#আড়ালে_আবডালে
#পর্ব_৫০ (অন্তিম পর্ব)
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
__________________
শীতের সকাল। কুয়াশার আড়ালে সূর্যের রক্তিম আভা। দেখতে অনেকটা ডিমের কুসুমের মতো লাগছে। শীতল বাতাস শরীরকে সিথিল করে দিচ্ছে। উত্তরে হাওয়া জানালার গ্রিলের ফাঁক-ফোঁকর দিয়ে প্রবেশ করছে। থাই গ্লাস খুলে রাখায় ঠান্ডা বাতাসের ঘরে প্রবেশ করার দুঃসাহস হয়েছে। আর এই দুঃসাহস দিয়েছে নিহি।
কোমরে শাড়ির আঁচল গুঁজে রুটি বেলতে ব্যস্ত নিহি। কখন থেকে আমানকে ডাকছে। কিন্তু শীতের অলসতা থেকে আমান বের হতে পারছে না। যতবার ডাকে ততবার একই কথা। ‘আরেকটু ঘুমাই!’ এই আরেকটু ঘুমাই আরেকটু ঘুমাই বলতে বলতে এক ঘণ্টা পার হতে চলল। তার ভাবসাব দেখে মনে হচ্ছে না এখন আর উঠবে বলে। আজ বোধ হয় অফিসও কামাই দেবে। দিনদিন অফিসে যেতেও তার বড্ড আলসেমি। তার অবশ্য কারণও আছে। আগে তাকে একা সামলাতে হতো পুরো অফিস। আর এখন সাহায্যর হাত যে আছে সাথে।
ঠান্ডা বাতাসের ফলে কাঁপুনী বেড়ে যাচ্ছে আমানের। লেপের ভেতর মাথা ঢুকিয়ে আঁটসাঁট হয়ে শোয়। এখন মনে হচ্ছে বাতাসের পরিমাণ বেড়েছে। কিন্তু জানালা দিয়ে তো এতো বাতাস আসার কথা নয়। লেপের ভেতর থেকে মাথা একটু বের করতেই পুরো ঘর বরফের মতো ঠান্ডা অনুভূত হয়৷ ওপরে তাকিয়ে রীতিমতো অবাক৷ ফ্যান ছেড়ে দিয়ে গেছে নিহি! ফ্যান বন্ধ করার জন্য হলেও এখন আমানকে বিছানা থেকে উঠতে হবে। ঠোঁট কাঁপা-কাঁপি শুরু হয়েছে। কাঁপতে কাঁপতে একটু জোরে চেঁচিয়ে বলে,
“নিহুপাখি, ফ্যানটা অফ করে দাও না প্লিজ! সত্যি বলছি আর বেশিক্ষণ ঘুমাবো না। আর দশ মিনিট।”
রান্নাঘর থেকে আমানের কথা শুনেও না শোনার ভান ধরে রইল নিহি। অগত্যা আমানকে উঠতেই হলো। রান্নাঘরে উঁকি দিতেই শয়তানি বুদ্ধি মাথায় আঁটে। প্যান্টের পকেটে দু’হাত ঢুকিয়ে হেলতে দুলতে রান্নাঘরে প্রবেশ করে। নিহির পাশেই দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়ায়৷ নিহি একবার তাকিয়ে আবার রুটি বানানোতে মন দেয়। আমান বলে,
“আমি হেল্প করি?”
“তার কোনো দরকার নেই। ফ্রেশ হতে যাও।”
“না বললে হয় নাকি? একটু তো হেল্প করা দরকার।”
“হু, তোমার হেল্প সম্পর্কে ধারণা আছে আমার। শুধু শুধু কাজ বাড়াবে।”
বাটি থেকে আটার গুঁড়ি নিয়ে নিহির কোমরে লাগিয়ে দিয়েই দৌঁড়ে রান্নাঘর থেকে আমান চলে যায়। নিহি কতক্ষণ হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর রান্নাঘর থেকেই চিৎকার-চেঁচামেচি করে। আমান বেডরুমে গিয়ে ফ্যান বন্ধ করে আবারও শুয়ে পড়ে। আর নিহির গালি শুনে হাসতে থাকে।
.
.
অফিসে এসে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছে অনল। গায়ে জ্বর। শীতের মধ্যে রাত করে গোসল করায় এই জ্বরটা বাড়িয়েছে। এমনিতে তো ঠান্ডা লাগছিলোই। জ্বরের কারণে আরও বেশি ঠান্ডা লাগছে। বমি দলা পাকিয়ে গলায় আঁটকে আছে। টক টক লাগছে গলার মাঝে। বমিটা হয়ে গেলে একটু শান্তি লাগতো। কিন্তু এখন সেটাও হচ্ছে না। পরক্ষণেই ভাবলো এই অল্পস্বল্প জ্বর আসলে কিছুই না। সুস্থতা, অসুস্থতা সবই এখন শুধু নিজের কাছে। চোখ বন্ধ করে কপালের ওপর হাত রেখে ডুবে যায় অতীতের সেই দিনটাতে। উপমা, নিহি, আমানকে সেদিন হাসপাতালে পাঠিয়ে দিয়ে লিসার কাছে যায় অনল। অনলের বাকি লোকেরা লিসাকে আটকে রেখেছিল। অনল লিসাকে ব্ল্যাকমেইল করেছিল। অনলের হাতে খুন হবে নাকি খুনের সব দায় নিজের ঘাড়ে নেবে। তৎক্ষনাৎ জীবনের মায়া ছিল লিসার। রাজি হয়ে যায় লিসা। মূলত লিসা রাজি হওয়ার পরই অনল পুলিশকে ইনফর্ম করে। মায়ের খুনি সাজায় লিসাকে। বাড়ির নিচের সুড়ঙ্গপথের আস্তানাটাকে লুকায়িতই রাখে। অনামিকা রহমানকে খুন করার দায়ে লিসার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছে। সেই ঘটনার আজ দুই বছর হতে চলল। এই দুই বছরে অনেক কিছু পাল্টে গেছে। আমানের সঙ্গে অনলের সম্পর্ক ঠিক হয়েছে। ভাই-ভাই মিলে গেছে। নিহির সঙ্গে হয়েছে বন্ধুত্বের একটা সম্পর্ক। অনল খেয়াল করেছে, এখনো অনলের মুখোমুখি হলে নিহির অস্বস্তিতে পড়া চেহারাটি। এই অস্বস্তির কারণ দুটো হতে পারে। এক. অতীতে অনলের করা বিশ্বাসঘাতকতা আর দুই.নিহিকে মায়ের খুন করতে দেখা।
অস্বস্তিতে নিহিকে খুব একটা পড়তে দেয় না অনল। সত্যি বলতে আমানের সঙ্গে নিহিকে দেখলে বুকের ভেতর চিনচিন করা সেই ব্যথাটা এখনো জেগে ওঠে। সহ্য করতে কষ্ট হয়। তার কারণ! তার কারণ, আজও যে আড়ালে-আবডালে শুধু নিহিকেই ভালোবাসে। অস্বস্তি থেকে নিহিকে দূরে রাখা এবং নিজেকে কষ্ট থেকে দূরে রাখার ব্যর্থ চেষ্টা করতেই দু’ভাই আলাদা বাড়িতে থাকে। আগের বাড়িটি ভেঙে নতুন করে নির্মাণের কাজ হাতে নিয়েছে আমান এবং অনল। অফিসে আসলে আমানের সঙ্গে দেখা হয়। নিহির সঙ্গে দেখা হয় না বললেই চলে। বলা যায়, অনল নিজেই চায় না। মাঝে মাঝে নিজেকে বড়ো একা লাগে তার। একাকিত্বরা ঘিরে ধরে। মরে যেতে ইচ্ছে করে তখন। কিন্তু মৃত্যু কি আর এতো সহজ? চাইলেই পাওয়া যায়?
চোখ মেলে বড়ো করে শ্বাস নেয় অনল। চোখের কার্ণিশে হাত দিয়ে দেখে অশ্রুকণা জমা হয়েছে। মৃদু হাসলো সে। দরজায় নক করছে তার পি.এ নীরা। অনল নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
“আসুন।”
নীরা দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে একটা ফাইল রাখলো টেবিলের ওপর। অনলের দিকে তাকাতেই চোখ দুটো বড়ো বড়ো হয়ে যায়। অস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করে,
“আপনার চোখমুখ এমন লাল হয়ে আছে কেন? আপনি ঠিক আছেন?”
অনল সোজা হয়ে বসে ফাইল ঘাটতে ঘাটতে বলল,
“একটু জ্বর এসেছে।”
তৎক্ষণাৎ নীরা অনলের কপালে হাত রেখে জ্বর মাপতে গেলে অনল সরে গেল। নীরার দিকে তাকিয়ে বলল,
“নিজের লিমিট ক্রস করবেন না।”
অনলের কথায় অপমানিত অনুভব করে নীরা। থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। অপমানে চোখমুখের বর্ণ পাল্টে গেছে। জোরপূর্বক মুখে হাসি টেনে বলে,
“আ’ম স্যরি স্যার। ফাইলটা দেখে রাখবেন। আমি আসছি।”
নীরা দ্রুত প্রস্থান করল সেখান থেকে। সে চলে যেতেই ফাইল রেখে অনল আবার চেয়ারে মাথা ঢেকিয়ে বসলো। অস্বস্তি হচ্ছে খুব। নীরা মেয়েটাকে কিছু বলা যায় না৷ একটু ধমক দিলেই গাঢ় কাজল কালো চোখ জোড়ায় বর্ষার আগমণ হয়। কখনো কান্না আটকে রাখতে পারে তো কখনো আবার পারে না। এই মেয়েটা কষ্ট পেলে কেন জানি অনলের নিজেরও খারাপ লাগে। তবে এই খারাপ লাগার অন্য একটা কারণ আছে। এই কারণটাই যথেষ্ট অনলকে কাবু করতে। নিহির সাথে নীরা মেয়েটার অনেক মিল রয়েছে। চোখ আর চুলগুলো একদম পাল্টানো যাবে। স্বভাবও নিহির মতো। সবচেয়ে অবাক করার বিষয় হচ্ছে, নীরাও একদিন নিহির মতো ভিম সাবান দিয়ে আপেল ধুয়ে দিয়েছিল। মূলত সেদিন থেকেই নীরাকে চোখে পড়েছে অনলের। আর নীরা যে কখন অনলের প্রেমে হাবুডুবু খেতে শুরু করেছে বুঝতেও পারেনি। কখনো বলতে পারবে নাকি সেটাও নীরা জানে না।
শরীরটা আরো বেশি খারাপ লাগছে। বিশ্রাম না নিয়ে উপায় নেই এখন। ফাইল না দেখেই বাড়িতে চলে যাওয়ার জন্য বের হয় অনল।
.
শিশির ভেজা ঘাসের ওপর পা ডুবিয়ে একসঙ্গে হাঁটছে নিহি, উপমা আর দীপ্ত। তিনজন আবারও একই ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে। পুরনো বন্ধুত্বের আড্ডায় প্রাণ ফিরে এসেছে। সংসার, ভার্সিটি দুটোই সামলাচ্ছে নিহি। সংসার বলতে আর তেমন কী! টুকটুকি আর আবুল তো আছেই। নিহি শুধু ওদের সঙ্গে টুকটাক কাজ করে।
ভার্সিটির ক্লাস শেষ করে নিহি একবার বাবার বাড়িতে যায়। বাড়িটায় এখন আর বাবা নেই। কষ্ট হয় খুব। বাবার কাছে চাওয়া শেষ ইচ্ছেটাও আর বলা হলো না। একটাবার বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলা হলো না ভালোবাসি! নিষ্ঠুরের মতো একা করে চলে গেল। বাড়ির দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বড়ো বড়ো শ্বাস নিয়ে কলিংবেল বাজালো। দরজা খুলে দিলো তিতির। নিহিকে দেখেই ফুপি ফুপি বলে জড়িয়ে ধরে। তিতিরকে কোলে নিয়ে চুমু খায় নিহি। ভেতরে গিয়ে দরজা লক করে সালেহা বেগমকে ডাকে।
“আম্মু!”
সালেহা বেগম ঘর থেকে বের হোন। এক গাল হেসে নিহিকে জড়িয়ে ধরে প্রাণভরে আদর করে দেন। সমস্ত মুখে চুমু খেয়ে বলেন,
“আমার ছোটো আম্মাজান!”
মাকে দেখলে কষ্ট হয় খুব। বাবার কথা তখন আরও বেশি করেই মনে পড়ে। নিহি মাকে জড়িয়ে ধরে বলে,
“আচ্ছা আম্মু তুমি আমার বাসায় আসো না কেন?”
“কোথাও যেতে ভালো লাগে না রে মা।”
“আমায় দেখতেও ইচ্ছে হয় না?”
“হয় তো! তখন তো আমার মা আমার কাছে চলেই আসে।”
“হুম বুঝলাম। আমার সাথে চলো। কয়টাদিন আমার কাছে থাকবে।”
“না রে, মা। আজ নয়। অন্য একদিন যাব।”
“তোমার অন্য একদিনটা কবে আসবে বলো তো?”
“যেদিন আসবে, সেদিনই যাব। এখন খাবি চল।”
নীলম অফিসে। তমা রান্নাবান্না শেষ করে টেবিল সাজাচ্ছে। নিহি তিতিরকে কোলে নিয়ে চেয়ারে বসে বলে,
“যেদিনই আমি আসি সেদিনই তুমি এতো রান্না কেন করো ভাবি?”
“এটা কেমন কথা? আমার আদরের ছোটো ননোদের জন্য এইটুকু করব না?”
নিহি মিষ্টি করে হাসলো। খাবার মাখতে মাখতে বলল,
“আচার বানিয়ে দিও তো মা।”
ভাবি তখন মজা করে বলে,
“কেন ননোদী? সুখবর আছে নাকি?”
“ভাবি!”
তমা শব্দ করে হেসে বলল,
“কী? ভাবি কী? আসবে নাকি নতুন অতিথি?”
“ধুর! যাও। আমি নিজেই তো একটা বাচ্চা।”
তিতির তখন নিহির গালে হাত রেখে বলে,
“আর আমি তোমার বাচ্চা।”
নিহি হেসে তিতিরের গালের সাথে গাল মেশায়। খাওয়া-দাওয়া শেষ করে কিছুক্ষণ গল্পগুজব করে। বাড়িতে যাওয়ার সময় তিতিরকেও সঙ্গে নেয়।
মাঝ রাস্তায় আমান ফোন করে। নিহি ফোন রিসিভ করতেই আমান বলে,
“কোথায় তুমি এখন?”
“বাড়িতে যাচ্ছি।”
“ওহ্। আমি অফিসে এসেছি বুঝেছো। অনলের শরীর ভালো না। জ্বর অনেক। অফিসে আসার আগে আবুল আর টুকটুকিকে পাঠিয়েছিলাম। ফোন দিয়ে খবর নিলাম জ্বর নাকি আরও বেড়েছে। তুমি যাও তো একটু ওর বাসায়। আমিও একটুপর আসছি।”
নিহি ইতস্তত করে বলে,
“আমি যাব?”
“হ্যাঁ, তাড়াতাড়ি যাও।”
আমান ফোন রেখে দিলো। নিহি রিক্সাওয়ালাকে রিক্সা ঘুরাতে বলল। অনলের বাসায় যাবে এখন।
______________
বিছানায় সোজা হয়ে শুয়ে আছে অনল। ডাক্তার এসে চেকআপ করে ওষুধ দিয়ে গেছে। আবুল পাশে বসে জলপট্টি দিয়ে দিচ্ছে। টুকটুকি স্যুপ বানাচ্ছে রান্নাঘরে। নিহির আসতে ত্রিশ মিনিটের মতো লাগে। কলিংবেলের শব্দ পেয়ে আবুল দরজা খুলে দেয়। নিহি জিজ্ঞেস করে,
“জ্বর কমেছে?”
“না আফামুনি। জ্বর তো কমতাছে না। চোখ লাল টকটকা হইয়া আছে।”
নিহি কোনো উত্তর করলো না। ভেতরে গেল। অনল চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। একটা চেয়ার টেনে অনলের মাথার সামনে বসলো। আবুলকে বলল,
“আবুল ভাই আমাকে আধা বালতি পানি এনে দিতে পারবেন?”
“হ৷ পারমু না ক্যান।আনতাছি।”
আবুল পানি আনতে যাওয়ার পর নিহি খুঁজে খুঁজে বড় মোটা একটা পলিথিন বের করে। নিহির কণ্ঠস্বর শুনে অনল চোখ মেলে তাকিয়েছে। পাশে বাবু হয়ে বসে আছে তিতির। ওর ছোটো ছোটো হাত দিয়ে অনলের মাথায় জলপট্টি দিয়ে দেয়। তিতিরের দিকে তাকিয়ে হাসে অনল। তিতির জিজ্ঞেস করে,
“তোমার কি খুব কষ্ট হচ্ছে পঁচা আঙ্কেল?”
অনল আগের হাসি বজায় রেখেই বলল,
“না, আম্মু।”
আবুল পানি আনার পর অনলের মাথার নিচে বালিশের ওপরে পলিথিন বিছিয়ে দিলো নিহি। মাথার সম্মুখে বসে মাথায় পানি ঢালে। চুলে হাত বুলাতেই বুঝতে পারে মাথার উত্তাপে ঠান্ডা পানিও গরম হয়ে যাচ্ছে। প্রায় বিশ মিনিটের মতো মাথায় পানি ঢেলে জ্বর কিছুটা কমায়। আবুল পরে টাওয়াল দিয়ে অনলের মাথা মুছে দেয়। খাটের সাথে হেলান দিয়ে বসিয়ে নিহি রান্নাঘরে যায়। টুকটুকিকে জিজ্ঞেস করে,
“হয়নি আপা?”
“হ, আপাজান। হইছে। লইয়া যান।”
স্যুপের বাটি নিয়ে ঘরে ফিরল নিহি। অনল খেতে নারাজ। নিহি রাগ দেখিয়ে ধমক দেয় অনলকে। বলে,
“খাবেন না কেন? না খেলে ওষুধ খাবেন কীভাবে? সুস্থ হতে হবে না?”
অনলের চোখমুখ শুকনো। শুকনো ঠোঁটেই হাসার চেষ্টা করে। চোখের দৃষ্টি এলোমেলো। তিতির বলে,
“ফুপি তুমি পঁচা আঙ্কেলকে বকো কেন? দেখছো না আঙ্কেল অসুস্থ!”
নিহি চুপ করে রইল। অনল হেসে বলে,
“এই বকাতেই ভালোবাসা খুঁজে নিই মামনী।”
নিহি ছোটো বাক্যে বলল,
“খেয়ে নিন।”
স্যুপের বাটি হাতে দিতে গিয়ে দেখল অনলের হাত কাঁপছে। নিজে থেকে সে খেতে পারবে না। নিহি তো নিজেও খাইয়ে দিতে পারবে না। তাই আবুলকে বলল খাইয়ে দিতে। স্যুপ খাওয়ার শেষের দিকে আমান আসে। আদরযত্ন করে ছোট ভাইকে ওষুধ খাইয়ে দেয়। এখন অনেকটাই সুস্থ লাগছে নিজের কাছে। আমান রাতে এখানে থাকতে চাইলেও অনল বারণ করেছে। নিজেকে সামলে নিতে পারবে বলেও জানিয়েছে। অনলের পীড়াপীড়িতে আবুলকে রেখে ওরা বাড়িতে ফিরে আসে।
.
.
শীতের কুয়াশায় সূর্যের অস্ত যাওয়াটাও দৃশ্যমান হয়নি। এখন চাঁদকেও দেখা যাচ্ছে না। কুয়াশার চাদরে ঢেকে গেছে ধরণী। হাত বাড়ালেই মনে হয় কুয়াশার মাঝে তলিয়ে যাওয়া যাবে। বারান্দায় বসে কুয়াশা দেখছিল আমান। তিতিরকে ঘুম পাড়িয়ে নিহিও আসে। আমানের কাঁধে হাত রেখে বলে,
“ঘুমাবে না?”
আমান কাঁধের ওপর থেকে নিহির হাত নিয়ে হাতের উল্টোপিঠে চুমু খেল। তারপর হাত টেনে ধরে কোলের ওপর বসায়। আমানকে আবেগী লাগছে। নিহিকে জড়িয়ে ধরে কান্না লুকানোর চেষ্টা করছে। আমানের চুলের মাঝে হাত বুলাতে বুলাতে নিহি জিজ্ঞেস করে,
“কাঁদছো কেন?”
“আগের কথা খুব মনে পড়ছে নিহু! বাবা-মা, নিরবকে খুব মিস করছি।”
নিহির বুকের ভেতর হু হু করে ওঠে। চোখে পানি চলে আসে বাবা আর নিরবের জন্য। বাবার তো রোড এক্সিডেন্টে মৃত্যু হয়েছিল। না চাইতেও মেনে নিতে পেরেছিল। কিন্তু নিরব! নিরবের মৃত্যুটা যে অনাকাঙ্ক্ষিত। শুধুমাত্র নিহিকে বাঁচাতেই ওর জীবন দিতে হয়েছে। নিরবের মৃত্যুটা এখনো মানতে পারে না নিহি। বুকের ভেতর উথাল-পাতাল শুরু হয়। ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকানোর চেষ্টা করে। এখন কাঁদলে চলবে না। আমানকে সামলাতে হবে। নিজেকে সামলে নিয়ে আমানের চোখের পানি মুছে দিয়ে বুকে মাথা চেপে ধরে বলল,
“কিছু অতীত মিষ্টি হয়। আর কিছু অতীত হয় বিষাদে গ্লানিত। তবে খুব কম মানুষের অতীতই সুন্দর হয়। যাদের অতীত সুন্দর ওরা হয় ভাগ্যবান নয়তো ভাগ্যবতী। আর দুনিয়ার এই ভাগ্যবান, ভাগ্যবতী মানুষগুলো খুব কম। আমাদের না চাইতেও অনেক অপ্রিয় সত্য মেনে নিতে হয়।”
আমান নিশ্চুপ। নিহি আবারও আমানের চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল,
“এখন চলো ঘুমাবে।”
আমান বারণ করল না।
__________________
পরেরদিনও অনল অফিসে যায়নি। জ্বর অনেকটা কমেছে কিন্তু শরীর দুর্বল। আমান সকালে অফিসে যাওয়ার সময় অনলকে দেখে গেছে। আর বারণ করে গেছে কিছুদিন অফিসে না যেতে। অফিসে এসে নীরার মন অস্থির। অনলের জ্বর কমেছে নাকি কে জানে! অফিসেও তো আসেনি। অনলকে না দেখে শান্তিও পাচ্ছে না। কোন বাহানায় অনলের বাসায় যাবে সেটাও বুঝতে পারছে না। নিজের মনের সাথে যুদ্ধ করে থাকতে না পেরে অবশেষে মনস্থির করল বাড়িতে যাবেই। না হয় বেহায়াই ভাববে। ভাবুক! তাতে কী আসে যায়? অসুস্থতার কথা বলে ছুটি নিয়ে অনলের বাড়িতে যায় নীরা।
দরজা খুলে দেয় আবুল। দরজার সামনে দাঁড়িয়েই নীরা জিজ্ঞেস করে,
“অনল স্যার বাড়িতে?”
“হ। আপনি কে?”
“আমি স্যারের পি.এ।”
“ওহ। আহেন। ভিতরে আহেন।”
নীরা ভেতরে গিয়ে অনলের ঘরের সামনে দরজায় নক করে বলে,
“আসব স্যার?”
অনল তখন বিছানায় আধশোয়া হয়ে ফোন চাপছিল। নীরাকে দেখে ঠোঁটে হাসি ফুঁটিয়ে বলে,
“আরে মিস নীরা! ভেতরে আসুন।”
নীরা ভেতরে গিয়ে পুরো রুমটা আগে ঘুরেফিরে দেখল। তারপর পড়ার টেবিলের চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসে বলল,
“এখন কেমন আছেন স্যার?”
“হ্যাঁ, আলহামদুলিল্লাহ। এখন অনেকটা ভালো।”
অনল আবুলকে ডেকে কফি বানাতে বলল। নীরা তখন বলল,
“আমি কিছু খাব না স্যার।”
“তা বললে হয় নাকি। ব্যাচেলর মানুষ তেমনকিছু খাওয়াতে পারব না।”
নীরা মিষ্টি করে হাসলো মাথা নুইয়ে। তারপর অনলের দিকে তাকিয়ে বলল,
“বিয়ে কেন করছেন না?”
“বিয়ে করে কী হবে?”
“এটা কেমন প্রশ্ন ছিল?”
“প্রশ্ন যেমনই হোক। উত্তর তো আছে।”
“না, নেই।”
“তাহলে আপনার প্রশ্নেরও কোনো উত্তর নেই।”
“সারাজীবন কি তাহলে সিঙ্গেলই থাকবেন? বিয়ে করবেন না?”
“আমি সিঙ্গেল কে বলল?”
“মানে? কেউ আছে আপনার?” ভয় আর আতঙ্ক নিয়ে প্রশ্ন করে নীরা।
অনল ঘোর লাগানো কণ্ঠে বলে,
“দৃশ্যমান নয় সে। আমার ভালোবাসার মানুষটি আড়ালে। আমি আড়ালেই তাকে ভালোবাসি।”
নীরার মনে আশার আলো উদয় হয়। খুশি খুশি লাগে। এর আগেও অনলের বাড়িতে অফিসের কাজের জন্য আসতে হয়েছিল নীরাকে। বেডরুমে অবশ্য আজই প্রথম। নীরা দেখেছে অনলের একটা নোটে নকশা করে এন(N) লেখা। মনে হলো, অনল কি তাহলে আমাকেই ভালোবাসে? আনন্দের পাশাপাশি লজ্জাও লাগছে। আজ তাহলে মনের কথাটা বলেই দিবে সে অনলকে। সেই প্রথম থেকে অনলের প্রতি যেই ভালোবাসার দানা বুকের জমিনে বুনতে শুরু করেছিল তার প্রকাশ আজ করবে। করতেই হবে। নীরা ভাবে অনলও নীরাকে ভালোবাসে। নীরা আমতা আমতা করে বলে,
“একটা কথা বলব।”
“হ্যাঁ, শিওর।”
“মানে! কীভাবে বলব বুঝতে পারছি না।”
“আরে বলুন। সমস্যা নেই।”
“হয়তো কথাটা শোনার পর আমায় বেহায়া মনে হবে। অথবা একটা মেয়ে হয়ে কথাগুলো নিজের বলা ঠিক হচ্ছে কী-না আমি সেটাও বুঝতে পারছি না।”
“আপনি বলুন। কোনো সমস্যা নেই।”
“আপনি হয়তো এতদিনে এটা বুঝতে পেরেছেন, আমি আপনাকে ভালোবাসি।”
অনল মৃদু হেসে বলল,
“কতটুকু জানেন আমার ব্যাপারে?”
“না জেনে ভালোবাসা যায় না?”
“জানলে হয়তো ভালোবাসতেই ইচ্ছে করবে না।”
“ভালোবেসেছি। ভালোবাসবো।”
“আমিও একজনকে ভালোবেসেছি। এখনো তাকেই ভালোবাসি!”
নীরার ভয় হচ্ছে। ভীতিগ্রস্ত হয়ে নীরা প্রশ্ন করে,
“কে সে?”
“আছে একজন।”
“আমি কি তাকে চিনি?”
“চিনতেও পারেন। নাও পারেন। আপনার প্রতি আমার পজিটিভ চিন্তাধারা,ব্যবহার দেখে হয়তো ভেবেছেন আমিও আপনাকে ভালোবাসি তাই না? আসলে এই ধারণাটা সত্য নয়। আমি আপনাকে পছন্দ করি। কিন্তু ভালোবাসি না। আপনি প্রায় অবিকল আমার সেই ভালোবাসার মানুষটার মতো দেখতে। আমি দেখেছি আপনি, এন(N) অক্ষরটা দেখে আপ্লুত হয়েছিলেন। মজার বিষয় হচ্ছে তার নামের প্রথম অক্ষরও এন(N)। নামের ঐ অক্ষরটা আমি আপনাকে নয় তাকে মনে করে লিখি। তার স্বভাবের সঙ্গে আপনার স্বভাব কিছুটা মিল আছে বলেই আমি আপনাকে পছন্দ করি। শুধুই পছন্দ। অন্য কিছু নয়।”
“তার মানে আপনি আমায় ভালোবাসেন না?”
“না। প্রথমদিকে আমার কিছু ফল্ট ছিল। নিজের দোষেই আমি তাকে হারিয়েছি। জানেন, সে আমায় বলেছিল, আমি যেদিন নিজের ভুল বুঝতে পারব সেদিন অনেক দেরী হয়ে যাবে। সত্যিই তাই হয়েছে। আর এতটাই দেরী হয়েছে যে, মনের মাঝখানে তার নাম খোদাই করে লেখা হয়ে গেছে। সেই লেখা কখনো মুছে ফেলা সম্ভব নয়। জখমও ধরবে না। ভালোবাসার নাম হয়ে চিরউজ্জ্বল হয়ে থাকবে। হয়তো কখনোই তাকে ভালোবাসি কথাটা বলতে পারব না। কারণ সেই অধিকার আমি বহু আগেই হারিয়েছি। জানি না আর কখনো জ্ঞানত আমি কাউকে ভালোবাসতে পারব নাকি!”
নীরা অভিমানীস্বরে বলে,
“আপনি তো বললেন আমি নাকি তার মতো। তাহলে আমায় কেন ভালোবাসতে পারবেন না? একটা সুযোগ তো দিন।”
অনল ব্যথিতভাবে মৃদু হেসে বলে,
“আপনি তার মতো। কিন্তু সে নন! আজও আড়ালে আবডালে আমি শুধু তাকেই ভালোবাসি।”
নীরার কষ্ট হচ্ছে। ভীষণ কষ্ট! ভালোবাসার মানুষটার মুখে অন্য কাউকে ভালোবাসার ব্যাখা শোনাটা কষ্টদায়ক। মানুষগুলো বড্ড অদ্ভুত! বড্ড! ছলছল নয়নে সে জিজ্ঞেস করে,
“সে কোথায় এখন? কথা হয় না?”
“হয়! আরও একটা কঠিন সত্য আছে। সে এখন অন্য কারো।”
“তাহলে তার জন্য আপনি কেন অপেক্ষা করে আছেন?”
“অপেক্ষা করে নেই তো! তার সুখ-ই দূর থেকে দেখি। একটা সময়ে তাকে পাওয়ার প্রবণতায় আমি পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম। তার বাবার কাছে পা ধরে তাকে চেয়েছিলাম। তিনি রাজি হননি। অপমান করে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিলেন। রাগে, জিদ্দে, অপমানে ভালোবাসার মানুষটির বাবাকে মেরে ফেলতেও দু’বার ভাবিনি।”
“মানে?” চমকে জিজ্ঞেস করে নীরা।
“মানে আমি খুনি! তাকে খুন করিয়েছি। এক্সিডেন্ট করিয়ে আমিই মেরেছিলাম তাকে। একজনকে খুনি কি কারো ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য?”
কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে নীরা। অনলের কথা বিশ্বাস করতে পারছে না। জ্বরের ঘোরে কি সে আবোলতাবোল বলছে? নীরা তাড়াহুড়ো করে বলে,
“আমার মনে হচ্ছে আপনার এখন রেস্ট নেওয়া উচিত স্যার। আমি না হয় পরে আসব।”
“আমি ঠিক আছি। আপনি বসুন। অনেকদিন ধরে বুকের ভেতর কথাগুলো পাথরচাপা দিয়ে রেখেছিলাম। আজ আপনাকে বলে শান্তি লাগছে।”
নীরা উঠতে গিয়েও বসে থাকে। অনল বলে,
“সে আমায় বলেছিল, সে আমায় ঘৃণাও করে না। আমি নাকি তার ঘৃণারও যোগ্য নই। একদিন তাকে বিপদ থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছি আমি। তারপর থেকেই আমার প্রতি তার অনুভূতি সংমিশ্রিত। সে আমায় ভালোওবাসতে পারে না। ঘৃণাও করতে পারে না। এই যে এখন তার সঙ্গে বন্ধুত্বের একটা সম্পর্ক আছে এটাই অনেক।
সত্যি তো এটাই আমি এখনো আড়ালে তাকেই ভালোবাসি। আর ঐ একটা সত্যিই লুকায়িত আছে। যেটা তার আড়ালে।”
“কোন সত্যি”
“ঐযে ওর বাবার খুনি আমি। ঐ এক্সিডেন্টটা আমিই করেছিলাম।”
_________________
বাগানের ফুলগুলোতে আজ নতুন নতুন ফুল ফুঁটেছে। সবগুলো গাছ আমান আর অনল মিলে লাগিয়েছিল। তার কারণ নিহির ফুল পছন্দ। পুরো বাড়িটা বানানো হয়েছি নিহির মনমতো করে। দো’তোলার বারান্দায় দাঁড়ালেই ফুলের বাগানটা দেখা যায়। সকালে আর রাতে ভেসে আসে ফুলের মিষ্টি গন্ধ। বিমোহিত হতে হয় নিহিকে। এতক্ষণ বারান্দায় দাঁড়িয়ে বাগান দেখছিল আমান। চোখ উপচে পানি আসতেই ঘরে চলে আসে। বারান্দার দরজা লাগিয়ে দেয়।
অনলের মৃত্যুর ৭ম দিন আজ। আমান অন্ধকার রুমে বসে কাঁদছে। নিহি আমানের কাছে গিয়ে বসে। কাঁধে হাত রেখে অসহায় দৃষ্টিতে তাকায়। আমান নিহির কোলে মাথা রেখে বাচ্চাদের মতো হাউমাউ করে কাঁদছে। নিহির বুকের ভেতর ঝড় বয়ে যাচ্ছে। অজানা কষ্টে বুকের ভেতরে হাহাকার করছে। এই অনুভূতির নাম নেই। আমানের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় নিহি। কাঁদতে কাঁদতে আমান বলে,
“কেন আমার সঙ্গে এমন হলো নিহু? বাবা-মাকে হারালাম। এখন ছোটো ভাইকেও। অনল কেন নিজেকে শেষ করে দিলো? ওর কষ্টটা কেন ভাগ করেনি বলো?হাসপাতালে ওর শেষ সময়ের করুণ মুখটা আমার চোখের সামনে ভাসছে। শেষ সময়টাও আমার ভাইটা হাসার চেষ্টা করেছে। ওর ঐ হাসি আমাকে ক্ষত বিক্ষত করেছে। কেন সবাই আমায় ছেড়ে যায় বলো নিহু?”
একটু থেমে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে আবার বলে,
“এখন আমার তোমায় নিয়ে ভয় হয়। তুমি ছাড়া আর কেউ নেই আমার। কখনো আমায় ছেড়ে যেও না প্লিজ!”
দীর্ঘশ্বাস নিয়ে নিহি আমানকে বুকের মাঝে জড়িয়ে নিয়ে বলে,
“ভয় পেও না। আমি কোথাও যাব না তোমায় ছেড়ে। এখন একটু ঘুমাও।”
আমান নিহির কোলে মাথা রেখে শোয়।
মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে নিহি মনে মনে বলে,
“আমায় তুমি ক্ষমা করে দিও আমান। অনেক সত্যি তোমার আড়ালে রেখেছি। এই সত্যিগুলো যে তুমি মানতে পারবে না। তোমার বাবার খুনি তোমার মা। যাকে এতো ভালোবেসেছ সে তোমার আপন মা নয়। সৎ মা। তোমায় খুনও করতে চেয়েছে সে। আর তোমার মাকে খুনটা আমিই করেছি। এগুলোর কোনোকিছুই তুমি সহ্য করতে পারবে না। এমনকি! এমনকি, তোমার ভাইকেও আমিই খুন করেছি। আমার বাবার খুনির বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই! অনল কেন শেষ মুহূর্তে এসেও বলেনি আমিই ওকে মারতে চেয়েছি! আমি জানিনা! আমি জানি না কখনো আড়ালে থাকা এই সত্যিগুলো তোমার সামনে আসলে তুমি কী করবে! সব সত্যি জানার পর যদি আমায় ঘৃণা করো তাহলে তোমার হাতে মরতেও আমার আপত্তি নেই। তুমি যা চাইবে সেদিন তাই-ই হবে। শুধু একটা কথাই বলব, ভালোবাসি তোমায় খুব।”
আমান ঘুমিয়ে পড়েছে। নিহি আমানের কপালে চুমু খায়। বালিশে আমানকে শুইয়ে দিয়ে চুলে বিলি কাটতে কাটতে ভাবে সেদিনের কথা। যেদিন অনলকে খুন করেছে নিহি!
.
সেদিন ভার্সিটি থেকে ফেরার পথে অনলের বাড়িতে গিয়েছিল নিহি। বাইরে থেকে নীরা আর অনলের কথোপকথন শুনে আর ভেতরে যায়নি। ভেবেছে গার্লফ্রেন্ড হবে হয়তো। তাই ওদের স্পেস দিয়ে চলে আসার জন্য উদ্যত হতেই কানে ভেসে আসে অনলের কথা। শেষ কথাটুকু শুনে বুঝতে অসুবিধা হয়নি ঠিক কোন সত্যটার কথা অনল বলেছে। পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যাচ্ছিল। অনলের কথা বিশ্বাস হচ্ছে না। দেয়ালের সাথে ঠেস দিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। কারো সঙ্গে দেখা না করে, কাউকে কিছু না বলেই নিহি বাড়িতে চলে আসে। কোনোভাবেই কোনোকিছুতে নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে পারে না। এরপরে কয়েকবার অনলের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। যতবার অনলকে দেখেছে ততবার রাগে, জিদ্দে নিজের ওপর নিজের ঘৃণা হয়েছে। ভেবে নিয়েছিল হয়তো নিজে এই পৃথিবীতে থাকবে নয়তো বাবার খুনি!
সেদিন রাতের কথা।
আমান গভীর ঘুমে। নিহির পরনে লাল পাড়ের একটা সাদা শাড়ি। লম্বা কালো চুলগুলো ছেড়ে দেওয়া। রাত প্রায় ১২টার পর অনলের ফ্ল্যাটে যায়। অনল সবেমাত্র তখন নীরার জন্মদিনের পার্টি থেকে ফিরেছে। সব সত্যি জানার পরও নীরা অনলকে ঘৃণা করতে পারেনি। বলেছিল, ভালো না বাসলেও যেন বন্ধু হয়ে থাকে। অনল আপত্তি করেনি। নীরা বায়না করেছিল অনল যেন নীল পাঞ্জাবি পরে আসে। নীরার আবদারের কাছে হার মানতে হয়েছিল অনলকে। নীরা নীল শাড়ি পরেছিল। আর অনল নীল পাঞ্জাবি।
আকাশের অবস্থা ভালো না আজ। শীতের সময়ও গুড়িগুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। শীতের মাত্রা বাড়িয়ে দিচ্ছে আরও।
অনলের বাড়িতে গিয়ে দরজায় নক করে নিহি। অনল দরজা খুলে নিহিকে দেখে অবাক হয়।অনল বাড়িতে একা। নিহি তখন অস্থির হয়ে বলে,
“আমাদের বাড়ি থেকে ফিরছিলাম। মাঝপথে বৃষ্টিতে পেলো।”
“ভেতরে আসো। এতো রাতে একা ফিরছিলে? ভাইয়া জানে?”
বলতে বলতে অনল ভেতরে গেল। নিহিও যায় পিছু পিছু। একটা বড় ছুরি নিয়ে এসেছিল শাড়ির আঁচলের নিচে লুকিয়ে। ভেতরে যেতে যেতে অনলের পেটে ছুরি ঢুকিয়ে দেয়। অনল ঘাড় বেঁকিয়ে একবার নিহির দিকে তাকিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। নিহি হাঁটু মুড়ে বসে পড়ে অনলের সামনে। অনলের চোখদুটো ছলছল করছে। নিহির চোখেও কেন জানি পানি টলমল করছে। নিহি ঠোঁট কামড়ে ধরে শেষ আঘাতটা করে অনলের বুকে। কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে নিহি বলে,
“আপনি আমার বাবার খুনি! কখনো ভাবিনি, আপনার এই বুকের আঘাতটা ছুরি দিয়ে করতে হবে আমার!”
ব্যথায়, কষ্টে মুখের বর্ণ পাল্টে গেছে অনলের। তবুও মুচকি হাসার চেষ্টা করে। রক্তাক্ত হাত নিহির গালে রাখার চেষ্টা করে। তার আগেই রক্তাক্ত হাতটি ফ্লোরে পরে যায়! আবারও কাঁপা কাঁপা হাতটি তুলে ওঠায়। নিহির গাল ছুঁয়ে দিয়ে ভাঙা ভাঙা গলায় বলে,
“আ..ড়ালে এতদিন ভালো..বেসে..ছি! এখনো ভালোবাসি তোম…”
পুরো কথা সম্পূর্ণ করার আগেই চোখ বন্ধ হয়ে যায়। বড়ো শ্বাস নিয়ে হাতটি ফ্লোরে পড়ে যায় অনলের। নিহি হুহু করে শব্দ করে কাঁদে। কেন কাঁদে সেই উত্তর তার কাছে নেই। নেই!
(সমাপ্ত)