ্বলে তোর?”
“তুমি কি আমার কথাটা শুনবে প্লিজ?”
“তোরে বিয়ে করাটাই আমার ভুল হইছে ফকিন্নির বাচ্চা! আমার মতো মেয়েকে তুই ডিজার্বই করিস না কুত্তার বাচ্চা।”
সবেগে স্মৃতির গালে থাপ্পড় বসায় লিমন। রাগে থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে বলে,
“সবকিছুর একটা সীমা থাকে। আমার বাবা-মা তুলে গালি দেওয়ার সাহস হয় কী করে তোমার? এতক্ষণ ধরে বোঝানোর চেষ্টা করছি। বুঝতেই চাইছো না!”
স্মৃতির গাল বেয়ে পানি পড়ছে। রক্তচক্ষু দ্বারা তাকিয়ে রাগে কাঁপতে কাঁপতে স্মৃতি বলে,
“তুই আমার গায়ে হাত তুললি? তোর জীবন আমি অতিষ্ঠ করে ফেলব। সঙ্গে এই মেয়েরও! দেখিস তুই।”
এরপর হাতের উল্টোপিঠে চোখের পানি মুছতে মুছতে স্মৃতি চলে যায়। কৌতুহলপ্রবণ পর্যটকরা নিজেদের মাঝে কথা বলাবলি করছে। লিমন নিচে পানির দিকে তাকিয়ে আছে। নিহি বুঝতে পারছে না কী করবে বা কী বলবে। এমনটা কি হওয়ারই ছিল? উৎসুক জনতা এখনো আছে এখানে। নিহি নিকাব বেঁধে আস্তে করে বলল,
“এখান থেকে চলো ভাইয়া!”
লিমন কিছু না বলে হাঁটা শুরু করে। নিহি পিছু পিছু আসে। আজকের দিনটাই খারাপ গেল। নিহির নিজেরই খারাপ লাগছে খুব। তবে সত্যি বলতে স্মৃতি নামের মেয়েটাকে খুব বাজে লেগেছে নিহির। ব্যবহার, আচার-আচরণ, শৃঙ্খলা কিচ্ছু নেই! লিমনের কথা ভেবেই খারাপ লাগছে। কিন্তু বিয়ের ব্যাপারটা সবার কাছে লুকিয়েছে কেন?
হাজারও কথা ভাবতে ভাবতে নিহি অন্যমনস্ক হয়ে হাঁটছে। আশেপাশে আরো অনেক পর্যটকরাও যাওয়া-আসা করছে। ভীড়ের মাঝে একজন সুদর্শন ছেলের সাথে ধাক্কা খায় নিহি। অন্যমনস্ক ছিল বলেই এই ধাক্কাটা এখন খেতে হলো। ছেলেটির হাতের পানির বোতল মাটিতে পড়ে গেছে। যেহেতু ভুলটা নিহির তাই সে নিজেই মাটি থেকে পানির বোতল তুলে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘স্যারি!’ তখনই জবান বন্ধ হয়ে যায় নিহির। চোখ আটকে যায় সেই সুদর্শন পুরুষটির মুখের দিকে। সে নিজেও এমন ঘটনায় বিরক্ত হয়েছিল। তবে এবার নিকাব পরা নিহির চোখের দিকে তাকিয়ে আৎকে ওঠে। অনেক, অনেক বেশিই পরিচিত এই কাজলকালো চোখ দুটো। এই চোখের ভাষাও দীর্ঘপরিচিত। অস্ফুট স্বরে অনলের মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে,
“নিহি!”
চলবে…
[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ।]