এক রক্তিম শ্রাবণে পর্ব-৩৯

0
797

#এক_রক্তিম_শ্রাবণে❤️
#লেখিকা_মালিহা_খান❤️
#পর্ব-৩৯

সূর্য ডুবে গেছে প্রায় অনেকক্ষণ।চারিপাশে এখন আলোকশূন্য সন্ধ্যার বিষন্ন বাতাসের আনাগোনা।তবে সেই বাতাসের ছোঁয়া তোহার মন অবধি পৌছাতে পারেনি।কিশোরী মনটায় আজ খুশিখুশি আমেজ।গাড়ির মিরর গ্লাসে ফুটে ওঠা প্রতিচ্ছবিটার মধ্যে আটকে রয়েছে মুগ্ধ আঁখিযুগল।তিহানের পরিয়ে দেয়া গলার ছোট্ট লকেটটা গভীর নীলাভ রংয়ের।যে কারো দৃষ্টি আকর্ষন করতে পুরোপুরি সক্ষম।পাথরের আকৃতিটা একফোঁটা গড়িয়ে পরা পানির মতো।আধো তম্রসায় বুকের উপর এক টুকরো সমুদ্রের মতো জ্বলজ্বল করছে পাথরটা।তোহাকে নিরবিচ্ছিন্নভাবে আয়নার দিকে চেয়ে থাকতে দেখে মুখ খুললো তিহান।বললো,
—“পছন্দ হয়েছে?”

তোহা দিরুক্তি করলোনা।আড়চোখে তাকিয়ে লাজুক হেসে মাথা নামিয়ে ফেললো।হাসলো তিহানও।খানিকবাদে গাড়ি ড্রাইভ করতে করতে দাঁত দিয়ে ঠোঁট কাঁমড়ে ধরে আফসোস করে বললো,

—“এই জিনিসটা দেয়া উচিত হয়নি বুঝলে?”

তোহা ভ্রুকুটি করলো।কপালে ভাঁজ ফেলে অনুসন্ধিৎসু কন্ঠে বললো,
—“কেনো?”

তিহান এবার বাঁকা হাসলো।চট করে ঘাড় ফিরিয়ে লকেটটার উপর চোখ বুলিয়ে জ্বালাময়ী কন্ঠে বললো,

—“বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকলে তুমি আমাকে নির্লজ্জ বলবে।”

কিছুক্ষণ বোকা বোকা চাহনী দিয়ে অত:পর কথাটা বুঝে যেতেই বিশ্রিভাবে মুখ কুঁচকে ফেললো তোহা।নড়েচড়ে বসে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে অষ্পষ্ট স্বরে বললো,”ছিহ্!”

বাসায় ফিরতেই আতিয়ার মুখোমুখি হয়েছে তারা।গেট খুলে তিহান আর তোহাকে দেখে সহাস্য মুখে “ভেতরে আয়”বললেও পরমূহুর্তেই চোখের কোঁণায় সুক্ষ ভাঁজ পরলো তার।দৃষ্টি তোহার লকেটটায়।হাত বাড়িয়ে তা দেখে নিলেন তিনি।অত:পর তিহানকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
—“ভারি সুন্দর তো।এবারো জেদ করেছিলো নাকি?”

আতিয়ার কৌতুকপূর্ণ স্বর আর বলার ঢং দেখেই রসিকতাটা বুঝতে পারলো তিহান।আগে তোহাকে শাড়ি চুড়ি কিনে দিলে সবসময় সে বলতো”তিহু জেদ করে কিনেছে।”তার বলা কথাটা দিয়ে তাকেই জব্দ করার চেষ্টা করছে খালামনি।তিহান মাথা ঝুঁকিয়ে হেসে সহজ গলায় বললো,
—“এবার আর জেদ করার সুযোগ দেইনি খালামনি।জেদ করার আগেই কিনে দিয়েছি।”

তোহা বিস্ফোরিত নয়নে তিহানের মুখপানে চেয়ে থাকলো।এই লোকের মুখে কিচ্ছু আটকায়না।নিজের খালামনির সামনেও একরত্তি লজ্জা নেই।হাহ্!
__________
হুড়মুড় করে পার হয়ে গেছে আরো কয়েকটা মাস।ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ চলছে।তোহার টেস্ট পরীক্ষা শেষ হয়েছে পাঁচদিন আগে।কলেজজীবনের সমাপ্তি হয়ে গেছে প্রায়।এখন শুধু বাসায় পড়াশোনা করবে আর তারপর তিনমাস পর উচ্চমাধ্যমিক।শীতকালের প্রাদুর্ভাব ধীরে ধীরে বাড়ছে।আজকাল ভোরবেলায় কুয়াশায় আচ্ছাদনে ছেঁয়ে থাকে শহর।দিনের বেলায় সূর্যের রাজত্ব কম।স্তূপীকৃত মেঘের বেড়াজালে দিনের আলো তার ডালপালা ছড়িয়ে দিতে পারেনা।রাত্রিপ্রহরে মোটা শীতের কাপড় না পরলে কাঁপুনি ধরে যায়।

গুমোট বিকেলবেলায় গোসলে ঢুকেছে তোহা।সকালে ঘুম থেকে উঠতে পারেনি।দুপুর পর্যন্ত কম্বল গায়ে দিয়ে বেঘোরে ঘুমিয়েছে।তাও ঘুমটা পুরোপুরি হয়নি।আরো কিছুক্ষন ঘুমোতে পারলে ষোলোকলা পূর্ণ হতো কিন্তু তার আগেই ফ্যানের আকস্মিক নষ্ট হয়ে যাওয়ার তা আর পূর্ণতা পায়নি।শীতকাল হলেও ফ্যান আর কম্বল ছাড়া ঘুম হয়না তোহার।
দুপুর থেকেই মেজাজ খারাপ থাকায় ভেবেছিলো আজ গোসলটা বাদ দিবে কিন্তু বিকেল হতেই নোংরা নোংরা বোধ করায় তা আর করতে পারেনি।

কলিংবেলের শব্দের তুমুল উপদ্রবে বিছানা ছেড়ে উঠে গেলো তূর্য।তোহা গোসলে যাওয়ার আগে তাকে বলে গিয়েছে কেউ বাসায় আসলে যেনো গেট খুলে দেয়।আতিয়া দরজা আটকে ঘুমাচ্ছে আর আরমান সাহেব বাসায় নেই।তাই তূর্যকেই যেতে হবে।
দরজার বাইরে একটা অচেনা ছোকরা টাইপের ছেলের সাথে তিহানকে দেখে ভ্রু কুঁচকালো তূর্য।তাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে তিহান বললো,
—“তিহুর ঘরের ফ্যান নাকি নষ্ট হয়ে গিয়েছে?খালামনি মিস্ত্রি ডাকতে বলেছিলো।”

তূর্য ভদ্রতার সহিত সরে দাড়ালো।আজকে সকাল থেকে রুম থেকে বের হওয়া হয়নি।সে জানতোনা তোহার ফ্যান নষ্ট হয়েছে।জানলে আর তিহানকে কষ্ট করতে হতোনা সে নিজেই মিস্ত্রি নিয়ে আসতো।
তোহার রুমের সামনে যেয়ে একটু দাঁড়ালো তিহান।নক করার জন্য হাত বাড়াতেই তূর্য মুচকি হেসে বললো,
—“তোহা গোসলে গেছে।ভেতরে যান,সমস্যা নেই।”

আস্তে করে দরজা খুললো তিহান।রুমে কেউ নেই ব্যাপারটা শতভাগ নিশ্চিত হতেই তূর্য আর ছেলেটাকে ঢোকার জায়গা দিলো।বাথরুম থেকে পানি ঢালার শব্দ আসছে অনবরত।এই বিকেল বেলায় মেয়েটার কিসের গোসল?সর্দিজ্বর বাঁধাবে পরে।

বিছানার উপর একটা টুল বসিয়ে তার উপর উঠে ফ্যানে যন্ত্রপাতি চালাচ্ছে ছেলেটা।তূর্য এটা ওটা এগিয়ে দিচ্ছে নিচে রাখা যন্ত্রপাতির ব্যাগটার থেকে।তিহান দাড়িয়ে আছে বাথরুমের দরজার পাশের দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে।তার কঠোর দৃষ্টি ছেলেটার দিকে।কিভাবে কি করছে তাই তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষন করছে।
বাথরুমের ভেতরের পানি পড়ার শব্দ বন্ধ হতেই মস্তিষ্ক সচল হয়ে উঠলো তার।ছিটকিনি খুলে দরজাটা ফাঁক হতেই সচকিত দৃষ্টিতে সেদিকে তাকালো তিহান।কয়েকসেকেন্ড তোহার সদ্য স্নানকরা পবিত্র মুখখানা আর স্নিগ্ধ ভেজা চুলগুলো দেখে নিয়ে দরজার হাতল আঁকড়ে ধরে গলা নামিয়ে অবরুদ্ধ কন্ঠে বললো,
—“এখন না,একটু পরে বের হ।”

তোহা হতবিহ্বল কন্ঠে আশ্চর্য হয়ে বললো,
—“পরে মানে?আমি কি বাথরুমে দাড়িয়ে থাকবো?বের হতে দিন।”

চোয়াল শক্ত করে চোখ রাঙানো তিহান।বললো,
—“মানা করেছিনা?”
নিভে গেলো তোহা।বাধ্য মেয়ের মতো দরজাটা আবারো আটকে দিয়ে থম ধরে দাড়িয়ে রইলো বাথরুমের ভিতর।ঘরে মিস্ত্রি এসেছে তা সে বুঝতে পেরেছে।ওয়াশরুমের ভিতর থেকেও সবই শোনা যায়।কিন্তু তাই বলে তাকে বেরোতে দিবে না তিহান?অদ্ভুত!প্রায় দশ পনেরো মিনিট পর ঘরের ভেতরের পুরুষালি কন্ঠস্বরগুলো থেমে গেলো।দরজায় কান পেতে সে বুঝলো মিস্ত্রি চলে গিয়েছে।কিছু বলার আগেই তিহান দরজায় নক করে বললো,
—“এখন বের হ।”

তোহা বের হলো।পরণে লালরঙা কামিজ।গায়ে ওড়না নেই।জামার লাল ওড়নাটা বালিশের পাশে রাখা।খুব সম্ভবত ভেতরে নিতে যেতে ভুলে গিয়েছিলো।চুলগুলো এখনো ভেজা।গলা ভেজা।পানিগুলো মুক্তোদানার মতো আকর্ষন করছে।তিহান বিছানায় বসেছে।চোখমুখ স্হির।”

—“আপনি কি পাগল নাকি?”বিরক্তির সুরে কথাটা বলে বালিশের পাশ থেকে ওড়নাটা নিয়ে গায়ে জড়ালো তোহা।চুলগুলো কানের পিছে গুঁজে তিহানের দিকে এগিয়ে আসতেই তিহান তাকে হাত টেনে পাশে বসিয়ে চুলে ডানহাতের পাঁচআঙ্গুল ডুবিয়ে দিয়ে বললো,

—“”তোমার ভেজা চুলে অন্য কারো নজর পরবে তা তো আমি কি করে হতে দেই?।”

—“ছেলেটা ফ্যান ঠি ক করতে এসেছিলো।আমার ভেজা চুল দেখতে নয়।”তেঁতো কন্ঠে বললো তোহা।

—“তা ঠি ক,কিন্তু তুমি ওর সামনে বের হলে ওর নজর তো তোমার উপর পরতোই।তাইনা?”বলতে বলতেই তিহানের চোখ গেলো তোহার গলার দিকে।তার দেয়া লকেটটা না দেখতে পেয়ে মূহুর্তেই দৃষ্টি সরু হয়ে এলো।শক্ত কন্ঠে সে বললো,
—“তোমার লকেট কোথায়?”

তিহানের হঠাৎ রাশভারি কন্ঠে চমকে উঠলো তোহা।চোখ নামিয়ে আমতা আমতা করে ড্রেসিং টেবিলের দিকে হাত দিয়ে দেখিয়ে বললো,
—“ওইযে…,খুলে রেখেছিলাম।সাবান পানিতে যদি নষ্ট হয়ে যায়।”

তিহান সাথেসাথেই চুল থেকে হাত সরালো।আদেশসূচক কন্ঠে বললো,
—“নিয়ে আসো।”

তোহা চুপসে গেলো পুরোদমে।তিহান যে রেগে আছে বুঝতে বাকি নেই।ধীরপায়ে উঠে গেলো সে।লকেটটা এনে তিহানের হাতে না দিয়ে আড়ষ্ট কন্ঠে বললো,

—“আমি পরে নিচ্ছি।ভাইয়া এসে পরলে কি ভাববে..”

কথাটা শেষ করার আগেই হাত থেকে লকেটটা নিয়ে একটানে তোহাকে বিছানায় বসালো তিহান।ভেজা চুলগুলো একপাশে এনে লকেটটা পরানোর জন্য কাছে ঝুঁকে গেলো।হুক না দেখে তো আর আটকাতে পারবেনা।মূহুর্তেই জমে গেলো তোহা।তিহানের গাল তার কানের পাতা স্পর্শ করছে।নি:শ্বাসগুলো ছড়িয়ে পরছে ঘাড়ের কাছটায়।তোহা আমতা আমতা করে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো তার আগেই তিহান তাকে থামিয়ে দিয়ে প্রবল অধিকার নিয়ে বলে উঠলো,

—“আজ পরিয়ে দিচ্ছি।আর কখনো যেন খুলতে না দেখি।”

~চলবে~