এক শ্রাবণ হাওয়ায়-২ পর্ব-১৮+১৯

0
761

#এক_শ্রাবণ_হাওয়ায়-২
#লেখিকা – কায়ানাত আফরিন
#পর্ব – ১৮
আনভীরকে ইগ্নোর করার জন্য আমার যা করা দরকার তাই করেছি আমি। আজকে হসপিটালের ম্যানেজিং ডিরেক্টরের সাথে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি মিটিং ছিলো এখানকার সকল ইমপ্লয়িদের। মূলত এখানকার কিছু ফ্যাসিলিটি বাড়ানোর চিন্তা নিয়েই এই মিটিংটা করা। প্রায় তিনঘন্টার এই মিটিংয়ে আমাদের ইন্টার্নশিপ কমপ্লিট ট্রেনিংপ্রাপ্ত মেডিক্যাল স্টুডেন্টদের আর কতদিন এভাবে কাজ করতে হবে সে ব্যাপারলেও কিছু আলাপচারিতা হচ্ছিলো। মিটিং শেষে আমি ক্লান্তি নিয়ে কেবিনে আসলাম।
ধ্রুব স্যারের অন্তর্ভুক্ত হয়ে কাজ করছি বলে আমার টেবিলটা উনার কেবিনেই ছিলো। আর আমার কাজ হচ্ছে সব পেশেন্টদের রিপোর্ট চেক করে সেটার কন্ডিশন স্যারকে বলা।

টাইম ট্যাবেল চেক করে আরও একদফা হতাশ হলাম আমি। সচরাচর আমার ডিউটি দুপুরে পড়ে কিন্ত আজ পড়েছে সকালে। পরক্ষণে ভাবলাম ভালোই হয়েছে। এতে মোবাইলে এত এটেনশনও থাকবে না আবার আনভীর কল দিলেও মাথা ঘামাতে পারবো না।
উনার নির্বিকার ভাবের কথা স্মৃতিচারণ করেই রাগে গা শিরশির করে আমার। নিজেকে কি ভাবে মানুষটা? কই আমার কেয়ার করবে সেটা না করে নিজের মতো হেসে খেলে বেড়াচ্ছে৷ আজ আর যাই হোক, মোবাইল যেহেতু অফ করেছি সেটা আর খুলবো না। কল করতে থাকলে করুক। উনাকেও বুঝতে হবে ইগ্নোর জিনিসটা কত বিচ্ছিরি ব্যাপার।

ডিউটি শেষে আমি হসপিটালের ক্যান্টিনে বসে ছিলাম চুপচাপ। টেবিলে রাখা ক্লিপ বোর্ডের কাগজগুলোতে মনোযোগ দিয়ে নিজের শিডিউল দেখতে ব্যাস্ত। আমায় এভাবে বসে থাকতে দেখে আমার মেডিকেল ব্যাচমেট ধারা আর ইশা এসে বসলো আমার পাশে। ওরা নিজেদরে মধ্যে আলাপচারিতা চালালেও আমার ওদিকে মন নেই। হুট করে কেউ বললো,

‘ এখন লাঞ্চ টাইম আহি! এসব কাজ তো তোমায় আমি লাঞ্চ টাইমে করতে বলিনি।’

আমি মাথা উচিয়ে দেখলাম ধ্রুব স্যার দাঁড়িয়ে আছেন। এপ্রোনটা এখনও খুলেননি। আমি মিহি হেসে বললাম,

‘ ওমন কিছু না স্যার। আমি লাঞ্চ করবো না। আপনি কেবিনে প্রফেসরের সাথে ব্যাস্ত ছিলেন বলে এখানে এসেছি।’

‘ তাই বলে লাঞ্চ করবে না?’

‘ পরে করবো।’

ধারা পাশ কেটে বলে ফেললো,

‘ আপনি আমাদের সাথে লাঞ্চ করুন স্যার। আহি নাহয় পরে করবেনে। ডক্টর সিনথি এখনি এসে পড়বে।’

‘ ওয়েট আমি কফি নিয়ে আসি আহির জন্য!’

স্যার একথা বলে যাওয়া মাত্রই ধারা আর ইশা দুষ্টু হেসে বলে উঠলো,

‘ কেয়া বাত হে মেরি জান, তুই দেখি স্যার এর ‘দিল কা টুকরা’ হয়ে গিয়েছিস!’

আমি আড়চোখে তাকিয়ে বললাম,

‘ সবসময়ই ফাজলামো না করলে হয়না বুঝি?’

‘ আরেএএ, বুঝবি বুঝবি। পরে নাহয় টের পাবি। আচ্ছা শোন তো আহি! তোর কাছে ধ্রুব স্যারের নাম্বার আছে?’

‘ হ…হ্যা কেনো?’

ধারার এ কথায় আমি জিজ্ঞেস করলাম ওকে। ধারা এবার বললো,

‘ আরে তুই দে তো! এত কিছু জানতে হবে না।’

এদিকে আমি ভাবছি অন্যকিছু। কারন আমার ফোন বন্ধ। যদি আনভীর আগে ফোন দিয়ে থাকে আর মোবাইল বন্ধ পায় তবে সুইচ অন করলেই উনার কাছে এসএমএস যাবে যেটা সচরাচর সকল সিম কোম্পানিতেই হয়ে থাকে।

‘ কি হলো দে?’

ধারার কথায় আমার ধ্যান ভাঙলো। সুইচ অন করে কল লিস্ট থেকে এবার স্যারের নাম্বারটা দিতেই হুট করে কল আসলো কারও। স্ক্রিনে ‘চাশমিশ বিলাই’ নামটা দেখেই রুহু কেপে উঠলো আমার। ইশা স্ক্রিনে এমন অদ্ভুত নাম দেখে বললো,

‘ চাশমিশ বিলাইটা আবার কে?’

‘ তুই যদি জানতি এটা কে তাইলে এখানেই খুশিতে মরে যেতি!’

বিড়বিড়িয়ে কথাটি বললাম আমি। ধারা এবার বললো,

‘ কি হলো? কল রিসিভ কর!’

আমায় এভাবে বসে থাকতে দেখে ধারাই মাতব্বরি করে কল রিসিভ করে আমার কানে ধরিয়ে দিলো। ওপর পাশ থেকে বলে উঠলো,

‘ হোয়ার আর ইউ আহি?’

এই চারটা গম্ভীর শব্দ আমার নিঃশ্বাস বন্ধ করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিলো। আমি প্রতিক্রিয়াহীন ভাবে বসে রইলাম। কানের কেবল শুনতে পাচ্ছি অপর মানুষটার নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের শব্দ। এর মধ্যে কফির কাপ নিয়ে এলো ধ্রুব স্যার। সেটা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,

‘ কফিটা খেয়ে নাও।’

কথায় আছে না,’যেখানে বাঘের ভয়; সেখানেই সন্ধ্যা হয়’, আমার সাথে এরকমই কিছু হয়েছে। ধ্রুব স্যারের কন্ঠ শুনে অপরপাশে মিহিয়ে গেলেন আনভীর। বুঝলাম এই মিহিয়ে যাওয়াটা খুব ভালো একটা লক্ষণ নয়। আমি মোবাইলটা কানে ধরেই ধ্রুব স্যারের দিকে হেসে বললাম,

‘ ধন্যবাদ স্যার!’

‘ ইটস ওকে! আফটার অল আমরা একসাথে কাজ করি, ছোট খাটো ক্ষেত্রে এসব তো চলেই।’

ফট করে অপরপাশে কল কেটে দিলেন আনভীর৷ আমি পরপর দু’বার শুকনো ঢোক গিলে তাকিয়ে থাকলাম মোবাইল টার দিকে। এতক্ষণ আমি রেগে থাকলেও এখন ভয় হচ্ছে রীতিমতো। লাঞ্চ টাইম শেষ বলে আর না ভেবে লিফটের দিকে চলে গেলাম।

_________

ঘড়ির কাটায় তাকিয়ে দেখি সাড়ে চারটা বাজে। আজকের জন্য কাজ প্রায় শেষ আমার। আজকে হুট করে শিউলি ভাবি কল দিয়েছিলো৷ বলেছিলো আগামীকাল আঙ্কেল-আন্টির বিবাহবার্ষিকী তাই আসতে বলেছিলো আমাদের৷ আমি মিহিয়ে গেলাম। ভাবি হয়তো ভাবে যে আমাদের ব্যাপারটা অন্য চারপাঁচ জনের মতোই স্বাভাবিক কিন্ত ব্যাপারটা আপাতদৃষ্টিতে এমন না। আনভীর সবসময় আমায় নিয়ে একটু বেশিই বাড়াবাড়ি করেন। সবকিছুতেই আমার বাঁধা। এদিকে আমি যতটুকু জানি আনভীর যাবেন না এই ছোট্ট প্রোগামটিতে যতই এটা উনার বাবা-মাকে ঘিরেই হোক না কেন। তবুও আমি আশ্বস্ত করলাম ভাবিকে। বললাম, চেষ্টা করে দেখবো উনাকে মানানোর।

কল কাটার পর ইশা জিজ্ঞেস করলো,

‘ কার সাথে কথা বলছিলি?’

অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম আমি। কেননা আনভীরের কথামতো আমি কাউকেই কিছু বলিনি এ ব্যাপারে৷ তাই মিনমিনিয়ে বললাম,

‘ আমার দূরসম্পর্কের এক ভাবি। দাওয়াত দিয়েছিলো আমায়!’

‘ ওহ! তুই কি তাহলে মিরপুরের ওই আগের ফ্ল্যাটেই থাকিস যেটা তোর ওই কাজিন ব্রাদার দিয়েছিলো? ‘

ইশা অপূর্ব ভাইয়ার কথা বলতেই আমি তৎক্ষনাৎ বললাম,

‘ না, অন্যজায়গায় থাকি এখন।’

‘ একদিন পারলে নিয়ে যাস তোর নতুন বাসায়।’

ইশার কথায় সম্মতি জানালাম আমি। যদিও তা হয়তো সম্ভব না। তখনই এক পিয়ন এসে আমায় বললো,

‘ মিস আহি! আপনাকে ডক্টর ধ্রুব ডাকছে।’

ঘড়ির কাটায় তাকিয়ে একটু অবাক হলাম। যতটুকু জানি এসময় তো উনার হসপিটালে থাকার কথা না। কারন সন্ধ্যার সময় উনি পুরান ঢাকার সুমনা হসপিটালে বসেন। যার জন্য আগেভাগেই বের হতে হয়৷ তাহলে এখন এখানে আছে কেন? এসব ভাবতে ভাবতেই আমি দরজা খুলে বললাম,

‘ স্যার আসবো?’

‘ হ্যাঁ আসো।’

স্যারের অপরপাশে একজন বসে আছে আমার দিকে পিঠ দিয়ে। আমি সেখানে খেয়াল না করেই বললাম,

‘ ডেকেছিলেন স্যার?’

‘ হ্যাঁ! আমি তোমায় একজনের এক্স-রে রিপোর্ট রাখতে দিয়েছিলাম না? তুমি তো আমায় ওটা দিয়ে যাওনি।’

‘ ওহ! ভুলে গিয়েছিলাম। এখনি দিচ্ছি। ‘

বলেই আমি উনার পাশে আমার ডেক্সটার ড্রয়ার খুলে সেই রিপোর্ট দিলাম। আমি জানতাম না কার রিপোর্ট ছিলো এটা। কিন্ত সেটা স্যারের কাছে দেওয়ার সময় যাকে দেখলাম তাকে দেখে কয়েক মুহূর্ত স্তব্ধ হয়ে ছিলাম আমি। আচমকা বলে উঠি,

‘ আপনি?’

ধ্রুব স্যারের অপজিটে আনভীর বসে ছিলেন। ক্যাপ, সানগ্লাস আর মাক্স পড়ে থাকায় হয়তো দূর থেকে কেউ ভালোভাবে খেয়াল করেনি উনাকে। আর এই হাসপাতালে কম বেশি অনেক বিজনেসম্যান, সেলিব্রেটি, পলিটিশিয়ানরা আসে। এর একটি কারন দেশের বেসরকারি হাসাপাতালে মধ্যে এটা আপাদত প্রথম সারিতে আছে। আর দ্বিতীয় কারন এর সুযোগ-সুবিধা। আনভীর মিহি হেসে বললেন,

‘ কেমন আছো আহি?’

বিস্মিত হলেন ধ্রুব স্যার। সেই সাথে আমিও। কেননা আমাদের মধ্যে কথা হয়েছিলো আমাদের পরিচয় কিছুতেই যেম প্রকাশ না পায়। তাহলে! ধ্রুব স্যার এবার জিজ্ঞেস করলেন,

‘ আহিকে চিনিস তুই?’

ধ্রুব স্যার যে আনভীরের স্কুল ব্যাচমেট, সেটা জানতাম। এই কথাটি উনি প্রথমদিনই বলেছিলেন। তবে ধ্রুব স্যারের কথা শুনে এক গাল হাসলেন আনভীর৷ আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন,

‘ চিনি তো! সি ইজ মাই বেবিগার্ল। ‘

বুকে কেউ এক কেজি পাথর বসিয়ে দিলো আমার। ধ্রুব স্যার বললেন, ‘ কি?’

‘ আই মিন, আমার বাবার বন্ধুর মেয়ে। সবসময় বেবিগার্ল বলেই ডাকতাম। এখনও তাই ডাকি৷ তাই না?’

বলেই আমার দিকে তাকিয়ে চশমার আড়ালেই চোখ টিপ মারলেন উনি। আমি তাজ্জব না হয়ে পারলাম না৷ একটা মানুষ যে কতটা লু/ই/চ্চা হতে পারে এই চাশমিশ বিলাইরে না দেখলে আমি হয়তো জানতেই পারতাম না। হেসে দিলেন ধ্রুব স্যার। চুলগুলোতে আঙুল চালিয়ে বললেন,

‘ আমিও কি ভাবলাম!’

আনভীর কিছু বললেন না আর। এক্স-রে রিপোর্টটা আসলে ছিলো আনভীর যার আন্ডারে এবার সং কভার করছেন তার। আর উনি যে কেন এখানে এসেছেন সেটা ভালোমতোই জানি আমি। আমি এবার অপ্রস্তুত হয়ে বললাম,

‘ আমার দেরি হচ্ছে। আমি গেলাম তাহলে।’

বলে দ্রুতই বেরোলাম আমি। নাহিদ ভাইয়া নিচে আছেন আমি জানি। তাই এখানে আনভীরের সাথে কথা না বলাটাই ভালো হবে। অন্যথায় কেউ দেখলে হিতে বিপরীত হয়ে যাবে৷ লিফটে ঢুকে সুইচে চাপ দিতেই ঝড়ের গতিতে লিফটে ঢুকলেন আনভীর। দটজাটা বন্ধ হওয়া মাত্র একেবারে ঘেষেই দাঁড়ালেন আমার সাথে। আমি নিশ্চল হয়ে গেলাম। ক্রমেই টের পেলাম বুকে দুড়ুম দুড়ুম শব্দ হচ্ছে। আমি আমতা আমতা করে বললাম,

‘ ক…কি হয়েছে?’

আমায় এতটা অপ্রস্তুত হতে দেখে তৃপ্তির হাসি দিলেন আনভীর৷ কালো চুল, চিকন ফ্রেমের গ্লাস, ব্লু ডেনিম আর মুখের বাকা হাসি তোলপাড় লাগিয়ে দিয়েছে আমার হৃদয়ে। আনভীর ঝুঁকে এলেন আমার দিকে। ফিসফিসিয়ে বললেন,

‘ অনেক জ্বালিয়েছো আজ আমায় বেবিগার্ল। এর শোধ ডিরেক্ট বাসায় গিয়ে তুলবো। ‘

লিফট খুলতেই উনি বেরিয়ে গেলেন এবার। সাথে উনার সেই বডিগার্ডটা বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। আমায় অবাক করে দিয়ে উনি গাড়ি নিয়ে চলে গেলেন সেখান থেকে। ইশারায় বললেন নাহিদ ভাইয়া কাউন্টারে আছে। আর উনি রাতে আসবেন। এগুলোর কোনো কিছুতেই মন নেই আমার৷ এখন বড়ই আফসোস হচ্ছে কেন যে মোবাইল সুইচ অফ করতে গেলাম! একটু আগের বলা কথাগুলো আবারও স্মৃতিচারিত হতে থাকলো,
‘ অনেক জ্বালিয়েছো আজ আমায় বেবিগার্ল। এর শোধ ডিরেক্ট বাসায় গিয়ে তুলবো। ‘
.
.
.
.
.
~চলবে ইনশাআল্লাহ

#এক_শ্রাবণ_হাওয়ায়-২
#লেখিকা – কায়ানাত আফরিন
#পর্ব – ১৯
গাড়ি ড্রাইভ করছে আনভীর। পাশেই বসা ওর বডিগার্ডটা। সচরাচর বডিগার্ড ড্রাইভ করলেও আজ ওর ড্রাইভ করতে ইচ্ছে করছিলো। সেটা কিছুটা রাগবশতই। আহির কথা মাথায় আসতেই আনভীর তপ্ত নিঃশ্বাস ছাড়লো। ইচ্ছে করছে ধ্রুবটাকে জ্বালিয়ে ছারখার করে ফেলতে। পরক্ষণে নিজের ভাবনা সম্পর্কে ভাবতেই হেসে দিলো। না চাইতেও ‘আহি’ নামক চিন্তাচেতনা মস্তিষ্কে ঘিরে ধরছে বারবার৷ হঠাৎ পাশে থাকা বডিগার্ড মোবাইলে সিডিউল দেখে বলে উঠলো,

‘ নাহিদ স্যার বলেছে আপনার একজনের সাথে মিটিং ছিলো এআরকে!’

‘ কার সাথে?’

‘ একটা এড করার জন্য আপনাকে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিলো। ডাইরেক্টরের সাথে মিট করার জন্য নাহিদ স্যার টাইম দিয়েছে আজকে। ইন্টারকন্টিনাল এ!’

‘ ওহ!’

বলেই আনভীর স্টেয়ারিং ঘুরিয়ে ইন্টারকন্টিনাল এ যাওয়ার জন্য উদ্যত হলো। এই এড করার জন্য বিগত তিনমাস যাবত ডাইরেক্টর পিছু পিছু ঘুরছিলো। কিন্তু সময় বের করতে পারেনি আনভীর। পরবর্তীতে বাধ্য হয়ে বলেছিলো অন্যকাউকে এই অফারটা দিতে। কিন্তু রাজি হয়নি ডাইরেক্টর৷ আনভীর তাই পরবর্তীতে কিছু বলেনি আর। হঠাৎ মোবাইলে আননোন নাম্বার থেকে একটা কল আসাতেই খানিকটা অবাক হলো আনভীর৷ সচরাচর আননোন নাম্বার থেকে কল আসে না। তাই বডিগার্ডকে ইশারা করে বললো,।

‘ কলটা রিসিভ করো তো!’

তাই করলো বডিগার্ড। শক্ত গলায় বললো,

‘ হ্যালো কে বলছেন?’

আনভীর তপ্তশ্বাস ছাড়লো। এতদিনে একটা গার্ডকেও সে শেখাতে পারেনি কিভাবে নরম গলায় কথা বলতে হবে। রগে রগে এদের কঠোরতা। বডিগার্ড বিস্মিত হলো। বললো,

‘ আপনি কে সেটা বলেন?’

ওপরপাশের কথা শুনে বিরক্ত হলো বডিগার্ড। আনভীরকে বললো,

‘ মহাশয় ঘাড়ত্যাড়া এআরকে। বলছে আপনার সাথে কথা বলবে।’

‘ ওকে। ব্লুটুথ এক্টিভ করে কানেক্ট করো। কথা বলছি আমি।’

তাই করলো বডিগার্ড। আনভীর এবার কলের অপরপাশের মানুষটার উদ্দেশ্যে বললো,

‘ হ্যালো!’

অপরপাশের মানুষটা মৌনতা কাটালো কিছুক্ষণ। বলে উঠলো,

‘অপূর্ব বলছি। আমি আপনার সাথে দেখা করতে চাই এআরকে, রাইট নাও!’

বাকা হাসি দিলো আনভীর। বললো,

‘ আহা! অপূর্ব হাসান দেখা করবে আর আমি যাবোনা তা কি সম্ভব?……. এড্রেস পাঠান। দেখা করছি আমি।’

কল কেটে দেওয়ার শব্দে ক্ষীণ হাসলো আনভীর। বডিগার্ড এবার বললো,

‘ এআরকে! আপনার তো এখন মিটিংয়ে যাওয়ার কথা?’

‘ উনাকে বলে দাও, আগামীকাল কথা বলবো। আপাদত এই কাজটা উনার এডের রোল প্লে করার থেকেও বেশি ইম্পর্টেন্ট। ‘

এড্রেস অনুযায়ী সেখানেই এবার গাড়ি নিয়ে গেলো আনভীর। প্রায় এক ঘন্টার মধ্যেই পৌঁছে গেলো যথাস্থানে। ঢাকার বাইরে একটা হাইওয়ের রাস্তা এটি। রাত হওয়ার দরুন সুনসানও বটে। পাশ কেটে সা সা করে বড় বড় ট্রাক, গাড়ি ছুটে যাচ্ছে অন্য গন্তব্যের দিকে। আনভীর মিরর দিয়ে সামনে পিছনে তাকিয়ে এক কোণে একটি কালো গাড়ি দেখতে পারলো। সিক্সথ সেন্স স্পষ্টভাবে জানান দিচ্ছে কার গাড়ি। বডিগার্ড আনভীরের মতিগতি ধরতে পারছে না। অজান্তেই তাই সে নিজের গানের ট্রিগার লক খুলে ফেললো।

গাড়ি থামিয়ে সেখান থেকে বেরুলো আনভীর৷ অপূর্ব গাড়িতেই বসে আছে। আর তার পাশের মানুষটাকে দেখে বাকা হাসি দিলো সে। কেননা সেটা আর কেউ না রাহিই ছিলো।

অপূর্বকে দেখে আনভীর বলে উঠলো,

‘ তো কেমন আছেন অপূর্ব? আমায় মিস করছিলেন বুঝি?’

আনভীরের এসব ঠাট্টা মশগুলের কথাগুলো শুনে অপূর্বর ইচ্ছে করছে এখনই এই রকস্টারকে শেষ করে ফেলতে। দাঁতে দাঁত চেপে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করলো সে। বলে উঠলো,

‘ আপনাকে না। আহিকে মিস করছি। ‘

হাসলো আনভীর। অপূর্বের দিকে দৃষ্টি প্রগাঢ় করে বললো,

‘ আহি আপাদমস্তক আমার। ওকে কেন্দ্র করে যা হবে সেগুলো সব আমার। সেই হিসেবে ওকে মিস করার রাইটও আমার মি.অপূর্ব হাসান। ডোন্ট ডেয়ার টু সে ইট এগেইন।’

অপূর্বের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা রাহি শুকনো ঢোক গিললো আনভীরের এমন শীতল কন্ঠ শুনে। আনভীর উপর দিয়ে সহজ সরল থাকার চেষ্টা করলেও চাইলে অপূর্ব থেকেও ভয়ঙ্কর হতে পারে এটাই স্পষ্ট ইঙ্গিত পেয়েছে ওর কথায়। অপূর্ব এবার বললো,

‘ দেখুন রকস্টার! কি দরকার এসব খামখেয়ালি ঝামেলায় পড়ার? আপনার এক ইশারায় তো অজস্র মেয়ে বিছানায় শুতে দ্বিধাবোধ করবে না। তো আহির পেছন খামোখা ঘুরে কোনো লাভ আছে? আমি সিম্পলি একটা জিনিস বুঝাই। আহি আজ যে এই পর্যায়ে বেঁচে আছে, সেটা আমার জন্য। আরে ওর বাপই ওকে বাঁচিয়ে রাখতে চায় না। সেদিকে আপনি খামোখা ওকে নিয়ে পড়ে আছেন কেনো? কি সম্পর্ক আপনার আহির সাথে?’

আনভীর এবার নির্বিকার চোখপ তাকালে রাহির দিকে। রাহি বুঝেছে যে কিসের ইঙ্গিত করতে চেয়েছে সে। আনভীর এবার বলে উঠলো,

‘ খুঁজে বের করুন। আমি বললাম তো আহি আনার কাছে। এখন আমার সাথে ওর সম্পর্ক কি, আর ও কোথায়ই বা থাকছে, কেনই বা আমার সাথে থাকছে, সেটা খুঁজে বের করুন। আর হ্যাঁ……’

বলেই অপূর্বের একটু কাছে দাঁড়ালো আনভীর। বললো,

‘ যদি আহি কখনও বলে যে ও আপনার কাছে যেতে চায়, ট্রাস্ট মি আমি আহিকে ফেরত দিবো আপনার কাছে। বাট কোনোভাবে আপনি যদি জোর করার চেষ্টা করেন, দ্যান আই উইল কিল ইউ!’

আনভীরের এই কথায় নিজেকে ঠিক রাখতে পারলো না অপূর্ব। একজন রকস্টার ওকে থ্রেড দিচ্ছে এটা ভাবতেই গান বের করে তাক করলো আনভীরপর কপালে। এতক্ষণ অদূরেই দাঁড়িয়ে ছিলো আনভীরের বডিগার্ড। যেই না এটা দেখলো ওমনেই বডিগার্ড পরপর দুবার শুট করলো মাটির কাছে। নিশানা অন্যত্র গেলো অপূর্বের। বডিগার্ড আনভীরের সামনে এসেন দাঁড়িয়ে অনুগতদের ন্যায় বললো,

‘ আপনি গাড়িতে গিয়ে বসুন এআরকে, এদের আমি দেখছি। ‘

‘ এরা এমন কিছুই করবে না আসলাম। একবার এই দুঃসাহস টা করেই দেখুক! আর হ্যাঁ অপূর্ব,খুঁজে বের করুন আহিকে। ‘

এবার রাহির কাছে দাঁড়ালো আনভীর। অপূর্বের উদ্দেশ্যে বললো,

‘ এইযে এই মেয়েটা আছে না! ও হলো সব সমস্যার মূল। আমি আহিকে কেন আমার কাছে এনেছিলাম আর আমার সাথে আহির সম্পর্ক কি সেটা এই মেয়েটা খুব ভালো করে জানে। পারলে ওর কাছ থেকেই জেনে নিবেন। আফটার অল আপনারা সবাই তো এতবছর শুধু ইউজ করে গিয়েছিলেন আহিকে। কিন্ত এখন তা আর হবেনা অপূর্ব !’

এই বলে আনভীর তাকালো অপূর্বের দিকে। বললো,

‘ এটা ভাববেন না যে আহির পাস্ট সম্পর্কে আমি কিছু জানিনা। আপনি, আপনার বাবা ওরফে চাচা মশায়, আহির সো কলড বাবা এন্ড লাস্টে রাহি….শুধুমাত্র আহির মায়ের প্রোপার্টি হাসিলের জন্য যা যা করেছেন এর প্রাপ্য তো দুনিয়াতেই ভোগ করে যেতে হবে।
আহিকে ভুলে যান। কারন আমি থাকতে আহির টু পরিমাণ ক্ষতি করতে পারবেন না আপনি। ‘

বলেই আনভীর গাড়িতে উঠে চলে গেলো জায়গাটি প্রস্থান করে। অপূর্ব দাঁড়িয়ে আছে নির্বিকার ভঙ্গিমায়। চোখের দৃষ্টি নিষ্প্রভ। বারবার অপূর্ব একই ভুল করছে আনভীরকে সহজ সরল ভেবে। কিন্ত আনভীর ওমন না। অপূর্ব নিজের চুলে আঙুল চালালো। রাহির উদ্দেশ্যে বললো,

‘ আমি সব সত্য জানতে চাই রাহি! এআরকে কি চাচ্ছে আসলে?’

____________

ঘরে ক্রমাগত পায়চারি করে চলছি আমি। হসপিটালে তখন আনভীরের বলা কথাগুলোর কথা ভাবতেই আমার অন্তরাত্না রীতিমতো কেঁপে উঠলো৷ নাহিদ ভাইয়ার আমার দিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। সম্ভবত উনাকে কোনো কাজ দিয়েছে আনভীর। আপাদত তাই উনি ড্রইংরুমের সোফায় একগাদা কাগজপত্র আর ল্যাপটপ নিয়ে কাজে মশগুলো আছেন। নুড়ী আপা আমায় এক গ্লাস পানি দিয়ে গেলো।

আমি পানি খেয়ে তাকালাম নাহিদ ভাইয়ার দিকে। তারপর তার কাছাকাছি সোফায় বসে আদুরে কন্ঠে বললাম,

‘ ভাইয়াআআআ!’

নাহিদ ভাইয়া রীতিমতো অবাকপ্রসন্ন হয়ে তাকালো আমার দিকে। বললো,

‘ এভাবে ডাকবেন না আমায় ভাবি। আপনার মুখে এত আদুরে ডাক শুনলে ভয় লাগে আমার। এমনিতেতো কম জ্বালান না। না জানি আবার কি করতে বলবেন!’

আমি ফোস করে নিঃশ্বাস ত্যাগ করলাম। বললাম,

‘ আ…আসলে, আনভীর কখন আসবেন?”

‘ তা আমি কি করে বলবো? তার সাথে গার্ড আছে ভাবি ভয় পাবেন না।’

আরে আমি এজন্য ভয় পাচ্ছিনা রে ব্যাটা! ভয় পাচ্ছি অন্যকোনো কারনে। কিন্ত কারনটি কখনোই বলা সম্ভব না নাহিদ ভাইয়ার কাছে। আমি এবার ফট করে বললাম,

‘ আমি আজকে আপনার রুমে শুবো ভাইয়া!’

নাহিদ ভাইয়া সব কাজ ছেড়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো আমার দিকে। একপ্রকার তটস্থ হয়ে বললো,

‘ দেশি গাঁজা-টাজা খেয়েছেন নাকি ভাবি যে এসব বলছেন? আপনি আমার ছোট বোনের মতো ভাবি। ভাই যদি শুনে আপনার উল্টাপাল্টা কথা তবে পিটাবে আমায়।’

আমি অস্থির হয়ে বললাম,

‘ আরে আমি ওমন করে বলতে চাইনি ভাইয়া যেমনটা আপনি ভাবছেন। আমি….আমি বলছিলাম যে, আপনি আজকে আনভীরের সাথে ঘুমান। আমি আপনার রুমে ঘুমাবো!’

সন্দিহান চোখে তাকালো নাহিদ ভাইয়া৷ বললো,

‘ কেনো? কোনো ঝামেলা আছে নাকি!’

আমি এবার তেজি গলায় বললাম,

‘ ঝামেলা তো আপনার ওই খাটাস ভাইটা! আমি আজকে উনার রুমে যাবোনা, ব্যস!’

‘ তাই নাকি আহি!’

হঠাৎ এত গম্ভীর কন্ঠ শুনতেই থমকে গেলাম আমি। নাহিদ ভাইয়া বোকার মতো একবার আমার দিকে আর একবার ওদিকে তাকালো। যা ভেবেছিলাম তাই , আনভীর এসে পড়েছেন। এখানেই থামলেই হয়তো হতো। কিন্ত শুনেও ফেলেছেন আমার কথা। আমি উনার দিকে তাকিয়ে দেখলাম উনার মুখে নির্বিকারত্নের ছাপ। নুড়ী আপা উনাকেও পানি দিলেন এবার।

আনভীর ব্যস্ত স্বরে বললেন,

‘ আমার খাবার সব বক্সে ভরে ফ্রিজে রেখে দিন আপা।’

‘ আচ্ছা!’

বলেই চলে গেলো আপা। আমি ফাটা বেলুনের মতো বসে রইলাম। এবার আমার দিকে তাকালেন আনভীর। বললেন,

‘ আমার সাথে বেডরুমে আসো আহি!’

উনার মুখে আহি ডাকটি শুনে স্পষ্ট বুঝলাম, তখন মোবাইল অফ রাখার কারনে ভয়াবহভাবে রেগে আছেন উনি। আমি আহত চোখে তাকালাম নাহিদ ভাইয়ার দিকে। কিন্ত উনি এমন একটা ভাব নিয়ে আছেন যে আমাদের ত্রিসীমানার মধ্যেও উনি নেই। আনভীর পা বাড়ালেন উপরে যাওয়ার জন্য। আমি নাহিদ ভাইয়ার মুখে সোফার কুশন ছুড়ে তেজি গলায় বললাম,

‘ দিন আমারও আসবে একদিন, তখন আপনার ইনোসেন্ট ওয়ালা মুখ ছুটিয়ে বের করবো!’

বলেই গটগট করে এখান থেকে চলে গেলাম আমি৷ রুমে গিয়ে দেখলাম রুমে নেই আনভীর। সম্ভবত শাওয়ার নিতে গিয়েছেন। আমি এবার কি করবো ভেবে পেলাম না। তাই চুপচাপ বসে রইলাম খাটে। কিয়ৎপ্রহর অতিবাহিত হওয়ার পর দরজা খোলার শব্দে ধ্যান ভাঙলো আমার। আনভীর বেরিয়ে এলেন শাওয়ার সেরে।

উনাকে দেখে বিস্ফোরিত কন্ঠে লম্বা সময় তাকিয়ে থাকলাম আমি। কেননা আনভীর জাস্ট একটা ট্রাউজার পড়ে বেরিয়ে এসেছেন। গলায় একটি হালকা রঙের তোয়ালে ঝোলানো। অগোছালো চুলগুলো পানির স্পর্শে আরও অগোছালো করে তুলেছে উনাকে। আমি দৃষ্টি সরিয়ে নিলাম। ওড়না খামচে বসে রইলাম সেভাবে।

মানুষটার মধ্যে লাজ লজ্জার উচ্ছিষ্টটুকুও নেই। আনভীর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,

‘ সিরিয়ালের বউদের মতো বসে আছো কেনো টমেটো হয়ে? কাম হেয়ার। আমার চুল মুছে দাও। ‘

উনার এসব আদিক্ষেতা বিরক্তির দিকে ঠেলে দিলেও আমি কিছু বললাম না। চুপচাপ দু’পা উচু করে উনার সামনের চুলগুলো মুছে দিতে উদ্যত হলাম। কিছুক্ষণ পর আমি বললাম,

‘ টিশার্ট পড়ে নিন এখন!’

আনভীর মজা পাচ্ছেন আমায় এ অস্বস্তিতে দেখে
তাই বললেন,

‘ হোয়াট! আমি তো ভাবছি আজ সারারাত এভাবেই থাকবো?’

আমি সাথে সাথেই বললাম,

‘ মোটেও না। আপনার লাজলজ্জা না থাকলেও আমার আছে মি.!’

আনভীর সরু চোখে তাকালেন আমার দিকে। সম্ভবত ভাবছেন কিভাবে আমায় শাস্তি দেওয়া যায়। উনার দৃষ্টি দেখে আমার গলা শুকিয়ে গেলো। পিটপিট করে তাকালাম উনার দিকে।
আনভীর আমার দিকে খানিকটা ঝুঁকে এসে বললেন,

‘ এতই যখন আমি লাজলজ্জাহীন, ক্যারেক্টারলেস, খাটাস; আমার তো উচিত সেগুলোর যথার্থ প্রয়োগ করা। তাই না?’
.
.
.
.
~চলবে ইনশাআল্লাহ