এক রক্তিম শ্রাবণে পর্ব-১৪

0
916

#এক_রক্তিম_শ্রাবণে❤️
#লেখিকা_মালিহা_খান❤️
#পর্ব-১৪

বারান্দায় নতুন লাগানো ফুল গাছের ছোট্ট টবের উপর একটা প্রজাপতি বসেছে।টবটা ঝুলন্ত অবস্থায় থাকায় দক্ষিণা হাওয়ার ধাক্কায় একটু আধটু দুলছে।তোহার মাধুর্যে ভরা দৃষ্টি আটকে রয়েছে প্রজাপতির রঙিন পাখাদুটোর উপর।নি:শব্দে একপা দু পা করে এগিয়ে দরজা ঘেঁষে দাড়ালো সে।তার থেকে মাত্র দুহাত দূরেই সদ্য ফোঁটা দুটো ফুলের উপর রং বেরঙে পাখা মেলে বসে রয়েছে প্রজাপতিটা।তোহা একটু হাসলো।নামমাত্র দুরত্ব হওয়া সত্তেও প্রজাপতিটাকে ছুঁয়ে দিতে ভয়।ছুঁয়ে দিলেই তো তা উড়ে যাবে।হারিয়ে যাবে।মিলিয়ে যাবে সুবিশাল আকাশের গহীন সাম্রাজ্য।তখন আর তাকে দেখা যাবেনা,ধরা যাবেনা,ছোঁয়া যাবেনা।মৃদু হেসে হাঁফ ছাড়লো তোহা।
ফুলের টবটা তূর্য এনেছে তার জন্য।যে বন্ধুর বাড়ির গিয়েছিলো ওদিকে নাকি অনেক ফুলের গাছ পাওয়া যায়।সেখান থেকে কিনে বোনের জন্য এতদূর এটাকে বয়ে এনেছে সে।মূলত ফুল প্রচন্ড পছন্দ তোহার।

মনটা আজকে ফুরফুরে।দুপুরে নিশা আসবে তার জামাই সহ।তাছাড়া সাইফ,নুহাশ আর স্বর্নালিও আসবে।থাকবে দুদিন।বিয়ের পর এই প্রথম আসা নিশার।আরো আগেই আসতো তবে নানার অসুস্থতার খবর শুনে আর আসেনি।কারণ বাসায় তোহা ছাড়া আর কেউই ছিলোনা।এসে কি করতো?তবে এখন সমস্যা নেই।দুদিন আগেই তার মা,খালামনি ফিরে এসেছে।নানা এখন অনেকটাই সুস্থ।
_______________

বিকেল প্রায় চারটা বাজে।হাসি তামাশার প্রবল আনন্দে মেতে উঠেছে তোহার ঘর।দুপুরের খাওয়া শেষে সবাই বসেছে আড্ডা দিতে।হাস্সোজ্জ্বল কন্ঠ গুলো যেনো অনুভূতিদের স্বতস্ফুর্ত মিলনমেলা।
নিশার বর সৌহার্দ্য মির্জা অত্যন্ত মিশুক স্বভাবের একজন সুপুরুষ।সবার থেকে বয়সে প্রায় অনেকটা বড় হওয়া সত্তেও সবার সাথে মিলেমিশে কোনো অসস্তি ছাড়াই আড্ডা দিচ্ছে সে।
খাটে জায়গা না হওয়ায় পাশে একটা চেয়ার টেনে দুই পা ভাঁজ করে তুলে বসে আছে তোহা।মুখে নজরকাড়া হাসি টেনে সবার সাথে গল্পে মশগুল সে।

হাসাহাসির মাঝেই চুলে হাত চালাতে চালাতে রুমে প্রবেশ করে তিহান।সবার দৃষ্টি আচমকা তার দিকে পরতেই চমৎকার করে হেসে শার্টের হাতা গুটাতে গুটাতে সে বলে,
—“আমাকে ছাড়াই আড্ডা দিচ্ছিস সবগুলা?কথাটা বলে সৌহার্দ্যর দিকে চোখ পরতেই তোহাকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গিয়ে হাত বাড়িয়ে সে বললো,”আরে দুলাভাই যে,কেমন আছেন?”

সৌহার্দ্য হাসলো।হাতে হাত মিলিয়ে বললো,
—“আছি ভালোই।তুমি কেমন আছো?”

—“এইতো আছি।তো কি নিয়ে এত হাসাহাসির হচ্ছিলো?”বলে বসার জন্য আশেপাশে তাকায় তিহান।প্রায় সাথে সাথেই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়ায় তোহা।একটু সরে দাড়িয়ে তিহানের দিকে চেয়ারটা এগিয়ে দিয়ে চাপা স্বরে বলে,
—“বসুন।”

তিহান তোহার দিকে না তাকিয়েই চেয়ার টেনে বসে পরলো।মুখের হাসি ততক্ষনে সরে গেছে তোহার।চুপটি করে চেয়ারের পাশ ঘেঁষে দাড়ালো সে।
সৌহার্দ্য একবার আশেপাশে চোখ বুলালো।স্বর্ণালি,তোহা,এমনকি নিশাও একটু চুপসে গেছে।
সৌহার্দ্য মুচকি হেসে বললো,
—“এদেরকে খুব বেশি টাইটে রাখো বুঝি?তোমাকে দেখেই সবকটা ভিজে বিড়াল হয়ে গেলো?”

উওরে তিহান শুধুমাত্র হাসলো।হৃদয় কাঁপিয়ে দেয়া হাসি।সেদিক তাকিয়ে একটুখানি থমকালো তোহা।বামহাত দিয়ে তিহানের চেয়ারের পিঠ ঠেকানোর উপরের অংশটা আরো একটু খামছে ধরলো সে।
নিশা তেঁতে উঠে বললো,
—“আমরা মোটেও ভিজে বিড়াল হইনি।তিহান ভাইকে আমরা যথেষ্ঠ সম্মান করি বুঝলে?সেজন্যই উনাকে কথা বলার সুযোগ করে দেয়ার জন্যই আমরা চুপ হলাম।”

তিহান ভ্রু উচিয়ে বললো,
—“তাই নাকি রে?তুই চুপ না করলেতো আমি কথাই বলতে পারতামনা।বড় উপকার করলি রে নিশা।অনেক বড় উপকার করলি।”

তিহানের কথায় অপদস্ত হয়ে চুপ করে গেলো নিশা।তবে নিশা ছাড়া সবাই ই সমস্বরে হেসে উঠলো।

খানিকবাদেই তিহানের চোখ গেলো বিছানার কোঁণে সাইফ,নুহাশের সাথে বসে থাকা সুদর্শন ছেলেটার উপর।এতক্ষণ সে খেয়ালই করেনি।মূহুর্তেই ভ্রু কুচকে গেলো তার।থুতনি তে হাত বুলিয়ে সে বললো,
—“উনি কে?”

সাথে সাথেই ছেলেটা তার দিকে তাকিয়ে উজ্জ্বল হাসি টেনে বললো,
—“আমি ভাবির দেবর।অনন্ত”।বলে নিশার দিকে ইশারা করলো সে।

—“তোমাকেতো দেখিনি বিয়েতে?।”কৌতুহলটা কন্ঠ তিহানের,

সৌহার্দ্য উওর দিলো,
—“ও আসতে পারেনি বিয়েতে।অসুস্থ ছিলো।তবে এংগেজমেন্টে এসেছিলো।তুমি হয়তো খেয়াল করনি।”

তিহান মাথা নাড়িয়ে বললো,”হয়তোবা।” অনন্ত আবারো মুচকি হাসলো।
তোহা তখন বসে আছে খাটের পাশের কাঠের ছোট্ট টেবিলের উপরে।বেশ অনেকটা সময় পর তিহানের চোখ আবারো পড়লো অনন্তের উপর।ঘাড় বাঁকিয়ে তার চকচকে দৃষ্টি অনুসরণ করে তোহার আপত্তিকর স্হানে চোখ পরতেই মূহুর্তে মুখের চোয়াল শক্ত হয়ে এলো তার।
দাঁতে দাঁত চেপে রাগটা আটকিয়ে চেয়ার ঘুরিয়ে তোহাকে তার পিছে আড়াল করে বসলো সে।
______

আকাশী রংয়ের একটা হ্যান্ডপ্রিন্টের সুতি শাড়ি পরেছে তোহা।আকাশী রংয়ের মধ্যে সাদা মেঘের মতো সাদা রংয়ের রংতুলির ছোয়াঁ দিয়ে খুব যত্নে তৈরি করা হয়েছে শাড়িটা।গতবছর বৈশাখের সময় মেলা থেকে শখ করে কিনেছিলো তবে আজ পর্যন্ত পরার সুযোগ হয়নি।আজকে সুযোগ পেয়েই পরে ফেলেছে।
সাদা রংয়ের ব্লাউজের সাথে গলায় ছোট একটা সাদা পাথরের লকেটটা একদম ফুঁটে উঠেছে।চুলে খোঁপা করে সামনে থেকে কিছু চুল বের করে নিলো তোহা।দু’হাতভর্তি সাদা রংয়ের তিহানের দেয়া সেদিনের কাঁচের চুড়ি।চোখে খুব সাবধানতার সাথে আইলাইনার লাগিয়ে ঠোঁটে হাল্কা গোলাপি লিপস্টিক লাগিয়ে পরিপাটি হয়ে বের হলো সে।সে বের হতে না হতেই স্বর্ণালি আর নিশাও পাশের রুম থেকে বের হলো।তাদের পরণেও শাড়ি।তারা বেরিয়ে আসতেই ড্রইংরুমে বসা ছেলেরা উঠে দাড়ালো।একবার পুরো ড্রইংরুমে চোখ বুলাল তোহা।তিহানকে দেখা যাচ্ছেনা কোথাও।

সবাই মিলে রেস্টুরেন্টে যাবে তারা।সৌহার্দ্যর পক্ষ থেকে বিয়ের পর প্রথম ট্রি ট।বিকেল তখন পাঁচটা সতেরো বাজে।এখনও রোদ আছে আশেপাশে।আলোয় ঝলমলে চারিপাশ।

একহাতে শাড়ির কুঁচি ধরে মাথা নিচু করে সিঁড়ি দিয়ে নামছে তোহা।তার আগে আগে নিশা আর স্বর্ণালি।হঠাৎ পিছে কারো অস্তিত্ব অনুভব করতেই একটু থেমে ঘাড় ঘুরালো সে।ধবধবে সাদা পান্জাবিতে তিহানকে দেখে একমূহুর্ত পলকহীনভাবে চেয়ে থেকে একটু সাইড দিয়ে বললো,
—“আপনি আগে যান।”

তিহান কিছুক্ষন তোহাকে আপাদমস্তক দেখে নিয়ে মুখ এগিয়ে এনে বললো,
—“আমি আগে গেলে তোমাকে সামলাবে কে?ধীরেসুস্থে শাড়ি সামলে নামো।”

কথাটা কানে যেতেই চকিত দৃষ্টিতে সামনে তাকালো তোহা।নিশারা শুনলে কি একটা লজ্জায় পরবে সে।তবে নিশা আর স্বর্ণালিকে সামনে না দেখে স্বস্তির নি:শ্বাস ফেলতেই তিহান বললো,
—“কেউ শুনেনি।নামো।”।

তোহা আর কিছু বললোনা।চুপচাপ নিচে নামতেই দেখলো পাশাপাশি তিনটে গাড়ি দাঁড় করানো।একটার ড্রাইভিং সিটে বসেছে সৌহার্দ্য তার পাশে নিশা।পেছনে বোধহয় তূর্য,অনন্ত আর স্বর্ণা।আরেকটা গাড়ি সাইফদের।সাইফ আর নুহাশ উঠেছে সেটায়।
তোহাকে দেখে অনন্ত জানালা দিয়ে মুখ বের করে বললো,
—“তুমি এখানে আসো তোহা।”

তোহা আমতাআমতা করতেই তিহান তার হাত টেনে বললো,
—“ও আসলে চাপাচাপি করে বসতে পারে না।সমস্যা নেই।তোমরা যাও।ও আমার সাথে যাবে।”

অনন্ত আরো কিছু বলার আগেই সৌহার্দ্য গাড়ি স্টার্ট দিলো।তিহান মুচকি হেসে সাইফদের গাড়ির কাছে যেয়ে মাথা ঝুঁকিয়ে বললো,
—“তোরা যা,আমি তোহাকে নিয়ে আসছি।”

_______________

গাড়িতে বসে আছে তোহা।বারবার সামনের চুলগুলো চোখের উপর থেকে সরাতে গিয়ে কাঁচের চুড়িতে রিনঝিন করে বেঁজে উঠছে শব্দতরঙ্গ।তিহান ড্রাইভ করছে মনোযোগ দিয়ে।তার দৃষ্টি সামনের দিকে।তোহার দিকে তাকচ্ছেনা সে।
হঠাৎই গাড়ির মোড় ঘুরাতে ঘুরাতে তিহান গম্ভীর কন্ঠে বললো,
—“তিহু,ডানপকেটে হাত ঢুকাতো।”

তোহা বুঝতে না পেরে বললো,
—“জি?”

—“পান্জাবির ডানপাশের পকেটে হাত ঢুকা।”

ইততস্ত ভাবে তিহানের পকেট হাতরাতেই একটা সিলভার কালারের ছোট্ট ঝুমকা কানের দুল বেরিয়ে এলো।
সেগুলো হাতে নিয়ে তোহা কিছু বলার আগেই তিহান বললো,

—“পড়।”

তোহা বিনাবাক্য দুলদুটো পরে নিতেই গাড়ি থামালো তিহান।ঝুঁকে গিয়ে তোহার পাশের গাড়ির জানালার কাঁচ উঠিয়ে দিয়ে একটানে তোহার চুলের খোঁপা খুলে দিলো সে।চুলগুলো এলোমেলো হয়ে সারা গায়ে ছড়িয়ে পরতেই তোহা লজ্জায় মিইয়ে যাওয়া কন্ঠে পিটপিট করে বললো,
—“তিহান ভা….”

বাক্যটা শুরু করলেও শেষ করতে সক্ষম হলোনা সে।তার আগেই তিহান তার সারামুখে চোখ বুলাতে বুলাতে বামগালে হাত রেখে বৃদ্ধাআঙ্গুল ঠোঁটের উপর রেখে নিচু কন্ঠে বললো,
—“একদম “মেঘময়ূরী” লাগছে তোমাকে।নীল সাদা মেঘে জর্জরিত আমার একমাত্র “মেঘময়ূরী”।”

~চলবে~