এক রক্তিম শ্রাবণে পর্ব-৩২

0
836

#এক_রক্তিম_শ্রাবণে❤️
#লেখিকা_মালিহা_খান❤️
#পর্ব-৩২

চা টা শেষ করে মাত্র কাপটা মেঝেতে রেখেছে তিহান।এরই মাঝে পুকুরের পাশ থেকে পানির শব্দে কান খাড়া হয়ে এলো তার।ঘাড় ফিরিয়ে একবার তাকালো।শুধু সেই নয় সেখানে উপস্থিত সবাই-ই তাকালো।কিছুক্ষণ একদৃষ্টিতে চেয়েও থাকলো।তিহানের কপালে গভীর ভাঁজ।পানিতে ঝাপটানোর অনবরত আওয়াজ আসছে।
কিছুক্ষণের ব্যবধানেই তার শূন্য মস্তিষ্ক সচল হয়ে উঠলো।ঘাড় ঘুরিয়ে একপলকে সবার দিকে তাকিয়ে তড়িঘড়ি করে উঠে দাড়িয়ে সে।শঙ্কিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,”তিহু কোথায়?”

চারিদিকে পানি।পুকুরটা বেশ গভীর তার উপর গুমোট অন্ধকার।দুহাত মেলে ঝাপটাচ্ছে তোহা।এখনো ডুবে যায়নি।সে সাঁতার জানে।তার যখন পনেরো-ষোল বছর ছিলো তখনই নিজ দায়িত্বে তাকে সাঁতার শিখিয়েছিলো তিহান।শহরের তেমন পুকুর -টুকুর নেই।কোন জায়গায় এক সুইমিংপুল ছিলো সেখানে নিয়ে গিয়ে টানা বিশদিনে সাঁতার জিনিসটা রপ্ত করতে পেরেছিলো সে।তবে এখানটায় পানির গভীরতা তার উপর আকস্মিক ভয়টা সারা গায়ে,মন মস্তিষ্কে নিপুণভাবে জেঁকে বসেছে।হাত-পা কাঁপছে।সাঁতরানোর ঠাঁই পাচ্ছেনা কোনোভাবেই।তবুও হাল ছাড়েনি।সাঁতরিয়ে পাড়ে না পৌছাতে পারুক অনন্ত ডুবে যেন না যায় সেই চেষ্টাই করছে।

এলোমেলো পায়ে নিচে ছুঁটছে তিহান।তার পা কাঁপছে।মাথায় কাজ করছেনা কোনোকিছু।সবকিছু কেমন জমাট বেঁধে যাচ্ছে।তোহাকে না দেখা পর্যন্ত শান্তি হচ্ছেনা এতটুকুও।তার পিছে পিছে বাকিরাও আসছে।তিহানকে রীতিমত দৌড়ে বেরিয়ে যেতে দেখে হলরুমে বসে থাকা আতিয়া স্বর্ণালির দিকে চেয়ে প্রশ্ন করে বললো,
—“কি হয়েছে?এভাবে কই যাচ্ছিস সবকটা?”

স্বর্নালি কিছু বলতে পারলোনা।বিষয়টা এখনো পুরোপুরি ঠাওর করতে পারেনি সে।তাকে ফ্যালফ্যাল করে বোকার মতো চেয়ে থাকতে দেখে সাইফ আগ বাড়িয়ে উওর দিলো,
—“তোহা বোধহয় পুকুরে পরে গিয়েছে খালামনি।আমরা শিওর না।”

“কিহ্”বলে আৎকে উঠলো আতিয়া।টেনশনটা তার বরাবরই বেশি।মাথা চক্কর দিয়ে উঠলো।তূর্য নেই আশেপাশে।সে আগেই ছুটেছে তিহানের পিছুপিছু।তার অসচ্ছ দৃষ্টি দেখেই সাইফ এগিয়ে গেলো।আলতো করে ধরে বসিয়ে দিলো সোফায়।
_____________

তোহার অবস্থা নিভু নিভু।বেশ বুঝতে পারছে কয়েকটা পা এদিকেই দৌড়ে আসছে তবে ডাকার নূন্যতম শক্তিটাও পাচ্ছেনা।নিস্তেজ হয়ে আসছে শরীর।শেষ কয়েকবার হাত দিয়ে এগোনোর চেষ্টা করলো সে।
হাল ছেড়ে দেয়ার আগমূহুর্তে পানিতে আরো একজনের ঝাপিয়ে পরা আর মুখের উপর ফ্ল্যাশলাইট পরায় কিছুটা চেতনা ফিরে পেলো।সামনের কালো অবয়বের মানুষটির মুখ না দেখেই সে ক্ষীণ কন্ঠে ডাকলো,
—“তিহান,ধরুন আমাকে”।

কথাটা পুরোপুরি শেষ না হতেই দুহাতে তোহাকে জাপটে ধরে বুকের সাথে একেবারে মিশিয়ে ফেললো তিহান।
সাথেসাথেই সম্পূর্ণ গায়ের ভার তার উপর ছেড়ে দিলো তোহা।এতক্ষনের ভয়টা নিমিষেই কেটে গেছে।তবে শক্তি পাচ্ছেনা।তিহান কে যে একটু জড়িয়ে ধরবে সেই উপায়টাও নেই।
তোহার মাথাটা বুকের সাথে চেপে ধরে জোরে জোরে শ্বাস নিলো তিহান।বুকের হাঁসফাঁসটা কমানোর চেষ্টা করলো।তবে সফল হলোনা।আর একটু হলে সে নিজেই জ্ঞান হারাতো ভয়ে।তূর্য ততক্ষনে ফেনের ফ্ল্যাশলাইট সমেত পুকুরের সিঁড়ি ধরে অর্ধেক নেমে গেছে।তিহানকে উদ্দেশ্য করে সে গলা বাড়িয়ে ডাকছে,
—“তিহান ভাই,আমি আসবো?”

—“না,তুই দাড়া ওখানেই।আমি পারবো।আসতেছি।”বলে তোহাকে পাঁজাকোলা করে কোলে তুলে নিলো তিহান।তোহার চোখ বন্ধ।তবে জ্ঞান হারায়নি।

—“দয়া করে জ্ঞান হারাবানা।আমার কিন্তু ভয় করছে খুব।”তিহানের কাঁপা কন্ঠের বাচ্চাসূলভ আবদারে মলিনভাবে হাসলো তোহা।
তাকে নিয়ে পাড়ে উঠে মাটির উপরই বসে পরেছে তিহান।তোহার মাথা তার বুকে।তূর্য আস্তে আস্তে হাত বুলাচ্ছে বোনের মাথায়।চুপচুপে ভেজা জামায় শরীরের অবয়ব স্পষ্ট।গায়ের ওড়না এখনো পুকুরেই ভাসছে।তাড়াহুড়োয় সেটা আর আনা হয়নি।

—“কথা বলছেনা কেনো?অজ্ঞান হয়ে গেছে?”তোহার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললো তূর্য।

তোহার ভেজা চুলগুলো কানের পিছের দিকে গুঁজে দিয়ে তিহান মৃদু গলায় উওর দিলো,
—“নাহ,জ্ঞান আছে।খুব ভয় পেয়েছে হয়তো।”বলেই চোখজোড়া বোজল তিহান।
এই সন্ধ্যাবেলা এমন একটা ভয়ংকর কাজ ঘটে যাবে বুঝতেই পারেনি সে।মেয়েটা কখন উঠে গেছে খেয়ালই করেনি।করলে হয়তো এমন হতোনা।
এরইমাঝে ছুটে এলো বাড়ির সবাই।এদিকের লাইট জ্বলে উঠতেই তোহাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে দুহাতে লুকিয়ে আগলে ধরলো তিহান।আতিয়া কান্না করছে ফুঁপিয়ে।
তিহান ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে তাকে সান্তনা দিয়ে বললো,
—“তিহু ঠি ক আছে খালামনি।কেঁদোনা।ও আরো ভয় পেয়ে যাবে।”

আরমান সাহেব এগিয়ে আসলেন।আতিয়া ধরে উঠিয়ে মেয়ের মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দিয়ে তিহানকে বললেন,
—“ওকে একটু ঘরে নিয়ে যেতে পারবে তিহান?দুজনেই তো ভিজে গেছো।”

তিহান মাথা ঝুকালো।ভদ্রতার সহিত নম্র কন্ঠে বললো,
—“জি খালু,নিয়ে যাচ্ছি।আপনি খালামনিকে ভিতরে নিয়ে যান।আমরা আসছি।”

আরমান সাহেব মৃদু হেসে আতিয়া নিয়ে ভেতরে ঢুকলেন।তার স্ত্রী অল্পতেই অস্থির হয়ে উঠে।প্রেশার বেরে যায়।
তারা ভেতরে চলে যেতেই আফিয়ার দিকে চোখের ইশারায় কিছু একটা বললো তিহান।ছেলের ইঙ্গিত বুঝতে পেরে আশেপাশে তাকালো আফিয়া।স্বর্ণাকে দিয়ে হলরুমের সোফা থেকে তার গায়ের শালটা আনিয়ে তোহার গায়ে জড়িয়ে দিলো।
তিহান মুচকি হেসে তোহাকে কোলে নিতে গেলেই তোহা আধো আধো স্বরে বললো,
—“আমি পারবো।”

দাঁতে দাঁতে চেপে অগ্নিচোখে তাকালো তিহান।শুধুমাত্র দূর্বল হয়ে পরেছে বলে তোহাকে কিছু বলেনি এতক্ষণ।নতুবা একা একা এখানে আসার অপরাধে তার আগেই একে দু-চারটা চড় লাগানো উচিত ছিলো।
তথাপি তোহার কথাটা দাম না দিয়ে তাকে কোলে তুলে নিলে তোহা আবারো কিছু বলতে গেলেই সে রাগে কটমট করে বললো,
—“একদম চুপ”।

মুখটা চুপসে গেলো তোহার।ঠোঁটজোড়াও আপনাআপনিই বন্ধ হয়ে গেলো।
তিহান তাকে কোলে করে নিয়েই রুমে ঢুকলো।তখন শুধু আফিয়া আর স্বর্ণালি আছে রুমে।স্বর্ণালি তোহার জামাকাপড় বের করছে আর আফিয়া গ্লাসে পানি ঢালছে।তিহানের নিজের জামাকাপড়ও ভিজে গায়ের সাথে লেপ্টে আছে।ফোনটা ছিলো পকেটে সেটাও হয়তো গেছে নষ্ট হয়ে।
কিছু করার নেই,সেই মূহুর্তে তো আর ফোনের কথা মনে ছিলোনা তার।তপ্ত একটা নি:শ্বাস ছাড়লো তিহান।
তোহাকে শুইয়ে দিতে দিতে হাল্কা ঠোঁট নাড়িয়ে বললো,
—“এভাবে নাম ধরে ডাকলে..রোজ রোজ পুকুরে পরে গেলেও কিছু বলবোনা,প্রমিস!”।
_____________
রাতের খাবার খাচ্ছে তোহা।খাচ্ছে বলতে তাকে খাইয়ে দেয়া হচ্ছে।আতিয়ার হাতে খাচ্ছে সে।একবারো তাকে বের হতে দেয়া হয়নি রুম থেকে।পায়ের কাছটায় বসে আছে তিহান।অন্যকেউ নেই রুমে।আতিয়ার কড়া বকার উপর আছে সে।তবে সে নিজেও জানে সে বকা খাওয়ার মতো কাজই করেছে আজ।দু-একটা থাপ্পড় যে এখনো গালে পরেনি এইতো ঢের বেশি।তবে আতিয়া ছাড়া আর কেউ কিছু বলতে এলেই তাকে ভদ্রতার সহিত থামিয়ে দিচ্ছে তিহান।ফলস্বরূপ তিহান আর আতিয়া ছাড়া আর কারো বকার শিকার এখন অবধি হতে হয়নি।
যদিও তিহানের সাথে লজ্জায় চোখ মেলাতে পারছেনা তোহা।বয়সে তার থেকে এত বড় মানুষটাকে নাম ধরে কিভাবে ডেকে ফেললো?ইশ!”আপনি” করেই তো বলে সবসময়।আজকে কিভাবে যেনো শুধু নামটাই বেরিয়ে গেছে।

—“সামান্য মন খারাপ ছিলো বলে তুই এই ভর সন্ধ্যাবেলা পুকুর পাড়ে যাবি তোহা?”

তোহা উওর দিলোনা।চুপচাপ ভাত চিবাতে লাগলো।মাকে এ ব্যাপারে নিজের পক্ষ নিয়ে আর কিছু না বলাই শ্রেয়।কখন যেন দ্বিগুন রেগে যায়।

—“আর তোমার মেয়েকে হুদাই এতো কষ্ট করে টাকা খরচ করে সাঁতার শিখিয়েছিলাম আমি খালামনি?কি লাভ হলো বলোতো?”ফুঁসে উঠে বললো তিহান।আতিয়াও সাঁয় দিলো তার কথায়।

তোহা অপরাধীর মতো মাথা নুইয়ে আস্তে করে বললো,
—“আমি সত্যিই পারছিলাম না তিহান ভাই।পানি ছিলো অনেক।”।তিহান ঠোঁট চেপে তাকাল।একটা কারণে অবশ্য নিজের উপরই রাগ লাগছে।তবে আতিয়া সামনে আছে দেখে সে বিষয়ে কিছু বলছেনা।

খানিকবাদে আতিয়া ভাতটা খাইয়ে দিয়ে প্লেট রাখার জন্য বেরিয়ে যেতেই তিহান উঠে তোহাকে পানি খাইয়ে দিলো।নিজের হাতে ভেজা ঠোঁটের চারপাশ মুছিয়ে দিতে দিতে বললো,

—“তোমার মন খারাপ থাকবে কেনো?এই আমিটা আছি কি করতে?তোমার মনই যদি ভালো না রাখতে পারি তবে কিভাবে নিজেকে প্রেমিক দাবি করি বলোতো?এতো ঘোর অন্যায়”।

~চলবে~