#এই_মনের_আঙিনায়[১]
#কুরআতুল_আয়েন
বসারঘর থেকে কথার আওয়াজ শুনতেই আদুরী দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো।চোখ মেলে তাকালো বসারঘরের দিকে।বড়আপা সুহানাকে সোফায় বসে থাকতে দেখে আদুরীর মুখটা মলিন হয়ে গেলো।মুখটা বিড়বিড়িয়ে বললো,’এসেছে মাস্টারনি।’আদুরী নিঃশব্দে ঘরের দিকে পা বাড়াতেই সুহানা ডেকে উঠলো।চোখের চশমাটা ঠিক করে নিয়ে বললো,
‘আদু এদিকে আয় তো।’
আদুরী থেমে গেলো।বড়আপার ডাক অগ্রাহ্য করার অধিকার বা সাহস কোনোটাই তার নেই।মেঝোআপা হলেও একটা কথা ছিলো।মেঝোআপার সাথে আদুরীর বয়সের বেশিদিনের ফারাক নেই যতটা না আছে বড়আপার সাথে।বলতে গেলে বড়আপার সাথে আদুরীর বয়সের ফারাক অনেকটাই।তাই তো সখ্যতা তেমন একটা হয়ে উঠে নি।ভয়টাই বেশি পায়।সুহানা আবারও ডেকে উঠে বললো,
‘কি হলো এদিকে আয়।’
আদুরী এগিয়ে গেলো।সুহানার ঠিক সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।সুহানা চশমা ভেদ করে আদুরীকে দেখতে লাগলো।ফর্সা শরীরটা’য় কালো জর্জেটের একটা থ্রিপিস জড়িয়ে আছে।লম্বা সোজা চুল গুলো কেটে ফেলায় ঘাড় অবধি হয়ে আছে।সুহানা আঁতকে উঠলো।শাড়িটা ঠিক করে নিয়ে সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো।আদুরীর দিকে প্রশ্ন ছুড়ে মারলো।
‘এই আদু তোর লম্বা চুল গুলো কেটে কি করেছিস।’
এতেই থেমে নেই সুহানা।জোর গলায় রাহেলা খাতুনকে ডাকলো।রাহেলা খাতুন রান্নাঘরে ব্যস্ত ছিলেন।মেয়ে,নাতী আসায় ভালোমন্দ রান্নার জোগাড় করছিলেন।মাত্রই ফ্রিজ থেকে ইলিশ মাছের পোটলা’টা বের করেছেন।মুহুর্তেই বড়মেয়ের ডাক কানে আসতেই রান্নাঘর থেকে তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে পড়লেন।বসারঘরে গিয়ে ভ্রুকুটি কুঁচকে তাকিয়ে রইলেন সুহানার দিকে।সুহানা রাহেলা খাতুনকে দেখেই বললো,
‘আম্মা!আদুরী এটা কি করলো।তুমি কিছু বলো নি আদুরীকে।’
রাহেলা খাতুন নির্বিকার ভঙিমা করে বললেন,
‘আমি কিছু জানি না।মেঝো’টার সাথে গিয়ে করে এসেছে।’
‘তাই বলে তুমি কিছু বলবে না।’
‘আমার কথা শুনলে তো হতোই।’
‘আব্বাও কিছু বলে নি।’
‘তোর আব্বার এইসবে খেয়াল আছে নাকি।ব্যবসা নিয়েই তো ব্যস্ত থাকে।’
সুহানা এবার আদুরীর দিকে তাকিয়ে বললো,
‘আর যেনো এইসব চুল কাটতে না দেখি।লম্বা চুল সৌন্দর্যের অধিকারী।এইরকম বেক্কল কাজ করতে যেনো আর না দেখি।’
রাহেলা খাতুন দু’মেয়ের দিকে তাকিয়ে চলে গেলেন রান্নাঘরে।সুহানার কথায় আদুরী মাথা নাড়ালো।যার অর্থ পরেরবার থেকে আর চুল কাটবে না।আদুরী চলে আসতে নিতেই সুহানা পুনরায় ডেকে উঠলো।এমতাবস্থায় বললো,
‘বস এখানে।’
আদুরী বসলো।তবে বড়আপার চোখের দিকে তাকায়নি।সুহানা আদুরীকে পরখ করে নিয়ে বললো,
‘পড়াশোনার খবর কি?’
‘চলছে বড়আপা।’
‘চলছে মানে কি রে!ঠিকমতো পড়ছিস তো।’
‘হ্যাঁ বড়আপা।’
‘মনে রাখিস আদু!আব্বা পড়াশোনা নিয়ে কোনো হেরফের সহ্য করতে পারে না।মন দিয়ে পড়বি।প্রথম বর্ষের অর্ধবার্ষিক কেমন হয়েছে।’
‘মোটামুটি বড়আপা!’
‘মোটামুটি মানে কি রে!আদু আবারও বলছি মন দিয়ে পড়বি।’
আদুরী মাথা উপর-নিচ করলো।সুহানা খাণিকক্ষণ চুপ থেকে বললো,
‘তাহলে তোর কলেজ গ্রীষ্মের কয়েকদিনের বন্ধ আছে তাই তো।’
‘হ্যাঁ বড়আপা।’
‘আচ্ছা ঠিকাছে।’
আদুরী কিছুক্ষণ আশপাশ বুলিয়ে সুহানাকে উদ্দেশ্য করে বললো,
‘বড়আপা সুবহান কই।দেখছি না যে।’
সুহানা ফোন চালানোতে মগ্ন হয়েই উত্তরে বললো,
‘বাবু বাগানে খেলছে ঈশুর সাথে।’
‘মেঝোআপাও কি বাগানে আছে।’
‘হ্যাঁ বাবুকে নিয়ে বাগানেই গিয়েছে।’
আদুরী আর বসলো না।সে-ও দৌড় লাগালো বাগানের দিকে।বাড়ির সদর দরজা পেরোতেই যেনো হাঁপ ছেড়ে বাঁচলো।বড়আপাকে কি আর শুধু শুধুই মাস্টারনি ডাকে।হাই স্কুলের সাথে সাথে যেনো বাড়িতেও তার মাস্টারগিরি চলতেই থাকে।
—-
আদুরীর প্রথম বর্ষের ফাইনাল এক্সাম শেষ হয়েছে কয়েকদিন আগেই।এখন শুয়ে বসেই দিন কাটে।রেজাল্টের পর আবার দ্বিতীয় বর্ষের ক্লাস শুরু হবে।তারপর থেকে যেনো বিশ্রাম নেওয়ার সময়টাও পাবে না।ক্লাস শেষ হতে না হতেই টেস্ট এক্সামও চলে আসবে।তারপর কলেজ জীবনের সেই কঠিন সময়টা পার করেও যেনো নিস্তার নেই।পুরোদমে এডমিশনের জন্য লাগতে হবে।আদুরী নিজের চোখে দেখেছে মেঝোআপাকে পড়তে।সারারাত জেগে জেগে পড়াশোনা চালিয়ে গিয়েছে।অবশ্য সফলও তো হয়েছে।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত বিভাগে আছে।এইরকম একটা সময় আদুরীকেও যে পার করতে হবে তা ভেবেই আদুরী নিজেকে গুটিয়ে নিলো।ভাবলো না আর।আপাতত কয়েকটা দিন আনন্দে কাটিয়ে দিবে।বিছানায় শুয়ে ঘুমোনোর প্রস্তুতি নিতেই ঈশিতা আদুরীকে ডেকে তুললো।তাড়াহুড়ো দেখিয়ে বললো,
‘আদু তৈরি হয়ে নে।আমি তোর জামাকাপড় গুছিয়ে দিচ্ছি।’
আদুরী গোল গোল চাহনি নিক্ষেপ করে তাকালো।অবাকের কণ্ঠস্বর নিয়ে বললো,
‘মানে কি মেঝোআপা।কোথায় যাবো।’
‘তুই আর আম্মা নানুবাড়ি যাবি।আব্বা তোদের দিয়ে আসবে।’
‘তুমি বাড়িতে একা থাকবে মেঝোআপা।’
‘একা কোথায়!বড়আপা আসবে তো।এখান থেকে কয়েকদিন নাকি মাস্টারি করবে।আর আব্বাও তো আম্মা আর তোকে নানুবাড়ি পৌঁছে দিয়ে চলে আসবে।’
‘কিন্তু হঠাৎ নানুবাড়ি যাবো কেনো মেঝোআপা।’
‘ফারিহার সামনের সপ্তাহে বিয়ে।তাই যেতে হবে।’
‘তাহলে তোমরা যাবে না কেনো মেঝোআপা।’
‘যাবো তো আদু।কিন্তু গায়ে হলুদের আগের দিন।এখন তুই আর আম্মা যাবি।’
আচমকাই আদুরী বেঁকে বসলো।এমতাবস্থায় বললো,
‘আমি যাবো না মেঝোআপা।নানুবাড়িতে গিয়ে আমার একা একা থাকতে হয়।আম্মাকে একা পাঠিয়ে দাও।’
‘আম্মা তোকে ছাড়া কখনো থেকেছে।আর তুই সবার অনেক ছোট হওয়ায় কারোর সাথে সখ্যতা তেমন একটা হয়ে উঠে নি।এবার গিয়ে অনেকদিন থাকা হবে তো দেখবি সখ্যতা গড়ে উঠেছে।আর ভালোও লাগবে।আর,তোকে নিয়ে আম্মা তেমন একটা কোথায় গিয়ে থাকেও নি।আমাকে আর বড়আপাকে নিয়ে তো প্রায়ই নানুবাড়ি থেকেছে।এবার গিয়ে থেকে আয় দেখবি ভালো লাগবে।’
আদুরী কিছু বললো না।মুখ ফুলিয়ে বসে রইলো।
—
নানুবাড়ির সমাগমে আদুরীর ভালোই লাগছে।মামাতো বোনদের সাথে সখ্যতা অনেকটাই তৈরি হয়ে নিয়েছে।সবাই তার থেকে বয়সে বড় হলেও আচরণ যেনো তার মতোই।গরমের প্রকোপ বেশি হওয়ায় উঠোনের এককোণায় আম মাখানোর প্রস্তুতির চলছে।উঠোনের এদিকটায় গাছপালা বেশি হওয়ায় ছায়া রয়েছে।পাশ থেকে অর্পা ফারিহাকে উদ্দেশ্য করে বললো,
‘ফারাজ ভাই কবে আসবে রে।’
‘কাল সকালেই আসবে।আজকে রাতেই ফ্লাইট ভাইয়ার।আসতে আসতে ধরে নে সকাল হয়ে যাবে।’
‘কতদিন বাদে ফারাজ ভাই আসছে।বিদেশের মাটিতে গিয়ে দেশে আসার নামগন্ধ যেনো ভুলে বসেছিলো।’
‘আরে ভাইয়া খুব ব্যস্ত মানুষ।নিজের স্বপ্ন পূরণের জন্যই তো বিদেশের মাটিতে পা দিয়েছে।পড়াশোনা শেষ করেই আবার দেশের মাটিতে পা রাখছে।’
‘তাহলে কি ফারাজ ভাই এখন আর বিদেশে যাবে না।’
‘না যাবে না।যে কাজের জন্য গিয়েছিলো তার তো সমাপ্তি ঘটেছেই।আর গিয়ে কি করবে।’
আদুরী চুপচাপ বসে ফারিহা আর অর্পার কথাগুলো শুনছিলো।ফারাজের কথা শুনতেই মনে পড়ে গেলো ছোটবেলার এক কাহিনী।ফারাজের সাথে আদুরীর তেমন একটা দেখাসাক্ষাৎ হয় নি।যখন ছোট ছিলো তখন কয়েকবার এসেছিলো নানুবাড়িতে।তখনিই টুকটাক দেখা।সবার থেকে ছোট হওয়ায় আদুরী একা একাই খেলতো।নানুবাড়ি আসলেই তার খেলার সঙ্গী হয়ে উঠতো পুতুল।আর বাকিরা নিজেদের মতোই থাকতো।আর,এই পুতুল খেলা নিয়ে আদুরী ঠিকই একদিন ফারাজের কাছে জোরেশোরেই এক রামধমক খেয়েছিলো।শুধু কি তাই!গম্ভীর চোখের চাহনি নিক্ষেপ করে তাকিয়েও ছিলো।রামধমক খেয়ে আদুরীর চোখ ফেটে কান্নার যেনো বন্যা নেমেছিলো!তারপর থেকে ফারাজের সাথে আদুরীর আর দেখা নেই।বাকিদের সাথে দেখা হলেও ফারাজের সাথে দেখা হয় নি।এভাবেই সময় অতিবাহিত হতে থাকে।সবাই সবার নতুন জীবন নিয়ে এগিয়ে যেতে লাগলো।আদুরীও যেনো গা-গতরের দিক দিয়ে আচমকাই বড় হয়ে গেলো।বুঝতে শিখলো অনেক কিছুই।তার কয়েকমাস পরেই আম্মার মুখ থেকে শুনেছিলো ফারাজ নাকি পড়াশোনার সূত্রে দেশের বাহিরে গিয়েছে।তখন আদুরী মাথা না ঘামালেও এখন ঠিকই খাণিকটা অস্বস্তি এসে ভীড় করলো।ফর্সা মুখশ্রী’টা কেমন পাণ্ডুবর্ণে হয়ে গিয়েছে।অর্পা আদুরীকে খেয়াল করে বললো,
‘কিরে আদুরী!মুখটা’কে এমন করে রেখেছিস কেনো?কিছু হয়েছে।’
আদুরী মুখে জবাব না দিয়ে মাথা নাড়ালো।যার অর্থ না কিছু হয় নি!অর্পা পুনরায় বললো,
‘এখানে ভালো লাগছে না?’
‘লাগছে আপু।’
‘তাহলে এভাবে বসে আছিস কেনো।নে আম মাখা খা!’
আদুরী আর কিছু বললো না।আম মাখা খেতে লাগলো।তবে মনে মনে ঠিকই অশান্তিরা ঘিরে ধরেছে।
——
সকালে আদুরীর ঘুমটা একটু লেইট করেই ভাঙলো।পরীক্ষা শেষে অলসতা তাকে খুব আষ্ঠেপৃষ্ঠেই জড়িয়ে ধরেছে।কান খাড়া করেই শুনতে পেলো উঠোন থেকে অনেক হৈ চৈ এর আওয়াজ ভেসে আসছে।আদুরী বিলম্ব করলো না।হাতমুখ ধুয়ে বেরিয়ে পড়লো ঘর থেকে।এতো হৈ চৈ এর কারণ জানতে এসেই পা দুটো আঁটকে গেলো।চোখ পড়লো গম্ভীর মুখশ্রীর এক চেহারার দিকে।আদুরীর বুঝতে আর বাকি রইলো না মানুষটা কে!আদুরী পেছনে ঘুরতে নিলেই ফারিহা ডেকে বসলো।আদুরীর কাছে গিয়ে হাত ধরে টেনে ফারাজের সামনে গিয়ে থামলো।আদুরী ফারাজের দিকে তাকায়নি মাথাটা নিচু করে রেখেছে।ফারিহা ফারাজকে উদ্দেশ্য করে বললো,
‘ভাইয়া চিনেছিস আমাদের আদুরীকে।দেখ কতো বড় হয়ে গিয়েছে।’
ফারাজ শান্ত চোখের নজর বুলালো।গলদেশ আরেকটু গম্ভীর করে বললো,
‘ওই যে একবার রামধমক দিয়েছিলাম।’
ফারাজের কথায় বাকিরা হেসে দিলেও আদুরী হাসলো না।মনে বিশাল অভিমান নিয়ে তাকালো ফারাজের দিকে।চোখাচোখি হলো দু’জনের।মুহূর্তেই আদুরী চোখ নামিয়ে নিলো।আর দাঁড়িয়ে থাকলো না।গুটিগুটি পা’য়ে চলে আসলো উঠোন থেকে।
___
আত্নীয় স্বজনরা আসতে শুরু করে দিয়েছে।আদুরী এই প্রথম সব কাজিনদেরকে একসাথে পেয়েছে।সবাই তার থেকে বড়।আদুরীর কষ্ট হলো।সবাই এসে গিয়েছে কিন্তু তার বড় আর মেঝোআপাই আসলো না।আদুরী ঘুরেফিরে রাহেলা খাতুনকে খুঁজতে লাগলো।ব্যর্থ হলো!কোথাও পেলো না।মন খারাপ নিয়ে ঘরের দিকে যেতে লাগলো।সামনে ফারিহাকে দেখেই আদুরী বলে উঠলো,
‘আপু আম্মাকে দেখেছো।’
ফারিহা ফারাজের সাথে কথা বলতে বলতে এদিকটায় আসছিলো।আদুরীর গলা পেয়ে সামনে তাকালো।ফারাজও তাই করলো।ফারিহা আদুরীর গালদুটো ধরে বললো,
‘না তো!ছোটফুপিকে দেখি নি।কিছু হয়েছে তোর?লাগবে কিছু?
আদুরীর এতোক্ষণে চোখ পড়লো ফারাজের দিকে।আগের সেই অগাধ মুখোভাব।আদুরী মিনমিনে গলায় বললো,
‘না আপু!আমার কিছু লাগবে না।’
আদুরী আর দাঁড়ালো না।পাশ কাটিয়ে সামনের দিকে প্রস্থান করলো।ফারিহা ফোন দেখতে দেখতে চলে গেলো।কিন্তু ফারাজ আগের ন্যায় দাঁড়িয়ে আছে।পকেটে হাত গুঁজে দিয়ে তাকিয়ে রইলো আদুরীর যাওয়ার পানে!
চলবে।