আড়ালে আবডালে পর্ব-৪৪+৪৫

0
4139

#আড়ালে_আবডালে
#পর্ব_৪৪
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
________________

কাজল আঁখির ন্যায় কালো মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে আকাশজুড়ে। এইতো বোধ হয় এখনই ঝুপঝুপ করে বৃষ্টি নামবে। পাখিরা ফিরে চলেছে ওদের আশ্রয়স্থলে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে প্রকৃতির এই তেজী রূপ পর্যবেক্ষণ করছিল আমান। আজমল আহমেদের অফিসে জয়েন করেছে তিন মাস ধরে। বাড়ি থেকে অফিসের দূরত্ব বেশি হয়ে যাওয়ায় এই বাড়িতে থাকা। এখান থেকে আমানের অফিসটাই শুধু কাছে হয়। অনামিকা রহমান এবং অনলের কলেজ দূরে হওয়ায় তারা আগের বাড়িতেই থাকতেন। ছোট থেকেই আমানের একা থেকে অভ্যাস আছে। নিজের সব কাজ নিজেই করতে পারে। আগে অবশ্য শুধু ডিম ভাজিটাই পারত। বিদেশে পড়তে গিয়ে সব শিখে নিয়েছে৷ তাই একা থাকতে খুব বেশি অসুবিধা হয়নি ওর।

বারান্দায় বসে যখন আবহাওয়া অবলোকন করছিল তখন একটা ওড়না উড়ে এসে নিচে পড়ে। আমান উঁকি দিয়ে সরাসরি থাকা ফ্ল্যাটটির ছাদের দিকে তাকায়৷ একটা মেয়ে ছাদ থেকে উঁকি দিয়ে নিচে তাকিয়ে আছে। প্রচণ্ড বাতাসে চুলগুলো উড়াউড়ি করছে। কিছু চুল এসে মুখ ঢেকে রেখেছে। তাই মুখটা দেখা যাচ্ছিল না। এবার নিচের দিকে তাকালো। লাল রঙের একটা ওড়না রাস্তায় পড়ে আছে। তখন আমানের হুশ আসে ওর নিজের পোশাকও তো ছাদে শুকাতে দিয়েছিল। তৎক্ষনাৎ দৌঁড়ে ছাদে যায় সে। কাপড় তুলতে তুলতে বৃষ্টি পড়া শুরু করে। তাড়াতাড়ি করতে গিয়ে আনমনে একবার পাশের ছাদে তাকায়৷ সেই মেয়েটা! এবার মুখটা পরিস্কার দেখা যাচ্ছে৷ চিলেকোঠার আড়ালে লুকিয়ে পড়ে আমান। মেয়েটার অবাধ্য চুল হাওয়ায় উড়ছে। কপালে ভাঁজ পড়ে আছে। চোখেমুখে বিরক্তির ছাপ। কাপড়গুলো তুলে মেয়েটা দৌঁড়ে ছাদ থেকে নেমে যায়।

এক ধ্যানে কিছুক্ষণ মেয়েটার যাওয়ার পথে তাকিয়ে থাকে আমান। পা স্থির হয়ে আছে। বৃষ্টি এবার ঝুপ ঝুপ করে নেমেছে৷ অনমনস্ক থাকায় খেয়ালই করেনি৷ যখন খেয়াল হলো তখন আনমনেই হেসে ফেলে।

জানালার থাই গ্লাসে বৃষ্টি গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে। পাশেই একটা টেবিল। অনেকদিন বাদে প্রিয় একটা ডায়েরী বের করল আমান। কলমদানি থেকে কলম নিয়ে লিখতে শুরু করল,
‘এলোকেশী
কে সে তুমি?
দমকা হাওয়ায় ওড়না উড়ালে;
উড়ালে এলোকেশ
এলোকেশে দিওয়ানা হয়ে এখন আমার
পাগল, পাগল বেশ!’

ডায়েরীটা বন্ধ করে একবার আনমনেই হাসলো। তারপর বারান্দায় গিয়ে নিচে দাঁড়ালো। ওড়নাটা এখনো সেখানেই পড়ে আছে। মেয়েটা এমন কেন? ওড়না নিতেও আসলো না! ছাতা মাথায় আমান নিজেই নিচে নামে৷ দারোয়ান সিকিউরিটি রুমে বসে ঝিমুচ্ছিল। বৃষ্টি হচ্ছে বলে বাইরেও কোনো মানুষজন নেই৷ চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে ওড়নাটা নিয়েই ভেতরে চলে আসে আমান। সাবান দিয়ে খুব সুন্দর করে ধুয়ে পাশের রুমে ফ্যান ছেড়ে শুকাতে দেয়।

এরপর থেকে প্রায়ই আমান বারান্দায় আর ছাদে যেত। এলোকেশীকে দেখতে পেলেই লুকিয়ে পড়ত। কেন জানি আড়াল থেকে দেখতেই ভালো লাগত। এলোকেশী মুগ্ধময়ী প্রণয়িনী। তবে ছোট। এই ছোট মেয়েটার হাসিতেই যে এত মাদকতা এটা না দেখলে আমান জানতোই না। এইতো সেদিনের কথা। শরীরটা খারাপ লাগায় তাড়াতাড়ি অফিস থেকে বাড়িতে এসেছিল। বিকেলে যখন ছাদ থেকে কাপড় তুলতে যায় তখন দেখতে পেল সেই এলোকেশীকে। ছাদে ছোটাছুটি করছে ছোট ছোট কতগুলো বাচ্চাকে নিয়ে। আরেকজন মেয়ে সমানে বকেই চলেছে। এই মেয়েটাকে এর আগে অনেকবার দেখেছে আমান। এলোকেশীর চেহারার সাথে অনেক মিল। হয়তো বোন হয়। বকা খেয়ে এলোকেশী আরও খিলখিল করে হেসে ওঠে। সেই হাসিতে ঘায়েল হয় আমান।

আরেকদিনের ঘটনা। আমান অফিসে যাওয়ার জন্য বাড়ি থেকে বের হচ্ছিল। তখন সামনের ফ্ল্যাটটির ভদ্রলোক আমানকে জিজ্ঞেস করলেন,
“ভাই কি বাজারের দিকে যাচ্ছেন?”
“জি ভাই৷” মুচকি হেসে উত্তর দিল আমান।
লোকটি বলল,
“সমস্যা না থাকলে যদি একটু লিফ্ট দিতেন। একচুয়ালি আমার বাইকের হুট করেই কী যেন হয়েছে। এদিকে হাতে বেশি সময়ও নেই৷ ঠিক সময়ে অফিসে পৌঁছাতে না পারলে বুঝেনই তো!”

আমান আগের মতোই হেসে বলল,
“কোনো সমস্যা নেই ভাই। গাড়িতে বসুন।”
“থ্যাঙ্কস।” বলে সে গাড়িতে উঠে বসল। প্রথম পরিচিত হওয়ার পর্ব সে-ই শুরু করল। ডান হাত এগিয়ে দিয়ে বলল,
“হাই, আমি সৈকত।”
স্টিয়ারিং থেকে ডান হাত তুলে হ্যান্ডশেক করে আমান বলল,
“আমি আমান।”
“আগে তো এই বাড়িটা ফাঁকা ছিল। আপনি কি ভাড়া নিয়েছেন?”
“না। আমাদেরই বাড়ি এটা। তিন মাস হবে এসেছি।” হেসে বলল আমান।
“ওহ আচ্ছা। একাই থাকেন?”
“হ্যাঁ। যাতায়াতের সুবিদার্থে।”

যেতে যেতে আরও অনেক গল্পগুজব হয়। আমান সৈকতের চেয়ে বয়সে ছোট হওয়ায় তুমি করে বলতে বলল আমান। সৈকতও অনায়াসে তুমি তুমি করে কথা বলছিল। আমান তখন কৌশলে জিজ্ঞেস করে,
“আপনি তো ফুল ফ্যামিলি এখানে থাকেন?”
“না। আমি আর আমার স্ত্রী। তোমার মতোই অফিসের সুবিদার্থে এখানে থাকি।”
“তাহলে একটা ছোট মেয়েকে যে সেদিন দেখলাম। আপনার বোন?”
“কে? তুমি মনে হয় নিহির কথা বলছো।”
“আমি তো চিনি না তাকে৷ তার সাথে আরো একজনকে ছাদে দেখেছিলাম। চেহারার অনেক মিল রয়েছে।”
“ওহ। তাহলে মিহি আর নিহিকেই দেখেছ। মিহি আমার স্ত্রী। আর নিহি শালীকা হয়। আমার কোনো বোন নেই। ওকে আমার বোনের মতোই দেখি। কাল বিকেলে বাড়ি চলে গেছে।”
“ওহ।”
আমান কৃত্রিম হাসি হাসলো সৌজন্যতার খাতিরে। কিন্তু চলে গেছে শুনে মনটা কেন জানি বিষণ্ণতায় ছেয়ে গেল।

এভাবে সময় কেটে যায় আরো চার মাস। সৈকত আর মিহির সাথেও ভালো একটা সম্পর্ক হয়। এতদিনে নিহির কথা খুব করেই মনে পড়ত। কিন্তু তাই বলে কাজে ফাঁকি দিত না একদম। বাবার বিজনেসের হাল ধরেছিল শক্ত হাতে। কখনো কখনো অফিস থেকে ফিরতে রাত এগারোটাও পার হয়ে যেত। ফ্রি হয়ে মধ্য রাতে ডায়েরীটা নিয়ে বসত। মুক্তর মতো অক্ষরে লিখত,
‘নিহু! নিহুপাখি। তুমি কি আমার হবে? কখনো জানতে পারবে আমার মনের কথা? আচ্ছা আমি কি তোমায় ভালোবাসি?’
.
শুক্রবার। বন্ধের দিন। বাজার করে বাড়ি ফিরছিল আমান। তখন মিহির সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। সাথে সৈকতও ছিল। ওদের বাজারের ব্যাগ অনেকগুলো দেখে কয়েকটা ব্যাগ নিজের হাতে নিল আমান। গল্প করতে করতে তিনজনে একসাথে বাসায় আসে। মিহি আর সৈকত বায়না ধরে আজকে দুপুরের খাবার আমানকে ওদের বাড়িতেই খেতে হবে। আমান রাজি হয়। কথার ফাঁকে ফাঁকে কৌশলে মিহির মুখ থেকে নিহির সব খবর জেনে নেয়। নিহির স্কুল, স্বভাব-চরিত্র সব শোনে। নিহির করা দুষ্টুমির কথা বলতে গিয়ে মিহি কখনো হেসে লুটোপুটি খেয়েছে। আরো এক দফা বেশি ভালোবাসা অনুভব করা শুরু করেছিল আমান।

পরেরদিনই সকালবেলা নিহির স্কুলে সামনে চলে যায়। দূর থেকে লুকিয়ে কাঙ্ক্ষিত মানুষটির প্রিয় হাসি মুখ দেখে মনে শান্তি লাগে। এভাবে প্রায়ই যখনই নিহিকে দেখতে মন চাইতো ছুটে চলে আসতো স্কুলের সামনে৷ লুকিয়ে লুকিয়ে দেখে মনের তেষ্টা মেটাতো। কখনো মনের কথা জানানোর সাহস হয়নি। সাহস হয়নি বলতে মনে হয়েছিল এটা আসলে উপযুক্ত সময় নয়। একদিন স্কুল ছুটির সময় আমান নিহিকে দেখতে গিয়েছিল। নিহি তখন ক্লাসের এক ছেলের সাথেই ব্যাগ নিয়ে কাড়াকাড়ি করছিল আর উচ্চশব্দে হাসছিল। পাশেই আরো ছেলেমেয়েরা হাসাহাসি করছিল। এক মুহূর্তের জন্য মনে হয়েছিল নিহি বোধ হয় রিলেশনশিপে আছে৷ বাড়িতে এসে বিষন্ন মন নিয়ে আবার লিখতে বসল সে।
‘এলোকেশী,
তোমার হাসিতে মুক্ত ঝড়ে। আমার মনে শান্তি আনে। কিন্তু কেন আজ শান্তি নেই আমার মনে। কেন তোমার ঐ হাসি আজ আমার হৃদয়কে চূর্ণ-বিচূর্ণ করল? অন্য ছেলের জন্য কেন হাসবে তুমি? তবে কি তোমায় পাওয়ার আগেই আমি হারিয়ে ফেলেছি?’

কথাগুলো লিখতে লিখতে দু’ফোঁটা অশ্রু বিসর্জন দিল আমান৷ এভাবে কেটে যায় আরো পাঁচদিন। এই পাঁচদিনে একবারও আমান নিহিকে দেখতে যায়নি৷ মনের ভেতর অশান্তি হচ্ছিল খুব৷ থাকতে না পেরে পরেরদিনই গেল নিহিকে দেখতে। সকালে নিহির দেখা পায়নি বলে বিকেলে ছুটির সময় আবার গেছে। কিন্তু তখনও ওর দেখা পাওয়া যায়নি৷ পাবে কীভাবে দেখা? সেদিন তো নিহি আসেইনি স্কুলে।

বিষণ্ণ বিষাদিত মন নিয়ে বাড়িতে এসে সারপ্রাইজড হয়ে গেল। যখন দেখল থাই গ্লাসের অপর পাশের বারান্দায় নিহি দাঁড়িয়ে! আনন্দে আত্মহারা হয়ে ডায়েরীতে লিখেছিল,
‘তুমি আমার হও বা না হও
তাতে আমার কোনো আফসোস নেই।
আমি তোমায় ভালোবাসি,
আর ভালোবাসব।
না হয় সবসময় তোমার দৃষ্টির অগোচরেই থেকে যাব আড়ালে আবডালে।’

এভাবে কেটে যায় অনেকটা সময়। নিহির এস.এস.সি শেষ হয়। পরীক্ষার রেজাল্ট বের হওয়ার পর পুরো অফিসের সবাইকে মিষ্টি খাইয়েছিল৷ অথচ এই খবরটাও কখনো জানতেও পারেনি নিহি। নিহির যেই কলেজে পড়ার ইচ্ছে সেই কলেজের নাম জানলো মিহির মুখে। জেনে আনন্দিতও হলো৷ কারণ সেই কলেজেই শিক্ষকতা করেন অনামিকা রহমান৷ এবং ঐ ভার্সিটিতেই পড়ে অনল। তবে কলেজে খুব একটা যাওয়া হতো না। যতটা যাওয়া হতো স্কুলের সামনে। তার কারণও অবশ্য ছিল। ঐ কলেজের কমবেশি সবাই আমানকে চিনত। তারচেয়েও বড় কথা পাছে অনল বা অনামিকা রহমান কিছু টের পেয়ে যায়!

এখন বলছি সেদিনের কথা যেদিন মুগ্ধ করা ঐ হাসিমুখে অশ্রু দেখেছিল আমান। গাড়ি নিয়ে গিয়েছিল কলেজের সামনে। কিন্তু গাড়ি থেকে বের হয়নি। নিহিকে কাঁদতে কাঁদতে আসতে দেখে বুকের মাঝে মোচর দিয়ে উঠেছিল। ঐ মুখে হাসি থাকবে। অশ্রু নয়! সেদিনই প্রথম চিঠি পাঠায় নিহিকে৷ পিয়নকে এক্সট্রা টাকা দিয়ে নাম-ঠিকানাহীন চিঠি তার মাধ্যমে পৌঁছে দেয় নিহির কাছে। এরপরের কাহিনী আমার পাঠকদের জানা!
.
.
শুরু থেকে সবটা বিস্মিত ও মুগ্ধ হয়ে শুনল নিহি। একটা মানুষ কী করে এতটা ভালোবাসতে পারে? এতটা সময় ধরে কী করে অপেক্ষা করতে পারে। আমান পানির ভেতর হাত নাড়াচ্ছে। নিহি তাকিয়ে আছে তার দিকে। জিজ্ঞেস করে,
“আপনি জানতেন না আপনার ভাই আমায় পছন্দ করত?”
“না। কারণ তোমার পেছনে আমি কোনো লোক লাগিয়ে রাখিনি কখনো।”
“যদি জানতেন?”
“নিজেকে গুটিয়ে নিতাম।”
“যদি তার সাথে আমার রিলেশন হয়ে যেত?”
“আগের মতোই ভালোবাসতাম। তবে আড়ালে থেকে। তোমায় নিয়ে যে কতশত কবিতা, লেখা আমার ডায়েরীতে ভর্তি তা তুমি কল্পনাও করতে পারবে না।”
“আচ্ছা মীরাক্কেলভাবে বিয়েটা কী করে হয়ে গেল?”
“সেটা আমিও জানি না। তবে প্রতি ওয়াক্তে নামাজ পড়ে আমি আল্লাহ্-র কাছে তোমাকে চাইতাম। হয়তো আল্লাহ্-র ইচ্ছেটা এমনই ছিল।”
“বিয়ের পরও আপনি চিঠি পাঠাতেন। কিন্তু কেন?”
“বলতে পারো সেটা এক প্রকার ছোট্ট পরীক্ষা করার জন্য।”
“মানে?”
“মানে আমি তো এমনিতেই সন্দিহান ছিলাম যে, তোমার কোনো বয়ফ্রেন্ড আছে কী-না। তার মধ্যে বিয়ের দ্বিতীয় দিনই তুমি ডিভোর্স চাইলে। আমি আরো ঘাবড়ে গেলাম। ভাবলাম, চিঠি দেওয়া বন্ধ করব না। যদি তুমি অন্য কোনো রিলেশনে থেকে থাকো তাহলে চিঠির প্রতি অনীহা থাকবে তোমার। আর যদি রিলেশনে না থাকতে তাহলে হয় ঐ চিঠির মালিকের প্রতি আকৃষ্ট হতে নয়তো আমায় ভালোবাসতে।”
“পরে তো জেনেছেন আমি কোনো রিলেশনে ছিলাম না৷ তবুও কেন চিঠি পাঠাতেন?”
“ঐযে বললাম! তাছাড়া আরো একটা কারণ ছিল। আমি লক্ষ্য করছিলাম তুমি ধীরে ধীরে আমার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ছো। আমি শিওর হতে চাচ্ছিলাম তুমি আসলেই আমায় ভালোবাসো কী-না!”
“কী? আপনি আমায় সন্দেহ করতেন?”
“না তো। শুধু ভয় দূর করেছিলাম।”
“আচ্ছা ঐ পিচ্চি ছেলেটা কে তাহলে? ওকে আমি অনলের বাইকেও দেখেছিলাম।”
“পিচ্চিটার নাম জিসান। আমি যেই ফ্ল্যাটে থাকি ঐ বাসার সিকিউরিটি চাচার ছেলে হয়। অনলের সাথেও ওর খুব ভাব।”
“হায় আল্লাহ্! আমি আরো ভেবেছিলাম চিঠিগুলো অনল দেয়। আচ্ছা সেদিন যে আমি ঐ পিচ্চিটার পিছু পিছু দৌঁড়াচ্ছিলাম তখন কি আমায় ফলো করছিলেন?”

এবার আমান হাসতে হাসতে বলল,
“আরে না৷ আমি অফিস থেকেই ফিরছিলাম। তোমায় বাসায় পৌঁছে দেওয়ার পর জিসান ওর মায়ের ফোন থেকে ফোন করে আমায় সব বলেছিল।”
“কী বলেছিল?”
“বলেছিল, ‘ভাইয়া ভাবি আজকে আমায় যেই দৌঁড়ানি দিছে! পা ব্যথা হয়ে আছে আমার। তুমিও ভাবির সাথে দৌঁড়িয়ে পারবে না মনে হয়’।” শব্দ করে হাসতে হাসতে বলল আমান।

__________________

উপমার মুখোমুখি বসে আছে ছেলেটা। স্তব্ধ চারপাশ। মুখ ঢাকা ছেলেটির। উপমার মুখের বাঁধন খুলে দিতেই সে জড়োসড়ো হয়ে যায়। কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলে,
“ক…কে আপনি?”
ছেলেটি চেয়ারের সাথে হেলান দিয়ে বসে বলল,
“আমায় তো তুমি চিনবে না।”
“তাহলে আমায় এখানে নিয়ে এসেছেন কেন? কারা আপনারা? কী করেছি আমি?”
“তোমার দোষ একটাই। তুমি নিহির ফ্রেন্ড!”

উপমা এবার চুপ হয়ে যায়। ছেলেটি বলে,
“এখন খুব আফসোস হচ্ছে তাই না? আমিও তাই ভাবী। কেন যে তুমি নিহির ফ্রেন্ড হতে গেলে!”
“নিহিকে নিয়ে আপনার কী সমস্যা? নিহিকে চিনেন কীভাবে?”
“আরে, আরে! আস্তে। আস্তে প্রশ্ন করো। নিহির নাম শুনতেই ভয়েসের জোর দেখি বেড়ে গিয়েছে। ভয় করছে না এখন?”

ঢোক গিলে উপমা বলে,
“আমার প্রশ্নের উত্তর দিন।”
“আমি দিচ্ছি।” ছেলেটার পেছন থেকে উত্তর দিল একজন। কণ্ঠটা মেয়েলি। পরনে কালো শাড়ি। আস্তে আস্তে মেয়েটা যখন এগিয়ে এলো তখন মনে হলো শাড়িটা আসলে কালো নয়। নেভি ব্লু। চুলগুলো কোঁকড়া কোঁকড়া কোমর পর্যন্ত। ছেলেটি চেয়ার থেকে উঠে গেল। মেয়েটি বসল সামনে। লাইটের অস্পষ্ট আলোতেও মুখটা ভীষণ পরিচিত। মেয়েটি খুব মিষ্টি করে হাসলো। খুশির হাসি। কোনো কিছু জয় করেছে বা জয় হবে এটা শিওর জানার পর যতটা হাসিখুশি একজনকে দেখায় সামনের মেয়েটিকেও ততটাই হাসিখুশি দেখাচ্ছে। চোখের কোটর থেকে চোখগুলো বেরিয়ে আসার উপক্রম হয়েছে উপমার। অস্পষ্ট স্বরে বলে,
“সুমাইয়া আপু!”

মেয়েটি চোখ পিটপিট করে বলল,
“আহা! সুমাইয়া নয়। আমি সামিয়া। সুমাইয়ার যমজ বোন। আমাদের দুজনকে একই রকম দেখতে তাই না?”
“আপনি! আপনি সুমাইয়া আপুর যমজ বোন?”
“কেন বিশ্বাস হচ্ছে না?”
তারপর পাশের ছেলেটিকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“আমাদের দু’বোনের ছবি বের কর তো ফোন থেকে।”
“আপনার সাথে নিহির কীসের শত্রুতা?” উপমার প্রশ্ন।

সামিয়া ঠোঁট বাকিয়ে বলল,
“সমস্যা তো আগে ছিল না ডিয়ার। ঐ মেয়েকে তো আমি চিনতামই না। আর একজন অচেনা মেয়ে আমার খুব কাছের একজনকে কেড়ে নিয়েছে। আমার আমানকে কেড়ে নিয়েছে।”

শেষের কথাটা চেঁচিয়ে বলল। উপমা ভয় পেয়ে যায়। সামিয়া আবার বলে,
“এতটা সময় ধরে আমি আমানকে ভালোবাসি। আর শেষমেশ কী-না অন্য একটা মেয়ে এসে আমার ভালোবাসা কেড়ে নিয়ে যাবে?”
“আপনি আমান ভাইয়াকে ভালোবাসেন বা না বাসেন তাতে নিহির কী? বিয়েটা তো ওদের কারো ইচ্ছেতে হয়নি।”
“তাই? তা বেশ তো,নিহি চলে যাক আমানের জীবন থেকে। তাহলেই তো সমস্যা সমাধান।”
“কখনো না। ওরা কখনোই আলাদা হবে না।”

সামিয়া উচ্চস্বরে হাসতে হাসতে বলল,
“বোকা মেয়ে! আলাদা হবে নাকি হবে না সেটা পরে দেখা যাবে৷ এইযে, তোমাকে এখানে নিয়ে এসেছি। সেটা কি এমনি এমনি? আমি তো জানি তোমার প্রতি নিহির ভালোবাসার গভীরতা। খুব গলায় গলায় পিরিত না দুই বান্ধবীর? অবশ্য এতে তো আমারই লাভ হয়েছে।”
“কী করতে চাচ্ছেন আপনি?”
“তেমন কিছু না। শুধু আমানের থেকে নিহিকে আলাদা করতে চাচ্ছি। আর সেটা তোমাকে হাতিয়ার করে। তোমার প্রাণের দাম নিশ্চয়ই আছে নিহির কাছে? এখন ঝটপট তোমার ফোনের লকটা খোলো। নিহির নাম্বারটা দাও।”
“দেবো না। প্লিজ নিহির কোনো ক্ষতি করবেন না আপনারা। আমায় ছেড়ে দিন।”
“ভালোভাবে বলছি। আমার কথা শোনো।” উপমার গালে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল সামিয়া।
“আপনার পায়ে পড়ি আমি। ছেড়ে দিন আমায়। আমি তো কোনো ক্ষতি করিনি৷ কেন আমায় আটকিয়ে রাখছেন?” কাঁদতে কাঁদতে বলল উপমা।
“ভয় নেই মনে? লক খোলো। ভালোভাবে বলছি শোনো। নয়তো…”
“নয়তো?”
“নয়তো নিহির ছোট্ট গুলুগুলু ভাস্তি তিতির আর তোমার আদরের ছোট বোনকে লাশে পরিণত হতে হবে।”
“অসভ্যর বাচ্চা! জঘন্য মহিলা তুই। ওদের কোনো ক্ষতি করার চেষ্টা করলে জানে মেরে ফেলব তোকে।” উত্তেজিত হয়ে বলল উপমা।

সামিয়া উচ্চস্বরে হেসে জোরে থাপ্পড় বসায় উপমার গালে। ফর্সা গালে হাতের ছাপ পড়ে যায়। চেয়ারের হাতলে দু’হাত রেখে উপমার দিকে একটু ঝুঁকে দাঁড়ায় সামিয়া৷ দাঁত কটমট করে বলে,
“যেখানে তোর নিজের জীবনই ঝুঁকিতে আছে,সেখানে তুই আমাকে মেরে ফেলার হুমকি দিস?”

চলবে…

#আড়ালে_আবডালে
#পর্ব_৪৫
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
__________________

ফোনের লক খুলে দিয়েছে উপমা। খুলতে বাধ্য হয়েছে। যেই মেয়ে অন্য মেয়েকে কিডন্যাপ করাতে পারে সেই মেয়ে ঐ ছোট বাচ্চা দুটোর ক্ষতিও করতে পারবে অনায়াসে।

সামনের চেয়ারে বসে খুবই উত্তেজিত হয়ে কন্টাক্ট লিস্ট চেক করছে সামিয়া। সেখানে নিহির কোনো নাম্বার নেই। মানে নিহি নাম দিয়ে কোনো নাম্বার সেভ করা নেই। কল লিস্ট চেক করেও কোনো নাম্বার পাওয়া যায়নি। বিরক্তের চরম পর্যায়ে পৌঁছে গিয়ে দাঁত কটমট করে জিজ্ঞেস করে,
“নিহির নাম্বার কোথায়?”

উপমা সরল কণ্ঠে বলে,
“আমি জানি না। ওর সঙ্গে অনেক আগে থেকেই আমার কোনো যোগাযোগ নেই।”
“মিথ্যা বলবে না একদম আমার সঙ্গে।”
“মিথ্যা কেন বলব আমি? নিজেই তো ফোন চেক করলেন।”
স্বল্পক্ষণ চুপ থেকে সামিয়া হাসলো। তারপর পাশের ছেলেটিকে বলল,
“যতগুলো নাম্বার ফোনে আছে সবগুলোতে ফোন দিয়ে দেখো। অন্য কোনো নামে ওর নাম্বার সেভ করা থাকতে পারে। কাল সকালের মধ্যে নিহির নাম্বার চাই আমার।”
“জি, আচ্ছা।”

সামিয়া চলে যাওয়ার পর ছেলেটি চেয়ারে বসলো। আলস্য নিয়ে ফোন চেক করতে করতে উপমার দিকে তাকালো। তারপর ফোনের টর্চ অন করে উপমার মুখের ওপর তাক করতেই চোখ বন্ধ করে ফেলে উপমা। চেঁচিয়ে বলে,
“কী সমস্যা? আমায় ছেড়ে দিন।”
ছেলেটি আহতস্বরে বলল,
“ফোনে যখন নাম্বার নেই তখন লকটা খুলে দিলে কী হতো? এই থাপ্পড়টা তো আর খেতে হতো না!”
“মায়া দেখাচ্ছেন?”
“মায়া হচ্ছে।”
ছেলেটি উপমার হাত-পায়ের বাঁধন খুলতে খুলতে বলল,
“ভোরের আলো ফোঁটার আগেই পালিয়ে যাও।”
“হোয়াট? কী বললেন? পালিয়ে যেতে?” চোখ দুটো বড় বড় করে জিজ্ঞেস করল উপমা।
বাঁধন খোলা হলে ছেলেটি সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল,
“এখান থেকে বের হয়ে সোজা দৌঁড়াবে। বাগানের শেষ মাথায় দেখবে একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। কোনো কিছু না ভেবেই সেই গাড়িতে উঠে পড়বে। সে তোমায় তোমার বাড়িতে পৌঁছে দেবে।”

সবকিছুই কেমন যেন স্বপ্নের মতো লাগছে উপমার কাছে। কিডন্যাপ করে এনে এখন বলছে পালিয়ে যেতে! কী অদ্ভুত! লোকটার মাথায় কি কোনো সমস্যা আছে? উপমা তখনো ঠায় বসে আছে। এবার ছেলেটি মৃদু ধমক দিয়ে বলল,
“কী হলো? বসেই থাকবে? নাকি পালাবে?”
“আপনি কি আমার সাথে মজা করছেন?”
“মজা করার মতো সময় এখন না। তুমি যাও।”

উপমা কী করবে না করবে ভেবে পেলো না ঠিকই৷ তবে মনস্থির করে নিলো সে পালাবে। ছেলেটি তখন বলল,
“যাওয়ার আগে তোমাকে যেভাবে বেঁধে রাখা হয়েছিল আমাকেও সেভাবেই বেঁধে রাখো।”
“কিন্তু কেন?”
“প্রশ্ন করবে না। বাঁধো।”

ছেলেটি চেয়ারে বসে পড়ল। উপমাও আর কিছু না ভেবে ওকে বেঁধে পালালো। বাহিরে ঘন জঙ্গল। তবে চাঁদের আলোয় সবটা পরিষ্কার। বাগানটা দেখে মনে হচ্ছে কেমন যেন ভূতুরে ভাব। শরীর শিউড়ে উঠে গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যায়। এরপর প্রাণপণে ছুটে চলে সামনের দিকে। তবুও বাগান শেষ হয় না। দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে দূর থেকে একটা গাড়ি দেখতে পায়। পা ব্যথা হয়ে গেছে। তবুও উপমা দৌঁড়ায়। গাড়ির সামনে গিয়ে কিছুক্ষণ হাঁপায়। তারপর দরজা খুলে পিছনে বসে পড়ে। সামনে যিনি বসে আছে তিনি কোনো কথা না বলে গাড়ি চালানো শুরু করে।
.
.
খাঁ খাঁ দুপুরের তপ্ত রোদ মাথার ওপর। ভ্যাপসা গরমও পড়েছে। অস্থির অস্থির লাগছিল খুব। পাশাপাশি সিটে বসে আছে আমান এবং নিহি। গাড়ি ড্রাইভ করছিল নিরব। নিহির কান্নার বাঁধ মানছে না। হাউমাউ করে কান্না করছে বাচ্চাদের মতোন। আমানের নিজের চোখেও পানি। নিহিকে সামলানোর মতো শক্তিও যেন লোপ পেয়েছে।

সকাল দশটার দিকে নীলমের ফোন এসেছিল। নিজাম ইসলাম এক্সিডেন্ট করেছেন। হাসপাতালে ভর্তি এখন। অবস্থা খুবই ক্রিটিকাল। খবরটা শোনার পর থেকেই নিহির কান্না শুরু হয়েছে। কোনোভাবেই ওর কান্না থামানো যাচ্ছে না। তখনই ওরা রওনা দিয়েছে ঢাকার উদ্দেশ্যে। শিশির তরুকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছে। নিহি এখনো বাচ্চাদের মতো কাঁদছে। আমান ওর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলে,
“শান্ত হও নিহু।”
কান্নার গতি বাড়ে আরও। হেঁচকি উঠে যায়। হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলে,
“আব্বুর কিছু হবে না তো? ভাইয়া কী বলেছে বলেন?”
আমান কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল,
“তেমন কিছু হয়নি৷ তুমি শান্ত হও।”

মনে মনে ব্যথিত হলো আমান। নিহিকে মিথ্যে বলতে হলো। অবস্থা অনেক গুরুতর নিজাম ইসলামের। কিন্তু নিহিকে সেটা বলা যাবে না। গোপনে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো তার।
_____________

জানালা দিয়ে রোদ ঘরে প্রবেশ করছে। জানালার পাশাপাশি বিছানা হওয়ায় রোদ বিছানাতেও ছড়িয়ে পড়েছে। যার ফলে কিছুটা গরম অনুভব হয় বিছানায় বসলে। অনল বারান্দায় বসে সিগারেট খাচ্ছে। ইদানীং ওর নতুন সঙ্গী হচ্ছে সিগারেট। আগে সিগারেটের ধোঁয়া সহ্য না হলেও এখন এটা খুব প্রিয়। বলা যায় ভালো থাকার টনিক। আগের অনলের মাঝে আর এখনকার অনলের মাঝে বিস্তর তফাৎ। কলেজেও যায় না। কারো সঙ্গে প্রয়োজন ছাড়া কোনো কথাও বলে না।

‘আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে দেখতে আমি পাই নি।
তোমায় দেখতে আমি পাই নি।
বাহির-পানে চোখ মেলেছি, আমার হৃদয়-পানে চাই নি॥
আমার সকল ভালোবাসায় সকল আঘাত সকল আশায়
তুমি ছিলে আমার কাছে, তোমার কাছে যাই নি॥
তুমি মোর আনন্দ হয়ে ছিলে আমার খেলায়–
আনন্দে তাই ভুলেছিলেম, কেটেছে দিন হেলায়।
গোপন রহি গভীর প্রাণে আমার দু: খসুখের গানে
সুর দিয়েছ তুমি, আমি তোমার গান তো গাই নি॥’

ফোনে রবীন্দ্র সঙ্গীত শুনছিল আর সিগারেট ফুঁকছিল। তখন দরজায় জোরে জোরে করাঘাতের শব্দ হয়। বিরক্ত হয় অনল। বারান্দা থেকে ঘরে যেতেই শুনতে পায় মিলন আর সাকিবের গলার স্বর। দরজা খুলে দিতেই মিলন স্থিরতা হারিয়ে বলে,
“দোস্ত তাড়াতাড়ি চল।”
চরম বিরক্ত হয়ে অনল জিজ্ঞেস করে,
“কোথায় যাব?”
“সুমাইয়ার বাসায়।”
“আমি এখন কোথাও যাব না। ভালো লাগছে না আমার। তোরা এখন যা।”
“দোস্ত সুমাইয়ার বোন সামিয়া মারা গেছে।”

এবার একটু সিরিয়াস হয় অনল। কপালে ভাঁজ টেনে বলে,
“সামিয়া না লন্ডনে পড়ত? দেশে ফিরেছে কবে?”
“অনেক আগেই। যখন নিহিকে নিয়ে তোদের ঝামেলা চলল। তখনই ফিরেছে।”
“কিন্তু মারা গেল কীভাবে?”
“কার এক্সিডেন্ট।”
“শীট!”
“দোস্ত চল যাই। বিপদে-আপদে সুমাইয়া সবসময় আমাদের পাশে থেকেছে। ওর খারাপ সময়ে এখন আমাদেরও ওর পাশে থাকা উচিত।”
“বস একটু। আমি ফ্রেশ হয়ে নিই।”

অনামিকা রহমান বাড়িতেই ছিলেন। দরজায় দাঁড়িয়ে কথা বলতে দেখে তিনি বললেন,
“আরে দাঁড়িয়ে কেন তোমরা? বসো।”
ওরা সালাম দিয়ে বলল,
“না ম্যাম। বসব না। সুমাইয়ার বোন যে এক্সিডেন্টে মারা গেছে শুনেছেন ম্যাম?”
“কী বলো?” অবাক হলেন তিনি৷ আবার বললেন,
“কবে হলো এক্সিডেন্ট?”
“আজই।”
“তোমরা কি ওর বাসাতেই যাচ্ছো?”
“জি ম্যাম।”
“আচ্ছা আমিও যাব।”
.
.
বাড়ির সামনে মানুষজন গিজগিজ করছে। সকল আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, প্রতিবেশীরা ছুটে এসেছেন। সবাই আহারে আহারে করছেন। বাড়ির ভেতর ঢোকা মুশকিল প্রায়। ঢেলেঢুলে ভেতরে ঢুকে দেখে সুমাইয়া আর ওর বাবা-মা আহাজারি করে কান্না করছেন। সামিয়ার লাশটি সাদা কাপড় দিয়ে ঢাকা। এক্সিডেন্টে পুরো শরীর থেঁতলে গেছে। পুলিশ এসেছিল। পোস্টমর্টেম করতে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু সামিয়ার পরিবার রাজি হয়নি। শরীরের যেটুকু অংশ বাকি আছে সেটুকু অংশ কাটাকাটি করতে চান না তারা। সুমাইয়ার পাশে বসে আছে লিসা। শান্তনা দেওয়ার বৃথা চেষ্টা করছে।

অনল, মিলন আর সাকিবও গিয়ে পাশে বসল। ওদেরকে পেয়ে সুমাইয়া আরো হাউমাউ করে কান্না শুরু করে। কান্নার জন্য কথাই বোঝা যাচ্ছে না। আর্তনাদ করে বলে,
“কেন এমন হলো বল তো? কেন ওকে এভাবে আমাদের ছেড়ে যেতে হলো!”
কেউই পারছে না শান্তনা দিতে। এই সময়ে কি কারো কোনো শান্তনা কাজে লাগে?
.
.
দুপুর গড়িয়ে গেলে নিহি আর আমান বাড়িতে পৌঁছায়৷ এর মাঝে নীলম একবার ফোন করেছিল আমানকে। কী কথা হয়েছে তা নিহি জানে না। জিজ্ঞেস করলেও আমান এড়িয়ে গেছে। প্রথমে ওদের হাসপাতালে যাওয়ার কথা ছিল। আমান যখন নিরবকে নিহির বাড়ির রাস্তা ধরতে বলল তখন নিহি জানতে চেয়েছিল কেন আমান হাসপাতালে না নিয়ে বাড়িতে ফিরে যাচ্ছে। মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হয়নি আমানের। সারা রাস্তা নিহি প্রশ্ন করে গেছে। এক পর্যায়ে আমান ধমক দিয়ে বলেছিল, “একটু শান্ত হয়ে বসো তো। পেইন দিও না। ভালো লাগছে না।”

নিহি চুপসে গিয়েছিল। ছলছল দৃষ্টিতে আমান নিহির দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলেছিল, “ক্ষমা করে দিও নিহু৷ তোমার সাথে এখন খারাপ ব্যবহার করা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না আমার। সত্যটা আমি বলতেও পারতাম না। তুমি সইতে পারবে না!”

বাড়ির মেইন দরজা খোলা। নিহি দৌঁড়ে ভেতরে যায়। আমান তার করা শপথ রাখতে পারেনি। নিহিকে একেবারে নিয়ে যাওয়ার আগেই এই বাড়ির ভেতরে আসতে হয়েছে। একটা কঠিন সত্যর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে এই শপথ অতি তুচ্ছ!

ড্রয়িংরুমে গিয়ে থমকে দাঁড়ায় নিহি। সাদা কাপড়ে শরীর ঢাকা নিজাম ইসলামের। শুধু মুখটা বের করা। সাহেলা বেগম অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছেন। কয়েকজন মহিলা তার জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা করছেন। তিতির তমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে আর বলছে, ‘মাম্মাম, দাদু উঠে না কেন? দাদুকে ডাকো? সবাই কাঁদছে কেন?’ মিহি হাত-পা ছড়িয়ে বসে কাঁদছে। সৈকত ওকে মানানোর চেষ্টা করছে। পাশের এক মহিলার কোলে মাহির। সেও কাঁদছে। এত মানুষ দেখে ভয়ে কাঁদছে নাকি মিহিকে কাঁদতে দেখে কাঁদছে তা বোঝা যাচ্ছে না।

নিহির মনে হচ্ছে সে হাওয়ায় ভাসছে। অন্ধকার লাগছে সবকিছু। নীলম কাঁদতে কাঁদতে নিহির দিকে এগিয়ে এসে নিহিকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। নিহি তখনও কিছু বুঝতে পারছে না। ওর মস্তিষ্ক কাজ করছে না। ঠোঁট কাঁপছে। ভাইকে কাঁপা কাঁপা স্বরে জিজ্ঞেস করে,
“আব্বু! আব্বু এভাবে শুয়ে আছে কেন ভাইয়া?”

নীলম নিহিকে ছেড়ে দিয়ে অন্যদিকে মুখ করে দাঁড়ায়। শার্টের হাতায় চোখ মুছে। বুক ফেঁটে কান্না আসে নিহির। জোরে চিৎকার দিয়ে ওঠে। আমানও তখন ভেতরে চলে আসে। নিহিকে ধরতে গেলে ছিটকে সরিয়ে দিয়ে নিজাম ইসলামের পাশে বসে। তার বুকে মাথা রেখে বলে,
“ও আব্বু! আব্বু রে তুমি এভাবে কেন শুয়ে আছো আব্বু? কথা বলো আমার সাথে। তুমি এভাবে কেন চলে যাবে বলো?”

নীলম নিহির পাশে বসে টেনে নিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলে,
“শান্ত হ বোন! শান্ত হ!”
চেঁচিয়ে কাঁদতে কাঁদতে নিহি বলল,
“কীভাবে শান্ত হতে বলো? আমার আব্বু কেন কথা বলে না? আব্বুকে কথা বলতে বলো ভাইয়া প্লিজ!”

চলবে…
[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ।]