এক রক্তিম শ্রাবণে পর্ব-১৯

0
1003

#এক_রক্তিম_শ্রাবণে❤️
#লেখিকা_মালিহা_খান❤️
#পর্ব-১৯

ফ্যানের বাতাসে গা শিরশির করছে তোহার।তারউপর বৃষ্টি হয়েছে বলে পরিবেশও আজ অনেকটাই শীতল।ঘরের জানালাটাও বোকার মতো খুলে রেখেছে বিধায় ঠান্ডা হিমেল হাওয়ায় রুমে থাকাটাই মুশকিল হয়ে উঠছে।সন্ধ্যায় ছাদ থেকে নেমে শাওয়ার নিয়েছিলো তাই বোধহয় শীত শীত ভাবটাও তার বেশি অনুভব হচ্ছে।

গায়ে পাতলা কাঁথা নিয়ে অবিরাম মুচরামুচরি করছে তোহা।গভীর ঘুমের মাঝে কষ্ট করে উঠে ফ্যান আর জানলাটা বন্ধ করার ইচ্ছাটা থাকলেও তা করার শক্তিটা নেই তার।হাড়ের মধ্যেও একটা নিস্তেজ নিস্তেজ রেশ চলে এসেছে।সারাবছরের ঘুম যেনো ভর করেছে চোখে কিন্তু বাঁধ সাধছে এই অতি ঠান্ডাভাবটা।
রাত প্রায় গভীর।ঘড়ি দেখা হয়নি।তবুও নি:সন্দেহে বলা যায় একটা অথবা দেড়টা তো বেজেই গেছে।
গায়ের কাঁথাটা ভালো করে ছড়িয়ে তার ভিতর মাথা ঢুকিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করলো তোহা।কাজও হলো এতে।ঠান্ডাটা অতটা গায়ে লাগছেনা।খানিকবাদে হরিণীর ন্যায় চোখদুটোতে তন্দ্রাভাব এসে জাপটে ধরতেই দরজার লক ঘুরানোর আওয়াজে বাজে ভাবে একটা ব্যাঘাত ঘটে গেলো ঘুমের মাঝে।মেজাজ চটে গেলো তোহার।চটা মেজাজটা আরো বেশি চড়াও করার জন্য ঘরের লাইটটাও জ্বলে উঠলো।রাগে দু:খে কান্না পেয়ে গেলো তোহার।হাল্কা করে মাথা বের করে উচ্চস্বরে চিল্লানোর পূর্বেই তূর্যকে দেখতে পেয়ে হুড়মুড় করে উঠে বসলো সে।পাশ থেকে ওড়না নিয়ে গায়ে জড়াতে জড়াতে শঙ্কিত কন্ঠে বললো,
—“ভাইয়া তুমি এতরাতে?কিছু হয়েছে?আব্বু ঠিক আছে?”

বোনের ভীত কন্ঠের মানে বুঝতে পারে তূর্য।মাঝেমাঝে তাদের আব্বু রাতের বেলা অসুস্থ হয়ে যায়।তীব্র বুকে ব্যাথা উঠে আবার কখনো প্রেসার লো হয়ে যায়।তবে আজ তার আব্বু সুস্থ।সে এসেছে অন্য কারণে।
বোনের দিকে তাকিয়ে আশ্বস্তভরা কন্ঠে সে বলে,

—“আব্বু ঠি ক আছে,শান্ত হ।”

—“তবে?”সন্দিহান কন্ঠে বলে তোহা।

—“তিহান ভাই অসুস্থ।১০৪ ডিগ্রি জ্বর উঠে গেছে উনার।কোনোমতেই জ্বর নামানো যাচ্ছেনা।খালামনি কান্নাকাটি করছে।আব্বু আম্মু ওখানেই,তোকেও যেতে বলেছে।”

মাথা ঘুড়ে যায় তোহার।সম্ভিৎ হারিয়ে কিছুক্ষন ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে সে।তূর্য তাঁড়া দিয়ে বলে,
—“জলদি উঠ বোন।তোকে ওই ফ্ল্যাটে দিয়ে আমি বাসা তালা দিয়ে ফার্মেসীতে যাবো।এতরাতে ফার্মেসিও খোলা থাকবে কিনা সন্দেহ।”

কোনরকমে নিজেকে সামলে উঠে দাড়ায় তোহা।মাথায় ওড়না টেনে নিয়ে বলে,
—“চলো।”


খালু আর তোহার বাবা ড্রইংরুমের সোফায় বসে আছে।দুজনের কানেই ফোন।হয়তো ডাক্তারদের ফোন করছে তারা।খুব সন্তর্পণে তাদের কে পাশ কাটিয়ে তিহানের রুমে ঢোকে তোহা।
তিহানের একপাশে খালামনি আরেকপাশে ওর মা।
তোহা কাছে এগিয়ে যেতেই তড়িঘড়ি করে উঠে দাড়ালো আফিয়া।তোহাকে তিহানের মাথার পাশে বসার জায়গা করে দিয়ে কান্নাভেজা কন্ঠে বললো,
—“তোর কথা অনেকবার করে বলছিলো মা।তুই একটু পাশে বসে থাক।ওর ভালো লাগবে।”

মায়ের সামনে খানিকটা ইততস্ত নিয়েই তিহানের মাথার কাছটায় বসলো তোহা।আফিয়ার হাত থেকে পানির বাটিটা নিয়ে বললো,
—“কান্না করোনা খালামনি,শান্ত হয়ে বসো।আমি পট্টি দিয়ে দিচ্ছি।”বলে তিহানের কপাল থেকে গরম হয়ে যাওয়া রুমালটা সরিয়ে ঠান্ডা পানিতে ভেঁজালো তোহা।খানিকবাদে তা দুহাতে চিপড়িয়ে আবারো তিহানের কপালে দেয়ার সময় লক্ষ্য করলো,চেহারা পুরো লাল হয়ে গেছে তিহানের।ঠোঁটগুলো মনে হচ্ছে ঠোকা দিলেই রক্ত গড়িয়ে পরবে।হাল্কা গোঙ্গাচ্ছে তিহান।মাকে মাথা নিচু করে কোন একটা দোয়া পরতে দেখে আলতো করে তিহানের গালে হাত রাখলো তোহা।জ্বরে শরীর রীতিমত পুড়ে যাচ্ছে।প্রচন্ড ঘাবড়ে গেলো তোহা।কাঁথার নিচ দিয়ে তিহানের হাত আঁকড়ে ধরে মাথা নামিয়ে ভীত কন্ঠে ডাকলো,
—“তিহান ভাই?”

তার একডাকেই আবছাভাবে চোখ মেললো তিহান।তার ধূসর মনিজোড়াও ফ্যাকাশে হয়ে গেছে।
তোহার দিকে তাকিয়ে বিরবির করে সে বললো,
—“ভালো লাগছেনা তিহু।কিছু ভালো লাগছেনা।”

—“আচ্ছা আচ্ছা,আপনি চোখ বন্ধ করে রাখেন।ভালো লাগবে।”

চোখ বন্ধ করে ফেললো তিহান।তোহা হাতটা ছাড়াতে নিলেই চাপা স্বরে ছেলেমানুষি কন্ঠে বললো,
—“ধরে রাখ প্লিজ।”

তোহা আর ছাড়ালোনা হাতটা।শক্ত করে ধরে আরেকহাতে ধীরে ধীরে তিহানের চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো,
—“খালামনি,আরেকটা কাঁথা বের করে উনার গায়ে দিয়ে দাও।শীত কম লাগবে কিছুটা।”

আফিয়া তাই করলো।যদিও দুটো কাঁথা জড়ানো তিহানের গায়ে।তারপরও আরো একটা মোটা কাঁথা এনে তিহানের গায়ে দিয়ে বাচ্চাসূলভ কন্ঠে বললো,
—“তিহান?এখন একটু ভালো লাগছে বাবা?”

তিহান শব্দ করলোনা।সে ঘুমিয়ে পরেছে।আফিয়া ডাকলোনা আর।তোহা আড়চোখে মায়ের দিকে তাকালো।তিহানের অপরপাশের হাত মুঠোয় নিয়ে একমনে দোয়া পরছে তার মা।চোখ যদিও বন্ধ তবুও কপালের চিন্তার ভাঁজ গুলোই বলে দিচ্ছে কতোটা টেনশনে আছে সে।

—“খাবার খেয়েছেন উনি?”গলা নামিয়ে প্রশ্ন করলো তোহা।তার হাত তখনো অনবরত তিহানের চুলের ভাঁজে বিলি কেটে যাচ্ছে।

—“না রে মা।শতবার বলেও রাজি করাতে পারিনি।কিছুতেই খাবেনা।”হতাশ কন্ঠ আফিয়ার।

—“ভাইয়া ফার্মেসীতে গেলো কেনো?ঘরে প্যারাসিটামল নেই?উনাকে ওষুধ খাওয়াওনি?”

—“খাইয়েছি।দুটো নাপা ছিলো।দুটোই খাইয়েছি।রাতে যদি জ্বর না কমে সেজন্যই তূর্য নতুন আনতে গেলো।”

“ওহ” বলে আবেগভরা দৃষ্টিতে তিহানের মুখের দিকে তাকায় তোহা।কপালের রুমালটা আবারো ভিজিয়ে পুনরায় কপালে দিতেই তূর্য হন্তদন্ত হয়ে রুমে প্রবেশ করে।আফিয়ার হাতে একটা প্যাকেট ধরিয়ে বলে,
—“তিন মোড় ঘুরে একটা ফার্মেসী খোলা ছিলো খালামনি।সেজন্যই আনতে দেরি হলো।জ্বর কমেছে একটু?”

তোহা তৎক্ষনাত গালে গলায় হাত ছোঁয়ালো তিহানের।জ্বর মেপে বললো,
—“কমেনি ভাইয়া।”

—“খাবার খাইয়ে,আরেকটা নাপা খাইয়ে দেয়া দরকার তাইলে।খালি পেটে এতো ওষুধ খেলে আবার হিতে বিপরীত হতে পারে।”

হতাশ শ্বাস ছাড়লো তোহা।খালামনিকে বললো,
—“তুমি ভাত নিয়ে আসো খালামনি।আমি দেখি কিভাবে উনাকে খাওয়ানো যায়।”

তার কথাটা শেষ হতে না হতেই তিহান জ্বরের মাঝেই তেঁতো স্বরে বলে উঠলো,
—“আমি কিছু খাবোনা।শুধু শুধু ভাত এনে লাভ নেই।”

আফিয়া থেমে গেলো।কাতর নয়নে তাকাতেই তোহা তাকে বিশ্বাস দিয়ে বললো,
—“তুমি নিয়ে আসোতো খালামনি।”

—“তিহু আমি খাবোনা কিন্তু।….”জ্বরের ঘোরেও ধমকে উঠলো তিহান।

ভয় পেলোনা তোহা।বাবার ডাকে তূর্য রুম থেকে বেরিয়ে যেতেই হাল্কা ঝুঁকে তিহানের গালে হাত রেখে মৃদু কন্ঠে বললো,
—“আমি খাইয়ে দিলেও খাবেননা আপনি?ভেবে বলছেন তো?”

চুপ করে রইলো তিহান।নিরবতা সম্মতির লক্ষন ভেবে মুচকি হাসলো তোহা।


ভাতের শেষ লোকমাটা তিহানের মুখে তুলে দিয়ে স্বতিদায়ক হাফ ছাড়লো তোহা।আফিয়ার ঠোঁটের কোঁণে মুচকি হাসি।তোহা নির্বিকার।আতিয়া তখনো যায়নি।তবে ক্লান্তির ছাপ ফুটে উঠেছে তার মুখে।তোহা উঠে ভাতের প্লেটটা পাশে রেখে তিহানের মুখে একটা ওষুধ দিয়ে পানি খাইয়ে দিয়ে বললো,
—“এখন শুয়ে থাকেন।জ্বর নেমে যাবে একটুপর।আমি হাতটা ধুয়ে আসি।”

বলে সে বাইরে যেতেই তিহান আতিয়াকে বললো,
—“খালামনি,তুমি অসুস্থ হয়ে পরবে।তুমি যেয়ে ঘুমিয়ে পরো।তিহু আর মা আমার কাছে থাকুক।তাতেই হবে।চিন্তা করোনা।”

_______
হাত ধুয়ে রুমে ঢুকলো তোহা।তিহান মাঝখানটায় ঘুমিয়ে আছে।পাশে আফিয়া খাটের সাথে হেলান দিয়ে বসা।আতিয়াকে না দেখে বিশেষ অবাক হলোনা সে।এসব তিহানের কারসাজি,জানে সে।

তিহানের ডানপাশে যেয়ে বিছানায় পা ভাঁজ করে তুলে বসলো তোহা।আফিয়া চোখ বন্ধ করে রেখেছে।হয়তো ঘুম পাচ্ছে তার।
জ্বর দেখার উদ্দেশ্য হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে তিহানের গাল ছুঁয়ে দিতেই তিহান চোখ বন্ধ অবস্থাতেই বললো,
—“মাথাটা টিপে দে তো তিহু।ব্যাথা করছে।”

সাথেসাথেই বিনাবাক্য ব্যায়ে একহাতে তার মাথা টিপে দিতে লাগলো তোহা।আরেকহাত তিহানের চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো,
—“ঘুমানোর চেষ্টা করুন।এখন ভালো লাগছে একটু?”

ক্ষীণ হাসলো তিহান।উওর দিলো,
—“তুমি কাছে থাকলে আমার কখনো খারাপ লাগেনা ‘জানপরী’।”

~চলবে~