#এক_শ্রাবণ_হাওয়ায়-২
#লেখিকা – কায়ানাত আফরিন
#পর্ব – ৩৮
‘ আমার তোমার মতো একটা কিউট মেয়ে বেবি চাই বুঝলে? তাই নিজেকে প্রস্তুত রাখবে। আজকাল তুমি যেভাবে আমায় পাগল করছো, হয়তো ক’দিন পরই বাবা-মাকে সুসংবাদ দিতে হবে।’
আনভীরের নিভু নিভু কন্ঠে এমন কথা শুনে কান গরম হয়ে গেলো আমার। সামনের পথ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে তাই বড় বড় চোখ করে তাকালাম আনভীরের দিকে। উনার চোখ মুখের ভাব প্রতিক্রিয়াহীন। তবে ঠোঁটে বিদ্যমান খুবই সুক্ষ্ম, খুবই সুক্ষ্ম এক ধরনের হাসি। এই হাসির মর্ম বুঝতে পারাতে আমার শরীর দিয়ে অদ্ভুত এক শীতল স্রোত বয়ে গেলো। মাথা হয়ে গিয়েছে শূণ্য। আমায় এভাবে দেখে আনভীর কথা না বলে গাড়ি স্টার্ট করলেন এবার। জিজ্ঞেস করলেন,
‘ প্রস্তুত তো?’
চমকে উঠলাম আমি। উনি কি আমায় বেবি নেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নেওয়ার কথা বলছেন? আল্লাহ! আমি তো ভেবেই অজ্ঞান হওয়ার উপক্রমে আছি আর এই লোক তো সে কথা বলেই আমার জান কেড়ে নিবে। আমি অস্বস্তি নিয়ে বললাম,
‘ মোটেও না।’
আনভীর আমার দিকে তাকিয়ে দুষ্টু হাসি দিলেন। সিট বেল্ট খুলে আচমকা এগিয়ে এলেন আমার কাছে। ততক্ষণাৎ উনার এমন কান্ডে বাকশূণ্য হয়ে গিয়েছি আমি। নিজের অবস্থান থেকে দু কদম পিছিয়ে সিটের সাথে ঘেষে বসে ভয়ার্ত চোখ করে উনার প্রতি দৃষ্টি আবদ্ধ করলাম৷ আর আমার ভাবনা উড়িয়ে নিঃশব্দে সিট বেল্ট লাগিয়ে দিলেন উনি। কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বললেন,
‘ বেবি নেওয়ার জন্য প্রস্তুত হতে বলিনি মিসেস আহি। জিজ্ঞেস করছিলাম এখন যাওয়ার জন্য প্রস্তুত তো?’
আমি সচকিত হয়ে ‘ হ্যাঁ’ প্রতিউত্তর দিলাম। আমি ভেবেছিলাম কি আর উনি বলেছেন কি। আনভীর সরে এলেন আমার কাছে থেকে। গাড়ির স্টেয়ারিং ঘুরিয়ে রোড সাইডে নিয়ে গেলেন এবার। ব্যাক মিররের দিকে তাকিয়ে একবার রাস্তা পরখ করে আমার উদ্দেশ্যে অস্ফুট স্বরে বললেন,
‘ আই লাইক ইউর ডার্টি মাইন্ড!’
লজ্জায় জুবুথুবু হয়ে বসে আছি আমি। এসি চলা সত্বেও কপালে জমে উঠেছে বিন্দু বিন্দু ঘাম। আনভীর নীরবে ড্রাইভ করছেন। আমি একটা কথাও বলিনি অস্থিরতায়। হঠাৎ মোবাইলে কলের আওয়াজে আমার ধ্যান কাটলো। স্ক্রিনে ভেসে উঠলো ‘ধ্রুব স্যার’ লিখাটি।
আনভীর ড্রাইভ করা অবস্থাতেই একবার আমার মোবাইলের দিকে আর একবার আমার মুখের দিকে শীতল দৃষ্টিতে তাকালেন। তড়িঘড়ি করে তাই মোবাইল রেখে দেই আমি। কিন্ত কিছুক্ষণ পর আবার কল আসতেই হতাশায় হাসফাস করতে থাকলাম। এবার কল কেটে দেওয়ার জন্য মোবাইল হাতে নিতেই আনভীর বাঁধা দিলেন আমায়৷ বললেন,
‘ কল রিসিভ করো।’
আমি অপ্রতিভ হয়ে হয়ে পড়লাম। তাই জিজ্ঞেস করলাম,
‘ র-রিসিভ করবো?’
‘ রিসিভ করে আমার কাছে দাও।’
আমায় আরও একধাপ অবাক করে দিয়ে বলে ফেললেন আনভীর। আমি তাজ্জব হয়ে বললাম,
‘ পাগল টাগল হয়ে গেলেন নাকি? আপনি কি কথা বলবেন?’
আনভীর কথা বাড়ালেন না। একহাতে ড্রাইভ করতে করতে অন্যহাত দিয়ে খপ করে ধরে ফেললেন আমার হাতের মোবাইলটি। রিসিভ করে বললেন,
‘ হ্যালো!’
অপরপাশে হয়তো হকচকিয়ে গিয়েছেন ধ্রুব স্যার। আমায় কল দিয়ে হঠাৎ পুরুষালি কন্ঠ শুনে হয়তো খেয়ালই করেননি এই পুরুষালি কন্ঠের অধিকারি মানব আসলে উনার বন্ধু। বস্তুত এটা স্বাভাবিক ব্যাপার। অপরপাশে ধ্রুব স্যার বললেন,
‘ হ্যালো! এটা কি আহির নাম্বার?’
‘ হ্যাঁ এটা আহির নাম্বার এন্ড আমি ওর উড বি। এনি প্রবলেম? ‘
আমি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকি উনার দিকে। অপরপাশে হয়তো ধ্রুব স্যারও রীতিমতো থতমত খেয়ে গিয়েছেন। বলে উঠলেন,
‘ আহির উড বি আপনি? কই আমায় তো আহি কিছু বললো না?’
আনভীর বিদ্রুপ স্বরে বললেন,
‘ যতটুকু আমি জানি আপনার সাথে আহির প্রফেশনাল লাইফ ছাড়া আর কোনো পার্সোনাল কথা হওয়ার কথা না ড. ধ্রুব।’
‘ আপনি আমার কথাও জানেন?’
‘ তো জানবো না? আহি সবকিছুই বলেছে ওর প্রফেশনাল লাইফের কথা। এমনকি আজকে আপনি ডিনারের অফার করেছেন সেটাও। কিন্ত কি করবো বলুন, আমার উডবি ওয়াইফ মানে তো ওয়াইফই হয়৷ আর তাই আজকে আমি অফার করেছিলাম ডিনারে যাবো। আমার কথা বেচারি আর ফেলতে পারেনি।’
‘ ওহ! এখন বুঝলাম আহির জরুরি প্রোগামের কথা।’
‘ আপনার সাথে কথা বলে ভালো লাগলো বেশ। আহি তো আপনাকে বড় ভাইয়ের মতোই সমীহ করে। প্রবলেম নট ব্রাদার৷ আমাদের বিয়ে হলে আমি সহ আহিকে আর একবার আপনার বাসায় ডিনারে দাওয়াত দিবেন কেমন?রাখি তাহলে।’
বলেই টুট টুট করে কল কেটে দিলেন আনভীর। এতক্ষণ আমার চোখ বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে ছিলো। এই মাত্র কিসব বললেন উনি ধ্রুব স্যারকে? কল কাটা মাত্র আমি খপ করে হাতিয়ে নিলাম মোবাইলটা। অবাক মিশ্রিত গলায় বলে উঠলাম,
‘ কিসব বললেন আপনি উনাকে?’
‘ কিসব বলেছি?’
‘ এইযে আপনি আমার উডবি, বিয়ে করবেন আরও কত কি?’
‘ তো সত্য বলতে চাও যে তুমি আসলে আমার কে?’
আমি চুপ হয়ে গেলাম। আনভীর খানিকটা হেসে ব্যাস্ততম নগরীর পথে মনোনিবেশ করলেন আবার। গাড়ির স্টেয়ারিং ঘুরাতে ঘুরাতে বললেন,
‘ তবে যাই বলো না কেন, যদি ধ্রুব জানে যে ওই মানুষটা ওর নিজেরই বন্ধু এআরকে নির্ঘাত হার্ট এট্যার্ক করবে।’
কথাটি সত্য বটে। আমি কিছু না বলে ঠোঁট চেপে হাসি দিলাম তাই।
___________
নেটফ্লিক্সে ‘কে ড্রামা’ ছেড়েছে নীলু। ওদের বাসায় সচরাচর নেটফ্লিক্স দেখা হয়না। তবে আনভীরের বাড়িতে এসে ভালোই একটা সুযোগ পেয়েছে। আহি যাওয়ার পর সেই যে ড্রইংরুমে টিভি দখল করে বসলো আর সরলো না। নুড়ী আপা একটু পরপর পপকর্ন তো জুস নাহয় অন্য কিছু এনে দিচ্ছে। এদিকে নাহিদ এক ঘন্টার একটা ঘুম দিয়ে এসে দেখলো নীলু সেখানেই আছে যেখানে দেখে রুমে গিয়েছিলো।
ক্ষান্ত হলো নাহিদ। তখনও নীলু টিভিতে মন দিয়ে ছিলো এখনও সেভাবে আছে দেখে কথা বাড়ানোর সুযোগ পেলো না। ডাইনিং টেবিলে খাবারের ঢাকনা গুলো উঠিয়ে দেখলো যে খাবার কি কি আছে। তারপর নীলুর কাছে এসে বলে উঠলো,
‘ ডিনার করবে না?’
নীলু টিভি থেকে দৃষ্টি সরিয়ে তাকালো নাহিদের দিকে। পরনে একটা লাইট ইয়েলো টিশার্ট যার বুকে বোল্ড ব্ল্যাক ওয়ার্ডে ”N” লিখা। সাথে পড়েছে গ্রে ট্রাউজার। ঘুম থেকে উঠে এসেছে বলে মুখটা অন্যরকম লাগছে।
নীলু কিছুক্ষণ হা হয়ে তাকিয়ে রইলো নাহিদের দিকে। এর চেহারা অনেকটাই এআরকে’র গঠনের। বিশেষ করে চোয়ালের দিকটা। হয়তো এআরকে’র কাজিন বলেই এতটা মিল।
‘ বলছি যে ডিনার করবে না?’
নাহিদের আবার ডাকাতে ধ্যান কাটলো নীলুর। এভাবে ফ্যালফ্যালিয়ে মানুষটার দিকে তাকিয়ে থাকাতে এবার লজ্জা পাচ্ছে বেশ৷ টিভি স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,
‘ আপু আসলে খাবো।’
‘ ভাবি ডিনার করতে গিয়েছে আনভীর ভাইয়ের সাথে। উনি কি ভাবিকে না খাইয়ে নিয়ে আসবে?’
নাহিদের এমন কথায় নীলুর ভাব বদলালো না। নির্বিকার কন্ঠে বলে উঠলো,
‘ ক্যান্ডেল লাইট ডিনারে খাওয়া কম রোম্যান্স বেশি হয় বস।আপনি সিঙ্গেল মানুষ তো, বুঝবেন না।’
.
.
.
.
#চলবে ইনশাআল্লাহ
#এক_শ্রাবণ_হাওয়ায়-২
#লেখিকা – কায়ানাত আফরিন
#পর্ব – ৩৯
‘ ক্যান্ডেল লাইট ডিনারে খাওয়া কম রোম্যান্স বেশি হয় বস।আপনি সিঙ্গেল মানুষ তো, বুঝবেন না।’
নাহিদ বিস্ময়ে তাকালো নীলু নামের মেয়েটার দিকে। বয়সে ছোট ছোট মনে হলেও কথার ধার এমন যে স্তব্ধ না হয়ে পারলো না। খানিকটা অবাক হয়ে বললো,
‘ এভাবে নিজের বোন দুলাভাইয়ের নামে এমন কথা বলতে বুক কাঁপে না?’
‘ ওমা! বুক কাঁপবে কেন? আমি কি আপনার মতো ভীতুর ডিম যে এআরকের এক ধমকেই হাটু কাঁপা-কাঁপি স্টার্ট করবো৷ আই নো মি. যে এআরকে চরম লেভেলের রোম্যান্টিক। আপনার জায়গায় আমি হলে বিয়ের জন্য হতাশায় হাসফাস না করে ফ্রিতে সিন দেখতাম। তাহলে কষ্ট করে আর কে. ড্রামা দেখতে হতো না।’
এই প্রথম মনে মনে অপমানিত বোধ করলো নাহিদ। বলে উঠলো,
‘ কে বলেছে তাদের দেখে আমি হতাশায় হাসফাস করি?’
‘ আমি কিন্ত জানি যে আপুর বার্থডে তে আপনি তাকে কি গিফ্ট দিয়েছেন। সাথে আপু এটা বলেছিলো না যে আপনার জন্য আপু সখিনা খালাকে নিয়ে আসবে?’
শেষ কথাটি নীলু বলে উঠলো বিদ্রুপ সুরে। নাহিদ ঘুনাক্ষরেও ভাবেনি যে আহি একথা নীলুকে বলে দিবে। তাই বিস্ময় নিয়ে বললো,
‘ ভাবি একথাও বলেছে আপনাকে?’
‘ তো বলবে না? দেবর আগে নাকি বোন আগে?’
নীলুর একথায় নাহিদ কিছু না বলে চুপচাপ ডাইনিং টেবিলে পা বাড়ালো৷ আজ আহির জন্য ওর মানসম্মান সব ব্লাস্ট হয়ে গিয়েছে। হতাশায় তাই আহির উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,
‘ আপনার নামে আসলে মানহানির মামলা করা উচিত ভাবি!’
————-
‘এআরকে’ হিসেবে সবার কাছে একটি বিশেষ খ্যাতি পাওয়াতে খুব বেশি জায়গায় জাওয়ার সুযোগ নেই আনভীরের। আর তা যদি ঘনবসতিপূর্ণ হয় তবে তো একেবারেই না। সেই সুবাদে উনি আমায় নিয়ে বেশ দূরেই একটা জায়গায় এসেছেন। জায়গাটা অবশ্য ঢাকার বাহিরে নয়, তবে আনভীরের বাসা থেকে জ্যাম জট পেরিয়ে বেশ দূরে বলাই চলে। এক ঘন্টার মধ্যেই আমরা পৌঁছে গিয়েছিলাম ‘লিটল ফ্লাওয়ার’ নামের রেস্টুরেন্টটিতে। নাম যেমন অদ্ভুত, ডেকোরেশও ছিলো অদ্ভুত। নিচতলায় মানুষ থাকলেও ওপরতলা পুরো খালি ছিলো একেবারে। সামনে একটা খোলা স্পেস থাকায় সেখানে ফুলগাছ বুনন করা ছিলো আর ভেসে আসছিলো অদ্ভুত কিছু ঘ্রাণ।
আকাশটা মেঘলা ছিলো আজ। ক্ষণে ক্ষণে চমকে উঠছে পরিবেশ। হালকা ছিমছাম হাওয়া আর মৃদু আলোয় পরিবেশনে খাবারগুলো থেকে আনভীরের চাহিনী কাবু করে ফেলেছিলো আমায়। সামনে জলন্ত দু’তিনটে ক্যান্ডেল দপদপ করছে। হয়তো একটা পাল্টা প্রবাহেই তা নিভে যাবে। আমি দু’হাত নিরাপদ দুরত্বে দিয়ে দিলাম যাতে বাতাসের প্রবাহে সেটা বন্ধ হয়ে না যায়। আনভীর নিরুদ্বেগে বললেন,
‘ বন্ধ হবে না এটা। তুমি হাত সরিয়ে নিতে পারো।’
তাই করি আমি। স্পুন নিয়ে খাবার মুখে পুরে নেওয়ার পর ভাবতে পারছিনা কি করবো। আনভীরও আছেন নিঃশব্দে। সেই সাথে আমিও। কি দিয়ে কথা আগাবো সেটা খুঁজে না পেয়ে মনে মনে বেজায় বিরক্ত হলাম। নীলু ঠিকই বলে। আসলেই আমি একটা গাধি।
‘ কি ভাবছো এত তুমি?’
আনভীরের কথায় পলক ফেললাম আমি। মিষ্টি হেসে বললাম,
‘ কিছু না।’
‘ উমমম্, দেখে তো মনে হচ্ছে তুমি গভীর চিন্তায় আছো। কয়টা বেবি নিবে সেটার প্ল্যানিং করছো নাকি?’
বিষম খেলাম আহি। চোখের পলক না ফেলে বড় বড় চোখ করে তাকালাম উনার দিকে। আনভীর আমার চাহিনীতে ভ্রুক্ষেপ না করে আনমনে বললেন,
‘ লিসেন আহি, বেবি নেওয়ার টাইম আছে অনেক। তোমায় এত তাড়াহুড়ো করতে হবেনা বুঝেছো? আগে আমি নিজের ক্যারিয়ারটা একটু সামলে উঠি, সবাইকে জানিয়ে তোমায় প্রোপারলি বিয়ে করি, দ্যান ভাবা যাবে। তোমার এই বর পালিয়ে যাবেনা বুঝলে?’
মাথা ঘুরাচ্ছে আমার এই লোকের কথা শুনে। আমি কখন বেবি নেওয়ার জন্য আবার তাড়াহুড়ো শুরু করলাম? অবাক প্রসন্ন অবস্থায় নিজেকে স্থির করে রেখেছি আমি। আনভীর আমায় এভাবে দেখে অদ্ভুত চাহিনী নিয়ে তাকালেন আমার দিকে। ভ্রু উচিয়ে বললেন,
‘ আই নো আই এম হ্যান্ডসাম মিসেস আহি। এই চাহিনী দিয়ে অনেকবার ঘায়েল করেছো।এতবার ঘায়েল না করলেও চলবে।’
উনার ঠাট্টা ধরতে পেরে আমিও বললাম,
‘ আমি আপনার দিকে তাকাতে যাবো কেনো?’
‘ আমি হ্যান্ডসাম তাই। আফটার অল, আমার ফ্যানরা তো আমায় দেখেই অজ্ঞান হয়ে যায়। এমন বহু টক্সিক ফ্যান দেখেছি আমি যে আমায় দেখামাত্রই বেহুঁশ। বুঝলে?’
ইশশশ! ভাব দেখলে বাঁচি না এই লোকের। তাই কোনো কথা না বাড়িয়ে নিজের কাজে মনোনিবেশ করিলাম আমি।
বাইরে চলমান রয়েছে ঝিরঝিরে বৃষ্টি। অগত্যাই রেস্টুরেন্টের ওপরতলায় দুজন বসে কিছুক্ষণ বৃষ্টিতে আচ্ছন্ন নগরীর সৌন্দর্যে ডুবে পড়লাম। ওয়েটার এসেছিলেন মাঝখানে। আনভীর কিছু একটা বলতেই উনি মুচকি হেসে চলে গেলেন। আমি জানিনা ব্যাপারটি কি। তবে সন্দিহান লাগলো ব্যাপারটা। কিন্ত উনাকে কিছু বললাম না। বৃষ্টির গতি কমার পর আনভীর আমায় নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন এখান থেকে। গাড়িতে আমায় বসিয়ে ফিসফিসানো কন্ঠে বললেন,
‘ কেমন লাগলো আজকের ডিনার?’
লজ্জায় মিহিয়ে পড়ি আমি। কেননা আজকের এই সময়টা আমার কাছে স্পেশাল তো ছিলো বটেই কিন্ত আনভীরের সাথে ওই মুহূর্তগুলোর কথা ভাবলেই অন্যরকম অনুভূত হতে থাকলো আমার। নীলু তাই এজন্যই বলেছিলো আমায় গুছিয়ে নিতে। আনভীর আমার মুখ দেখে বুঝে নিলেন তার কাঙ্খিত উত্তরটা। গাড়ি স্টার্ট করতেই যাবেন তখনই উনার মনে পড়লো যে উনি রেস্টুবেন্টে ক্রেডিট কার্ডটি ভুলে রেখে এসেছে। আমায় তাই ধাতস্থ করে বললেন,
‘ একটু বসো আহি। দু’মিনিটের মধ্যেই ফিরে আসছি।’
আনভীর চলে গেলেন তারপর। বৃষ্টি পড়ছে বিরামহীনভাবে। আমি ঘোলাটে গ্লাসে দেখতে পেলাম উনি দ্রুত পায়ে রেস্টুরেন্টে ঢুকলে। অন্যপাশ দিয়ে রকেট গতিতে ছুটে চলছে গাড়ি। হঠাৎ ড্রাইভিং সিটে পড়ে থাকা মোবাইলে টুং করে একটি শব্দ হলো। মেসেজ এসেছে আনভীরের। সচরাচর আমি অভ্যস্ত নই আনভীরের ফোন ধরে কিন্ত স্ক্রিনে ভেসে উঠা লেখাটি কৌতুহলী করলো আমায়। আমি তুলে নিলাম মোবাইলটি। নোটিফিকেশন বারে ছোট করে লিখা,
‘ ইমিডিয়েটলি তোমার সাথে দেখা করতে চাই এআরকে। এখনই আমার পুরনো ফ্ল্যাটে আসো।’
যে মেসেজটি পাঠিয়েছে, তার নাম দেখে অবাকের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছি আমি। সেখানে স্পষ্ট ইংরেজী ব্লক লেটারে লিখা ‘RAHI’। এটা যে আমার বড় বোন রাহি ছাড়া অন্য কেউ নয় তা ভালোমতোই বুঝতে পারলাম। আনভীর আবারও মিথ্যে বলেছেন আমায়। মিথ্যে বলেছেন যে উনি রাহি আপুর খোঁজ জানেন না। নাহলে রাহি আপু এত রাতে তার কাছে ডাকছে কেনো আনভীরকে? উনি কি আমার কাছ থেকে লুকিয়ে তাহলে রাহি আপুর সাথেই কিছু করছেন যার কথা অপূর্ব ভাইয়া বলেছিলো?
মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে আমার অসংখ্য প্রশ্ন। আনভীরের ব্যবহারে স্পষ্ট প্রকাশ পায় যে ঘৃণা করেন উনি রাহি আপুকে। আপুর জন্যই নাকি উনি আজ ফ্যামিলি থেকে দূরে। এটা সত্যি যে মায়ের মৃত্যুর পর রাহি আপু আর আমি বড় হয়েছি আলাদাভাবে সেই সুবাদে আপুর বাল্যকাল সম্পর্কে সবকিছুই অজানা আমার। কিন্ত এর মানে কি?
তন্মধ্যেই এসে পড়লেন আনভীর। আমার হাতে উনার মোবাইল দেখে চমকে উঠলেন। আমি স্তব্ধ হয়ে ছিলাম তখনও। নিষ্প্রভ চোখ দিয়ে রাখলাম মোবাইল স্ক্রিনের দিকে। আনভীর অপ্রস্তুত হয়ে বললেন,
‘ আহি আমার ফোন……’
ততক্ষণাৎ আরেকটি মেসেজ এলো রাহি আপুর কাছ থেকে। ভয়েস মেসেজ। আমি সময় ব্যয় না করে চাপ দিলাম ওটাতে। তখনই ওপাশ থেকে ভেসে এলো,
‘ জরুরি কথা আছে তোমার সাথে এআরকে। আমার ফ্ল্যাটে আসো রাইট নাও। একটা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছি। এটা দিয়ে সহজেই প্রমান করা যাবে যে বাবাই খুন করেছে মাকে। এতে আহি ওর প্রাপ্য দলিলে সাইন করতে পারলেই অপূর্ব আর কিছু করতে পারবে না ওর। তাহলে বুঝতেই পারছো যে ঠিক কারনে ওকে বিয়ে করেছো সেই দায়বদ্ধতা থেকেও মুক্ত হয়ে যাবে। তাই খবরদার! আহি যেন সিগনেচার করার আগে মোটেও জানতে না পারে যে তোমার আর আহির বিয়ে একটা দায়বদ্ধতা ছাড়া আর কিছুই না।’
বিকট বজ্রপাতের খেলা শুরু হয়েছে বাইরে। সেই সাথে বেড়ে যেতে থাকলো বর্ষণের ধারা। বাতাস বহমান। সেই পানি আছড়ে পড়ছে গাড়িতে। রাহি আপুর কথা অদ্ভুতভাবে বাজতে থাকলো আমার কানে। কথাটার জোর যেন বজ্রপাতের চেয়েও বেশি। আনভীর যেন জমে গেলেন এবার। আমি নিরুদ্বেগে বললাম,
‘ এটা কি আনভীর?’
আনভীর ধাতস্থ করলেন নিজেকে। শীতল কন্ঠে বলার চেষ্টা করলেন,
‘ আহি আমি এক্সপ্লেইন……’
‘ এটা কি আনভীর? রাহি আপু কি বলছে এগুলো?’
কথা বললেন না আনভীর। এতদিনে, এতদিনে আমি বুঝতে পারলাম ঘটনার মূল উদ্দেশ্য। না রাহি আপু আনভীরের ক্ষতি করেছে। আর না রাহি আপুকে পাওয়ার জন্য আনভীর আমায় কিডন্যাপ করেছে। এগুলো সব ছিলো চক্রান্ত। উইলে এটা স্পষ্ট লিখা ছিলো যে আমার বিয়ের পরই আমি প্র্রোপার্টি দখলে নিতে পারবো। এরই কি সুযোগ নিলেন আনভীর? এজন্যই সেদিন উনার বাবা যখন আমার আর উনার বিয়ে পড়িয়ে দিলেন তখন নির্বিকারে মেনে নিলেন? আর ভাবলাম না আমি। জিজ্ঞেস করলাম,
‘ বিয়েটা কি দায়বদ্ধতা ছিলো আনভীর?’
‘ আহি, লেট মি এক্সপ্লেইন…..’
‘ হ্যাঁ, নাকি না আনভীর? আমি জানতে চাই যে আপনিও কি তবে প্রোপার্টির জন্য……’
চিৎকার করে বললাম আমি। আনভীর নত হয়ে গেলেন এবার৷ গম্ভীর মুখে বললেন,
‘ হ্যাঁ। কিন্ত আরও অনেক কারন আছে আহি। সবটা না জেনে আমায় ভুল বুঝো না।’
কাতর কন্ঠ কথাটি বললেন আনভীর। আমি কথা বাড়ালাম না৷ যা বোঝার বুঝে গিয়েছি। অপূর্ব ভাইয়া আর আনভীরেরে মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। সবাই ঠকিয়েছে আমায়৷ আমি চুপ হয়ে গেলাম। মৌন কন্ঠে বললাম,
‘ গাড়ি স্টার্ট করুন আনভীর। আমার দমবদ্ধ লাগছে।’
.
.
.
.
.
#চলবে ইনশাআল্লাহ
রিচেক করা হয়নি।